You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971 | বৃটেনে গঠিত বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি ড. এনামুল হকের চিঠিপত্র ও যোগাযোগ | গণ-সংস্কৃতি সংসদের দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
বৃটেনে গঠিত বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি ড. এনামুল হকের চিঠিপত্র ও যোগাযোগ গণ-সংস্কৃতি সংসদের দলিলপত্র ১৯৭১

আবুল সাদুদ্দীন
নৃ-সংগীতবিদ্যা
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া
৭ জুন, ১৯৭১
প্রিয় এনাম,
তোমার সাথে ফোনালাপ আমাকে প্রীত করেছে। এটা অবিশ্বাস্য শোনায়, তাই নয় কী? আমি খুবই খুশি যে তুমি দেশের বাইরে অবস্থান করছ। আমি নিশ্চিত যে তুমিও জান তুমি কতটা ভাগ্যবান। অতীতে তোমার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড (টিভিতে ‘মুজিব কোট’ পরিধান করা সহ) অবশ্যই তোমার নাম বহুদিন ধরে কড়া পাহারায় রাখা সেনাবাহিনীর গুপ্ত তালিকায় ঢোকাবার জন্য যথেষ্ট ছিল!জানি না কেন, কিন্তু তুমি যে অক্সফোর্ডে তা না জেনেই তোমাকে নিয়ে আমারঅস্থিরতা অনুভূত হচ্ছিল। আমি ড. ডেভিডসনকে সে কথা বলেছিও। আমি কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম কিভাবে ২৬ মার্চ, আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক দিনটিতে, হয়ত তোমাকে তোমার জাদুঘরের বাসা থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসা হয়েছে। হয়ত সবচেয়ে মর্মান্তিক পরিণতিই বরণ করতে হয়েছে তোমাকে। আমাদের অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ যে তোমার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। আর আমি মনে করিসাহায্য প্রদানে সক্ষম মানুষের আশায় অপেক্ষা করে থাকা মানুষজনের সাহায্যার্থে এখন তুমি অনেক বেশি ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবে।
আমি মাত্রই লস অ্যাঞ্জেলস এর আমেরিকান লীগ অফ বাংলাদেশ এর একটি সভা থেকে ফেরত আসলাম। সেখানে কী হয়েছে তা বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে। সিলেটি গ্রুপ (যারা ব্যক্তির যোগান দেয়, বুদ্ধির নয়) যেকোনো প্রকারে এতে বাধা দেবার সুযোগ খুঁজছিল কারণ এই সংগঠনে তারা কোনো পদ পায় নি। আমি আগে থেকে অভিহিত ছিলাম না যে আমাদের বিব্রত করবার জন্যে তারা এক অশুভ পরিকল্পনা রচনা করেছে, এবং শেষ পর্যন্ত তাই-ই ঘটেছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনার বদলে তারা আমাদের হিসাব-পত্র দেখতে চাইল, যেন আমরা একদল চোর বৈ কিছু নই। আমি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদে এই সভা ত্যাগ করে চলে আসি। একজন এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে যে দালানের বাইরে সে আমাকে আঘাত করে এবং ‘কুত্তার বাচ্চা’ গালি দেয়। সে হুমকি দেয় যে আমাকে সে দেখে নিতে পারবে। যদি কেবলমাত্র সে আমাকে, এই আহাম্মক সাদুদ্দীনকে বাদ দিয়ে ইয়াহিয়া খানকে দেখে নিতে পারত! এতে অবাক হবার কিছু নেই যে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী বাংলা বিজয় করেছিল এবং আজও ইয়াহিয়ার গর্দভ সেনারা আমাদের ওপর প্রভুত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। ঠাকুর, প্রকৃতপক্ষেই, একজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন!
“সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি!”
আমি শুনেছি একই রকম ঘটনা ইংল্যান্ডেও ঘটে চলেছে। সম্পূর্ণ পরিস্থিতি সম্বন্ধে তোমার অভিমত কী? এই ধ্বংসাত্মক এবং অপব্যায়িত শক্তি আরো ভালভাবে ব্যবহারের উপায় কী? এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আমি সে আশাতেই তোমার কাছে লিখছি যেন তুমি এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করে আমাদেরচিরস্থায়ী আনুগত্যের মানহানিকর অবস্থান থেকে রক্ষা করতে পার। আমি মনে করি তোমার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্বন্ধে আমার কিছু ধারণা রয়েছে এবং এখনই তার জন্যে সর্বোৎকৃষ্ট সময়। আমাদের কিছু করা দরকার। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে এ বিষয়ে তোমার যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে এটা বোঝার জন্য যে একজন ব্যক্তি কিভাবে “সময়কে করায়ত্ব” করতে পারে। তুমি কি গুরুত্ব সহকারে কোনকিছুর কথা ভাবছ? আমার টাকা থাকলে আম যতদ্রুত সম্ভব কিউবা চলে যেতাম। যখন লাল সেনারা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা উপভোগ করছিল তখন আমি রেড চায়নায় অবস্থান করছিলাম। নিজের চোখে আমি দেখেছি কিভাবে একটি বিদ্রোহের জন্ম দিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখা যায়। আমি ইতোমধ্যে কিছু ইসরায়েলি গ্রুপের সাথে কথা বলেছি। একটি ট্রটস্কাইট গ্রুপ আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে এটা জানার জন্যে যে বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তনে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে কি তোমার কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা বা উপদেশ দেবার রয়েছে?
