বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও আর্থ-সামাজিক পটভূমি
বর্তমান বাংলাদেশ যে ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত তা শত শত বছর ধরে “পূর্ব-বাংলা” নামে পরিচিত ছিল আর এর অধিবাসীদের বলা হতাে “বাঙালি”। ১৭৫৭ সালে বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে পূর্ববাংলা হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের ও বিভিন্ন বংশের রাজা-বাদশাহ কর্তৃক শাসিত হয়েছে, কখনাে পৃথক রাজনৈতিক একক হিসাবে, আবার কখনাে বর্তমান ভারতীয় রাজ্য পশ্চিম-বাংলার সঙ্গে যৌথভাবে।১
দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত বাংলার অধিবাসীদের ধর্ম ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ এবং ভাষা ছিল বাংলা। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার পর অবাঙালি মুসলমানগণ এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন আরম্ভ করে, এবং বৈবাহিক সম্পর্ক ও ধর্মান্তরের ফলে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে সমগ্র বাংলায় মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।২
১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল এই ছয় বছর ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় দু’শ বছর ব্রিটিশ শাসনকালে পূর্ববাংলা ছিল বাংলা প্রদেশের অংশ, যার রাজধানী ছিল কলকাতা। ১৯০৫ সালে বাংলাকে ভাগ করা হয় এবং পূর্ববাংলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে “পূর্ববাংলা ও আসাম” নামে ব্রিটিশ ভারতের একটি পৃথক প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। নতুন প্রদেশের রাজধানী ছিল ঢাকা। কিন্তু ১৯১১ সালে বঙ্গ বিভাগ রদ করা হয় এবং পূর্ব-বাংলা ও পশ্চিম-বাংলাকে একত্রিত করে একটি প্রদেশে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করা হলে বাংলা। আবার বিভক্ত হয় এবং পূর্ব-বাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হয়।
১. হিন্দু-মুসলমান সংঘাত ও পাকিস্তানের জন্ম
ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু ও মুসলমান এই দুটি ছিল প্রধান সম্প্রদায়। সমগ্র ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক-চতুর্থাংশ এবং হিন্দুদের সংখ্যা ছিল তিনচতুর্থাংশ। মুসলমানরা কেবল সংখ্যালঘু ছিল না, হিন্দুদের তুলনায় তারা ছিল। অনেক অনগ্রসর। এমন কি যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল সেসব প্রদেশেও তারা শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা, বাণিজ্য ইত্যাদি সব দিক দিয়েই হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে ছিল। ১৯১১ সালে বাংলায় মুসলমানরা জনসংখ্যার ৫১% হলেও
২৯
তাদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৪%। অপরপক্ষে হিন্দুদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল প্রায় ১২%। ঐ সময় বাংলায় বিভিন্ন পেশায় নিয়ােজিত হিন্দু-মুসলমান অনুপাত ছিল নিম্নরূপ:৩
পেশা | হিন্দু | মুসলমান |
প্রজা | ৫ | ৯ |
জমিদার | ৭ | ৩ |
আইনজীবী | ৯ | ১ |
ডাক্তার | ৫ | ১ |
শিক্ষক | ৭ | ২ |
পুলিশ | ২ | ১ |
বেসামরিক কর্মচারী | ৭ | ২ |
১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব-বাংলা ও আসাম গঠিত হলে পূর্ব-বাংলার মুসলমানরা নতুন সুযােগ-সুবিধা লাভের আশায় তাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু হিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও রাজনীতিকগণ বাংলা বিভাগকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতির ফসল হিসাবে চিহ্নিত করেন। তারা মনে করেন যে, বঙ্গভঙ্গ ছিল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করে ভারতের রাজনৈতিক অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার চক্রান্ত।৪
সুতরাং তারা বঙ্গভঙ্গ রদের দাবি জানায় এবং বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে এক তীব্র ‘স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তােলেন। কলকাতা ভিত্তিক কিছু সংখ্যক মুসলিম বুদ্ধিজীবীও এ আন্দোলনে যােগ দেন।৫
ফলে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং বাংলার অনেক স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত হিংসাত্মক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের রূপ নেয় এবং ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গ বিভাগ রদ করতে বাধ্য হয়। ফলে পূর্ব-বাংলা ও পশ্চিম-বাংলা একত্রিত করে কেবল বাংলা ভাষাভাষী এলাকা সমম্বয়ে বাংলা প্রদেশ গঠন করা হয়।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলন যেমন ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করে, তেমনি এর মধ্যে দিয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্বও প্রস্ফুটিত হয়। যখন হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য দেশব্যাপী। আন্দোলনে লিপ্ত, তখন ভারতের মুসলমান জমিদার ও অন্যান্য পেশাজীবী এলিট শ্রেণী ঢাকায় মিলিত হয়ে ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম লীগ নামে তাদের নিজস্ব সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। মুসলিম লীগের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থের সংরক্ষণ ও বর্ধন।
অপরদিকে, ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতবর্ষকে একটি জাতি বলে দাবি করে এবং ভারতের হিন্দু-মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয় চেতনা সংহত ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠাকে অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে
৩০
গ্রহণ করে। কিন্তু কংগ্রেস ছিল একটি হিন্দুপ্রধান সংগঠন। এর নেতৃত্বের বিরাট অংশ ছিল জমিদার ও পেশাজীবীদের মধ্য থেকে আগত, যাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ সংরক্ষণ করা। কংগ্রেস ১৯০৬ সালে ভারতের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবি উত্থাপন করে। হিন্দু-মুসলমানদের দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগ স্বায়ত্বশাসনের দাবিকে সমর্থন করে এবং দাবি আদায়ের আন্দোলনে কংগ্রেসের সঙ্গে পূর্ণ সহযােগিতার নীতি গ্রহণ করে। কারণ, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘটনাটিকে মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতির লংঘন মনে করে এবং তারা বুঝতে শিখে যে, আন্দোলনই দাবি আদায়ের প্রধান পথ।
কিন্তু ১৯১৯ সাল থেকে স্বায়ত্তশাসনের প্রসারের সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান বিরােধও প্রসার লাভ করে।৬
যেহেতু হিন্দুরা ছিল অগ্রসর এবং মুসলমানরা নানাভাবে বঞ্চিত, সেহেতু সরকারের সামনে উপস্থাপিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থ-জড়িত সাধারণ প্রশ্নগুলােও সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করে।৭
তাছাড়া, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে মুসলিম লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে অস্বীকৃতি এবং কংগ্রেসশাসিত প্রদেশগুলােতে হিন্দুভাবাপন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক নীতির প্রবর্তন মুসলমান সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ করে।৮
কংগ্রেস ১৯২৯ সালে ভারতের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে। মুসলিম লীগও ১৯৩৭ সালে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতাকে তার লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে। কিন্তু মুসলিম লীগের ভয় ছিল স্বাধীন ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থায় মুসলমানরা তাদের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অধিকার আদায় করতে পারবে না, কারণ তারা ছিল সংখ্যালঘু ও অনগ্রসর। সুতরাং মুসলমানরা পৃথক জাতি হিসেবে একটা পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করতে শুরু করে।
দ্বিজাতিতত্ত্ব ও লাহাের প্রস্তাব : ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ সভাপতি মােহম্মদ আলী জিন্নাহ ঘােষণা করেন যে, যে কোনাে বিচারে ভারতের মুসলমানরা একটি পৃথক জাতি। হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক ধর্ম, পৃথক সামাজিক আচার ও পৃথক সাহিত্যের অধিকারী। তাদের সভ্যতা আলাদা, ইতিহাস আলাদা, জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। একটি সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু, আর একটি সংখ্যালঘু। এই দুই সম্প্রদায় একই সরকারের অধীনে থাকতে পারে না। অতএব মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি, পৃথক ভূখণ্ড ও পৃথক রাষ্ট্র থাকতে হবে। জিন্নাহর এই দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহােরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা লাহাের প্রস্তাব নামে খ্যাত। প্রস্ত বিটির মূল দাবি ছিল নিম্নরূপ :
প্রয়ােজনীয় আঞ্চলিক পুনর্বিন্যাস সাপেক্ষে, ভৌগােলিকভাবে সংলগ্ন ইউনিটগুলাের (প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলাে) সমম্বয়ে এমনভাবে এলাকা গঠন করতে হবে যাতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ, যথা ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ও
৩১
পূর্ব অঞ্চল, পৃথক পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র (Independent States) হিসেবে সংগঠিত হতে পারে, যেখানে অঙ্গীভূত ইউনিটগুলাে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম হবে।৯
স্পষ্টত লাহাের প্রস্তাবে ভারতবর্ষকে ভাগ করে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে একটি রাষ্ট্র এবং দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি করা হয়। এই দুই মুসলিম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ইউনিট বা প্রদেশগুলাের জন্য একই সাথে স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমত্বের কথা বলে সম্ভবত প্রদেশগুলােকে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের কথাই বােঝানাে হয়। কিন্তু ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসের অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ দলীয় সংসদ-সদস্যদের এক সম্মেলনে মূল লাহাের প্রস্তাবকে সংশােধন করে ভারতবর্ষের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলাের সমবায়ে “একটি স্বাধীন রাষ্ট্র” তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। তবে মূল প্রস্তাবে প্রদেশগুলাের জন্য যে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয় তা অটুট থাকে।
কিন্তু পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবি সম্পর্কে মুসলিম লীগের ওটাই শেষ কথা ছিল না। ১৯৪৬ সালের মে মাসে ক্যাবিনেট মিশন ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে পরিকল্পনা পেশ করে তাতে বলা হয় যে, একটি সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ইউনিয়ন গঠন করা হবে। প্রদেশগুলাে তিনটি আঞ্চলিক গ্রুপে বিভক্ত হবে। প্রথম গ্রুপে থাকবে মধ্যভারতের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রুপে থাকবে যথাক্রমে উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের (বাংলা ও আসাম) মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলাে। ইউনিয়ন সরকারের হাতে মাত্র তিনটি ক্ষমতা থাকবে পররাষ্ট্র দেশরক্ষা ও যােগাযােগ। অবশিষ্ট ক্ষমতা থাকবে গ্রুপ সরকারগুলাের হাতে। প্রথমে মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু কংগ্রেসের। একগুঁয়েমির কারণে এই পরিকল্পনা কার্যকর হতে পারেনি। ফলে মুসলিম লীগ তার ভারত বিভাগ ও পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ফিরে যায়।
স্বাধীন বাংলা আন্দোলন : ১৯৪৭ সালের প্রথমদিকে, যখন গভর্নর-জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে ভারত বিভাগ সম্পর্কে আলাপআলােচনা করছিলেন, তখন বঙ্গীয় মুসলিম লীগের এক প্রভাবশালী অংশ মূল লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করে। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম ঘােষণা করেন:
ভারতের মুসলমানরা লাহাের প্রস্তাব এবং কেবল (মূল) লাহাের প্রস্তাবের প্রতিই অনুগত; তারা এর ভিন্ন ব্যাখ্যা বা সংশােধনী গ্রাহ্য করে না। লাহাের প্রস্তাবে অখণ্ড মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বলা হয়নি; ধর্মান্তর কিংবা গণপ্রত্যাবাসনের মাধ্যমে কৃত্রিম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও এতে ছিল না। এর দ্বারা বঙ্গদেশ ও ভারতের অন্যান্য সাংস্কৃতিক ইউনিটকে পূর্ণ স্বাধীনতা দানের প্রস্তাব করা হয়।১০
তিনি বাংলার হিন্দু-মুসলমান সবার প্রতি তাদের দেশকে” (বাংলাকে) বাইরের সকল প্রকার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করবার আহ্বান জানান।
৩২
বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীও অখণ্ড স্বাধীন বাংলার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, হিন্দু ও মুসলমান সম্মিলিতভাবে বাংলাকে একটি মহৎ দেশ ও বাঙালিকে একটি মহৎ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।১১
শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শংকর রায় প্রমুখের নেতৃত্বে বাংলা কংগ্রেসের এক প্রভাবশালী অংশ অভিন্ন ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি সমর্থন করে। বাংলার মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতাদের সমবায়ে গঠিত একটি যৌথ কমিটি স্বাধীন বাংলার ভবিষ্যত সংবিধান সম্পর্কে একটি রূপরেখা ও প্রণয়ন করে।১২
কিন্তু হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব স্বাধীন বাংলা পরিকল্পনার বিরােধিতা করে। ঐ সময়ে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের এমনই অবনতি ঘটে যে, সারা ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিস্তার লাভ করে, এবং স্বাধীন বাংলার প্রবক্তাগণ “মহাত্মা গান্ধী ও “কায়েদে আজম” জিন্নাহর মতাে সম্মােহনী নেতৃত্বের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হন। সুতরাং ১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্ত হয় এবং পূর্ব-বাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ ও পশ্চিম বাংলা ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত হয়।
২. পূর্ব-বাংলা ও পশ্চিম-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব
পাকিস্তান ছিল একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্র। ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা ভৌগােলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান—এই চারটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত অঞ্চলটি পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল। তার প্রায় এক হাজার মাইল দূরে অবস্থিত পূর্ব-বাংলা ছিল অপর একটি প্রদেশ। দুই অঞ্চলের দুই জনগােষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র বন্ধন ছিল ধর্ম। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রথা, খাদ্য, বেশভূষা প্রভৃতি প্রায় সবদিক থেকেই দুই জনগােষ্ঠী ছিল পৃথক। কেবল হিন্দু আধিপত্যের ভয়ে বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষ সমর্থন করে। কিন্তু শিক্ষিত বাঙালি গােষ্ঠী তাদের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক সত্তাকে বিসর্জন কিংবা কোনাে অবাঙালি গােষ্ঠীর শাসন মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। এমতাবস্থায় পাকিস্তান জাতি গঠনের জন্য প্রয়ােজন ছিল দুই অঞ্চলের স্বার্থ ও পারস্পরিক সমঝােতার ভিত্তিতে একটা গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। কিন্তু তা না করে পশ্চিম-পাকিস্তান ভিত্তিক শাসকগােষ্ঠি পূর্ব-বাংলার প্রতি উপনিবেশসুলভ সাংস্কৃতিক একীকরণ, অর্থনৈতিক শােষণ ও রাজনৈতিক আধিপত্যের নীতি অনুসরণ করে। ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার বিদ্যমান ব্যবধান গভীরতর হয় এবং পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে। ১৯৫১ সালের আদমশুমারী অনুসারে পাকিস্তানের রাজনীতি-৩
৩৩
জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানরা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিল এবং পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে বাংলাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করত। তারা আশা করে যে, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু জনগােষ্ঠীর ভাষা বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চায়। উর্দুর পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে পাকিস্তানের উর্দুভাষী প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন :
পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং মুসলিম জাতির ভাষাই হবে তার রাষ্ট্রভাষা। উপমহাদেশের দশ কোটি মুসলমানের দাবির ফলে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে এবং এই দশ কোটি মুসলমানের ভাষা হলাে উর্দু।১৩
পাকিস্তানের গভর্নর-জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহও উর্দুকে ইসলামী ভাষা বলে দাবি করেন এবং ঘােষণা করেন যে, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। যারা এর বিরােধিতা করবে তারা বিদেশের চর, পাকিস্তানের শত্রু। তিনি যুক্তি দেখান যে, রাষ্ট্রভাষা একটি না হলে কোনাে জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে না।১৪
উর্দু-আরবি ভাষায় শিক্ষিত কিছু আলেম এবং বাংলার সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু ভুইফোড় মুসলিম লীগ নেতা পাকিস্তান সরকারের এই রাষ্ট্রভাষা নীতি সমর্থন করেন।
জাতীয় ঐক্যের জন্য একটি রাষ্ট্রভাষা থাকা ভালাে। কিন্তু উর্দুর পক্ষে পাকিস্তানি শাসকদের যুক্তিগুলাে ছিল ভিত্তিহীন ও আক্রমণাত্মক। ভারতে দশ কোটি মুসলমানের ভাষা উর্দু—এ দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। পাকিস্তানের মাত্র ৭% লােকের মাতৃভাষা ছিল উর্দু, অপরপক্ষে ৫৫% লােকের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। তাছাড়া উর্দুকে ইসলামী ভাষা বলারও কোনাে যৌক্তিকতা নেই। উর্দু মূলত একটি ভারতীয় ভাষা, যার প্রায় ৭৫% শব্দ সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষা থেকে আগত।১৫
পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রকে ধ্বংস করে নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন চিরস্থায়ী করা। তাদের রাষ্ট্রভাষা নীতি বাঙালিদের দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ করে। এর দ্বারা কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতান্ত্রিক অধিকার অস্বীকার করা হয়নি, এটা ছিল বাঙালিদের মাতৃভাষা ও দেশপ্রেমের প্রতি প্রত্যক্ষ আঘাত। তবে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি কেবল আবেগের প্রশ্ন ছিল না, বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থও এর সঙ্গে জড়িত ছিল। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হলে বাঙালিকে একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষার বােঝা কাঁধে নিতে হতাে, নতুবা তারা সরকারি চাকরি তথা প্রশাসনিক ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হতাে।
১৯৪৮-৫১ সময়কালে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি ছাত্র-বুদ্ধিজীবী ও ক্ষুদ্র রাজনীতিক গােষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৫২ সালে বিরােধীদল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, গণতান্ত্রিক যুব লীগ প্রভৃতি সংগঠনের সমবায়ে এটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার
৩৪
দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি গ্রহণ করে। ঐ দিন তৎকালীন পূর্ব-বাংলার নুরুল আমিন সরকার সকল প্রকার সমাবেশ ও শােভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। কিন্তু ছাত্ররা ঐ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঢাকার রাজপথে শােভাযাত্রা বের করে। ফলে পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ ঘটে এবং কয়েকজন ছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারবিরােধী প্রচণ্ড বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে জনসাধারণ ব্যাপক হারে অংশগ্রহণ করে। এক গণবিস্ফোরণমূলক পরিস্থিতিতে সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং উর্দুর পাশাপাশি বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা করা হলেও পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী বাংলা ভাষা পাকিস্তানি সংস্কৃতির উপযুক্ত বাহন হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। সুতরাং তারা বাংলা ভাষাকে ইসলামী করণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। একই ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারী পশ্চিম বাংলার বাঙালি ও পূর্ব-বাংলার বাঙালিদের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টিও সম্ভবত এই ইসলামীকরণ নীতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল। ইসলামীকরণের উদ্দেশে গৃহীত পদক্ষেপগুলাের মধ্যে ছিল বাংলা বর্ণমালার পরিবর্তে প্রথমে আরবি ও পরে রােমান বর্ণমালা প্রবর্তনের প্রস্তাব, বাংলা সাহিত্যে ইসলামী তথা আরবি, উর্দু, ফার্সি শব্দ ও বাকধারার ব্যাপক প্রচলন এবং পাকিস্তানি আদর্শ-বিরােধী’ রবীন্দ্র সঙ্গীত ও নাটক পরিবেশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ। কিন্তু পূর্ব-বাংলার প্রধান সাংস্কৃতিক ও ছাত্র-সংগঠনসমূহ এসব পদক্ষেপকে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র বলে মনে করে এবং তাদের তীব্র প্রতিরােধের মুখে সেগুলাে কার্যকর হতে পারেনি।
এভাবে ইসলামী ঐক্যের নামে পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে পূর্ব-বাংলার ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু তা কেবল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার ব্যবধানকে আরাে প্রশস্ত করে। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যেসব তরুণ জীবন উৎসর্গ করে তারা জাতীয় বীরের মর্যাদা লাভ করে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হতে থাকে। এই ভাষা-আন্দোলন সুপ্ত বাঙালি স্বাতন্ত্র্যবােধকে পুনর্জাগরিত করে এবং পাকিস্তানি শাসকদের পূর্ববাংলাকে শােষণ ও শাসনের নীতি বাঙালি জাতীয়তাবােধকে গভীরতর করে।
অর্থনৈতিক শােষণ : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান মূলত এক কৃষিনির্ভর অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ঐ সময় দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তর ছিল একই রূপ। যদিও পূর্ব-পাকিস্তানের মাথা পিছু আয় পশ্চিম-পাকিস্তানের তুলনায় সামান্য কম ছিল, জাতীয় আয়ের অধিকাংশ (প্রায় ৫২%) আসত পূর্ব-পাকিস্তান থেকে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে পশ্চিম-পাকিস্তানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার পূর্ব-পাকিস্তানের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দুই অঞ্চলের মধ্যে বিরাট অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়।
৩৫
১৯৪৯ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় ছিল ৩০৫ টাকা ও পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৩৩০ টাকা। ১৯৫৯-৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২৮৮ টাকা, অপর পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৭৩ টাকা।১৬ ১৯৬৪-৬৫ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য ছিল ৪৬%। পাকিস্তানের তৃতীয় পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম ঘােষিত লক্ষ্য ছিল দুই অঞ্চলের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য ২০% হ্রাস করা। কিন্তু বাস্তবে এই বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৬৯-৭০ সালে। ৬০ শতাংশে উপনীত হয়।১৭
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অন্যতম কারণ ছিল রাজস্ব ও উন্নয়ন উভয় খাতে পশ্চিম পাকিস্তানে অধিক ব্যয়-বরাদ্দ করা। ১৯৫১৫২ অর্থ বছর থেকে ১৯৬৯-৭০ পর্যন্ত এই ১৮ বছরে পাকিস্তানে মােট রাজস্ব ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৬৬৪৩ কোটি টাকা। তার মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানে ব্যয় হয় মাত্র ১৫০৭ কোটি টাকা এবং অবশিষ্ট ৫১৩৬ কোটি টাকা ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। উপযুক্ত সময়কালে পূর্ব-পাকিস্তানে উন্নয়ন খাতে (সরকারি ও বেসরকারি খাত একত্রে) মাত্র ২৯৯৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়, অপরপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয় ৬১৯৮ কোটি টাকা।১৮
যেহেতু, দেশের রাজধানী ও সামরিক স্থাপনা পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ছিল, সেহেতু পূর্ব-পাকিস্তান থেকে যে রাজস্ব আদায় হতাে তার একটা মােটা অংশ পশ্চিম-পাকিস্তানে ব্যয় করা হতাে। পূর্ব-পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রারও একটা মােটা অংশ পশ্চিম-পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়নে বিনিয়ােগ করা হতাে। এভাবে, ১৯৪৮-৪৯ সাল থেকে ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত বিশ বছরে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম-পাকিস্তানে প্রায় ৪১৯ কোটি টাকার সম্পদ পাচার করা হয়।১৯
তাছাড়া, বৈদেশিক সাহায্য বণ্টনে দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য ছিল প্রচুর। ১৯৫০ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান মােট ৫৬৮৩ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সাহায্য লাভ করে। তার মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় মাত্র ১৯৪১ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৩৪%।২০
পাকিস্তান সরকারের অর্থনৈতিক নীতির ফলে পশ্চিম-পাকিস্তান একটা শিল্পোন্নত অঞ্চল হিসেবে গড়ে ওঠে এবং পূর্ব-পাকিস্তান তার উপনিবেশ তথা রক্ষিত বাজারে পরিণত হয়। এমন কি পূর্ব-পাকিস্তানে অবস্থিত বেসরকারি শিল্পসমূহের ৪৩ শতাংশের মালিকানা চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে এবং ব্যাংক ও বীমা ব্যবসায় তাদের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাজনৈতিক আধিপত্য : ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ সাল (অক্টোবর) পর্যন্ত পাকিস্তানে এক ধরনের সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। সেই সময় পাকিস্তান গণপরিষদ কেন্দ্রীয় আইনসভা হিসেবে কাজ করত এবং মন্ত্রিসভা তার নিকট দায়ী ছিল। প্রথম দশকে পাকিস্তানে দু’টি গণপরিষদ তথা আইনসভা গঠিত হয়। প্রথম গণপরিষদে (১৯৪৭-১৯৫৪) সদস্য-সংখ্যা ছিল ৭৯। এই ৭৯ জনের মধ্যে পূর্ব
৩৬
পাকিস্তান থেকে ৪৪ জন এবং পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে ৩৫ জন সদস্য জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় গণপরিষদে (১৯৫৫-১৯৫৮) সদস্য-সংখ্যা ছিল ৮০। এর মধ্যে ৪০ জন পূর্ব-পাকিস্তান ও ৪০ জন পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হন। আইনসভায় পূর্ব-পাকিস্তানের এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা সংখ্যাসাম্য সত্ত্বেও পাকিস্তানের রাজনীতি ও প্রশাসনে পশ্চিম পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিদ্যমান ছিল।
১৯৪৭-৫৮ সালে পাকিস্তানে চারজন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন; তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন বাঙালি। ঐ সময়ে সাতজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ছিল তিন। সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা (১৯৫৬-৫৭) ছাড়া সকল মন্ত্রিসভায় অধিকাংশ ক্যাবিনেট মন্ত্রী ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি, এবং প্রতিরক্ষা, অর্থ, পররাষ্ট্র, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলাে কদাচিৎ বাঙালি মন্ত্রীদের হাতে অর্পণ করা হতাে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে বাঙালিদের দুরবস্থার অন্যতম কারণ ছিল এই যে, ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগের নেতৃত্ব ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। মােহম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের সভাপতি ও গভর্নর-জেনারেল হিসাবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন; কার্যত মন্ত্রিসভা ছিল তার অধীনস্থ উপদেষ্টা মাত্র। জিন্নাহর মৃত্যুর পর একজন পূর্ব-পাকিস্তানি (খাজা নাজিমুদ্দীন) পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। কিন্তু তখন প্রকৃত ক্ষমতা চলে যায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের হাতে। ১৯৫১ সালে নাজিমুদ্দীন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিন্তু ১৯৫৩ সালে পাঞ্জাবী গভর্নর-জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ অন্যায়ভাবে তাঁকে পদচ্যুত করেন। অপর একজন বাঙালি (মােহাম্মদ আলী). নাজিমুদ্দীনের স্থলাভিষিক্ত হন। কিন্তু তিনিও ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি চক্রের হাতে বন্দি। ১৯৫৪ সালে যখন তিনি গভর্নরজেনারেলের ক্ষমতা হ্রাসের উদ্দেশ্যে গণপরিষদে কতিপয় বিল পাসের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তখন গােলাম মােহম্মদ গণপরিষদ ভেঙে দেন। ১৯৫৫ সালে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠিত হয় এবং সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব-পাকিস্তানের ওপর সংখ্যাসাম্য চাপিয়ে দেয়া হয়। ১৯৫৬-৫৭ সালে সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা পূর্ব-পাকিস্তানের স্বার্থে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেন, কিন্তু তাকেও পদচ্যুত করা হয়। এভাবে বাঙালিদের দুর্বলতা অথবা পশ্চিম-পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রের কারণে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বাঙালিরা কোনাে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
প্রাদেশিক পর্যায়েও বাঙালিদের অবস্থা ভিন্নতর ছিল না। প্রাদেশিক সরকারের প্রধান ছিলেন গভর্নর। তিনি গর্ভনর-জেনারেল কর্তৃক মনােনীত হতেন, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ও প্রশাসনের ওপর তাঁর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছিল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব-পাকিস্তানে চারজন গভর্নর শাসন করেন এবং তাদের মাত্র একজন ছিলেন বাঙালি।
কেন্দ্রীয় সরকার আমলাতন্ত্রের মাধ্যমেও পূর্ব-পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতাে। উচ্চ পর্যায়ের আমলাদের প্রায় সবাই ছিলেন অবাঙালি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে
৩৭
আগত মােট ৯৫ জন আই. সি. এস ও আই.পি. এস অফিসারের মধ্যে মাত্র। একজন ছিলেন বাঙালি। সুতরাং প্রথম দশকে কেন্দ্রীয় ও পূর্ব-পাকিস্তান সচিবালয়ে সকল ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পশ্চিম-পাকিস্তানিরা অধিষ্ঠিত ছিলেন। এক হিসাব অনুসারে, ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে মােট ১৯৩ জন সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের মধ্যে মাত্র ১৩ জন ছিলেন বাঙালি এবং এই ১৩ জনের কেউ সচিব পদে ছিলেন না। ঐ সময়ে পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্য সচিব পদেও কোনাে বাঙালি ছিলেন না।২১
১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ (মে মাস) পর্যন্ত পাকিস্তানে পূর্ণ সামরিক শাসন বলবৎ ছিল। ঐ সময় সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল সেনাবাহিনী প্রধান আইউব খান ও সামরিক আমলাদের হাতে যাদের সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। ১৯৬২ সালের জুন মাসে আইউব খান সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নতুন সংবিধান প্রবর্তন করেন। কিন্তু আইউবের শাসনব্যবস্থা ছিল কার্যত এক সাংবিধানিক একনায়কত্ব। এই ব্যবস্থার অধীনে প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল রাষ্ট্রপতির হাতে। তিনি তাঁর মনােনীত উপদেষ্টাদের সাহায্যে শাসন পরিচালনা করতেন, এবং রাষ্ট্রপতি আইউবের শীর্ষস্থানীয় উপদেষ্টারা সবাই ছিলেন অবাঙালি। আর আইউব শাসন আমলে যেসব বাঙালি পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতেন তাদের প্রায় সবাই ছিলেন জনসমর্থহীন তােষামদকারী। আইউবের অধীনে ১৬ জন বাঙালি কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিত্ব করেন। তাদের মধ্যে চারজন ছিলেন প্রাক্তন আমলা ও একজন সাংবাদিক। বাকী ১১ জন ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা, যাদের মধ্যে আটজনই ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হন। আইউবের শাসনামলে পূর্বপাকিস্তানে চারজন গভর্নর কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন বাঙালি। এই দুজনের মধ্যে একজন ছিলেন প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা এবং অপরজন ছিলেন প্রত্যাখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা।২২
আইউব আমলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অবর্তমানে নীতি নির্ধারণ ও প্রশাসনে সামরিক ও বেসামরিক আমলারা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এই আমলা বাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। ১৯৬৪ সালে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে মােট ১৭ জন সচিবের মধ্যে মাত্র দু’জন ছিলেন বাঙালি। সচিবালয়ে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের মধ্যে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল ২৫ শতাংশেরও কম। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে মােট ৮০১ জন প্রথম শ্রেণির কর্মচারি ছিলেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৭০ জন ছিলেন বাঙালি।২৩
কেন্দ্রীয় চাকরিতে সার্বিকভাবে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৪% (দেখুন সারণি ২.১)।
সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল আরাে কম। ১৯৬৫ সালে জেনারেল, লে জেনারেল ও মেজর-জেনারেল পর্যায়ের উচ্চ পদস্থ মােট ১৭ জন। সামরিক অফিসারের মধ্যে মাত্র একজন মেজর-জেনারেল ছিলেন বাঙালি।২৪
৩৮
সারণি ২.১
পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকরিতে আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব
(১লা জানুয়ারি, ১৯৬৫)
পূর্ব-পাকিস্তান | পশ্চিম-পাকিস্তান | |||
সংখ্যা | শতাংশ | সংখ্যা | শতাংশ | |
গেজেটেড কর্মচারী | ১৩৩৮ | ২৬.৫ | ৩৭০৮ | ৭৩.৫ |
নন-গেজেটেড কর্মচারী | ২৬৩১০ | ২৪.১ | ৮২৯৪৪ | ৭৫.৯ |
সর্বমােট | ২৭৬৪৮ | ২৪.২ | ৮৬৬৫২ | ৭৫.৮ |
উৎস: Natoinal Assembly of Pakistan, Debates, খণ্ড ২, সংখ্যা ২১ (২৩ শে জুন, ১৯৬৬), পৃষ্ঠা ১৩২৯।
১৯৬৩ সালে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীতে বাঙালি অফিসারদের সংখ্যা ছিল যথাক্রম ৫%, ১০%, ও ১৬%।২৫
ষাট দশকে সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালি জোয়ানদের সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও তা কোনােদিনই গড়ে ১০ শতাংশের বেশি ছিল না। এক হিসাব মতে, ১৯৭১ সালের প্রথমদিকে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে মােট ৩,৯২,০০০ জন সদস্যের মধ্যে। বাঙালিদের সংখ্যা ছিল ৩৮,০০০ মাত্র।২৬
তাছাড়া, পরিকল্পনা কমিশন ও পাবলিক কর্পোরেশন সমূহের প্রধানগণ প্রায় সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। এভাবে প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাঙালিদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই সীমিত। এর ফলে কেবল পূর্ব-পাকিস্তানের স্বার্থই ব্যাহত হয়নি, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের মধ্যে তিক্ততাও সৃষ্টি হয়।
৩. পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্ত শাসন আন্দোলন
