শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে বাঙ্গালী কূটনীতিক এ.এম. মুহিতের স্মারকলিপি | এ.এম. মুহিত সংকলিত ‘Thoughts in exile’ | ১৯ এপ্রিল, ১৯৭১ |
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে স্মারকলিপি
প্রায় পনের বছর আগে আমি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলাম এবং যেহেতু পাকিস্তান এখন আর অখন্ড নয় তাই দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমি পাকিস্তান সরকার থেকে নিজেকে পৃথক করার ঘোষণা দিচ্ছি।
২২ বছর বয়সী তরুণ হিসেবে, নিজের জন্য ও নিজের দেশের জন্য উচ্চাশা নিয়ে আমি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেই। পাকিস্তান ছিল আমার তরুণ বয়সের স্বপ্নের ভূখন্ড- উন্নত সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় দ্বারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ আর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরাধীনতার বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের মুসলিমদের বিদ্রোহের স্বার্থকতা। সিভিল সার্ভিসকে আমার শুধু উন্নত জীবন যাপনের মাধ্যম হিসেবেই নয় উপরন্তু আমার দেশের গরীব মানুষের সেবা করার মাধ্যম হিসেবেও প্রতীয়মান হয়েছিল। আমার জানামতে আমি যথাযথ আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার সাথে দেশের সেবা করার চেষ্টা করেছি যার জন্যে ক্যারিয়ারের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাকে স্বীকৃতিও দেয়া হয়েছে। আস্থা ও ভরসাপূর্ণ বিভিন্ন পদের দায়িত্ব আমার কাঁধে অর্পিত হয়েছিল, পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের জেনারেল আযম খানের উপ-সচিব হিসেবে আমার ব্যস্ত কিন্তু সংক্ষিপ্ত মেয়াদ আমি উপভোগ করেছি। রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের অধীনে প্রায় তিন বছর ও তারপর আপনার অধীনে স্বল্পমেয়াদে মন্ত্রিপরিষদের উপ-সচিব হিসেবে কাজ করাকে আমি বিশেষ সুযোগ বলে মনে করি। ১৯৬৬ সালে আমি তামিঘা-এ-পাকিস্তান নাগরিক পুরষ্কার লাভ করি।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে আমি সরকারী চাকুরীর সময় সমানভাবে কাটিয়েছি ও আমার অন্যান্য সহকর্মীদের মতো আমিও বুঝতে পেরেছি যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সুবিচার করা হচ্ছে না এবং বাঙ্গালীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না, পাকিস্তান যে আদর্শের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি- এক সম্প্রদায় দ্বারা অন্য সম্প্রদায়কে ও এক অঞ্চল দ্বারা অন্য অঞ্চলকে শোষণ বেড়েই যাচ্ছিল, শ্রেণী, ভাষা ও স্থান নির্বিশেষে নাগরিকদের কাছে সমান সু্যোগ কখনও পৌঁছায় নি, সমাজ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের গণতান্ত্রিকীকরণ ইচ্ছাকৃতভাবে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি কখনও সম্পূর্ণ আশাহীন মনে হয়নি। বেসামরিক প্রশাসনে বাঙ্গালীর অংশগ্রহণ বাড়ছিল যদিও বৃদ্ধির হার খুবই হতাশাজনক ছিল। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ বাড়বে বলে আপনার ভাল সত্ত্বা আশা ধরে রাখলেও এই রাস্তা কন্টকপূর্ণ হবে সেটা বিশ্বাস করার পেছনে সকল কারণই ছিল। অর্থনৈতিক উন্নয়নে ত্বরণ বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল কিন্তু সেটাও আক্রোশবিহীন ছিল না। আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণের নীলনকশা অবশেষে আলোর মুখ দেখছিল। আমাদের ব্যবস্থায় একজন সরকারী চাকুরের জন্যে দলীয় রাজনীতি সহজ কথা নয় কিন্তু আমি যা বলছি তা দলীয় রাজনীতির ব্যাপার নয়, এটা আমাদের সিংহভাগ জনগণের মঙ্গলের ব্যাপার, জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের খুবই মৌলিক একটা বিষয়।
