শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত বাংলাদেশের কবিগান | বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন (ল্যাংকারশায়ার ও পার্শ্ববর্তী এলাকা)প্রকাশিত পুস্তিকা | মে, ১৯৭১ |
বাংলার এ দুর্দিনে যার অপার উৎসাহে এই ক্ষুদ্র কবিগান লেখা সম্ভব হলো, তিনি আর কেউ নন- তিনি
আমার প্রতিবেশী ও পরম শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুবর মাস্টার এ. আজিজ। তারই সহযোগিতায় কবিগানটি উৎসর্গ করলাম রকেট যুগের অগ্নিপুরুষ, বঙ্গজননীর বীর সন্তান স্বাধীন বাংলার স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে…
“আমাকে বন্দি করো, আমাকে হত্যা করো-
এতে আমার দুঃখ নেই; কিন্তু আমার দেশবাসীর
উপর অত্যাচার কোরো না”। – মুজিব
বাংলাদেশের কবিগান
-কবি আবদুর রহমান খান রচিত
চিল শকুনে মানুষ খায় হায়রে সোনার বাংলায়
হুকুম দিল এহিয়ায় খুন করিতে।। (ধুয়া)
উনিশ সাত চল্লিশ সনে, হিন্দু আর মুসলমানে
সোনার ভারত স্বাধীন আনে বৃটিশ রাজ হতে
দুই ধর্ম দুই জাতি পাক-ভারত হলো স্থিতি
গেল ভাই বাংলার শক্তি দুই ভাগেতে।।
পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানে শাসন করে খান পাঠান
বাঙালিরা ভাই জানে ভাব ভক্তিতে
পূর্ব বাংলার ফল ফসল তাদেরে খাওয়াইয়া সকল
বাংলার মানুষ হলো দুর্বল এই জগতে।।
ধর্মের নামে জুয়া খেলা লুটলোরে সোনার বাংলা
তেইশ বছরের দুঃখ জ্বালা পারি না সহিতে,
কি বলিব দুঃখের কাহিনী দুই নয়নে ঝরে পানি
দেশে যত হয় আমদানী তাদের ভাগ্যেতে।।
পাট তামাক চা আমরা ফলাই, গো মহিষের খল
মোদের ভাগ্যে সকলেই ছাই খাই, তাদের হাতে
দুঃখের উপর দুঃখ ভারী, কড়াক্রান্তি হিসাব করি
দিতে হ’লে খাজনার কড়ি অফিস আদালতে।।
বলছি গত বন্যার কথা, হঠাৎ এল ঘূর্ণিবার্তা।
হারায়াছি ভগ্নি ভ্রাতা পারি না ভুলিতে,
হাতিয়া সন্দ্বীপের অধিবাসী একশ পঁচিশ হাজারের বেশি
জলের স্রোতে গেল ভাসি নদী নালাতে।।
ভোলা ও পতুয়াখালি হয়ে গেছে মানুষ খালি
মায়ে ছেলে গলাগলি ভাসা পানিতে
নোয়াখালী ও বরিশালের মানুষের লাশ খালে বিলে
মাংস খাইল কাক শৃগালে পাইলাম দেখিতে।।
মানুষ পশু সারি সারি ভাসল জলে মরি-মরি
সোনার বাংলার নরনারী কাঁদছে শোকেতে
ওদের কান্দনের সুর শুনল কি সরকার বাহাদুর
বল মোদের কিয়া কসুর চাই জানিতে।
ডুবল মাথের পাট ধান্য ঘরে নাই কারো মুষ্টি অন্ন
কি আছে বাঙালির জন্য জীবন রাখিতে
বাংলাদেশের কয়টি জেলা চিটাগাং ঢাকা কুমিল্লা
