You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা

আমরা অনেকেই বুঝে বা না বুঝে ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতাকে সমার্থক করে ফেলি। সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন মানুষের সহজাত। ব্যতিক্রম নেই তা অবশ্যই নয়। এই যে ব্যক্তি মানুষের বিশ্বাস—তার দ্বারা সে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলবে, ব্যক্তি জীবনে তার প্রতিফলন থাকবে-এতে কারাে কিছু বলার বা করার নেই। কিন্তু সমস্যা হলাে এই ধর্ম-বিশ্বাসকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যখন ব্যক্তি বা গােষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল করার উদ্যোগ নেয়া হয় তখনই সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ঘটে। সকল ধর্মই মানুষের কল্যাণ এবং শান্তির কথা বলে। কিন্তু আমাদের দেশে কোনাে কোনাে মহল সাধারণ মানুষের সরল ধর্মবিশ্বাসকে নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের কাজে ব্যবহার করছে। ফলে জনজীবন, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে কখনাে কখনাে গভীর সংকটেই শুধু নয়। অস্তিত্বেরও মুখােমুখী হতে হয়। এ সংকট থেকে উত্তরণই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। 

সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে রাজনীতি যেহেতু ওতপ্রােতভাবে জড়িত সেহেতু আমাদেরকে একটু পেছনের দিকে তাকাতেই হবে। আমাদের জানতে হবে এর শেকড়ের কথা। বিশেষকরে এ উপমহাদেশে মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে বা ভারতীয় হিসেবে বিবেচনা না করে ধর্মেরভিত্তিতে ভাগ করা হােল কবে থেকে। তাহলে একটু দেখে নেই গােড়ার সেই কথাগুলাে।

একথা আমাদের সকলের জানা যে, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্যদিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয়যাত্রা শুরু হয়। প্রায় একশত বছর ধরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বৃটিশ রাজশক্তির সহায়তায় প্রায় ছয়শত ছােট বড় ভারতীয় রাজা এবং সামন্তপ্রভূকে ময়দানের লড়াইয়ে কিংবা কূটকৌশলে পরাভূত করে তাদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে। এ সকল লড়াইয়ে ভারতবর্ষের বহু দেশপ্রেমিক রাজা, প্রজা এবং সামন্তপ্রভূ বীরত্বের সাথে লড়াই করে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে কিন্তু বশ্যতা স্বীকার করে নি। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভিতকে নাড়িয়ে দিলেও আধুনিক সমরাস্ত্র এবং নিজেদের ঐক্যের অভাবের কারণে এই বিদ্রোহ ব্যর্থ

হয়। বহু দেশপ্রেমিককে ফাঁসী, দীপান্তর ও নানা ধরনের শাস্তি প্রদান করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সিপাহী বিদ্রোহে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকক্ষেত্রে হিন্দু সামন্তরাজ এবং প্রভাবশালীদের সহযােগিতা না পাওয়ায় বিশ্বাসের ঘাটতি এবং সম্পর্কেরও অবনতি ঘটে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শতবর্ষের শাসনের পর ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর ইংল্যান্ডের মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। বড়লাট লর্ড ক্যানিংকে তিনি ভারতবর্ষের প্রথম ভাইসরয় (গভর্নর জেনারেল)। নিযুক্ত করেন। কালক্রমে ভারতবর্ষে নানা ধরনের সামাজিক সংগঠন গড়ে উঠলেও একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের প্রয়ােজন অনুভব করতে থাকে সচেতন মহল। বিশেষকরে শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাই এর প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন। এ সময় ব্রিটিশ সিভিলিয়ান ও ভারতবাসীর ইংরেজি শিক্ষায় বিশেষভাবে আগ্রহী মি. হিউম তার বন্ধু তৎকালীন বড়লাট ডাফরিনকে ভারতীয়দের একটি রাজনৈতিক দল গড়ার ব্যাপারে অনাপত্তি জানাতে রাজী করিয়েছিলেন। অনানুষ্ঠানিক কয়েকটি বৈঠকের পর ১৮৮৫ খ্রি. ৫ ডিসেম্বর বােম্বাইয়ে প্রখ্যাত বাঙালি ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এর সভাপতিত্বে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৭২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি এক সভায় মিলিত হয়ে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’—গঠন করেন। সভাপতি হলেন ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আর সম্পাদক বৃটিশ নাগরিক এ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম। এ সভার মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে দাদাভাই নওরােজী-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। 

