You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ

শতাব্দীর পর শতাব্দী বাঙালি জাতি পরাধীন থেকেছে। কিন্তু ছিল তাদের মাতৃভাষা বাংলা আর ছিল ভূখণ্ড। কিন্তু ছিল না স্বাধীনতা। বাংলার শস্য-শ্যামল প্রকৃতি আর অসীম সম্পদের ভাণ্ডার বারবার ঔপনিবেশিক বিদেশী শক্তি আর সাম্রাজ্যবাদী দখলকারদের উদ্বুদ্ধ করেছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনাবিধৌত এই পুণ্যভূমি বাংলাকে করতলগত করতে। কেউ কেউ লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে এ দেশের সম্পদ। কিন্তু মুঘলরা ভারতবর্ষ থেকে ফিরে যায়নি। তারা এই দেশকে দখল করে রেখেছে। আপন করে নিয়ে নিজেদেরকে বিলীন করে দিয়েছে এ দেশের মাটি ও মায়ায়। তাই তারা স্থায়ীভাবে থেকে গেছে এ দেশে। সমগ্র ভারতবর্ষ দাপটের সঙ্গে শাসন করেছে আপন। দেশ হিসাবে। ভারতবর্ষকে রক্ষা করতে বারবার যুদ্ধ বিগ্রহে জড়িয়ে পড়েছে। জীবনবাজি রেখেও ভারতের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটেছে ব্রিটিশ শাসন আর পশ্চিম পাকিস্তানীদের বেলায়।
ভারতে ব্রিটিশের প্রায় দুইশত বছরের দুঃশাসনের প্রতিবাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে সংগ্রামেও বাঙালির ছিল এক বিরােচিত ও বিরাট অবদান। কিন্তু তাতেও বাঙালিদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। ভারতবর্ষের মাটি থেকে ব্রিটিশ তাড়ানাের পর আসে বাঙালিদের উপর পাকিস্তানী শাসন। অবশ্য ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে আধুনিকতার যাত্রা শুরু করে। ফলে ভারতবর্ষ দ্রুত আধুনিক যুগে পদার্পণ করে। কিন্তু তাদের শােষণ আর শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসী রুখে দাঁড়ায়। বাধ্য হয়ে ব্রিাটশরা ভারত ছাড়তে মনস্থ করে । ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দুটি পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। একটি ভারত এবং অন্যটি পাকিস্তান। অধিকাংশ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে পাকিস্তান যার দুটি অংশে পাকিস্তান। একদিকে পূর্ব পাকিস্তান আর অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান। মাঝে বিরাট ভারত রাষ্ট্র। প্রায় একহাজার মাইল দূরে থেকেও পাকিস্তান একসঙ্গে থাকে প্রায় ২৩ বছর । কেবল ধর্মকে পুঁজি করে পশ্চিম পাকিস্তানীরা এদেশের বাঙালিদের শাসন ও শশাষণ করে। কিন্তু স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই স্বাধীন পাকিস্তানের বাঙালি নাগরিকরা রাষ্ট্রভাষা বিতর্কে বুঝতে পারে পাকিস্তানীরা আমাদেরকে পাকিস্তানের উপনিবেশ বলে গণ্য করছে। পাকিস্তানের জাতির পিতা মােঃ আলী জিন্নাহ ঘােষণা দেয়। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বাঙালিরা তা মেনে নেয়নি। বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসাবে মর্যাদা দিতে বাঙালিদের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি। বুকের রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে বাঙালিরা সেদিন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ।
বাঙালির মায়ের ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেলেও থেমে থাকেনি পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্র আর অত্যাচার। তাদের তেইশ বছরের বর্বর শােষণ নিপীড়ন আর বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এক অংশ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ধীরে ধীরে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। তাই বাঙালিরা প্রতিবাদ থেকে প্রতিরােধ আর প্রতিরােধ থেকে প্রতিশােধ আর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে একদিন মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পরে। ১৯৬৬ সালে বাঙালির প্রাণের দাবি ৬দফা দাবি তােলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। এই দাবি আদায়ে সমগ্র বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধিকার আন্দোলনে। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই একদিন শুরু হয়ে যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আর তারই ফলশ্রুতিতে প্রায় ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে এবং প্রায় দুই লক্ষ মা বােনের ইজ্জতের বিনিময়ে একদিন এই দেশকে স্বাধীন করে। পৃথিবীর মানচিত্রে এক নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের মানচিত্র অংকিত হয়। বাঙালি জাতির স্বাধীন পতাকা উড়তে থাকে সারা পৃথিবীতে। আজ বাঙালি জাতির মাতৃভাষার আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত দিনটি ২১শে ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পায় অন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ২০০০ সালে। ছােটবেলা থেকেই আমি ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বড়ভাই ও আত্মীয়দের সাথে প্রভাতফেরীতে যেতাম। যা এখনও অব্যাহত আছে। তখনকার ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন আর এখনকার পালনে বেশ পরিবর্তন এসেছে। তখন ভাের বেলায় খালি পায়ে কালাে বেজ ধারণ করে ধীরগতিতে এক শােকের ভাব নিয়ে প্রভাতফেরীতে পুরুষ মহিলা ফুল দিয়ে যেত বেদিতে। তখন কোনাে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান ২১শের বেদীতে ফুল দিতে আসত না। ২১শের বেদনা কেবল এ দেশের বাঙালি জনতার হয়ে থাকত। কারণ তখন ছিল পাকিস্তানী শাসন। আর এখন ২১শের অনেক পরিবর্তন। এখন ২১শে আনন্দ বেদনার। এখন ২১শের প্রথম প্রহর থেকে শুরু হয় ২১শের বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবার পালা। রাত ১২টা এক মিনিটে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা জানান প্রথমে। তারপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ছাত্র-জনতা সারিবদ্ধভাবে ফুল নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে দুপুর পর্যন্ত । এখন শহীদ মিনার আর বাংলা একাডেমীর সারা চত্বরে বসে মেলা। নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে নিয়ে বসে রাস্তা ভরে। ২১শের চেতনা চলে বাংলা একাডেমীতে মাসভরে বইমেলা, কবিতা রচনা, আর আবৃত্তি করার উৎসব নিয়ে চলে সাংস্কৃতির অনুষ্ঠান, বাঙালি আর বাংলা সংস্কৃতি এগিয়ে চলেছে ২১ কে নিয়ে। এ চেতনা চিরদিন বেঁচে থাকুক এই আমার প্রত্যাশা। বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে যেতে বাধ্য হয় ‘৭১-এর ২৫শে মার্চের পাক হানাদারদের আক্রমণের জবাবে । ঐ রাতের হত্যা হার মানায় চেঙ্গিস খান, হালাকুখকেও। যা মনে হলে শিউরে উঠে সেই সময়কার মানুষরা। আমি তার একজন। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি মনের তাগিদে। দেশের স্বাধীনতার জন্য লক্ষ লক্ষ বাঙালি প্রাণ দিয়েছে যে আবেগে আমারও সেই আবেগ কাজ করেছে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে।বিভীষিকাময় কালরাত্রি
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাত্রি এ দেশের জনগণের জীবনে নেমে আসে এক ভয়াবহ রাত যাকে কালরাত্রি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। এই রাতে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাঙালি জাতির উপর বর্বর পাকিস্তানী সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। ট্যাংক কামানের গােলায় গুড়িয়ে দেয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তর (পরবর্তীতে বিডিআর)সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী হলগুলিতে। একরাতের তাণ্ডবে ঢাকা শহরেই প্রাণ হারায় লক্ষাধিক নিরস্ত্র নিরীহ ঘুমন্ত জনতা। লুষ্ঠিত হয় হাজার হাজার মাবােনের সম্ভ্রম । কিন্তু না। তবুও হানাদারেরা স্তব্ধ করে। দিতে পারেনি বাঙালির মনােবল আর মুক্তির নেশা। সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ঘুমন্ত পুলিশগণ ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে উঠলেও তারা প্রাণের বিনিময়ে হলেও আক্রমণ প্রতিহত করে। এই দিনে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের বীরদর্পে যুদ্ধ আর আত্মত্যাগের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হবে। তেমনি ভাবে সারাদেশে। পাকিস্তানী সৈন্যরা আক্রমণ চালায় নিরীহ বাঙালি ও সেনানিবাসগুলােতে আর বাঙালি সৈন্যদের সহ হত্যা করে নিরীহ লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে। এই অবস্থায়ও যে যেখানে যে অবস্থায় আছে বাঙালি সৈন্য জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে প্রতিহত করে বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যদের। দিশেহারা বাঙালি রুখে দাঁড়ায় পাকিস্তানীদের আক্রমণ । যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে বাঙালি জাতি প্রতিহত করে বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যদের। বাঙালির দামাল ছেলেরা জীবন বাজি রেখে অসীম সাহসিকতায় শত্রুর আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদের সাথে মােকাবেলা করেছে বীরদর্পে। শুরু হয় দখলকারীদের থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এই মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির সর্বস্তরের জনতা জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষই কোনাে না কোনােভাবে এই যুদ্ধে সাহায্য সহযােগিতা করে। কেবল হানাদার বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে দেশের বিরােধিতা করে কিছু কুলাঙ্গার, রাজাকার, আলবদর, আলসামস দালালচক্র জামাত নামক এক রাজনৈতিক দল এই যুদ্ধে বিরােধিতা করে বাঙালি নিধনে সহযােগিতা করে হায়েনাদের । নিজের জীবন বাজি রেখে প্রায় নয় মাস যুদ্ধ করে প্রায় ত্রিশ লক্ষ জনতার জীবন এবং প্রায় দুই লক্ষ মা-বােনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাঙালিরা নিজেদের মুক্ত করে। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির এই মহান মুক্তিযুদ্ধের আমি এক গর্বিত সৈনিক। এ আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।

আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর অসহযােগের ডাকে সমগ্র দেশ অচল হয়ে পড়ে। পাকিস্তান সরকারের কোনাে কর্তৃত্বই আর রইল না দেশে। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যাংক বীমা সব বন্ধ। অচল দেশ। আমি তখন বেকার যুবক। থাকি পরিবারের সাথে আখাউড়া রেল কলােনিতে। কলােনির তরুণ যুবকদের নিয়ে আমরা একটি দল গঠন করি । রেলওয়ে পুলিশের একজন হাবিলদার আব্দুর রশিদ তার সরকারি ৩০৩ রাইফেল দিয়ে রেলওয়ে স্কুল মাঠে আমাদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ
৫০
দিতে লাগলেন। ক্রলিং করা, গ্রেনেড চার্জ এবং নিশানা স্থির করাসহ যুদ্ধাবস্থায় জরুরি পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার কৌশল শেখানােই ছিল এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য। আর সুযােগ বুঝে নিজেকে বাঁচিয়ে অতর্কিতে শত্রু পক্ষের উপর আক্রমণ চালান এবং সরে পড়া। আমাদের সকলের মাঝে তখন সেকি উত্তেজনা। গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের দেশ-মাতৃকাকে স্বাধীন করার স্বপ্নে বিভাের আমরা সবাই। ক্রলিং করতে করতে হাতের কনুই ও হাঁটু দিয়ে রক্ত ঝরছে। তবু আমাদের বিরাম নেই। মােকাবিলা আমাদের করতেই হবে। শত্রুমুক্ত করতে হবে আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে। চলতে থাকলাে প্রশিক্ষণ এবং সকাল সন্ধ্যায় এসব বিষয়ে আলােচনা। আমাদের এখন একটাই কাম্য মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করা।
‘৭১-এর মার্চের উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠায় একদিন নেমে এল বাঙালি জাতির উপর সেই কালরাত্রি ২৫শে মার্চ। ভাের রাতেই আমরা আখাউড়া রেলওয়ে টেলিকমিউনিকেশনের মাধ্যমে ঢাকায় পাকবাহিনীর বর্বর গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার খবরটি পেয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ে এ খবর । সকালের মধ্যেই উত্তেজিত জনতা-ছাত্র যুবক সম্মিলিতভাবে আখাউড়া রেলস্টেশনের দক্ষিণে গঙ্গাসাগর রেলসেতুর উত্তর পাড়ে এবং স্টেশনের উত্তর দিকে তিতাস নদীর উপর রেলসেতুর পশ্চিমপাড়ে রেল লাইন তুলে ফেলি। উদ্দেশ্য যাতে হানাদার বাহিনী আখাউড়া জংশনে প্রবেশ করতে না পারে। এই কাজের জন্য সেদিন আমরা কারাে নির্দেশের অপেক্ষা করিনি। কারণ, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতিকে নির্দেশ দিয়েই রেখেছিলেন, “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তােমাদের কাছে অনুরােধ রইল। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ই মার্চের নির্দেশই আমাদের মাঝে এই উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য পরে মুক্ত এলাকা আখাউড়া বাহ্মণবাড়ীয়া মুক্ত থাকা অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচল যােগাযােগের জন্য রেল লাইনটি আবার চালু করা হয়। এটা ছিল আমাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ।
এভাবে সারাদিন কেটে গেল রাত যেন আর শেষ হয় না। বিভিন্ন দিক থেকে হানাদারদের অত্যাচার আর গণহত্যার লােমহর্ষক সব খবর আসতে লাগল। খবর আসতে লাগল ঢাকা শহরের ধ্বংসলীলা আর গণহত্যারও। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার ইপিআর ক্যাম্প এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের ওপর কামানের আক্রমণ আর হত্যাযজ্ঞের খবর পেয়ে আমরা কেবল উত্তেজিত হতে থাকি। কত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ঢাকায় রয়েছে, তাদের জন্যেও দুশ্চিন্তায় মনকে গ্রাস করে। কিন্তু সব ছাপিয়ে মনের মধ্যে জেগে উঠে প্রতিশােধের আগুন । উত্তেজনা, উৎকণ্ঠায় কেটে গেল ২৬শে মার্চ । ভাের হতে না হতেই বন্ধু রফিক আর আমি স্থির করলাম আগরতলায় যাব । আগরতলা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী। যা আখাউড়া থেকে মাত্র ৫/৬ কিলােমিটার দূরে পূর্ব সীমান্তে । ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে এই সীমান্ত দিয়েই পূর্ব পাকিস্তান আর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে চলত আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় এই সীমান্ত বন্ধ হয়ে যায় ।
৫১
অস্ত্রের সন্ধানে আগরতলায় গমন