বারে বারে বন্যার ঠেলা আছে ভুগিতে।।
মনপুরাতে মরছে মানুষ আহারে বিনা হইয়া বেহুঁশ
পশ্চিমারা খায় কাঁঠাল কোষ ময়দার রুটিতে
বড় কষ্টে দিন কাটাই ডাইল ভাত খাইতে না পাই
তৈল বিনা জটারে লাগাই বঁধূর চুলেতে।।
ন্যায্য দাবী চাইলে মোরা বহে মোদের রক্তধারা
কারো হাতে শিকলকড়া ভরে জেলেতে
বাংলার যুবক বি-এ পাশ দেশে কাটে ঘোড়ার ঘাস
কেউ টানেরে মরা লাশ চৌকিদারিতে ।।
উনিশ আটান্ন সনে আইয়ূব বসেন সিংহাসনে
ইস্কান্দার মির্জা যায় বৃটেনে প্রাণের ভয়েতে
কামান গোলার ভয় দেখাইয়া রক্ত মোদের খায় চুষিয়া
বাংলার মানুষ চুপ করিয়া রইল ঘরেতে।।
শোনেন দেশের ইতিকথা দেশে আনল চেয়ারম্যান প্রথা
ভাঙ্গিল বাঙালির মাথা ভোট না দিতে
সংখ্যায় আমরা অনেক বেশি দুঃখের ভিতর ফুটে হাসি
বানাইতে চায় মানুষ ডাক্তারী মতে।।
শেরে বাংলা সুহরাওর্দী বাংলার শোকে কাঁদি কাঁদি
দুঃখ পাইল জন্মবধি অন্যায় শক্তিতে।
রেখে গেল প্রেমসিদ্ধুশেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু
জাগিল বাঙালি পঙ্গু তাহারে ডাকিতে।।
স্ট্রাইক হল কলেজ স্কুল ছাত্রছাত্রী তুলল রোল
বাঙালিরা আঁখি খোল সংগ্রাম চালাইতে
ভয় পেয়ে বীর আইয়ূব খানে এহিয়াকে ডেকে আনে
বসাইল নিজাসনে স্বার্থ রাখিতে।।
নেতা যেজন পিতা বটে হয় না নেতা বটে চটে
নেতা হয়ে গণভোটে স্বাধীন দেশেতে
হইল দেশে ভোটাভোটি বাঙালিরা সপ্তকোটি
ভোট দিয়াছে মানুষ খাঁটি মুজিবের হাতে।।
শেখ মুজিবের হ’ল জয় পাঞ্জাবি পাঠানের ভয়
বাংলার বুকে হ’ল উদয় চন্দ্র নিশিথে
মুজিব হবেন রাষ্ট্রশ্রেষ্ঠ পাঞ্জাবিদের মনে কষ্ট
কি ভাবে হয় শ্রেষ্ঠ নষ্ট ভাবে কমজাতে।।
কলকৌশলে তিন মাস গেল দুটি তারিখ বাতিল হল
বাংলার মানুষ জেগে উঠল বাঁচার দাবীতে
মোদের এত রোনাজারি দেখ এহিয়ার ছলচাতুরি
কারফিউ আইন জারি করি দলি ঢাকাতে।।
বঙ্গবন্ধু বললেন তবে এবার বাংলা স্বাধীন হবে
বাংলার মানুষ কাঁদবে কত পেটের ক্ষুধাতে
আছে হাড় নাই মাংস সব নিয়াছে রাবন কংস
হায়রে অসুরের ধ্বংস মানব সুরেতে।।
যখন ভুট্টো এহিয়া মিলে ঢাকায় যায় মিটিং- এর ছলে
আশায় ভাষায় কথা বলে শর্ত সন্ধিতে
পাঠান পাঞ্জাবি সত্তর হাজার বংগসাগর দিচ্ছেরে পারি
কেউ জানে না সংবাদটি তার বাংলার মাটিতে।।
ভুট্টো এহিয়া পাজি কথা বলে আজিবাজি
পৌঁছিল যাইয়া করাচি পশ্চিম দেশেতে
দেশে গিয়ে দিল ভাষণ শেখ মুজিব রাষ্ট্র দুশমন
সাত কোটি বাঙালির মন তখন জ্বলে গোস্যাতে।।
শেখ মুজিবের স্বপ্নধ্যান সাত কোটি বাঙালির প্রাণ