আমরা দেখেছি, সরকারের রাষ্ট্রভাষা ও সাংস্কৃতিক নীতি পূর্ব-বাংলার জনগণকে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করে এবং তাদের মধ্যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবােধকে পুনর্জাগরিত করে। ফলে পঞ্চাশ দশকের প্রথমার্ধে মুসলিম লীগ-বিরােধী রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনসমূহ দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। ১৯৫৪ সালে মার্চ মাসে পূর্ব-বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, কৃষক প্রজা পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও নেজাম-ই-ইসলামী এই চারটি বিরােধী দল সমন্বয়ে গঠিত “যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ২১-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা কর্মসূচিতে পূর্ব-বাংলার কৃষি, শিল্প ও শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের আর্থ-সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করার যেমন আশ্বাস ছিল, তেমনি ছিল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি। সর্বোপরি ছিল বাঙালিদের স্বাতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি। এতে পূর্ব-বাংলার জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হয় এবং সামরিক ক্ষেত্রে পূর্ব
৩৯
বাংলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়। এতে বলা হয় যে, কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে রেখে অবশিষ্ট সকল ক্ষমতা পূর্ববাংলার হাতে ছেড়ে দিতে হবে। ২১-দফার মধ্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে “শহীদ দিবস ঘােষণা ও ভাষা-আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে, একুশে ফেব্রুয়ারির সম্মানেই এই কর্মসূচি ২১ দফায় গণ্ডীবদ্ধ করা হয় (২১ দফা কর্মসূচির পূর্ণ বিবরণের জন্য দেখুন পরিশিষ্ট-ক)।
অপরদিকে, ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ যুক্ত ফ্রন্টের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদ বলে আখ্যায়িত করে এবং ইসলাম ধর্মকে প্রধান ইস্যুতে পরিণত করে। মুসলিম লীগের নির্বাচনী প্রচারের মূল সূর ছিল নিম্নরূপ :
একমাত্র মুসলিম লীগ ইসলাম ও পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারে। মুসলিম লীগ পরাজিত হলে পাকিস্তান এবং মুসলমানেরা ধ্বংস হয়ে যাবে। পাকিস্তান একটি ইসলামী রাষ্ট্র হবে কি না তা নির্ধারিত হবে এই নির্বাচনের মাধ্যমে। কারণ একপক্ষে রয়েছে মুসলিম লীগ, আর অন্যপক্ষে রয়েছে এমন সব দল যারা ইসলামী রাষ্ট্র চায় না। পূর্ব-বাংলা পাকিস্তানের অংশ থাকবে, না ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে তাও নির্ধারণ করবে এই নির্বাচন। কারণ, যুক্তফ্রন্ট পূর্ব-বাংলাকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিতে চায়।২৭
বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য আসন সংরক্ষণসহ পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩০০ সাধারণ বিশিষ্ট আইন পরিষদে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ২২৮টি আসনের মধ্যে ২০৬টি লাভ করে যুক্তফ্রন্ট এবং মুসলিম লীগ পায় মাত্র ন’টি আসন। অবশিষ্ট একটি আসন পায় খেলাফত রব্বানী পার্টি ও ১২টি পান নির্দলীয় প্রার্থীগণ।
অমুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত ৭২টি আসনের মধ্যেও যুক্তফ্রন্ট ১৩টি আসন লাভ করে। অবশিষ্টগুলাের মধ্যে কংগ্রেস দল পায় ২৪টি, তফসিল ফেডারেশন ২৭টি, খ্রিস্টান একটি, বৌদ্ধ দুটি, কম্যুনিস্ট পার্টি চারটি ও নির্দলীয় প্রার্থী একটি।
১৯৫৪ সালের ২রা এপ্রিল কৃষক প্রজা পার্টির নেতা শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কিন্তু দেড় মাস যেতে না যেতেই মুসলিম লীগ চালিত কেন্দ্রীয় সরকার আইন-শৃঙ্খলার অজুহাতে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তের ফলে পরবর্তী সময়ে যুক্তফ্রন্টও ভেঙে যায়। তবে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, পূর্ব-বাংলার জনগণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসনের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ এবং তাদের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটা প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব-বাংলার জনগণ তাদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন; শুধু ধর্মের নামে তাদেরকে প্রতারিত করা যায় না। ভাষা-আন্দোলনের
৪০
মাধ্যমে যে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সূত্রপাত ঘটে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর তা আরাে জোরদার হয়। তৎকালীন বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৫ সালে তার নাম থেকে মুসলিম” শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক রূপ লাভ করে এবং পরে পাকিস্তানে যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে দ্বিজাতি তত্ত্বের মূলে কুঠারাঘাত করে।
ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম গণপরিষদ ভেঙে দেয়া হয়। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে দ্বিতীয় গণপরিষদ নির্বাচিত হয়। ইতিমধ্যে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। দ্বিতীয় গণপরিষদে পূর্ব-বাংলার জন্য নির্ধারিত ৪০টি আসনের মধ্যে শের-ই-বাংলার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ১৬টি, আওয়ামী লীগ ১৩টি, কংগ্রেস চারটি, তফসিল ফেডারেশন তিনটি, ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি দুটি, মুসলিম লীগ একটি এবং নির্দলীয় প্রার্থী একটি আসন লাভ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০টি আসনের মধ্যে ৩৫টি লাভ করে মুসলিম লীগ। উল্লেখ্য যে, গণপরিষদ সদস্যরা প্রাদেশিক পরিষদসমূহের সদস্যগণ কর্তৃক পরােক্ষ পদ্ধতিতে নির্বাচিত হন।
১৯৫৫ সালের ৭ জুলাই পশ্চিম পাকিস্তানের মারীতে দ্বিতীয় গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। ঐ সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক কাঠামাে সম্পর্কে এক চুক্তিতে পৌছেন। এই চুক্তির পাঁচটি শর্ত ছিল নিম্নরূপ:
১. পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশকে একত্রিত করে একটি প্রদেশ গঠন;
২. প্রদেশসমূহকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসন প্রদান;
৩. সকল ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের মধ্যে সংখ্যাসাম্য প্রবর্তন;
৪. যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন;
৫. বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান।
১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে চৌধুরী মােহম্মদ আলীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ও শের-ই-বাংলার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এই সরকারের তত্ত্বাবধানে ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ কর্তৃক পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়।
১৯৫৬ সালের সাংবিধানে পূর্ব-বাংলার আশা-আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেনি। যদিও এই সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থা ছিল, এতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়নি। মারী চুক্তিতে প্রতিশ্রুত সকল ক্ষেত্রে সংখ্যাসাম্য ও যুক্ত নির্বাচনের ব্যবস্থাও এতে ছিল না। তবুও আওয়ামী লীগসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাে ১৯৫৬ সালের সংবিধান মেনে নেয়। কিন্তু যখন নতুন সংবিধানের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়ােজন চলছিল তখন আইউব খান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সংবিধান বাতিল করে দেন। প্রায় চার বছর যাবৎ অবারিত ক্ষমতা প্রয়ােগের পর ১৯৬২ সালের জুন মাসে
৪১
আইউব খান তাঁর মর্জি মাফিক এক সংবিধান প্রবর্তন করেন। এই সংবিধানের অধীনে সকল ক্ষমতা এক ব্যক্তি তথা রাষ্ট্রপতির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। রাষ্ট্রপতি ও আইনসভা সরাসরি ভােটে নির্বাচিত না হয়ে পরােক্ষভাবে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর ভােটে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে স্বায়ত্তশাসনের যেটুকু প্রতিশ্রুতি ছিল তাও কেড়ে নেয়া হয়। একই সাথে আইউবের শাসনামলে আঞ্চলিক বৈষম্য দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৬-দফা কর্মসূচি
যখন পশ্চিম-পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের রাজনৈতিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক শােষণের ফলে বাঙালিরা ক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্ত, তখন ১৯৬৫ সালের পাকভারত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ পূর্ব-বাংলার মানুষের মধ্যে গভীর নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করে। ভৌগােলিক কারণে পূর্ব-বাংলার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তােলা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে প্রায় সকল সামরিক স্থাপনা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাকিস্তানি শাসকদের যুক্তি ছিল, পূর্ব-পাকিস্তানের রক্ষাব্যবস্থা পশ্চিম-পাকিস্তানেই নিহিত রয়েছে। কিন্তু ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ এই যুক্তির অসারতা প্রমাণ করে। ঐ যুদ্ধের সময় পূর্ব-পাকিস্তান পশ্চিম-পাকিস্তান তথা সারা বিশ্ব থেকে। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং প্রতিরক্ষাহীন হয়ে পড়ে। এক হাজার মাইল দূরে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সরকার যে পূর্ব-পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারে না তা সুস্পষ্ট হয়ে যায়। শেখ মুজিবের ভাষায়, “১৭ দিনের যুদ্ধ প্রমাণ করে যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানরা বিপদের সময় আমাদের পাশে দাঁড়াতে পারেন না। আমরা চাই না যে, শত্রু আমাদের গিলে ফেলুক”।”২৯
এমতাবস্থায় মুজিব পূর্ব-পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি সম্বলিত ৬-দফা কর্মসূচি ঘােষণা করেন। এই কর্মসূচির দাবিগুলাে ছিল নিম্নরূপ :
১. পাকিস্তানকে সত্যিকার যুক্তরাষ্ট্ররূপে গড়তে হবে এবং সেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করতে হবে।
২. কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকবে। অবশিষ্ট সকল বিষয় প্রদেশের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
৩. (ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যােগ্য মুদ্রার প্রচলন করতে হবে এবং দুই অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র ‘স্টেট ব্যাংক’ থাকবে। অথবা,
(খ) দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে কিন্তু সংবিধানে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকবে যাতে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে মুদ্রা পশ্চিম-পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে।
৪. সকল প্রকার কর ও খাজনা ধার্য ও আদায় করার ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। আঞ্চলিক সরকারের আদায়যােগ্য অর্থের
৪২
একটি নির্ধারিত অংশ বাধ্যতামূলকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিলে জমা দিতে হবে।
৫. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সরকারগুলাে স্বাধীন হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে অথবা সংবিধানে নির্ধারিত হারে আদায় করা হবে।
৬. পূর্ব-পাকিস্তানের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণাধীনে ‘মিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে।
৬-দফার মূল কথা ছিল, পূর্ব-পাকিস্তান কেবল একটি প্রদেশ নয়। ভৌগােলিক কারণে পূর্ব-পাকিস্তানকে একটি আঞ্চলিক রাজ্য (State) হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং তা পরিচালনার দায়িত্ব আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। অর্থাৎ ৬দফা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক শােষণ ও রাজনৈতিক আধিপত্য থেকে বাঙালিদের মুক্তির দাবি…একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে আমাদের বাঁচার দাবি”। সুতরাং ৬-দফা কর্মসূচি ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। কিন্তু আইউব খান ৬-দফা কর্মসূচিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী চক্রান্ত বলে আখ্যায়িত করেন এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে দমন করার জন্য বিভিন্ন নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমে রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপের অভিযাগে শেখ মুজিবসহ শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। এই সব নেতার মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন। তারিখে হরতালের ডাক দেয়। সরকার কর্তৃক আরােপিত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঐ দিন ঢাকায় ছাত্র-শ্রমিক জনতার অসংখ্য মিছিল বের হয় এবং পুলিশের গুলিতে অন্তত ১১ ব্যক্তি নিহত ও বহু লােক আহত হয়। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন সমর্থন করার কারণে দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রকাশনা বন্ধ ও তার সম্পাদক তােফাজ্জল হােসেনকে (মানিক মিয়া) কারারুদ্ধ করা হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা : স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে চিরতরে নস্যাৎ করার জন্য পাকিস্তানি শাসকরা ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র। মামলা নামে এক মামলা দায়ের করে। এই মামলার প্রধান আসামি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যান্য আসামির মধ্যে ছিলেন তিনজন বাঙালি আমলা, ২৪ জন বাঙালি সামরিক অফিসার ও কতিপয় রাজনীতিক। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল যে, তারা ভারতের সাহায্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেন।৩০
এই মামলার মূল লক্ষ্য ছিল স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলনকারীদের ভীতি প্রদর্শন ও আন্দোলনের নায়ক মুজিব ও তার দলকে রাষ্ট্রদ্রোহী প্রমাণ করে রাজনীতি থেকে উৎখাত করা। পাকিস্তানি শাসকরা ভেবেছিল যে, দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা শুনলেই জনগণ ষড়যন্ত্রকারীদের খতম করে দেবে।৩১
কিন্তু বাস্তবে ফল হয় বিপরীত।
৪৩
১৯৬৮ সালের জুন মাসে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে পশ্চিম-পাকিস্তানি বিচারক নিয়ে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলার শুনানী শুরু হয়। শুনানীকালে আসামিরা তাঁদের ওপর অকথ্য অত্যাচার এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনে বাঙালিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের করুণ বিবরণ প্রদান করেন। বাংলাদেশের মানুষ এই সব বিবরণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে বাঙালির বিরুদ্ধে আইউব খানের ষড়যন্ত্র বলেই বিবেচনা করে। ফলে বাঙালি মনে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের প্রতি অবিশ্বাস ও ঘৃণার ভাব তীব্রতর হয়। শেখ মুজিবের প্রতি বাঙালিদের সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি জাতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনের প্রবল চাপের মুখে আইউব সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং মুজিবসহ সকল আসামিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন ও ১১-দফা কর্মসূচি : বাঙালির বিরুদ্ধে। আইউবের নিপীড়ন ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলে জনগণ যখন বিক্ষুব্ধ, তখন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান ছাত্র সংগঠনসমূহ (পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একাংশ) “ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ” (Students Action Committee) নামে এক আইউব-বিরােধী জোট গঠন করে।
১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি আইউব-বিরােধী আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে সংগ্রাম পরিষদ একটি ১১-দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই ১১-দফার প্রধান দাবিগুলাে ছিল নিম্নরূপ:
১. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও কম খরচে শিক্ষার ব্যবস্থা;
২. সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন;
৩. ১৯৬৬ সালের ৬-দফা ভিত্তিক পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান;
৪. পশ্চিম-পাকিস্তানে এক-ইউনিট বাতিল করে সকল প্রদেশকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান;
৫. ব্যাংক, বীমা ও বৃহৎ শিল্পসমূহ জাতীয়করণ;
৬. কৃষকদের ওপর থেকে খাজনা ও করের বােঝা হ্রাস;
৭. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও বােনাস প্রদান এবং শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা;
৮. পূর্ব-পাকিস্তানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলসম্পদের সদ্ব্যবহার;
৯. নিরাপত্তা আইনসহ সকল নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার;
১০. ‘সেন্টো’ ‘সিয়াটো’ সহ সকল সামরিক চুক্তি বাতিল এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ;
১১. সকল রাজবন্দির মুক্তিদান ও আগরতলা মামলাসহ সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ।
৪৪
এদিকে ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ (মস্কোপন্থী), মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), জামায়াত-ই-ইসলামী, নেজামই-ইসলাম, জামিয়াত-ই-উলামা-ই-ইসলাম ও ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টসহ পূর্ব পাকিস্তানের আটটি প্রধান বিরােধীদল ৮-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে “গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ” (Democratic Action Committee) নামে একটি জোট গঠন করে। এই ৮-দফা কর্মসূচির মধ্যে ছিল; যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা, সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা এবং সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দান।
দেখা যাচ্ছে যে, ছাত্রদের ১১-দফা কর্মসূচি আওয়ামী লীগের ৬-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায় এবং কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে কিছু সমাজতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলাের ৮-দফা কর্মসূচি কেবল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তার অর্থ হলাে এই যে, বিরােধী দলগুলাে আইউব ও তাঁর শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছিল, কিন্তু তারা স্বায়ত্তশাসনের পরিমাণ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মতাে মৌলিক প্রশ্নে একমত ছিল ।