কংগ্রেসে যােগদান করা নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আলীগড় আন্দোলনখ্যাত স্যার সৈয়দ আহমদ সে সময়ে মুসলমানদের কংগ্রেসে যােগদানের ঘাের বিরােধী ছিলেন। অপরদিকে প্রগতিশীল মুসলমানদের নেতা বদরুদ্দীন তায়েবজী ও রহিমুল্লাহ্ মায়ানী কংগ্রেসে যােগদান করলেও ব্যাপকসংখ্যক মুসলমানকে দলে নিতে ব্যর্থ হন। কংগ্রেসে মুসলমানদের যােগদানের বিরােধী স্যার সৈয়দ আহমদ কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায় ‘মােহামেডান এডুকেশন্যাল কনফারেন্স’—গঠন করেন। এ সংগঠন গড়ে তােলার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তােলা, যাতে তারা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের চাইতে পিছিয়ে না পড়ে। স্যার সৈয়দের এই উদ্যোগ আলীগড় আন্দোলন নামে খ্যাত। ১৮৯৮ সালে স্যার সৈয়দ আহমদের মৃত্যু হলে নওয়াব মহসীন উল মূলক সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একদা কংগ্রেসে মুসলমানদের যােগদানের বিপক্ষে থাকলেও পরবর্তীতে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। তিনি কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি

৭২

বদরুদ্দীন তায়েবজী-এর সাথে সাক্ষাৎ করে ১৯০৩ সালে তাঁর হাতে মুসলিম এডুকেশন্যাল কনফারেন্স-এর দায়িত্ব প্রদান করেন। এইভাবে কংগ্রেসে যােগদান নিয়ে মুসলমানদের মতপার্থক্য কমতে শুরু করে।

সিমলা ডেপুটেশন

ভারতবর্ষের রাজনীতি, ভারত বিভক্তি এবং সমকালীন বাংলাদেশের রাজনীতিতেও সিমলা ডেপুটেশনের প্রভাব জোরালােভাবে উপস্থিত। সে সময় ভারতীয় কংগ্রেস এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, ভারতীয় আইনসভার। সদস্যপদে মনােনয়ন বা সিলেকশন প্রথা বাতিল করে সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা হােক। শ্ৰী বালকৃষ্ণ গােখেল, শ্রী রমেশ দত্ত প্রমুখ আইনসভার অধিবেশনে কংগ্রেসের এ দাবী উত্থাপন করেন। রানীর মনােনীত ভারত সচিব লর্ড মলি ব্রিটিশ কমন্স সভার বাজেট অধিবেশনে তাঁর বক্তৃতায় কংগ্রেসের দাবীর যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। 

স্যার সৈয়দ আহমদের অনুসারী মুসলিম এডুকেশন্যাল কনফারেন্স এর অন্যতম প্রধান সংগঠক নওয়াব মহসিন উল মূলক অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যখন দেখলেন ভারতীয় আইন সভার সদস্য পদে প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি বৃটিশ সরকার মেনে নিতে পারে তখন মুসলমানদের স্বাতন্ত্র রক্ষায় তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর মহামান্য আগা খানের নেতৃত্বে মুসলমানদের দাবী-দাওয়া সম্পর্কিত একটি স্মারকলিপি সিমলায় ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর নিকট হস্তান্তর করা হয়। এই ডেপুটেশনে ভারতবর্ষের তৎকালীন মুসলমান সমাজের ৩৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন—নওয়াব মহসিন উল্ মূলক, নওয়াব ইমদাদ উল্ মূলক, নওয়াব ভিকার উন্ মূলক, হেকিম আজমল খান, স্যার আলী ইমাম, স্যার মােজাম্মেল উল্লাহ খান, স্যার রফিকউদ্দিন আহমদ, স্যার মােহাম্মদ শফি, স্যার আবদুর রহিম, নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ, বিচারপতি শাহেদীন প্রমুখ। 

