স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন | আবুল ফজল হক
অন্যান্য নতুন দেশের মতাে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী এলিটগণ প্রথমে যে কাজে হাত দেন তা হলাে দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের প্রধান সামাজিক-রাজনৈতিক গােষ্ঠীসমূহ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শােষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছিল, কিন্তু জাতীয় আদর্শ, রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে দের মধ্যে সুস্পষ্ট মতৈক্য ছিল না। সুতরাং সংবিধান প্রণয়নের সময় তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই বিতর্কের ধারা এবং সংবিধান। সম্পর্কে বিভিন্ন গােষ্ঠীর মতামত একটু তলিয়ে দেখা দরকার। কেননা সংবিধান। সম্পর্কে ঐকমত্যের মাত্রার ওপর তার কার্যকারিতা বহুলাংশে নির্ভর করে।
১. সাংবিধানিক কর্তৃত্ব
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ নিজেদের সমন্বয়ে একটি গণপরিষদ গঠন করেন এবং ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র জারি করেন। ঘােষণাপত্রে বলা হয় যে, সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন। রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক হবেন এবং প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী এবং আইন-প্রণয়নমূলক ক্ষমতা প্রয়ােগ করবেন। তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়ােজন অনুসারে অন্যান্য মন্ত্রী নিয়ােগ করবেন। তিনি কর আরােপ ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা ভােগ করবেন, গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও মুলতবী করতে পারবেন এবং বাংলাদেশের জনগণকে একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়সঙ্গত সরকার প্রদানের জন্য প্রয়ােজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
স্বাধীনতার ঘােষণা ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর ধরা হয় এবং তা দেশের প্রথম মৌলিক আইন এবং সকল কর্তৃত্বের ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। এই ঘােষণা রাষ্ট্রপতিকে কেবল নির্বাহী, আইন প্রণয়ন, অর্থ সংক্রান্ত ও সামরিক ক্ষমতা প্রদান করেনি, দেশে একটি সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান-প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণেরও দায়িত্ব অর্পণ করে।
২. অস্থায়ী সংবিধান
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির সকল ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন। ১৯৭২ সালের
৭৩
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১১ জানুয়ারি তারিখে বাংলাদেশের জন্য একটি অস্থায়ী সংবিধান জারি করেন। সেখানে বিধান করা হয় যে, একজন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকবে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে তাঁর সকল কাজ সম্পাদন করবেন। গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন একজন সদস্যকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ করবেন। স্থায়ী সংবিধান প্রণয়নের পূর্বে কোনাে সময়ে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে মন্ত্রিসভা বাংলাদেশের একজন নাগরিককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়ােগ দান করবে, যিনি সংবিধান অনুসারে অপর একজন রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। অস্থায়ী সংবিধানে আরাে বিধান করা হয় যে, বাংলাদেশে একজন প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতি সমম্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট থাকবে।
এভাবে আইন প্রণয়নমূলক ক্ষমতাসহ অন্যান্য ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতেই থেকে যায়, কিন্তু অস্থায়ী সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান পরিণত করা হয়। রাষ্ট্রপতি সকল ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করবেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে গণপরিষদের আস্থাভাজন ব্যক্তি হতে হবে। এসব বিধান করে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে পরিকল্পিত রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থার পরিবর্তে মন্ত্রীপরিষদ ব্যবস্থা সূচনা করা হয়।
অস্থায়ী সংবিধান জারির পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুজিব রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার জায়গায় হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ও প্রখ্যাত মুক্তিযােদ্ধা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মন্ত্রিসভা কর্তৃক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।
৩. গণপরিষদ
সংবিধান প্রণয়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ রাষ্ট্রপতি “বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ” (রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ২২) জারি করেন। তাতে গণপরিষদের গঠন ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা হয়। এতে বিধান করা হয় যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিগণ সমন্বয়ে বাংলাদেশ গণপরিষদ গঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও মুলতবি করবেন এবং গণপষিদ ভেঙে দিতে পারবেন। গণপরিষদের একমাত্র কাজ হবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা। একই দিনে জারিকৃত “বাংলাদেশ গণপরিষদ (সদস্যপদ বাতিল) আদেশ” নামে অন্য একটি আদেশে (রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ২৩) বলা হয় যে, গণপরিষদের কোনাে সদস্য কোনাে দলের মনােনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে সেই দল থেকে পদত্যাগ করলে কিংবা বহিষ্কৃত হলে তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে।
মূলত গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৬৯-পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত ১৬৯ জন এবং পূর্ব-পাকিস্তান পরিষদে নির্বাচিত ৩০০ জন।
তিন জন ছাড়া সকল সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয়। আওয়ামী লীগ বহির্ভূত তিনজন সদস্যের মধ্যে দুজন ছিলেন স্বতন্ত্র এবং একজন ছিলেন মস্কোপন্থী ন্যাপ দলের অন্তর্ভুক্ত।
৭৪
৪. খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি
১৯৭২ সালের ১০-১১ এপ্রিল গণপরিষদের দু’দিনব্যাপী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিনে গণপরিষদ তার কার্যপ্রণালী বিধি প্রণয়ন করে এবং দ্বিতীয় দিন ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি নির্বাচিত করে। তৎকালীন আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হােসেন কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। কমিটির সকল সদস্যই ছিলেন গণপরিষদের সদস্য এবং ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাড়া সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ দলের।
কমিটির বেশির ভাগ সদস্য ছিলেন ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়স্ক ব্যক্তি যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ৩৪ জন সদস্যের মধ্যে ৩২ জন ছিলেন মুসলমান এবং দু’জন হিন্দু। প্রায় সকল সদস্যই ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবার থেকে আগত উচ্চ শিক্ষিত পেশাজীবী এবং অনেকেই ছিলেন ভূ-সম্পত্তির অধিকারী। ৩৪ জনের মধ্যে ২৪ জন সদস্যই ছিলেন আইনজীবী (যাদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন ইংল্যান্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যারিস্টার), চারজন অধ্যাপক, একজন ডাক্তার এবং একজন সাংবাদিক। কমিটির একজন সদস্য ছিলেন কৃষক নেতা। কমিটিতে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী কিংবা শ্রমিক শ্রেণির কোনাে প্রতিনিধি ছিলেন না (সারণি-৩.১ দেখুন)।
সারণি ৩.১
খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের আর্থসামাজিক পটভূমি
সংখ্যা | শতকরা হার | ||
বয়স : | ৩০ বছরের নিচে | ১ | ৩ |
৩০-৪৫ বছর | ২১ | ৬২ | |
৪৬ থেকে ৫৬ বছর | ১২ | ৩৫ | |
মোট | ৩৪ | ১০০ | |
ধর্ম : | মুসলমান | ৩২ | ৯৪ |
হিন্দু | ২ | ৬ | |
মোট | ৩৪ | ১০০ | |
পেশা : | আইনজীবী | ২৪ | ৭০ |
অধ্যাপক | ৪ | ১২ | |
ডাক্তার | ১ | ৩ | |
সাংবাদিক | ১ | ৩ | |
কৃষক নেতা | ১ | ৩ | |
সমাজকর্মী | ৩ | ৯ | |
মোট | ৩৪ | ১০০ |
উৎস : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ-সদস্যদের জীবন বৃত্তান্ত, ঢাকা, ১৯৭৫ এবং আব্দুল মমিন (খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য এবং এককালীন আওয়ামী লীগ দপ্তর সম্পাদক ও মন্ত্রী)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকার।
৭৫
খসড়া প্রণয়ন কমিটির দায়িত্ব ছিল একটি বিল আকারে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন এবং রিপাের্টসহ তা গণপরিষদে পেশ করা। তদানুযায়ী কমিটির সভাপতি ১৯৭২ সালের ১২ই অক্টোবর গণপরিষদে সংবিধান বিল উত্থাপন করেন, যা ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর সামান্য সংশােধনীসহ গৃহীত হয়।
৫. সংবিধানের প্রধান ধারাসমূহ
১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা, ১১টি ভাগে বিভক্ত ১৫৩টি অনুচ্ছেদ এবং ৪টি তফসিল ছিল।