বৃদ্ধলোক হইয়াছে জোয়ান শত্রুনাশিতে
কেঁপে উঠে ঢাকার সিটি কেউ লইলরে হস্তে লাঠি
চায় ওরা শান্তি সৃষ্টি অশান্তি দেশেতে।।
তখন উঠল বাংলার জয় পতাকা চারিদিকে তার স্বর্ণমাখা
ভিতরে বঙ্গের চিত্র আঁকা বাংলা কালিতে
আহা কি বিচিত্র নিশান জানিয়া কোন কবির ধ্যান
এই নিশানের গাহিব গান বাঁচলে ধরাতে।।
চোরের মতন রাত বারটায় দুশমন সৈন্য গেল ঢাকায়
গান মেশিন ট্যাংক বন্দুক চালায় ঘুমের ঘরেতে
ঘরে ঘরে আগুন দিল ঢাকা শহর ছাই করিল
লক্ষাধিক মানুষ মরিল কামান গোলাতে।।
ভাংলো ঢাকার ইউনিভার্সিটি ছাত্র মারল কোটি কোটি
রাঙগা হোল ঢাকার মাটি মানুষের রক্তে
রোকেয়া ইকবাল হলে তিনদিন ভরা আগুন জ্বলে
নাশিল শিক্ষা সমূহে গোলাম বানাইতে।।
হাকিম মোক্তার ব্যারিস্টার প্রফেসার আর লেকচারার
মারে কত বিজ্ঞ ডাক্তার অগ্নি অস্ত্রেতে
হত্যাযজ্ঞ অবশেষে ছড়ে পড়ে সারা দেশে
শহর বন্দর ভরল লাশে চিটাগাংগেতে।।
বিদেশি সাংবাদিক যারা তাদেরে করিয়া তাড়া
মিটাইল সাধ পুরাপুরি মনের খুশিতে
হোস্টেল বোর্ডিং দিয়ে হানা চালাইল হায় জিনাকিনা
কবিতার ছন্দ চলে না এসব লিখিতে।।
হসপিটাল ফার্মেসি যত ভাঙল ঢাকায়ে শত শত
সৃষ্টি নতুন ইতিবৃত্ত বংগ ভূমিতে
রেডক্রস দিল ফিরাইয়া পাষাণ নিষ্ঠুর ইয়াহিয়া
গেল ভাই কারবালা হইয়া ঢাকার বুকেতে।।
যেমন এজিদ সীমার মারোয়ান, এহিয়া ভুট্টো টিক্কা খান
বধিত বাঙালি সন্তান নামল রণেতে
জয়নাল আবেদীন হবেই রাজা উড়াও স্বাধীন বঙ্গধ্বজা
ঠিক রাখ ভাই নামাজ রোজা ঈমানের সাথে।।
কচি কচি ছেলেমেয়ে বাধিল পাষাণ কোন হৃদয়ে
শিশুর লাগি কাঁদে মায়ে বসি রাস্তাতে
লক্ষ লক্ষ নরনারী চলে গেল গৃহ ছাড়ি
বনজঙ্গল পাড়ি দিয়া স্বাধীন ভারতে।।
ধন্যরে ভাই ভারতবাসী, তোরাই মোদের প্রতিবেশী
তোরাই ফুটাইলি হাসি- মায়ের মুখেতে,
থাকবো তোদের চিরঋণী, লিখবো ভাই ভারত কাহিনী
উঠবে যখন দিনমণি, ভাঙ্গা ঘরেহে।।
কুমিল্লার শ্রী ধীরেন দত্ত, গুলিতে হইলেন নিহত,
কাঁদছে মানুষ শত শত সারা বাংলাতে
শুটিং, লুটিং, বার্নিং, হত্যা বলবো কত মৃত্যুর কথা
নত নয় বাঙালির মাথা থাকবে উঁচুতে।।
রংপুরের মশিউর রহমান, হয়ে গেলেন শহীদ কুরবান
সিলেটে ফরিদ দেওয়ান অনেক মতে।
ছিল ওরা দেশের বাতি, থাকবে অমর ওদের খ্যাতি
ফিরে যদি বাংলার জ্যোতি, আল্লার কৃপাতে।।
সারা বঙ্গে পড়ল সাড়া, বুকটান করিয়া দাঁড়া
লড়তে হবে গুলি ভরা বন্দুকের সাথে।
বাংলার পুলিশ, ই পি আর, হেরি দুঃখ বঙ্গ মা’র,