উক্ত ডেপুটেশনে ভারতীয় আইন সভায় প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করা হয়। ১৯০৯ সালে গৃহীত মিন্টো-মর্লি সংস্কার নামে অভিহিত ভারতের শাসন ব্যবস্থায় হিন্দু-মুসলমানের স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতি চালু মূলত এ ডেপুটেশনের ফলেই

৭৩

বাস্তবায়িত হয়েছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভব, ভারতবর্ষের বিভক্তি, এমনকি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং আজকের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও। এ ডেপুটেশনের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতে একই দেশের মানুষকে বিভক্ত করা এবং রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার উত্থানে এ ডেপুটেশনের সুদূরপ্রসারী ভূমিকাকে বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে।

ডেপুটেশনে অংশগ্রহণকারীদের উদ্যোগে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স-এর শেষ দিনের অধিবেশনে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্-এর প্রস্তাবে এবং হেকিম আজমল খান এর সমর্থনে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ (অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ) গঠিত হয়। সভাপতি নির্বাচিত হন নওয়াব মনসুর উল্ মূলক। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন আগা খান, নওয়াব সলিমুল্লাহ্ ও নওয়াব ভিকার উল মূলক।

ভারত বিভক্তিকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষের নির্মম মৃত্যু ঘটে। একদিকে বৃটিশের শাসন থেকে ভারতবাসীর মুক্তি অপরদিকে হিন্দু-মুসলমানের আলাদা অস্তিত্বের লড়াই, এ জটিল পরিস্থিতিতে বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষ থেকে তাদের শাসন গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার পর সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবিতে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ (Direct Action Day) ঘােষণা করে। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্যের অস্পষ্টতার কারণে হিন্দুরা এই সংগ্রামকে তাদের বিরুদ্ধের সংগ্রাম হিসেবে বিবেচনা করে রক্ষক্ষয়ী দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে। বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, নােয়াখালীতে এ দাঙ্গা ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে এবং হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। বৃটিশ কর্তৃক কংগ্রেসকে ভারতের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানালে মুসলিম লীগ-এর প্রতিবাদে ১৯৪৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘কালাে দিবস’ (Black Day) পালনের ঘােষণা দেয়। এই কালাে দিবস পালনকে কেন্দ্র করে স্তিমিত হয়ে আসা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আবার নতুন করে সম্প্রসারিত হয় এবং ভয়াবহ দাঙ্গায় কয়েক হাজার হিন্দু-মুসলমানের মৃত্যু ঘটে। অগ্নি সংযােগ, লুটপাট, শ্লীলতাহানীর ঘটনাও ঘটে প্রায় সর্বত্র। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন বৃটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কিত রােয়েদাদ ঘােষণা করে। এতে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ তথা ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে দুটি আলাদা রাষ্ট্রে বিভক্ত করার ঘােষণা দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ বৃটিশ সিদ্ধান্ত মেনে নেয় এবং সে মােতাবেক ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

