You dont have javascript enabled! Please enable it! 1948.03.11 | ১১ মার্চ ১৯৪৮- পূর্ববঙ্গে সাধারণ ধর্মঘট - সংগ্রামের নোটবুক

১১ মার্চ ১৯৪৮- পূর্ববঙ্গে সাধারণ ধর্মঘট

২৮ ফেব্রুয়ারি তমদুন মজলিস এবং পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথসভায় রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটি গঠিত হওয়ায় ইতিপূর্বে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অনানুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘঠে। শূন্যতা পূরণ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে ২রা মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে কমরুদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে বিভিন্ন ছাত্র-যুব-রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের এক যৌথসভা

১৮

অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন আবুল কাসেম, কাজী গােলাম মাহবুব, শামসুল আলম, রণেশ দাসগুপ্ত, আজিজ আহমদ, অজিত গুহ, শামসুদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল আলী, সরদার ফজলুল করিম, আলী আহমেদ, মহীউদ্দিন, শওকত আলী, আনােয়ারা খাতুন, অলি আহাদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুল আউয়াল, শহীদুল্লা কায়সার, তাজউদ্দিন আহমদ, লিলি খান, নুরুল আলম, আবদুল অদুদ প্রমুখ। সংগঠনগতভাবে গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তানে মুসলীম ছাত্রলীগ, ছাত্র ফেডারেশন, প্রগতি লেখক সংঘ এ দিনের সভায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সভায় শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির দুটি সভা ৪ ও ৫ মার্চ ১৯৪৮ ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত হয়। ১০ মার্চ একই হলে অনুষ্ঠিত সংগ্রাম কমিটির সভায় ১১ মার্চের সাধারণ ধর্মঘটের বিস্তারিত কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়। ঢাকা শহরের কোনাে কোনাে স্থানে পিকেটিং হবে, কে কোন পয়েন্টে নেতৃত্ব দেবে ইত্যাদি ঠিক করা হয় এই সভায়।

১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান নিয়েও নানা ধরনের চক্রান্ত চলে। আন্দোলনের অনভিজ্ঞতা, ভয়-ভীতি, মুসলিম লীগ সরকারের ষড়যন্ত্র, মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফর সবকিছু মিলিয়ে নেতৃত্বের অনেকেই দোদুল্যমানতায় ভুগছিলেন কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে। ভাষা আন্দোলনের এই পর্বে তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর দূরদৃষ্টি, সাহস এবং সাংগঠনিক দক্ষতা প্রথম পর্যায়ের এ আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আন্দোলনকে সংগঠিত করে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে যেতে তাঁর দৃঢ়প্রত্যয়ী ভূমিকা বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক বলেন,

“ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলাে। ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলাে। ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি সভা বসল। সভায় আপােশকারীদের ষড়যন্ত্র শুরু হলাে। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়কসহ অনেকেই তখন দোদুল্যমানতায় ভুগছে, আপস করতে চাইছে সরকারের সঙ্গে। একটি বজ্রকণ্ঠ সচকিত হয়ে উঠল- সরকার কি আপস প্রস্তাব দিয়েছে? নাজিমুদ্দিন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে। এই বজ্রকণ্ঠ ছিল শেখ মুজিবের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে সমর্থন দিলেন অলি আহাদ, তােয়াহা, মােগলটুলীর শওকত সাহেব, শামসুল হক সাহেব। আপােষকামীদর ষড়যন্ত্র ভেসে গেল।”

১৯

[সূত্র : ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, লেখক : মাযহারুল ইসলাম, পৃ. ২৪-২৫]

গাজীউল হকের বক্তব্যের সমর্থন মিললাে অলি আহাদের কথায়। এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ বলেন, “সেদিন সন্ধ্যায় যদি মুজিব ভাই ঢাকায় না পৌছাতেন তাহলে ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিং কিছুই হতাে না।”

সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-জীবন ও রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, সম্পাদকমােনায়েম সরকার, পৃ. ১৬৭]