রণ করিতে হ’ল তৈয়ার আনন্দ চিত্তে।।
রাখতে হবে বাংলা স্বাধীন, থাকলে ধরার আসমান জমিন
বলেছেন মন্ত্রী তাজউদ্দিন, বাংলা হতে,
মৌলানা ভাসানীর বাড়ী, উঠছেরে শহীদের ধ্বনি
বিলাইয়া দে জিন্দেগানী, আল্লার রাহেতে।।
ওরা দিল বীরের পরিচয়, জয় জয় বাংলা জয়,
শত্রুসৈন্যের পরাজয় রণ ক্ষেত্রেতে,
শত্রুসেনা রণ ছাড়ি, উঠল রে আকাশে উড়ি
প্লেন হতে বোমার ঝড়ি লাগে ফেলিতে।।
বাংলাদেশের জেলায় জেলায় কাপুরুষরা বোমা ফেলায়
কুষ্টিয়া ও চুয়াডাংগায় ভীষণ জোরেতে,
হায়রে মোদের অস্ত্র নাই, মরবে কি বাঙালি সিপাই
ভাই মরিলে কাঁদবেরে মায় পুত্র শোকেতে।।
দিনাজপুরে আবদুর রবে বীরত্ব দেখায় সগৌরবে
বঙ্গ মা তোর জয় হবে স্বাধীন জঙ্গেতে,
শ্রীহট্টে মেজর ওসমান, রাথিতে স্বাধীন জন্মস্থান
চালাইল যুদ্ধ অভিযান নানান জেলাতে।।
ইউনুস আলী চীপ এডভাইজার আরেক সন্তান বঙ্গ মা’র
পশ্চিম পাকিস্তানে হাজার হাজার আছেন বন্দীতে।
ওরা যদি থাকত মুক্ত, দেখতে মা তুই শত্রুর রক্ত
আদায় করত তোমার শর্ত ভীম পদাঘাতে।।
বোশেখ মাসের পাকা ধান, মাঠে মাঠে হইল বিরাট
কৃষক শ্রমিক লড়িতে যান, পাছে বৃদ্ধ পিতা হাঁকে
শত্রুমাররে লাখে শোভা নাই এতে।।
এই মতন হাজার ভাই সবার নাম জানা নাই
ওদের কাছে সালাম জানাই বিলাত হইতে,
নছিব মন্দ ঘরের বার, মোরা হেথায় আমি হাজার
পাইলাম ভাগ শহীদ সুধার কলির যুগেতে।।
যেথায় যত বঙ্গবাসী দেশের লাগি হও উদাসী
কে দোষী কে নির্দোষী দেখরে শেষেতে,
ছাড় হিংসা দলাদলি ঐক্য দাঁড়াও মাথা তুলি,
মাকে ডাক মা’ বলি আও একতাতে।।
মিনতি বিশ্বের মহাশক্তি, বাংলাদেশের চাই স্বীকৃতি
সাত কোটি মানুষের শান্তি, চাই কমনওয়েলথে,
শুন মা ইংল্যান্ডের রাণী, তোমার কাছে এই বাণী,
দাও ফিরাইয়া চিন্তামণি, সিরাজ বাংলাতে।।
গানটি আমার রক্তলেখা, উর্ধ্বে তোর জয় পতাকা,
মায়ের অঙ্গে রক্ত মাখা, বাংলা ভাষাতে।
বলছে কথা এ রহমান, এবার মোদের শেষ রক্তদান,
জয় বাংলার জয় গান, গাওরে খুশিতে।।
প্রকাশনায়ঃ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন (ল্যাংকারশায়ার ও পার্শ্ববর্তী এলাকা) ৩৩৬, স্টকপোর্ট রোড, ম্যানচেস্টার।
প্রকাশক কর্তৃক সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত।
লেখক বৃটেনে কর্মরত একজন সাধারণ শ্রমিক। ১৯৭১ সনের ৮ মে ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত জনসভায় গানটি পরিবেশিত হয়। এই সভায় আবু সাঈদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।