প্রস্তাবনায় ঘােষণা করা হয় যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়ােগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণােৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সব আদর্শ হবে এই সংবিধানের মূলনীতি। এখানে আরাে বলা হয় যে, রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এক শােষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
সংবিধানের প্রথম ভাগটি ছিল মূলত বর্ণনা বা ঘােষণামূলক। এখানে ঘােষণা করা হয় যে, বাংলাদেশ হবে একটি এককেন্দ্রিক সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে পরিচিত হবে (অনুচ্ছেদ : ১)। এখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার বর্ণনা দেয়া হয় (অনুচ্ছেদ : ২) এবং বলা হয় যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা (অনুচ্ছেদ : ৩) এবং রাজধানী হবে ঢাকা (অনুচ্ছেদ : ৫)। তাছাড়া, প্রথম ভাগে জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় প্রতীকের বর্ণনা দেয়া হয় (অনুচ্ছেদ : ৪), এবং ঘােষণা করা হয় যে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন (অনুচ্ছেদ : ৭)।
“রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি” শিরােনামে দ্বিতীয় ভাগটি মূলত জাতীয় আদর্শ ও আর্থসামাজিক লক্ষ্য সম্পর্কে ঘােষণা। এখানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারটি আদর্শকে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি বলে ঘােষণা করা হয়। এবং সেগুলাের সংজ্ঞা দেয়া হয়। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বলা হয় যে, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি (অনচ্ছেদ : ৯)। এভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে জাতীয়তাবাদের মূল সূত্র হিসেবে জোর দেয়া হয়, তবে ভারতীয় বাঙালিদের সাথে পার্থক্য নির্দেশ করে বলা হয় যে, বাংলা ভাষাভাষী যে জনগােষ্ঠী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে সে জনগােষ্ঠীই বাঙালি জাতির অন্তর্ভুক্ত। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বলা হয় যে, মানুষের ওপর মানুষের শােষণ থেকে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করবার উদ্দেশে “সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে (অনুচ্ছেদ : ১০)।
৭৬
আরাে ঘােষণা করা হয় যে, বাংলাদেশ হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে (অনুচ্ছেদ:১১)। ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে, (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনাে ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশে ধর্মের অপব্যবহার, এবং (ঘ) ধর্মের কারণে কোনাে ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা নিপীড়ন বিলােপ করা হবে (অনুচ্ছেদ : ১২)।
দ্বিতীয় ভাগে আরাে কতিপয় নীতি অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেখানে নাগরিকদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এই সব নীতির মধ্যে ছিল: (ক) কৃষক ও শ্রমিকদের সকল প্রকার শােষণ থেকে মুক্তিদান; (খ) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা; (গ) মুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মের অধিকার; (ঘ) যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনােদন ও সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার; এবং (ঙ) সম্পদ ও সুযােগের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে মানুষের মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করা। মালিকানা নীতির ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয় যে, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালীর মালিক বা নিয়ন্ত্রক হবে জনগণ। রাষ্ট্রে তিন প্রকারের মালিকানা থাকবে: (ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা (অর্থনীতির প্রধান প্রধান ক্ষেত্র সমম্বয়ে গঠিত) রাষ্ট্রায়ত্ত খাত, (খ) সমবায়ী মালিকানা, এবং (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তি মালিকানা। মূলনীতি হিসেবে আরাে ঘােষণা করা হয় যে, কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের জন্য অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং “প্রত্যেকের নিকট থেকে যােগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী”—এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ব্যক্তি পারিশ্রমিক লাভ করবে (অনুচ্ছেদ : ২০) উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ প্রতিশ্রুতি বা আদর্শ মাত্র, তাদের কোনাে আইনগত মূল্য ছিল না। সংবিধানে ৮ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয় যে, মূলনীতিসমূহ বাংলাদেশ পরিচালনার মূল সূত্র হবে, আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র সেগুলাে প্রয়ােগ করবে, সংবিধান ও অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যা দানের ক্ষেত্রে নির্দেশক হবে এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কাজের ভিত্তি হবে, কিন্তু এসব নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযােগ্য হবে না।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ সন্নিবেশিত হয়। এই সব অধিকারের মধ্যে ছিল: আইনের চোখে সমতা, সরকারি নিয়ােগ লাভের অধিকার, জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার, খেয়াল খুশিমতাে গ্রেফতার ও আটকের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ; চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকার। সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে বিধান করা হয় যে, রাষ্ট্র মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোনাে আইন প্রণয়ন করবে না এবং অনুরূপ কোনাে আইন প্রণীত হলে তা বাতিল হয়ে যাবে। তাছাড়া, মৌলিক অধিকারসমূহ বলবৎ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলা রুজু করার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয় (অনুচ্ছেদ : ৪৪)।
৭৭
কিন্তু অধিকাংশ মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনস্বার্থ, জনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য, শালীনতা, নেতিকতা, অথবা বিদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের স্বার্থে “আইনের দ্বারা আরােপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ” সাপেক্ষ ছিল। অর্থাৎ, সংসদ অধিকারগুলাের ওপর বাধানিষেধ আরােপ করতে পারতাে এবং সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ছিল অনুরূপ বাধানিষেধগুলাে যুক্তিসঙ্গত কি না তা নির্ধারণ করার। তবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার এমনই সীমিত ছিল যে, সংসদ আইনের দ্বারা যে কোনাে বাধানিষেধ আরােপ করতে পারতাে (অনুচ্ছেদ : ৪২)। আরাে বিধান ছিল যে, সংসদ যদি স্পষ্টরূপে ঘােষণা করে যে, সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহের কোনাে একটিকে কার্যকর করবার জন্য অনুরূপ বিধান করা হয়েছে, তাহলে কোনাে সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, দখল কিংবা সাময়িকভাবে কোনাে সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কোনাে আইন কোন মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এই কারণে বাতিল হবে না (অনুচ্ছেদ : ৪৭)।
সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য যেমন সম্পত্তির অধিকার সীমিত করা হয়, তেমনি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের উদ্দেশে সংগঠনের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বিধান করা হয় যে, কোনাে ব্যক্তি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ গঠন করতে কিংবা অনুরূপ কোনাে সংগঠনের সদস্য হতে পারবে না। এভাবে ১৯৭১ সালে ইসলামী দলগুলাের ওপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞাকে সাংবিধানিক রূপ দেয়া হয়। তাছাড়া, মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধীদের ভােটদান এবং নির্বাচিত হবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। সংবিধানের ৬৬ এবং ১২২ অনুচ্ছেদের ২ (ঙ) ধারায় বিধান করা হয় যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে যােগসাজশের অপরাধে দণ্ডিত কোনাে ব্যক্তি ভােটার তালিকাভুক্ত কিংবা সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হবার যােগ্য হবে না।
সংবিধানের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ ভাগে সরকারের সংগঠন সম্পর্কে বিধান করা হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রবর্তিত সরকারের রূপ ছিল ব্রিটিশ ধাঁচের সংসদীয় গণতন্ত্র। ইংল্যান্ডের রাজা, মন্ত্রিসভা ও পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণকারী কনভেনশনসমূহ বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। রাষ্ট্রপতি ছিলেন নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি সংসদ কর্তৃক পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হতেন। তবে সংসদ অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভােটে অভিশংসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারতাে। রাষ্ট্রপতি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আস্থাভাজন সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করতেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে তিনি সকল কাজ সম্পাদন করতেন। প্রধানমন্ত্রীর হাতেই প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল। মন্ত্রিসভা সম্পর্কেও প্রধানমন্ত্রীর প্রচুর ক্ষমতা ছিল। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর মতােই তিনি ছিলেন মন্ত্রিসভার প্রাণকেন্দ্র। তার পরামর্শক্রমেই রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের নিয়ােগ বা অপসারণ করতে পারতেন। মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকতাে। সংসদের আস্থা হারালে প্রধানমন্ত্রী হয় পদত্যাগ করতেন নতুবা সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতেন (অনুচ্ছেদ : ৫৬-৫৮)।
