You dont have javascript enabled! Please enable it! 1947.05.19 | ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আলােচনার সূত্রপাত - সংগ্রামের নোটবুক

ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আলােচনার সূত্রপাত

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি উচ্চারিত হয় ব্রিটিশ কর্তৃক ভারতবর্ষ ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আলাপ-আলােচনা থেকে। ১৯ মে ১৯৪৭ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে, হায়দরাবাদে ‘মজলিস-এ-এত্তেহাদুল মােছলেমিন’এর বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে আয়ােজিত এক উর্দু সম্মেলনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং

কমিটির অন্যতম নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। 

চৌধুরী খালেকুজ্জামানের এ বক্তব্যের প্রায় দু-মাস পর ১৯৪৭ সালের ১৪ জুলাই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে জোরালাে বক্তব্য দেন।

চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং ড. জিয়াউদ্দিনের বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় বাঙালি মুসলমান লেখকদের মধ্যে সর্বপ্রথম এ সকল বক্তব্যের বিরােধিতা এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন সে সময়ে কলিকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সওগাত’ ও ‘শিশু সওগাত’ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আবদুল হক। এ সময় আবদুল হক ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার পক্ষে নানা যুক্তি উপস্থাপন করে ৪টি প্রবন্ধ লেখেন। তিনটি নিজের নামে এবং একটি মিসেস এম.এ হক ছদ্মনামে। প্রথম প্রবন্ধটি দৈনিক ইত্তেহাদে ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৭ জুন, দ্বিতীয়টি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ৩০ জুন, তৃতীয়টি ইত্তেহাদে ২৭ জুলাই এবং চতুর্থটি ৩ জুলাই ‘বেগম’ পত্রিকায় মিসেস এম.এ হক নামে। আবদুল হক তার প্রতিটি প্রবন্ধেই ভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অকাট্য যুক্তি দিয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। তাঁর বহু যুক্তি বর্তমান সময়েও সমান প্রযােজ্য। ২৯ জুন ১৯৪৭ ইত্তেহাদে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ এ তিনি লেখেন :

“আমরা কেন আমাদের দেশে ইংরেজি-উর্দু-হিন্দি বলতে বাধ্য থাকব? আমাদের দেশে যারা বাস করে সেইসব ইংরেজ বা উর্দু-হিন্দিভাষীরা কেন বাংলা শিখতে বাধ্য হবে না? আমার মত এই যে, এ দেশে যেসব অভারতীয় বা অবাঙালি বাস করবে, তাদের বাংলা শিখতে হবে, যদি তারা এদেশে বাস করতে চায় এবং আমাদের সঙ্গে চলতে চায়। বাংলা শেখা তাদেরই গরজ। তাদের জন্য ইংরেজি-উর্দু-হিন্দি শেখা আমাদের গরজ নয়, বরং আমাদের পক্ষে ঘাের অমর্যদাকর। আন্তর্জাতিক সম্বন্ধের জন্য এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংযােগের জন্য যতটুকু ইংরেজি-উর্দু-হিন্দি শেখা দরকার, শুধু ততটুকুই আমরা শিখব এবং অন্তত ততটুকু বাংলা পৃথিবীর জাতিগুলােকেও শিখতে হবে।”

লেখক আবদুল হকের প্রবন্ধের পরপরই ২০ জুলাই ১৯৪৭ ইত্তেহাদে মাহবুব জামাল জাহেদীর ‘রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই দৈনিক আজাদ পত্রিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। আলােচ্য প্রবন্ধে তিনি রাষ্ট্রভাষারূপে ইংরেজি, উর্দু, বাংলার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলেও

চুড়ান্ত বিচারে বাংলার পক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিনের ‘উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন।

এছাড়া এ সময় মুহম্মদ এনামুল হক, কাজী মােতাহার হােসেন, এম. ওয়াজেদ আলী, ফররুখ আহমদসহ বিশিষ্ট লেখকরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় এবং সংবাদ প্রকাশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উচ্চারিত হয়।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, মতাদর্শ এবং নেতৃত্বের প্রশ্নে : নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগ’ এর মধ্যে দুটো ধারা সৃষ্টি হয়। একটি ধারা ধর্মের নামে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ধর্মীয় অনুশাসন ও চিন্তা-চেতনা তথা ইসলামি তাহজিব-তমদুনের ভিত্তিতে দেশ শাসনে দৃড় প্রতিজ্ঞ। এই ধারায় পূর্ব বাংলায় নেতৃত্ব দেন মাওলানা আকরাম খাঁ ও খাজা নাজিমুদ্দিন। অপরদিকে মুসলিম লীগের উদারনৈতিক প্রগতিশীল অংশের নেতা ছিলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। এই প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্ববাসীদের একটি অংশ ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় এক বৈঠকে কমরুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে ‘গণ আজাদী লীগ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তােলে। এই সংগঠন ‘আশু দাবি, কর্মসূচি, আদর্শ’ নামে একটি মেনিফেস্টো প্রকাশ করে। এতে ভাষা সম্পর্কে বলা হয়, “মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে দেশের যুগপােযােগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”

