You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সুত্র তারিখ
এক ইউনিট প্রশ্নে বিতর্ক পাকিস্তান গণপরিষদ আগষ্ট-সেপ্টেম্বর, ১৯৫৫

 

২৫ আগস্ট, ১৯৫৫ তারিখে পাকিস্তানে গঠিত পরিষদে শেখ মুজিবুর রহমানের ০১১ এক ইউনিট বিল নিয়ে দেয়া বক্তব্যের উদ্ধৃতাংশ

… জনাব, আপনি দেখতে পাবেন যে তারা “পূর্ব বাংলা” এর জায়গায় “পূর্ব পাকিস্তান” বসাতে চায়। আমরা বহুবার দাবী করেছি যে আপনাদের এটা “বাংলা” (পাকিস্তান) করা উচিত। “বাংলা” শব্দটার একটা ইতিহাস, একতা নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। শুধুমাত্র জনগণের সাথে পরামর্শ করার পরেই আপনি এটা বদলাতে পারেন। আপনি যদি এটা পাল্টাতে চান তবে আমাদের বাংলায় ফিরে যেতে হবে এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে যে তারা এটা মেনে নিবে কিনা। “এক প্রদেশ” (ওয়ান ইউনিট) এর ব্যাপারটা সংবিধানে আসতে পারে। আপনারা কেন সেটা এখনই কার্যকর করতে চান? রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যাপারে কি হবে? যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর কি হবে? স্বায়ত্তশাসনের কি হবে? পূর্ব বাংলার জনগন “এক প্রদেশ” মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত হবে যখন এই ব্যাপারগুলা কার্যকর হবে। তাই আমি আমার ওই পক্ষের বন্ধুদের কাছে আবেদন করব, তারা যেন জনগনকে তাদের রায় দেয়ার সুযোগ করে দেন, সেটা বাধ্যতামূলক গণভোট হিসেবে হোক অথবা সাধারণ গণভোট হিসেবে। সীমান্তবর্তী মানুষদের বলতে দিন যে তারা এক প্রদেশ (ওয়ান ইউনিট) চায়। এই মুহূর্তে তারা বলছেন তারা এটার বিপক্ষে, কিন্তু অন্য দিন ডঃ খান সাহেব বললেন যে জনগন এক প্রদেশের পক্ষে, কিন্তু তার ভাই খান আব্দুল গাফফার খান এবং মানকি শরীফের পীর সাহেব বললেন যে তারা এটার বিপক্ষে। এখন তাহলে কে এটা বিচার করবে? কার হওয়া উচিত বিচারক? যদি সীমান্তবর্তী জনগণ বলে যে তারা এক প্রদেশের পক্ষে, তাহলে আমাদের তাতে কোন আপত্তি নেই। একইভাবে সিন্ধুতে, জনাব খুহরো বলেন যে তারা এর পক্ষে, অন্যদিকে জনাব জি.এম. সৈয়দ এবং অন্যান্যরা বলেন জনগণ এক প্রদেশের বিপক্ষে। ঠিক আছে, তারা যদি পক্ষেই থাকেন তাহলে একটা গনভোটের আয়োজন করা হোক। জনগণকে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদেরই নিতে দিন এবং আমরা সেটা মেনে নিব।
করাচীর ব্যাপারে বলতে গেলে, করাচীতে কোন গণভোট হওয়া উচিত নয় কারণ করাচী কায়েদ-ই-আজমের বানানো যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজধানী এবং কায়েদ-ই-আজম ও মরহুম জনাব লিয়াকত আলী খানের কোন ধরণের অপমান আমরা জনগণকে করতে দেব না। করাচী এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিকট থেকে করাচীকে নিয়ে যাওয়ার কোন অধিকার আমাদের নাই। এটা যেমন আমাদের তেমনি পাকিস্তানের অন্যান্য অংশেরও। এর উন্নয়নের জন্য আমরা কত অর্থ ব্যয় করেছি। তাহলে কেন আপনারা আরেকটি রাজধানী বানাতে চান এবং শত শত হাজার হাজার রুপী ব্যয় করতে চান এবং যার জন্য আপনার কমপক্ষে আরো ৫০ বছর প্রয়োজন হবে।
এইসব কারণে, আমি আমার বন্ধুদের কাছে আবেদন জানাই “জুলুম মাত কারো ভাই” (এত নির্দয় হবেন না)। আপনারা যদি আমাদের উপর এটা চাপিয়ে দেন তাহলে আমাদের অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করতে হবে। আপনাদের সাংবিধানিকভাবে আগানো উচিত। আপনি যদি জনগণকে সাংবিধানিক পন্থা অনুসরণ করতে না দেন, তারা তখন অসাংবিধানিক পন্থাই বেছে নিতে বাধ্য হবে। এটাই সারা বিশ্বে হয়ে এসেছে এবং ইতিহাস ঘাঁটলেই এর দেখা মিলবে। তাই তাদের কাছে আমার আবেদন, যদি আপনারা পাকিস্তানকে ভালোবাসেনঃ যদিও দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তান অর্জনের পর, আপনারা এর কাণ্ডারি হয়ে বসে আছেন এবং যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য লড়েছিলেন তাদের কেউ আর আমাদের মাঝে নেই।
তাই, আমি আপনাদের কাছে আবেদন করব, যদিও আপনাদের কাছে ক্ষমতা আছে, তাও পাকিস্তানের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, মানবতার স্বার্থে, কায়েদ-ই-আজমের স্বার্থে, জনগণের কাছে যান এবং তাদের মত দেয়ার সুযোগ দিন এবং আমরা সেটা মেনে নিব।
২৬ আগস্ট, ১৯৫৫

