শিরোনামঃ করাচীতে টিভি সাক্ষাৎকারে জেনারেল ইয়াহিয়া
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ৫ আগস্ট, ১৯৭১
তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ
প্রেসিডেন্টের টিভি সাক্ষাৎকারঃ তিন সপ্তাহের মধ্যে অযোগ্য
এম এন এ’দের নাম ঘোষণা
করাচী ৪ঠা আগস্ট (এ পি পি )- প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান তিন থেকে চার মাসের মধ্যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করেছেন।
গত ৩০শে জুলাই শুক্রবার করাচীতে আন্তর্জাতিক টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এর প্রতিনিধিদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট বলেন যে, দু’ থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যদের মধ্যেকার যাদের আসন থাকবে এবং অপরাধমূলক ও রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার জন্য কোন কোন সদস্যের আসন বাতিল হয়ে যাবে, তাদের নাম ঘোষণা করবেন।
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নেটওয়ার্কের সাক্ষাৎকার নামক ৮৪ মিনিট ব্যাপী সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানটি আজ রাতে পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশনের ৪টি কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়।
জাতির উদ্দেশ্যে গত ২৮শে জুন প্রদত্ত তাঁর বেতার ভাষণের উল্লেখ করে, প্রেসিডেন্ট বলেন যে, উক্ত ভাষণে তিনি জনগণের প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য তাঁর রাজনৈতিক পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটছে এবং কি ঘটতে পারে তিনি তার সঠিক বিবরন দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, যত শীঘ্র সম্ভব সরকার পরিচালনার দায়িত্ব জনগণের নিকট হস্তান্তর করতে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
তিনি বলেন যে, তার নিজের ধারণা অনুসারে তিনি বিষয়টি বিবেচনা করেছেন এবং তাতে তিন থেকে চার মাস সময় লাগবে বলে তিনি মনে করেন।
প্রেসিডেন্ট আশা প্রকাশ করেন যে, জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আসন বহাল থাকবে এবং স্বল্প সংখ্যক সদস্য তাদের আসন হারাবেন। তিনি বলেন যে, বাতিল আসনগুলোতে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট বলেন যে, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও আওয়ামী লীগের সদস্যদের মধ্যে যারা জাতীয় পরিষদের আসনে নির্ধারিত হয়েছেন তাদের মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক তৎপরতায় লিপ্ত ব্যক্তিগণ ছাড়া অন্যান্যদের আসন বাতিল করা হয় নি।
তিনি বলেন যে, জাতীয় পরিষদে যে সমস্ত সদস্যকে তাদের আসন রাখতে দেয়া হবে, তিনি তাদেরকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন যে, যারা সীমানা পেরিয়ে গেছে এবং কোনরূপ অপরাধমূলক কাজ করেননি তাদের মধ্যেও কিছু সংখ্যক সদস্যকে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানানো হবে এবং তাদের আসন বহাল রাখতে দেয়া হবে।
প্রেসিডেন্ট বলেন যে, সীমান্ত এলাকা ব্যতীত পূর্ব পাকিস্তানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন রয়েছে। সীমান্তের অপর পার থেকে উক্ত এলাকাগুলোতে গোলযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, সীমান্তে বরাবর দিনরাত প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে এবং এই সংঘর্ষের পরিণামে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে।
তিনি বলেন যে, সীমান্ত বরাবর গোলযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন। উপনির্বাচনের পর অবিলম্বে তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করবেন বলে জানান।
প্রেসিডেন্ট সুস্পষ্ট ভাষায় জানান যে, পাকিস্তান যুদ্ধ চায় না। তিনি বলেন, যুদ্ধ সমস্যাদির সমাধান করতে পারে না। যুদ্ধে কেবল বিপুল ধ্বংসলীলা সংঘটিত হয় এবং মানুষের জীবন যাত্রা ও যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি ব্যাহত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, তিনি একাধিকবার ঘোষণা করেছেন যে, তিনি ভারতের সঙ্গে যেকোনো পর্যায়ে আলোচনা করতে রাজী আছেন। কিন্তু তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন যে, ভারত এ ব্যাপারে কোন সাড়া দেয় নি।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধের খুবই কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে। কিন্তু তিনি যথেষ্ট ধৈর্যের সঙ্গে যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করছেন বলে জানান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, এর চাইতেও অনেক কম গুরুতর পরিস্থিতি পৃথিবীতে যুদ্ধের কারন হয়েছে। তিনি বলেন যে, পাক-ভারত উপ মহাদেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা অত্যন্ত পরিবর্তনশীল, বিস্ফোরন্মুখ ও বিপদজ্জনক।
তিনি বলেন, আমার সরকার ও আমি অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছি, মূলতঃ সে কারনে আমরা এখনো যুদ্ধে জড়িয়ে পরিনি।
প্রেসিডেন্ট এটা সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে কোনরুপ তৎপরতার মাধ্যমে যদি পাকিস্তানের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে যুদ্ধ হবে।
বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন যে, যারা সীমানা পেরিয়ে ভারতে চলে গেছে, তাদের বাড়িঘরে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পাকিস্তান বিশেষভাবে আগ্রহী।
তিনি বলেন যে, বাস্তুত্যাগীদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে এবং তাদের ফিরে আসার সুযোগসুবিধা দেয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় অনেকগুলো অভ্যর্থনা শিবির খোলা হয়েছে।
তিনি বলেন যে, বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের সাহায্যকে পাকিস্তান স্বাগত জানিয়েছে এবং জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, বাস্তুচ্যুতদের সাহায্য করার জন্য পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাই কমিশনের পর্যবেক্ষকদের গ্রহণ করতে রাজী হয়েছে, কিন্তু অপর পক্ষের এই প্রস্তাব গ্রহণের উপরই তার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে।
প্রেসিডেন্ট প্রশ্ন করেন যখন সশস্ত্র অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে এবং যখন বাস্তুচ্যুতদের চারপাশে ফিল্ডগান ও মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ চলছে বাস্তুচ্যুতরা কিভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ফিরে আসতে পারে?