আপনি নিজেই বলেছেন, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী পুরো দেশের জন্যে ও বিশেষ করে বাঙ্গালীদের জন্য খুবই উদ্বেগ ও বেদনার উৎস। ঠিক যখন দেশ একটা গণতান্ত্রিক যুগে প্রবেশের দেরগোরায় ছিল, তখনই দেখা গেল যে, সামাজিক কাঠামো ও জাতীয়তার ভিত্তি নৃশংসভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। আমরা যারা দেশের বাইরে আছি, তারা ডিসেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক উন্নয়ন নিরব যন্ত্রণায় পর্যবেক্ষণ করছি। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানে ছয় দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে স্বায়ত্বশাসনের প্রতি এত বিশাল সমর্থন প্রতিফলিত হবার পরও পাকিস্তানের ক্ষমতাধররা সেদিকে কান দেননি। এর পরিবর্তে পরিষদের অধিবেষণ স্থগিত করতে রাজী হয়ে ও বিচ্ছিন্নতাবাদী অনুভূতিকে উপরের হাত শক্ত করতে দিয়ে আপনি এতদিন নেয়া সকল উদ্যোগ হারিয়েছেন।তবে পাকিস্তানকে নিয়ে আশা আবার পুনর্জাগরিত হয় যখন মার্চের মাঝামাঝি আপনি আলোচনা আবার শুরু করেন। কিন্তু সকল আশা ভেঙ্গে যায় যখন নৃশংস ক্রাক-ডাউনের খবর আসে। পুরো একটা দিন না যাওয়া পর্যন্ত এই সামরিক আঘাতের তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য জানা সম্ভব হয় নি। ঐসময় থেকে সরকারী চ্যানেলের মাধ্যমে প্রাপ্ত খবর ও অন্য সকল উৎস থেকে প্রাপ্ত খবরে এত বৈসাদৃশ্য ছিল যে পরিস্থিতি সঠিকভাবে উপলব্ধি করা কঠিন ছিল। সময়ের পরিক্রমায় এই সুবিশাল ট্রাজেডি নিজ মহিমায় উদ্ভাসিত হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্রের বিলম্বিত ঘোষণা তিন বছর আগের অনুরুপ প্রচেষ্টার (কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা) মতোই অবিশ্বাসযোগ্য ছিল। যা সত্য মনে হচ্ছিল তা হল শোষণের অবসান ঘটিয়ে মানুষের কাছে ক্ষমতা সমর্পণ করার মাধ্যমে পাকিস্তানে আধিপত্য বিস্তারকারী কায়েমী স্বার্থসমূহের সমন্বয় সাধন করা যায় নি; বরং একটি রাজনৈতিক সঙ্কটের সামরিক সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছিল।
মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি যেমন খড়কুটো আকড়ে ধরে তেমনি আমিও, আমার স্বদেশী অনেক মানুষের মতো নিকষ কালো মেঘের মধ্যেও আশার আলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম। আমি আশা করে আছি যে সামরিক অপারেশনের নামে এই উন্মাদ কার্যকলাপ বন্ধ করা হবে। আমি আশা করছি যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সৈন্য ফিরিয়ে আনতে আপনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমি প্রার্থনা করছি যে আপনি শেষ পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিদের সাথে একটা বোঝাপড়ায় আসবেন ও বাঙ্গালীদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকারের অনুমোদন দেবেন(একটি প্রক্রিয়া যার জন্য আমাদের দেশ চিৎকার করে কাঁদছে)। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল একটিও সুস্থ মস্তিষ্কের যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ আপনার সরকার নেয়নি। আপনার বহুল প্রতীক্ষিত ২৮শে জুনের ঘোষণা যেভাবে দেয়া হয়েছে তা বেদনাদায়ক হতাশা নিয়ে এসেছে। এই বিবৃতি আশা বা ভরসার জন্য কোন জায়গা রাখেনি। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে সকল নাগরিক অধিকার দমন করে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে ও অবশেষে পাকিস্তানের উভয় পক্ষের অর্থনীতি ধ্বংস করে, সর্বোপরি সরকার সকল কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
যদিও এটা দাবি করা হচ্ছে যে ভ্রান্ত পথে চলমান একদল অল্প কজন মানুষ দেশ ভাঙ্গার চেষ্টা করছে, শাস্তি কিন্তু সম্পূর্ণ বাংলাদেশকেই নির্বিচারে দেয়া হচ্ছে। যেকোন অজুহাতে বাঙ্গালী মারা হচ্ছে ও সম্পদ বিনাশ করা হচ্ছে। বস্তি এলাকা উজাড় হওয়া, গোলাগোলি ও নাশকতার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক আচরণ, যোগাযোগ নেটওয়ার্কে নাশকতা প্রতিরোধ, দুষ্কৃতিকারীদের অনুসরণ ও অন্যান্য অনেক অজুহাত হল এর ছোট কিছু উদাহরণ মাত্র। বাঙ্গালী হিন্দু সম্প্রদায়ের যে ৮ মিলিয়ন পদদলিত অবশিষ্টাংশ রয়ে গেছে যাদের বিগত ২২ বছরে ভারতে আশ্রয় নেবার ইচ্ছা বা উপায় কোনটাই ছিল না তাদের দ্বারা নাকি ৬৪ মিলিয়ন বাঙ্গালী মুসলিম বিভ্রান্ত হচ্ছে, এমন একটা অপমানজনক অজুহাতের ভিত্তিতে আপনার সরকার পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের শেষ করার একটা ঘৃণ্য উদ্দেশ্য অনুসরণ করছে। গত তিন মাস যাবৎ এতটাই অবিবেচনাপ্রসূত সামরিক অপারেশন চলছে যে পূর্ব পাকিস্তানে এখন জীবিত থাকার ঘটনাটাই সবচেয়ে বড় বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার এখন তার নাগরিকদের জীবন ও সহায় সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বদলে দেশ ও জনগণের ধ্বংস করার দায়িত্ব নিয়েছে। দেশপ্রেমিক জনসাধারণ এক বিদেশ ভূমিতে প্রবেশ করতে বাধ্য হচ্ছে যে দেশ আগে কখনও আমাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের ভিতরে ও বাইরে উভয় দিকে নাগরিকদের রোগে ও অনাহারে মারা যাতে বাধ্য করা হচ্ছে। আপনার সরকার পাকিস্তানে (পুর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশ) খবর পাঠানো ও পাকিস্তান থেকে খবর নেয়া উভয়ই এত কঠিন বানিয়ে রেখেছে যে, শর্ষের মধ্য থেকে ভূত বের হবার ভয়ে আপনি ভীত এই সিদ্ধান্তে আসা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। প্রকৃতপক্ষে দেশে সম্পূর্ণরুপে ত্রাসের রাজত্ব চলছে আর রহস্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের এই বর্ণনাতীত নৃশংসতা শুধু আরও তীব্রতর হচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তানে ঔপনিবেশিক জল ঘোলা করার চেষ্টা করা হচ্ছে যদিও এটা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে ক্ষমতা খুব শীঘ্রই মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে। পূর্ব পাকিস্তানের সরকার চালানোর জন্য বড় ও পাতি উভয় ধরনের কর্মকর্তা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনয়ন, পূর্ব পাকিস্তানের কৌশলগত স্থানসমূহে অবাঙ্গালী বসানো, বন্দর, বিমানবন্দর, কারখানা