দয়া করে তোমার সামনের পরিকল্পনা এবং কর্মসূচি সম্বন্ধে আমাকে যত দ্রুত সম্ভব অভিহিত কর। বসন্তের সময় তোমাদের এই পশ্চিম তীরবর্তী কলেজগুলোতে কথা বলার জন্য আনতে না পারাটা আসলেই খুব দুঃখের ব্যাপার। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই যে যেসকল পেশাগতভাবে শিক্ষক তাদের উচ্চতর বিভিন্ন ডিগ্রীর জন্য ক্রেডিট সংগ্রহ করতে এখানে আসে তাদের জন্য গ্রীষ্ম উপযুক্ত সময় কি না। যাই হোক, বিচারপতি চৌধুরীকে পশ্চিম তীরে, বিশেষ করে বার্কেলে এবং ইউ. সি. এল. এ. তে এসে কথা বলতে রাজি করাও। সাধারণভাবে আমেরিকান জনগণ বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে খুবই অন্ধকারে বাস করে (যেমনটা আমরা করি কলাম্বিয়ান বা ফিনিশ রাজনীতি সম্পর্কে)।
অত্যাচার এবং গণহত্যার কিছু ছবি পাঠিও। আমরা তাদের বড় করে কপি করে ছড়িয়ে দিতে পারি যা আমেরিকানদের প্রভাবিত করার জন্য, কারণ তারা এমন জিনিস দেখতে পছন্দ করে। এ পদ্ধতিতে সহজেই তাদের মধ্যে আবেগ ও সহমর্মিতা জাগিয়ে তোলা সম্ভব। এমন কিছু ব্রিটিশ প্রতিবেদক এবং মানুষের সাথে কথা বল যাদের কাছে ছবি থাকতে পারে। “জনমত” এক্ষেত্রে একটি ভাল উৎস হতে পারে।
আমার মনে হয় ডেভিডসনের কাছে ব্যক্তিগতভাবে লিখে আমাদের জন্য ইউ. সি. এল. এ. এর মাধ্যমে তাকে কিছু করতে অনুরোধ করা যেতে পারে। এখানে তার সাথে আমার সাক্ষাৎ এর চেয়ে লন্ডন বা অক্সফোর্ড থেকে তোমার লেখা অধিক ক্রিয়াশীল হবে। মনে করে অস্ট্রেলিয়ার বাশাম এর নিকটেও লিখ। সে তোমার চিঠি পেয়ে খুবই খুশি হবে। তাকে জানিও তুমি কী করছ। ‘কিউরেটার’ উপাধিটি তার মধ্যে ব্যাপক কৌতূহলের জন্ম দিবে। দুটি ঠিকানাই নিচে দেয়া আছে।
মুজিবুর রহমান সম্বন্ধে তোমার কাছে কী কী খবর রয়েছে? ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি তাকে এর মাঝে মেরে ফেলা হয়েছে। মুজিবের ‘ভাষণ’ যখন গোপন বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল সেসময়ে বাঙালিদের মনোবল কার্যত ধ্বংস করে দেবার জন্যেও সেনাবাহিনী যে তাকে বন্দি অবস্থায় জনসম্মুখে প্রদর্শন করে নি সেটাই প্রমাণ করে যে ঐসময়ে তিনি জীবিত ছিলেন না। তুমি কি এমন কোনো পরিকল্পনা করতে পার যা প্রমাণ করবে তিনি আর বেঁচে নেই? আমি সংবাদপত্রে (চিঠির আকারে) একটি রচনা প্রকাশের কথা ভাবছিলাম যাতে লিখা থাকবে সঠিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এটা আমেরিকান জনগণকে বোঝাবার জন্যে যথেষ্ট হবে। আমার এই মতবাদকে ভুল প্রমাণিত করার একটিই উপায় রয়েছে। আর তা হল ইয়াহিয়া খান যদি জনসম্মুখে তা নাকচ করে আমেরিকান প্রতিবেদকদের সামনে মুজিবকে ‘জীবিত’ প্রদর্শন করে। এটা প্রমাণ করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে যে মুজিবের প্রকাশিত ছবিটি অনেক পুরোনো, সম্ভবত ১৯৬৬ এরও আগের যখন তিনি একটি ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে কারারুদ্ধ ছিলেন। এ বিষয়ে আর কারো সাথে আলোচনা কোরো না, কিন্তু আমাকে জানিও আমরা কিভাবে কার্যকররূপে এটা সম্পন্ন করতে পারি। ইতিহাস তোমাকে পথ দেখাবে। রাইখস্ট্যাগে হিটলারের আগুন লাগানো এবং তার দায় কমিউনিস্টদের ঘাড়ে চাপানোর ঘটনাটি মনে রাখবে।
আমি জানি তুমি খুবই ব্যস্ত। কিন্তু তুমি তোমার সচিবকে মুখে মুখে বলে একটি চিঠি লেখাতে পার এবং সে খুবই দক্ষতার সাথে বাকি সবগুলো কাজ করে ফেলবে।
ইনু
এ. কবির
সি/ওঃ পিসি রয়
৪৯/৪, হিন্দুস্তান পার্ক
কলকাতা ২৯
২৮/০৮/১৯৭১
প্রিয় জনাব হক,
আপনার টেলিফোন বার্তা আমার কাছে পৌঁছেছে। আমরা একজন (বা দুজন) প্রতিনিধি পাঠাতে সম্পূর্ণ তৈরী, যা নির্ভর করছে আপনার টিকেট প্রেরণের ক্ষমতার উপর। আমরা মুক্তি বাহিনীর ওপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী করবার বিরুদ্ধে, কারণ এটা বেশ বড় একটি নিরাপত্তা ঝুঁকি। তবে “বাংলাদেশ ওয়ার অফ ন্যাশনাল লিবারেশন” নামক তথ্যচিত্রটির প্রথম অংশের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই অংশে গণহত্যার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং আমাদের আন্দোলনের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করবার চেষ্টা করা হয়েছে।আশা করছি আপনার তা পছন্দ হবে। দ্বিতীয় অংশ “বার্থ অফ অ্যা নেশন” এবং এই ৬ খণ্ডের তথ্যচিত্রের বাকি ৪ খণ্ডের কাজ আগামী ৬-৮ সপ্তাহের মাঝে শেষ হয়ে যাবে। প্রতিটি অংশের দৈর্ঘ্য হবে ২০ মিনিট। যদি সম্ভব হয় তবে ইউকে, ইউরোপ এবং ইউএসএ এর টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র থিয়েটারগুলোতে এদের বণ্টনের ব্যবস্থা করুন। এর অগ্রগতি আমাদের পরবর্তীতে আরো বৃহদাকার প্রকল্প গ্রহণে সক্ষম করে তুলবে। যদি আমরা লন্ডনের সাংস্কৃতিক সম্মেলনে আমাদের প্রতিনিধি পাঠাতে পারি তবে সে সেখানে এই ছায়াছবিটি বহন করে নিয়ে যাবে।
প্রতিনিধি পাঠাবার মূল সমস্যা হল আমাদের মধ্যে খুব অল্প কজনেরই পাসপোর্ট রয়েছে। বিশেষায়িত ভ্রমণ ব্যবস্থাদি তখনই করা সম্ভব যখন আপনি টিকেটের সাথে একটি আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পত্র (ছাপানো নামঠিকানা এসব সব সহকারে) পাঠাবেন। অনুগ্রহ করে যত দ্রুত সম্ভব এই পত্রটি পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন, এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নয়ত আপনি যাদের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের মাঝে কেউই যেতে পারবেন না।
শুভকামনায়
আলমগীর
—————————————————
ইনকা ০১৮ কলকাতা সার্কাস অ্যাভিনিউ ১৮ ৬ ১০০৫
জেড০০৯৪ অয়াইআর০০৮৪এক্স বিএলবি৩৮৯ সিবিএ০০১৭ সিএস/৩/৬ সিবিএলবি কো