এক প্রশ্নের উত্তরে প্রেসিডেন্ট বলেন যে, পাকিস্তানে যারা ফিরে আসছেন, অধিকাংশই অনুমোদিত পথ দিয়ে আসতে পারছেন না, কারণ ভারত তাদের ফিরতে বাধা দিচ্ছে। তিনি বলেন যে, এ সমস্ত বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি অনুমোদিত পথে পাকিস্তানে ফিরে আসছেন।
প্রেসিডেন্ট বলেন যে, ইতিমধ্যেই লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি পূর্ব পাকিস্তানের তাদের বাড়িঘরে ফিরে এসেছেন এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৩০ থেকে ৪০ জন হচ্ছে হিন্দু। প্রেসিডেন্ট বলেন যে, ভারত বাস্তুচ্যুতদের যে সংখ্যা দাবী করছে তা সম্পূর্ণ ভুল। তিনি বলেন যে, ভারত সীমান্ত এলাকায় যে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে, তা বাস্তুচ্যুতদের ফিরে আসার ব্যাপারে বাধা স্বরূপ। তিনি বলেন যে, যদি ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে তাহলে বাস্তুচ্যুতদের সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে এবং বাস্তুচ্যুতরা নিরাপদে তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসতে পারবেন। নিরাপত্তার অভাবে জনগণের এখনো পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে যাওয়ার বিষয় প্রেসিডেন্ট সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সশস্ত্র বিদ্রোহীদের হাত থেকে দেশের পূর্বাঞ্চলের সাত কোটি জনগণকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। তিনি বলেন যে, বে-আইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ এই বিদ্রোহের উস্কানি দিয়েছিল।
তিনি বলেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে বিক্ষোভ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বন্ধ হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।
পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর কোনরূপ গণহত্যা চালানোর খবরকে প্রেসিডেন্ট সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে বর্ণনা করেন। ভারতে পালিয়ে যাওয়া বে-আইনী ঘোষিত আওয়ামী সদস্যগণ কর্তৃক মিথ্যা কাহিনী রটনার ফলে এই ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে মুজিবুর রহমানের কোটারি ও বে-আইনী ঘোষিত আওয়ামী সদস্যরাই তাদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারীদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে।
তিনি বলেন যে, সীমান্তের ও-পারের বন্ধুদের উস্কানিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেছে।
প্রেসিডেন্ট বলেন যে, একটি রাজনৈতিক সমাধানের আশায় তিনি ধৈর্যের সঙ্গে এ সমস্ত সহ্য করছিলেন। কিন্তু তিনি যখন শেখ মুজিবুর রহমানের একগুয়েমি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলেন, তখন সশস্ত্র বাহিনীকে সরকারের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার এবং বিপদাপন্ন জনগণের জীবন রক্ষা করার নির্দেশ দিলেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ পূর্ব পরিকল্পিত থাকার বিষয় প্রেসিডেন্ট অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, যদি এই ব্যবস্থা পূর্বপরিকল্পিত হতো তাহলে আওয়ামী লীগের এতো বেশী সংখ্যক সদস্য ভারতে পালিয়ে যেতে পারতেন না।
পূর্বপাকিস্তানে হিন্দুদের উপর নির্যাতন চালানোর বিষয়ও প্রেসিডেন্ট অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, হিন্দুরা যদি পূর্বপাকিস্তানে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেই থাকে তবে সীমান্তের ওপারের চক্রান্তের ফলেই তারা এরূপ বোধ করছে।
স্বচক্ষে সবকিছু দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট বিদেশী সাংবাদিকদের পূর্বপাকিস্তানে সফরের আমন্ত্রণ জানান।
প্রেসিডেন্ট একজন সাংবাদিককে বলেন যে, পূর্বপাকিস্তানে অভ্যুত্থান চলাকালে আড়াই লাখ লোককে হত্যার খবর অত্যন্ত অতিরঞ্জিত।
তিনি বলেন, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এই যে, আওয়ামী লীগ বিদ্রোহীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় এবং সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
প্রেসিডেন্ট বলেন যে, সশস্ত্র বিদ্রোহীরা হতাহত হয়েছে। জাতির প্রতি কর্তব্যবোধের তাগিদে ও জনসংখ্যার বাকী অংশকে রক্ষা করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করতে বাধ্য হয়।
তিনি বলেন যে, বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যার মত হতাহতের সংখ্যাকেও বিশেষভাবে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট উভয় সংখ্যাকে সম্পূর্ণ ভুল বলে বর্ণনা করেন।
(অসমাপ্ত)