৭৮
জাতীয় সংসদ নামে পরিচিত আইনসভা ৩১৫ জন সদস্য সমবায়ে গঠিত হতাে। সদস্যদের মধ্যে ৩০০ জন ১৮ বা তদুর্ধ বয়সের নাগরিকগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হতেন। অবশিষ্ট ১৫ জন কেবল মহিলাদের মধ্যে থেকে সংসদ-সদস্যগণ কর্তৃক পরােক্ষভাবে নির্বাচিত হতেন। বিধান ছিল যে, মহিলাদের জন্য এই আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা সংবিধান চালু হবার তারিখ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার উদ্দেশে ৭০ অনুচ্ছেদে বিশেষ বিধান করা হয় যে, যদি কোনাে সংসদ-সদস্য কোনাে দলের মনােনীত প্রার্থীরূপে নির্বাচিত হয়ে তাঁর দল থেকে পদত্যাগ অথবা সংসদে তাঁর দলের বিরুদ্ধে ভােট দান করেন তবে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে। তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনাে নির্বাচনে বা উপ-নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হবার অযােগ্য হবেন না।
এই সংবিধানের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সংসদের প্রাধান্য। যেহেতু জাতীয় সংসদকে একটি লিখিত সংবিধানের কাঠামাের মধ্যে কাজ করতে হতাে, সেহেতু সংসদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতাে সার্বভৌম ছিল না, কিন্তু তার যথেষ্ট আইন প্রণয়ন ও অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতা ছিল। সংসদ কর্তৃক গৃহীত যে কোনাে বিলে রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়ােজন হতাে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কোনাে ভেটো ক্ষমতা ছিল না। তিনি অর্থবিল ছাড়া অন্য কোনাে বিল পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠাতে পারতেন। কিন্তু বিলটি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে পুনরায় গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতির সম্মতি ছাড়াই আইনে পরিণত হতাে। যদিও আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ সংসদে উপস্থাপন করার আবশ্যকতা ছিল না, সংসদের সম্মতি ব্যতীত যুদ্ধ ঘােষণা করা যেত না।
প্রজাতন্ত্রের বিচার ক্ষমতা একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত ছিল, যার শীর্ষে ছিল সুপ্রিম কোর্ট। একটি আপীল বিভাগ ও একটি হাইকোর্ট বিভাগ সমম্বয়ে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হতাে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হতেন এবং তাঁরা ৬২ বছর বয়স পর্যন্ত পদে বহাল থাকতে পারতেন। কেবল প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে জাতীয় সংসদের মােট সদস্যসংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভােটে গৃহীত অভিশংসন প্রস্তাবের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের কোনাে বিচারপতিকে অপসারণ করা যেতাে। নিম্নতন আদালতসমূহের বিচারকগণ সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। বিচারকার্যে নিয়ােজিত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত ছিল। তবে সরকারি কর্মচারীদের কর্মের শর্তাবলি এবং কোনাে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বা সরকারি কোনাে সম্পত্তির অর্জন, প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও বিলি। ব্যবস্থা, প্রভৃতি ক্ষেত্রে এখতিয়ার প্রয়ােগের জন্য সংসদ আইনের দ্বারা এক বা একাধিক প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করতে পারতাে, এবং অনুরূপ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারের অন্তর্গত কোনাে বিষয়ে সাধারণ আদালত কোনােরূপ কার্যধারা গ্রহণ বা আদেশ প্রদান করতে পারত না (অনুচ্ছেদ : ১১৭)।
৭৯
সপ্তম, অষ্টম ও নবম ভাগে যথাক্রমে নির্বাচন, হিসাব-নিরীক্ষণ ও সরকারি কর্মবিভাগ সম্পর্কে বিধান করা হয়। নির্বাচন কমিশনারবৃন্দ, মহা-হিসাব নিরীক্ষক এবং সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ তাদের কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভােগ করতেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হন, কেবল সেইরূপ পদ্ধতি ও কারণে তাদের অপসারণ করা যেত (অনুচ্ছেদ : ১১৮, ১২৯ ও ১৩৯)। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ ভােটে গৃহীত প্রস্তাব ছাড়া তাদেরকে অপসারণ করা যেত না। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের বরখাস্তের বিরুদ্ধে কোনাে রক্ষাকবচ ছিল না। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়ােজিত ব্যক্তিগণ রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি অনুযায়ী পদে বহাল থাকতেন। কোনােরূপ কারণ প্রদর্শন কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ প্রদান ব্যতিরেকেই সরকার যে কোনাে কর্মচারিকে অপসারণ, বরখাস্ত বা পদাবনমিত করতে পারতেন (অনুচ্ছেদ : ১৩৫)।
দশমভাগে সংবিধানে সংশােধন পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেখানে বিধান করা হয় যে, জাতীয় সংসদ মােট সদস্যের অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভােটে গৃহীত বিলের মাধ্যমে সংবিধানের যে কোনাে ধারা সংশােধন বা রহিত করতে পারে (অনুচ্ছেদ: ১৪২)।
একাদশ ভাগে বিবিধ বিধানাবলী অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রথম তফসিলটি ছিল আদালতের আওতা বহির্ভূত আইনসমূহের তালিকা। দ্বিতীয় তফসিলে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন সংক্রান্ত নিয়মাবলি, তৃতীয় তফসিলে কতিপয় সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের শপথনামা এবং চতুর্থ তফসিলে ক্রান্তিকালীন বা অস্থায়ী বিধানাবলি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
৬. সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া
খসড়া প্রণয়ন কমিটির প্রথম বৈঠক হয় ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখে। সেই বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে আগ্রহী সংগঠন ও ব্যক্তিদের নিকট থেকে সংবিধান সম্পর্কে প্রস্তাব আহ্বান করা হয়। সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে অনুরূপ আহ্বান জানানাে হয়। কমিটির নিকট প্রস্তাব পৌছানাের শেষ তারিখ ছিল ৮মে, ১৯৭২। এই আহ্বানের প্রেক্ষিতে কমিটি ৯৮টি স্মারকলিপি পায়। বিরােধী দলসমূহ কমিটির নিকট কোনাে প্রস্তাব বা পরামর্শ পাঠায়নি।
বলা বাহুল্য সংবিধান সম্পর্কে সকল স্তরের নাগরিকদের মতামত যাচাই করাই ছিল এই আহ্বানের উদ্দেশ্য। কিন্তু জনগণের নিকট থেকে যে সাড়া পাওয়া যায় তা ছিল মাত্র কিঞ্চিৎ। এর অন্যতম কারণ ছিল এই যে, একটি প্রশ্নমালার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি বা সংগঠনের মতামত যাচাই না করে গণমাধ্যমসমূহে সাধারণ আমন্ত্রণ জানানাে হয়। স্বাভাবিকভাবে তা জনগণের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যথার্থই বলেন যে, সংবিধান সম্পর্কে প্রস্তাব পাঠানাের সাধারণ আমন্ত্রণের অর্থ হচ্ছে আগ্রহী প্রত্যেক ব্যক্তি বা সংগঠন কর্তৃক একটি করে সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করা, যা কারাে পক্ষে কদাচিৎ সম্ভব।২
৮০
তাছাড়া, কমিটির নিকট প্রস্তাব পাঠানাের জন্য মাত্র তিন সপ্তাহ সময় দেয়া হয়েছিল, যা সংবিধানের মতাে একটা গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য মােটেও যথেষ্ট ছিল না।
খসড়া প্রণয়ন কমিটি মােট ৪৭টি বৈঠকে মিলিত হয় এবং খসড়া প্রণয়নে প্রায় ৩০০ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে।৩
কমিটির কার্য বিবরণী যদিও প্রকাশিত হয়নি, প্রাপ্ত তথ্যদি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সেখনে উন্মুক্ত পরিবেশেই আলাপ আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। বিরােধীদলীয় একমাত্র সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন যে, কমিটির সদস্যগণ খােলা মন নিয়ে সংবিধান সম্পর্কে আলােচনা করেন।৪
আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী কমিটি সদস্য আসাদুজ্জামান খান (যিনি খসড়া সংবিধান সম্পর্কে একাধিক ক্ষেত্রে ভিন্নমত প্রদান করেন) গর্বের সঙ্গে বলেন, বঙ্গবন্ধু কিংবা তার সরকার কোনাে সময়েই আমাদেরকে প্রভাবাম্বিত করার চেষ্টা করেন নি, আমরাও হইনি।”৫
কমিটিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সর্বসম্মতিক্রমে এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে কতিপয় ক্ষেত্রে কমিটির ছয়জন সদস্য ভিন্ন মত প্রদান করেন। ভিন্নমত প্রদানকারীদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন আওয়ামী লীগের এবং একজন ছিলেন মােজাফফর ন্যাপের সদস্য। ভিন্নমতসমূহের প্রধান দিকগুলাে নিম্নে উল্লেখ করা হলাে :