৭৪

মুসলিম প্রধান প্রদেশগুলিকে নিয়ে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরবর্তী সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ববঙ্গকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান নাম দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সমগ্র পাকিস্তানের মােট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বাঙালি এবং পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী। অধিকাংশ জনগণের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে তৎকালীন মুসলিম লীগের নেতৃত্বাধীন শাসকগােষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রক্রিয়া ও ষড়যন্ত্র শুরু করে। সে সময় মুসলিম লীগ এবং অপরাপর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলাে মনে করে যে, বাংলা হিন্দুদের ভাষা এবং মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবার যােগ্য নয়। ধর্মের ভিত্তিতে ভাষাকে বিভক্ত করার মধ্যদিয়ে সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতার বীজ রােপিত হয় যা পাকিস্তানি শাসনামলের ২৩ বছর আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বাঙালিদের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে পূর্ব। পাকিস্তানকে শােষণের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়। যখনই বাঙালি নিজেদের অধিকার চেয়েছে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে তখনই ধর্মীয় অস্ত্র ব্যবহার করে তাকে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে ভারতের চক্রান্ত এবং হিন্দুদের প্ররােচনা বলে অপ-প্রচার চালানাে হয়েছে। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের সহযােগী ধর্মীয় সংগঠনগুলাের এ অঞ্চলের নেতাকর্মীরা সরলপ্রাণ বাঙালি মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেও চূড়ান্ত বিচারে ব্যর্থ হয়। তারপরও কয়েকবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানাের চেষ্টা হয়েছে- যার ফলে বহু হিন্দু মাতৃভূমি ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। 

১৯৭০ এর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে সমগ্র পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী একজন বাঙালি শেখ মুজিবের হাতে পাকিস্তানের। শাসনভার হস্তান্তরে একমত ছিল না। তারা এগােয় ষড়যন্ত্রের পথে। বাঙালি নিধনে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র এবং সৈন্য সমাবেশের জন্য প্রয়ােজন ছিল কিছুটা সময়ের। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান আলােচনার নাটক সাজিয়ে সময় ক্ষেপণ করে তার কাঙ্ক্ষিত সময়ে বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শুরু হয় ইতিহাসের এক নির্মম বর্বর হত্যাকাণ্ড। আধুনিক অস্ত্রেসজ্জিত পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর। অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচালিত এ অভিযানে এক রাতেই ঢাকা শহরে হত্যা করা হয় কয়েক হাজার নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিকে। ২৫ মার্চের সে রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হবার পূর্বে বঙ্গবন্ধু

৭৫

শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। তার পরের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণাকে বাস্তবে রূপায়িত করবার জন্য ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় এ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে প্রকৃত অর্থে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের নতুন অধ্যায়।

অপরদিকে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী ‘পােড়ামাটি নীতি অবলম্বন করায় পুরাে বাংলাদেশ যেন এক বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বর্বরতা থেকে জীবন বাঁচানাের জন্য প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে পালিয়ে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। এদিকে শুরু হয় প্রতিরােধ যুদ্ধ। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে হাজার হাজার তরুণ বীর বাঙালি সশস্ত্র ট্রেনিং গ্রহণ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যখন প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করবার জন্য মরণপ্রাণ লড়াই করছে তখন চলতে থাকে আরেক খেলা। যে মানুষগুলাে রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরােধীতা করেছিল, বাঙালির স্বার্থকে নিজের স্বার্থ হিসেবে ভাবেনি, তারাই আবার মাঠে নেমে গেল নতুন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামকে তারা আখ্যা দিল ভারতের চক্রান্ত এবং মুক্তিযােদ্ধাদের বলল ভারতের চর। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি নিধনকে বলল ইসলাম রক্ষার জন্য জেহাদ আর বাঙালি নারীদের ইজ্জত লুটে নেয়াকে বলল গনিমতের মাল। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামে ইসলাম প্রমুখ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরােধীতা করে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী নামের সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তােলে। এই সংগঠনগুলাে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ, লুটপাট করেছে। যুবতী নারীদের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল ইজ্জত লুটে নেবার জন্য আর এসবই তারা করেছে ইসলাম ধর্ম রক্ষার নামে। শুধু সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেই এ সংগঠনগুলাে ক্ষান্ত হয়নি, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা প্রদানের জন্য। তাদের নেতৃত্বে একটি বেসামরিক সরকারও গঠন করা হয়েছিল। গভর্নর ডাঃ আবদুল মােতালেব মালেক-এর নেতৃত্বে সত্তর-এর নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, পিডিপি, নেজামে ইসলামীর সদস্যদের নিয়ে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। ইসলাম রক্ষার নামে নিজ মাতৃভূমির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানি দখলদার