২৭শে মার্চ ১৯৭১ সাল। দিনটি আমার জীবনে এক স্মরণীয় দিন। সেইদিন দলের বন্ধু রফিককে সাথে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলা যাবার পরিকল্পনা করলাম। উদ্দেশ্য অস্ত্র ও সাহায্যের সন্ধান। কারণ একটা বিষয় আমি বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করছিলাম যে, আমাদের মনােবল যতই কঠিন হউক না কেন, আমরা দেশের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পারব কিন্তু দেশকে মুক্ত করতে হলে আমাদেরকে কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। কাজেই এভাবে গােটা কয়েক রাইফেল, লাইসেন্স করা বন্ধু আর বাঁশের লাঠি আর রেল লাইন উপড়ে ফেলে অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত পাক হানাদার বাহিনীর গতিরােধ করা যাবে না। গেরিলা যুদ্ধের জন্যও উন্নত প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধাস্ত্র চাই। মনে একটা আশঙ্কাও কাজ করছে। আমি কোনাে নামী দামী রাজনৈতিক বা খ্যাতিমান ছাত্রনেতা নই। আমার আহ্বানে কি প্রতিবেশী দেশের সরকার সাড়া দেবে? কেউকি সাহায্যের হাত বাড়াবে? তবু মনের তাগিদে বুকভরা আশা নিয়ে দেশমাতৃকার মুক্তির টানে কিছু না বুঝেই পা বাড়ালাম অজানা অচেনা প্রতিবেশী দেশের উদ্দেশ্যে। দেশ ভিন্ন হলেও আগরতলা শহরের অধিকাংশ বাসিন্দাই কোনাে না কোনাে ভাবে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, আখাউড়ার আদিবাসী। ধর্ম যাই হউক তারা বাঙালি । তাদের অনেকেই সাতচল্লিশের পর থেকে পাকিস্তানীদের অত্যাচারে নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করে ধীরে ধীরে এখান থেকে ওপারে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তাদের সহানুভূতি ও সাহায্য অবশ্যই পাওয়া যাবে। এখনাে তাদের আত্মীয়-স্বজন জমিজমা রয়েছে এদেশে। নাড়ীর টানে তারা অবশ্যই সাড়া দেবে। এই ভরসা নিয়েই দুপুরের পর আগরতলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। সঙ্গে বন্ধু রফিক। দুজনে আখাউড়া থেকে রিক্সা নিয়ে আগরতলার সীমান্তে পৌছলাম। ত্রিশ মিনিটের পথ পেরিয়ে সীমান্ত। চৌকিতে এসে উপস্থিত হলাম। আজ এই দুর্দিনে বাইরের সাহায্য আমাদের একান্ত প্রয়ােজন। হানাদারদের অত্যাচারের জবাব দিতে আমাদের অস্ত্র চাই, চাই ট্রেনিং, চাই জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করা, চাই বুকের রক্তে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করা। মনের স্পৃহা আর অদম্য সাহস নিয়ে সীমান্তে এসে উপস্থিত হলাম। তখন আমাদের বয়সও পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাব এবং মুক্তির নেশা আমাদেরকে তাড়িত করেছে এই পদক্ষেপ নিতে।
সীমান্ত চৌকিতে পৌঁছলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিওরিটি ফোর্স (বিএসএফ) আমাদের সীমান্ত অতিক্রমে বাধা দেয়। কারণ পাকিস্তানী নাগরিকদের জন্য ভারতে অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এখানে আসার আগে এই কথাটাও মনে আসে নাই আমাদের মনের মধ্যে কেবল কি করে দেশের দুর্দিনে কিছু করা। বাঁধা পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। তাহলে আজ আমাদের এখান থেকেই ফিরে যেতে হবে । এ সময় সীমান্তের ওপারে আগরতলা কলেজের কিছু ছাত্র জনতা অধীর আগ্রহে বাংলাদেশের অবস্থা জানার জন্য অপেক্ষা করছিল। ওরা ওপার থেকে আমাদের সাথে কথা বললেন। মাঝে লােহার গেইট আর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী দাড়ান। ওরা জানতে চাইলাে দেশের কি অবস্থা, আমাদের আগরতলায় যাবার উদ্দেশ্যে। আমরা ২৬শে মার্চে কালরাত্রির কিছু বর্ণনা দিলে তারা আমাদেরকে সহযােগিতা করতে আগ্রহ জানাল এবং আগরতলা নিয়ে যেতে চাইল । সীমান্ত চৌকি দিয়ে না গিয়ে সীমান্ত অতিক্রম
৫২
করতে তারা আমাদেরকে চেক পােস্টের কিছুটা উত্তর দিকে যেতে অনুরােধ করে। সীমান্তরক্ষীরা তাতে কোনাে আপত্তি করছে না দেখে আমরা সেদিকে অগ্রসর হই। কিন্তু সেখানে সীমান্ত অতিক্রমে বাধা হয়ে দাঁড়ায় একটি ছােট খাল। আমরা ভাবছি খালে কত পানি। পায়ের জুতা খুলে পানিতে নামার প্রস্তুতি নিতেই আগরতলার ২জন কলেজ ছাত্র বুক সমান পানিতে ভিজে এপাড়ে এসে এক রকম জোর করেই আমাদের দু’জনকে কাঁধে তুলে ওপাড়ে নিয়ে যায়। সীমন্তরক্ষীরা এদিকে তাকিয়ে রইল। কিছুই বলল না। আমাদের মুখে বাংলাদেশের দুরাবস্থার বিস্তারিত শুনে তখনই তারা আমাদের আগরতলা রাজ্য কংগ্রেস অফিসে যাবার আমন্ত্রণ জানায়। ভারতবর্ষে কংগ্রেস দল তখন ক্ষমতায়। আমরা সানন্দে তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দেই। উত্তেজনা আর আনন্দে আমাদের বুক ফুলে উঠে। আমরা তাদের সাথে পথ চলতে থাকি। মনে হলাে। আগরতলার রাজপথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সৈনিকের বেশে আমরা হেঁটে চলেছি। সঙ্গী ছাত্র জনতার সাথে পথে পথে আরাে ঔৎসুক্য জনতা যােগ দেয়। আমাদের চলার পথ এক সময় মিছিলের রূপ নেয়। যানবাহন, পথচারী রাস্তা ছেড়ে একপাশে দাঁড়ায়। অনেকেই প্রশ্ন করেন, ওরা কারা? ছাত্ররা উত্তর দেয় বঙ্গবন্ধু । ওরা জয় বাংলার মানুষ। বঙ্গবন্ধু বলতে তারা হয়ত সেদিন বুঝতে চেয়েছিল আমরা বাংলাদেশের মানুষ, তাদের বন্ধু । কিন্তু ওরা হয়ত তখন পর্যন্ত জানতাে না যে, এদেশের জনগণ ইতিমধ্যেই তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করেছে। যার আহ্বানে ও নির্দেশেই আমরা আজ বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রামে একতাবদ্ধ। আমাদের আগরতলায় আগমন তারই সেই নির্দেশের প্রতিফলন।
ছাত্রদের সাথে চলতে চলতে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাই আগরতলার রাজবাড়ির গেইটে রাজ্য কংগ্রেস দপ্তরে। ছাত্ররা আমাদেরকে রাজ্য কংগ্রেসের সচিবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সচিব আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করেন। তিনি এবং তার অন্যান্য সহকর্মী আমাদের দেশের অবস্থা জানতে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারা আমাদেরকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে থাকেন। আমরা একে একে তুলে ধরি নিরস্ত্র বাঙালি জনতার উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরােচিত হামলার কথা। তুলে ধরি ঢাকাবাসীর ওপর পাকিস্তানী হায়েনাদের বর্বর আক্রমণ, আর হত্যাযজ্ঞের কথা । নেতৃবৃন্দ আমাদের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন এবং আমাদের কি সাহায্য করতে পারেন তা জানতে চান। আমরা তাদের কাছে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার অনুরােধ জানাই। কংগ্রেস সচিব কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ ছাড়া আমাদের অস্ত্র সরবরাহ সম্ভব নয় বলে জানান। তবে। আমরা চাইলে তাদের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ থাকা খাওয়ার ব্যবস্থার আশ্বাস দেন। তাদের এই ব্যবস্থা দলীয়ভাবে। আমরা আশ্বস্ত হলাম । রফিকের সঙ্গে পরামর্শ করলাম যে, দলের সাথীদের নিয়ে এখানে এসে ট্রেনিং নেব। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারের কথা নৃশংস বর্বরতার খবর বিশ্ববাসীর কাছে প্রচারের জন্যও আমরা কংগ্রেস সচিবকে বিশেষভাবে অনুরােধ জানাই। কারণ পাক হানাদারদের এই নৃশংস বর্বরতার খবর বিশ্ববাসীকে জানানাের আর কোনাে রাস্তা তখন আমাদের সামনে ছিল না। আজকের মতাে প্রচার মাধ্যম তখন
৫৩
আমাদের দেশে ছিল না। যা কিছু সুযােগ ছিল তাও পাকিস্তানীরা খবর প্রচারের সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে সকল বিদেশী বার্তাসংস্থা ও পত্রিকার প্রতিনিধিদের এদেশ থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। দেশের এক এলাকার অত্যাচারের কথা এবং বীর বাঙালিদের প্রতিরােধের খবরাখবর অন্য এলাকায় জানার উপায় ছিল না। আমাদের অনুরােধে কংগ্রেস সচিব বাংলাদেশে পাক হানাদারদের নির্যাতনের খবরাখবর দেশ বিদেশে প্রচারের আশ্বাস দেন। আমরা তাদের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে পাক সেনাদের অত্যাচার, গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ এবং বাঙালি মুক্তিসেনা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন খবরাখবর ব্রাহ্মণবাড়ীয়া আখাউড়া এবং আশপাশের সহ দেশের বিভিন্ন এলাকার খবরা-খবর যা কিছু জানতে পেরেছি আমাদের এলাকা মুক্ত থাকা পর্যন্ত আকাশবাণীতে প্রচারের জন্য পাঠিয়েছি। যথারীতি তা আকাশবাণী ও ভারতের উল্লেখযােগ্য সকল পত্র-পত্রিকায় প্রচারও হয়েছে। সীমিত সুযােগে এবং নিজের উদ্যোগে দেশের জন্য সেই সময় এইটুকু কাজ তখন করতে পেরে নিজেকে। ধন্য মনে করছি।
রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের সাথে আলাপ করতে করতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এল । সচিবের সাথে কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর ছাত্ররা আমাদেরকে শহরের একটি হােটেলে খাবারের জন্য নিয়ে যায় এবং জনৈক ছাত্রের বাড়িতে রাত যাপনের ব্যবস্থা। করে। আমরা রাতে ঐ বাড়িতে আশ্রয় নিলেও মুহূর্তের মধ্যে পাড়ার মানুষজন আমাদের আগমনের খবর পেয়ে যায়। পুরুষ, মহিলা, যুবক, বৃদ্ধ ভিড় জমায় সেখানে। প্রতিটি মানুষ যেন আমাদের কাছ থেকে আমাদের এই দুরাবস্থার খবর জানতে চায়। তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে রাত গভীর হয়ে আসে। বাড়িটি যেন একটি জনসভায় পরিণত হয়। আমাদের অবস্থা দেখে এবং আমাদের বিশ্রামের কথা ভেবে ছাত্ররা বারবার অনুরােধ জানায় আর বিরক্ত না করার জন্য এবং এক প্রকার জোর করেই লােকজন সরিয়ে আমাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে।
আমরা ক্লান্ত, মনের অবস্থা ভীষণ খারাপ। কিছুই যেন ভাল লাগছে না। ছাত্ররা সযত্নে আমাদের ঘুমােবার ব্যবস্থা করেছে। তাদের আন্তরিকতায়ও আমরা মুগ্ধ। কিন্তু ধবধবে সাদা চাদর বেষ্টিত বিছানায় শুয়েও সারা রাত আমার চোখে ঘুম আসেনি । মনের মধ্যে সর্বক্ষণ উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা। আখাউড়ায় মা-বাবা, ভাই-বােনদের চিন্তায় আর দেশের দুরাবস্থার কথা ভেবে ছটফট করতে থাকি। তাছাড়া ভিনদেশের অচেনা পরিবেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করায়ও শঙ্কাষিত। চোখের উপর ভেসে আসছে হত্যা আর প্রজ্বলিত আগুনের লেলিহান শিখা। আমার সারা দেহ রাগে দুঃখে উত্তেজনায় উত্তপ্ত । আমি যেন কিছুই করতে পারলাম না । ব্যর্থতার গ্লানি যেন আমার মনকে বিষন্ন করে তােলে। অশান্ত হৃদয়ে সারা রাত নানা স্মৃতি মনে পড়তে লাগলাে । মনে পড়তে লাগলাে আখাউড়ার অবাঙালি বিহারীদের কথা। একই এলাকায় বসবাস করে একই স্কুলে পড়াশুনা করা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে আমাদের কেমন যেন একটা ব্যবধান ছিল। তারা কিছুতেই আমাদের সাথে মিশতে চাইত না। তাদের সমাজ যেন আলাদা। বাঙালিদের প্রতি তাদের আচরণে মনে হত তারা আমাদের হেয় মনে করছে। এই দেশটি যেন তাদের। পাকিস্তান তাদের রাষ্ট্র। আর পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী যেন তাদের প্রভু যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে বরাবরই বাঙালি মুসলমান
৫৪
হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টায় মেতে ছিল, ‘৬৫ -এর পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তানীরা এদেশে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে স্থায়ী বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। পাকিস্তানীরা গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সৃষ্টি করছে হিন্দু এবং হিন্দুস্তানের প্রতি আমাদের বিদ্বেষ। তাদের মিথ্যা প্রচারে আমরা মােহিত হয়ে বাঙালি জাতীয়তা প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিলাম। এই সুযােগে পাকিস্তানীরা বিহারী মুসলমানদের পুনর্বাসনদের নামে এদেশে তাদের প্রতিনিধি সৃষ্টি করেছে। যদিও এই বিহারীরা বারবার রায়ট করে হিন্দ জনগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে অত্যাচার করে। হত্যাযজ্ঞ চালায়। ফলে এই বিহারীদের কারণেই হিন্দু-মুসলমানের দূরত্ব ঘনীভূত হয়। পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রে বাঙালি মুসলিম হিন্দু পরস্পরের থেকে দূরে যেতে লাগলাম। কিন্তু এই ধর্মীয় অহমিকা যে মানবতার যুদ্ধ আর জাতীয়তার লড়াইয়ের কাছে হার মানে, তার প্রমাণ আমরা আজ আগরতলা শহরে এসে পেলাম। তাদের আদর আপ্যায়ন আমাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং সহযােগিতার যে উদারতা দেখিয়েছে তা আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে। ভেঙেছে আমাদের অনেক দিনের ভুল ধারণা। তেমনি ভাবে কোনাে কোনাে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভিতরও মুসলমানদের উপর ধর্মীয় কুসংস্কারের প্রভাব ছিল প্রকট। যা ছােট বেলায় আমার মনেও দাগ কেটে ছিল। আজ আমার সেই ধারণা পাল্টাল। মনে পড়ে গেল ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের কথা। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান হুংকার দিলেন একদিনে দিল্লী দখল করে নেবেন। অথচ পাকিস্তানের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দূরত্ব প্রায় ১ হাজার মাইল। মাঝে ভাত রাষ্ট্র কিন্তু যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করার কোনাে ব্যবস্থাই তিনি করেননি। তখন আখাউড়ায় আমরা কিছু তরুণ সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং নিই, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য কিভাবে কাজ করতে হয় । আকাশপথের বিমান আক্রমণের বােমা হতে বাঁচার জন্য বাংকার খনন, আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া, নাগরিকদের সচেতন করা, সময় মতাে সাইরেন বাজলে বাংকারে আশ্রয় গ্রহণ করা, নিপ্রদীপ মহড়া দেয়া ইত্যাদি। একদিন সত্যি সত্যি সাইরেন বাজল। বিমান আক্রমণের সংকেত। লােকজন দৌড়াদৌড়ি করে অনেকে বাংকারে আশ্রয় নিল। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, নিস্তব্ধ রাত। আমি হেলমেটটা মাথায় দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে বের হলাম বিমান আক্রমণ হলে নাগরিকদের সাহায্য করতে। কিন্তু সাথীদের কাউকে দেখা গেল না। বিমান আক্রমণও হলাে না। ‘৬৫ সালের এই যুদ্ধে বাঙালিদের মনে এই ধারণা সৃষ্টি হলাে যে, পাকিস্তানীরা বাঙালিদের বন্ধু বা এক জাতি হিসাবে গণ্য করে না। তাই বাঙালিদের মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে। থাকে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পদ বণ্টন বাঙালিদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। তাইত বাঙালিরা প্রতিবাদী হয়ে উঠে। তারই ফলশ্রুতিতে স্বাধিকার আন্দোলন। আজ আমাদের উপর কর্তব্য হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন।
এমনি উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তার মধ্যে এক সময় ভাের হলাে। রফিককে ডেকে উঠালাম। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে আখাউড়ায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাত্রদের কয়েকজন এসে উপস্থিত হলাে। আমরা তখনই তাদের কাছে বিদায় চাইলাম। ওরা আমাদেরকে কিছু না খাইয়ে ছাড়তে চাইছে না। তাই অপেক্ষা করতে অনুরােধ করল। কিন্তু আগরতলায় আমাদের আগমন এবং কংগ্রেস নেত্রীবৃন্দের সঙ্গে আলােচনার অগ্রগতি আখাউড়ায় সংগ্রামী সাথীদের দ্রুত জানাবার কথা বলে ছাত্রদের কাছ থেকে এক প্রকার
৫৫
জোর করেই বিদায় নিলাম। মনে হল আমাদেরকে এখনই কিছু করতে হবে দেশের জন্য। হুট করে দেশত্যাগ করে অন্য দেশে চলে আসা এবং বাড়িতে কাউকে কিছু না বলা ও তাড়াতাড়ি দেশে ফেরার তাগাদা মনে বাসা বাঁধে। অবশ্য কয়েকজন ছাত্র আমাদেরকে সীমান্ত চৌকি পর্যন্ত পৌছে দিল। আজ আগরতলার মানুষদের মনে হল। আমাদের আত্মীয়। তারা আমাদের এই দুর্দিনে কিছু করতে খুবই আগ্রহী। আমরা এবার সীমান্তরক্ষীদের উপস্থিতিতে সীমান্ত চৌকি দিয়েই দেশে ফিরে এলাম। সীমান্ত রক্ষীরা আমাদের সাথে করমর্দন করে বিদায় দিল। তাদের চোখের ভাষায় মনে হল তােমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাও। আমরা আছি তােমাদের সাথে। আমরা যেন এক শক্তি ও কঠিন মনােভাব নিয়ে দেশে ফিরছি। দেশের মাটিতে পা দিয়েই মনে মনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে আগরতলাবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালাম। মনে মনে নিজেকে গর্বিতও মনে হলাে। আমাদের প্রতি তাদের ভালবাসা এবং সেই অচেনা ছাত্রদের আচরণ আমার হৃদয়ে চিরজাগ্রত হয়ে উঠল। স্মৃতির পটে সদাজাগ্রত সেই দিনটি। সেই দিন আমাদের কাঁধে তুলে নেয়া দুজন ছাত্রের নাম আমার এখনও মনে আছে থাকবেও চিরদিন। তারা হলেন অনিল ও তুহিন। জানি না আমাদের সেই দিনের অকৃত্রিম বন্ধুরা। কোথায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার ও ভারতের অগণিত জনগণ নানা ভাবে আমাদের সাহায্য সহযােগিতা করেছে, আত্মত্যাগ করেছে। জীবন দিয়েছে ভারতীয় সৈন্য। আমরা কি তার প্রতিদান দিতে পারব কোনােদিন?