ও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক চালানোর জন্য পশ্চিম থেকে শ্রম আমদানী ইত্যাদি সকল পদক্ষেপ কেবলমাত্র এক বন্য ঔপনিবেশিক ক্ষমতার পক্ষেই ভাবা সম্ভব। আপনার সরকারের কাছে সব বাঙ্গালীই সন্দেহজনক। দায়িত্বপূর্ণ পদে যারা আছেন তাদের দায়িত্ব হয় শিথিল করা হচ্ছে অথবা তাদের অকার্যকর করা হচ্ছে। বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী কর্মকর্তাদের মধ্যে সম্পর্ক আগের যুগের বৃটিশ কর্মকর্তা ও তাদের স্থানীয় সহকর্মীদের চেয়েও খারাপ রুপ নিচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চকন্ঠ জনগণ আপনাদের কঠোর সামরিক দমন পীড়নের চাপে স্থম্ভিত ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। প্রাণ বাচানোর জন্য তাদের তোতাপাখির মতো কথা বলতে হচ্ছে ও লিখতে হচ্ছে।
আপনার সরকার এমন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যা পূর্ব পাকিস্তানকেই শুধু রক্তপাত করাচ্ছে না বরং এই দর কষাকষিতে পশ্চিম পাকিস্তানও ধ্বংস হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের শহরগুলো মূলত জনশূন্য; অর্থনৈতিক লেনদেনের অভাবে যোগাযোগমাধ্যম স্থবির; বেসামরিক প্রশাসনের চাকা মূলত অচল ও দেশের যুবক সম্প্রদায় আত্নগোপনে। খাদ্যশস্য সংগ্রহ খুবই কম হচ্ছে (সেপ্টেম্বর ১৯৭০ থেকে মাত্র ৬০০,০০০ টন আমদানী করা হয়েছে)। ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ কার্যত বন্ধ রয়েছে আর ফসলের বপন ও ফলন উভয়ের অবস্থা খুব খারাপ। সবকিছু পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান দুর্দশার চিত্র উপস্থাপন করছে যা মানুষের কল্পনারও বাইরে। যে হারে বিদ্রোহ বেগবান হচ্ছে, এতে করে এই বিপর্যয় নিরসনের কোন আশাই নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের উপর পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির প্রভাব অত্যন্ত গভীর। পশ্চিম পাকিস্তান একটি ভাল ও বড় বাজার হারিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে চালানো সামরিক অপারেশন অর্থায়ন করতে বলা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানকে। বহির্বিশ্ব থেকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য পাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রকে চূড়ান্ত দেউলিয়াত্বের দিকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দমনের মাধ্যমে সকল ধরনের বৈধতা হারিয়েছে পাকিস্তান সরকার যার নেতৃত্বে আছেন আপনি। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলকে আপনি “আজীবন নিষিদ্ধ” ঘোষণা করেছেন। দেশের উভয় অংশের মানুষকে প্রতিনিধিত্বকারী অনেক নেতা আপনার হুমকির কারণে গা-ঢাকা দিয়েছেন। আপনার নির্দেশে যে বর্বরতার সাথে গণহত্যা চালানো হচ্ছে ও মানব বসতি ধ্বংস করা হচ্ছে, পাশাপাশি দেশের উভয় অংশে ভিন্নমত পোষণকারীদের উপর যে নিষ্ঠুর দমন পীড়ন চালানো হচ্ছে এতে করে সভ্য দুনিয়ায় আপনার সরকারের স্থান সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছে। ২৫শে মার্চ চরম ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে আপনার করা আঘাত পুর্ব পাকিস্থানে মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন করেছে ও সেখানে আপনার সৈন্যরা দখলদার বাহিনী হিসেবে গণ্য হচ্ছে। যে বর্বরতার সাথে আঘাত করা হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তানীদের জন্য বাঙ্গালীদের মনে ঘৃণার জন্ম দিয়েছে আর এখন এই ক্ষত এত গভীর যে তা মেরামতের অনুপযোগী। বস্তুত, জাতীয়তাবোধের ভিত্তি এখন পারষ্পরিক ঘৃণা ও ভয়ের নিচে দাফন হয়ে গেছে। এটা চিন্তা করা অস্বাভাবিক নয় যে পাকিস্তানের সমাধিফলক মেহেরপুরের আম্রকাননেই লেখা হয়ে গেছে। পৃথিবীর চোখে আপনার সরকার গণহত্যা ও পাকিস্তানের বিভাজনের অপরাধে অপরাধী।