যাহােক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত আইউব-বিরােধী আন্দোলন শীঘ্রই এক সহিংস গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। এবং তাতে ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষক, পেশাজীবীসহ সকল শ্রেণীর মানুষ অংশগ্রহণ করে। হরতাল, মিছিল, বিক্ষোভ, কার্ফ, গুলি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়। ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাসহ বহু নাম-না-জানা ছাত্র ও কর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আগরতলা মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে বন্দি দশায় হত্যা করা হয়। কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা যত বাড়তে থাকে, ছাত্র-জনতার জঙ্গী মনােভাব তত দৃঢ়তর হয়। এভাবে দেশে যখন এক ভয়াবহ অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন আইউব খান জনশক্তির নিকট নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। ১৯৬৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আইউব খান দৈনিক ইত্তেফাক সংবাদ পত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন এবং সাংবিধানিক সংস্কার সম্পর্কে আলােচনার জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের ‘গােল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ তথা মুজিবকে বাদ দিয়ে গােল টেবিল বৈঠক অর্থহীন ছিল। এবং মুজিব বন্দি অবস্থায় কোনাে বৈঠকে যােগদান করতে অস্বীকার করেন। ফলে সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও মুজিবসহ সকল আসামিকে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে সদ্যমুক্ত শেখমুজিব ও আগরতলা
৪৫
মামলার অন্যান্য আসামিকে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে) এক বিরাট গণসম্বর্ধনা দেয়া হয়। এই সম্বর্ধনা সভায় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” আখ্যায় ভূষিত করেন। মুজিব তাঁর ৬-দফার সঙ্গে ১১-দফাকেও গণদাবি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সেগুলাে আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সংখ্যাসাম্যের পরিবর্তে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বরও দাবি করেন।
১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ও ১০-১৩ মার্চ তারিখে রাওয়ালপিন্ডিতে গােল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল এই বৈঠকে যােগদান করে। বৈঠকে যােগদানকারী পূর্ব-পাকিস্তানের অন্যান্য নেতার মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ (ন্যাপ), নুরুল আমিন। (এন.ডি.এফ), হামিদুল হক চৌধুরী, মাহমুদ আলী, ফরিদ আহমদ ও বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদ। উল্লেখ্য যে, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ (চীনপন্থী) গােল টেবিল বৈঠকে যােগদানে অস্বীকৃতি জানায়।
গােল টেবিল বৈঠকে আইউব খান দুটি সর্বসম্মত দাবি মেনে নেন। এগুলাে হলাে প্রাপ্ত বয়স্কদের সর্বজনীন ভােটাধিকার ভিত্তিক প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও সংসদীয় সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন। কিন্তু ৬-দফা কর্মসূচির প্রশ্নে বিরােধী দলগুলাের মধ্যে মতানৈক্যের সুযােগে আইউব খান আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে আওয়ামী লীগ “গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ” ত্যাগ করে এবং ৬দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এদিকে মওলানা ভাসানীও প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেন এবং তার অনুসারীরা ঘেরাও, জ্বালাও, পােড়াও কর্মসূচি গ্রহণ করে। ফলে সাধারণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দারুণ অবনতি ঘটে। এমতাবস্থায়, আইউব খান তদানীন্তন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে বিদায় নেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচন : জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করেন এবং ১৯৬২ সালের সংবিধান বাতিল করে দেন। তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন- (১) পশ্চিম-পাকিস্তানে এক ইউনিট ভেঙে দিয়ে পূর্বতন চারটি প্রদেশের পুনরুজ্জীবন এবং (২) জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রদেশসমূহকে প্রতিনিধিত্ব প্রদান। তদনুসারে ১৯৭০ সালের ৩০মার্চ তিনি এক আইনগত কাঠামাে আদেশ (Legal Framework Order) জারি করেন। এতে পাকিস্তানের জন্য একটি ৩১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এই ৩১৩ জন সদস্যের মধ্যে ৩০০ জন প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত হতেন এবং বাকি ১৩টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল, যারা নির্বাচিত ৩০০ জন সদস্যের দ্বারা মনােনীত হতেন। আসনসমূহের আঞ্চলিক বণ্টন ছিল নিম্নরূপ :
৪৬
প্রদেশ | সাধারণ আসন | মহিলা আসন | মোট |
পূর্ব-পাকিস্তান | ১৬২ | ৭ | ১৬৯ |
পশ্চিম পাঞ্জাব | ৮২ | ৩ | ৮৫ |
সিন্ধু | ২৭ | ১ | ২৮ |
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ | ২৫ | ১ | ২৬ |
বেলুচিস্তান | ৪ | ১ | ৫ |
মােট | ৩০০ | ১৩ | ৩১৩ |
আইনগত কাঠামাে আদেশে প্রত্যেক প্রদেশের জন্য একটি প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থাও করা হয়। পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সাধারণ আসন সংখ্যা ছিল ৩০০টি।
আইনগত কাঠামাে আদেশের অধীনে ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদসমূহের জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে পূর্ব-পাকিস্তানের কয়েকটি এলাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি তারিখে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি জাতীয় পরিষদ গঠন করা। জাতীয় পরিষদ ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করবে এবং সংবিধান প্রণয়নের পর জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহ যথাক্রমে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা রূপে কাজ করবে। সুতরাং সাংবিধানিক প্রশ্নটিই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রদান ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। আমরা দেখেছি, পাকিস্তানে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে এটা সাধারণ ঐকমত্য গড়ে ওঠে। প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে যে বিতর্ক ছিল ইয়াহিয়া খান তারও মীমাংসা করে ফেলেন। তবে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়।
আওয়ামী লীগ ৬-দফা ও ১১-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে তার নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন করে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে “গণভােট” বলে ঘােষণা করে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের জনগণকে শােষণের জন্য পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকবৃন্দ ও তাদের বাঙালি দোসরদের তীব্র সমালােচনা করেন। মস্কোপন্থী ন্যাপ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে ঘােষণা করে এবং ৬-দফা ও ১১ দফা কর্মসূচির প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জ্ঞাপন করে। ভাসানী ন্যাপ লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বললেও এ সম্পর্কে কোনাে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি। আসলে এই দল নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি সামনে আনতে প্রস্তুত ছিল না। মওলানা ভাসানী বলেন, সমাজতন্ত্রই মুক্তির একমাত্র পথ; সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নই উঠবে না। তিনি ৬-দফা কর্মসূচিকে সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত বলে অভিহিত
৪৭
করেন এবং বলেন যে, এতে শ্রমিক, কৃষক ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর জনগণের জন্য শােষণমুক্তির কোনাে ব্যবস্থা নাই।৩২
মুসলিম লীগ, জামায়াত-ই-ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলাম, জমিয়াত-ইউলামা-ই-ইসলাম, প্রভৃতি ইসলামী ডানপন্থীদল-উপদল বাঙালিদের অধিক হারে চাকরি প্রদান এবং পূর্ব-পাকিস্তানে অধিকতর বিনিয়ােগ ও রাজস্ব ব্যয়ের দাবি জানালেও তারা ৬-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের ঘাের বিরােধী ছিল। তাদের কেউ কেউ ৬-দফা কর্মসূচিকে বিচ্ছিন্নতাবাদ বলে সমালােচনা করে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রশ্নে গণভােট বলে ঘােষণা করে।৩৩
আসলে এই সব দল পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর ‘শক্তিশালী কেন্দ্র তত্ত্বের সমর্থক ছিল এবং প্রকারান্তরে তারা ১৯৫৬ সালের সংবিধান পুনঃ প্রবর্তনের পক্ষেই মত প্রদান করে।৩৪
১৯৭০ সালের নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় । ঐ নির্বাচনে পূর্ব-পাকিস্তানে তালিকাভুক্ত ভােটার সংখ্যা ছিল ৩,১২,১১,২২০ এবং প্রদত্ত ভােটের হার ছিল ৫৫.০৯%।৩৫
পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচির পক্ষে নিরঙ্কুশ রায় প্রদান করে। আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ভােটের ৭৫% এবং পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি লাভ করে। অবশিষ্ট দুটি আসনের মধ্যে একটি লাভ করেন পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টির নুরুল আমিন এবং অপরটি পান পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় (নির্দলীয়) (দেখুন সারণী ২.২)। পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদেও আওয়ামী লীগ ৭০% ভােট, এবং ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮ টি লাভ করে বিপুলভাবে জয়ী হয়। অবশিষ্ট ১২টি আসনের মধ্যে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি দুটি, মস্কোপন্থী ন্যাপ একটি, জামায়াত-ইইসলামী একটি এবং নির্দলীয় প্রার্থীগণ পান আটটি আসন।৩৬
পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত সাতটি মহিলা আসনের সবকটি লাভ করে আওয়ামী লীগ। ফলে ৩১৩-সদস্য বিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে মােট ১৬৭টি আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৩৮ সাধারণ আসনের মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৮৩টি, মস্কোপন্থী ন্যাপ ছয়টি, মুসলিম লীগ (কাইউম) দুটি, মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), সাতটি, মুসলিম লীগ (কনভেনশন) দুটি জামায়াত-ইইসলামী চারটি, জামিয়াত-ই-উলামা-ই-পাকিস্তান সাতটি, জমিয়াত-ই-উলামা-ইইসলাম সাতটি ও নির্দলীয় প্রার্থীগণ ১৩টি আসন আসন লাভ করে। সংরক্ষিত ছয়টি মহিলা আসনের মধ্যে পাকিস্তান পিপলস পার্টি পায় পাঁচটি আসন এবং একটি আসন পায় মস্কোপন্থী ন্যাপ ।
১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল সর্বজনীন প্রত্যক্ষ ভােটের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় নির্বাচন এবং এই নির্বাচন ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে পাকিস্তানের অসারতা প্রমাণ করে। পূর্ব-পাকিস্তানের ১৬২টি সাধারণ আসনের মধ্যে
৪৮
সারণী ২.২
১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নির্বাচনের ফল (পূর্ব-পাকিস্তানে দলীয় অবস্থান)
দল | প্রাপ্ত ভােটের শতকরা হার | প্রার্থী সংখ্যা | প্রাপ্ত আসন সংখ্যা | |
আওয়ামী লীগ | ৭৫.১১ | ৭.১৭ | ১৬২ | ১৬০ |
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কোপন্থী) | ২.০৬ | ৩৯ | — | |
পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি | ২.৮১ | ৭৮ | ১ | |
মুসলিম লীগ (কনভেনশন) | ২.৮১ | ৯৩ | — | |
মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) | ১.৬০ | ৫০ | — | |
মুসলিম লীগ (কাইউম) | ১.০৭ | ৬৫ | — | |
জামায়াত-ই-ইসলামী | ৬.০৭ | ৭১ | — | |
জামিয়াত ও নেজাম-ই-ইসলাম | ০.৯২ | ১৫ | — | |
জামিয়াত ও নেজাম-ই-ইসলাম | ২.৮৩ | ৪৯ | — | |
অন্যান্য দল | ১.২৫ | ৪৬ | — | |
নির্দলীয় প্রার্থী | ৩.৪৭ | ১১৩ | ১ | |
মোট | ১০০ | ৭৮১ | ১৬২ |
* অন্যান্য দলের মধ্যে ছিল ন্যাপ (ভাসানী), পাকিস্তান জাতীয় লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, গণমুক্তি দল, পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস ও ইসলামী গণতন্ত্রী দল।
উৎস : পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন, Report on General Election, Pakistan (1970-71), খণ্ড ১, ১৯৭২।
১৬০টি লাভ করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মাত্র আটজন এবং তাঁরা সবাই শােচনীয়ভাবে পরাজিত হন। অপরদিকে ভুট্টোর পিপলস পার্টি জাতীয় পরিষদে ৮৩ টি আসন লাভ করে এবং এই ৮৩টি আসনই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে জাতীয় পরিষদে পিপলস পার্টির কোনাে প্রার্থীই ছিল না। প্রকৃত পক্ষে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টি উভয়ই ছিল আঞ্চলিক দল তারা যথাক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করত এবং আদর্শ ও কর্মসূচির দিক দিয়ে ছিল পরস্পর বিরােধী। সুতরাং দুই অঞ্চলে দুই দলের বিজয় পাকিস্তানের অন্তর্নিহিত দুর্বলতাকে প্রকট করে তােলে। মুসলিম লীগ, জামায়াত-ই-ইসলামী, জমিয়াত-ই-উলামা-ই-ইসলাম প্রভৃতি পাকিস্তান ভিত্তিক দল যারা শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে ওকালতি করত বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করে কার্যত পাকিস্তানের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করে বসে।
৪৯
৪. স্বাধীনতা ঘােষণা
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফল পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর নিকট গ্রহণযােগ্য ছিল না। তারা ভাবতেই পারেনি যে, আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে। একটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আওয়ামী লীগের বিজয় কেবল তাদের ক্ষমতার মসনদ থেকেই বিতাড়িত করবে না, ৬-দফা ভিত্তিক সংবিধান গৃহীত হলে তাদের ভবিষ্যৎ শােষণের পথও রুদ্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং তারা আওয়ামী লীগ তথা বাঙালির এই বিজয়কে নস্যাৎ করার জন্য যাবতীয় পন্থা অবলম্বন করে। প্রথমে তারা নব নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না করে সংসদের বাইরে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে ৬-দফা দাবির প্রশ্নে কিছু ছাড় লাভের চেষ্টা করে। সে। উদ্দেশে ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঢাকায় শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলেও অভিহিত করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের জন্য চাপ দিতে থাকে এবং অভিমত ব্যক্ত করে যে, ৬-দফা ও ১১-দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচিত হবে, তবে পরিষদের ভিতরে-বাইরে অন্যান্য দলের সঙ্গে আলােচনা চলতে পারে।
১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করেন যে, ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। অপরদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ ৬ দফা কর্মসূচি রদবদল না করলে তার পিপলস পার্টি ৩ মার্চের অধিবেশনে যােগ দেবে না। তিনি ঢাকায় আহুত প্রস্তাবিত পরিষদকে কসাইখানা বলে অভিহিত করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের তাতে যােগদান না করার জন্য হুশিয়ার করে দেন। ভুট্টোর হুমকি সত্ত্বেও পিপলস পার্টি ও কাইয়ুম মুসলিম লীগ ছাড়া অন্যান্য দলের সদস্যগণ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দিতে প্রস্তুত ছিলেন এবং তাদের কেউ কেউ ঢাকায় এসে পৌঁছেন। এমন সময় ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ তারিখে জাতীয় পরিষদের প্রস্তাবিত অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করেন। এ থেকে অনেকে ধারণা করে যে, প্রস্তাবিত অধিবেশন বানচাল করার লক্ষ্যে ইয়াহিয়া খান। পরিকল্পিতভাবে ভুট্টোকে দিয়ে এক উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন।
সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ দলের সঙ্গে কোনােরূপ পরামর্শ না করে আকস্মিকভাবে অধিবেশন স্থগিত ঘােষণাকে বাংলাদেশের জনগণ এক গভীর। ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে সমগ্র বাংলাদেশ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-শ্রমিক-ব্যবসায়ী সকল স্তরের মানুষ রাজপথে নেমে আসে। “তােমার দেশ আমার দেশ: বাংলাদেশ, বাংলাদেশ”, “তােমার আমার ঠিকানা: পদ্মা-মেঘনা-যমুনা”, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”, ইত্যাদি স্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা দেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ঐ দুই দিনে দেশের বহু স্থানে পুলিশের গুলিতে বহু লােক হতাহত হয়। ৩ মার্চ ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানে এক জনসভার আয়ােজন করে। সেই সভায় বঙ্গবন্ধু স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে অসহযােগ ৫০ বাংলাদেশের রাজনীতি সংঘাত ও পরিবর্তন
৫০
আন্দোলনের ডাক দেন এবং জনগণকে অফিস-আদালত, কল-কারখানা, খাজনাট্যাক্স বন্ধ রাখার নির্দেশ দান করেন।
প্রচণ্ড গণবিস্ফোরণের মুখে ইয়াহিয়া খান ৬ মার্চ তারিখে ঘােষণা দেন যে, ২৫শে মার্চ তারিখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। তিনি ইতােপূর্বে সংসদীয় দলসমূহের এক নেতৃ সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেন। কিন্তু শেখ মুজিব সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং ৭ মার্চ তারিখে রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করেন। তিনি বলেন, “সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, হত্যার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, পরিষদে বসব কি বসব না”। তিনি কোর্ট-কাচারি, অফিস-আদালত ও শিক্ষা। প্রতিষ্ঠানসমূহ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ দেন এবং বলেন, এদেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত খাজনা ট্যাক্স বন্ধ থাকবে।” তিনি গ্রামে গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠনের আহ্বান জানান এবং “যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। তিনি বলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি আরাে দেব, তবু। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।৩৭