আখাউড়া ফিরে সংগ্রামী বন্ধুদের আগরতলা সফরের বিস্তারিত অভিজ্ঞতা বললাম এবং দ্রুত একটি দল নিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পুনরায় আগরতলায় যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম । দেশের স্বাধীনতাকামী সব যুবক তখন ভারত যাওয়ার মতাে মানসিক প্রস্তুতি অর্জন করেনি। তাছাড়া যুদ্ধ সম্পর্কেও তাদের তেমন উল্লেখযােগ্য ধারণা নেই। রেল লাইনের পাথর, বাঁশের লাঠি আর দু-চারটে গাদা বন্ধুক দিয়েই ওরা পাকিস্তানীদর মেরে তাড়িয়ে দিবার জন্য ওঠে পড়ে লেগেছে। টান টান। উত্তেজনা। আমাদের এলাকা আখাউড়া এখনও মুক্ত। স্থানীয়ভাবেই এসময় আমাদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে আত্মনিয়ােগ করতে হয়।

যুদ্ধের প্রস্তুতি
মুক্তএলাকা আখাউড়ায় পূর্ণোদ্যমে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। চারদিকে সাজ সাজ রব। যুবকদের মধ্যেও ব্যাপক উদ্দীপনা। পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে হবে। প্রতিরােধ করতে হবে হানাদারদের আক্রমণ। নিতে হবে প্রতিশোেধ। মুক্ত এলাকায় ব্রাক্ষণবাড়ীয়া, আশুগঞ্জ, আখাউড়া, কসবায় অবস্থান নিল বাঙালি সৈন্য বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্র-জনতা। আমিও এই বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আখাউড়া প্রতিরােধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হলাম। ব্রাক্ষণবাড়ীয়া ও তার আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখন মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে আমরা রাত-দিন পরিশ্রম ও অতন্দ্র প্রহরায় নিয়ােজিত । দিনরাত আমরা ট্রেনিং নিচ্ছি কিভাবে শত্রুর মােকাবেলা করব । কিভাবে আত্মরক্ষা করব । আমাদের মনে আর কোন ভাবনা নাই । কিভাবে আমরা এই দেশ থেকে পাক হানাদারদের বিতাড়িত করব। এই নিয়েই
৫৬
আমাদের পরিকল্পনা চলছে দিনরাত । আমরা প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করব ইনসাল্লাহ বুকে গুলি নিয়ে হলেও।
এপ্রিলের প্রথম দিকে আমার এক ভাই এম.এ. হান্নান একটি চাইনিজ রাইফেল নিয়ে আখাউড়া এসে আমার সাথে দেখা করেন। হান্নান পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকরি করেন, বিমান বাহিনীর সৈন্যদের ট্রেনিং করাননাই তার কাজ। তিনি মার্চ মাসেই ছুটিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। একই গ্রামে পাশাপাশি আমাদের বাড়ি। হান্নান ভাই আমাকে বললেন ইপিআর এর বাঙালি জোয়ানদের বর্ডার থেকে তুলে আনতে হবে এবং তাদেরকে মূল মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত করতে হবে। আমি মেজর খালেদ মােশাররফের কাছ থেকে সেই নির্দেশ নিয়ে এসেছি। তুমি চল আমার সাথে। আমাকে তােমার সাহায্য করতে হবে। মেজর খালেদ মােশাররফ ইতােমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় পাকিস্তান সেনা বাহিনীর পাঞ্জাবী কমান্ডারদেরকের পরাভূত করে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নিয়ন্ত্রণ নেন এবং তিনি মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছেন।
একটি রিক্সায় দুজন আখাউড়ার উত্তর দিকে আজমপুর সিংগারবিলে ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী একটি ইপিআর ক্যাম্পে উপস্থিত হলাম। সেখানে সার্জেন্ট হান্নান ইপিআরএর সুবেদার মেজরের সাথে আমাদের আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন মেজর খালেদ মােশাররফের নির্দেশ সকল ইপিআর জোয়ানদের নিয়ে বর্ডার ছেড়ে তাঁর বাহিনীতে যােগ দিতে হবে। সুবেদার সাহেব জানালেন, আমরা সতর্ক আছি এবং আমাদের সাথে যত পশ্চিম পাকিস্তানী জোয়ান আছে তাদের পাহারায় রেখেছি। তবে মেজর খালেদ মােশাররফের লিখিত নির্দেশ না পেলে তিনি বর্ডার ছেড়ে আসতে পারবেন না বলে আমাদের জানান। অগত্যা আমাদের ফিরে আসতে হল। এর পরের ঘটনা হান্নান ভাই আর আমাকে অবহিত করেননি। অবশ্য বর্ডারের সকল ইপিআর সদস্যই পরবর্তীতে মূল বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে। আখাউড়া পতনের পর গ্রামে গিয়ে আমি আর হান্নান ভাইকে খুঁজে পাইনি। কেননা ইতােমধ্যে চাকরিতে যােগ দিতে পুনরায় তিনি পশ্চিম পাকিস্তান চলে গেছেন। পরে দেশ স্বাধীন হবার পর তার রাইফেলটির কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি আমাকে জানান সেই রাইফেলটি তিনি কোনাে এক পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন। এভাবে হান্নান ভাই পাকিস্তান বিমান বাহিনীর চাকরি রক্ষা করলেন। এদিকে শক্তি সঞ্চয় করে বাঙালি সৈন্যরা মেজর খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে মুক্ত এলাকা রক্ষার জন্য প্রস্তুত হল। আমরা কিছু যুবক তার বাহিনীর সাথে যােগ দিলাম । মুক্ত এলাকা মুক্ত থাকা অবধি। আমি এই বাহিনীর সাথে থেকে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি।

আখাউড়ায় ইপিআর সদর ক্যাম্প দখল
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। তার সীমান্তবর্তী এলাকা আখাউড়া পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ জংশন। ব্রিটিশ আমলেও এই রেল জংশন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ত্রিপুরাসংলগ্ন চোরাচালানের স্বর্গরাজ্যও আখাউড়া । তাছাড়া সামরিক কৌশলগত দিক থেকেও আখাউড়া গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল) পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই সংস্থার নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ
৫৭
রাইফেল (বিডিআর)-এর একটি সদর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে এখানে। এরাই এ অঞ্চলের সীমান্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রারম্ভ থেকে ইপিআর-এর অবাঙালি সদস্যরা আখাউড়ায় তাদের আঞ্চলিক সদর ক্যাম্প দখল করে বসে রইল। প্রচুর গােলাবারুদ আর সীমান্ত রক্ষার উপযােগী অস্ত্রশস্ত্র এখানে মজুদ রয়েছে। আখাউড়া এলাকা এখন পর্যন্ত মুক্ত এবং সীমান্ত মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। ইপিআরএর পশ্চিমা জোয়ানরা পুরা সদর ক্যাম্প চারদিক থেকে কঠোর প্রতিরােধ গড়ে তুলে দূর্গ সৃষ্টি করেছে। হয়ত তাদের ধারণা ছিল পাকআর্মি আখাউড়া দখল নিলে তারা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু পাকআর্মি আখাউড়া দখল করার আগেই আমরা ইপিআর ক্যাম্পটি মুক্ত করার পরিকল্পনা নিলাম। বাঙালি ইপিআর, আনসার ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমন্বয়ে সম্মিলিত বাহিনী গঠন করা হল। স্থানীয় ছাত্র-জনতাও এই বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত। ব্যাপক রক্তপাত এড়ানাের জন্য প্রথমে ক্যাম্পে অবস্থানরত পাক ইপিআর সদস্যদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানাের সিদ্ধান্ত নেয়া হল। সে অনুযায়ী একজন সাহসী বাঙালি ইপিআর-এর হাবিলদারকে সাদা পতাকা হাতে পাঠান হয়। আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর তিনি ফিরে এসে জানালেন ওরা আত্মসমর্পণ করবে না। বাধ্য হয়ে আমরা প্রস্তুতি নিলাম এই রাতেই আক্রমণের। ইপিআর-এর উক্ত ক্যাম্পটি একটি দ্বীপের মতাে দেখতে। এর প্রায় চারদিকেই নিচু জলাভূমি, খাল-বিল । ওখানে একটি পুরনাে দালান এবং বড় বড় কয়েকটি টিনের গুদাম রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে এই দ্বীপটিতে পাটের কোম্পানির দপ্তর এবং গুদাম ছিল। এর পাশ দিয়ে তিতাস নদীর একটি শাখা বয়ে গেছে। এই নৌপথেই ব্রিটিশ ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পাটের কারবার চালাত। বর্ষাকালে বড় বড় নৌকা এবং সিপ্লেন এই শাখা নদীতে নামত। যা আমি ছােটবেলায় বহুবার দেখেছি। দেখেছি এই নদীটিতে। কত মাছইনা পাওয়া যেত। বর্ষাকালে তিতাস নদীর এই শাখাটি পানিতে ভরপুর থাকত। জেলেরা নদী থেকে মাছ তুলত। আমরা সেই মাছ কিনে নিয়ে রান্না করে খেতাম। তরতাজা মাছ কতনা স্বাদের। কিন্তু এখন আখাউড়ার সেই যৌব, আর নেই। নদীটিও তার যৌবন হারিয়ে কেমন যেন জীর্ণ শীর্ণ হয়ে গেছে। এখন আর এই তিতাসের শাখা নদীটিতে পানি থাকে না। ছােট ছােট দ্বীপগুলিতে এখন মানুষ বাড়িঘর করে বসবাস করে। আখাউড়া তখন মােটামুটি একটা ছােট নদীবন্দর ছিল। পাটকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ আমলে অনেক গুদাম আর অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার দুই একটা নির্দশন এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ক্যাম্পটিই তার একটি।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে । ধীরে ধীরে আমরা দ্বীপটির তিনদিকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জড়াে হতে লাগলাম। সন্ধ্যা পেরিয়ে নেমে এল রাত এবং গভীর রাত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তেই আক্রমণ চালান হল অবাঙালি ইপিআরদের দখল করে রাখা ক্যাম্পটিতে । তিন দিক থেকে ঘিরে আক্রমণ চললাে । অপর দিকটি ছিল সম্পূর্ণ বিল আর বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ । আমাদের ভারি অস্ত্রগুলি গর্জে উঠল । প্রতিউত্তরও আসতে লাগলাে দ্বিগুণ । প্রচণ্ড গােলাগুলির ভেতরেও চারদিক থেকে বারবার জনতা জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে লাগলাে। এই গগনবিদারীধ্বনি যেন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তােলে। ‘৭১-এ জয় বাংলা ধ্বনি বাংলার প্রতিটি নারী, পুরুষ, শিশুর ছিল অতি প্রিয়। যা
৫৮
আমাদের সংগ্রামে সাহস যুগিয়েছে। তখন বাড়ির পােষা পাখিও জয় বাংলা বলে ডেকে উঠত । রাইফেলের নলের সামনে দাঁড়িয়েও বীরবাঙালিরা ‘জয় বাংলা’ বলে হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়েছে। বাংলার মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রতিটি ভাষণের শেষে জয়বাংলা স্লোগান দিয়েই তার ভাষণ শেষ করতেন। এই জয়বাংলা স্লোগানই যুগিয়েছিল আমাদের মুক্তির প্রেরণা ও সাহস। আর এই জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে অস্ত্র হাতে নিয়ে বাঙালি জনতা পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধ করে পাকিস্তানী বাহিনীকে পরাভূত করে । অসংখ্য শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা এই জয়বাংলাই পরিণত হয়েছিল এদেশের মানুষের জাতীয় স্লোগানে। পাকিস্তানী হানাদারদের কাছে আধুনিক মারণাস্ত্রের চেয়েও ভীতিকর ছিল এই জয়বাংলা শব্দ দুটি। আর এই কারণেই ‘৭৫ সালের মর্মান্তিক ঘটনার পর প্রথমে আঘাত করা হয় এই জয়বাংলার উপর। এদেশের পরাজিত শক্তি ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানের অনুকরণে এদেশে জিন্দাবাদ পুনপ্ৰচলন করে। ভারতে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে বন্দে মাতরম’ ধ্বনিই কেবল ইতিপূর্বে অনুরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধীজীর আহ্বানে অহিংসা আন্দোলনে বিনাউস্কানিতে ভারতবাসী ব্রিটিশের পুলিসের মার খেয়েছিল এবং জীবন আত্মহুতি দিয়েছিল এমনিভাবে। কিন্তু আমরা বাঙালিরা বীর দর্পে যুদ্ধ করছি দখলদার বর্বর অত্যাচারী পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে ।
আমরা সেদিন জয়বাংলা’ ধ্বনি আর যার যা আছে তাই নিয়ে এগােতে লাগলাম । কারাে হাতে কুচ, বল্লম, কারাে হাতে বাঁশের লাঠি। কারাে হাতে বড়দা আর মনে অদম্য সাহস আর মাতৃভূমিকে মুক্ত করার চেতনা । আমিও একটি রাইফেল নিয়ে এই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি। আমাদের বাহিনীর হাতে গােলাবারুদ কম। পক্ষান্তরে শত্রু পক্ষের অনেক বেশি। আমরা কিছুক্ষণ পর পর গুলি ছুড়ছি। আর চারদিক থেকে জনতার সম্মিলিত ধ্বনি জয়বাংলা’। এটাই আমাদের বড় শক্তি। আমরা গােলাগুলি করে এগােতে লাগলাম। শত্রুপক্ষ অনবরত গুলি করেই চলছে। ভােরের আলাের আগমনের আগেই শত্রুপক্ষের গােলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। আমরা সতর্কতার সঙ্গে তিন দিক থেকে এগােতে লাগলাম। শত্রুরা পালাবার পূর্ব মুহুর্তে গােলাবারুদ আর অস্ত্রের গুদামটি উড়িয়ে দিয়ে গেল । বিকট আওয়াজ, আগুন আর ধোঁয়ার কুণ্ডুলী পাকিয়ে এলাকা প্রকম্পিত করল। এর মধ্যেই আমরা ক্যাম্পটি দখল করে পাকিস্তানী ইপিআরএর ফেলেযাওয়া কয়েকটা লাশ ও ধ্বংস করা কিছু অস্ত্র ছাড়া কাউকে জীবিত খুঁজে পেলাম না। গােডাউনের দেয়াল এবং ভেতরের অবস্থা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। কিন্তু পেছনের খােলাপথ দিয়ে বিলের মধ্য দিয়ে পালিয়েছে ইপিআর-এর পাকিস্তানী সদস্যরা। আমরা ক্যাম্পটি দখল করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ালাম । আর জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত করলাম এলাকা। পরে জানতে পেরেছি পালাবার সময় বেঁচে যাওয়া ইপিআর সৈন্যরা ক্রোধে, উত্তেজনায় পথে পথে কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে। চেষ্টা করেছে ভারতের সীমান্তে পৌঁছাতে । কিন্তু তবুও তারা বাঁচতে পারেনি। বিভিন্ন এলাকায় জনতা তাদেরকে ঘেরাও করে খতম করেছে ।
৫৯
প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ
এলাকা শত্রুমুক্ত হল। চলল কসবা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ও আশুগঞ্জে পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করার আয়ােজন। পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরােধ গড়ে তােলা হয়। আমি আখাউড়ায় মুক্তি বাহিনীর আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় যােগাযােগ নিয়ে ব্যস্ত। আখাউড়া থেকে রেলওয়ের হাতে টানা ট্রলিতে রােজ কয়েকবার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া যাতায়াত করি। ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় মুক্তি বাহিনীর হেড কোয়ার্টার থেকে মেজর খালেদ মােশাররফের নির্দেশ নিয়ে আখাউড়া এলাকায় অবস্থিত মুক্তিবাহিনীদেরকে জানাই । গােলা বারুদও সংগ্রহ করে আনি। এই হাতেটানা ট্রলিটি চলাচলে রেলের কর্মচারীরা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই করেছে। এরাও দেশের কাজে আত্মসম্পৃক্ত হতে পেরে আনন্দিত। একাত্তরে এদেশের বাঙালিরা প্রায় সবাই কোন না কোন ভাবে অংশ গ্রহণ করেছে যার যতটুকু সম্ভব। কেবল কিছু কুলাঙ্গার আলবদর আল সামস রাজাকার হয়ে স্বাধীনতাবিরােধী কার্য করেছে। অথচ গুটি কয়েক স্বাধীনতা বিরােধীদের আমরা এখনও বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে পারিনি। এ বাঙালি জাতির কলঙ্ক হয়ে রইল।