আওয়ামী লীগ দলীয় দু’জন কমিটি সদস্য সম্পত্তির অধিকার সংক্রান্ত ৪২ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে আপত্তি করে বলেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বাধ্যতামূলক গ্রহণ অথবা জাতীয়করণের জন্য ক্ষতিপূরণের কোনাে ব্যবস্থা নেই। তারা দাবি করেন যে, শুধু “গণ উদ্দেশেই” ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ করা উচিত এবং “জাতীয়করণ” ব্যতীত অন্য উদ্দেশে কোনাে সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আওয়ামী লীগ দলীয় চারজন সদস্য ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপন করেন। মূলত ৭০ অনুচ্ছেদে বিধান ছিল যে, কোন সংসদ-সদস্য তার দল থেকে পদত্যাগ করলে কিংবা বহিষ্কৃত হলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হয়ে যাবে। ভিন্ন। মতাবলম্বীরা বলেন যে, এই বিধান গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং নির্বাচকমণ্ডলীর অধিকারের পরিপন্থী। তারা বিশেষ করে দল থেকে বহিষ্কারের কারণে সদস্যপদ বাতিল হবার বিধানের ঘাের বিরােধিতা করেন এবং তাঁদের মধ্যে একজন মত প্রকাশ করেন যে, কেবল পদত্যাগ করলে কিংবা সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভােট দিলেই কোনাে সদস্যের পদ বাতিল হওয়া উচিত। একজন আওয়ামী লীগ-দলীয় সদস্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইন সভার পক্ষেও মত প্রকাশ করেন।
কোনাে কোনাে ভিন্নমত প্রদানকারী সদস্যের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা লক্ষ করা যায়। আওয়ামী লীগ দলীয় একজন মুসলমান সদস্য দাবি করেন যে, ইসলামী ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংবিধানের প্রারম্ভে “বিসমিল্লাহ-অররাজনীতি—৬
৮১
রহমান-অর রহিম’ শব্দগুচ্ছ সন্নিবেশিত করা হােক। অপরদিকে, আওয়ামী লীগ দলীয় একজন হিন্দু সদস্য দাবি করেন যে, সংবিধানে এমন বিধান থাকতে হবে যাতে করে সরকার তফসিলি হিন্দু ও উপজাতীয়দের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের উন্নতি বিধানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
বিরােধী দলীয় ন্যাপ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পক্ষ থেকে সর্বাধিক আপত্তি উত্থাপিত হয়। তিনি ২৪টি সুপারিশ পেশ করেন। তাঁর মূল আপত্তি ছিল এই যে, সংবিধানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়ােজনীয় বিধান করা হয়নি। তিনি মৌলিক অধিকারসমূহকে অস্পষ্ট ও অপর্যাপ্ত বলে বর্ণনা করেন, কারণ প্রায় সকল মৌলিক অধিকারের ওপর বিভিন্ন ধরনের বাধা নিষেধ আরােপ করা হয়। তিনি সংসদে আসন সংখ্যা ৩৫০-এ বৃদ্ধি করার সুপারিশ এবং সংসদে মহিলাদের জন্য আসন। সংরক্ষণের বিরােধিতা করেন। তিনি সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর নির্ধারণের দাবি জানান।৬
১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর সংবিধান বিলটি গণপরিষদে উপস্থাপিত হয় এবং ঠিক এক সপ্তাহ পরে ১৯ অক্টোবর সাধারণ আলােচনার জন্য গৃহীত হয়। শুরুতেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রস্তাব করেন যে, জনমত যাচাই-এর জন্য বিলটি প্রচার করা হােক এবং সে উদ্দেশে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত গণপরিষদের অধিবেশন মুলতবি রাখা হােক। তিনি যুক্তি দেখান যে, দেশের দূর-দূরান্তে বসবাসকারী জনগণের বিভিন্ন স্তরের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য এক সপ্তাহ সময় মােটেই পর্যাপ্ত নয়। আইনমন্ত্রী প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, অধিবেশন মুলতবি রাখার অর্থ হবে সময়ের অপচয় করা। সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানাে হয় যে, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারটি মূল আদর্শের ভিত্তিতে সংবিধানের খসড়া প্রণীত হয়েছে। এই চারটি আদর্শের পক্ষে জনগণ পাকিস্তান আমলেই রায় দিয়েছে এবং সে সব আদর্শের জন্য ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছে। গণপরিষদের সদস্যগণ কেবল সেই আদর্শগুলােকে সাংবিধানিক রূপ দেয়ার জন্য একত্রিত হয়েছে।৭
সংবিধান বিলের ওপর সাধারণ বিতর্ক ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত চলে। এ পর্যায়ে গণপরিষদ ১০টি বৈঠকে প্রায় ৩১ ঘণ্টা ধরে আলােচনা করে। মােট ৪৭ জন। সদস্য সাধারণ বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। এই ৪৭ জনের মধ্যে ৪৪ জন ছিলেন। আওয়ামী লীগের, একজন মােজাফফর ন্যাপের এবং দু’জন স্বতন্ত্র সদস্য। আওয়ামী লীগের ৪৪ জনের মধ্যে নয়জন ছিলেন মন্ত্রী এবং ১৬জনই ছিলেন। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য। ১৭৫ জন আওয়ামী লীগ সদস্য বিতর্কে অংশগ্রহণের জন্য প্রধান হুইপের নিকট তাঁদের নাম লিপিবদ্ধ করেন। স্পষ্টতই তাদের অনেককে নিরাশ হতে হয়। অবশ্য আওয়ামী লীগ সদস্যগণ সংসদীয় দলের সভায় সংবিধানের ওপর আলােচনার যথেষ্ট সুযােগ পান।
যা হােক, সাধারণ আলােচনা ছিল নিরুদ্দীপক। মূলনীতিগুলাে সম্পর্কে তেমন কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক হয়নি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত খসড়া কমিটিতে তাঁর প্রদত্ত
৮২
বক্তব্যের পুনরুল্লেখ করে বলেন যে, সংবিধানে চার মূলনীতির পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেনি। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত অর্থনৈতিক অধিকারসমূহ সাধু ইচ্ছা বৈ আর কিছুই নয়, কারণ সেগুলাে আদালতের মাধ্যমে বলবৎযােগ্য নয়। তিনি আরাে বলেন, মৌলিক অধিকারসমূহের ওপর বাধানিষেধ আরােপ করে গণতন্ত্রকে অবাস্তব করে তােলা হয়েছে। তাছাড়া, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সংসদ ভেঙে দেয়ার। ক্ষমতা (অনুচ্ছেদ : ৫৭ (২), ৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে সংসদ-সদস্য পদ বাতিল, রাষ্ট্রপতির সরকারি কর্মচারিদের অপসারণ বা বরখাস্ত করার অবাধ ক্ষমতা (অনুচ্ছেদ : ১৩৫), ইত্যাদি বিধানকে অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করেন।৮
দু’জন স্বতন্ত্র সদস্যও একই সুরে সংবিধানের সমালােচনা করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় প্রতিনিধি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা অভিযােগ করেন যে, সংবিধানে মেহনতী ও পশ্চাৎপদ জনগােষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। তিনি উপজাতীয়দের পৃথক জাতি হিসেবে স্বীকৃতি এবং চট্টগ্রামের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেন।৯
অপর স্বতন্ত্র সদস্য আব্দুল আজিজ চৌধুরী অভিযােগ করেন যে, সংবিধানটি সংসদীয় গণতন্ত্রের সুষ্ঠু কার্যকারিতা ও বিকাশের উপযােগী নয় এবং বলেন তা জনগণের নিকট গ্রহণযােগ্য হবে না।১০
বিতর্কে অংশগ্রহণকারী সকল আওয়ামী লীগ সদস্য সংবিধানের প্রতি জোরালাে সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং একে অপরের যুক্তির পুনরাবৃত্তি করেন। এমন কি যেসব আওয়ামী লীগ সদস্য খসড়া প্রণয়নের পর্যায়ে ভিন্ন মত প্রদান করেন, তাঁরাও গণপরিষদে কোনাে আপত্তি উত্থাপন করেননি।
সংবিধানের ওপর দ্বিতীয় পাঠ শুরু হয় ৩১ অক্টোবর এবং তা ৪ নভেম্বর, ১৯৭২ পর্যন্ত চলে। এই পর্যায়ে ধারাওয়ারী আলােচনার জন্য গণপরিষদ মাত্র ২০ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে। অথচ সাধারণ বিতর্কে সময় লেগেছিল ৩১ ঘণ্টা। দ্বিতীয় পাঠের সময় গণপরিষদে মােট ১৫৬ টি সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এরমধ্যে ৮৫টি সংশােধনী প্রস্তাব আনেন সরকারি দলের সদস্যগণ এবং ৮০টি প্রস্তাব আনেন বিরােধী ও স্বতন্ত্র সদস্যবৃন্দ। গণপরিষদ কর্তৃক মােট ৮৬টি সংশােধনী গৃহীত হয়। এই ৮৬টির মধ্যে মাত্র একটি ছিল বিরােধীদলীয় সদস্য কর্তৃক উত্থাপিত।
গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত সংশােধনীর সংখ্যা ছিল অনেক, কিন্তু সেগুলাে ১৫৩ অনুচ্ছেদ বিশিষ্ট সংবিধানের মাত্র ৫০টি অনুচ্ছেদকে স্পর্শ করে। বেশির ভাগ সংশােধনী কার্যত সম্পাদকীয় ধরনের ছিল; এগুলাের উদ্দেশ্য ছিল ভাষাগত উৎকর্ষ সাধন কিংবা ভাবের সুস্পষ্টকরণ। যাহােক, গৃহীত সংশােধনীগুলাের মধ্যে নিম্নোক্ত চারটি ছিল কিছুটা তাৎপর্যপূর্ণ।
১. মূল ৪২ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, আইনের কর্তৃত্ব ছাড়া কোনাে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাবে না। কিন্তু সেখানে ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এই অনুচ্ছেদে একটি নতুনধারা (২) সংযােজন করা হয় এবং তার দ্বারা জাতীয় সংসদকে।
৮৩
“ক্ষতিপূরণসহ অথবা বিনা ক্ষতিপূরণে” যে কোনাে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ বা রাষ্ট্রায়ত্ত করার জন্য আইন প্রণয়নের অবাধ ক্ষমতা দেয়া হয়। অনুরূপ আইনে ক্ষতিপূরণের বিধান করা হয়নি কিংবা ক্ষতিপূরণের বিধান অপর্যাপ্ত হয়েছে এই কারণে সে আইন সম্পর্কে কোনাে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
২. মূল ৫৬ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, কেবল সংসদ-সদস্যগণই মন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ লাভের যােগ্য হবেন। এই অনুচ্ছেদে একটি নতুন ধারা (৪) সংযােজন করে বিধান করা হয় যে, সংসদ সদস্য নন এমন ব্যক্তিকেও মন্ত্রীরূপে নিয়ােগ করা যাবে, তবে অনুরূপ ব্যক্তিকে অবশ্যই ছয়মাস। সময়ের মধ্যে সংসদ-সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে হবে নতুবা তিনি মন্ত্রিত্ব হারাবেন।
৩. ৭০ অনুচ্ছেদকে এমনভাবে সংশােধন করা হয় যাতে কোনাে সংসদ| সদস্য কেবল দলত্যাগ কিংবা সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভােটদানের কারণে (দল থেকে বহিষ্কারের কারণে নয়) তার সদস্যপদ হারাবেন। এভাবে সংসদ-সদস্যদের ওপর দলের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল করা হয়।