১১ মার্চের সাধারণ ধর্মঘট সফল করার জন্য ভাের থেকেই ছাত্ররা রাস্তায় নেমে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জগন্নাথ কলেজসহ ঢাকা শহরের প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্ররা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পিকেটিং করে। নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাক, টেলিগ্রাফ অফিস, রেলওয়ে ওয়ার্কসপ ও রমনা পােস্ট অফিসে অবরােধ কর্মসূচি পালিত হয়। অফিসগামী জনসাধারণকে ফিরিয়ে দেয়। পিকেটাররা। হাইকোর্টের গেটেও ছাত্ররা পিকেটিং করে এখানে কতিপয় আইনজীবীর সাথে ছাত্রদের বাকবিতণ্ডা হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেক্রেটারিয়েট (তকালীন ইডেন বিল্ডিং) ছিল উত্তপ্ত। ছাত্রনেতারা এখানে পিকেটিং করে। পুলিশ ছিল বেপরােয়া মারমুখি। ছাত্রনেতারা অফিসারকর্মচারীদের ধর্মঘটে অংশগ্রহণ এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়। আন্দোলনের নেতা শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেটে এবং কাজী গােলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রমুখ দ্বিতীয় গেটে পিকেটিং এ নেতৃত্ব দেন। এখানে পুলিশ বেপরােয়া লাঠিচার্জ করে এবং কাজী গােলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, শামসুল হক, অলি আহাদসহ আরও অনেককে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।

পুলিশী নির্যাতন এবং ছাত্রনেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ওই দিন দুপুরবেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক বিরাট সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন। সভায় বক্তারা পুলিশী নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানান। তারা গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে। যাবার উদাত্ত আহ্বান জানান। সভাশেষে এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল কার্জন হল অতিক্রম করে হাইকোর্টের সামনে পৌছুলে পুলিশ মিছিলে বাধা প্রদান করে। মিছিলটি তােপখানা রােডে না যেয়ে আবদুল গণি রােডে ঢুকে পড়ে এবং

২০

সেক্রেটারিয়েটের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই সময় পুলিশ সুপার আবদুল গফুরের নেতৃত্বে পুনরায় ছাত্রদের উপর হামলা চালানাে হয়। পুলিশের বন্দুকের বাঁটের আঘাতে মােহাম্মদ তােয়াহা আহত হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি সরকারের লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডাবাহিনীও ছাত্রদের উপর হামলায় অংশ নেয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আয়ােজিত সেদিনের বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রদের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক সরকারি কর্মচারী এবং সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি যে ব্যাপকতর মানুষের মাঝেও আবেদন সৃষ্টি করেছে তা এ থেকে সহজেই স্পষ্ট হয়ে উঠে।

এ কে ফজলুল হক ও নঈমুদ্দীনের পৃথক বিবৃতি

হাইকোর্ট থেকে ফিরবার পথে সেক্রেটারিয়েট এলাকায় বেশ কিছু ছাত্রকে শ্লোগান দিতে দেখেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক। তিনি সেখানে ছাত্রদের সাথে কথা বলে বক্তব্য দেয়া শুরু করলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং এ.কে ফজলুল হক সামান্য আহত হন। ফজলুল হকের আহত হওয়ার ঘটনা এবং বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেফতার হওয়ায় সর্বত্রই উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। যারা অফিসে এসেছিল, দোকান খুলেছিল-তারাও সবকিছু বন্ধ করে বাড়ি ঘরে ফিরে যায়।

১১ মার্চের সাধারণ ধর্মঘটের দিন ঢাকা শহরে যা ঘটেছিল সে সম্পর্কে এ.কে ফজলুল হক সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রদান করেন। 

১১ মার্চের ঘটনা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ ও সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি সে। দিনের ঘটনার বর্ণনা, আন্দোলনের যৌক্তিকতা, সরকারের দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে ছাত্রসমাজকে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন :

“পাকিস্তানের শতকরা ৬৬ জন অধিবাসীর মাতৃভাষাকে পাকিস্তান ডােমিনিয়নের সরকারি ভাষা করার দাবি করিয়া যে আন্দোলন শুরু হইয়াছে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রীসভা তাহা দমন করার চেষ্ট করিয়া ফ্যাসিস্ট নীতিই অনুসরণ করিতেছেন। তাঁহারা নিরীহ ছাত্রদের উপর গুলি ও লাঠি চালাইয়াছেন এবং অনেককে গ্রেফতার করিয়াছেন। ছাত্ররা ইহাতে আতঙ্কিত না হইয়া বাংলাকে

২১

পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য তাহারা যে দাবি করিয়াছে সরকার তাহাদের দাবি পূরণ করিবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। আমাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণের জন্য আমরা যে আন্দোলন শুরু করিয়াছি তাহাতে যােগদানের জন্য পাকিস্তানের সকল ছাত্রকে আহ্বান করিতেছি। গতকাল্যকার ঘটনায় ২০০ জন আহত হইয়াছে। তাহাদের মধ্যে ১৮ জন গুরুতর আহত হইয়া হাসপাতালে প্রেরিত হয়। ৯০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাহাদের মধ্যে হইতে পরে অনেককে ছাড়িয়া দেয়া হইয়াছে। ৬৯ জনকে জেল-হাজতে প্রেরণ করা হইয়াছে। গতকল্যকার ঘটনার সময় যাহারা গ্রেফতার হইয়াছে তাহাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহামন, মি. অলি আহাদ এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা ইনসান-এর সম্পাদক মি. আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী অন্যতম। অন্যান্য ব্যক্তির সহিত তমদুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম এবং স্থানীয় বাংলা সাহিত্যিক ‘জিন্দিগী’র সহযােগী সম্পাদক মি. কাজী সামসুল ইসলামও আহত হইয়াছেন।”

[সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ মার্চ ১৯৪৮ সংখ্যা ও বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন, লেখক- মােঃ আইয়ুব আলী, প্রকাশক-খােশরােজ কিতাব মহল, ঢাকা, পৃ. ৬৬-৬৭] ।

সরকারি প্রেসনোেট

১১ মার্চের সাধারণ ধর্মঘট সম্পর্কে পূর্ববঙ্গ সরকার একটি ইশতেহার প্রকাশ করে। এই ইশতেহারে মিথ্যাচারের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়ার একটি সূক্ষ্ম প্রচেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়। ১৩ মার্চ ১৯৪৮ দৈনিক আজাদে ইশতেহারটি প্রকাশিত হয়। ইশতেহারে বলা হয়,

“ বাংলা ভাষাকে কেন্দ্রে সরকারি ভাষা করা হবে না বলে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, তার প্রতিবাদে ১১ মার্চ যে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল কতিপয় বিভেদকারী ও একদল ছাত্র তা কার্যকর করার চেষ্টা করে। শহরের সমগ্র মুসলিম এলাকা এবং অমুসলিম এলাকার অধিকাংশ লােক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে। শুধুমাত্র কয়েকটি হিন্দু দোকান বন্ধ করা হয়। কিন্তু আইন আদালতে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম চলতে থাকে। তবে রমনা অঞ্চলে ধর্মঘটীরা কিছু অফিস কর্মচারীকে নিরস্ত করতে সমর্থ হয়। সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট ও অন্যান্য অফিসের সামনে পিকেটিং করার জন্য দলে দলে ছাত্ররা সমবেত হতে থাকে। তাদের অনেকেই শান্তভাবে সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু অন্যান্যরা অফিসগামী ব্যক্তি ও পুলিশের উপর পাথর নিক্ষেপ করে

২২

আক্রমণ করতে থাকে ফলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং ৬৫জনকে গ্রেফতার করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে বাধ্য হয়। পুলিশ দু-বার ফাকা আওয়াজ করে। শােভাযাত্রায় পুলিশের হস্তক্ষেপের ফলে ১৪জন আহত হয়ে হাসপাতালে আছে, তার মধ্যে কারাে আঘাত গুরুতর নয়। কয়েকটি স্থানে খানাতল্লাশির ফলে প্রদেশের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য এবং পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রে গােলযােগ সৃষ্টি করার এক গভীর ষড়যন্ত্রের তথ্য সরকারের হস্তগত হয়েছে।” 