দক্ষিণে কসবা-গংগাসাগরে রেল এবং সড়কপথে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আগত পাকবাহিনী কে গংগাসাগর রেলসেতু এবং দক্ষিণে সড়কপথে কসবা ও উজানিসার সেতুর উত্তর পাড়ে এবং উত্তর-পশ্চিমে ঢাকা থেকে আগত পাকবাহিনীকে নরসিংদী, ভৈরব, আশুগঞ্জ ইত্যাদি এলাকায় রেল, সড়ক ও নৌপথে প্রতিহত করার কাজে মুক্তিবাহিনী ব্যস্ত। বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ ছাত্র-জনতার মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা। পাকআর্মিরা অবশেষে এপ্রিলের মাঝামাঝি আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করলাে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া শহর ও আখাউড়ার উত্তরে গংগাসাগরে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানগুলির উপর ওরা জল, স্থল ও বিমানে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া শহরে বিমান থেকে বােমার আক্রমণ চালায়। শহরে তাদের আক্রমণে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। শত্রুর অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে আমাদের টিকে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়ে। জানমালের ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়তে থাকলাে। তাই কৌশলগত কারণে আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসারণ করে। পতন ঘটে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া-শহরও মূল মুক্তাঞ্চলের । এই যুদ্ধে আমাদের সহযােদ্ধা নিয়মিত সৈন্য ও ছাত্র জনতা অনেকেই প্রাণ হারায়। আমরা পুনরায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলাম। দখলদার সৈন্যদের সাথে আমাদের পথে পথে যুদ্ধ চলল। আমরা গেরিলা কায়দায় একের পর এক আক্রমণ করে এবং তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে আমরা তাদের জান-মালের প্রচুর ক্ষতি সাধন করতে। লাগলাম। পাকআর্মির আধুনিক অস্ত্রের মােকাবেলায় আমরা পশ্চাদপসারণ করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ক্যাম্প স্থাপন করি। শেষ পর্যন্ত তাদের ভারি অস্ত্রের গােলায় প্রচণ্ড যুদ্ধ করে তাও আমাদের ছাড়তে হল। আমরা আশ্রয় নিলাম সীমান্তের ওপারে। স্থাপন করলাম মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প। আমরা। সীমান্তের ওপাড় থেকে সারা পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীকে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ চালাতে লাগলাম। আমাদের আক্রমণে পাকবাহিনীর মনােবল ভেঙ্গে যেতে লাগল। আমরা এরই মধ্যে প্রচণ্ড আক্রমণের জন্য নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুললাম। এভাবে বন্ধু। রাষ্ট্র ভারতের সহযােগিতায় চূড়ান্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হলাম ‘৭১-এর ডিসেম্বরে। এভাবেই নয় মাসের যুদ্ধে আমরা এই দেশকে মুক্ত করলাম ।
৬০
আখাউড়ায় যুদ্ধ
সম্ভবত ১৮ই এপ্রিল, সন্ধ্যা নেমে এল। আখাউড়া এখনও মুক্ত। চারদিক থেকে আখাউড়াকে ঘিরে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধ বেষ্টনী গড়ে তােলা হয়। দক্ষিণে গংগাসাগর রেলওয়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়া হয় শত্রুর গতিরােধ করতে। উত্তর-দক্ষিণে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করতে বাংকারে বাংকারে অবস্থান নেয় মুক্তিবাহিনী। উত্তরে তিতাস নদীর উপর রেলওয়ে ব্রিজের দিকে তাক করে মুক্তিবাহিনী ব্রিজের নিকটেই বাংকারে অবস্থান নিয়ে মেশিনগান তাক করে প্রস্তুত শত্রু সেনাদের প্রতিহত করতে। একটি বাংকারে ২জন বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈন্য একটি ভারী মেশিনগান বসিয়ে অতন্দ্র প্রহরায় নিয়ােজিত। তাদের সাথে আমিও একজন সিভিলিয়ান হিসাবে অবস্থান নিলাম। মাথায় করে গুলির বাক্স নিয়ে এসে জমা করলাম বাংকারে। গুলির ভারি বাক্স টানতে টানতে শরীর ব্যথায় একেবারে কাহিল। তবু আমার সেদিকে চিন্তা নাই। যুদ্ধের নেশায় সব ভুলে রইলাম। নিস্তব্ধ রাত। সজাগ দৃষ্টি সামনে। উত্তর দিক থেকে আক্রমণের আশংকা । আমরা তা প্রতিহত করব।
হানাদাররা কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে বের হয়ে এগােতে থাকে। প্রথমে রেলপথ। ধরে দক্ষিণ দিক থেকে এসে কসবা, গংগাসাগর রেল স্টেশন হয়ে আখাউড়া উপকণ্ঠে উপনীত হয়। আক্রমণ চালায় আমাদের দক্ষিণ অবস্থানের উপর। আমি তখন উত্তর দিকে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করতে প্রস্তুত। দক্ষিণে মুক্তিযোেদ্ধারা সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীর অগ্রযাত্রায় বাঁধার সৃষ্টি করে। সেদিনের প্রচণ্ড যুদ্ধে পাকবাহিনীর প্রায় তিনশ সৈন্য নিহত হয়। কিন্তু তবুও পাকবাহিনীকে প্রতিরােধ করা গেল না। তাদের। অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের সামনে মুক্তিবাহিনী সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করলেও তাদের অগ্রগতি ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি বেশি সময়। রাতের অন্ধকারে ওরা দক্ষিণ দিক দিয়ে আখাউড়ায় প্রবেশ করে এবং এলােপাতাড়ি গােলাগুলি আর আগুন দিয়ে জ্বালাতে থাকে পাগলের মতাে। এই যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। তার মধ্যে কয়েকজন আমার মতাে ছাত্র জনতা। তারা মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। দেশ একদিন স্বাধীন হল ঠিকই, কিন্তু তাদের এই আত্মত্যাগের কথা আজ আর কেউ বিশেষ ভাবে মনে করে না।
রাত বাড়ছে, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার দিক থেকে পাকবাহিনীর আক্রমণের আশংকা । উত্তর দিকে মেশিনগান তাক করে আমরা প্রস্তুত। কিছুদূরে আমাদের আরাে কয়েকটি বাংকারে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান নিয়েছে। যেভাবেই হােক আজ পাকহানাদারদের প্রতিহত করব। গভীর রাত কোনাে সাড়াশব্দ নেই। ধীরে ধীরে দূর থেকে গােলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। ভাবছি দক্ষিণে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের লড়াই চলছে। আমার ধারণা মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী ডিফেন্স ভেদ করে কিছুতেই পাকিস্তানী সৈন্যরা দুই একদিনের মধ্যে আখাউড়ায় প্রবেশ করতে পারবে না । উত্তরে তিতাস নদীর উপর রেলসেতুর দিকে তাক করে রয়েছে আমাদের অস্ত্র । কখন আক্রমণ হয়। আমরা তা প্রতিহত করবই । মুক্তিবাহিনীর দুই দিকের ডিফেন্সের মাঝে রেল স্টেশন, কলােনি ইত্যাদি বিরাট এলাকা।
চারদিক অন্ধকার। প্রচণ্ড গােলাগুলির আওয়াজ হঠাৎ অনেক কাছে শােনা যাচ্ছে । ভাবছি মােকাবেলা করতে হবে। কিন্তু না, গুলির আওয়াজ আমাদের ঠিক পিছনে, খুব
৬১
কাছে । আমার মনে হচ্ছে গুলি আমাদের পিঠে এসে পড়ল । হঠাৎ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য দুজন গায়ের খাকি রঙের ইউনিফর্ম খুলে ফেলে দিল। পরনে আন্ডার ওয়ার আর গেঞ্জি। মেশিনগানটিও ধাক্কা মেরে বাংকারে ফেলে দিল। তারপর নেমে যেতে লাগলাে অন্ধকারে বিলের দিকে পশ্চিমে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বলল পালাও। বুঝতে। পারলাম আমরা পাকবাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেছি। দক্ষিণ দিক থেকে ওরা এলাকায় প্রবেশ করেছে। আমার তখন দিশাহীন দিগবিদিক অবস্থা। দ্রুত ধেয়ে আসছে মৃত্যু। কি করব ভাবতে পারছিলাম না। কেবল মনে পড়ছে পেছনের রেল কলােনিতে দক্ষিণ দিকে আব্বা, আম্মা, ভাই-বােন সবাই রয়েছেন। বাসার দিকে দৌড় দিলাম। রাস্তা অন্ধকার হলেও ফাকা। অনুমান করলাম একলােক একটি বড় ট্রাঙ্ক মাথায় নিয়ে এদিকেই আসছে। আমাদের বাসার এলাকার কথা তাকে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে তিনি বললেন, ঐদিকে কেউ নেই। পাকবাহিনীর সৈন্যরা ঐদিক থেকেই আসছে। সব জ্বালাচ্ছে, পােড়াচ্ছে। যেও না, মারা যাবে। এলাকার সবাই। বড়মপুরের দিকে গেছে। তােমাদের বাসার সবাই হয়ত খড়মপুরেই গেছে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। খড়মপুরে আমাদের আত্মীয়-স্বজন আছেন। তারা সেদিকেই যাবেন। হয়ত। আমি খড়মপুর যাবার জন্য উত্তর পূর্ব দিকের কলােনির ভেতর দিয়ে দৌড়ে এগােতে লাগলাম। পূর্ব দিকের রেল লাইন পেরিয়ে খড়মপুর যেতে হবে। তখনও পুরােপুরি সকাল হয়নি। আবছা আবছা অন্ধকার । দূর থেকে ভেসে আসছে প্রচণ্ড গুলির আওয়াজ। ভয়ার্ত মানুষের আর্তচিৎকার সে এক বিভীষিকাময় চিত্র। আর তারই মধ্যে শােনা যাচ্ছে আযানের ধ্বনি। “আছছালাতু খায়রুমমিনান নাউম। ঘুমের চেয়ে নামাজ শ্রেয়। তখন কি কারাে চোখে ঘুম আছে? হয়ত তখন অনেকেই তাদেরই স্বজাতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুসলমান ভাইদের হাতেই গুলির বদৌলতে চিরদ্রিায় চলে গেছে। তারা আর কোনােদিন জাগবে না। ঘুম ভাঙ্গবে না আযানের আহ্বানে। দূরে দেখা যাচ্ছে আগুনের লেলিহান শিখা। আখাউড়া রেল স্টেশন জ্বলছে। ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকার কেটে ভােরের আলাে উঁকি দিচ্ছে আর নেমে আসছে বাঙালির জীবনের কালাে অধ্যায়।
খড়মপুর ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এখানে বিখ্যাত হজরত সৈয়দ আহাম্মদ গেছুদরাজ পীর কল্লা শহিদের মাজার। এই গ্রামের অধিবাসী প্রায় সকলেই খাদেম উপাধিতে ভূষিত। মাজারের খাদেম তারা। এই গ্রামেই মাজারের নিকট আমার মামাতাে বােনের বাড়ি। আব্বা আম্মা হয়ত সেখানেই গেছেন। যদিও এই গ্রামের অনেকেই আমাদের পরিচিত, আত্মীয়। মনে ধারণা নিয়ে ছুটলাম খড়মপুরের দিকে। ঢাকা চট্টগ্রামের রেল লাইনের পূর্বদিকে রেলের কলােনি তার পাশেই খড়মপুর গ্রাম। আমি তখন পশ্চিম দিকে। রেললাইন পার হয়েই আমাকে খড়মপুর যেতে হবে। ইতিমধ্যে পাকবাহিনী আখাউড়া দখল করে ফেলেছে। রেল লাইন ধরেই তাদের আক্রমণ এবং অগ্রসর হওয়া, রেল লাইনের কাছে যেতেই দেখলাম, একদল পাকিস্তানী সৈন্য লাইন। ধরে দুদিকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে রেল লাইনের উপর দিয়ে দৌড়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরে তিতাস নদীর ওপর ব্রিজের দিকে যাচ্ছে। আর আশপাশের রেল কলােনিতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। কি আতংকগ্রস্ত অবস্থা। আমি বুঝতে পারলাম আমি পাকআর্মীর ঘেরাওয়ের মধ্যে আছি। কিভাবে উদ্ধার হব জানি না। মনে ভয় জাগলেও সাহস নিয়েই রেল লাইন পার হবার মনস্থ করলাম। রেল লাইন পার হতে পারলাম না ।
৬২
একটি দেয়ালের আড়ালে আশ্রয় নিলাম। আমি একা । এলাকায় কোনাে প্রাণীও নেই। পাকআর্মির নিক্ষিপ্ত কয়েকটা গুলি এই দেয়ালে এসে লাগল। পাকআমীর দলটি রেল লাইন ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে গেল আমি আড়াল থেকে দক্ষিণ দিকে তাকালাম মনে হল বেশ দূরে আরও একদল আর্মি একই ভাবে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসছে। চারদিকে প্রচণ্ড গােলার আওয়াজ, চিৎকার ও আগুন। হয়ত তাদের প্রচণ্ড গােলার আঘাতে বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা ও নিরীহ জনতা ঘটনাস্থলেই নিহত হন। দুই পাশের বাসাগুলি পুড়ছে। লাইনের দু’পাশে নামছে না ওরা, নামলে হয়ত আজ আমি এই বিভীষিকাময় দিনের কথা লিখতে পারতাম না। পাকআর্মির পরের দলটি এখানে পৌঁছার আগেই মনে সাহস ও প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে একদৌড়ে রেল লাইন পেরিয়ে পূর্ব দিকের ঢালুতে পড়ে ভীষণ ব্যথা পেলাম। পুরােন রেল লাইন, লােহা, পাথর কিছুই দেখলাম না। কোন রকমে এই জায়গাটা পার হতে হবে। বেশ বড় ধরনের আঘাত পেলাম। কোন রকমে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কলােনির আড়ালে পৌছি । হাতেপায়ে রক্ত ঝরছে। পরণের প্যান্ট ছিড়ে হাঁটু বেয়ে রক্ত ঝরছে। দেখলাম আমার মতাে আরাে কয়েকজন খড়মপুরের দিকে ছুটছে। একটু সাহস হল। তাদের পেছনে ছুটলাম। শরীরের ব্যথা-বেদনা আর রক্তপাতের কথা ভুলেই গেলাম। মহিলা, ছােট ছােট ছেলে। মেয়েরা আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও প্রাণভয়ে উৎকণ্ঠার সাথে ছুটছে । সে এক ভয়াবহ দৃশ্য।
আখাউড়ার পতন ঘটল। হানাদাররা দ্রুত এদিকে আসছে। বিলের তীর ধরে। খড়মপুরের দিকে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে অন্ধকার কেটে আলােকিত হচ্ছে আকাশ। ভােরের আলােতে দেখতে পেলাম বিলের মাঝে অনেকগুলাে ছােট ছােট নৌকা ভাসছে মাঝবিলে, তাতে মনে হচ্ছে মানুষ। জীবন বাঁচাতে মানুষগুলাে প্রাণ নিয়ে বিলের মাঝে চলে গেছে। আরাে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই মনে হলাে কেবল একটি নৌকা বিলের তীরে দাঁড়িয়ে। আবছা আলােয় মনে হল ঐ নৌকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কেউ । তার যাত্রীরা মনে হলাে সবাই উৎকণ্ঠিত এবং একজন একপা নৌকায় আর একপা ডাঙায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আরাে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম ঐ দাঁড়িয়ে থাকা লােকটি আর কেউ নন, আমার পিতা। মনে হল তিনি আমারই জন্য অধীর আগ্রহ আর দুঃশ্চিন্তা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আর তাকিয়ে আছে পথের দিকে। বাবার মনের অবস্থা বুঝবার অবস্থা তখন আমার ছিল না । আমি মুক্তিপাগল । আমি কিছুক্ষণ আগেও তাদের ভুলে ছিলাম। দেশকে হানাদারদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে বুকে গুলি নিতে প্রস্তুত ছিলাম। বাবা আমাকে দেখামাত্র দৌঁড়ে এসে আমার হাত ধরে রাগে বকা দিয়ে নৌকায় ছুঁড়ে ফেললেন। মাঝিকে বললেন, নৌকা ভাসাও। নৌকা ভাসল বুঝতে পারলাম বাবা আমার জন্য বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাই রাগ রাখতে পারলেন না । একদিন এই বাবাই আমাকে যুদ্ধে যেতে বললেন। মনে কষ্ট হলেও তিনি আমাকে বিদায় দিলেন, বললেন যা চলে যা, দেশের জন্য যুদ্ধ কর । মরবি ত দেশের জন্য মরগে। যখন আমি গ্রামে অবস্থান করে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করতে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটছিলাম তখন বাবার মনে উৎকণ্ঠা যেকোনাে মুহূর্তে পাকআর্মীরা আমাকে ধরে নিয়ে গুলি করে মারবে। নৌকায় উঠার সাথে সাথে আমার আম্মা আর ছােট বােন আলেয়া আমার জন্য খুব কাঁদল। বুঝতে পারলাম মনের গভীর উৎকণ্ঠার মধ্যে তারা মনের আবেগ আর ধরে রাখতে পারলেন না, আমাকে জীবিত দেখতে পেয়ে সেই আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতে লাগল । দুশ্চিন্তা
৬৩
আর ভয়ে সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। আলেয়ার জন্য আমার ভীষণ খারাপ লাগে। সে আর আমাদের মাঝে নেই। অল্প বয়সে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেল। সে ছিল আমার পিঠাপীঠি বড় আদরের ছােট বােন। ১৯৮৪ সালের ২০শে ডিসেম্বর বিদেশে (মালদ্বীপে) হৃদযন্ত্রে আক্রান্ত হয়ে ইহজগত থেকে বিদায় নিল। তার ২ কন্যা ও এক পুত্র। তারা তখন সবাই নাবালক।
আমি নির্বাক, রাগে-দুঃখে আর হেরে যাওয়ার বেদনায় পাথর। হানাদার বাহিনীর ব্যবহৃত অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের সামনে টিকে থাকতে পারিনি। শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত প্রিয় এলাকা, মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে জীবনবাজি রেখেছিলাম। কিন্তু কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসারণ করতে হলাে। রক্ষা করতে হল নিজের জীবনকে।
মাঝি বাবাকে গন্তব্যের কথা জিজ্ঞেস করলে বাবা বললেন, পশ্চিম দিকে চালাও, মরিতাে মরি নিজের বাড়িতে গিয়েই মরব। নৌকায় আমরা সবাই নির্বাক। মাঝি নৌকা বাইছে বিলের মাঝ দিয়ে । মাঝির বৈঠার টানে নৌকা এগিয়ে চলছে। পানির আওয়াজ যেন আমার পিঠে চপেটাঘাত করছে। রাগে-দুঃখে আমি হতবাক এই অপমান আমাকে আরাে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ করল। এর জবাব আমাকে দিতেই হবে। আমার দাদা এবং বাবা ব্রিটিশ রেলওয়েতে চাকরি করেছেন। আমার দাদা ব্রিটিশদের অধীনে চাকরি করলেও ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। মহাত্মা গান্ধীর সাথে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য বৈঠক করেছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন। গান্ধীর অসহযােগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন সমাজসেবী । মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন সারা জীবন। ৪৩-এর দুভিক্ষের সময় তিনি আসাম থেকে চাউল এনে গ্রামবাসীদের মাঝে বিলি করেছেন। তিনি বেশ সুনামের সাথে জীবন কাটিয়ে গেছেন। ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন দেখেছেন, দেখেছেন ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। আমার বাবা ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। ভাষা আন্দোলন দেখেছেন, দেখেছেন সর্বশেষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং মুক্ত বাংলাদেশ। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহযােগিতা করেছেন । গােপনে মুক্তিযােদ্ধারা তাঁর সাথে দেখা করেছে। খবরাখবর গেরিলাদের মাধ্যমে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। উর্দুতে কথা বলে এলাকার মানুষকে রক্ষা করতে ভূমিকা রেখেছেন। পাকআর্মি এলে এগিয়ে গিয়ে কথা বলে গ্রামে প্রবেশ করা থেকে বিরত করেছেন। গেরিলাদের চলাফেরার সুযােগ করে দিয়েছেন নানাভাবে। ১৯৭২ সালেই আমার বাবা চাকরি থেকে অবসর নেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে তিনি আমাকে বাধা সৃষ্টি না করে খুশিমনেই বিদায় দিয়েছিলেন। মাও কোনাে আপত্তি করেননি। ১৯৯৪ সালে মাত্র চারদিনের ব্যবধানে ১১ই জুলাই আমার প্রিয় মা এবং ১৫ই জুলাই আমার বাবা জান্নাতবাসী হয়েছেন। তাদেরকে আমাদের গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে।