৪. চতুর্থটি ছিল ৭৩ অনুচ্ছেদ সম্পর্কিত, যা বিরােধী দলীয় সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কর্তৃক উত্থাপিত হয়। এই সংশােধনীর মাধ্যমে সংসদীয়। গণতন্ত্রের একটি সর্বজনীন রীতিকে আইনের রূপ দেয়া হয়। সংবিধানের ৭৩ অনুচ্ছেদের (১) ও (২) ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপ্রতি সংসদে ভাষণদান এবং বাণী প্রেরণ করতে পারতেন। এই অনুচ্ছেদে একটি নতুন ধারা (৩) সংযােজন করে বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতির বাণী বা ভাষণ সম্পর্কে সংসদ আলােচনা করবে।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান বিলের তৃতীয় ও শেষ পাঠ অনুষ্ঠিত হয় এবং ঐ দিনই গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধানটি গৃহীত হয়। কোনাে সদস্য বিপক্ষে ভােট দেননি। ১৯৭২ সালের ১৪-১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদের এক আনুষ্ঠানিক অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে স্পিকার সংবিধানটি নিশ্চিত করেন এবং সদস্যগণ সংবিধানের একটি হস্তলিখিত ও অলংকৃত বাংলা লিপি ও একটি ইংরেজি লিপিতে স্বাক্ষরদান করেন। অবশ্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্বাক্ষরদানে বিরত থাকেন। নতুন সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর (বিজয় দিবস) থেকে বলবৎ হয় এবং ঐ দিনই গণপরিষদের বিলুপ্তি ঘটে।
এভাবে বাংলাদেশ সংবিধানের খসড়া প্রকাশিত ও গণপরিষদে উপস্থাপিত হবার মাত্র ২৪ দিন পর চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। এত অল্প সময়ের মধ্যে সংবিধান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৃষ্টান্ত খুব বিরল। ভারতের খসড়া সংবিধান প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে এবং গৃহীত হয় ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে। ভারতের গণপরিষদে মােট ১১৪ দিন সংবিধানের ওপর আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। ৩৯৫ অনুচ্ছেদ বিশিষ্ট ভারতের সংবিধানটি অবশ্য আকারে বাংলাদেশের সংবিধানের
৮৪
দ্বিগুণেরও বেশি এবং ভাষিক, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক বিরােধের মতাে জটিল সমস্যাবলি যা ভারতীয় সংবিধান প্রণেতাদের মােকাবেলা করতে হয় তা বাংলাদেশে প্রায় অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পশ্চাতে কেবল এই কারণগুলােই কাজ করেনি, আরও অনেক কারণ ছিল।
প্রথমত বাংলাদেশের গণপরিষদ কার্যত একটি একদলীয় সভা ছিল; মাত্র তিন জন সদস্য (যারা তুলনামূলকভাবে বয়সে নবীন এবং সংসদীয় ক্ষেত্রে ছিলেন অনভিজ্ঞ) বিরােধী ভূমিকা পালন করেন। সুতরাং বিরােধী সদস্যদের পর্যাপ্ত সময় দেয়ার পরেও সরকারি দল সংবিধান বিলটি স্বল্প সময়ে পাস করিয়ে নিতে সমর্থ হয়। দ্বিতীয়ত গণপরিষদে আলাপ-আলােচনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কড়াকড়িভাবে দলীয় হুইপ প্রয়ােগ করে। প্রধান হুইপ কর্তৃক প্রণীত তালিকার বাইরে কোনাে সদস্যকেই বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়নি এবং সংসদীয় দলের সভায় স্থিরীকৃত সংশােধনী প্রস্তাব ছাড়া অন্য কোনাে প্রস্তাব গণপরিষদে উত্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়নি। কেবল ৪ নভেম্বর আইনমন্ত্রী কর্তৃক উত্থাপিত ৫টি মামুলি ধরনের সংশােধনী প্রস্তাব এ নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল। তৃতীয়ত বিরােধীদলসমূহ সংসদের বাইরে সংবিধান সম্পর্কে কোনাে গণপ্রতিবাদ গড়ে তুলতে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। ফলে শাসকদল অতি নিশ্চিন্তে তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। তদুপরি প্রধানমন্ত্রী ও পরিষদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব এবং সংবিধানে বিলের পরিচালক আইনমন্ত্রী ড. কামাল হােসেনের পাণ্ডিত্য ও দক্ষতার ফলে সংবিধান পাস করা সহজ ও ত্বরাম্বিত হয়।
৭. গণপরিষদ বহির্ভুত বিতর্ক
খসড়া সংবিধানের পূর্ণ বিবরণ ১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবরের জাতীয় দৈনিকসমূহে প্রকাশিত হয়। বিরােধী রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনসমূহ প্রধানত সংবাদপত্রের মাধ্যমে সংবিধান সম্পর্কে স্ব স্ব অভিমত ব্যক্ত করে। তাদের বক্তব্যের প্রকৃতি ও সমালােচনার ধারা অনুসারে এই সব দল বা সংগঠনকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করা যায় :
১. ন্যাপ (ভাসানী), বাংলাদেশের ক্যুনিস্ট পার্টি (লেলিনবাদী), বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এবং বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন।
২. বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (রব-সিরাজ) তথা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল।
৩. ন্যাপ (মােজাফফর), বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি (মনি সিং) এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।
প্রথম গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত দলগুলাে পিকিংপন্থী বাম দল হিসাবে পরিচিত ছিল। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি তাদের আস্থা ছিল না, তারা বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা সংবিধানের তীব্র সমালােচনা করে, এমন কি গণপরিষদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে । ন্যাপ নেতা মাওলানা ভাসানী যুক্তি প্রদর্শন
৮৫
করে বলেন, গণপরিষদের সদস্যগণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আইনগত কাঠামাের (১৯৭০) অধীনে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত হন। তাঁরা অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামাের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য ৬দফা ভিত্তিক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ম্যান্ডেট লাভ করেন। অতএব সকল রাজনৈতিক দলের যৌথ সংগ্রামের মাধ্যমে যে সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে সে বাংলাদেশের সংবিধান রচনার অধিকার তাদের নাই।”১১
বাংলাদেশের ক্যুনিস্ট পার্টি (লেলিনবাদী) এবং বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টিও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করে। এই সব সংগঠন দাবি করে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের প্রতিনিধি সমবায়ে গঠিত জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন ও গণভােটের মাধ্যমে তা গ্রহণ করতে হবে।
এই গ্রুপের দলগুলাের মতে সংবিধান ছিল না সমাজতান্ত্রিক, না গণতান্ত্রিক। তারা বলে, কিন্তু ভাল ভাল কথা ও সাধু ইচ্ছা রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে সন্নিবেশিত হলেও সেখানে নাগরিকদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের কোনাে নিশ্চয়তা নেই এবং সংসদে কৃষক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বেরও কোনাে ব্যবস্থা নেই। “বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি” বাজেয়াপ্ত এবং “সামন্তবাদ” বিলােপের কোনাে বিধান সংবিধানে নেই। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলােপ করা হয়নি, এমনকি তার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত করা হয়নি। অতএব তারা মনে করে যে, এই সংবিধানের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব নয়। তারা আরাে অভিযােগ করে যে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনস্বার্থ, নৈতিকতা ইত্যাদির নামে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ অস্বীকার করা হয়েছে।১২
বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক বলেন সংবিধানটি সংশােধনেরও অনুপযুক্ত এবং তাদের নিকট অগ্রহণযােগ্য।১৩
মাওলানা ভাসানীও ঘােষণা করেন যে, তাঁর দল ঐ সংবিধান প্রত্যাখ্যান করেছে।১৪
বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন এবং ভাসানী ন্যাপ সমর্থিত বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন মনে করে যে, সংবিধানে জনগণের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি এবং তারা একটি গ্রহণযােগ্য সংবিধান প্রণয়নের জন্য “জাতীয় কনভেনশন” আহ্বানের দাবি জানায়।১৫
দ্বিতীয় গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত সংগঠনসমূহ নিজেদেরকে মার্কসবাদাধী বলে দাবি করেণ, কিন্তু তারা চীনপন্থী কিংবা রুশপন্থী বলে পরিচিত হতে অস্বীকার করে। শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল সংবিধানে পরিকল্পিত সমাজতন্ত্রকে পরিত্যক্ত সম্পত্তির সমাজতন্ত্র” বলে সমালােচনা করে। এই দলের নেতা বলেন, সরকার সমাজতন্ত্রের নামে কেবল পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করেছে, কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রধান লক্ষ্য যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলােপ এবং শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কোনাে ব্যবস্থা সংবিধানে করা হয়নি। মূলনীতিসমূহ কার্যকর করার জন্য
৮৬
আদালতের শরণাপন্ন হবার অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই সংবিধানের অধীনে দেশে উঠতি ধনিক শ্রেণি ও জোতদারদের শাসন পাকাপােক্ত হবে এবং সমাজতন্ত্রের নামে শ্রেণি শােষণ অব্যাহত থাকবে।১৬