১৪ মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে পূর্ববঙ্গ সরকারের এই ইশতেহারের সমালােচনা করা হয়। এতে বলা হয়—

“..সরকারি ইশতেহারে বলা হইয়াছে যে, কেবল অমুসলমানদের একাংশ বিক্ষোভসূচক ধর্মঘটে যােগ দিয়েছিল। আমাদের ধারণা এই যে, এই বিবরণ সম্পূর্ণ নহে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নজড়িত আন্দোলন কোনাে বিশেষ সম্প্রদায়ে আবদ্ধ নহে। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন তােলার কোনাে কারণ বা সঙ্গতি আছে বলিয়া আমরা মনে করি না।”

১১ মার্চের সাধারণ ধর্মঘটের কর্মসূচি কেবল ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ জেলায় এ কর্মসূচি পালিত হয়। বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, চাঁদপুর, ভৈরব, যশাের, নােয়াখালী, রংপুর, চট্টগ্রাম, মেহেরপুর, পাবনা, খুলনা, দৌলতপুর, মুন্সিগঞ্জ, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় ধর্মঘট, সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ছাত্র এবং শিক্ষিত সমাজের বাইরেও ব্যাপক জনগােষ্ঠীর মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জোরদার হতে থাকে।

১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালনকালে পুলিশী নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ ফুঁসে উঠে। ১২ মার্চ জগন্নাথ কলেজে এক প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। বহিরাগত শ খানেক লােক বাইরে থেকে এসে সভায় হামলা চালায়-এতে দলিলুর রহমান নামের এক ছাত্র আহত হয়। ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান বি.দাসগুপ্ত হামলাকারীদের বাধা দিতে গেলে তিনিও আক্রান্ত হন।

১৩ মার্চ ঢাকা শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলন ক্রমাগত বিস্তারলাভ করতে থাকে এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং সমর্থন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৪ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ঐ দিন পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন-এর সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউজে বেলা তিনটায় মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের সভা শুরু হয়। রাত ন’টা পর্যন্ত ছাত্ররা এখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে—এ দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় ১৫ মার্চ পূর্ববঙ্গ আইনসভার অধিবেশনের দিন সাধারণ ধর্মঘট

২৩

পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জনাব মােহাম্মদ তােয়াহা ও তাজউদ্দিন আহমেদ এ সভায় আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রেল ধর্মঘট সফল করার জন্য সংগ্রাম পরিষদের কর্মীদের টঙ্গী ও কুর্মিটোলায় পাঠানাে হয়।

একদিকে ১৫ মার্চ পূর্ববঙ্গে আইনসভার অধিবেশন, অপরদিকে ১৯ মার্চ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকায় আগমন-এমনি সময়ে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং ফুসে উঠা ছাত্র আন্দোলনকে প্রশমিত করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের অন্যতম নেতা কমরুদ্দীন আহমদ তাঁর প্রবন্ধে বলেন যে, ১৪ মার্চ রাতে ডাক্তার মালিক, জনাব তােফাজ্জল আলী—খাজা নাজিমুদ্দিনের এক চিঠি নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করেন। চিঠিতে বলা হয়, যেহেতু জাতির পিতা কায়েদে আজমকে ১৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় প্রথম সম্বর্ধনা জানানাে হবে, সেইহেতু প্রধানমন্ত্রী কর্মপরিষদের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্বন্ধে আলােচনা করতে চান। জনাব কমরুদ্দীন আহমদ প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেন যে, যেহেতু তিনি এবং আবুল কাসেম ছাড়া রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বাকি সদস্যরা প্রায় সকলেই জেলে এমতাবস্তায় তাঁদের সাথে আলােচনা না করে কোনাে মতামত দেয়া সম্ভব নয়।