আখাউড়া যুদ্ধে চরমভাবে পরাজিত হয়ে ৭/৮ মাইল পশ্চিমে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান নিলাম। খালিহাতে এককাপড়ে বিতাড়িত পরিবারের প্রধান বাবা ব্রিটিশ আমলের পুরানাে জরাজীর্ণ দালানের ছাড়াবাড়িতে নতুন করে কোনাে রকমে সংসার পাতলেন। বাড়িতে উঠার আগে আমরা পাশের গ্রামে আমার খালার বাড়িতে উঠে ছিলাম। কারণ আমাদের বাড়িটি তখন বসবাসের উপযুক্ত ছিল না। বহু বছর বাড়িতে না থাকায় বাড়িটি একেবারে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। ভাঙা বাড়ি ভাঙাঘর । এখন এই বাড়িটিই আমাদের দুর্দিনের সম্বল। ডেক ডেকসি, থালাবাটি জোগাড় করতে
৬৪
হল নতুন ভাবে । বাঁচার তাগিদে মানুষের প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র যােগাড় করে সংসার জীবন শুরু করা মনুষ্য জাতির চিরাচরিত স্বভাব। বাড়িতে আমার মন বসল না । মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই হানাদার বাহিনীকে সমুচিত জবাব দিতে হবে। ছােট বেলার বন্ধু মিরণকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়াতে লাগলাম, মিরণ সব কাজেই খুব আন্তরিক। যেকোনাে কাজে যেকোনাে সময় তাকে পাওয়া যায়। গ্রামের সকলেই কোনাে না কোনাে কাজে মিরণকে খোজে। মিরণ যেন গ্রামের মানুষের নানা প্রয়ােজনের অকৃত্রিম বন্ধু। এই মিরণই এখন আমার সার্বক্ষণিক বন্ধু সাথী। পরিচিত বন্ধু-বান্ধব খুঁজে বের করতে লাগলাম। উদ্দেশ্য একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে তােলা । অতর্কিতে হানাদারদের চলার পথে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে ঐ অস্ত্র দিয়েই পাল্টা আক্রমণ করা। কিন্তু না। তেমন সাড়া পেলাম না। সবাই ভীত। দুই একজন ছাড়া কেউ এগিয়ে এল না। আমাদের এলাকা এখন সম্পূর্ণভাবে পাক আর্মিদের নিয়ন্ত্রণে । পাশেই রেল স্টেশন। নিকটে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া-কুমিল্লার প্রধান রাস্তা। মাঝে আমাদের গ্রাম। জানতে পারলে গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে তারা। হত্যা করবে নিরীহ গ্রামবাসীকে। গ্রামের মানুষজন আমাকে এড়িয়ে চলে। হয়ত ভাবে হানাদারেরা জানতে পারলে বিপদ হবে তাদেরও। বুঝতে পারলাম এখানে থেকে দেশের জন্য আর কিছুই করতে পারব না।
গেরিলা যুদ্ধের প্রচেষ্টা আগেই বলেছি আমাদের গ্রামের একেবারে গা ঘেঁষেই রেল লাইন চলে গেছে। আর স্টেশন পাঘাচং। পাকআর্মিরা এই লাইন ধরেই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকে আখাউড়া জংশন ও আখাউড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় দিবারাত্র কখনাে ট্রেনে কখনােবা রেলের হাতে টানা। ট্রলিতে যাতায়াত করছে। যেমনটি এলাকা মুক্ত থাকা অবস্থায় আমরা করেছিলাম। এ অবস্থার মধ্যেও আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি গেরিলা যুদ্ধের জন্য সাথী সংগ্রহ করতে । পাকিস্তানী আর্মিরা গণহত্যার জালাও পােড়াওয়ের খবরাখবর পেয়ে গ্রামের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত । কখন আর্মীরা আমাদের গ্রামে ঢােকে, কাকে মারে, কাকে ধরে নিয়ে যায়। অনেকের ধারণা আমার এই কার্যকলাপ আমরা জানতে পারলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। আমার এ গ্রাম, সে গ্রাম ছুটে চলাতে তারা বিরক্ত, এমন কি হানাদার ও দালালদের ভয়ে আমার সাথে কথা বলা, চলাফেরা বন্ধ করেছে গ্রামের লােকজন। নিজ গ্রামে আমি একঘরে হয়ে গেলাম।
আমাদের গ্রামে তখনও পাকআর্মি ঢােকেনি। সকলের ধারণা, আর্মিরা যেকোনাে দিন আমাকে ধরতেই গ্রামে ঢুকবে। আর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে যাবে গ্রাম । নিজের বাড়িতে ঘুমােতে পারি না। সকলের অজান্তে এ বাড়ির রান্না ঘরে, ও বাড়ির পাটের গুদামে রাত কাটাই। কারণ দালালরা কখন আর্মিকে আমার অবস্থানের খবর জানিয়ে দেয়। তবুও আমি মেনে নিতে পারছি না আমার জাতির এ পরাজয়। অপমানের গ্লানিতে আমার মনকে বিষন্ন আর বিদ্রোহ করে তুলছে। যা সহ্য করা আমার পক্ষে কঠিন হয়েছে। অস্থির মন নিয়েই আমার প্রচেষ্টা চলছে।
রেল লাইনের পাশেই আমাদের গ্রামের বাজার। একদিন বিকেলে বাজারে গেলাম। দেখি একটি রেলওয়ে ট্রলিতে করে কয়েকজন পাকআর্মি ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার দিক
৬৫
থেকে আখাউড়ার দিকে যাচ্ছে। অমনি বাজার থেকে কিছু লােক একটি পাকিস্তানী । পতাকা হাতে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে তাদের দিকে দৌড়ে গেল । দূর থেকে অনুভব করলাম ট্রলিটি ঘিরে লােকগুলাে আর্মিদের সাথে কি যেন বলছে। আর্মিরা ট্রলি থামিয়ে । লােকগুলিকে কি যেন বলছে। বিষয়টি দেখার জন্য কৌতূহলে আমিও তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি চাটুকাররা বাংলা উর্দ মিলিয়ে এক অদ্ভুত ভাষায় পাক আর্মিদের সাথে কথা বলছে আর মাঝে মাঝে পাকিস্তান-জিন্দাবাদ বলে চেঁচাচ্ছে। সহ্য করতে পারলাম না। গায়ে আগুন জ্বলে উঠল । পেছন থেকে পাকিস্তান স্লোগানের জবাবে চাটুকাররা বলল জিন্দাবাদ আর আমার মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এল মুর্দাবাদ। আমার পাশে দাঁড়ানাে একজন বয়স্ক লোেক আমার মুখ চেপে ধরলেন। ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে বললেন একি করছ। নিজের জীবনতাে যাবেই আমাদেরকেও বিপদে ফেলবে। গ্রাম জ্বালাবে। চলে যাও এখান থেকে। এভাবে ঐদিন আমার জীবন বাঁচালেন ঐ মানুষটি। এদের মধ্যে সকলেই পাকিস্তানীদের পক্ষে তাই নয়, তবুও গ্রাম বাঁচাতে নিজেদের রক্ষা করতে হয়ত এভাবে স্লোগান দিল, অনেকে মনেপ্রাণে হয়ত।
রাগে আর ঘৃণায় ফুস ফুস করতে করতে সেখান থেকে ফিরে এলাম। অদ্ভুত অনুভূতি, কিছু করতে পারছি না-সহ্যও করতে পারছি না। সারা শরীর রাগেদুঃখে ফেটে পড়ছে। হায়রে বাঙালি। সেদিন যদি আমরা এক হতাম, তাহলে ওখানেই ঐ কয়জন হায়েনাদের শেষ করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা তাদের উপর আক্রমণভাে করলামই না, উপরন্তু পাকিস্তানী পতাকা নিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে তাদেরকে এই দেশ দখলে রাখার সাহস যােগালাম। সারা দেশেই তখন এই অবস্থা। আর তার পরিণতিতে প্রায় এককোটি বাঙালি হল ভারতে শরণার্থী । প্রতিশােধ নিতে হলাম আমরা মুক্তিযােদ্ধা। দেশের মাটিকে দখলদার মুক্ত করতে প্রায় ত্রিশ লক্ষ বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দিল। সম্রম হারাল মা-বােন। বাঙালি জাতির অসীম সাহসী তরুণ নয় মাস যুদ্ধ করে ছিনিয়ে নিল বিজয়। আমরা স্বাধীন হলাম। আমাদের এ রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ভারতের সাহায্য এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহস্র সহায়তা এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে স্বাধীনতা পেলাম। আমরা মুক্তিযোেদ্ধা এবং এককোটি শরণার্থী তাদের সাহায্য না পেলে সেদিন আমাদের কি অবস্থাই না হতাে। হয়ত বিলীন হত এই বাঙালি জাতিসত্তা। আরাে লক্ষ লক্ষ বাঙালি প্রাণ হারাত। আর এই পরাধীনতার শৃংখল হতে কবে কিভাবে মুক্তি পেতাম জানি না। আজকের প্রজন্ম তা কল্পনাও করতে পারবে না।
তার ২/১ দিন পরই শুনতে পেলাম আমাদের পাশের আটলা নামক গ্রামে গভীর। রাতে পাকআর্মি হামলা চালিয়ে একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করেছে। যে গ্রামে আমার খালার বাড়ি সে গ্রামে আখাউড়া যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। ভাের বেলায় দৌড়ে গেলাম দেখতে। দেখলাম বাড়ির দরজার উপর পড়ে আছে বুকে গুলিবিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতা মনাে কন্ট্রাক্টর’-এর লাশ। তার চোখ ভােলা মনে হলাে লােকটি যেন তাকিয়ে আছে স্বাধীনতার পতাকা দেখবে বলে। দেখলাম পাশের বাড়ির প্রায় ১০/১২ টা ঘর জ্বলে পুড়ে ছারখার। এখানে সেখানে পােড়া গন্ধ আর ধােয়া উড়ছে। পাশে পােড়া বাঁশঝাড়ের আড়ালে কয়েকজন মহিলা ঢুকরে কাঁদছে। দেখতে পেলাম পােষাগরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী আগুনে পুড়ে রােস্ট হয়ে আছে। অবলা জীব জম্ভগুলােও রেহাই পায়নি হায়েনাদের হাত থেকে। পশুর গলায় বাধা দড়িগুলাে পর্যন্ত
৬৬
পুড়ে ছাই হয়ে দড়ির আদলেই পড়ে আছে মাটিতে। গরুগুলাে যেন শক্তি যুগিয়ে আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে। মনাে কন্ট্রাক্টরের অপরাধ সে স্থানীয় আওয়ামী লীগে চাঁদা দিতেন এবং বাড়িগুলি পুড়িয়ে দেয় কারণ ঐ বাড়ির ২/৩ যুবক মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিয়েছে। তারা গতরাতে বাড়িতে এসেছিল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম সত্যি মুক্তিবাহিনীর ছেলেগুলাে সে রাতে বাড়ি এসেছিল। কিন্তু পাকহানাদাররা আসার আগেই কেটে পড়েছে। তাদের আগমনের খবর পাকআর্মিদের কাছে পৌছল কি করে? নিশ্চয়ই গ্রামের দালাল কুলাঙ্গাররা এ কাজ করেছে। সমগ্র দেশেই এদের সহযােগিতায় পাকহায়েনারা ঘরে ঘরে গিয়ে হত্যা করতে লাগলাে দেশপ্রেমিক ও আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের। বিষন্ন মন নিয়ে বাড়ি ফিরছি আর ভাবছি এখানে আর নয়। যেকোনাে মুহুর্তে দালালরা আমাকেও পাকআর্মির হাতে তুলে দিতে পারে। সারা বাংলায় এমন বহু মনােকন্ট্রাকটরের মতে লােকেরা এই স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনের প্রতি মায়া রাখেনি। হাসতে হাসতে বুকে গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এই আত্মত্যাগেরই ফসল বাংলার স্বাধীনতা।
দিন দিন পাকহানাদারদের অত্যাচার আর হত্যাযজ্ঞ বেড়েই চলেছে। শহর-বন্দর আর গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করছে। হত্যা করছে নিরীহ মানুষকে। ছাত্র যুবক পেলেই ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে। নারী-শিশুদেরকেও রেহাই দিচ্ছে না। মা-বােনদের সম্ভ্রমের ওপর হানা দিচ্ছে। মার সামনে পুত্রকে গুলি করে মারছে। বাবার সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করছে, লাঞ্ছিত করছে পুত্রের সামনে মাকে। মার কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করছে বেয়নেটের খোঁচায়। লক্ষ লক্ষ মা বােনকে করেছে বিধবা। গ্রাম-কি গ্রাম উজার করছে। বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যদের এই সকল অত্যাচার, হত্যা, লুণ্ঠন, দর্শন, জালাও পােড়াওয়ের সহযােগিতা করেছে আমাদের দেশের কিছু কুলাঙ্গার রাজাকার, আলবদর, আলসামস। তারা মুক্তিযােদ্ধা ও দেশপ্রেমিক নাগরিককে ধরিয়ে দিয়েছে। মা-বােনদের ধরে নিয়ে গিয়ে তুলে দিয়েছে হায়েনাদের হাতে। করেছে লুন্টন। তাদের বিচার কি হবে না এই বাংলার মাটিতে? আমাদের জাতির কলঙ্ক কি আমরা ঘুচাতে পারব না? আতঙ্ক আর অত্যাচারের মাঝেও বাঙালিরা এসময় প্রতিরােধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে। যেখানেই হায়েনারা বাঁধা পাচ্ছে, সেখানেই তাদের অত্যাচার বেড়ে যাচ্ছে। চারদিকে আতঙ্ক, কখন আর্মিরা গ্রামে প্রবেশ করে। কাকে ধরে নিয়ে যায় । কাকে হত্যা করে। বিভীষিকাময় ঐ দিনগুলিতে মা-বাবা আমাকে নিয়ে ভীষণ রকম উদ্বিগ্ন । দিনরাত গ্রাম কি গ্রাম ছুটে চলেছি গেরিলা আক্রমণ করে পাকআর্মীকে প্রতিহত করতে, মুক্তিকামী মানুষ, যুবককে সংগঠিত করতে। মাবাবার ভয় এভাবে একদিন ধরা পড়ে জীবন যাবে। আমি বুঝতে পারলাম এই এলাকায় থেকে গেরিলা যুদ্ধ করার জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না, সম্ভবও নয়। এখানে আর নয়। মনঃস্থির করলাম দ্রুত আবার আগরতলায় যাবাে এবং আবার মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেব। সে রাতে এমনি উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে গ্রামেই মামা বাড়ির রান্নাঘরে সকলের অজান্তে রাত কাটালাম। সকালে বাড়ি এসে কিছু প্রয়ােজনীয় কাপড়চোপড় নিয়ে পােটলা বানিয়ে ছদ্মবেশে আগরতলার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। যাবার আগে আব্বা-আম্মাকে সালাম করে বিদায় চাইলাম। তারা যেন প্রকারান্তরে খুশি হয়েই আমাকে বিদায় দিলেন। আমাকে নিয়ে তাদের অনেক ভয়। হয়ত ভাবলেন, তার গতিবিধি ভাল না। কখন কি ঘটে যায়। এখানে থাকলে এমনিতেও সে মারা যাবে।
৬৭
কেবল আমি এগিদ্দেশ্যে, সীমান্তের দিয়ে চলা পথ ধরে
তার চেয়ে বরঞ্চ দেশের জন্য কিছু একটা করুক। বাবা বললেন, যা তুই চলে যা, দেশের জন্য যুদ্ধ কর।
সীমান্তের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। মিরণ আমাকে নদীর পাড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। শুরু হলাে আমার মাতৃভূমির মুক্তিসংগ্রামে আত্মােৎসর্গের পরবর্তী অভিযান। কিছু পথ পায়ে হেঁটে, কিছু পথ নৌকায়, আবার পায়ে হেঁটে চলতে লাগলাম । চলার পথে কিছুদূর কয়েকজন সাথী পেলাম। একসময় তারা অন্য পথে চলে গেল। এবার আমি একা। ফাকা পথ-ঘাট, কোথাও কোনাে লােকজন নেই। কেমন যেন নিষ্প্রাণ সব। অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে, মনে সাহস নিয়ে এগােতে লাগলাম একাই। উত্তপ্ত আকাশ। মাথার উপর তপ্ত রােদুর। ভারাক্রান্ত মন। এক সময় উঠলাম রেল লাইনেআখাউড়া সিলেট রেল লাইন। এদিক ওদিক তাকালাম কাউকে দেখলাম না। বেলা দুপুর। রেল লাইন রােদে উতপ্ত হয়ে তাপ ছড়াচ্ছে, এ যেন আমার মনের তাপ। এখানে আমি একা। গা শিউরে উঠল। আমাকে সীমান্ত পার হয়ে আগরতলা শহরে পৌছতে হবে। তাই আমি রেল লাইন পার হয়ে পূর্বদিকে এগােচ্ছি। বিস্তীর্ণ কাঠাল বাগান। কোথাও কোথাও ঝােপ-জঙ্গল। পায়ে চলা পথ ধরে এগিয়ে চলেছি পূর্ব দিকে আগরতলা শহরের উদ্দেশ্যে, সীমান্তের দিকে। পথে একটি প্রাণীও চোখে পড়ল না। কেবল আমি এগিয়ে চলেছি সীমান্তের দিকে অসিম সাহস নিয়ে অচেনা পথ ধরে। আলাের উদ্দেশ্যে।
আগরতলা শহর আমার পূর্ব-পরিচিত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ ২৭ মার্চ তারিখে একবার এসে কথা বলে ছিলাম এ দেশের নেতাদের সাথে । চেয়েছিলাম অস্ত্র আর ট্রেনিং এবং সহযােগিতা। রাত্রি যাপনও করেছিলাম সেইদিন। কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। দুরু দুরু বুকে এগােতে লাগলাম। কখন কোন দিক থেকে পাকআর্মি আক্রমণ চালায়। এমনি দুশ্চিন্তা আর ভাবনা নিয়ে সীমান্তের দিকে এগােতে লাগলাম। সীমান্ত অতিক্রমের সময় আমার মন আঁৎকে উঠল । অজান্তে দুচোখ গড়িয়ে নেমে এল অশ্রুধারা। পেছনে ফিরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। নিজের দেশ ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। অবচেতন মনেই তুলে নিলাম জন্মভুমির একখণ্ড মাটি। যত্ন করে কাগজে জড়িয়ে সঙ্গের পােটলায় রাখলাম। মাতৃভূমির মাটিকে সালাম জানিয়ে প্রবেশ করলাম। প্রতিবেশী বন্ধুদেশ ভারতে। মনের অজান্তে আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম। দু’চোখ ভিজে গেল। একটুকরা কাগজে লিখে রাখলাম যুদ্ধে আমার মৃত্যু হলে এই মাটিটুকু আমার কবরের উপর দিয়ে দেবেন। যুদ্ধের ৯টি মাস দেশের মাটির টানে মন অস্থির হয়ে উঠত। মাবাবা ভাইবােন কাউকে দেখি না। মনের ভিতর কেমন যেন অনুভূতি হয়। সীমান্তে গিয়ে তাকিয়ে থাকি দেশের দিকে আর সঙ্গে আনা দেশের মাটি বারবার শুকি নাকের কাছে নিয়ে । ভাবি কবে বীরের বেশে স্বাধীন দেশের মাটিতে যাব। মন দুর্বল হয়ে অজান্তে দু’চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রু । অজানা জঙ্গলে পায়ে হাঁটা পথ ধরে আন্দাজ করে এগােতে এগােতে এক সময় বড় রাস্তায় উঠলাম। এখান থেকে। আগড়তলা শহর অনেক দূর। একজন পথচারীকে জিজ্ঞাসা করে বাসে চড়ে বসলাম। কন্ডাক্টর আমার পরিচয় জেনে আমার কাছ থেকে ভাড়াও নেন নাই। উপরন্তু বসার জায়গা করে দিলেন এবং শহরে পৌছে রাজবাড়ির পথও দেখিয়ে দিলেন।
