শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবুল এইচ. সাদউদ্দিনের চিঠিপত্র | ব্যক্তিগত চিঠিপত্র | এপ্রিল-মে, ১৯৭১ |
এথনোম উজিকোলজি
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
লস এঞ্জেলস – ৯০০২৪
২৭ এপ্রিল, ১৯৭১
জনাব সিনেটর,
আমাদের এই সংকটময় মুহূর্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ (প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান) এর সকল স্থানীয় নেতৃত্ববৃন্দকে সরিয়ে দেয়ার যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে এবং আমার দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর যে ভয়ংকর বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তা দেখে আমরা নির্বাক ও হতবাক হয়ে পড়েছি। আমার ভাই-বোনেরা রক্তপিপাসু পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হিংস্র নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রতিবাদী সব কণ্ঠ রোধ করে দেয়া হয়েছে।
আশ্চর্যের বিষয় হল মার্কিন সরকারের কেউ এখনও পর্যন্ত এই বর্বরতার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করেনি এমনকি তাদের দেশ থেকে সরবরাহকৃত অস্ত্র দ্বারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক আমাদের প্রফেসর, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, উকিল, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষার্থীসহ নিরাপরাধ মানুষদেরকে নির্মমভাবে হত্যার বিরুদ্ধে কেউ নিন্দাও জানায়নি। অত্যন্ত দুঃখজনক! প্রেসিডেন্ট নিক্সন চার্লস ম্যানসনকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন, অথচ বাংলাদেশে যা ঘটছে, সে সম্পর্কে তিনি খুব সচেতনভাবেই কিছু জানার বা বলার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। আমেরিকার এই নীরবতা খুবই লজ্জাজনক।
দয়া করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্ষমতার এই দম্ভকে প্রতিহত করতে আওয়াজ তুলুন যাতে করে বাংলাদেশের মানুষগুলোকে বাঁচতে পারে। সরকার যদি গণমানুষের জন্য কাজ করতে না-ই পারে, তবে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেবল অস্ত্রের মুখেই অর্জন করা সম্ভব বলে আমরা ধরে নেব। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই আমরা স্বাধীন হবই। বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতার নাম।
রেড চায়নার প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের চরমপন্থী উপাদানসমূহের পক্ষে সমস্ত মধ্যপন্থী শক্তিগুলোকে উচ্ছেদ করার একমাত্র উদ্দেশ্যটি যদি সত্য হয়ে থাকে (দ্রষ্টব্য লস এঞ্জেলস টাইমস; বৃহষ্পতিবার, ২২ এপ্রিল, ১৯৭১) তবে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রেরই বিপদ হবে। কিন্তু একই সাথে এটাও আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, আপনাদের সামরিক সম্পৃক্ততা বা হস্তক্ষেপ কোনভাবেই আমাদের কাম্য নয়।
জনাব সিনেটর, আপনার কাছে আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, দয়া করে পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক উভয়রূপেই সাহায্য প্রদান বন্ধ করুন। বাংলাদেশ অভুক্ত থেকে হলেও স্বাধীনতা অর্জন করবেই। অনুগ্রহ করে লক্ষ্য রাখবেন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে কোন শিক্ষাগত বৃত্তি ও অনুদান কিন্তু নেই।
পাকিস্তানিদের প্রতি যেকোন ধরণের বিনিময় কার্যক্রম বন্ধ করে দিলেই পাকিস্তানি সামরিক সরকারের নির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রতি অসম্মান জানানো হয়। এতে করে পাকিস্তানি জেনারেলদের টনক নড়তে পারে।
আমার ব্যক্তিগত শুভেচ্ছা রইল।
বিনীত নিদেবক
(আবুল এইচ.সাদউদ্দিন)
৩৫ লিবারেল সিনেটর
ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান
ইউ এস সিনেট
ক্যাপিটাল হিলস
ওয়াশিংটন ডিসি
——————–
৫০৫ গ্যালেই অ্যাভিন্যু
৪০১ লস এঞ্জেলস
ক্যালিফোরনিয়া – ৯০০২৪
৬ মে, ১৯৭১
সভাপতি
ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়
ব্লুমিংটন, ইন্ডিয়ানা – ৪৭৪০৫
জনাব,
আমার দেশে (প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান)পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক এখনও পর্যন্ত নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর ঘৃণ্য বর্বরতা চালানো হচ্ছে, যার পরিপ্রেক্ষিতেসম্প্রতি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এবং বাংলাদেশ (বেঙ্গল) নামে নতুন গঠিন সরকার ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। এই বিষয়ের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র(১৯৬৪) হবার সুবাদে আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে লিখছি।
পাকিস্তান থেকে খুব অল্পই প্রতিবদন বের হচ্ছেযার কারণেবেশিরভাগ খবর আমেরিকানদের কাছেও পৌছায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে সামরিক নৃশংসতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, কখনও কখনও সপরিবারে। নিম্নে নিহতদের একটি আংশিক তালিকা আমার বক্তব্যকে বৈধতা দিতে সাহায্য করবে। আপনার ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের কয়েকজন প্রফেসর হয়ত এই হতভাগ্য প্রফেসরদের কাউকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার কারণে ব্যক্তিগতভাবে চিনেও থাকতে পারেন। ঢাকা বা চট্টগ্রামের কোন আমেরিকান শরণার্থীর কাছ থেকে সরাসরি কোন রিপোর্ট পেয়ে থাকলে আমার বর্ণনাকে বরং কমই মনে হবে আপনার কাছে।
বাংলাদেশি জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর (অফিসার ও তালিকাভুক্তদের ৯৫%ই পশ্চিম পাকিস্তানি; বাঙালি অফিসার হাতেগোণা কয়েকজন, তারা কখনই লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদের ওপরে প্রোমোশন পান না) এই নির্মম বর্বরতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি আপনাকে তীব্র নিন্দা জানানোর জন্য এবং আমাদের জনগণের মূল্যবান প্রাণের অমর্যাদা করার জন্য পাকিস্তানি সামরিক সরকারের প্রতি ধিক্কার জানোনোর আকুল আবেদন জানাচ্ছি।
ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় (শিক্ষা) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ব্যবসায় শিক্ষা)- উভয়কেই সহযোগিতা দিয়ে থাকে। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবেআপনার কাছে আকুল আবেদনযে, আপনি, অন্যান্য কর্মকর্তা ও ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ডিনবৃন্দ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ঘৃণ্য বর্বরতার প্রতি তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণা জানিয়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়কে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সবধরনের সাহায্য প্রদান থেকে বিরত থাকবেন। একজন পশ্চিম পাকিস্তানি শিক্ষার্থীও যেন আপনার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বছর কোন বৃত্তি বা অনুদান না পায় দয়া করে সেদিকে খেয়াল রাখবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সাহায্য প্রদান যেন সঙ্গত কারণেই বন্ধ না হয়।
এটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং আশ্চর্যজনক যে, বর্তমানে চলতে থাকা এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে! এখন হিটলারের জার্মানির ‘ইহুদী সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান’কেনাজ্জি জার্মানির “অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ হিসেবে ধরে নিয়ে নিজেকে প্রবোধ দিলে নিশ্চয়ই ভুল হবেনা!