১৫ মার্চ সকাল সাড়ে সাতটায় মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বার্তা নিয়ে জনাব মােহাম্মদ আলী ও মরহুম খাজা নসরুল্লা পুনরায় কমরুদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করে জানান যে, মুখ্যমন্ত্রী কর্মপরিষদের সদস্যদের সাথে আলােচনায় প্রস্তুত এবং তাদের দাবি-দাওয়া মানতে রাজি আছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সকাল সাড়ে আটটায় কর্মপরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয় ফজলুল হক হলে এবং বেলা এগারােটায় খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে বৈঠক শুরু হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষে আলােচনায় অংশ নেন কমরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, নঈম উদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যসচিব। পাঞ্জাবি আমলা আজিজ আহমেদের সভায় উপস্থিত থাকার প্রস্তাব করলে ছাত্রনেতৃবৃন্দ তুমুল বিরােধিতা করেন এবং তাকে বাদ দিয়েই আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। তুমুল তর্কবিতর্ক ও বাকবিতণ্ডার পর কর্মপরিষদের পক্ষে কমরুদ্দীন আহমদ প্রণীত ৭ দফা দাবি সম্বলিত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। খাজা নাজিমুদ্দিন। ৭ দফা প্রস্তাব মেনে নিয়ে নতুন আরেকটি প্রস্তাব যুক্ত করেন। চুক্তি সম্পাদনের স্বার্থে কর্মপরিষদের নেতারা তা মেনে নেন। 

চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে সভা মুলতবি দিয়ে কমরুদ্দীন আহমেদ, আবুল কাসেম প্রমুখ ভাষা আন্দোলনে কারাবন্দি নেতা শামসুল হক, শেখ মুজিবুর

২৪

রহমান, কাজী গােলাম মাহবুব, শওকত আলী, অলি আহাদ, রণেশ দাসগুপ্ত প্রমুখকে চুক্তির শর্তাবলী দেখিয়ে তাদের সমর্থন নিয়ে আসেন। অতঃপর বর্ধমান হাউসে ফিরে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি সম্পাদিত হয়। পূর্ববঙ্গ সরকারের পক্ষে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষে কমরুদ্দীন আহমদ চুক্তিতে সাক্ষর করেন।

খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদিত ৮ দফা চুক্তিনামা

১. ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সাল হইতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাঁহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তিদান করা হইবে। 

২. পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযােগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন। 

৩. ১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারি আলােচনার জন্য যে দিনটি নির্ধারিত হইয়াছে সেইদিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং তাহাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্যে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে। 

৪. এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে, প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি উঠিয়া যাওয়ার পরই বাংলা তাহার স্থলে সরকারি ভাষা রূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাংলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল কলেজগুলােতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হইবে। 

৫. আন্দোলনে যাহারা অংশগ্রহণ করিয়াছেন তাহাদের কাহারাে বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না।

৬. সংবাদপত্রের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে। 

৭. ২৯ শে ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ব বাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে। 

৮. সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলােচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই। 

[ বদরুদ্দীন উমর-পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, প্রথম ভারতীয় সংস্করণ, পৃ. ৮৪-৮৫]

২৫

মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন-এর সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদিত ৮ দফা চুক্তি নিয়ে ক্ষোভ ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অন্যান্য বন্দিদের সাথে সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান এই চুক্তিকে একটি আশপাশের দলিল বলে ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেন। এবং তার প্রস্তাবে ১৬ মার্চ সকালবেলা ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জরুরি বৈঠক বসে। এই বৈঠকে ৮ দফা চুক্তিনামার ৩টি সংশােধনী এনে সেই সংশােধিত প্রস্তাব ওই দিনকার ছাত্রসভায় পেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সংশােধনী ৩টি প্রস্তাবণা হল :

১. ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় পুলিশী বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্তের জন্য সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক অনুমােদিত এবং সরকারি ও বেসরকারি সদস্যদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি নিয়ােগ করিতে হইবে। 

২. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের সুপারিশ করিয়া প্রস্তাব গ্রহণের উদ্দেশ্যে আলােচনার জন্য পূর্ব বাংলা পরিষদের অধিবেশন চলাকালে একটি বিশেষ দিন নির্ধারণ করিতে হইবে। 

৩. সংবিধানসভা কর্তৃক তাঁহারা উপরােক্ত সংশােধনী প্রস্তাবগুলাে অনুমােদন করাইতে অসমর্থ হইলে সংবিধানসভার এবং পূর্ব বাংলার মন্ত্রিসভার সদস্যদিগকে পদত্যাগ করিতে হইবে।

[ সূত্র : বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, প্রথম ভারতীয় সংস্করণ, পৃ. ৯৩]

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ঐ দিন ১৬ মার্চ বেলা দেড়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা নঈমুদ্দীনের প্রস্তাবে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সভায় শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন একমাত্র বক্তা। সাধারণ সভায় ৮ দফা চুক্তিনামার ৩টি সংশােধনী প্রস্তাব গ্রহণ করে তা মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের নিকট প্রেরণ করা হয়। সভাশেষে শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে একটি জঙ্গিমিছিল এসেম্বলির দিকে যায়। মিছিলকারীরা সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং উত্তেজনাকর শ্লোগান দিতে থাকলে পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সম্পর্কে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক বলেন-

২৬

“আট দফা চুক্তির ফলে মিইয়ে যাওয়া ভাষা আন্দোলনকে সেদিন বঙ্গবন্ধু এককভাবে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এখানেই ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের বৈপ্লবিক দিক। এখানে উল্লেখ্য তারপর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক জনাব শামসুল আলম পদত্যাগ করেন।”

[সূত্র: ভাষা আন্দোলনের আর্থ সামাজিক পটভূমি : আতিউর রহমান সম্পাদিত, চতুর্থ খণ্ড, ভাষা আন্দোলন : অংশগ্রহণকারীদের শ্রেণি অবস্থান, আতিউর রহমান ও সৈয়দ হাশমী, পৃ. ৫৩]

১৬ মার্চের ছাত্রসভা সম্পর্কে আন্দোলনের অন্যতম নেতা মােহাম্মদ তােয়াহা বলেন—

“ আমরা মিটিং দিয়েছিলাম ইউনিভার্সিটিতে সকাল ১১ টার সময়। সেদিন মিটিং এর জন্য আমরা গিয়ে দেখলাম শেখ মুজিবুর রহমান সময়ের পূর্বেই বেলতলায় মিটিং শুরু করে দিয়েছে। সেখানে তখন ১০০ জনের মতাে ছাত্র ছিল। আগে আমারই মিটিং এ সভাপতিত্ব করার কথা ছিল কিন্তু মুজিব আগে থেকেই সভাপতি হয়ে বক্তৃতা শুরু করে দিয়েছিলেন।…যাই হােকে, আমরা। গিয়ে দেখলাম সে খুব গরম বক্তৃতা দিচ্ছে। এর পূর্বে নাজিমুদ্দিনের সাথে আমাদের একটি Agreement হয়েছিল, কিন্তু মুজিব সে Agreement এর কোনাে কথা জানতাে না। কথা ছিল আমরা সে দিনের মিটিং এ Agreement এবং তার বিবরণ পেশ করব। কিন্তু মুজিবের জন্য সেটা সম্ভব হয় নি। সে বক্তৃতার পর অন্য কাউকে বলার সুযােগ না দিয়ে বলল ‘চলাে চলাে। Assembly চলাে।’ সে সময় প্রাদেশিক Assembly সেশন হচ্ছিলাে। ..শ্লোগান দিয়ে মুজিব কিছু সংখ্যক ছাত্রদের নিয়ে Assembly’র দিকে রওয়ানা হলাে। পরে পথে আরও লােক জুটে গেল।” {সূত্র: [ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ : কতিপয় দলিল (দ্বিতীয় খণ্ড), বদরুদ্দীন উমর, পৃ. ২৬৪] সে দিনের সভা সম্পর্কে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আরেক নেতা শওকত আলী বলেন—