৬৮
পুনরায় আগরতলায়
একদিনের পরিচিত শহর আগরতলা। সব কিছুই প্রায় নতুন। মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করে রাজবাড়ির বাগানে পৌছলাম। ২৭শে মার্চ রাজবাড়ির গেইটে রাজ্য কংগ্রেসের অফিসে এসেছিলাম। আজ আবার আশা নিয়ে এলাম এই অফিসে নেতাদের সাথে দেখা করতে। কারাে সাথে দেখা হলে আমার পরবর্তী উদ্দেশ্য সফল হবে এই আশা নিয়ে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল। কংগ্রেস অফিস বন্ধ, তালা ঝুলছে। আর আমাকে অসহায় মনে হচ্ছে। কিযে করি। পথিমধ্যে আমাদের এলাকার কয়েকজন পরিচিতকে পেলাম। হাঁটাচলা দেখে মনে হলাে তারা ইতিমধ্যে আগরতলায় বেশ মানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু জিজ্ঞেস করেও আমার আশ্রয় নেবার ঠিকানা পেলাম না। সবাই যেন কেমন এড়িয়ে চলে যায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা সমাগত। সারাদিন দানাপানি কিছুই পেটে পড়েনি। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে চানাচুর কিনে বাগানের একটি বেঞ্চে বসলাম। এদেশে পাকিস্তানী মুদ্রা চলে। ভীষণ ক্লান্ত। পাশের চাপকল থেকে হাতে পানি নিয়ে খেয়ে প্রাণ জুড়ালাম। ভাবছি রাতটা কিভাবে কাটাব। চোখে পড়ল রাজবাড়ির বারান্দায় কয়েকজন বিছানা পাতছে। হয়ত তারা এখানেই রাত কাটাবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, পুটলিটা মাথায় দিয়ে আজ রাতটা এই বারান্দাতেই কাটিয়ে দেব। কাল সকালে যা কিছু একটা করা যাবে। অবসন্ন দেহটা বেঞ্চে এলিয়ে দিয়ে ভাবছি, এককালের প্রভাবশালী এই রাজবাড়িটির কথা। এক সময় যার ত্রিসীমানায়ও কেউ আসতে সাহস পেত না। এদিকে তাকালে বুক কেঁপে উঠত। প্রাসাদের জলসাঘরে ঝলমলে আলােয় বাইজীর নৃত্য ঝংকার আর সুরা পানের উন্মুক্ত আসর বসতাে। এই রাজবাড়ির দেয়ালে কত হাসি-কান্না যে বিলীন হয়ে আছে ইতিহাসের অন্তরালে। আজ এই বাড়িটি পরিত্যক্ত। নাই শান-শওকত, নাই পাইক পেয়াদা, সৈন্যসামন্ত, হাতী ঘােড়া, লােকলস্কর। আজ এই বাড়িটি ইতিহাসের কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর । এখানে পৌছতে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়েছে আমাকে। কত কল্পনাই না মনের মধ্যে ভেসে আসতে লাগলাে। আজ এই রাজবাড়ির বারান্দায় অন্যান্য ছিন্নমূল মানুষের মতাে রাত কাটাব আমিও।
অন্ধকার দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হচ্ছিল। উদ্বিগ্ন চোখে সামনে তাকিয়ে দেখি, কেউ একজন এই বাগানেই আমার পাশের রাস্তা দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার, কাছাকাছি হতেই পথিককে আমি চিনতে পারলাম । আনােয়ার হােসেন (বাচ্চু)। ছােট বেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু । আখাউড়ায় একই এলাকায় আমাদের দুই পরিবারের বসবাস। একই স্কুলের ছাত্র। এই ভয়াবহ দিনে কে কোথায় কেউ কারাে খবর জানে না। সকলেই নিজেকে বাঁচাতে ছুটাছুটি করছে। কারাে খবর নেয়ার অবস্থা ছিল না। নাম ধরে ডাকতেই থমকে দাঁড়ালাে, তারপর আমার কাছে এগিয়ে এল বাচ্চু। কুশলাদি বিনিময়ের পর জানতে চাইল আমি কোথায় উঠেছি। সে হয়ত বুঝতে পারেনি যে, আমি কিছুক্ষণ হলাে এদেশে এসেছি। বাচ্চুকে দেখে আমার মনে সাহস সঞ্চিত হলাে। তাকে সব খুলে বল্লাম। কোথায় যাবাে সে বিষয়ে তার পরামর্শ চাইলাম। কোনাে কথার জবাব না দিয়ে সরাসরি বাচ্চু বললাে, এখন তুমি আমার সঙ্গে চলাে। কাল দেখা যাবে কি করা যায়। মন আনন্দে ভরে
৬৯
উঠল। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাচ্চুর সঙ্গে রওনা দিলাম। সৃষ্টিকর্তা তার বান্দাকে এমনি ভাবেই রক্ষা করে। প্রায় ১০ কিঃ মিঃ পথ পাবলিক বাসে অতিক্রম করে নরসিংগড়ে অবস্থিত আগরতলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের হােস্টেলে গিয়ে উঠলাম। বাচ্চুর আব্বা-আম্মা, ভাই-বোেন সবাই আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। গভীর আগ্রহ নিয়ে আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার খোঁজখবর জানতে চাইলেন। আমাদের পরিবার ও পরিচিতদের খবরাখবরও জিজ্ঞেস করলেন। যতটুকু জানি সবই বললাম। রাতে তাদের জন্য বরাদ্দ ত্রিপুরা সরকারের সাহায্যের অন্নে হােস্টেলের মেঝেতে বসে। আমারও নৈশভােজ সম্পন্ন হল। সারা দিনের অভুক্ত পেটের জ্বালা এভাবেই মিটল। বাচ্চুর আব্বা আখাউড়ায় রেলওয়ের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, যুদ্ধের এই ভয়াবহতায় পুরা পরিবার নিয়ে তিনি এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন, তেমনিভাবে অনেকেই।
হােস্টেলের একটি কক্ষে বাছুদের সাথেই মেঝেতে রাত কাটাবার ব্যবস্থা হল। ক্লান্ত দেহে নানা দুশ্চিন্তা এসে মন ভারি করে দিল । মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার জন্য কিছু করতে পারব তাে? যারা বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ভিটেমাটি ত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছে, তারা কি আর কোনােদিন স্বদেশে ফিরে যেতে পারবে ? আমাদের দেশ কি স্বাধীন হবে না? এমনি নানা প্রশ্ন। হােস্টেলটির অনেক কক্ষ তখনও খালি। কলেজ ছুটি দিয়ে বাংলাদেশী গণ্যমান্য শরণার্থীদের থাকার জন্য ত্রিপুরা রাজ্য সরকার এই ব্যবস্থা করেছেন।
এখানে বাংলাদেশের আরাে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি তাদের পরিবার নিয়ে উঠেছেন। পর দিন আমার থাকার জন্য স্বতন্ত্র একটি কক্ষ খুলে দেবার ব্যবস্থা করল বাচ্চু। কিন্তু সে ঘরে শােবার মতাে একটি চকি ছাড়া আর বিছানাপত্র নেই। লুঙ্গি তােয়ালে বিছায়ে তাতেই বিছানা পাতলাম। আগরতলা পলিটেকনিকের এই হােস্টেলটি সীমান্তের খুব কাছেই অবস্থিত। তাই হানাদার পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সংঘটিত সীমান্ত যুদ্ধের গােলাগুলির আওয়াজ এখান থেকে বেশ জোরে জোরেই শােনা যায়। যতদিন রাতে এই হােস্টেলে থেকেছি, প্রায় প্রতিদিনই গােলাগুলির আওয়াজ কানে ভেসে আসত । যেদিন গােলাগুলির আওয়াজ হত না, সেদিন মন খারাপ হয়ে যেত। মনে হতাে আমরা কি তাহলে হেরে যাচ্ছি? আমাদের দেশ কি স্বাধীন হবে না?
আগেই উল্লেখ করেছি, সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা প্রবেশের আগে মাতৃভূমির একখণ্ড মাটি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। মাঝে মধ্যে তা বের করে দেখে নেই । নাকে শুকি। ঐ মাটির ঘ্রাণ নেয়ার সময় আমি খুব আবেগী হয়ে পড়ি। নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয় । জয় বাংলা, বাংলার জয় বা আমার সােনার বাংলা’ গানগুলি শুনলেও চোখে নেমে আসে অশ্রুধারা। দেশের মুক্তির জন্য কত তাজাপ্রাণ নিজের জীবন আত্মাহুতি দেয় অকাতরে এই আবেগেই। এই আবেগেই আমার মতাে যুবক মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে, দেশকে স্বাধীন করতে এই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। তখন মনে কেবল একটি চিন্তা বুকে গুলি নিয়ে হলেও এই দেশকে স্বাধীন করবাে । এই বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে কত বাঙালিকেইনা প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়েছে। কত নিরীহ বাঙালি সন্তানদেরকে এদেশেরই কুসন্তান আলবদর আলসামস, রাজাকার বাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে জাতির বিবেক বুদ্ধিজিবীদেরকে। কত বাঙালি
৭০
নারী শিশু যুবক বৃদ্ধাকে হত্যা করেছে পাকবাহিনী, আর এদেশের রাজাকার, আল-বদর আর এদেশে আশ্রয় নেয়া বিহারীরা কত বাঙালিকে ধরে নিয়ে জল্লাদখানায় জবাই করেছে। তুলে দিয়েছে কত মা বােনকে হানাদারদের হাতে তার হিসাব কে রাখে। যা পরবর্তীতে বধ্যভূমি হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে।

আগরতলায় কর্মব্যস্ত দিনগুলি
আগরতলার নরসিংগড়ের পলিটেকনিক হােস্টেলে থাকার জায়গা হল। বাছুর পরিবারের সাথেই আমার আহারেরও ব্যবস্থা হলাে আপাতত। পরবর্তীতে অবশ্য মুজিবনগর সরকারে যােগদান করায় আমার জন্য বরাদ্দ অর্থেই আমার এবং অনেককে সাহায্য করতে পেরেছি। শফিকেরও ব্যবস্থা চলছে আমারই টাকায়।
একদিন খবর পেলাম দেরাদুনে মুক্তিবাহিনীর অফিসার ট্রেনিংয়ের জন্য আগরতলা থেকে বাংলাদেশের যুবকদের বাছাই করে পাঠানাে হচ্ছে। আমি এ ধরনের সুযােগের অপেক্ষায় ছিলাম খােজখবর করে আগরতলা শহরে গেলাম। প্রথমে কর্নেল চৌমুহনির ‘জয় বাংলা অফিস থেকে বাংলাদেশের শরণার্থী হিসেবে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করলাম। এই পরিচয়পত্র থাকলে মােটামুটি নিরাপদে শহরে এবং বাসে বিনাভাড়ায় যাতায়াত করা যায়। আগরতলাবাসী এ সময় বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য অনেক ত্যাগ করে চলেছেন। নিজেদের অসুবিধা হলেও তারা আমাদের অনেক সাহায্য সহযােগিতা করেন। আমাদেরকে তারা জয় বাংলার মানুষ বলে সম্বােধন করত। আমরা বাসে উঠলে তারা নিজেরা দাড়িয়ে আমাদের বসার জায়গা করে দেন। বাসের কন্ডাক্টর আমাদের থেকে ভাড়া নিত না। অনেকে বাংলাদেশের মানুষের থাকার জন্য নিজেদের বাড়িঘরে পর্যন্ত জায়গা করে দিয়েছে। নিজেরা কষ্ট করে আমাদের জন্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা এবং সাহায্য সহযােগিতা করে যেন তারা আনন্দিত। জাতিগত কোনাে ভেদাভেদ দেখা গেল না। এতদিন পাকিস্তানীরা আমাদের দেশে ধর্মের দোহাই দিয়ে হিন্দু-মুসলমানদের মাঝে যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পেরেছিল তা আজ হার মানল মানবতার কাছে।
আগরতলা শহরে কৃষ্ণনগর নামক পাড়ায় একটি একতলা বাড়িতে মুজিবনগর সরকারের ইস্টার্ন জোনের অফিস স্থাপিত হয়েছে। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হাসান তওফিক ইমাম এই অফিরে জোনাল এডমিনিস্ট্রেটরের দায়িত্বে আছেন। আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য জহুর আহমদ চৌধুরী হলেন মুজিবনগর সরকারের লিবারেশন কাউন্সিলের ইস্টার্ন জোনের চেয়ারম্যান। জয়বাংলা অফিস থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে কৃষ্ণনগর অফিসে ইমাম সাহেবের সাথে দেখা করলাম। তাঁকে বিশেষভাবে অনুরােধ করলাম আমাকে দেরাদুনে ট্রেনিংয়ে পাঠানাের জন্য। তিনি জানান, দুই এক দিন আগেই একটি দল দেরাদুনে ট্রেনিংয়ে চলে গেছে। পরের ব্যাচেই তােমাকে পাঠানাে যাবে। এখন ত্রাণ কাজে অংশ গ্রহণ কর। ত্রাণের কাজ এখন জরুরি। বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ বাঙালি তখন ভারতে প্রবেশ করেছে। এদের আশ্রয়ের ব্যবস্থাই এখন জরুরি। তার কথায় এবং নির্দেশে নিষ্ঠার সাথে আমি ত্রাণ কাজে ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে গেলাম। ইমাম সাহেব আমার আত্মীয়। তার স্ত্রী আমার শ্রদ্ধেয় আপা। দূর সম্পর্কের হলেও তিনি তাঁর ছােট ভাইয়ের মতােই স্নেহ করতেন। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা
৭১
করব যতদিন বেঁচে আছি। তার জন্যই ইমাম সাহেব আমাকে শ্যালক হিসাবে অনেক সাহায্য সহযােগিতা করেছেন। তাঁর প্রতিদান আমি কোনােদিন দিতে পারব না। দেশ স্বাধীন হবার পরও তাঁরই সাহায্যে আজ আমি প্রতিষ্ঠিত। আমি চিরদিন তাঁর কাছে ঋণী । আমি তাঁর প্রতিদান দিতে চাই না। আমি তাঁর কাছে ঋণীই থাকতে চাই। আমি তাকে এতটাই শ্রদ্ধা করি যে, আমি কোনােদিন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে কোনাে । কথা বলতে পারিনি। এখনও এত বছর পর চাকরি জীবন থেকে অবসর নিলেও তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা এতটুকু কমেনি। তার সামনে গেলে এখনও আমার একই অবস্থা। হয়।
শুরু হলাে কৃষ্ণনগর অফিসে আমার ত্রাণ কাজ। বাংলাদেশ থেকে আগত বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও সরকারি কর্মচারীদের তালিকা প্রণয়ন করে, তালিকা অনুযায়ী কৃষ্ণনগর অফিস থেকে সাহায্য হিসাবে কিছু নগদ টাকা দেয়ার ব্যবস্থা হয়। অসহায় মানুষগুলি এই নগদ টাকা পেয়ে খুবই আনন্দিত হন। দুর্দিনে তা অনেক কাজে। লাগবে। এ কাজে আরাে কয়েকজনের সঙ্গে আমি অক্লান্ত পরিশ্রম করতে লাগলাম । আমাদের টিমটিকে সরাসরি তদারকি করতেন জোনাল চেয়ারম্যান জহুর আহমদ চৌধুরীসহ হাসান তৌফিক ইমাম (এইচ.টি.ইমাম) ও কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ প্রমুখ। রকিব উদ্দিন সাহেবকে আমি আগে থেকেই চিনি। পাক বাহিনী প্রবেশের পূর্বে তিনি ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মুক্ত থাকাকালে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচুর সহযােগিতা করেছেন। ইমাম সাহেব পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক থাকাকালে তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা পাকআর্মির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরােধ গড়ে তােলে। পরবর্তীতে পাকআর্মির বেপরােয়া আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে অফিসের অধিকাংশ কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ অফিস চালানাের মতাে আসবাবপত্র টাইপ রাইটার, কাগজ কলম এবং ৪টি গাড়ি নিয়ে তিনি আগরতলায় এসে কৃষ্ণনগরে এই অফসটি খােলেন। এখান থেকে ত্রিপুরা সরকারের সহযােগিতায় কলকাতায়। অবস্থানরত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ইমাম সাহেব পাকআমীর আগমনের সাথে সাথেই ভারত সরকারের সাথে যােগাযােগ করে যুদ্ধের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করেন এবং চট্টগ্রাম এলাকায় পাকআর্মীদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে সংগঠিত করেন এবং ভারতের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
পরবর্তীতে ইমাম সাহেব মুজিব নগর সরকারের কেবিনেট সচিব পদে নিয়ােগ পেয়ে কোলকাতায় যান। ইতিমধ্যে ইস্টার্ন জোনটিকে ২টি জোনে ভাগ করা হয়। কৃষ্ণনগর অফিসটি দক্ষিণ পূর্ব জোন-খ এর অফিস হিসেবে কাজ করতে থাকে। ইমাম সাহেবের স্থলে কাজী রকিবউদ্দিন সাহেব জোনের এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পান।
আমি যাদের সাথে কাজ করতাম তাদের কয়েকজনের নাম এখনাে মনে করতে পারছি। এদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযােগ্য হচ্ছেন লুত্যর রহমান, এস, এ, মাহমুদ, আসাদুজ্জামান ও আব্দুর রশিদ এরা সবাই ইমাম সাহেবের সাথে আগরতলায় এসেছেন। এরা দেশে বিভিন্ন সরকারি ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন। আমরা এই কয়জন এখন মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ কাজে ব্যস্ত।
আমি ছিলাম পিছুটানহীন একা এবং বয়সে সবার চাইতে তরুণ। তাই জহুর আহমদ চৌধুরী এবং রকিবউদ্দিন সাহেব সব সময় আমাকেই ত্রাণ কাজ ছাড়াও অধিক পরিশ্রমের কাজে জড়িয়ে রাখতেন। যেমন স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে টাকা তুলে
৭২