স্বাধীন পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুহম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানের নতুন সরকার যাত্রা শুরু করে। যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খ, ক্ষমতার মােহ এবং কোটারী স্বার্থের কারণে সে আশা দ্রুতই নিঃশেষ হতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের মতামতকে তােয়াক্কা না করে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অবজ্ঞা করে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন নতুন শাসকগােষ্ঠী তাদের নিজস্ব ইচ্ছা এবং ধ্যানধারণা মতাে পাকিস্তান শাসন করার নীতি গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগােষ্ঠীর কথা বিবেচনা না করে শুরুতেই পাকিস্তান

১০

সরকার মানিঅর্ডার, পােস্টকার্ড, মুদ্রায় শুধুমাত্র উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার শুর করে। একই সময়ে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে নিয়ােগের ইন্টারভিউ এর ক্ষেত্রেও বাংলাকে উপেক্ষা করা হয়। এর ফলে সচেতন, শিক্ষিত এবং প্রগতিবাদী মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

১৪ আগস্টের পর মুসলিম লীগের সােহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের কলকাতায় অবস্থানকারী কর্মীরা ঢাকায় এসে তখনকার প্রগতিশীল অংশের সাথে যুক্ত হয়ে একটি যুব সংগঠন গড়ে তােলায় উদ্যোগী হয়। ১৫০নং মােগলটুলিতে অবস্থিত মুসলিম লীগের অফিস প্রগতিশীল কর্মীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। নানা প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান খান বাহাদুর আবুল হাসানাত আহমেদ-এর বাড়ির বিশাল লন এবং হলরুমে যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র পূর্ববাংলা থেকে ৭ শতাধিক প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশ নেন। তসন্দুক আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে ব্যাপক আলাপ-আলােচনার পর অনেকগুলাে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। উক্ত কর্মী সম্মেলনে ভাষা সম্পর্কিত একটি যায়। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজিউল হক বলেন,

৬ সেপ্টেম্ব সন্ধ্যা থেকে শুরু করে প্রায় পরদিন ভাের পর্যন্ত বিষয় নির্বাচনী কমিটির বৈঠক চলে। এই বৈঠকে পরদিনের গৃহীতব্য প্রস্তাবগুলি আলােচিত হয় এবং পরবর্তীকালে সাধারণ সভায় গৃহীত হয়। বিষয় নির্বাচনী কমিটির ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলিসহ প্রায় সবগুলি প্রস্তাবের আলােচনায় মুজিব ভাই বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলি ছিল নিম্নরূপ :

‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলাভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে সে সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক, এখানে উল্লেখ্য যে, প্রস্তাবের শেষ অংশটি “জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক’ সংযােজনের প্রস্তাব করেন সেদিনকার আপােষহীন সংগ্রামী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁকে সমর্থন করেন রাজশাহীর যুবনেতা আতাউর রহমান। সুতারাং এই কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র বাইশ দিন পর তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের যখন বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্নটি ওঠে এবং যে দাবি জানানাে হয়, তখনও বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রথম সারির নেতৃত্বের কাতারেই ছিলেন।”

১১

{ সূত্র : ভাষা আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক পটভূমি, সম্পাদনা-আতাউর রহমান (চতুর্থ খণ্ড), ভাষা আন্দোলনে : অংশগ্রহণকারীদের শ্রেণি অবস্থান, আতাউর রহমান ও সৈয়দ হাশমী, পৃ. ৫১}।

উক্ত কর্মী সম্মেলনে ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাবটি ছিল খুবই গুরত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর বলেন, “পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলাভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে সে সম্পর্কে আলাপ আলােচনা ও সিদ্ধান্ত প্রদানের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।”

[ সূত্র: পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড), 

লেখক : বদরুদ্দীন উমর, পৃ.২৫]। 

বদরুদ্দীন উমর প্রস্তাবকারী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ না করলেও তাঁর উত্থাপিত প্রস্তাবটিকে সামনে এনেছেন। এই তথ্যটিও প্রকৃত ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধানের জন্য বিশেষভাবে গুরত্বপূর্ণ। অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম উক্ত কর্মী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব গ্রহণ এবং কর্মী সম্মেলন সফল করার জন্য শেখ মুজিবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।

Reference – কালের ধ্বনি – গোলাম কুদ্দুস