ঐ সময় আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে যথেষ্ট চাপ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগ ছিল একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন। সম্ভাব্য সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার প্রস্তুতি বা সামর্থ্য কোনােটাই তার ছিল না। তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করলে মুজিব রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত হতেন এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের সহানুভূতি ও সহযােগিতা থেকে বঞ্চিত হতেন। সুতরাং তিনি আত্মরক্ষামূলক কৌশল অবলম্বন করেন এবং ইয়াহিয়া খানকে আক্রমণকারীর ভূমিকায় রাখতে চান। তাই তিনি অসহযােগ আন্দোলনকে হাতিয়ার হিসাবে বেছে নেন এবং জনগণকে “স্বাধীনতা সংগ্রাম”-এর জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের মানুষ অক্ষরে অক্ষরে বঙ্গবন্ধুর আদেশ পালন করে। সরকারি কর্মচারী, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী প্রভৃতি সকল শ্রেণীর মানুষের সার্বিক অসহযােগের ফলে ইয়াহিয়া সরকার সম্পূর্ণ পঙ্গু হয়ে পড়ে এবং কার্যত মুজিবের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে এক সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সকল স্তরের বেসামরিক কর্মচারী মুজিবের প্রতি আনুগত্য স্বীকার। করেন এবং দৈনন্দিন প্রশাসন তাঁর নির্দেশেই পরিচালিত হতে থাকে।
এমন অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং ১৬ থেকে ২৪ শে মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ পশ্চিম-পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দও ঐ সময় ঢাকায় আসেন এবং আলােচনার বিভিন্ন পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন। আলােচনাকালে ইয়াহিয়া খান
৫১
রাজনৈতিক মীমাংসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং শেষ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ নিম্নোক্ত মৌলিক বিষয়ে একমত হয় :
১. প্রেসিডেন্টের ঘােষণার মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা;
২. প্রদেশেসমূহে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর;
৩. অন্তর্বর্তীকালীন সময় ইয়াহিয়ার হাতে কেন্দ্রের শাসনভার অর্পণ; এবং
৪. প্রথমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে পরিষদ সদস্যগণ কর্তৃক আঞ্চলিক সংবিধানের কাঠামাের প্রণয়ন এবং পরে উভয় অঞ্চলের সদস্যগণের যুক্ত অধিবেশনে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন।৩৮
তবে অন্তবর্তীকালে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কী কী ক্ষমতা থাকবে এবং আঞ্চলিক সরকারের হাতে কী কী ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া হবে এই বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়। আওয়ামী লীগ স্বভাবতই ৬-দফার ভিত্তিতে কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া সব ক্ষমতা বাংলাদেশের হাতে হস্তান্তর করার দাবি জানায়। কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তানি কায়েমী স্বার্থবাদী মহল এ দাবি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তারা অস্ত্রের জোরে বাংলাদেশকে তাদের কুক্ষিগত রাখতে চায়।
আসলে গােটা আলােচনা পর্বটাই ছিল এক ধরনের প্রতারণা। ইয়াহিয়া খানের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল আলাপ-আলােচনার আড়ালে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং যথােপযুক্ত সময়ে বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আঘাত হানা। তাই তিনি আলােচনা পর্ব শেষ না করেই তার সেনাবাহিনীকে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় সংগােপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী সেদিন রাতে অতর্কিতভাবে ই.পি.আর. (বর্তমান বিডিআর) ও পুলিশ ছাউনি, ছাত্রাবাস, শ্রমিক কলােনী, বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে আক্রমণ চালায় এবং হাজার হাজার বাঙালি নরনারীকে নির্বিচারে হত্যা করে। একই সময় দেশের অন্যান্য শহর-বন্দরে একইরূপ হামলা চালানাে হয় এবং সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। গ্রেফতার হবার অল্পক্ষণ আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে ঘােষণা করেন এবং আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের প্রতি সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তােলার নির্দেশ দেন।৩৯
৫. স্বাধীনতা যুদ্ধ
পাকিস্তান বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের মুখে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই.পি.আর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা স্ব স্ব এলাকায় প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। ফলে সারা দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চ থেকে সকল
৫২
রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ ও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। পাকিস্তানিদের হত্যা, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ প্রভৃতি অকথ্য অত্যাচারের ফলে লক্ষ লক্ষ বাঙালি বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে চলে যায়। আওয়ামী লীগের কোনাে যুদ্ধ প্রস্তুতি ছিল না সে রাবণে, নেতৃবৃন্দ দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণ কলকাতায় একত্রিত হন এবং ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র (Proclamation of Independence) জারি করেন। এই ঘােষণাপত্রে বলা হয় :
যেহেতু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রিত হয়ে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করে তুলেছে… সেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে যে রায় দিয়েছে সে রায় মােতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি; এবং এতদ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা অনুমােদন করছি। এতদ্বারা আমরা আরাে সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন (স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের পূর্ণ বিবরণের জন্য দেখুন পরিশিষ্ট খ)।
উপযুক্ত ঘটনাবলী থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা পূর্বপরিকল্পিত ব্যাপার ছিল না। আওয়ামী লীগের যেমন নিজস্ব কোনাে যুদ্ধ-প্রস্তুতি ছিল না তেমনি তারা কোনাে বিদেশি শক্তির সঙ্গে সাহায্যের ব্যাপারে পূর্বাহ্নে কোনাে বন্দোবস্ত করেনি। ২৫ মার্চের কালাে রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের মুখে মুজিব স্বাধীনতা ঘােষণা করলে তা দেশের সর্বস্তরের মানুষের স্বতস্ফূর্ত ও সক্রিয় সমর্থন লাভ করে।
বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকার : স্বাধীনতা ঘােষণার প্রেক্ষিতে, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিপ্লবী সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি মনােনীত হন। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মােশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, (পরে জেনারেল) মােহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী (১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টিকিটে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য) সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের
৫৩
১৭ই এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার ভাবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলা আমবাগানে বহু দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, পরিষদ সদস্যবৃন্দ ও মুক্তিসেনাদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের সদস্যবৃন্দ শপথ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে শপথ গ্রহণের স্থানটিকে “মুজিবনগর নাম দেওয়া হয়। বিপ্লবী সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় অবস্থিত থাকলেও। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগরই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল।
ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মােজাফফর), বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ও কংগ্রেস দল বিপ্লবী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই চারটি দল থেকে যথাক্রমে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান। ভাসানী, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, মনি সিং ও মনােরঞ্জন ধর এবং আওয়ামী লীগের পাঁচজন প্রতিনিধি সমবায়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। এই উপদেষ্টা পরিষদের কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় বিপ্লব সরকারকে সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান করা। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ বিপ্লবী সরকার তথা আওয়ামী লীগের হাতেই থেকে যায়।
বাংলাদেশ বিপ্লবের বিশেষত্ব ছিল এই যে, এই বিপ্লবে যারা নেতৃত্ব দান করেন তাঁরা ছিলেন জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে বলপ্রয়ােগের নীতি অনুসরণ করে। ফলে বিপ্লবী সরকার সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী জনগােষ্ঠী ও সরকারগুলাের অকুণ্ঠ সহানুভূতি ও সমর্থন লাভ করে। যেসব দেশ বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় সাহায্য প্রদান করে তাদের মধ্যে ভারত ও সােভিয়েত রাশিয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ভারত কেবল বিপ্লবী সরকারকে রাজনৈতিক ও সামরিক সাহায্যই দেয়নি, সে দেশে প্রায় এক কোটি শরণার্থী বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধকালে আশ্রয় ও খাদ্য প্রদান করে এবং বিপ্লবী সরকারকে তার মাটি থেকে যুদ্ধ পরিচালনার সকল সুযােগ-সুবিধা প্রদান করে। তেমনি রাশিয়া জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সমর্থন দান করা ছাড়াও বিভিন্ন। বৈষয়িক সাহায্য প্রদান করে। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে।
বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ই.পি.আর.)-এর কয়েক হাজার নিয়মিত সেনা এবং এক লক্ষাধিক গেরিলা যােদ্ধা সমবায়ে একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করে। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকসহ সকল শ্রেণীর বাঙালি যুবক এই মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করে। ভারত ও রাশিয়ার সাহায্য ও সমযােগিতায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা অল্প সময়ের মধ্যে উপযুক্ত। প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র লাভ করে।
১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় নয় মাস যাবত বাংলাদেশের জনগণ দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে ইতিহাসের অন্যতম বীরত্বপূর্ণ ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যায়। পাকিস্তান বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ,
৫৪
অগ্নিসংযােগ, লুট ইত্যাদি জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে তারা প্রায় ৩০ লক্ষ বেসামরিক নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে, প্রায় দুই লক্ষ রমণীর সতীত্ব নষ্ট করে, প্রায় ৬০ লক্ষ বাড়িঘর ধ্বংস করে এবং প্রায় এক কোটি বাঙালিকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। কিন্তু পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতা যতই বৃদ্ধি পায় বাংলাদেশের মানুষ ততই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং পাকিস্তানিরা সম্পূর্ণ গণবিচ্ছিন্ন তথা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। কয়েকমাসের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও সম্মুখ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ভেঙে পড়ে। ইয়াহিয়া খান নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক রূপ দানের চেষ্টা করেন। সে লক্ষ্যে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ৩ ডিসেম্বর তারিখে অতর্কিতে ভারতের ওপর আক্রমণ চালায়। এই পরিস্থিতিতে ভারত ৬ ডিসেম্বর তারিখে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশ ও ভারতের সেনাবাহিনীর সমবায়ে এক যৌথ কম্যান্ড’ গঠিত হয়। মাত্র ১০ দিন যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজী প্রায় ৯০ হাজার সৈন্যসহ ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে যৌথ কমান্ডের নিকট বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেন এবং বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। তাই ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির জন্য গৌরবময় দিন-“বিজয় দিবস”।
স্বাধীনতাযুদ্ধে বিভিন্ন দলের ভূমিকা : আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগ ছিল মূলত পূর্ব-বাংলা ভিত্তিক একটি জাতীয়তাবাদী দল। এই দল পূর্ব-বাংলার জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি সম্বলিত ৬-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে এবং তার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। আওয়ামী লীগ তার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করতে চায়। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চের রাতে অতর্কিতে সশস্ত্র আক্রমণ করে বাংলাদেশের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগ বিপ্লবী সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করে। কতকগুলাে রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধে স্বতস্ফূর্ত ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু কিছু কিছু দল মুক্তিযুদ্ধের ঘাের বিরােধিতা করে। এমন কি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে উল্লেখযােগ্য দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল।
আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সালে তার যাত্রা শুরু করে আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে। দলটি মূলত পূর্ব-বাংলার মধ্যবিত্ত উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করত। অধিকতর শক্তিশালী পশ্চিম পাকিস্তানি বুর্জোয়াদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে তার সমর্থন ভিত্তি সম্প্রসারিত করে, এবং পর্যায়ক্রমে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র দলের অন্যতম মূলনীতি বা আদর্শ হিসেবে স্থান লাভ করে। কিন্তু দলের একটি ডানপন্থী অংশ এইসব নীতিগত পরিবর্তন মেনে নিতে পারেনি। এই ডানপন্থী অংশটির প্রধান নায়ক ছিলেন খন্দকার মােশতাক আহমদ।
৫৫
খন্দকার মােশতাক কুমিল্লার এক পীর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নিজ নাম থেকে মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে খন্দকার মােশতাক আওয়ামী লীগ দল ত্যাগ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন এবং পরে অন্যতম সহ-সভাপতির পদ লাভ করেন। কিন্তু তিনি নিজেকে যােগ্যতম নেতা বলে মনে করতেন এবং দলের পদসােপানে পঞ্চম স্থান পেয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ৬-দফা কর্মসূচি ও আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনে সমর্থন দান করলেও মােশতাক চক্র সর্বদা পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীর প্রতি নরম দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করত এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় সমর্থক ছিল।
ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। অপরদিকে সােভিয়েত রাশিয়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সহায়ক শক্তি ছিল। ফলে বিপ্লবী সরকার সােভিয়েত রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে সমাজতন্ত্রের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে যখন এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য এক গােপন প্রচেষ্টা চালায়। এই গােপন তৎপরতার মাধ্যম ছিল খন্দকার মােশতাক আহমদ। মােশতাক ও তাঁর অনুচরগণ (যাদের মধ্যে তাহের উদ্দীন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী ও শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য) ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, পাকিস্তান সরকার যদি বাংলাদেশকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে তবে একটা সমবায় রাষ্ট্র (Confederation) হিসেবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা হবে। মােশতাকের ঘনিষ্ঠ সহযােগী ও তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষী সে মর্মে একটি গােপন পত্র পাকিস্তান সরকারের নিকট প্রেরণ করেন। তাছাড়া মােশতাক চক্র ‘স্বাধীনতা না বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক এক প্রচারপত্র বিলি করে। তাতে বলা হয় যে, পাকিস্তান কারাগার থেকে যে কোনাে মূল্যে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে হবে এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য প্রয়ােজন হলে স্বাধীনতা যুদ্ধ স্থগিত করতে হবে।৪০
এভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে তারা নানা ধরনের তৎপরতা চালায়, কিন্তু সফলকাম হতে পারেনি। তাদের ষড়যন্ত্র অচিরেই ফাঁস হয়ে যায়। বিপ্লবী সরকার মাহববুল আলম চাষীকে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে অপসারণ করে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাককে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে জাতিসংঘে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখে। উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর খন্দকার মােশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করা হয়।