আনা, বাংলাদেশ সরকারের সরকারি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করানাে, মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে ত্রিপুরা সরকারের দপ্তরে যােগাযােগ ও কার্য সম্পন্ন করা, বাংলাদেশ ফোসের্স সদর দপ্তরের সাথে সরকারি নির্দেশ ও উপদেশসংক্রান্ত গােপনীয় পত্রাদি বহন করা এবং সঠিক লােকের নিকট পৌছান। সেক্টরসমূহের সাথে যােগাযােগ ও গুরত্বপূর্ণ খবরাখবর সংগ্রহ করা, শরণার্থী ক্যাম্পগুলিতে, ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা করা। এবং প্রতিবেদন সংগ্রহ করে সচিবালয়ে পেশ ও বিভিন্ন তালিকা প্রণয়ন প্রভৃতি। এছাড়াও দুই একবার বিশেষ কাজের জন্য যেমন গেরিলা নিয়ােগের জন্য যুবক। বাছাইয়ের কাজেও আমাকে জড়িত হতে হয়েছে। আবার কোনাে কোনাে সময় বিভিন্ন সেক্টরে গােলাবারুদ পৌছানাের কাজেও আমাকে পাঠান হয়েছে। এসব কাজে আমি এক পর্যায়ে দারুণভাবে জড়িয়ে পরলাম। এখন আমি মুজিবনগর সরকারের ইস্টার্ন জোনের লিয়াজো অফিসারও। আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে মুজিবনগর সরকার আমাকে নিয়ােগপত্রসহ বেতন-ভাতারও আদেশ দিলেন। ভাতার টাকা আমার জন্য তখন অনেক। পুরাে টাকা আমার প্রয়ােজন হতাে না। তাই ব্রাক্ষণবাড়ীয়া ও আখাউড়ার পরিচিত অসহায় লােকজনকে কিছু কিছু সাহায্য করতে পারতাম। আখাউড়া রেল কলােনির অনেক পরিবারই তখন আগরতলায় আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের অনেককেই খুব কষ্টের মধ্যে চলতে দেখেছি। অনেকেই আমাদের অফিসে সাহায্যের জন্য আসতেন। আমি আমার নিজের তরফ হতে এবং চেয়ারম্যান জহুর আহমদ সাহেবের অনুমােদন নিয়ে তাদেরকে কিছু বাড়তি সাহায্য করতে পেরেছিলাম। এদের অনেকেই ছিলেন আমার বাবার সহকর্মী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা আমার বাবার কাছে এসে এই সহযােগিতার কথা বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
আগরতলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলােমিটার দূরে নরসিংগড় পলিটেকনিক কলেজের হােস্টেলে থাকি। বন্ধু বাচ্চুর সঙ্গে এখানে এসে সেই যে উঠেছিলাম, আর স্থান বদল করিনি। বড় দুঃসময়ে বাচ্চুর হাত ধরে এখানে এসে আমি আশ্রয় পেয়েছিলাম। এই হােস্টেলটিতে বাংলাদেশের আরাে বেশ কয়েজজন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আশ্রয় নিয়েছেন পরিবার নিয়ে।
ক্রমান্বয়ে আগরতলাকে নিজের এলাকার মতােই মনে হতে লাগলাে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি শরণার্থীর চাপে উদ্ভূত নানা সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সত্ত্বেও আগরতলাবাসী শরণার্থীদের সানন্দে গ্রহণ করেছে। তখন ত্রিপুরা রাজ্যের অধিবাসী প্রায় ১৪ লক্ষ আর শরণার্থীও প্রায় সমপরিমাণ। ত্রিপুরার নারী বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকেই বহু পূর্বে বাংলাদেশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে এখানে চলে এসেছিলেন বা আসতে বাধ্য হয়েছিলেন তারাও আমাদের প্রতি গভীর আগ্রহ ও সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। এ-রাজ্যের বেশির ভাগ লােকই এক সময় বাংলাদেশের কুমিল্লা, নােয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার বাসিন্দা ছিলেন। একাত্তরে আগরতলা ও ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীরাও এই এলাকারই অধিবাসী। স্বভাবতই আমাদের প্রতি তাদের একটি বিশেষ আকর্ষণ এবং মমত্ববোেধ কাজ করেছে। অনেকেই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য সহযােগিতা করেছেন। তাদের কয়েকজনের কথা আজ মনে পড়ছে। আগরতলা বিমানবন্দরে চাকরি করতেন বাদল সাহা। তিনি নানাভাবে আমাদের সহযােগিতা করতেন। কারণ তাঁর পূর্ব-পুরুষ ব্রাক্ষণবাড়ীয়ারই বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর ছােটবােন বীণা আগরতলা মহিলা কলেজে বিএ ক্লাসের ছাত্রী। সে আমাকে নিজের ভাইয়ের মতােই দেখেছে। তার বান্ধবী শিখা চক্রবর্তী, ছােটভাই
৭৩
চন্দনও রীতিমতাে আমাদের খোঁজখবর রাখতাে। এরাও দেশভাগ হবার পর ব্রাক্ষণবাড়ীয়া থেকে আগরতলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। শিখা প্রায়ই বাড়ি থেকে আমাদের জন্য নানা ধরনের খাবার তৈরি করে পাঠাতাে। নিমন্ত্রণ করেও খাইয়েছে তাদের বাড়িতে। শিখার আন্তরিকতা আমার হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। পরবাসে শিখা আমার অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে নানা ভাবে সাহায্য সহযােগিতা করেছে। আপন করে নিয়েছে আমাকে। শিখা ছিল ৭ ভাইয়ের একমাত্র বােন। তার বাবা ছিলেন ডাক্তার। তপন নামে আরাে একজনের সঙ্গে আমাদের খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল। সেও প্রায়ই আমাদের খবরাখবর নিত। প্রয়ােজনে সাহায্য করত। আরাে স্থানীয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল। তারা সকলেই আমাদেরকে নানাভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন।
আগরতলার সেই বন্ধুদের আজ আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তাদের আন্তরিকতা আর অকৃত্রিম ভালােবাসা আমার মনে চিরজাগ্রত হয়ে আছে।
এখন আমি ত্রাণ কাজে খুবই ব্যস্ত । লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে খাবার, পানি, স্যানিটেশন, চিকিৎসা, ঘটিবাটি, থালাকম্বল ইত্যাদি ক্যাম্পগুলােতে সময়মতাে পৌছানাের ব্যবস্থা করা। জোনের বড় দায়িত্ব এসে পড়ল আমার ঘাড়ে। মেজর খালেদ মমাশাররফ হঠাৎ করে একদিন আমাদের অফিসে এলেন। একজন দায়িত্বশীল লােক চান তিনি, যাকে একটি ইয়ুথ ক্যাম্পে পাঠানাে হবে। জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার কাজী রকিব উদ্দিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। মেজর খালেদ মােশাররফ আমাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে হাতেলেখা একটি বার্তা ক্যাম্প ইনচার্জের হাতে দিতে বললেন। আমাকে একটি জিপে অরুন্ধুতি নগর ইয়ুথ ক্যাম্পে যেতে বললেন। আমি আমাদের অফিসের কাজে (বাংলাদেশ থেকে আনা) রাঙামাটি ক-১ জিপে চড়ে যাত্রা। করলাম, জিপটি রাঙামাটি জেলা প্রশাসক হাসান তৌফিক ইমাম সাহেব (এইচ টি ইমাম) রাঙামাটি থেকে নিয়ে এসেছিলেন। আমার উপর নির্দেশ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা অনেক ছাত্র ঐ ক্যাম্পে অবস্থান করছে। সেখান থেকে বাছাই করে ৫/৬জন স্বাস্থ্যবান এবং পদার্থ বিজ্ঞানের অনার্সের ছাত্র সঙ্গে নিয়ে আসতে হবে। পথিমধ্যে ভীষণ বৃষ্টি নামল লাল মাটির উঁচুনিচু ছােট পাহাড় আর টিলার রাস্তা দিয়ে জিপ চালিয়ে যাওয়া কঠিন। লালমাটি শুকনাে হলে বড়ই কঠিন আর ভিজলে খুবই নরম। জিপ উঁচুতে উঠতেই চায় না। বিপদের ঝুঁকি অনেক। কোনােক্রমে স্লিপ কেটে পড়ে গেলে গভীর খাদে পরে জীবনাবসান ঘটবে। আল্লাহকে স্মরণ করছি। ড্রাইভার বেশ পটু । উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসিকতা দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত ক্যাম্পে গিয়ে পৌছালাম। উঁচু জায়গায় সমতল মাঠ। বৃষ্টি থেমে গেছে। ক্যাম্প ইনচার্জের কাছে মেজর খালেদ মােশাররফের চিঠি দিলাম। তিনি চিঠিটি পেয়ে সবাইকে একটি বড় ছনের ঘরে ডাকলেন। ঘরটি কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের যুবকদের থাকার জন্য তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আমার এবং ড্রাইভারের খাওয়ার ব্যবস্থা হল। ক্যাম্প ইনচার্জ সমবেত যুবকদের মাঝ থেকে আমাকে বাছাই করতে বললেন। চাহিদা মতাে ২৫/৩০ জন পাওয়া গেল। কিন্তু এত লােকতাে নেয়া যাবে না। আমার প্রতি নির্দেশ ৫/৬ জনের। ছাত্রদের মন খারাপ হয়ে গেল। এখানে তারা প্রায় ২ মাস যাবৎ অপেক্ষা করছে যুদ্ধের ট্রেনিংয়ে যাবার জন্য। যুবকদের এই অসহায় অবস্থার কারণ ট্রেনিং নিয়েই ওরা অস্ত্রের জন্য অস্থির হয়ে উঠে। কিন্তু ভারত সরকার বা আমাদের সরকার এ মুহূর্তে এত অস্ত্র সরবরাহ করতে পারছে না বলে প্রশিক্ষণের কাজ চলছে ধীর
৭৪
গতিতে। তাই ইয়ুথ ক্যাম্পেই তাদেরকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কয়েকজন যুবক ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অনুরােধ করতে লাগল তাদের নেয়ার জন্য। অনেকের চোখে পানিও গড়িয়ে পড়লাে। আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। প্রতিটি ইয়ুথ ক্যাম্পে এ ধরনের প্রচুর যুবক এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সকলের অবস্থা একই রকম। ট্রেনিং এবং অস্ত্র সরবরাহ করতে পারলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে খুব বেশি দিন লাগবে না। শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে তাদের মধ্য থেকে মােট ৮জনকে সঙ্গে নিয়ে এলাম। তখনও আমি ভাবতে পারিনি মেজর খালেদ মােশাররফ এদের কি কাজে লাগাবেন। পরে জানতে পারলাম এদেরকে এক্সকুসিভ প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা যােদ্ধা হিসাবে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠান হয়েছে অপারেশন চালাতে । এক্সকুসিভ দিয়ে পাকআর্মিদের পথ চলার ব্রিজ কালভার্ট বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করতে।
আরেকদিন বিকেলে আকস্মিকভাবে মেজর খালেদ মােশাররফ আমাদের অফিসে এসে হাজির হলেন। জহুর আহমদ চৌধুরী সাহেবের সাথে আলােচনা শেষে আমার সাথে দেখা। বললেন, চল আমার সঙ্গে। আমি তার জিপের পেছনে চড়ে বসলাম। আরাে একজন উঠলেন। তাকে আমি চিনি কিন্তু এখন তার নাম মনে করতে পারছি।
পথে মেজর খালেদ মােশাররফ অনেক কথা বললেন। মুক্তিযুদ্ধ করতে হলে আমাদের কি ধরনের ত্যাগ করা উচিত। কিভাবে এবং কত তাড়াতাড়ি আমাদের যুদ্ধ। জয় করে দেশে ফিরতে হবে। আর বিলম্ব হলে কি রকম অসুবিধা হবে ইত্যাদি আরাে অনেক প্রসঙ্গ। সন্ধ্যার পর মনতলী মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পৌছলাম । ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন এখানকার সাব সেক্টর কমান্ডার । চাদনী রাত মুক্তিযােদ্ধারা সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করছে খালেদ মােশাররফ তাদের মধ্যে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। বললেন, এখন বাংলাদেশের দুর্দিন। এখন বাঙালিদের দিয়ে শক্ররা রাজাকার আলবদর বাহিনী গড়েছে। বাজাকাররাই এখন আমাদের বড় শত্রু। আমরা আগে আমাদের শত্রুকে খুব সহজেই চিনতে পারতাম। কিন্তু এখন গেরিলারা ভিতরে ঢুকে অপারেশন চালাতে পারে না। রাজাকাররা গেরিলাদের ধরে ফেলে। কারণ আমাদের গেরিলাদের হাতে আমরা কেবল গ্রেনেড দিয়ে পাঠাই। তারা গ্রেনেড চার্জও করে কিন্তু নিজের জীবন বাঁচিয়ে ফিরতে পারে না। কারণ তাদের সাথে তেমন কোনাে অস্ত্র থাকে না । কাজেই এরপর থেকে আমরা গেরিলাদের সাথে স্টেনগান ও রিভলবার দেব যাতে তারা নিজের জীবন বাঁচাতে পারে। তাছাড়া আমাদের যুবকদের তেমন কোন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারছি না। কারণ ট্রেনিং দেয়ার পর তাদেরকে ধরে রাখা সম্ভব হয় না। অস্ত্রের জন্য পাগল হয়ে যায়। ভারত সরকার অস্ত্র সরবরাহ করছে না। তাই আমাদের যুবকদের ট্রেনিং কোর্স মন্থর গতিতে চালাতে হচ্ছে। আমরা কিছু কিছু যুবককে স্বল্প। সময়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা হিসেবে ভেতরে পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। তাদেরকে বলা হচ্ছে ভিত্তিফৌজ। প্রয়ােজনে তারা রাজাকার হয়ে আমাদের গেরিলাদের নিরাপত্তা ও খবরাখবর দেবে। পরবর্তীতে এই ভিত্তি ফৌজের ছেলেরা দেশের ভিতরের খবরাখবর সংগ্রহ এবং রাজাকারদের সাথে যােগাযােগ করে মুক্তিবাহিনীকে সহযােগিতা করেছে।
সেখান থেকে খালেদ মােশাররফ সাহেব আবার রওয়ানা দিলেন ১ নং সেক্টরের উদ্দেশ্যে। আমাদের অন্য একটি গাড়িতে আগরতলায় পৌছবার ব্যবস্থা করলেন। রাত প্রায় ৩টায় আগরতলা শহরে এসে পৌছলাম। সেদিনের তার সেই বক্তৃতা আজো আমার মনে গেঁথে আছে। আমরা এই বীর সন্তানের মূল্য দিতে পারলাম না। তাঁকে সাধের স্বাধীন দেশে অপমানজনক মৃত্যুবরণ করেত হলাে। অপবাদ দেয়া হল ভারতের
৭৫
দালাল হিসেবে । যাকে দেখেছি বাংলাদেশের স্বার্থের ব্যাপারে প্রায়শঃই ভারতীয় সৈন্যদের বিরােধিতা করতে । যে বীরসন্তান সম্মুখ যুদ্ধ করতে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তিনি ২নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।

মার্কিন সিনেটের কেনেডির সাথে দেখা
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির প্রতিপক্ষ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসর আমেরিকা। আমেরিকান সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক সাব কমিটির চেয়ারম্যান এডওয়ার্ড কেনেডি ছিলেন একজন মানবতাবাদী রাজনীতিক। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমের চাপে মনের তাগিদে বাংলাদেশের পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের নৃশংসতার বাস্তব অবস্থা সরেজমিনে অনুসন্ধানের জন্য তিনি প্রথম ভারতে সফরে আসেন সেপ্টেম্বররের শেষ দিকে। পত্র-পত্রিকা, স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশবাণীতে সে খবর পাচ্ছিলাম। মিঃ কেনেডি সস্ত্রীক পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন এবং স্মরণাতীতকালের সর্ববৃহৎ উদ্বাস্তু শিবির লবণ হ্রদে গিয়ে মানুষের কষ্ট ও মানবতার অপমান দেখে মর্মাহত হয়ে পরেন। সেই কেনেডি ত্রিপুরাতেও এলেন অক্টোবরের প্রথম দিকে। তার আগমনে আমাদের কাজের চাপ কিছুটা বাড়লাে। যদিও তিনি ভারত সরকারের নিরাপত্তা ও আতিথ্য নিয়েই এসেছেন। কিন্তু বিষয়তাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং শরণার্থীদের সমস্যা। আমরা মুজিবনগর সরকারের তরফ হতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোেদ্ধ:দের হাসপাতাল এবং ২/৩ টি শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের ব্যাপারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করে ঠিক করে রাখলাম এবং সে মােতাবেক মিঃ কেনেডিকে স্বাগত জানানাের জন্য মুজিবনগর সরকার এবং ত্রিপুরা সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দের সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। মিঃ কেনেডি গাড়ি থেকে নেমে তাঁকে স্বাগত জানাতেই তিনি আমাদের সকলের সঙ্গে একে একে হাত মেলালেন। বঙ্গবন্ধু যে পশ্চিম পাকিস্তানের মিরানওয়ালী জেলে বন্দী আছেন এবং সুস্থ আছেন মিঃ কেনেডিই প্রথম এ খবর ত্রিপুরা সফরে এসে আমাদের জানিয়ে যান। তার কয়েক দিনের মধ্যেই আমার প্রতি নির্দেশ হলাে একটি মিশনের দায়িত্ব নিয়ে কলকাতায় যাওয়ার। কলকাতা থেকে আরাে অনেকের সাথে দিল্লী বাংলাদেশ মিশনে যেতে হবে। পাকিস্তানী সেনাদের বর্বতার হত্যার প্রতিবাদ জানাতে। সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে । পরবর্তীতে প্রয়ােজন না হওয়ায় আমার আর দিল্লী যাওয়া হলাে না নতুন নির্দেশ হলাে কলকাতাতেই নতুন দায়িত্ব নেবার। আমি নিষ্ঠার সাথে তা পালন করলাম। আজ আমেরিকার সেই মানবতাবাদী নেতা এডওয়ার্ড কেনেডিও বেঁচে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তার কর্ম এই পৃথিবীর বুকে এবং এই বাংলাদেশের মানুষের মাঝে । আমি তাঁকে কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করি ।

আমরা স্বাধীন হলাম
আমি তখন কলকাতায়। কলকাতায় আমাকে নতুন দায়িত্ব দেয়া হলাে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের অধীন মুজিবনগর সরকারের প্রানিং সেলে চলছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনপ্রণালী, পরিকল্পনা গঠন ইত্যাদি নিয়ে কাজ। বুঝতে পারলাম খুব শীঘ্রই দেশ স্বাধীন হতে চলেছে। আমার উপর পড়ল সরকার গঠন, প্রক্রিয়ার অর্গানােগ্রাম তৈয়ার করা। অর্থাৎ সরকার পরিচালনার ব্যবস্থা তৈয়ার করার ছক অংকন করা । আমার সাথে পাবনার আর এক যুবক। দুজনই প্রকৌশলী । নির্দেশ অনুযায়ী দুজন
৭৬
মিলে সরকার গঠনের ছক এঁকে দিলাম। পরিকল্পনা ও পরিচালনার একটি রিপাের্টও তৈয়ার করে দিলাম। ইতিমধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেল। ৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয় ভারত। তার পরের দিন অর্থাৎ ৭ ডিসেম্বর দেয় ভুটান। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরাসরি অবস্থান নেয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। হামলাকারী পাকিস্তানের পক্ষে। সব আরব দেশ ও আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