এনামুল হক ৩৩ অ্যাবি রোড অক্সফোর্ড
শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণের কারণে যোগদানে অক্ষম সবকিছু ঠিক থাকলে জহির যাবে।
মল্লিক
১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
যেডসিযেডসি যেডআর০৫৪২এক্স সি সিকেএ৮৬১ সিএস৩৭২/১৬
জেবিএলবি কো ইনকা ০১৮
কলকাতা সার্কাস অ্যাভিনিউ ১৮ ১৬ ১৯৩০
এনামুল হক ৫৯ সিমোর হাউস ট্রাভিস্টক প্লেস
লন্ডন ডব্লিউসি ১
১৮ এর বিকেলে পৌঁছাচ্ছি ফ্লাইট নামাব্র ৫৮২ বিমানবন্দরে থাকবেন।
জহির রায়হান
——————–
এ.আর. মল্লিক
১৭ সুনেলাইন নোহার অ্যাভিনিউ
কলকাতা ১৪, ভারত
২৫/০৯/৭১
প্রিয় এনামুল হক,
তোমার টেলিগ্রাম ও এর মধ্যে লেখা চিঠি পেয়েছি। তোমার টেলিগ্রাম পেয়ে আমার তখন লন্ডন যাওয়া সম্ভব নয় দেখে জহির রায়হানকে যেতে বলেছিলাম এবং তোমাকে জানাতে বলেছিলাম। জহির এখান থেকে দিল্লি পর্যন্ত গিয়েছে জানি – তবে সেখান থেকে সুবিধামত কোনো ফ্লাইট পায়নি বলে শুনেছি। এখান থেকে দাপ্তরিক কাজকর্ম করতে সময় লেগেছে। সম্ভবত তার ফলে তোমাদের কর্মশালার সময় অনুসারে বিলেতে পোঁছা তার পক্ষে সম্ভবপর হবে না। শেষ পর্যন্ত সে কী করবে জানি না। আমি দিল্লিতে ছিলাম, পরশু এসেছি। শুনেছ বোধকরি আমার নিউ ইয়র্ক যাবার কথা। সব ঠিক হয়েছে। হয়ত ৩/৪ দিনের মাঝে রওনা হব। যাবার পথে তোমাদের সাথে দেখা করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে ফেরার পথে অবশ্যই দেখা করে আসব।
……………পরে তোমাকে চিঠি দেব নিউ ইয়র্ক পোঁছে। প্রীতি ও শুভেচ্ছা রইল।
আজিজুর রহমান মল্লিক
——————–
১৬২/২৩, লেক হার্ডেনস
কলকাতা ৪৫
সেপ্টেম্বর ২৭, ৭১
প্রিয় জনাব হক,
আমি নিশ্চিত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে যোগদানের লক্ষ্যে বিলেতে যাওয়া বিষয়ে জহিরের ব্যর্থতায় আপনার সবাই খুবই হতাশ। তবে এরজন্য সে দায়ী নয়। সে তার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছে। কিন্তু সবকিছুইএকেবারে শেষ মুহূর্ত করবার জন্য রেখে দেয়া হয়েছিল। টিকেট আসতে আসতে বড্ড দেরি হয়ে যায়। তুমি তার দিল্লি টিকেটের জন্য যে টাকা পাঠিয়েছিলে তা মাত্র একদিন আগে এয়ার ইন্ডিয়ায় এসে পোঁছে। তারা দুদিন তা আঁকড়ে ধরে বসে ছিল। টিকেট ইত্যাদি প্রদর্শনপূর্বক ১৭ সেপ্টেম্বর জহির তার “পরিচয়ের শংসাপত্র” পেতে পারত। কিন্তু দায়িত্বরত ব্রিটিশ ব্যক্তি এতটাই দ্রুততার সাথে তার ভ্রমণের শংসাপত্র(ভ্রমণের নথিপত্র) কে বাতিল করে দেন যে কথা বলার অবকাশটুকুও পাওয়া যায় নি। কারণ হিসেবে তিনি দেখান যে তোমার চিঠিতে কোথাও তুমি এমন উল্লেখ কর নি যে বিলেতে গেলে তুমি তার দেখাশোনা করবে এবং ভিক্ষাবৃত্তি করে সেখানে তার চলতে হবে না। যাই হোক, এরপর বলা হল যে সে তবু বিলেতে যাক। সেখানে তুমি এয়ারপোর্টে এসে ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছেবিলেতে থাকাকালীন তার ভরণপোষণের নিশ্চয়তা দিতে পারবে।
এরপর আসল শেষ বাধা। তুমি অ্যারোফ্লোট এর যে টিকেট পাঠিয়েছিলে তাতে করে মস্কোর হয়েভ্রমণটি সম্পন্ন করতে হবে। তাড়াহুড়োর কারণে অ্যারোফ্লোট এর কলকাতা অফিস মস্কো থেকে লন্ডনের ফ্লাইটে একটি আসনের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। তারা উপদেশ দেয় যে জহিরের উচিৎ এরপরেও মস্কো চলে যাওয়া। মস্কো থেকে লন্ডনের পরের ফ্লাইটেও টিকেট পাওয়া যাবে না এমনটি হবার সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু তারা জহিরকে এটা জানাতে ভুলে যায় যে মস্কো থেকে বহির্গমন টিকেটের নিশ্চয়তা ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ ট্রানজিট যাত্রীদের সেখানে অবস্থানের অনুমতি দেয় না, যদি না তাদের কাছে যথোপযুক্ত সোভিয়েত ভিসা থাকে। এই তথ্যটি আমাদের দিল্লি এয়ারপোর্টে জানানো হয় যেখানে ট্রানজিট ভিসা না থাকায় অ্যারোফ্লোট কর্তৃপক্ষ জহিরকে উড়োজাহাজে চড়তে দিল না। আমিও সেখানে ছিলাম। আমি সেখানে জে. পি. নারায়ণের বাংলাদেশ বষিয়ক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। পরদিন ছিল ১৯ তারিখ, রবিবার। সেদিন দিল্লির সোভিয়ের দূতাবাস বন্ধ থাকে। ২০ তারিখের আগে কোনো ফ্লাইটও ছিল না। তাই আমি জহিরকে উপদেশ দিই টিকেটটা খরচ না করতে, কারণ সে তোমার সম্মেলনে অংশ নিতে পারছে না।
যখন এসব দাপ্তরিক কাজকর্ম খুবই কঠিন হয়ে উঠছিল আমরা পাসপোর্ট এবং এরূপ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে এমন কাউকে পাঠাবার কথা চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু তা করা যায় নি কারণ তুমি ফেরতযোগ্য নয় এমন টিকেট জহিরের নামে পাঠিয়েছিলে।
যাই হোক, আমি মনে করি জহিরের এই ভ্রমণটি করা উচিৎ-সম্ভবত আগামী মাসেই। আশা করা যায় তুমি তার উপস্থিতি বাংলাদেশ বিষয়ক যেকোনো সভায় কাজে লাগাতে পারবে।
তুমি কি অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের শুরুতে তারিখ ঠিক করতে চাও?
এখন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমাদের এক বন্ধুকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মিশনের জন্য বিলেতে পাঠানো হবে –দুই বা তিন সপ্তাহের জন্য। এমনকি আমাকেও এই চাকরিটির জন্য নির্বাচিত করা হতে পারে যদিও এ মুহূর্তে আমি কলকাতা ছেড়ে যেতে রাজি নই। তোমাকে অবশ্যই তার ফিরে আসার বন্দোবস্ত করতে হবে (এক পাক্ষিক – যাবার বন্দোবস্ত বাংলাদেশ সরকার করবে)। আবার বিলেতে থাকাকালীন তার থাকা-খাওয়ার খরচ রয়েছে। তুমি কি সাহায্য করতে পারবে? তুমি কোনভাবেই তার মিশন বা মিশনের প্রকৃতি সম্পর্কে কোনোরূপ প্রশ্ন করতে পারবে না। একেবারে অল্প, যাদের না জানালেই নয়, এমন দু-একজন ছাড়া আর কেউ যেন জানতেও না পারে সে বিলেতে কী করছে। তুমি এই কাজে সাহায্য করতে আগ্রহী হলে আমাকে জানিও।
সম্মেলন কেমন ছিল? এখানে প্রচারের উদ্দেশ্যে আমাকে প্রতিবেদন পাঠিও। সাপ্তাহিক “পিপল” পত্রিকার জন্যেও আমাদের একজন সংবাদ প্রতিবেদক দরকার। তুমি কি কারো নাম সুপারিশ করতে চাও?
তোমারই
আলমগীর
কামরুল হাসান