এই দলের ছাত্র সংগঠন সমাজবাদী ছাত্রজোটের মতে, “সংবিধানটি ছিল সমাজতন্ত্রের নামে সমাজতন্ত্রকে হত্যা করার সুপরিকল্পিত দলিল।১৭
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও সদ্যগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতা আসম আব্দুর রব বলেন যে, সংবিধানটি একটি “বাজে সংবিধান” তবে একবার না থাকার চেয়ে একটি বাজে সংবিধানও ভালাে। তিনি অভিযােগ করেন যে, মৌলিক অধিকারসমূহের ওপর বাধা নিষেধ আরােপ করে গণতন্ত্রকে “নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। সংবিধানে শ্রেণীদ্বন্দ্ব স্বীকার করা হয়নি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার যথাযথ নির্দেশনা নেই। ফলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় কাগুজে বুলিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতিকে “শাে বয়” এবং প্রধানমন্ত্রীকে সর্বেসর্বা করা হয়েছে। তিনি সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে পরােক্ষ নির্বাচন এবং ৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে সদস্যপদ বাতিল সংক্রান্ত বিধানকে অগণতান্ত্রিক বলে সমালােচনা করেন।১৮
তৃতীয় গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত দলসমূহ মস্কোপন্থী বাম সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছিল। তারা সংসদীয় পথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নীতিতে বিশ্বাসী ছিল এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সহযােগিতার নীতি অনুসরণ করে আসছিল।
এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ন্যাপ (মােজাফফর) সংসদীয় সরকার, মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদির জন্য সংবিধানের প্রশংসা করে, কিন্তু একই সঙ্গে মৌলিক অধিকারের ওপর বাধানিষেধ আরােপের সমালােচনা করে। এই দলের নেতৃবৃন্দ বলেন যে, অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়ােজনীয় বিধান সংবিধানে নেই। কর্ম ও জীবিকার ন্যূনতম উপকরণের নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর হাতে অযৌক্তিকভাবে অধিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং তাতে সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ ব্যাহত হবে। তাঁরা ৭০ অনুচ্ছেদকেও অগণতান্ত্রিক বলে সমালােচনা করেন। ন্যাপ সংবিধানের উৎকর্ষ বিধান কল্পে কতকগুলাে দাবি উত্থাপন করে। সেগুলাের মধ্যে ছিল, জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদা ও দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলােপের সুস্পষ্ট বিধান, উপজাতীয়দের জন্য স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা, সংরক্ষিত মহিলা আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যাহারের অধিকার।১৯
বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির মতে, কিছু অগণতান্ত্রিক ধারা থাকা সত্ত্বেও সংবিধানটি “মােটামুটি গণতান্ত্রিক”। এই দলের নেতৃবৃন্দ বলেন, সংবিধানটি সমাজতান্ত্রিক নয় এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে একটা সমাজতান্ত্রিক সংবিধান আশা করাও যায় না। সংবিধানকে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও সমাজতন্ত্র অভিমুখী করার লক্ষ্যে কম্যুনিস্ট পার্টি ১২-দফা দাবি পেশ করে। এই দাবিগুলাের মধ্যে ছিল: সকল
৮৭
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে জাতীয় অর্থনীতির মূল খাত হিসেবে গড়ে তােলা; সমাবেশ, মিছিল ও ধর্মঘটের অবাধ অধিকার; সংসদের আস্থা হারালে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিধান; সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচন এবং কেবল দলত্যাগ কিংবা দলের বিপক্ষে ভােটদানের কারণে সংসদ সদস্যপদ বাতিলের ব্যবস্থা।২০
বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মােজাফফর) সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ বলেন যে, সংবিধানটি সমাজতান্ত্রিক নয়, তবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সাপেক্ষে একটি অন্তবর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করা যায়। তাঁরা সংবিধানের কতকগুলাে ত্রুটির কথা উল্লেখ করেন এবং কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের অনুকরণে ১৬-দফা সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন।২১
এভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত সংগঠনসমূহ সংবিধানকে অগণতান্ত্রিক ও অসমাজতান্ত্রিক বলে তীব্রভাবে সমালােচনা করে, কিন্তু তারা কোনাে গঠনমূলক সুপারিশ পেশ করেনি। এমনকি, প্রথম গ্রুপ গণপরিষদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং খসড়া সংবিধানটি প্রত্যাখ্যান করে। তবে দ্বিতীয় গ্রুপ গণপরিষদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ কিংবা সংবিধান মেনে নিতে অস্বীকার করেনি। তৃতীয় গ্রুপের দৃষ্টিতে সংবিধানটির ভালাে এবং মন্দ উভয় দিকই ছিল। এই গ্রুপ কেবল সংবিধানের ত্রুটিগুলােই উল্লেখ করেনি, সংবিধানের উৎকর্ষ বিধান কল্পে কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পেশ করে। তৃতীয় গ্রুপ গণপরিষদকে বৈধ সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ বলেও স্বীকার করে, তবে ক্ষোভ প্রকাশ করে যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধান প্রণয়নের মতাে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে “দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনমূহের সঙ্গে যথার্থ পরামর্শ করেনি।২২
অরাজনৈতিক সংঘ বা গােষ্ঠীগুলাের মধ্যে কেবল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সংবিধান সম্পর্কে তার অভিমত ব্যক্ত করে এবং সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১৫ থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ করার দাবি জানায়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে ক’জন বুদ্ধিজীবী (মির্জা গােলাম হাফিজ, ড. আলিম-আল রাজী ও খান বাহাদুর নাজির উদ্দীন), একজন প্রাক্তন রাজনীতিবিদ (আবুল হাশিম), দু’জন সাংবাদিক-সাহিত্যিক (আবুল মনসুর আহমদ ও আব্দুল গাফফার চৌধুরী) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন অধ্যাপক (বদরুদ্দীন ওমর)। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সংবিধানের প্রশংসা করে বলেন যে, এটি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমম্বয়ে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ার একটি উপযােগী দলিল। আবার কেউ কেউ অগণতান্ত্রিক বা অসমাজতান্ত্রিক বলে সংবিধানের কঠোর সমালােচনা করেন। কিন্তু কেউ সংবিধানের মূলনীতিসমূহের বিরােধিতা করেননি।
যাহােক, এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ সংবিধানের পক্ষে বা বিপক্ষে জনমত গঠনের জন্য কোনাে উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সংবিধানের সমালােচনা মূলত সংবাদপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কেবল রুশপন্থী সংগঠনগুলাে ঢাকায় কয়েকটি মিছিল সমাবেশ ও বিক্ষোভের আয়ােজন করে।
৮৮
অপরপক্ষে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সংবিধানটিকে সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম ব্যবস্থা বলে প্রশংসা করে। প্রধানমন্ত্রী মুজিব বলেন সংবিধানটি একটি চমৎকার দলিল। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, জনগণ সানন্দে তা গ্রহণ করবে।২৩
গণপরিষদ তথা আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর। রাজনৈতিক সচিব তােফায়েল আহমদ বলেন, আওামী লীগ নীতিগত ও আইনগতভাবে সংবিধান প্রণয়নের অধিকারী। কারণ, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগের পক্ষে নিঃশর্ত রায় প্রদান করে। তাছাড়া, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দান করে এবং জনগণের সমর্থনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করে। তিনি সংবিধান প্রণয়নের জন্য জাতীয় কনভেনশন আহবানের প্রস্তাব নাকচ করে বলেন যে, গত নির্বাচনে যারা জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে তাদের সঙ্গে সংবিধান সম্পর্কে আলােচনার কোনাে অর্থ হয় না। তিনি ঘােষণা করেন যে, আগামী নির্বাচনের ফলাফলেই দেখা যাবে আওয়ামী লীগ এবং তার প্রণীত সংবিধানের প্রতি জনগণের সমর্থন আছে কি না।২৪
বিরােধী দলসমূহের অভিযােগ অস্বীকার করে কামাল হােসেন দাবি করেন যে, সংবিধানটি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক। সংসদের প্রাধান্য সমর্থন করে তিনি বলেন, গণতন্ত্রে ক্ষমতা জনগণের হাতে, অতএব জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদ সরকারের অন্যকোণ বিভাগের অধীন হতে পারে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, মৌলিক অধিকারসমূহ সম্পূর্ণ বাধাহীন হতে পারে না এবং যেহেতু বাধা নিষেধসমূহ নির্বাচিত সংসদ কর্তৃক আরােপিত হবে এবং বাধা নিষেধসমূহের যৌক্তিকতা বিচার বিভাগীয় পর্যালােচনার অধীন, সেহেতু এগুলােকে অগণতান্ত্রিক বলা যায় না। তিনি দাবি করেন যে, সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সংসদ ভেঙে দেয়ার বিশেষ অধিকার একটি সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত বিষয় এবং তা সার্বভৌম বিচারকমণ্ডলীর নিকট আবেদন করার নামান্তর মাত্র। সরকারি কর্মচারীদের বরখাস্ত করার বিধান সম্পর্কে আইনমন্ত্রী যুক্তি দেখান, যারা অতীতে (মুক্তিযুদ্ধের সময়) দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করেছে এবং এখনও নতুন প্রশাসনকে মেনে নিতে পারেনি তাদের হাত থেকে রেহাই লাভের জন্য এবং পুরানাে ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামােকে নতুন গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়ােজনে পুনর্গঠন করার স্বার্থে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যকর ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকা উচিত। তিনি অভিযােগ করেন যে, যাঁরা মূলনীতিসমূহকে আদালতে বলবৎযােগ্য করতে চান তারা কেবল বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন; এটা কোনাে সমাজতান্ত্রিক বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারসমূহ, যা মূলনীতির মধ্যে স্থান পেয়েছে, আদালতের মাধ্যমে আদায় করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়াজন যথাযথ পরিকল্পনা, আইন প্রণয়ন, অর্থ বরাদ্দ এবং সম্পদের সমাবেশ, যা বিচারবিভাগের কাজ নয়, বাং রাষ্ট্রের আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব।২৫