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মােজাফফর), বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ও জাতীয় কংগ্রেস মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করে। তবে আরা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাদেরকে নিয়ে একটি
৫৬
জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানায়। অবশ্য মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পরামর্শক্রমে তারা সেই দাবি পরিত্যাগ করে এবং বিপ্লবী সরকারের অধীনে উপদেষ্টা পরিষদে যােগদান করে। যদিও ন্যাপ (মােজাফফর) ও বাংলাদেশের কনস্টি পার্টি পৃথক গেরিলা বাহিনী গঠন করে নিজস্ব পথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়, বিপ্লবী সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ছিল সন্দেহাতীত এবং রাশিয়ার সাহায্য ও সমর্থন আদায়ের ব্যাপারে তাদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মাওলানা ভাসানীর সমর্থন ছিল দ্ব্যর্থহীন, কিন্তু মশিউর রহমানের নেতত্বে ন্যাপের ডানপন্থী অংশটির ভূমিকা ছিল সন্দেহজনক।
তবে কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক দল বা উপদল বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্য বিরােধিতা করে। মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধীদলগুলাে দুটো প্রধান গােষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। একটি ছিল ডানপন্থী ইসলামী গােষ্ঠী এবং অপরটি চীনপন্থী বাম গােষ্ঠী।
ডানপন্থী ইসলামী গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত দলগুলাের মধ্যে ছিল জামায়াত-ইইসলামী, নেজাম-ই-ইসলাম, জামিয়াত-ই-উলামা-ই-ইসলাম, খেলাফতে রাব্বানী পার্টি, পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি এবং মুসলিম লীগের তিনটি উপদল- কাউয়ুম, কাউন্সিল ও কনভেনশন। এই দলগুলাে ইসলামী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিল। তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সকল প্রকার সহযােগিতা করে এবং সামরিক জান্তার সকল রকম বর্বরতাকে সমর্থন দেয়। তারা গ্রামে গঞ্জে তথাকথিত “শান্তি কমিটি গঠন করে মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনা করে এবং রাজাকার’ নামে মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা আক্রমণাত্মক ও নিষ্ঠুর ভূমিকা গ্রহণ করে মৌলবাদী জামায়াত-ই-ইসলামী দল। এই দল তাদের সমর্থক ছাত্র সংগঠনের (তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংস্থা) সদস্য সমবায়ে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ নামে দুটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তােলে, যারা মুক্তিযুদ্ধকালে অসংখ্য ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বলে অভিযােগ রয়েছে।
অন্যান্য ডানপন্থী দলের মধ্যে আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, আবার বিরােধিতাও করেনি। তবে কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা ও এস এম সােলায়মান মুক্তিযুদ্ধকালে পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে প্রকারান্তরে পাকিস্তানি জান্তাকে সমর্থন করেন।
বামপন্থী যেসব দল বা উপদল মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করে তাদের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তান কমুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেলিনবাদী) ও পূর্ব-বাংলার ক্যুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেলিনবাদী)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ১৯৫০-এর দশকে ঐক্যবদ্ধ পূর্ব-পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি বাঙালির স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে, সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং এই দলের মঞ্চ থেকেই সর্বপ্রথম পূর্ব-বাংলার স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়। চীন-সােভিয়েত দ্বন্দ্বের প্রভাবে ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ক্যুনিস্ট পার্টি দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মনি সিং-এর নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট পার্টির রুশপন্থী অংশটি ৬-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও
৫৭
স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু চীনপন্থী অংশটি (মার্কসবাদী। লেলিনবাদী) স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে এক অস্পষ্ট ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালে চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করলে চীনপন্থীরা আরাে বিভ্রান্ত হয় এবং কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় উপদলটির নেতৃত্বে ছিলেন সুখেন্দু দস্তিদার, মােহাম্মদ তােয়াহা ও আব্দুল হক। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটি উপেক্ষা করে সারা পাকিস্তান ভিত্তিক “জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব” সাধনের পক্ষে যুক্তি দেখান। এই উপদলটি আওয়ামী লীগ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধকে “ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ” ও “রুশ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ”-এর ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে অভিহিত করে, এবং বিক্ষিপ্তভাবে মুক্তিবাহিনী ও কোনাে কোনাে স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যর্থ লড়াই করে। পূর্ব-বাংলার ক্যুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেলিনবাদী) একই রূপ ভূমিকা পালন করে। অবশ্য চীনপন্থী একটি উপদল অহিদুর রহমানের নেতৃত্বে রাজশাহী অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একযােগে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে।৪১
চীনপন্থী বলে পরিচিত আরাে কয়েকটি উপদল মুক্তিযুদ্ধ কালে দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই-এর জন্য বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” নামে একটি যৌথ কমিটি গঠন করে। এই সব উপদলগুলাের মধ্যে ছিল—কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেননের। নেতৃত্বাধীন ক্যুনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি’, দেবেন শিকদার ও আবুল বাশারএর নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার ক্যুনিস্ট পার্টি, নাসিম আলির নেতৃত্বাধীন হাতিয়ার গ্রুপ’, অমল সেন ও নজরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কম্যুনিস্ট সংহতি কেন্দ্র এবং সাইফুদ্দাহারের নেতৃত্বাধীন কম্যুনিস্ট কর্মী সংঘ’। মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি বিপ্লবী সরকারের প্রতি পূর্ণ সহযােগিতার হাত সম্প্রসারণ করে, কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তারা আশানুরূপ সাড়া পায়নি। ফলে এইসব উপদল নিজস্ব গেরিলা উপদল গঠন করে এবং মুক্তিযুদ্ধকে শ্রেণীভিত্তিক জনযুদ্ধে রূপান্তরের চেষ্টা করে। কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধের ওপর তেমন কোনাে প্রভাব ফেলতে পারেনি। বাংলাদেশ-বিরােধী অবস্থানের জন্য এইসব উপদল চীনের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল, কিন্তু ভারত ও রাশিয়াকেও তাররা মিত্র হিসাবে গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ এই দেশ। দুটি প্রধানত আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রাহ্য করে এবং তার মাধ্যমেই সকল সাহায্য প্রদান করে। পক্ষান্তরে চীনপন্থী গােষ্ঠীগুলাে অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে নাজেহাল হয়। সুতরাং তারা মনে করতাে যে, ভারতের শাসকগােষ্ঠী বাংলাদেশে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করার জন্য তাদের শ্রেণী মিত্র বুর্জোয়া আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানাের চেষ্টা করছে।৪২
দৃশ্যত মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী। আওয়ামী লীগের আদর্শগত ভিত্তি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান কমুনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও
৫৮
কংগ্রেস অনুরূপ আদর্শে বিশ্বাসী ছিল এবং তারা মুক্তিযুদ্ধে সর্বতােভাবে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু মুসলিম লীগ, জামায়াত-ই-ইসলামী প্রভৃতি ডানপন্থী সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম জাতীয়তাবাদ তথা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিল এবং তারা ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে ইসলামের পরিপন্থী বলে মনে করত। সুতরাং তারা ইসলামী পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করে । চীনপন্থী বাম দলগুলাে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল। সে সত্ত্বেও তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। এর কারণ ইসলামী আদর্শ রক্ষা নয়, বরং কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের প্রভাব।
ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারত বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে সবচেয়ে সক্রিয় সাহায্য ও সমর্থন দেয়। ভারত ছিল পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু”। দেশ দুটি একাধিকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং একে অপরকে দুর্বল করার সুযােগ ছাড়তে কেউ প্রস্তুত ছিল না। তদুপরি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকালে প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করলে তা ভারতের জন্য বড় ধরনের আর্থ-সামাজিক ও নিরাপত্তা সমস্যার সৃষ্টি করে। ভারত চাচ্ছিল যথাসম্ভব শীঘ্র বাঙালি শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠানাে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া এই বিপুল সংখ্যক বাঙালি দেশে ফিরতে প্রস্তুত ছিল না। সুতরাং ভারত ওতপ্রােতভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকে সােভিয়েত রাশিয়া বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রদান করে, কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বিপ্লবী সরকার তথা ভারতের পক্ষ সমর্থন করে। অপরদিকে আমেরিকা ছিল পাকিস্তানের সামরিক মিত্র। আবার ১৯৬২ সালের চীন-ভারত সীমান্ত বিরােধের কারণে চীন ছিল ভারতের শত্রু। অতএব ভারতের আজন্ম শত্রু পাকিস্তান ছিল চীনের মিত্র। তেমনি চীন-সােভিয়েত দ্বন্দ্বের কারণে চীনের শত্রু ভারত ছিল রাশিয়ার বন্ধু। এভাবে ১৯৬০-এর দশকে ভারতীয় উপমহাদেশকে ঘিরে দুটি শক্তিবলয় সৃষ্টি হয়। তাই ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধে একদিকে আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে, অন্যদিকে ভারত ও রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে এগিয়ে আসে। চীনের অনুকরণে চীনপন্থী দলগুলাে ভারতকে সম্প্রসারণবাদী ও রাশিয়াকে “সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধকে রুশ-ভারতের চাপিয়ে দেয়া আগ্রাসী যুদ্ধ বলে। আখ্যায়িত করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে রুশ-ভারতের প্রভাবের বিরােধিতা করতে গিয়ে চীনপন্থী দলগুলাে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করে।
৬. স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে অন্তর্বিরােধ
১৯৭১ সালের বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি শাসক চক্রের সাংস্কৃতিক অবদমন, অর্থনৈতিক শােষণ ও রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রাম। এদেশের বিভিন্ন গােষ্ঠীর মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও সকলেই পশ্চিমপাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক আমলা ও পুঁজিপতি শােষকদের শত্রু বলে মনে করে
৫৯
এবং সব শ্রেণীর মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু জাতীয় সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির রূপ সম্পর্কে বাঙালিদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরােধ থেকে যায়।
জাতীয় সংস্কৃতি : ইতােপূর্বে দেখা গেছে যে, পাকিস্তানের শাসকচক্র বাংলাকে মুসলমানদের ভাষা বলে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এবং বাংলা সাহিত্যে ও সংস্কৃতিকে ইসলাম-বিরােধী বলে মনে করে। সুতরাং তারা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে হিন্দু প্রভাব দূরীভূত করে তাকে ইসলামীকরণের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু বাঙালি ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী, শিল্পী, সাহিত্যক, ও বিরােধী রাজনৈতিক গােষ্ঠীসমূহের প্রবল বিরােধিতার ফলে ঐসব পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়ে যায়। এই সব গােষ্ঠী মনে করত যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হিন্দু-মুসলমানের যৌথ প্রচেষ্টার ফসল এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হচ্ছে একক এ অবিভাজ্য। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাশিম এই অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, “বাংলা ভাষা আমাদের ভাষা এবং বাংলা সাহিত্য আমাদের সাহিত্য। আমাদের (১৯৪৭ সালের) স্বাধীনতার সাথে সাথে আমরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সম্পূর্ণ ভাণ্ডারের উত্তরাধিকার লাভ করি”।৪৩
এই গােষ্ঠীসমূহ বাঙালি সংস্কৃতির মিশ্র চরিত্র অক্ষুন্ন রাখতে চায় এবং তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লেখক-কবিদের রচনা সমান প্রাধান্য লাভ করে। তারা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, সুকান্ত প্রভৃতি বাঙালি কবির জন্মজয়ন্তী ও বাংলা নববর্ষ উৎসবাদি নিয়মিত পালন করত। ১৯৬৭ সালে পাকিস্ত নি সরকার রবীন্দ্র সংগীত ও নাটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করলে প্রখ্যাত বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, ও শিক্ষাবিদগণ এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। তারা দাবি করেন যে, রবীন্দ্রনাথ, “বাংলা ভাষাভাষী পাকিস্ত নিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ”।৪৪
শেখ মুজিব বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা সংস্কৃতির কথা চিন্তা করাই পাপ।”৪৫
বাঙালি সংস্কৃতির মুসলমান প্রবক্তাগণ জাতি হিসেবে নিজেদেরকে ‘বাঙালি’ বলে পরিচয় দিতেই গর্ব বােধ করতাে। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তাদেরকে দমনের শত চেষ্টা সত্ত্বেও এই গােষ্ঠী ১৯৭১ সাল নাগাদ পূর্ব-বাংলার সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অঙ্গনে পূর্ণ আধিপত্য অর্জন করে।
অপরদিকে, পূর্ব বাংলার মুসলমান এলিটদের একটি অংশ পাকিস্তানি আদর্শ তথা ইসলামী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী সংস্কৃতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থেকে যায়। তারা নিজেদেরকে বাঙালি নয় বরং মুসলমান বা খুব জোর ‘মুসলমান বাঙালি’ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করত। এই ‘মুসলমান বাঙালিরা তিনটি প্রধান স্বার্থ। গােষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল এবং নিজ নিজ দৃষ্টি কোণ থেকে তারা বাঙালি সংস্কৃতি তথা জাতীয়তাবাদের বিরােধিতা করে। প্রথম গােষ্ঠীটি ছিল অভিজাত (আশরাফ)। শ্রেণীভুক্ত, যাদের পূর্ব পুরুষরা ভারতে মুসলিম শাসনামলে বাংলার বাইরে থেকে। এদেশে আসেন বলে মনে করা হয়। তারা নিজেদেরকে আদি মুসলমানদের
৬০
বংশধর বলে ভাবতাে। বাংলাদেশে জন্মলাভ করলেও তাদের গৃহভাষা ছিল উর্দু, কেউ কেউ বা উভভাষী (উর্দু ও বাংলা) ছিল।৪৬
স্থানীয় বাঙালি জনসাধারণের মধ্যে তারা শেকড় গাড়তে পারেনি। তাই তারা রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগােষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং ইসলামী স্লোগানের ওপর ভর করে টিকে থাকতে চাইত। দ্বিতীয় গ্রুপটি ছিল ‘উলেমা। তারা মাদ্রাসা মক্তবে “ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করে এবং উর্দু, আরবি, ফার্সি প্রভৃতি ভাষা ও সাহিত্য চর্চা করতাে। তারা ভাবতে পাকিস্তানে ইসলামী শাসন ও সংস্কৃতি কায়েম হলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিদের তুলনায় তারা রাষ্ট্রীয় জীবনে অধিক সুযােগ সুবিধা লাভ করবে। তৃতীয় গােষ্ঠীটি ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক মনমানসিকতা সম্পন্ন অথচ ইসলামী সংস্কৃতির সমর্থক। কারণ, তারা ভূস্বামী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী অথবা আমলা, হিসেবে পাকিস্তানের ক্ষমতা কাঠামােতে কিছু প্রান্তিক সুবিধা ভােগ করতাে।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি এই সব গােষ্ঠীর বিরূপ মনােভাবের একটি মনস্তাত্ত্বিক দিকও ছিল। এটা ঠিক যে, আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের সঙ্গে বাঙালি হিন্দুরা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল এবং ১৯৪৭ সালে বাংলা বিভাগের সময় এক্ষেত্রে নেতৃত্ব তাদের হাতেই ছিল। ফলে বেশির ভাগ বাংলা সাহিত্য ও শিল্পকর্মে হিন্দু জীবনধারা ও চরিত্রের প্রাধান্য ছিল সুস্পষ্ট, যা ইসলামী গােষ্ঠীর নিকট সুখকর ছিল না।
সুতরাং ইসলামী গােষ্ঠীসমূহ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে হিন্দু বলে জ্ঞান করে। এবং সেখান থেকে সকল প্রকার হিন্দু প্রভাব দূরীভূত করে পূর্ব-বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে “ভারতীয় সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ”-এর কবল থেকে মুক্ত করতে চায়।৪৭
তাদের মতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধি যে সংস্কৃতি হিন্দু সংস্কৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্র জয়ন্তী ইত্যাদি অনুষ্ঠানকে অনৈসলামিক বলে মনে করতাে এবং ঐসব “বিদেশি ঐতিহ্যের প্রতি কিছু লােকের অনুরাগের তীব্র নিন্দা করতাে।৪৮