প্রিয় এনামুল,
সি/ও, মো, খালেদ চৌধুরী

২/১ এ নরট রেঞ্জ
কলকাতা-১৭
২৮-৯-৭১

বহু তত্ত্ব-তল্লাশির পর তোমার ঠিকানা পেলাম।আশা করেছিলাম তোমার কাছ থেকেই আগে চিঠি পাব। আমি কলকাতায় এসেছি গত এপ্রিল মাসের তারিখে। সেই থেকেই তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম। যাই হউক, বহু কথা জমা হয়ে আছে। এখানকার এই পরিবেশে সেসব চিন্তায় কোন বাস্তব রুপ দিতে পারব বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের সভ্যদের মানসিকতা তো জানই। তবুও ধৈর্য ধরে কাজ করে যাচ্ছি। ব্যক্তিগত ভাবেও নিশ্চিন্তে নাই, কারণ আমি একলাই কলকাতায় এসেছি। তোমার ভাবী এবং রত্না এখনও ঢাকাতেই আছে। এই ছয় মাসের মধ্যে মাত্র দুবার যোগাযোগ রক্ষা করতে পেরেছি। বিশেষ অবস্থায় পড়েই তোমার ভাবি এখনো ঢাকায় পড়ে আছে। কখন যে কোন বিপদ আসে সেই চিন্তাতে মাঝে মাঝে খুবই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। গত মাসে আলভী ( শিল্পী) ঢাকায় গিয়েছিল কিন্তু সে আর সংবাদ নিয়ে ফিরে আসতে পারলনা। সে ধরা পড়ে গেছে পাক সেনাদের হাতে। অবশ্য ঢাকায় পৌঁছানোর কয়েক দিন পরে। আলতাফ মাহমুদ এর বাড়ী থেকে।
আলতাফ মাহমুদ ধরা পড়েছে আগেই এবং ওর উপর অমানুষিক অত্যাচার হয়েছে সংবাদ পেয়েছি। তাকে বোধ হয় জীবিত অবস্থায় আমরা দেখতে পাবোনা। জানিনা তুমি এ সংবাদ পেয়েছো কিনা। যাক এরকম সংবাদের তো শেষ নাই । এবার আমাদের কথা বলি ।
এর মধ্যে আমরা বাংলাদেশের শিল্পীরা Painting Exhibition করেছিলাম। নতুন, দেবদাস, স্বপনচৌধুরী , মুস্তুফামনোয়ার , কাজীগিয়াস এবং আরো অনেকে-প্রায় কুড়ি জন কলকাতায় আছে। নানান অসুবিধার মধ্যে সকলকে ছবি আঁকতে হয়েছে। মোটামুটি প্রদর্শনী ভালই হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের প্রচার দফতরের পক্ষ থেকে আরও কাজ করছি। poster আঁকছি । কিন্তু আমি যেভাবে কাজ করতে চাই তা এই পরিবেশে সম্ভব নয় । তোমাদের মাঝখানে যেতে পারলে খুব ভাল হত। অনেকেই তো গেল বিদেশ। শিল্পীদের মধ্যে কেউই যায়নি অথচ painting এর মধ্যে অনেক কিছু করার আছে । তাছাড়া লন্ডন এর মত জায়গায় গেলে বিভিন্ন মাধ্যমের কাজ সুযোগ পাওয়া যাবে ফলে painting এবং poster সবই করা সম্ভব। প্রচুর কাজ করার রয়েছে।
আমার মনে হয় তুমি আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেবের সাথে আলোচনা করে আমাকে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন করতে পারো। তোমাদের কাছে একবার যেতে পারলে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবো। তোমাদের পরিকল্পনার বিস্তারিত কিছুই জানিনা। আমার চিঠি পাওয়ার সাথে সাথেই তোমাদের পরিকল্পনার বিস্তারিত বিবরণ জানিও।