ধারণা করছি যে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে কোন বাঙালি ছাত্র নেই। আমার মনে হয়েছে যে চুপ করে থাকা যখন লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন কাউকে না কাউকে তো আওয়াজ তুলতেই হবে। তাই আপনাকে এই চিঠি লেখা।
ব্যক্তিগত শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা রইল।
বিনীত নিবেদক
(আবুল এইচ.সাদউদ্দিন)
শিক্ষা সহকারী
এথনোমিউজিকোলজি ইন্সটিট্যুট
ইউসিএলএ
———————
জনাব আবুল সাআদুদ্দিন
এথনোমিউজিকোলজি
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি
লস এঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া ৯০০২৪
যুক্তরাষ্ট্র সিনেটরবৃন্দ
শ্রম ও জনকল্যাণ কমিটি
ওয়াশিংটন, ডিসি ২০৫১৩
২০ মে, ১৯৭১
জনাব সাদউদ্দিন,
আপনার চিঠি এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির প্রমাণস্বরূপ সংযুক্ত কাগজপত্রের জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
আপনার দেশে গত কয়েক মাস ধরে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো প্রকৃতপক্ষেই দুঃখজনক। সেসব আমাদের দৃষ্টি ও মনযোগ আকর্ষণ করেছে।
আপনি হয়ত অবগত আছেন যে, সিনেট আইনে পাকিস্তানে অস্ত্র চালান বন্ধের বিষয়টি আছে এবং সিনেটে এ সংক্রান্ত আলোচনায় আমি অবশ্যই ব্যবস্থাটি গ্রহণের পক্ষে সমর্থন জানাব।
আমি জেনে খুশি হয়েছি যে, পূর্ব পাকিস্তানের হতভাগ্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য জাতিসংঘ সাহায্য পাঠাবার কথা চিন্তা করছে এবং আশা করি অচিরেই সেসব পৌঁছে যাবে।
গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন বলে খুশি হলাম। নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে এই বিষয়ে আমি আমার প্রতিজ্ঞা ও সম্পৃক্তি বজায় রাখব। আপনার দেশের জনগণের ভয়াবহ এই দুর্দশা নিরসনে গৃহীত যেকোন ব্যবস্থাকে আমি অবশ্যই সমর্থন জানাব।
বিনীত
অ্যালান ক্র্যান্সটন
ক্যালিফোর্নিয়া
———————–
যুক্তরাষ্ট্র সিনেট
বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি
ওয়াশিংটন, ডিসি ২০৫১০
২১ মে, ১৯৭১
প্রিয় বন্ধু,
পাকিস্তানের দুঃখজনক পরিস্থিতির বিষয়ে যোগাযোগ করার জন্য ধন্যবাদ। সময় করে লিখার জন্য প্রশংসা রইল।
আপনি জেনে খুশি হবেন যে, বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি মে মাসে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘাত না মেটা পর্যন্ত সামরিক সহযোগিতা পাঠানো স্থগিত রাখা এবং সাধারণ ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই ব্যাপারে আপনার সম্পৃক্তির কারণে আমার ধারণা এস.কন.রেস.২১ এর কমিটি রিপোর্টটি পড়তে আপনি আগ্রহী হবেন। একটি কপি সংযুক্ত করা হল।
অন্য একটি চিঠির আদলে লেখার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি, কারণ এই বিষয়ে আমার কাছে এতো চিঠি এসেছে যে প্রত্যেককে আলাদা করে উত্তর দেয়াটা অসম্ভব ছিল।
বিনীত
জে.ডব্লিউ.ফুলব্রাইট
চেয়ারম্যান
——————-
যুক্তরাষ্ট্র সিনেট
বিচারক কমিটি
ওয়াশিংটন ডিসি ২০৫১০
২৪ মে, ১৯৭১
জনাব আবুল এইচ.সাদউদ্দিন
৫০৫, গ্যালেই অ্যাভিনিউ ৪০১
লস এঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া ৯০০২৪
জনাব সাদউদ্দিন,
আমার সাথে মতপ্রকাশের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
পাকিস্তানি গৃহযুদ্ধে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার আমাকে গভীরভাবে বিচলিত করেছে। যদিও পাকিস্তানিদের হাতে ইতোমধ্যে পৌঁছে যাওয়া মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কিছুই করার নেই, কিন্তু একথা আমরা স্পষ্ট করে বলতে পারি যে, পরবর্তীতে আর কোন সামরিক সাহায্যের যোগান পাঠানো হবে না। রাষ্ট্রপতিকে এই বিষয়ে আমার অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য আমি এস.কম.ফি ২১ এ পৃষ্ঠপোষকতা করেছি, যা পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত দ্বন্দ্ব না থামা পর্যন্ত পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক সাহায্য প্রদান স্থগিত রাখা এবং ভয়ংকর এই সংঘর্ষ শেষ হবার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানে সমস্ত সামরিক দ্রব্যাদি বিক্রয়ের লাইসেন্স স্থগিত রাখা নিশ্চিত করবে। আমরা সবাই আশা ও প্রার্থণা করছি যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যেন ভবিষ্যতের যেকোন প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে মুক্তি পায়।
আপনার চিঠি পেয়ে ভাল লাগল এবং আশা করছি যে আমাদের দেশের সাথে জড়িত যেকোন বিষয়ে আপনি নির্দ্বিধায় আমাকে লিখবেন।
বিনীত
বার্চ বায়ে
যুক্তরাষ্ট্র সিনেট