তাদের মধ্যে কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, মূলত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনৈসলামিক ছিল না; পরবর্তী সময় একে হিন্দু রূপ প্রদান করা হয়। সুতরাং তারা বাদ্ধারা ও অলংকারাদি পরিবর্তন ও নতুন নতুন ইসলামী (উর্দু-আরবিফার্সি) শব্দ প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরণের ওপর জোর দেয়।
একদিকে বাঙালি সংস্কৃতি ও অন্যদিকে ইসলামী সংস্কৃতির সমর্থকদের মাঝখানে একটি তৃতীয় বামপন্থী গােষ্ঠী ছিল। তারা ১৯৫০-এর দশকে ভাষা আন্দোলন ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে চীন-সােভিয়েত বিরােধের পর সাংস্কৃতিক বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে চায়। এই গােষ্ঠীটি চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিল এবং এর অন্যতম নায়ক ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মাওলানা ভাসানী বলেন, “আমাদের আন্দোলন যে মৌল নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত তা হলাে জনগণের মুক্তি, ভাষা বা ভূখণ্ড নয়”।৪৯
৬১
এই গােষ্ঠী সমাজতান্ত্রিক মূল্যবােধের ওপর প্রতিষ্ঠিত এক ধর্মনিরপেক্ষ “গণমুখী” সংস্কৃতির পক্ষপাতী ছিল। তারা রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রতিনিধি বলে মনে করতাে, কিন্তু এই বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলেনি। কারণ, তা ইসলামী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলাের অবস্থান দৃঢ়তর করতাে, যা তারা চায়নি।৫০
রাজনৈতিক ব্যবস্থা : তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার সম্পর্কে মােটামুটি একমত ছিল। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংসদীয় গণতন্ত্রের অঙ্গীকার করে এবং তার ভিত্তিতে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়। পূর্ব-বাংলার রাজনীতি সচেতন অংশটি প্রধানত দুটি কারণে সংসদীয় পদ্ধতি সমর্থন করতাে। এক, ব্রিটিশ আমলে এক ধরনের সংসদীয় পদ্ধতির মধ্য দিয়েই রাজনীতিতে তাদের হাতে খড়ি হয় এবং ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল এই দুই দশক ধরে এই পদ্ধতির সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে। দুই, আইয়ুব খানের স্বৈরাচারের আমলে তাদের উপলব্ধি জন্মে যে, রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থায় ক্ষমতার সুষম বণ্টন সম্ভব নয়। ক্ষমতা ভাগাভাগির উপযুক্ত পন্থা হিসেবে তারা সংসদীয় পদ্ধতিকে শ্রেয় মনে করে। অবশ্য বামপন্থীদের একটি ছােট অংশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলত তারা সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল ছিল না।
সংসদীয় সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে রাজনীতিকদের মধ্যে একটা ব্যাপক ঐকমত্য থাকলেও রাজনীতির আদর্শিক ভিত্তি, বিশেষত রাজনীতিতে ধর্মের স্থান সম্পর্কিত প্রশ্নে যথেষ্ট মতবিরােধ ছিল।
পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ধর্মের এক জাদুকরী প্রভাব রয়েছে। সুতরাং পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ তাদের শাসন বজায় রাখার জন্য ধর্মীয় উন্মাদনা জিইয়ে রাখতে চান। তাছাড়া, পাকিস্তানের জন্মের পরপরই রাষ্ট্রভাষা বিতর্ককে কেন্দ্র করে বাঙালিদের মধ্যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উত্থান শাসকগােষ্ঠীকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তােলে এবং তারা ইসলাম ধর্মকে জাতীয় একাত্মতার একমাত্র ভিত্তি হিসেবে আঁকড়ে ধরেন।
১৯৪৯ সালে পাকিস্তান গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত আদর্শ প্রস্তাবে (Objectives Resolution) ঘােষণা করা হয় যে, সমগ্র বিশ্বের সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ, এবং তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের হাতে যে ক্ষমতা অর্পণ করেছেন তা তাঁর নির্দেশিত সীমার মধ্য থেকেই প্রয়ােগ করতে হবে। আদর্শ প্রস্তাবে আরাে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে, পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত ইসলামের শিক্ষা। অনুসারে মুসলমানদের জীবন যাপনের ব্যবস্থা করা হবে। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে আদর্শ প্রস্তাবটি প্রস্তাবনা আকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘােষণা করা হয়। এই সংবিধানে আরাে বিধান করা
৬২
হয় যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হবেন মুসলমান এবং সকল আইন ইসলামের নির্দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। ১৯৬২ সালের সংবিধানেও অনুরূপ ইসলামী বিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু পূর্ববাংলার হিন্দুরা (যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫%) “ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরােধী ছিল এবং তারা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। আদর্শ প্রস্তাবের বিরােধিতা করে কংগ্রেস নেতা শ্ৰীষ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন :
আমার মতে কোনাে রাষ্ট্রে, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের লােক বাস করে সেখানে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মের কোনাে স্থান থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের অবস্থান হবে। নিরপেক্ষ-কোনাে ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকবে না।…সার্বভৌমত্বের মালিক হবে জনগণ, অন্য কেউ নয়।৫০
তবে ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দাবি কংগ্রেস তথা হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানে ইসলামী জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে ফেলে এবং তার পর থেকে পূর্ব-বাংলায় বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন গড়ে উঠে। এদের মধ্যে পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও গণতন্ত্রী দলের নাম উল্লেখযােগ্য। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন ধর্ম-নিরপেক্ষ রাজনীতির পথকে আরাে প্রশস্ত করে। ঐ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট যে ২১-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তার মূল কথা। ছিল পূর্ব-বাংলার জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। অপরদিকে মুসলিম লীগের প্রধান অঙ্গীকার ছিল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচনে মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয় প্রমাণ করে যে, পূর্ব-বাংলার জনগণ তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন; কেবল ধর্মের নামে তাদেরকে প্রতারিত করা যায় না। এই উপলব্ধি থেকে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত “আওয়ামী মুসলিম লীগ” ১৯৫৫ সালে তার নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দিয়ে ধর্মনরিপেক্ষ রাজনীতির অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। আওয়ামী লীগ সমর্থক পূর্ব-বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগও ঐ সময় মুসলিম শব্দটি বর্জন করে পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগ নাম ধারণ করে। তখন থেকে আওয়ামী লীগ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমান অধিকার ও সমমর্যাদা দানের দাবির প্রতি জোরালাে সমর্থন জানায় এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানকে “ইসলামী প্রজাতন্ত্র” ঘােষণা করা হলে গণপরিষদে তার বিরুদ্ধে ভােটদান করে। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ১৯০৯ সালে প্রবর্তিত পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করে সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিয়ে যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তখনাে রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেনি। তবে ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল ভিন্নতর। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতা সােহরাওয়ার্দী “ইসলামী প্রজাতন্ত্র” নামকরণের বিরােধিতা করতে গিয়ে গণপরিষদে বলেন:
৬৩
“আমি ধারণাই করতে পারি না যে, যে দেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেদেশের আইনসভা কর্তৃক পাসকৃত আইনের কোনাে রং, গন্ধ বা ঝোঁক ইসলামী ছাড়া অন্য কিছু হবে। তাহলে এই ইসলামী প্রজাতন্ত্র নামকরণ কেন?…কেউ বলছে না যে, এটা (পাকিস্তান) ইসলামী রাষ্ট্র হবে না। কিন্তু আমার আপত্তি হচ্ছে এই যে, যতক্ষণ না একে সত্যিকার ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করা হচ্ছে ততক্ষণ ইসলামী রাষ্ট্র বলা যাবে না। যখন এদেশের সকল মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চাকরি, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে কেবল তখনই একে ইসলামী রাষ্ট্র বলা যেতে পারে।৫২
অনুরূপভাবে, ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে ন্যাপ গঠিত হয় সেই ন্যাপও সাংগঠনিক ও কর্মসূচির দিক দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল ছিল। কিন্তু ১৯৬০ দশকের শেষের দিকে মাওলানা ভাসানীও “ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইসলামী দলসমূহ ধর্মকে অন্যতম ইস্যু হিসেবে উপস্থাপন করে এবং দাবি করে যে, একমাত্র ইসলাম সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারে। তারা আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ইত্যাদি ধর্মনিরপেক্ষ দলকে ইসলাম-বিরােধী বলে কঠোর সমালােচনা করে এবং নিজেরা ইসলামী সংবিধান উপহার দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। ইসলামী গােষ্ঠীর আক্রমণের মুখে আওয়ামী লীগ আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করে বলে যে, তারা ইসলাম বিরােধী নয়; বরং পাকিস্তানি শােষকদের সমর্থন করে ইসলামী দলগুলােই ইসলামের নীতি লংঘন করেছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দেয় যে, ইসলামের পরীপন্থী কোনাে আইন প্রণয়ন করা হবে না এবং সকল স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের সুযােগ প্রদান করা হবে। সুতরাং আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির অর্থ ধর্মহীনতা ছিল না। এর মূল কথা ছিল ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের প্রতি সমান আচরণ এবং কোনাে ধর্মকে রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ মর্যাদা না দেয়া। তাই তারা জনগণের আর্থ-সামাজিক অধিকারের ওপর জোর দিলেও ধর্মকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করার কথা প্রকাশ্যে বলেনি। বরং ধর্মভীরু ভােটারদের সমর্থন হারাবার ভয়ে মাঝে মাঝে ধর্মের আবেদন ব্যবহার করেছে।
তবে বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণির একটি বড় অংশের মধ্যে পরিষ্কার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের পর থেকে বেশ কিছু সাহিত্য কর্ম প্রকাশিত হয় যাতে লেখকদের ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনার সুস্পষ্ট ছাপ পরিলক্ষিত হয়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক-রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ ১৯৬৪ সালে এক প্রবন্ধে লিখেন :
“যেখানে রাজনীতি ব্যর্থ হয় সেখানে ধর্ম সফল হােক। যেখানে ধর্ম শেষ হয় সেখানে রাজনীতি শুরু হােক। এই দুই যেন একত্রে মিলিত না হয়। যদি তা হয় তবে রাজনীতি ধর্মকে দুর্নীতিগ্রস্ত করবে এবং ধর্ম রাজনীতিকে অবাস্তব করে ফেলবে।৫৩
৬৪
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা : পাকিস্তানি শাসকচক্র জমিদার, শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ী এবং উচ্চ স্তরের সামরিক-বেসামরিক আমলাবর্গ নিয়ে গঠিত ছিল। তারা একটা আধা সামন্তবাদী আধা পুঁজিবাদী অর্থনীতি লালন করত। অপরপক্ষে বাঙালি প্রতিপক্ষ এলিট গােষ্টীর প্রতিনিধিত্বকারী আওয়ামী লীগের মধ্যে ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আগত পেশাজীবী, মাঝারি ভূস্বামী এবং উঠতি পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ীগণ। আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব-বাংলার জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন তথা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আদায় এবং দেশীয় সম্পদের ওপর বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা।
কিন্তু ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন এবং তাতে বিপুল সংখ্যক প্রগতিবাদী ছাত্র ও শ্রমিকের অংশগ্রহণ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করে। উদীয়মান বামপন্থী গােষ্ঠীসমূহের সমর্থন লাভের জন্য আওয়ামী লীগ ছাত্রদের ১১-দফা কর্মসূচিকে গ্রহণ করে, যে কর্মসূচির মধ্যে কৃষক-শ্রমিকের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে কিছু সমাজতান্ত্রিক সংস্কারের অঙ্গীকার ছিল। আওয়ামী লীগের ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে একটি শােষণমুক্ত ন্যায়ানুগ ও সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠাকে দলের অর্থনৈতিক কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হিসাবে ঘােষণা করা হয়। এতে একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয় এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কিছু নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়। এই সব পদক্ষেপের মধ্যে ছিল অর্থনীতির প্রধান খাতসমূহ জাতীয়করণ, পুঁজি বিনিয়ােগ ও শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ, ভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ এবং অতিরিক্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন।৫৪
এভাবে আওয়ামী লীগ একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলে, কিন্তু মতবাদ হিসেবে সমাজতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেনি। বরং এই দল “গণতান্ত্রিক কাঠামাের মধ্যে থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লব” সাধনের। অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। এটা ছিল দলের অভ্যন্তরে পাতি-বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত শ্রেণি বামপন্থী সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে আপস ফর্মুলা।
স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি দল ছিল যারা সমাজতন্ত্রের প্রতি পূর্ণ অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। এগুলাের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের ক্যুনিস্ট পার্টি ছিল সর্বপ্রথম। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে কম্যুনিস্ট পার্টি অংশগ্রহণ করে এবং চারটি আসনে বিজয়ী হয়। কিন্তু নির্বাচনের অব্যবহিত পর সরকার ক্যুনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করলে নেতৃবৃন্দ আত্মগােপন করেন এবং ১৯৫৭ সালে ন্যাপ প্রতিষ্ঠিত হলে কম্যুনিস্ট পার্টি ন্যাপকে সম্মুখ সংগঠন হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। ১৯৬০-এর দশকে চীন-সােভিয়েত দ্বন্দ্বের প্রভাবে কম্যুনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপ চীনপন্থী ও রুশপন্থী দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। রুশপন্থী ক্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণে বিশ্বাসী ছিল। অপরপক্ষে, চীনপন্থী ন্যাপ ও ক্যুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেলিনবাদী) বিপ্লবী পন্থায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিল।
৬৫
১৯৭০ সাল নাগাদ চীনপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেলিনবাদী) কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মােহাম্মদ তােয়াহার নেতৃত্বাধীন প্রধান উপদলটি সশস্ত্র বিপ্লবের চরম পন্থা গ্রহণ করে এবং শ্রেণি শত্রু খতম তথা ধনী কৃষক ও মহাজনদের হত্যার মতাে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। পূর্ব-বাংলার ক্যুনিস্ট পার্টি এবং কমুনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি- এই দুটি চীনপন্থী গােষ্ঠীও সশস্ত্র বিপ্লবের নীতি গ্রহণ করে। তবে দেশে বিদ্যমান বস্তুগত অবস্থা ও নেতৃত্বের প্রশ্নে তারা তােয়াহা উপদলের সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করতাে। এভাবে ১৯৬৬ সালের পর থেকে পূর্ব-বাংলার বামপন্থীরা তত্ত্বীয় দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল এবং জনগণের সামনে কোন সুস্পষ্ট কর্মসূচি তুলে ধরতের ব্যর্থ হয়। বরং চরমপন্থী। ক্যুনিস্ট উপদলগুলাের নির্বাচন-বিরােধী অবস্থান ও সন্ত্রাসী তৎপরতা জনগণ থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।৫৫
অপরপক্ষে, ইসলামী ডানপন্থীদলগুলাে (মুসলিম লীগ, জামায়াত-ই-ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলাম ইত্যাদি) পুঁজিবাদী অর্থনীতির সমর্থক ছিল। তারা সমাজতন্ত্রকে একটি বিদেশি অনৈসলামিক আদর্শ এবং সমাজতন্ত্রীদের ধর্মহীন নাস্তিক বলে কঠোর নিন্দা করে এবং অভিযােগ করে যে, সমাজতন্ত্রের অনুসারীরা ইসলামী মূল্যবােধ, গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা ধ্বংস করতে চায়।৫৬
দেশের ‘উলেমা সম্প্রদায়ও সমাজতন্ত্রের তীব্র বিরােধিতা করে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৫ জন আলেম ১৯৭০ সালের প্রারম্ভে এক কড়া ফতােয়া জারি করে বলেন :
যেহেতু সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ সমর্থনকারী দলসমূহ কোরান ও ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত, সেহেতু ঐসব দলের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য। তাদের সঙ্গে সহযােগিতা করা, অথবা তাদের পক্ষে ভােট প্রদান কাফেরকে সাহায্যে করার সামিল, এবং তা সম্পূর্ণ হারাম বলে গণ্য হবে।৫৭
৭. আর্থ-সামাজিক পটভূমি