………… রোজী (আমাদেরমেয়ে) সুইজারল্যান্ডে আছে। … করাচী থেকে ওকে পালাতে হয়েছে। এখানে আসার পর আমেরিকা থেকে নেনুর চিঠি পেয়েছিলাম। সে কিছু একটা করতে চায় আমাকে নিয়ে গিয়ে। কিন্তু আমি প্রথমে তোমাদের কাছে যেতে চাই। তোমরা বাংলাদেশের সরকারের তরফ থেকে আমাকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলেই সুবিধা হবে বলে আমার মনে হয়, আমি বাংলাদেশ সরকারের সাথেই সংযুক্ত। তুমি আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা নিও। উত্তরের অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকবো ।

ইতি-
কামরুল ভাই
—————–
শাহরিয়ার কবির
৬৬/৬ গোরাখাবিশি আরডি
দামদাম, কল-২৮
টেল ৫৭৩৭৮
ভারত

এনাম ভাই ,
আপনার টেলিগ্রাম পেয়েছি। আপনার স্বাগত বার্তার জন্য ধন্যবাদ। আমি অত্যন্ত উদ্ধিগ্ন ছিলাম লন্ডনে কিভাবে প্রদশর্নীর আয়োজন সম্ভব। পুস্তক-পুস্তিকা অব্যশই আনছি। এ ছাড়া উভয় বাংলার শিল্পীদের আঁকা ছবি, পোষ্টার আলোকচিত্র ইত্যাদিও সঙ্গে থাকছে। জহির রায়হান ‘STOP’ নামে যে প্রামাণ্য চিত্রটি তুলছেন সেজন্য কদিন অপেক্ষা করছি। ওটাই সঙ্গে করে আনছি।
কিছু সরকারী অনুমোদনের ব্যাপারে আমাকে এ মাসের ২৩/২৪ তারিখ পর্যন্ত কোলকাতা থাকতে হচ্ছে। আপনি এ সময়ের ভেতর আপনাদের সোসাইটির পক্ষ থেকে আমাকে একটি আমন্ত্রণ লিপি পাঠান।
প্রদশর্নীর জন্য যে জিনিষগুলো অপরিহার্য তারও উল্লেখ করবেন। তাতে আমার ইউ-কের ভিসা পেতে সুবিধা হবে।
জাফর ভাই (সিকান্দার আবু জাফর) সম্প্রতি কোলকাতা এসেছেন। তার একটা বিবৃতি বাংলাদেশ সরকার পুস্তিকাকারে ছাপছে। ওটার ইংরেজিতে অনুবাদ করে আপনাদের পক্ষে কি ছাপানো সম্ভব হবে? বিবৃতিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রামাণ্য ,এতে কোন সন্দেহ নেই।
তিনি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মানের কথা ভাবছেন । একটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশের ইচ্ছাও তাঁর আছে। তবে আর্থিক কোন সাহায্য এখানে পাচ্ছেন না। আপনারা কি তাঁকে কোন সাহায্য করতে পারেন ? আপনার চিঠি অথবা ফোনের অপেক্ষা করছি।
শ্রদ্ধান্তে
শাহরিয়ার বাংলাদেশ গণ- সাংস্কৃতিক সমিতি
৫৯, সেমৌর ভবন, তেভিস্তক, লন্ডন
১৭ অক্টোবর, ১৯৭১
শাহরিয়ার কবির
৬৬/৬ গোরাখাবিশি আরডি
দামদাম, কল-২৮
টেল ৫৭৩৭৮
ভারত

প্রিয় জনাব শাহরিয়ার কবির,
আপনার ৮ই অক্টোবর ১৯৭১ পত্রের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
উপরন্ত, আমাদের তারের তারিখের ২৮শে সেপ্টেম্বর আমাদের প্রাথমিক চুক্তি ইঙ্গিত। আমি আপনার দ্বারা প্রস্তাবিত বাংলাদেশ গণ- সাংস্কৃতিক সমিতি লন্ডন পেইন্টিং, পোষ্টার, ফটোগ্রাফ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের থিমে তৈরি ছায়াছবি প্রদর্শনী আয়োজন করবে চ্যাট নিশ্চিত করতে লিখুন।
আমরা আপনাকে পরামর্শ দিতে চাই যে , চিত্রপ্রদর্শনী সহ আপনার এখানে আসা দরকার এবং এটা প্রয়োজন পরবে যে আপনার কয়েক সপ্তাহ এখানে থাকতে হবে। আমরা প্রশংসা করব, আপনি যদি আপনার সাথে নির্বাচিত বই ও পত্রিকা , কাব্যধর্মী কাজ এবং সাম্প্রতিক সময়ের নাটক নিয়ে আসেন।
আমরা আরও সুপারিশ করবে যে আপনি মেসার্স সিকান্দার আবু জাফর, কামরুল হাসান সাথে যোগাযোগ করবেন। জহির রায়হান ও আলমগীর কবির তাদের পরামর্শ এবং এই প্রকল্পে সহযোগিতার জন্য আমরা ইউ.কে. অনুরূপ কর্মসূচি আয়োজনের জন্য তাদের সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ করছি।