৮৯
অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, মূলনীতিসমূহের রাতারাতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। দেশে বিরাজমান বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে অগ্রাধিকার নির্ণয় করে মূলনীতিসমূহ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব জনগণ। এং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ছেড়ে দেয়াই যুক্তিযুক্ত।২৬
৮. সংবিধান সম্পর্কে ঐকমত্য (Consensus)
ঐকমত্য বলতে সমাজের সকল সদস্যের সম্মতি কিংবা সকল প্রশ্নে পূর্ণ মতৈক্যের। প্রয়ােজনীয়তা বােঝায় না, বরং প্রধান প্রধান প্রশ্নে সচেতন ও সক্রিয় সদস্যদের। ব্যাপকাংশের মতৈক্যকে বােঝায়। মতৈক্যের ব্যাপ্তি ও গভীরতা এমনই হবে যে, ভিন্ন মতাবলম্বীদের দাবিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত বল প্রয়ােগের প্রয়ােজন হবে না। সংবিধান সম্পর্কে ঐকমত্যের প্রকৃতি ও মাত্রা নিরুপণ করতে হলে তিনটি প্রধান বিষয় বিশ্লেষণ করতে হয় : (১) সংবিধানের মূলনীতি ও ধারাসমূহ সম্পর্কে প্রধান। রাজনৈতিক গােষ্ঠীসমূহের মতামত, (২) গণপরিষদের (Constituent Assembly) গ্রহণযােগ্যতা, (৩) জনমত গঠনের জন্য প্রয়ােজনীয় সুষ্ঠু পরিবেশ।
(১) ১৯৭২ সালের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে ঘােষণা করা হয় এবং সংসদীয় পদ্ধতির মাধ্যমে “সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়। স্বীকৃত বিরােধী দলগুলাে সংবিধানের মূলনীতিসমূহ গ্রহণ করে, কেবল খুটিনাটির ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। এমনকি, চীনপন্থী বাম সংগঠনগুলাে সংবিধানের তীব্র সমালােচনা করলেও মূলনীতিমূহকে চ্যালেঞ্জ করেনি। তারা আপত্তি করে যে, ঐ মূলনীতি বা আদর্শসমূহ বাস্তবায়নের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সংবিধানে নেই। বাম বিরােধী দলগুলাের প্রধান যুক্তি ছিল, সংবিধানটি না ছিল গণতান্ত্রিক, না ছিল সমাজতান্ত্রিক। কারণ, একদিকে মৌলিক অধিকারসমূহের ওপর প্রচুর বাধানিষেধ আরােপ করা হয়; অপরদিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলােপ কিংবা জনগণের অর্থনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়নি।
কিন্তু এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হয় যে, আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারসমূহ বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। এই অধিকারগুলাে প্রয়ােগের ক্ষেত্রে নানাবিধ বাধানিষেধের শর্তাধীন করা হয়। কিন্তু বাধানিষেধগুলাে অবশ্যই “যুক্তিসংগত হবে এবং সেগুলাে একটি নির্বাচিত আইনসভা কর্তৃক আরােপিত হবে। আবার বাধানিষেধগুলাে যুক্তিসংগত কিনা তা পরীক্ষা করার ক্ষমতা থাকবে সুপ্রিম কোর্টের। সংসদের কোনাে আইন যদি মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তবে তা বাতিল ঘােষণা করার ক্ষমতা ও সুপ্রিম কোর্টের থাকবে। এই ব্যবস্থা নতুনও নয় অগণতান্ত্রিকও নয়। পৃথিবীর সব দেশেই মৌলিক অধিকারগুলাে আইনের দ্বারা সীমিত। বরং উপমহাদেশের মাপকাঠিতে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধান ছিল অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও উদার প্রকৃতির। ভারত ও পাকিস্তানের সংবিধানের মতাে বাংলাদেশের সংবিধানে বিনা বিচারে
৯০
নিবর্তণমূলক আটক কিংবা জরুরি অবস্থা ঘােষণার মাধ্যমে মৌলিক অধিকারসমূহ খর্ব বা স্থগিত করার বিধান করা হয়নি। কাজেই গণতন্ত্র সম্পর্কে বিরােধী দলগুলাের অভিযােগ সাধারণভাবে গ্রহণযােগ্য ছিল না।
বিরােধী দলসমূহ যথার্থই অভিযােগ করে যে, সংবিধানটি সমাজতান্ত্রিক ছিল না। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য প্রয়ােজনীয় আর্থ-সামাজিক বিধান, যেমন মালিকানা, বণ্টন ও সামাজিক নিরাপত্তার নীতিসমূহ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু সেগুলাে ছিল প্রতিশ্রুতি মাত্র এবং আইনের দৃষ্টিতে অকার্যকর। নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থান, খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, সমবায়ী মালিকানা কেবল অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসাবে থাকবে কি না এবং শেষ পর্যন্ত সব ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হবে কিনা সে সম্পর্কে সংবিধানে। কোনাে সুস্পষ্ট বিধান ছিল না।
কিন্তু সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনাে আইনগত বাধা ছিল না। সংবিধানের মূল কথা ছিল সংসদের প্রাধান্য। ব্যক্তিগত সম্পত্তি সীমা নির্ধারণ এবং ক্ষতিপূরণসহ কিংবা বিনা ক্ষতিপূরণে যে কোনাে সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করার অবাধ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত ছিল। যাতে করে কোনাে সরকার পূর্বে গৃহীত কোনাে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপ সহজে বানচাল। করতে না পারে সেই লক্ষ্যে সংবিধানে বিশেষ বিধানও করা হয়। ৪৭ অনুচ্ছেদের (২) ধারায় বলা হয় যে, রাষ্ট্রকে কোনাে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে হবে কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃক দেয় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এরূপ কোনাে আইন পাস করতে হলে সংসদের মােট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভােটে তা গ্রহণ করতে হবে।
এভাবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দায়িত্বটি অনাগত সরকারের সদিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। ক্যুনিস্ট পার্টির নেতা মনি সিং যথার্থই বলেন, সংবিধানটি এমনভাবে রচিত হয় যে, তা দেশকে প্রগতি অথবা প্রতিক্রিয়া, সমাজতন্ত্র অথবা ধনতন্ত্র, যে কোনাে পথে নিয়ে যেতে পারে।২৭
আইনমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী যথার্থই যুক্তি দেখান যে, সম্পদের সমাবেশ ও জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ব্যতিরেকে অর্থনৈতিক অধিকারসমূহের সংবিধানিক নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলােপ সম্পর্কে সাংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান করা যেতাে। সম্ভবত শাসনকারী এলিটদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে তা হয়নি। শাসকদল আওয়ামী লীগ ছিল পাতি বুর্জোয়া ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী একটি জাতীয়তাবাদী দল। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির গঠন দলটির শ্রেণি চরিত্র সম্পর্কে ইঙ্গিত বহন করে। এই দল ১৯৫৪ সালের ২১-দফা ইশতেহার এবং ১৯৬৬ সালের ৬-দফা কর্মসূচির মাধ্যমে দীর্ঘদিন যাবত সংসদীয় গণতন্ত্রভিত্তিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। ১৯৭০ সালের প্রারম্ভে দলের অভ্যন্তরে ও বাইরে বামপন্থীদের চাপে আওয়ামী লীগ, “সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কর্মসূচি গ্রহণ করে। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে
৯১
একাধিক আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য প্রদত্ত ভিন্নমতের প্রতিভাত হয় যে, ঐ দলের রক্ষণশীল অংশ স্থিতাবস্থার পক্ষপাতী ছিল এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির সাংবিধানিক নিশ্চয়তা চাচ্ছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দলের রক্ষণশীল ও বামপন্থী অংশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টা করে, এবং গৃহীত সংবিধানটি ছিল বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে একটা আপসরফা। মালিকানার প্রকৃতি ও সীমার খুটিনাটি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব এবং পর্যায়ক্রমে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়।
বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ও মােজাফফর ন্যাপের মধ্যপন্থী বাম নেতৃত্বও অভিমত পােষণ করতাে যে, সংসদীয় পথে ক্রমাম্বয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সুতরাং তারা একটি অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সংবিধানটি গ্রহণ করে এবং এর উৎকর্ষ বিধানের জন্য খুটিনাটি সুপারিশ পেশ করে।