ভূগােল : যে ভূখণ্ডটি বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত তা পূর্বতন বঙ্গপ্রদেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ও আসাম প্রদেশের একটি ছােট অংশ (সিলেট জেলা) নিয়ে গঠিত। দেশের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব সীমান্ত ভারত দ্বারা বেষ্টিত। দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মিয়ানমারের সঙ্গেও বাংলাদেশের একটা অভিন্ন। সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশ ৫৫,৫৯৮ বর্গমাইলের একটি সুচিহ্নিত ও সংযুক্ত ভৌগলিক একক। দেশের সর্বত্র প্রায় একই রকম আবহাওয়া। এখানে কোনাে উল্লেখযােগ্য প্রাকৃতিক বিভাজন। ব্যাপক জনগণের মধ্যে তেমন আঞ্চলিকতার মনােভাব। বাংলাদেশ অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত এক ঘন সবুজ মাঠের দেশ, যার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেশের অধিবাসীদের গভীর দেশাত্মবােধে উদ্বুদ্ধ করতে পারে । কিন্তু জনগণের মধ্যে আদর্শিক-ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব এবং আর্থ-সামাজিক দুরবস্থা ও বিভাজন এই সুন্দর দেশটিতে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে সক্ষম।
৬৬
জনসংখ্যা : বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে গৃহীত আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭ কোটি ১৫ লক্ষ এবং প্রতি বর্গমাইলে জনবসতি ছিল ১২৮৬ জন। প্রায় ৯৮% লােক বর্তমান বাংলাদেশের ভূসীমার মধ্যে জন্মগ্রহণ করে এবং এক শতাংশের কিছু বেশি লােকের জন্মস্থান ছিল বর্তমান ভারত কিংবা পাকিস্তান।৫৮
ভাষাগতভাবে, বাংলাদেশের জনগণ একটি সমজাতিক গােষ্ঠী। প্রায় ৯৯% লােকের মাতৃভাষা বাংলা, এবং তারা এক উন্নত সাহিত্যের অধিকারী। বাকী এক শতাংশ লােকের মধ্যে ০.৬৪% উপজাতীয়, যারা বিভিন্ন উপজাতীয় ভাষাভাষী, এবং ০.২৫% উর্দু ভাষী, যারা বিহারি নামে পরিচিত। অবাঙালি লােকেরা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ লােক উপজাতীয়। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুসারে ৫০৮৯ বর্গমাইল আয়তন। বিশিষ্ট (বাংলাদেশের মােট আয়তনের প্রায় ৯%) পার্বত্য চট্টগ্রামের পাঁচ লক্ষাধিক জনসংখ্যার প্রায় ৭০% লােক উপজাতীয় ছিল।৫৯
বাংলাদেশের জনগণ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত। তবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অর্থাৎ প্রায় ৮৫% মুসলমান। দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায় হলাে হিন্দু; তাদের সংখ্যা প্রায় ১৪%। অবশিষ্টরা হচ্ছে বৌদ্ধ (০.৬১%) খ্রিস্টান (০.৩%), কিংবা অন্য ধর্মাবলম্বী (০.২%)।
অতএব বাংলাদেশে বংশগত ও ধর্মীয় বিভাজন বিরােধের সম্ভাব্য সূত্র এবং জাতীয় একতার প্রতি হুমকি হিসেবে বিরাজমান।
অর্থনীতি : বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলাের মধ্যে একটি। ১৯৭৫ সালের হিসাব অনুসারে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯০ মার্কিন ডলার।৬১
অর্থনীতি ভীষণভাবে কৃষিনির্ভর। মােট দেশজ উৎপদানের প্রায় ৮৫% আসে কৃষি থেকে এবং মাত্র ১০% আসে শিল্প থেকে।৬২
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে কিছু প্রাকৃতিক গ্যাস বাদ দিলে দেশে খনিজ সম্পদ নেই বললেই চলে। ভূমি হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সম্পদ। মােট কৃষি উপযােগী ভূমির পরিমাণ ছিল প্রায় ২.২৪ কোটি একর। সাত কোটি জনসংখ্যা ধরে ১৯৭৪ সালে মাথাপিছু কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ০.৩ একর। তদুপরি কৃষি পদ্ধতি সেকেলে ধরনের এবং ফসল উৎপাদনের হার ছিল খুবই নিম্ন।৬৩
অতএব খাদ্য ঘাটতি ছিল একটি স্থায়ী সমস্যা। সেচ সুবিধার অপর্যাপ্ততা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবে কৃষি অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণভাবে আবহাওয়ার ওপর। নির্ভরশীল ছিল। তেমনি শিল্পোন্নয়নের জন্য বিদেশি সাহায্যের ওপর ভীষণভাবে নির্ভর করতে হতাে। এভাবে প্রকৃতির খেয়াল এবং ধনী দেশসমূহের দানের ওপর সরকারের কার্যকারিতা বহুলাংশে নির্ভর করে।
১৯৭৪ সালে অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় জনসংখ্যার প্রায় ৭৭% ছিল কৃষিজীবী, ১১% শিল্প ও পরিবহন শ্রমিক, প্রায় ৫% বিক্রেতা, প্রায় ৩% চাকরিজীবী এবং ২% পেশাজীবী অর্থাৎ চিকিৎসা প্রকৌশল, আইনব্যবসা ইত্যাদি টেকনিক্যাল
৬৭
পেশায় নিয়ােজিত (সারণী ২.৩ দ্রষ্টব্য)। কৃষিজীবীদের মধ্যে ২১% লােক জমির। মালিক, প্রায় ১৭% বর্গা চাষি (এদের মধ্যে কেউ কেউ অল্প জমির মালিক), প্রায় ২৫% ভূমিহীন ক্ষেতমজুর এবং অবশিষ্টরা ছিল পারিবারিক সাহায্যকারী।৬৪
বড় ও মাঝারি (যারা উদ্বৃত্ত জমির মালিক) তাদের অধীনস্থ বর্গাদার ও ক্ষেতমজুরদের নিয়ন্ত্রণ করে সেজন্য গ্রামীণ বাংলাদেশে তারা ক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সারণি ২.৩
বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় জনসংখ্যার কর্মভিত্তিক বন্টন
(১৯৭৪ সালের হিসাব অনুসারে)
কর্মগােষ্ঠী
(১০ বছর ও তদুর্ধ ব্যক্তিবর্গ) |
সংখ্যা
(হাজার) |
শতাংশ |
পেশাজীবী (Professional) | ৩৭৫ | ১.৮ |
প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা | ৩১ | ০.২ |
কেরানী (Clerical) | ২০৮ | ১ |
চাকরি (Services) | ৩৮৬ | ১.৯ |
বিক্রেতা (Salesman) | ৯৩৪ | ৪.৬ |
কৃষি | ১৫,৮৩৮ | ৭৭.২ |
শিল্প উৎপাদন ও পরিবহন | ২,২৪৭ | ১০.৯ |
বেকার/অন্যান্য | ৫০৩ | ২.৪ |
মোট | ২০,৫২২ | ১০০ |
উৎস : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে, Population Census of Bangladesh, 1974 (ঢাকা, ১৯৭৭), পৃষ্ঠা ৪১।
শহরায়ন ও সাক্ষরতা : বাংলাদেশ একটি গ্রাম প্রধান দেশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় নেপালকে বাদ দিলে বাংলাদেশেই শহরায়নের হার সর্বনিম্ন। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারী অনুসারে বাংলাদেশের মােট জনসংখ্যার ৯১.২% গ্রামে এবং মাত্র ৮.৮% শহরে বাস করে। একমাত্র ঢাকা শহরে ১০ লক্ষাধিক (১৬,৭৯,৫৭২) লােকের বাস ছিল। দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামের লােকসংখ্যা ছিল ৮,৮৯,৭৬০ ও খুলনার লােকসংখ্যা ছিল ৪,৩৭,৩০৪। ১৯৬১ সালের তুলনায় ১৯৭৪ সালের উপযুক্ত তিন নগরের লােকসংখ্যা ২২ শতাংশেরও অধিক বৃদ্ধি পায়। এ থেকে বােঝা যায় যে, নগরবাসীদের একটা বড় অংশ সম্প্রতি চাকরি বা ব্যবসার উদ্দেশে শহরে এসেছে। ফলে গ্রামের সঙ্গে এখনাে তাদের নিকট সম্পর্ক রয়ে গেছে এবং তারা গ্রামে যাতায়াতের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে শহুরে জীবন ধারার প্রসার ও নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি করে।
৬৮
১৯৭৪ সালের আদমশুমারী অনুসারে বাংলাদেশে সাক্ষরতার (কিছু লিখতে বা পড়তে জানা) হার ছিল মাত্র ২০.২%। ৩৫ বছর ও তদুর্ধ বয়সের প্রায় ৬৩% পুরুষ ও ৮৭% নারী (বাংলাদেশে নারী-পুরুষের অনুপাত ছিল ১০০:১০৮) সম্পূর্ণ নিরক্ষর। ১৫ বছর ও তদুর্ধ বয়সের পুরুষদের ১৪% এবং ঐ বয়সের নারীদের মাত্র ৩% ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত লেখা পড়া সমাপ্ত করে। উচ্চ শিক্ষা (ত্রয়ােদশ শ্রেণী ও তদুর্ধ) গ্রহণকারী পুরুষের সংখ্যা ছিল ১.৪% ও নারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ০.১% (সারণি ২.৪ দ্রষ্টব্য)। সুতরাং ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়স্ক পুরুষরা, যাদের অধিকাংশই ছাত্র, বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা সচেতন ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় গােষ্ঠী।
রাজনৈতিক যােগাযােগ : বাংলাদেশে যােগাযােগের মাধ্যম খুব অনুন্নত। সাক্ষরতার নিম্ন হার ও দারিদ্র্যের কারণে এদেশে সংবাদপত্র শিল্প উন্নতি লাভ করেনি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও সাময়িকীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৭% বেড়ে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২২। ১৯৭৮ সালে তালিকাভুক্ত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৮৮০০০, ৪৫৭২০০ ও ১৫৬৬০০।৬৫
গণযােগাযােগের অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে রেডিও ও টেলিভিশন। ১৯৭২ সালে দেশে মােট রেডিও সেটের সংখ্যা ছিল ৫০২৪৮৩। ১৯৭৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২,০০,০০০। একই সময়ে টেলিভিশন সেটের সংখ্যা ১৫,৩৫৭ থেকে ৩৫,০০০-এ বৃদ্ধি পায়।৬৬
সারণি ২.৪
বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তদুর্ধ বয়সের নারী-পুরুষের মধ্যে শিক্ষার স্তরভিত্তিক হার
(১৯৭৪ সালের হিসাব অনুসারে)
শিক্ষার স্তর | পুরুষ (শতাংশ) | নারী (শতাংশ) |
নিরক্ষর | ৬২.৮ | ৮৬.৬ |
১ম থেকে ৫ম শ্রেণী | ১৩.০ | ৬.৯ |
৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণী | ১৪.১ | ২.৯ |
১১শ থেকে ১২শ শ্রেণী | ১.৯ | ০.২ |
১৩শ শ্রেণী থেকে তদুর্ধ | ১.৪ | ০.১ |
অজানা | ৬.৮ | ৩.১ |
মােট | ১০০ | ১০০ |
উৎস : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে, Population Census of Bangladsh, 1974 (ঢাকা, ১৯৭৭), পৃষ্ঠা ৩০।
এভাবে দেখা যায় যে, ১৯৭৮ সাল নাগাদ প্রতি ২০০ ব্যক্তির জন্য একখানা দৈনিক সংবাদপত্র, প্রতি ৭০ ব্যক্তির জন্য একটি রেডিও সেট ও ২৪০০ ব্যক্তির জন্য একটি টেলিভিশন সেট ছিল। সাধারণ নিরক্ষরতা এবং আধুনিক গণমাধ্যমের
৬৯
এই অপর্যাপ্ততার কারণে জনসভা তথা মঞ্চ বক্তৃতা বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রচারণা ও যােগাযােগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
যেখানে রেডিও, টেলিভিশন ও অধিকাংশ সংবাদপত্র প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সেগুলােতে বিরােধী দলগুলাের প্রবেশাধিকার সিমাবদ্ধ সেখানে গণমাধ্যমগুলাে ক্ষমতাসীনদের একতরফা প্রচারণা যন্ত্রে পরিণত হয়। তাছাড়া বস্তুগত ও সাংগঠনিক সম্পদ বা সামর্থ্যের অভাবে রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচন বা বিশেষ সংকটকাল ছাড়া কদাচিৎ জনসাধারণের সামনে হাজির হতে পারে। ফলে রাজনৈতিক এলিট, বিশেষত বিরােধী দল ও জনগণের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান থেকে যায়। অনেক সময় জনগণ মিথ্যা প্রচারণার শিকার হয় এবং বিরােধী দলসমূহ সুস্থ প্রতিযােগিতার পরিবর্তে উত্তেজনাপূর্ণ আন্দোলনের রাজনীতিতে আত্মনিয়ােগ করে।
সূত্র ও টীকা
১. দেখুন কামরুদ্দীন আহম্মদ, A Socio-Political History of Bengal and the Birth of Bangladesh, (ঢাকা, ১৯৭৫), পৃষ্ঠা ১-২৯।
২. ১৯০১ সালে বাংলার জনসংখ্যার ৫১.২% ছিলমুসলমান এবং ৪৭% ছিল হিন্দু। দেখুন জে এইচ ব্রুমফিল্ড, Elite Conflict in a Rural Society: Twentieth Century Bengal, (বাকলী, ১৯৬৮) পৃষ্ঠা ৯-১০।
৩. ঐ পৃষ্ঠা ৪৪।
৪. ঐ, পৃষ্ঠা ২৯; মােহাম্মদ আব্দুর রহিম, The Muslim Society and Politics in Bengal, (ঢাকা ১৯৭৮) পৃষ্ঠা ২১২।
৫. কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩।
৬. কে বি সাঈদ, Pakistan: The Formative Phase, (লন্ডন ১৯৬৮), পৃষ্ঠা ৭।
৭. দেখুন লিওনার্ড এ গর্ডন, The Nationalist Movement, (দিল্লী, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ২০৪ ২০৬; ব্রুমফিল্ড, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৮৪-২৮৮।
৮. দেখুন হুমায়ুন কবির, Muslim Politics 1906-1974 and Other Essays, (কলকাতা, ১৯৬৯), পৃষ্ঠা ২৮-৩১।
৯. চৌধুরী খালেকুজ্জামান, Pathway to Pakistan, (লাহাের, ১৯৬১), পৃষ্ঠা ২৩৫-২৩৬।
১০. আবুল হাশিম, In Restrospection, (ঢাকা, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ১৪০।
১১. মােহাম্মদ আব্দুর রহিম, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৩২।
১২. রূপরেখার বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৪।
১৩. পাকিস্তান গণপরিষদ, Debates, খণ্ড ২, সংখ্যা ২ (২৫শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮) পৃষ্ঠা ১৭।
১৪. Jinnah: Some Speeches as Governor-General of Pakistan, (করাচি, ১৯৪৮), পৃষ্ঠা ৮২-৮৬।
১৫. চৌধুরী খালেকুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩১৯।
১৬. গুস্তভ এফ পাপানেক, Pakistan’s Development: Social Goals and Private Incentive (কেমব্রিজ, ১৯৬৭), পৃষ্ঠা ২০।
১৭. পূর্ব-পাকিস্তান সরকার, Economic Survey of East Pakistan, ১৯৬৯-৭০, (ঢাকা, ১৯৭০), পৃষ্ঠা ১৫।
৭০
১৮. পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশন, Reports of Advisory Panels For the Fourth Five | year Plan. Vol-1, 1970, সারণী ৩, পৃষ্ঠা ২৯।
১৯. ঐ, পৃষ্ঠা ৮৯।
২০. ঐ, পৃষ্ঠা ২৯ ও ২৭৯।
২১. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (ঢাকা, ১৯৭৫) পৃষ্ঠা ৩৪।
২২. তালুকদার মনিরুজ্জামান, Radical Politics and the Emergence of Bangladesh, (ঢাকা, ১৯৭২) পৃষ্ঠা ৩৪।
২৩. রওনক জাহান, Pakistan: Failure in National Integration (ঢাকা, ১৯৭৩), পৃষ্ঠা ৯৯।
২৪. কে বি সাঈদ, The Political System of Pakistan, (বােস্টন, ১৯৬৭), পৃষ্ঠা ১৯৫।
২৫. পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ Debates, খণ্ড ১ (৮ মার্চ, ১৯৬৩) পৃষ্ঠা ২৯-৩১।
২৬. Times (Amsterdom) ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
২৭. দেখুন, তৎকালীন পূর্ব-বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ নেতা নূরুল আমিনের বক্তৃতা, আজাদ, ১, ৫, ২০ ও ২২ জানুয়ারি এবং ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪।
২৮. বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, Report on the Election of East Bengal Legislative | Assembly, 1954 (ঢাকা ১৯৭৭) পৃষ্ঠা iii ও iv।
২৯. The Pakistan Observer, ২১ মার্চ ১৯৬৬।
৩০. ভারতের আগরতলা নামক স্থানে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত হয় বলে সরকার দাবি করেন এবং সেই সূত্রে মামলাটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে খ্যাত।
৩১. রাও ফরমান আলী, ভুট্টো- শেখ মুজিব-বাংলাদেশ (বাংলা অনুবাদ,মােস্তফা হারুন, ঢাকা, ১৯৭৮) পৃষ্ঠা ১৩।
৩২. The Pakistan Observer, ৮ এপ্রিল ১৯৬৬, ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯ ও ২০শে জানুয়ারি, ১৯৭০; দৈনিক পাকিস্তান, ৬ নভেম্বর, ১৯৭০।
৩৩. দেখুন জামায়াত-ই-ইসলামের জনসভার বিবরণ, আজাদ, ১৯ জানুয়ারি, ১৯৭০ ও মুসলিম লীগ নেতা খাজা খয়েরউদ্দীনের মন্তব্য,দৈনিক পাকিস্তান, ২রা নভেম্বর, ১৯৭০।
৩৪. দেখুন, দৈনিক পাকিস্তান, ৪ নভেম্বর ১৯৭০, The Dawn ২৯ নভেম্বর, ১৯৭০।
৩৫. পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন, Report on General Election, Pakistan, 1970-71, খণ্ড ১, ১৯৭২।
৩৬. ঐ
৩৭. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, বজ্রকণ্ঠ (ঢাকা, ১৯৭২) পৃষ্ঠা ৩-৬।
৩৮. বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মদের বিবৃতি, ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ দেখুন Bangladesh Documents পৃষ্ঠা ২৯১-২৯৮।
৩৯. পরিশিষ্ট খ দেখুন।
৪০. দেখুন, সুখরঞ্জন দাস গুপ্ত, Midnight Massacre in Dhaka. (নয়াদিল্লী, ১৯৭৮), পৃষ্ঠা ১৩-১৪।
৪১. বিস্তারিত আলােচনার জন্য দেখুন, তালুকদার মনিরুজ্জামান Radical Politics, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫১-৫২; দেবেন শিকদার, বাংলাদেশে কম্যুনিস্ট বিভ্রান্তি ও কম্যুনিস্ট ঐক্য প্রসঙ্গে ঢাকা, ১৯৭৯); তােয়াহার সাংবাদিক সম্মেলন, ইত্তেফাক, ৩১ অক্টোবর, ১৯৭৬।
৪২. এই অনুচ্ছেদটি কমুনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির অন্যতম নেতা হায়দার আকবর খান রনাে ও পূর্ব-বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টির তৎকালীন নেতা আবুল বাশারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের (মে ১৯৭৭) ভিত্তিতে রচিত। আরাে দেখুন, জ্যোতি সেন গুপ্ত, History of Freedom Movement in Bangladesh (কলকাতা, ১৯৭৫) পৃষ্ঠা ৩৪৬-৩৪৮।
৪৩. The Pakistan Observer, ১৩ জুলাই, ১৯৬৭।
৪৪. ঐ, ২৫ জুন, ১৯৬৭।
৭১
৪৫. ইত্তেফাক, ৫ জানুয়ারি, ১৯৭১।
৪৬. খাজা নাজিম উদ্দীন, খাজা শাহাবুদ্দীন, মােহাম্মদ আলী, তমিজউদ্দীন খান, ফজলুর রহমান প্রমুখ (যারা পাকিস্তানের ক্ষমতা কাঠামােতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিলেন) এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
৪৭. তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মােনেম খানের মন্তব্য দেখুন, The Pakistan Observer ৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৫।
৪৮. মুসলিম লীগ নেতা আব্দুস সবুর খানের বক্তব্য দেখুন, ঐ, ২৯ ও ৩০ জুন, ১৯৬৭।
৪৯. ঐ, ২০ জানুয়ারি, ১০৭০।
৫০. দেখুন, বদরুদ্দীন ওমর, যুদ্ধ-পূর্ব বাংলাদেশ (ঢাকা, ১৯৭৬)।
৫১. পাকিস্তান গণপরিষদ, Debates, খণ্ড ৫, সংখ্যা ৪ (১২ই মার্চ, ১৯৪৯) পষ্ঠা ৯০।
৫২. ঐ, খণ্ড ১, ২য় ভাগ (৩১ জানুয়ারি, ১৯৫৬) পৃষ্ঠা, ২২৩১, ২২৪৭-২২৪৮।
৫৩. আবুল মনসুর আহমদ, End of a Betrayal and Restoration of Lahore Resolution, (ঢাকা ১৯৭৫), পৃষ্ঠা ৯০। ১৯৬০ দশকের অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ লেখনীর জন্য দেখুন, আবুল ফজল, সমাজ-সাহিত্য-রাষ্ট্র ঢাকা, ১৯৬৮); বদরুদ্দীন উমর, সংস্কৃতির সংকট (ঢাকা, ১৯৬৭) ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (ঢাকা, ১৯৬৯); আব্দুল হক, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ (চট্টগ্রাম, ১৯৭৪)।
৫৪. আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের পূর্ণ বিবরণ দেখুন, Bangladesh Documents (নয়াদিল্লী), পৃষ্ঠা-৭০-৭৪।
৫৫. বামপন্থীদের মধ্যে ভাঙন ও তত্ত্বীয় বিতর্কের জন্য দেখুন, তালুকদার মনিরুজ্জামান Radical _Politics, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১২-১৭।
৫৬. দেখুন আজাদ, ১৭ ও ১৯ জানুয়ারি এবং ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০। ৫৭. ঐ, ২৬ জানুয়ারি, ১৯৭০।
৫৮. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে, Population Census of Bangladesh 1974, (ঢাকা, ১৯৭৭), পৃষ্ঠা ২৪।
৫৯. ঐ, পৃষ্ঠা ২৪।
৬০. ঐ, পৃষ্ঠা ২৩। ৬১. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে, 1979 Statistical Yearbook of Bangladesh, (ঢাকা ১৯৮০), পৃষ্ঠা ৫২৮।
৬২. পরিকল্পনা কমিশন, The First Five Year Plan, (ঢাকা, ১৯৭৩) পৃষ্ঠা ৮৩, ১৯৫।
৬৩. ১৯৭১-৭৫ সালে প্রতি একর জমিতে চাল উৎপাদনের গড় ছিল ১০০০ পাউন্ডের
কাছাকাছি।
৬৪. Population Census of Bangladesh, 1974, পৃষ্ঠা ৪৪।
৬৫. 1979 Statistical Yearbook of Bangladesh, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪১২, ৪১৩।
৬৬. ঐ, পৃষ্ঠা ৪৩৭।
৭২
Reference – বাংলাদেশের রাজনীতি সংঘাত ও পরিবর্তন – আবুল ফজল হক