আপনাকে শীঘ্রই দেখার অপেক্ষায়। আপনার আন্তরিক এনামুল হক সভাপতি
তথ্য, প্রচার ও বেতারদপ্তর
গণপ্রজাতন্ত্রীবাংলাদেশসরকার
মুজিবনগর
আমার ঠিকানা-৭৫বি, লিন্টন স্ট্রিট
কলকাতা-১৪
২৬-১০-৭১

—————

স্নেহের এনামুল,
তোমার ১৩/১০ তারিখে লেখা চিঠিখানি আমি বেশ কয়েকদিন আগেই পেয়েছি। তোমার টেলিগ্রাম আমি পাই নাই। আশা করছি তোমার ভাবীর কাছ থেকেও এবার চিঠি পেয়ে যাবো। তোমার চিঠি পরে খুব বেশী আশ্চর্য হই নাই । আমিরুল, জহির বাকবীর কেউই তোমার কথা আমার কাছে এতটুকু ঈঙ্গিতেও জানায় নাই। একবার শুনেছিলাম জহির লন্ডন যাচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত যাওয়া হল না এর মূলে যে তোমার প্রচেষ্টা ছিল তা আমি জানতে পারি নাই। তোমার চিঠি পাওয়ার পর জহিরের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় নাই। সমস্ত পরিস্থিতি জেনেও মন শক্ত করে যেতে হবে।
ষ্ট্যাম্প প্রকাশ করার ব্যাপারে এমন একটা গোপন ভাব চলছিল যা আমার কাছে খুবই অস্বস্তিকর লাগছিল। স্টোন হাউসের সাথে আমারও একদিন আলাপ হয়েছিল, এখানে কিন্তু এসব সমদ্ধে কোন আলোচনাই ভদ্রলোক করেনি। আর বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষে যারা অবস্থিত তাদের সাংস্কৃতিক চিন্তা এবং রুচিবোধ তোমার কাছে অপরিচিত নয়; অতএব এ নিয়ে চিন্তা না করাই ভালো । বাংলাদেশের প্রতীক এবং পতাকা অবশ্য পরিবর্তনীয়। এসব পরে হবে ।
তোমার বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি প্যাডের মানচিত্রটিও খুব ভাল হয় নাই, তাই আমি মানচিত্রটি নতুন করে এঁকে পাঠালাম। ছেপে নিও। আমি আপাতত বাংলাদেশ সরকারের ডিজাইন বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছি। দেবদাস, নিতুন, নাসির, প্রাণেশমণ্ডল, এরা কাজ করছে। এর মধ্যে অনেকগুলি পোষ্টার তৈরী করেছি। ইংরেজিতেও হচ্ছে। তোমার কাছে পাঠাবো।

সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের প্রচুর কাজ করার রয়েছে। ‘সামরিক জুন্তা’ এবার বিশেষভাবে আমাদের মত লোকদের ভীষণ পোষণ করছে। এর অন্তনিহিত কারণ বুঝতে পারলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তাৎপর্যও বুঝতে পারত কর্তাব্যক্তিরা।
আমি, দেবদাস এবং জহির লন্ডনে পৌঁছতে পারলে আমাদের আন্দোলন জোরদার হবেই। বাংলার সাংস্কৃতিক রুপকি এবং দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ক্ষেত্রে তাঁর প্রবলতা যে কত খানি ছিল তা বোঝাবার সময় এসেছে। আজ কলকাতায় বসে বুজতে পারছি আমরাই আজ সত্যিকারের বাঙ্গালী। আমাদের সন্তান্নেরা আজঅগ্রগামী। পশ্চিম বাংলার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র মোটেই সংস্কারমুক্ত নয় এবং এখানকার হিন্দুরা আরও হিন্দু এবং মুসলমানরা আরও মুসলমান হয়ে বসে আছে। এখানকার পুরাতন ব্রতচারীরা আমাকে পেয়ে খুবই উৎসাহিত এবং সমস্ত দায়িত্ব আমার উপর দিতে চায়। তাহলে বুঝতেই পারছ এরা কোথায় গিয়ে পড়েছে। যাক সাক্ষাতে সব আলোচনা এবং কর্ম পন্থা বেছে নেওয়া যাবে।

আমি লিনোকাট করছি। উবায়েদ কলকাতায় আসছে কয়েক দিনের জন্য। তাঁর হাতে লিনোকাটের একটি সেই পাঠিয়ে দিয়ো। এখানে যে সেট পাওয়া গেছে তাতে ভালো কাজ হয়নি। আমি যাওয়ার সময় অন্ততঃ ২০/২৫ টিলিনো বাংলাদেশের ঘটনার উপর নিয়ে যেতে পারব।
এ ব্যাপারে উবায়েদকেও লিখেছি। রশীদের সাথে নিশ্চয় তোমার যোগাযোগ ঘটেছে। তাকেও চিঠি লিখতে বলবে।
আমেরিকা থেকে হেনুও আমাকে চিঠি দিয়েছিল। সেখানে গিয়ে Exhibition করার জন্য। আগে তোমাদের কাছে যাই, তারপর দেখা যাবে। যাক মোট কথা হতাশ হলে চলবেনা, তোমরা কবে পর্যন্ত টিকেট পাঠাতে পারবে জানিও।
আমি এখন থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার আয়োজন করছি।
আমি এবং বদরুল একসাথে আছি। নতুন ঠিকানাতেই যোগাযোগ করবে এবার থেকে।
জুলেখা এবং বাচ্চাদেরকে আমার স্নেহাশীষ দিও। তোমাদের কুশল কামনা করি।
ইতি
কামরুল ভাই
১৭ এ, পামএভিন্যু
কলকাতা-১৯
৫/২২/৭১
শ্রদ্ধেয় এনামুল হক সাহেব,
……… আমাদের প্রযোজিত গীতি-নকশা ‘বিবর্তনের ইতিকথা’ ও নাটক ‘রক্তপথ’ আপনাদের আগ্রহ সৃষ্টি করেছে জেনে আমরা আনন্দিত ও উৎসাহিত হয়েছি। আমি সমর দাস, নারায়ণ , ঘোষ ও সুভাস দত্তের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করেছি। টেপ করে উক্ত নাটক ও গীতি-নকশা পাঠান সম্ভব।

আমার মনে হয় সেই সাথে একটি ছোট্ট নায়ক-গায়িকার টিম ও দুজন পরিচালক গেলে ভাল হয়। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানালে বাধিত হব।