৭৬

বাহিনীকে রাজনৈতিক এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে এই পুতুল সরকার গঠিত হয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযােগিদের সকল প্রচেষ্টা, বর্বর-নির্মম গণহত্যা সত্বেও যখন পরাজয় ঠেকিয়ে রাখা যাবে না প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল—তখন শুরু হলাে আরেক নতুন ষড়যন্ত্র। স্বাধীন বাংলাদেশ যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, বিজ্ঞান-মেধা-মননে। যাতে পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় তার জন্য দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, কবি-লেখক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ক্রীড়াবিদ, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বাসা থেকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে রায়েরবাজার, মিরপুর মধ্যভূমিতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। চোখ তুলে নিয়ে, হৃদপিণ্ড ক্ষত-বিক্ষত করে পরাজয়ের প্রতিশােধ নিতে চেয়েছিল ঘাতকের দল। শান্তির ধর্ম ইসলামকে এইভাবে কলংকিত করেছে তথাকথিত ধর্মান্ধ, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার এ বর্বর কাহিনী সে সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭১ লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় সাংবাদিক ‘পিটার হেজেলহাষ্ট’ এর একটি রিপাের্ট তুলে ধরছি। রিপাের্টে তিনি লিখেছেন:

“…এ কথা কেউ কোনাে দিন বলতে পারবে না যে, সবশুদ্ধ কতজন বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তার ইত্যাদি হত্যা করা হয়েছে। এদের অধিকাংশ কোনাে দিনই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবুও এদের আর কোনাে খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি। এরা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছেন। …ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আনােয়ার পাশার স্ত্রী মােহসীনাকে রাজধানীর উপকণ্ঠে একটা বিরাট গর্তের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। এখানে অসংখ্য বাঙালি বুদ্ধিজীবীর গলিত ও দুর্গন্ধময় লাশ পড়ে আছে। মােহসিনা সেই গলিত লাশগুলাের মধ্যে তার স্বামীর লাশটা সনাক্ত করার বৃথাই চেষ্টা করছে….।”

এ কথা আমাদের সকলেরই জানা যে, এদেশের অধিকাংশ মানুষ আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং সহজ-সরল ও ধর্মভীরু। তাদের এই সরলতা এবং বিশ্বাসের সুযােগ নিয়ে গত প্রায় দেড়শত বৎসর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি রাজনৈতিক উদ্দেশে ধর্মকে ব্যবহার করে ব্যক্তি ও গােষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল করেছে এবং করছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে ধর্মের মৌলবাণীকে কলংকিত করছে। বিশেষকরে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলােতে এই সাম্প্রদায়িক গােষ্ঠীর উত্থান এবং জঙ্গী। তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিককালে কক্সবাজারের রামু এবং

৭৭

উখিয়ায় বৌদ্ধ মন্দিরগুলােতে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানাে হয়েছে তাও আমাদের স্মরণে রাখা বাঞ্ছনীয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরােধী শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবার পর থেকেই এই সাম্প্রদায়িক শক্তির নব উত্থান ঘটে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতায় এবং কোনাে কোনাে রাজনৈতিক দলের মিত্রতা পেয়ে তারা এখন দেশব্যাপী শেকড় বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সময় এখনাে ফুরিয়ে যায়নি। মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রগতির পক্ষের শক্তি যদি এখনাে ঐক্যবদ্ধ হয় এই শেকড় ছিন্ন করা অসম্ভব নয়। কারণ, সত্য-ন্যায় এবং প্রগতির শক্তি অজেয়—একে কখনাে পরাভূত করা যায় না।

(সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সেমিনারে পঠিত, সাল ২০১৪)

৭৮

Reference – কালের ধ্বনি – গোলাম কুদ্দুস

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!