ডিসেম্বর ১৩ তারিখ মার্কিন সপ্তম নৌবহর রওয়ানা দেয় বঙ্গপােসাগরের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানকে সাহায্য ও শক্তি যােগাতে।
চীন ভারতের উত্তর সীমান্তে উসকানিমূলক আচরণ শুরু করে। পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের যুদ্ধ চলছে আর দক্ষিণ দিকে ভারত মহাসাগর হয়ে সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পাস হতে চলেছে পাকিস্তানকে সাহায্য ও শক্তি যােগাতে ।
চীন ভারতের উত্তর সীমান্তে উস্কানিমূলক আচরণ শুরু করে। পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের যুদ্ধ চলছে আর দক্ষিণ দিকে ভারত মহাসাগর হয়ে সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পাস হতে চলেছে ভারত আর আমাদের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে আমাদের নেত্রীবৃন্দ আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত করে নিয়ে গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর দৃঢ়তা, সাহায্য, সহযােগিতা, প্রজ্ঞা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে আমাদের এই প্রিয় ভূমিকে আমরা ৯ মাসের মধ্যে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছি। সারা বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধা আর ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিশ্বের নামকরা সৈন্য এবং আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত প্রায় ৯৩ হাজার পাক সৈন্যের এবং কয়েক হাজার এদেশীয় রাজাকার আলবদর আলসস ও পাকিস্তান সৈন্যদের সাহায্যকারী বাঙালির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ‘৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর তারিখে আমরা জয়ী হয়ে নুতন দেশ বাংলাদেশ পেলাম। দেশ স্বাধীন। ভারতে আশ্রয় নেয়া প্রায় এককোটি বাঙালি আর মুক্তিযােদ্ধারা দেশে ফিরতে লাগল। কেবল ফিরল না অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধা। যারা দেশের মুক্তির জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিল । মূল্যবান জীবনকে তুচ্ছ করে এই দেশকে মুক্ত করল। তাদের অনেকেরই কবর বাংলাদেশের মাটিতে জুটল না। তারা ঘুমিয়ে আছে অন্য দেশে। আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। দেশ শাসন করছি আমরা। ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়ি-গাড়ি, দেশ বিদেশে চাকরি সবই হয়েছে। স্বাধীন দেশের বাঙালিদের যারা দেশের স্বাধীনতা চেয়েছে যারা স্বাধীনতা চায় নাই তারা সবাই স্বাধীনতার ফল ভােগ করছে। কিন্তু কেউ কি মনে করে। সেই শহীদদের যাদের জীবনের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন। এই যুদ্ধে হাজারে হাজারে মুক্তিযােদ্ধা, নিরীহ মানুষ আর প্রায় হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য আত্মাহুতি দিল । এখন আমার ঘরে ফেরার পালা। যত তাড়াতাড়ি দেশে ফিরা চাই। বাংলাদেশ। সরকারের সকল দপ্তর গােছান হচ্ছে। আমাকে নতুন দায়িত্ব নিয়ে দেশে আসার নির্দেশ দেয়া হলাে। আমি কিছুতেই রাজী হলাম না। বাড়ি ফেরার জন্য মন অস্থির হয়ে আছে। নতুন দায়িত্ব নিলে আবার আমি কাজে জড়িয়ে যাব। এখন আর আমার মন বসছে না। আমাকে অব্যাহতি দিতে অনুরােধ করলাম। মুজিবনগর সরকার আমাকে অব্যাহতি দিলেন । জানি না বাড়ির সবার অবস্থা কেমন। এত বড় একটা যুদ্ধ হয়ে
৭৭
গেল কে বাঁচে কে মরে আল্লাই জানেন। আগরতলায় থাকলে সহজেই বাড়িতে পৌছে যেতে পারতাম। কিন্তু কলকাতা থেকে সেটা কিছুতেই সম্ভব নয় । বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে সড়ক পথে যাওয়া যাবে না। শুনেছি পথ-ঘাট ব্রিজ-কালভাট সব ভাঙা। তাই বাড়ি পৌছাতে এখন সহজ পথ আগরতলায় পৌছান। সেখান থেকে কয়েক মাইল মাত্র আখাউড়া। যেইভাবেই হােক আমার আগরতলায় পৌছা দরকার। যেভাবে প্রথম আগরতলায় এসেছিলাম সেইভাবেই আবার ফিরব। বিমানে আগরতলা ফেরার চিন্তা করলাম। কিন্তু কোনাে বিমানেই খুব তাড়াতাড়ি টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। অবশেষে ডেকোটা বিমানে টিকেট পেলাম, তাও জানুয়ারির ১০ তারিখের। সরকারের নির্দেশে নতুন কাজে গেলে কখন ঢাকায় পৌছে যেতাম। ভুল হল। দিন গুনছি কবে ১০ তারিখ আসবে। মন ছটফট করছে। ইচ্ছে হচ্ছে উড়ে বাড়ি চলে যাই। এদিকে দেশে সবাই ভাবছে আমি আর ফিরব না। আমি হয়ত বেঁচে নেই। তখন ত এখনকার মতাে। যােগাযােগের ব্যবস্থা ছিল না। ছটফট করতে করতে একদিন তারিখটি এল। ইতিমধ্যে আগরতলা থেকে বন্ধু শিখা কলকাতা এল চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। সে আমাদেরকে খুঁজে বের করে এবং ১০ই জানুয়ারি ফেরার দিন শহরের বিমান অফিসে। এসে দেখা করে বিদায় জানায়। বিদায়কালে তার এবং আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে আসে। বিপদের দিনের সেই অকৃত্রিম বন্ধুর কথা ভুলার নয়। এরপর আর কোনাে দিন শিখার সাথে আমার দেখা হয়নি, যােগাযােগও হয়নি। জানি না আগরতলার দুর্দিনের। ঐ আত্মীয়সম বন্ধুরা এখন কেমন আছেন। তাদের কাছে আমি চিরঋণী। আগরতলা বিমানবন্দরে নামলাম। একই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তার সাধের বাংলার মাটিতে পা ফেললেন। দুঃখের বিষয় একাত্তরের পরাজিত শক্তি রাজাকার-আলবদর-আলশামস ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের ও অন্যান্য রাজনৈতিক দোসরদের বিচার হলাে না। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সরকার এদের বিচারের জন্য এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে মানবতাবিরােধী অপরাধের বিচার কাজ শুরু করেন। ট্রাইবুনাল মানবতাবিরােধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ৩৭৪৭১ জনের বিচার শুরু করে। এবং ১৯৭৩ সালের ৩১শে অক্টোবরে ৭৫২ জনকে তাদের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। ২০৯৬ জনের অভিযােগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের খালাশ দেয়া হয়। একই বছর ৩০ নভেম্বর লঘু অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ছিল প্রায় ২৬,০০০ জনকে সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করে মুক্তি দেয়া হয়। তবে যে সব অভিযুক্ত হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ আর জঘন্য অপরাধের দায়ে কারারুদ্ধ ছিল, তাদের সাধারণ ক্ষমার। আওতার বাইরে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে পর্যন্ত এ সব অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে ১১,০০০ অপরাধীর বিচার প্রক্রিয়া চলছিল। বাঙালি জাতির জনক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে দেশ গড়তে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন সােনার বাংলা গড়তে । ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস, জাতিদ্রোহী এই কুলাংগাররা মহান নেতার মহানুভবতাকে পদদলিত করে কিছু বিপথগামী সৈন্যদ্বারা সপরিবারে তাকে হত্যা করলাে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। অবসান ঘটল এক মহান নেতার মহাপ্রাণের। বঙ্গবন্ধু তার সাধের বাঙালির রক্তের ঋণ এভাবেই শােধ দিলেন। যার বুকের ভেতর লুকিয়ে ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণ। যার হাতের আঙুলের ইশারায় একদিন বাঙালি জাতি হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ও উন্নত প্রশিক্ষণে সমৃদ্ধ একটি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে। বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে এদেশকে
৭৮
স্বাধীনতা দিল। সেই নেতার হত্যাকাণ্ড দেখলাে মুক্তিযােদ্ধারা। ঘৃণাভরে তাকালাে বিশ্ববাসী বাংলাদেশের মানচিত্রের উপর। জাতির পিতার অবর্তমানে পরবর্তীতে সকল যুদ্ধাপরাধী মুক্ত হয়ে এই স্বাধীন দেশেরই রাজত্ব করল। ইতিহাসের এই কলঙ্ক আমরা ঘুচাতে পারব কি? পারব কি যুদ্ধাপরাধীদেরকে বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড় করতে? পারব কি দণ্ড দিতে? যারা বাঙালিকে চিরদিন গােলাম করে রাখতে চেয়েছিল তাদেরকে? আর যারা এই সকল যুদ্ধাপরাধী খুনীদের প্রতিষ্ঠিত করেছে বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের আশ্রয় এবং প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, করেছে পুরস্কৃত তাদের? অবশ্যই জাতির পিতা হত্যাকারী এবং মুক্তিযােদ্ধের চেতনা ধ্বংসকারীদের বিচার একদিন হবেই। ইতিমধ্যে জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, বাস্তবায়নও হয়েছে কিছুটা। এই জাতির অপবাদ ঘােচাতে আমাদের এই প্রজন্ম অবশ্যই পারবে । যে আশা নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধ করে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলাকে মুক্ত করেছে,আমরা আশা করব যে কাজ আমরা শেষ করতে পারিনি তা এই প্রজন্ম শেষ করবে। তারা বঙ্গবন্ধুর সােনার বাংলা গড়ে তুলবে। এই আশা নিয়ে এখনও বেঁচে আছি। সেই দিন আর বেঁচে থাকব কিনা জানি না।

স্বাধীন মাটিতে পা দিলাম
মুজিবনগর সরকারের দেয়া সব কাজ গুটিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। আর কোনাে কাজ নয়। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা চাই । মাবাবা আত্মীয়-স্বজন আমার ফেরার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। কোনাে রকম যােগাযােগ ছাড়াই ১০ই জানুয়ারি আগরতলা বিমানবন্দরে নামলাম। সেখান থেকে সােজা আখাউড়া সীমান্তে উপস্থিত হই। সীমান্তের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আখাউড়ায় এসে পৌছলাম। ট্রেনে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে পাঘাচং স্টেশনে নামি। স্টেশনে নেমেই মিরণকে পেলাম। সে রােজই সবকটা ট্রেনের সময় স্টেশনে আসে। আর আমাকে খোঁজ করে। তার কাছে অনেকের মৃত্যুর সংবাদ শুনলাম। দেশে ফেরার শত আনন্দ এবং বেদনায় নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। সারাটা পথ কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে পৌছলাম। মাবাবা সবাই আমাকে পেয়ে খুশি। এতদিন পর তাদের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটল। সবাই হয়ত ভেবেছিল আমি আর ফিরতে পারব কিনা । আমরা স্বাধীন হলাম। পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নিল একটি নতুন দেশের যার নাম বাংলাদেশ। পেলাম একটি পতাকা। বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আমি সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনার একজন সৈনিক মাত্র। ৩০ লক্ষ প্রাণ আর প্রায় ২ লক্ষ মা বােনের ইজ্জত আর প্রায় দেড় কোটি আবাল-বৃদ্ধবনিতার যুদ্ধের ভয়াবহতায় বাড়ি-ঘর জায়গা-জমি সহায় সম্বল ফেলে দীর্ঘ নয় মাস পররাষ্ট্রে আশ্রয় শিবিরগুলােতে মানবেতর জীবন যাপন করে বেঁচে ছিল আর দেশের অভ্যন্তরে যারা শক্ৰবেষ্টিত অবস্থায় দুঃসহ, অনিশ্চিত ও ভয়াবহ জীবন যাপন করেছে তারা একটু স্বস্তি পেল। নয় মাস স্থায়ী একটি অসম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি আমাদের এই স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির প্রায় শতকরা নিরানব্বই শতাংশ মানুষই কোনে না কোনাে ভাবে এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ বা সাহায্য সহযােগিতা করেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার দিয়ে সাহায্য করেছে। তাদের অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে হায়েনা আর রাজাকারদের হাতে। হয়েছে লাঞ্ছিত, হয়েছে। চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত । কেবল কিছু সংখ্যক বাঙালির কলঙ্ক রাজাকার, আলবদর, আল সামস আর ঐ সকল বেইমান স্বাধীনতাবিরােধী ছাড়া। আজ এই প্রজন্মের অনেকেরই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ উদ্দেশ্য, চেতনা আর লক্ষ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। তারা
৭৯
কল্পনাও করতে পারছে না সেই দিনের ভয়াবহ অবস্থা আর দুর্ভোগের কথা । আমাদের এই দেশ আমাদের সন্তান। একজন মা যেমন ৯ মাস তিলে তিলে গর্ভ ধারণ করে একটি সন্তানের জন্ম দেয় ঠিক তেমনি ৯ মাস প্রতিনিয়ত জীবন বাজি রেখে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে আমরা এই স্বাধীন রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছি। তাই আমাদের এই প্রিয় সন্তানটি নিয়ে আমরা প্রতিনিয়তই ভাবি।
যুদ্ধশেষে স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রেখে ভাবলাম, আমি স্বাধীন দেশের একজন গর্বিত সন্তান। দেশের সমাজে আমার কত মূল্য, কত সমাদর করবে আমাদেরকে। মানুষের ভালবাসা নিয়ে আমরা বাকি জীবন কাটাব। আমরা এ দেশের সূর্য সন্তান, আমরা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
আমাদের যুদ্ধ ছিল সকল প্রকার অন্যায়, অত্যাচার আর শােষণের বিরুদ্ধে। আমাদের স্বপ্ন ছিল একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার। যেখানে প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা থাকবে। মুক্তিযােদ্ধাদের সকল দায়িত্ব। এদেশের নাগরিকের, সরকারের। কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা আজ কোথায় তলিয়ে গেলাম। আমাদের সেই স্বপ্ন কোনােদিন পূরণ হবে কি? হ্যাঁ, আজ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। শত গঞ্জনা আর রাজনৈতিক উত্থানপতনের মাঝেও বাঙালির অনেক উন্নতি হয়েছে। হয়েছে বাংলাদেশের উন্নতি। সারা পৃথিবীতে বাঙালিরা এখন মাথা তুলে। দাঁড়িয়েছে, বাঙালিরা এখন সব পারে। আজ বাংলা দেশকে সবাই চিনে। ভালমন্দ যাই হােক আমরা স্বাধীন জাতি। বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। বাঙালিরা এখন বৈদেশিক দূতাবাস চালায়, জাতিসংঘের সৈন্য বাহিনীতে সুনামের সাথে অংশ গ্রহণ করছে। খেলাধুলাসহ অন্যান্য কার্যক্রমে বিশ্বের অনেক দেশের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে। অনেক দেশে বাঙালিরা কাজ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বাংলাদেশের পণ্য এখন অনেক দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। এসবই দেশ স্বাধীন হওয়ার ফসল। পাকিস্তানীরা বাঙালিদের দাবায়ে রাখার জন্য বলে বেড়াত, বাঙালিরা কিছুই পারে না। আজ তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
অবশেষে স্বাধীন দেশে আর কিছু না হােক আমার যােগ্যতা অনুযায়ী একটি সরকারি চাকরি জুটল । নতুন মন নিয়ে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এবং ত্যাগের মনােভাব নিয়ে দেশের জন্য কাজ করার শপথ নিয়ে অর্পিত দ্বায়িত্ব পালন করতে এসে নানা অভিজ্ঞতা, সুবিধা অসুবিধা আর ১৯৭৫ সলের ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনায় সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার পর মুক্তিযােদ্ধা হিসাবে চাকরিতে বঞ্ছনা অবহেলা লাঞ্ছনা যন্ত্রণা আর মনের গভীর বেদনা নিয়ে প্রায় ৩৫ বছর কাটিয়ে চাকরি হতে অবসর নিলাম। আমার চাকরি জীবনে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ এবং প্রয়ােগ করতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খেয়েছি। হয়েছি। অবহেলিত অপমানিত বঞ্চিত হয়েছি ন্যায্য পাওনা হতে। যা সহ্য করে জীবনের একটি বিরাট সময় কাটিয়ে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর সত্যিকার ইতিহাস নতুন প্রজন্মের মাঝে দেখে যেতে পারলেই আমার মতাে বেঁচে যাওয়া সকল মুক্তিযােদ্ধারা শান্তি পাবে। আমার জীবনের পরবর্তী অধ্যায় চাকরি জীবনে কত প্রকার মানুষ এবং তাদের বিচিত্র চরিত্রের পরিচয় আমাকে বারবার অবাক করেছে, হয়েছি ব্যথিত। আর সহযােগিতাও পেয়েছি অনেক হৃদয়বান মানুষের।
৮০
Reference: ফিরে দেখা – সামসুজ্জোহা চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!