আশা করি আমাদের সোসাইটির কাজ ভালভাবে অগ্রসর হচ্ছে। সভ্যদের প্রীতি ও শুভেচ্ছা বলবেন।

_আবদুল জব্বার খাঁ
আহবায়ক, প্রোগ্রাম কমিটি,
বাংলাদেশ চলচিত্রশিল্পী ও কুশলী সমিতি।

৬৬/৬ গোরাখাবিশি আরডি
দামদাম, কল-২৮
টেল ৫৭৩৭৮
ভারত
১৩/১১/৭১
এনাম ভাই,
আপনার চিঠির জবাব অনেক আগেই দেয়া উচিত ছিলো। অনিবার্য কারণ বশত আমাকে বেশ কিছুদিন সীমান্ত এলাকায় কাটাতে হয়েছিল বলে লিখতে পারিনি। এ জন্যেআমি লজ্জিত। প্রদর্শনীর ব্যাপারে আপনাকে বিস্তারিত জানাচ্ছি।

এ প্রদর্শনীর জন্য আমি উভয় বাংলার শিল্পীদের আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছি। বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যারা কোলকাতায় এসেছেন এরা হচ্ছেন কামরুল হাসান-মোস্তফা মনোয়ার, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু ও প্রাণেশ মন্ডল। এ ছাড়া আছেন ধীরেন সোম , স্বপন চৌধুরী গিয়াসউদ্দিন, নাসিরউদ্দিন , শেখর , রঞ্জিত নিয়োগি এরা।
সব মিলিয়ে সতেরটা তৈলচিত্র (বেশবড়সাইজের) , চৌদ্দটা জলরং, ড্রইং এবং মিশ্র মাধ্যমের ছবি রয়েছে। ভারতীয় শিল্পীদের বাংলাদেশের উপরআঁকা গোটা চল্লিশেক ছবি রয়েছে। পোষ্টার তিরিশটা । আলোকচিত্র এখনো সংগ্রহ করছি। ৬০/৭০ টার মত সংগ্রহ করতে পারবো। আর বাংলাদেশের উপর যেসব বই (কবিতা, প্রবন্ধ) বেরিয়েছে, আনছি। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রচার পুস্তিকা তো রয়েছেই। কিছু রেকর্ড রেরিয়েছে বাংলাদেশের উপর। ওগুলো এবং আমাদের শিল্পীদের গানের টেপ আনছি। জহির রায়হানের প্রামান্যে চিত্রগুলি যদি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় আনবো ।
এবার আমি আপনার সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ন আলোচনা করতে চাই । এ প্রদর্শনীর ব্যাপারে আপনারা কতটা উৎসাহিত জানিনা। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহিত। বেসরকারীভাবে অবশ্য যতোখানি যম্ভব করবেন। আপনি চিঠিতে লিখছেন, সিকান্দার আবু জাফর এবং অন্যান্যদের সাথে আলাপ করার জন্যে আপনারাও এ ধরনের অনুষ্ঠান করতে আগ্রহী। আপনারা প্রত্যক্ষভাবে উদ্যেগী হলে আরো ব্যাপক আকারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ প্রদর্শনী হতে পারে।
প্রাথমিক পর্যায়ে আয়োজনের জন্য একটা ফান্ডের প্রয়োজন। আর্থিক স্বচ্ছন্দের ওপর প্রদর্শনীর স্বচ্ছল প্রদর্শন করছে। অবশ্য পরে প্রদর্শনীর ছবি এবং বিভিন্ন পুস্তক (যা প্রদর্শনী কতৃপক্ষ ছাপবে যা বিষয়বস্তু সঙ্গে করে আনছি) । বিক্রি করে প্রদর্শনীর টাকা তুলেও যথেষ্ট উদ্ধুত্ত থাকবে যা স্বচ্ছন্দে মুক্তি সংগ্রামের জন্য খরচ করা যেতে পারে। এ প্রদর্শনীর ব্যাপারে আমাদের মিশন যথেষ্ট আগ্রহশীল ।
আপনারা যদি এই প্রদর্শনীর গুরুত্ব উপলব্ধি করে এর সম্পূর্ণ ভার নিতে রাজি হন , এ চিঠি পাওয়া মাত্র লিখে জানাবেন। তাহলে সেভাবে ব্যবস্থা করবো। এ মাসের শেষ সপ্তাহে যাচ্ছি। জাফর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। আলমগীর কবির আপনার কোন চিঠি পাননি। জহির রায়হান বলেছেন ওকে চিঠি দিতে। জাফর ভাই আপনাকেখুব শীঘ্রই লিখেবেন। শ্রদ্ধা জানাবেন।
-শাহরিয়ার
—————————-

‘অভিযান’
বাংলাদেশ সাপ্তাহিক সংবাদপত্র, ঢাকা
সম্পাদকঃ শিকদার আবু জাফর
অস্থায়ীঠিকানাঃ
৮৪/৯, রিপন স্ট্রীট কলকাতা-১৬
২৪-১১-৭১
এনামুল,
……… ৬ সেপ্টেম্বর কলকাতায় আসার পর থেকে ক্রমানুগত অসুস্থ্য থাকছি (Acute Bronchitis Azthma)। …… এখানে একেবারে চুপ করে বসে না থেকে সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বের করেছি একখানা। কপি পাঠালাম। অন্যান্য সংখ্যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠাবো। তোমরা কাজে লাগিও এবং পত্রিকার জন্যে আগ্রহ ও অর্থসাহায্য সংগ্রহ করে পাঠিও।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত আমার অভিযোগ শীর্ষক বিবৃতি বাংলাদেশ সরকার প্রকাশ করেছেন। তাঁর দুকপিও তোমাকে পাঠালাম। প্রয়োজন মত ব্যবহার কর।
………… এখানকার সর্বাধুনিকহাসপাতালের শ্বাসবিশেষজ্ঞ আমাকে পরীক্ষা করে জানিয়েছেন। আমাকে কিছুটা সুস্থ্য করে তোলা সম্ভব। …… কিন্তু খরচ হবে কমপক্ষে দেড় হাজার টাকা। আপাতত সে টাকারব্যবস্থা নেই। অতএব , চিকিৎসার প্রশ্ন এখন আসেনা। কিন্তু সংগ্রাম চলবেই।
এসটি ক্রস কলেজ অক্সফোর্ড
পোস্টকোড অএক্সআই ৩টিইউ
টেলিফফোন ৪৩১৮২
২৫ অক্টোবর ১৯৭১
……… আমাদের পত্রিকার ব্যবহার করা সম্ভব এ রকম তথ্যাদি এবং পত্র-পত্রিকা যদি পাঠাতে খুবই উপকৃত হবো ……………