“১৬ তারিখ সকাল থেকে আমরা সভার ব্যাপারে কাজ-কর্ম করতে থাকলাম এবং বেলা দেড়টা-দুইটায় সভা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শুরু হলাে। সভায় সভাপতিত্ব করল শেখ মুজিবুর রহমান। সে ই বক্তৃতা করল তারপর একটি মিছিল নিয়ে আমরা Assembly House এর দিকে গেলাম।”

সূত্র: বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ-কতিপয় দলিল (দ্বিতীয় খণ্ড), পৃ.২৫০]

২৭

১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আয়ােজিত সভা সম্পর্কে আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক বলেন| “যা-ই হােক, সংশােধিত প্রস্তাব ছাত্রসভায় অনুমােদিত হওয়ার পর অলি আহাদের মাধ্যমে নাজিমুদ্দিনের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ইতিমধ্যে ঐ সভায় বক্তৃতা শেষে শেখ মুজিবুর রহমান সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলােচনা ছাড়াই কিছু সংখ্যক ছাত্রের একটি মিছিল নিয়ে সরকার বিরােধী ধ্বনি দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। পুলিশ সেখানে যথারীতি তাদের বাধা দেয়। তাদের শ্লোগানে আকৃষ্ট হয়ে আরও বহু ছাত্র সেখানে সমবেত হন এবং এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। পুলিশের লাঠি চালনা সত্ত্বেও ছাত্রদের বিক্ষোভ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এবং মন্ত্রী ও পরিষদ সদস্যগণ পরিষদ ভবন থেকে বের হতে পারে না। অবশেষে পুলিশের লাঠি, কাঁদানে গ্যাস এবং ফাঁকা গুলির। চাপে ছাত্রদের অবরােধ ছেড়ে চলে যেতে হয়।

[সূত্র ; ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য, লেখক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক, পৃ. ৫৫]

ছাত্রমিছিলে পুলিশী হামলার প্রতিবাদে করণীয় নির্ধারণের জন্য সে রাতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ১৭ মার্চ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও সভা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু পরদিন ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভা থেকে ১৯ মার্চ জিন্নাহর ঢাকা আগমন উপলক্ষে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে ছাত্রধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।

মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত গণসংবর্ধনার বক্তৃতায় এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বললে শুধু ছাত্রসমাজই নয় সারাদেশের মানুষ এর প্রতিবাদে মুখর হয়। এর মধ্যে ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ জিন্নাহর মৃত্যু হলে রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি আপাতত অমীমাংসিত থেকে যায় এবং আন্দোলনেও ভাটা পড়ে।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ এক মাইলফলক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টির ফলে ধর্মীয় আবেগ, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলমানদের একটি বড় অংশের ইংরেজি প্রীতি এবং মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর পাহাড় সমান জনপ্রিয়তাকে উপেক্ষা করে যে ছাত্র-যুবকরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেদিন আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সময় এবং পরিস্থিতির বিবেচনায় তাদের শুধু ভাষাপ্রেমী নয় বীর হিসেবে চিহ্নিত করাই হবে যথার্থ। বাহান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তদানের যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল তার সূত্রপাত

২৮

এবং প্রেরণা ছিল ১১ই মার্চ। আর সে কারণেই বাহান্নের পূর্ব পর্যন্ত ১১ই মার্চকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হতাে সর্বত্র। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ইতিহাস প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনেকেই ভাষা আন্দোলনের এ পর্যায়কে তেমন গুরুত্ব প্রদান করেননি। ইতিহাসে যার যা ভূমিকা তা যথার্থভাবে তুলে ধরার লক্ষ্যেই এই নিবন্ধ রচনা। আমি ভাষা আন্দোলনের উল্লেখিত পর্ব এবং পরবর্তীতে যারা অংশগ্রহণ ও আত্মদান করেছেন সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এ নিবন্ধের এখানেই ইতি টানলাম।

(সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়ােজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসেবে পঠিত, সাল ২০১২)

২৯

Reference – কালের ধ্বনি – গোলাম কুদ্দুস