কিন্তু ভাসানী ন্যাপ, বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি (লেলিনবাদী), বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টি, শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল ও জাসদ সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করত না। তারা বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সুতরাং তারা সংবিধানটি পুরােপুরি মেনে নিতে অস্বীকার করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সংবিধানটি প্রত্যাখ্যান করে বলে ঘােষণা দেয় এবং কেউ নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালাে” বলে তা গ্রহণ করে। এই উগ্র বামপন্থী দলসমূহ বিপ্লবী উত্তরণের জন্য জনগণকে সংঘবদ্ধ করার উদ্দেশে অবাধ গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা দাবি করে, রাজনৈতিক (বুর্জোয়া) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে নয়। সুতরাং বিভিন্ন দলের মধ্যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পন্থা সম্পর্কিত এই মতপার্থক্য সংসদীয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা বা হুমকি হিসাবে বিরাজ করে।
তাছাড়া কিছু আত্মগােপনকারী চরম বামপন্থী দল ছিল (যেমন পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি (এম এল), পূর্ব বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টি (এম এল), পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি), যারা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সুযােগ গ্রহণ করতেও প্রস্তুত ছিল না। তারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল।
ইসলামী ডানপন্থী দলসমূহ যাদেরকে স্বাধীনতা প্রাক্কালে নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়, তারা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতাে, কিন্তু তারা সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের কট্টর বিরােধী ছিল। এরাও বামপন্থীদের সাথে সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে বানচালের কাজে নিয়ােজিত হয়।
(২) গণপরিষদের বৈধতা সম্পর্কেও যথেষ্ট বিতর্ক ছিল। বিরােধী দলসমূহের একাংশ গণপরিষদের সংবিধান প্রণয়নের অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে। তারা যুক্তি দেখায় যে, গণপরিষদের সদস্যগণ অখণ্ড পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে নির্বাচিত হন। সুতরাং সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করার অধিকার তাদের নেই। এই আপত্তির প্রধান কারণ ছিল, গণপরিষদের বিরােধী দলগুলাের কোনাে প্রতিনিধি ছিল না বললেই চলে। সুতরাং তারা একটি সর্বদলীয় জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণের দাবি জানায়। অনুরূপ কনভেনশন ডাকতে
৯২
গেলে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্বের পরিমাণ ও পদ্ধতি এবং প্রস্তাবিত কনভেনশনের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে গুরুতর আইনগত ও রাজনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি হতাে এটা ঠিক। কিন্তু শাসক দল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিরােধী দলসমূহকে জড়িত করার জন্য কিছু অনানুষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতাে। দুর্ভাগ্যবশত আওয়ামী লীগ ব্যাপক ঐকমত্য গড়ার জন্য প্রয়ােজনীয় শলাপরামর্শের পথ পরিহার করে “একলা চল’ নীতি অনুসরণ করে। এমনকি, রুশপন্থী দলসমূহ যারা আওয়ামী লীগের প্রতি সর্বোচ্চ সহযােগিতার নীতি অনুসরণ করে আসছিল তাদের সঙ্গেও ক্ষমতাসীন দল কোনাে পরামর্শ করেনি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অভিযােগ করেন যে, আইনমন্ত্রী সংবিধান সম্পর্কে “দেশপ্রেমিক দলসমূহের সঙ্গে আলােচনার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা অজ্ঞাত কারণে রক্ষিত হয়নি।২৮
শাসক দল এই যুক্তিতে জাতীয় কনভেনশনের প্রস্তাব আগ্রাহ্য করে যে, পূর্ববর্তী (১৯৭০ সালের) নির্বাচনে বিরােধী দলগুলাে নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয় এবং আওয়ামী লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের আস্থা ভােগ করতে থাকে। এই দাবি বাস্তব বলে প্রতীয়মান হয়। ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠেয় যে কোনাে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের সম্ভাবনাই ছিল বেশি, এবং সেক্ষেত্রে ঐ দলই সংবিধান রচনা করতাে। তবে অনুরূপ একটি নির্বাচন কিংবা গণভােট অনুষ্ঠিত হলে গণপরিষদ এবং সংবিধানের বৈধতা দৃঢ়তর হতাে।
(৩) গণপরিষদে বিরােধী ও স্বতন্ত্র সদস্যগণকে সংবিধান সম্পর্কে মতামত প্রদানের যথেষ্ট স্বাধীনতা ও সময় দেয়া হয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, তিনি গণপরিষদে আলােচনার যে সুযােগ পেয়েছেন তা “গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি ইতিহাস হয়ে থাকবে”।২৯
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাও বলেন, তিনি গণপরিষদে অত্যন্ত মুক্ত পরিবেশে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করার পূর্ণ সুযােগ পেয়েছেন।”
কিন্তু গণপরিষদের বাইরে সারা দেশে ততটা সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল না। নবলব্ধ স্বাধীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা এবং জাতির পিতা” ও “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সর্বব্যাপী সম্মােহনী ব্যক্তিত্ব বিরােধী মত ও দলের বিকাশ এবং সুষ্ঠু জনমত গঠনের পরিবেশকে খানিকটা ব্যাহত করে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও ছিল কিছুটা সীমিত। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে, বিরােধী দলগুলাের পক্ষে জনসভা, মিছিল, বিক্ষোভ ইত্যাদির আয়ােজন করতে কোনাে বাধা ছিল না এবং তারা এই সীমিত সুযােগের সদ্ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়। সম্ভবত তার কারণ এই যে, ঐ মুহূর্তে তাদের নিকট কোনাে বিকল্প সাংবিধানিক পরিকল্পনা ছিল না। ফলে তারা সাংবিধানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। এই ভাবে ১৯৭২ সালে সারা দেশে এমন এক রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছিল যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সংবিধানটি সাধারণভাবে গ্রহণযােগ্য ছিল এবং পরবর্তী অধ্যায়ে দেখা যাবে যে, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলী সংবিধানটির পক্ষে বিপুলভাবে রায় দেয়।
৯৩
সূত্র ও টীকা
১. ইতােমধ্যে ১০ জন সংসদ-সদস্য মৃত্যুবরণ করেন (এই ১০ জনের মধ্যে পাঁচজন মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত হন), রাষ্ট্রপতির ২৩নং আদেশের অধীনে ২৩ জন আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য বহিষ্কৃত হবার ফলে সদস্যপদ হারান এবং ছ’জন সদস্য পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের জন্য অযােগ্য ঘােষিত হন। ১৯৭২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আরাে ১৯ জন সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হবার ফলে তাদের সদস্যপদ হারান।
২. বাংলাদেশ গণপরিষদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৪ (১৯ অক্টোবর, ১৯৭২) পৃষ্ঠা ১০৩।
৩. খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু সাইদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, ১৬ নভেম্বর, ১৯৭২।
৪. বাংলাদেশ গণপরিষদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ১ (১২ অক্টোবর, ১৯৭২), পৃষ্ঠা ২৭।
৫. ঐ, খণ্ড ২, সংখ্যা ৯ (২৫ অক্টোবর, ১৯৭২), পৃষ্ঠা ২৫৯।
৬. খসড়া প্রণয়ন কমিটির কার্যধারা এবং সদস্যদের ভিন্ন মত সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, বাংলাদেশ গণপরিষদ, খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির রিপাের্ট, ঢাকা, ১৯৭২।
৭. গণপরিষদের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের বক্তৃতা দেখুন, বাংলাদেশ গণপরিষদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৪ (১৯ অক্টোবর, ১৯৭২) পৃষ্ঠা ১১৮।
৮. বাংলাদেশ গণপরিষদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৮ (২৪ অক্টোবর, ১৯৭২) পৃষ্ঠা ২২১-২৩৮।
৯. ঐ, খণ্ড ২, সংখ্যা ৯ (২৫ অক্টোবর, ১৯৭২) পৃষ্ঠা ২৯২-২৯৪।
১০. ঐ খণ্ড ২, সংখ্যা ১২ (৩০ অক্টোবর, ১৯৭২) পৃষ্ঠা ৪১৫-৪১৭
১১. দৈনিক বাংলা, ২১ অক্টোবর, ১৯৭২।
১২. ঐ ১৯,২৩ ও ২৯ অক্টোবর, ১৯৭২।
১৩, ঐ, ২৯ অক্টোবর, ১৯৭২।
১৪. ঐ, ৩১ অক্টোবর ১৯৭২।
১৫. ঐ, ২৪ ও ২৫ অক্টোবর ১৯৭২।
১৬. ঐ, ১৯ অক্টোবর ১৯৭২।
১৭. ঐ, ২১ অক্টোবর, ১৯৭২।
১৮. ইত্তেফাক, ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর, ১৯৭২।
১৯. দৈনিক বাংলা, ১৭ অক্টোবর, ১৯৭২।
২০. দৈনিক বাংলা ও The Bangladesh Observer, ১৯ অক্টোবর, ১৯৭২।
২১. দৈনিক বাংলা ও সংবাদ, ১৭ অক্টোবর, ১৯৭২।
২২. তৃতীয় গ্রুপের মতে কেবল বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি (মনি সিং), ন্যাপ (মুজাফফর), | আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গসংগঠনসমূহ দেশপ্রেমিক সংগঠন ছিল।
২৩, দৈনিক বাংলা ও The Bangladesh Observer, ১২ ও ১৮ অয়ে
২৪. The Bangladesh Observer, ২৪ অক্টোবর, ১৯৭২।
২৫. বাংলাদেশ গণপরিষদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ১২ (৩০ অক্টোবর, ১৯৭২), পৃষ্ঠা ৪২০-৪৪২।
২৬. ঐ, পৃষ্ঠা ৩৮৬।
২৭. দৈনিক বাংলা, ২৬ অক্টোবর, ১৯৭২।
২৮. বাংলাদেশ গণপরিষদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৪ (১৯ অক্টোবর, ১৯৭২) পৃষ্ঠা ১০৮।
২৯. ঐ, খণ্ড ২, সংখ্যা ১৭ (৪ নভেম্বর, ১৯৭২), পৃষ্ঠা ৬৯১।
৩০. ঐ, পৃষ্ঠা ৪৯৩।
Reference: বাংলাদেশের রাজনীতি সংঘাত ও পরিবর্তন – আবুল ফজল হক