আপনার সরকার আরও অনেক উপায়ে ক্ষতির কারণ হয়েছে। এরা নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে অথবা অন্তত তাদের হত্যার কারণ হয়ে ও উপাসনালয়সহ মানব বসতি ধ্বংস করার মাধ্যমে ইসলামকে কলুষিত করছে। পূর্ব পাকিস্তানের এই সঙ্কট ভারতে বসবাসরত ৬৫ মিলিয়ন মুসলিমের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আপনার সরকার যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধাবস্থাকে ত্বরান্বিত করছে। এটা পূর্ব পাকিস্থানকে ভারতের হাতে চলে যেতে বাধ্য করছে-এমন একটি ক্ষতি যা ক্ষমার অযোগ্য। সবকিছুর উর্ধে আপনি পূর্ব পাকিস্তানে শ্রেণী যুদ্ধের অবস্থা তৈরী করেছেন- এমন একটি সামাজিক ধাক্কা যা সম্পূর্ণ দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে নিজের একান্ত মূহুর্তে আপনি নিজেকে বাহবা দিবেন যে আমার পক্ষে আপনার সরকারের সাথে যুক্ত থাকা আর সম্ভব নয়। আপনার সরকারের একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ দেখার জন্য আমি অনেকদিন অপেক্ষা করেছি। আমি ঔপনিবেশিক প্রভুদের অধীনস্থ স্থানীয় কর্মকর্তা হবার মতো মানুষ নই। আমি সবসময় নির্ভয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে চেয়েছি কিন্তু পাকিস্তানে এমন পরিস্থিতি এখন আর নেই। এই পর্যায়ে যেমন আমি ভয় পাচ্ছি যে আমাকে হয়তো দেশের বাইরে বাস করেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। যতদিন পূর্ব পাকিস্তানে আপনার সামরিক দমন পীড়ন চলতে থাকবে ততদিন বিবেকের তাড়নায় আমি সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিজের ন্যায়সঙ্গত জায়গায় ফিরে যেতে পারব না। এটা এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশ একাই অত্যাচারী, অবৈধ ও বর্বর ক্ষমতা জবরদখলকারী থেকে পাকিস্থানকে (উভয় অংশ) রক্ষা করবে। সুতরাং বাংলাদেশের উদ্দেশ্য সমর্থন করা ও এর উদ্দেশ্যে নিজের আনুগত্য সমর্পন করা ছাড়া আমার আর কোন বিকল্প নেই। আমি আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি, স্যার, আমি আপনার অধীনে চাকুরিরত সকল সরকারী কর্মকর্তার, যারা এই দেশে চলমান ত্রাসের সাম্রাজ্যে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে, তাদের মনের অনুভূতি প্রকাশ করছি।
আমি আপনার জন্য একটি ব্যক্তিগত প্রার্থনা দিয়ে শেষ করতে চাই। আমি বিশ্বাস করতে চাই যে আপনার উদ্দেশ্য আন্তরিক কিন্তু আপনি চলমান দ্রুত ঘটনাপ্রবাহের শিকার। তাই আমি আশা করছি যে, আপনি খুব দ্রুতই মন্দ প্রভাব থেকে বের হয়ে আসবেন অথবা বর্তমান ট্রাজেডি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। আল্লাহ আপনাকে ন্যায়পরায়নতার রাস্তা প্রদর্শন করুক এবং আপনার যেসব কৃতকর্মের জন্য হয়তো আপনি অনিচ্ছাকৃতভাবে দায়ী, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার সময় পান।