– সিকান্দার আবু জাফর
সেন্ট ক্রস কলেজ,অক্সফোর্ড
পোস্ট কোড – OXI3TU
টেলিফোন – ৪৩১৮২
২৫ অক্টোবর, ১৯৭১

ই হক স্কয়ার
৩৩,এবে রোড
অক্সফোর্ড

প্রিয় হক সাহেব
হাসান সাহেব(কামরুল হাসান) কে সাহায্য করার ব্যাপারে অধ্যাপক স্যার উইলিয়াম কোল্ডস্ট্রিম ব্রিটিশ কাউন্সিলের সাথে কথা বলেছেন। আমি যতটুকু দেখলাম তিনি প্রশ্নটা ঠিকভাবে উত্থাপন করতে পারেন নি দুর্ভাগ্যবশত,সম্ভবত তিনি ফিরতি টিকেটের জন্যে ৭০০পাউন্ড চেয়েছেন। প্রত্যুত্তরে ব্রিটিশ কাউন্সিল হাসান সাহেবের ইংল্যান্ডে আসার একটি সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে চেয়েছে,যেমন শিক্ষাবৃত্তি কিংবা এরকম কিছু। এরকম হলেও একজন পঞ্চাশোর্ধ মানুষকে এভাবে বিবেচনা করা উচিত হবে না।

দুঃসংবাদ হলেও আমার মনে হয় এখনই হতাশ হওয়ার মত কিছু হয় নি। ব্রিটিশ কাউন্সিল মি. উইলিয়াম কোল্ডস্ট্রিমের পরামর্শের কথা উল্লেখ করে জেরাল্ড ফোর্ট সাহেব কে লিখতে বলেছে। আমার মনে হয় সেটাই করা উচিত। পরের বার,হাসান সাহেবের টিকেট খরচ হিসেবে ২৫০ পাউন্ড এবং কয়েক মাসের খরচের কথা লিখবেন।
মি. জেরাল্ড ফোর্ট,ব্রিটিশ কাউন্সিল, ৩৭৩ ইউস্টন রোড,লন্ডন এন ডব্লিউ আই।
ইতি
ড.ডব্লিউ ই ফন হেইনিনজেন
——-
আলমগীর কবির
৪৯/৪,হিন্দুস্তান পার্ক,
কলকাতা -২৯
০৮- ০৮- ১৯৭১
প্রিয় হক সাহেব,
…..ড.মল্লিক এবং জহির সাহেব কলকাতার বাইতে থাকায় উত্তর দিতে দেরি হল। বিভাজনগুলোর কথা শুনে আমি আশ্চর্য হই নি। এদিককার পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাচ্ছে,তাই ঐক্য থাকা খুব দরকার।সর্বদলীয় জাতীয় স্বাধীনতা নামে একটি গুজব এদিকে শোনা যাচ্ছে। সুসংবাদ হল বাংলাদেশ যে কোন দিন স্বীকৃতি পাবে বলে আশা করছি যুদ্ধ খুব ভালোই এগোচ্ছে। দুটো পাক ডিভিশন একদম নির্মূল করে ফেলা হয়েছে। যুদ্ধের ধরণ দেখে বুঝা যাচ্ছে আমাদের পতনের হার খুব সামান্য সারা বাংলাদেশে এ হার ১৫০:১। কিন্তু সম্মুখ সমরে গেলে আমাদের পতনের হার বাড়তে পারে। এখন ৪০% এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে এবং পুরো এলাকাতেই আমরা অভিযান চালাতে পারছি। এমনকি রাতে আর্মিরা ক্যান্টনমেন্টে চলে গেলে ঢাকা শহরটাই আমাদের ছেলেদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। টিক্কা খান ও ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছে নৌবাহিনী যে কোন মুহূর্তে যুদ্ধে নামবে। বিমান বাহিনী ও ভারত স্বীকৃতি দেয়ার সাথে সাথে আক্রমণ করতে প্রস্তুত,ওদের সাথে আমাদের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ছেলেদের মনোবল চমৎকার, বরং সেক্টর কমান্ডারদেরই এদেরকে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফেরাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় এ মুহূর্তে এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক প্রচারণা এবং লবিংয়ের জন্যে আপনার প্রস্তাবনা আমি সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার খুবই ধীর এবং ড.মল্লিক কে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছে না। উনার ইংল্যান্ড সফরের ব্যাপারে আপনার তথ্য ভুল। আপনি একটা কাজ করতে পারেন – ড. মল্লিক এবং জহির রায়হানের জন্যে একটি করে দুটি টিকিট পাঠিয়ে দিন। পরে আমরা তাকে যে কোনোভাবে ভারতের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। এরপর তাকে ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকা পাঠাবেন।আশা করি, তিনি আবু সাঈদ চৌধুরীর চেয়েও এফিশিয়েন্ট হবেন।জহির ও যেতে রাজি আছে কিন্তু সিনেমার কাজ থাকায় যাত্রা বাতিল করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে,২১আগস্টের র্যালীর জন্যে আরেকজন প্রতিনিধি পাঠানো হবে। আমরা এখান থেকে জহির রায়হান কর্তৃক ইংরেজিতে নির্মিত একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ডকুমেন্টারি পাঠাব,যা ১৫ আগস্টের মধ্যে সম্পন্ন হবে। স্বাধীনতা পরিষদ ইতোমধ্যে ওয়াহিদুল হকের নেতৃত্বে একটি গানের দল গঠন করেছে। ওরা কয়েকটা জায়গায় অনুষ্ঠান করেছে এবং এটি দরকারি মনে হয়েছে। এখন ওরা মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পগুলো সফর করছে

শুভেচ্ছাসহ
আলমগীর কবির

ড.এনামুল হক
সভাপতি
বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সমাজ
৩৩,এবে রোড,অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য।