মিঁয়া মুমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা (পাঞ্জাবঃ মুসলিম)……… জনাব, এখানে আরেকটি বিষয় রয়েছে যা নিয়ে বলতে আমি সত্যিই দ্বিধাবোধ করছি। ইহা একটি ন্যায়ভ্রষ্ট এবং বিদ্বেষপরায়ণ বিতর্ক, ইহা এমন একটি বিতর্ক যে, পশ্চিম পাকিস্তানের একত্রীকরণ বাংলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরুপ। এখন জনাব, আমি মনে করি, এটা ছিল কিছু অস্পষ্ট ধারনা, এমন কিছু বিভ্রান্ত আশঙ্কার সংশয় যা আমার প্রিয় বন্ধু, জনাব ফজলুর রহমানের উপস্থাপিত কৌতুহল উদ্দিপক বাকবিতন্ডার উদ্রেক করেছে। জনাব ফজলুর রহমানের গণিত, বিশেষত একটি বিশেষ ধরনের গনিত যা আমি আমার বিদ্যালয়ে শিখি নাই। তিনি বলেছেন, আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান চাই তাহলে তা একক সরকারের মাধ্যমে অর্জন করা যায় অথবা আপনি এটা একই ভাবে এগারোটি ভাগে বিভক্ত পাকিস্তানের মাধ্যমে পেতে পারেন কিন্তু যদি শুধুমাত্র দুই ভাগে ভাগ করা হয় তাহলে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে, বিপর্যস্ত ও খন্ডিত হয়ে পড়বে। জনাব, এই ব্যাপারটাই আমি ঠিকমত বুঝে উঠতে পারলাম না। কিন্তু আমি মনে করি উনার মনের গভীরে এমন একটি ভয় রয়েছে যে; বাংলা একটি অবিভক্ত প্রদেশ, এখন পশ্চিম পাকিস্তানের একত্রিকরণের মধ্যে আমাদের হয়ে লড়াই করার, একটি ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত একক প্রদেশের বিরুদ্ধে অন্য প্রদেশকে পরিচালিত করার কোনো অভিসন্ধি, কোন ইচ্ছা রয়েছে। জনাব, আপনি যদি এই বিষয় গুলোর ভিত্তিতে চিন্তা করতে শুরু করেন, তো এর কোনো শেষ নেই। কিন্তু, জনাব, অত্যন্ত সততার সাথে আমি বলতে পারি যে, অন্য সবকিছুর আগে একক প্রদেশের প্রতিষ্ঠা বাংলার প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের জাতীয় দাবি পূরণের জন্য একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ। এর অন্য অনেক সুবিধা রয়েছে, কিন্তু একজন রাজনীতিকের কাছে, বিশেষ করে এই নির্বাচন পরিষদের সদস্যদের কাছে হয়ত এটাই সবচেয়ে বড় সুবিধা, সম্ভবত সবচেয়ে খুশির বিষয় এটাই হবে যে, এর ফলে আমরা সংবিধান গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব যাতে বাংলার মানুষের দাবী এবং ইচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন থাকবে। অতএব জনাব, আমাদের বাংলার সদস্যদের এই ব্যপারটা বুঝতে হবে যে, একটি প্রদেশের উন্নতি মানে পুরো অংশের উন্নতি। যদি একটি প্রদেশ ধ্বংস হয়ে যায়, যদি একটি প্রদেশে ভয়াবহ অশান্তি থাকে, যদি একটি প্রদেশ সর্বদা বিবাদে জর্জরিত থাকে, যদি একটি প্রদেশ বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি ও ক্ষয়ের কারণে ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে এর প্রভাব বাংলার শক্তি ও সঙ্গহতির উপরও পড়বে। আমি আপনাকে আস্থার সাথে বলতে পারি, জনাব যদি পশ্চিম পাকিস্তানের একত্রীকরণ পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে আরো সমৃদ্ধ করে, যদি এটা আমাদেরকে আমাদের পুঁজি ঠিক মত কাজে লাগাতে আরো বেশি সমর্থ করে তোলে, তাহলে যে সম্পদ ও শক্তি অর্জিত হবে তা বাংলারই সম্পদ ও শক্তি হয়ে দাঁড়াবে। আমি আমার বাঙালি ভাইদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমরা সবাই যখন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করি তখন আমরা তাদেরও আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চিন্তা করি। প্রকৃতপক্ষে আমি মনে করি, আমরা যারা পশ্চিম পাকিস্তানে থাকি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো একই নয়, আমরা হয়তো প্রাদেশিক, সঙ্কীর্ণ এবং জাতিগত ঈর্ষার উর্ব্ধে উঠতে পারব না, এবং সত্যি বলতে, আমরা বাংলার মানুষের দিকে তাকিয়ে আছি যারা আরো উদার দৃষ্টিভঙ্গির উদাহরণ স্থাপন করতে পারে যা দূরে থাকা সত্ত্বেও সহানুভূতির সাথে যেকোন সমস্যা সমাধান করার মানসিকতা থেকে আসে এবং আমি বিশ্বাস করি যে অতি শীঘ্রই পশ্চিম পাকিস্তানের একত্রীকরণ পশ্চিম পাকিস্তানের পাশাপাশি বাংলার মানুষেরও জাতীয় দাবিতে পরিণত হবে।

৩১শে আগষ্ট, ১৯৯৫

জনাব আব্দুল মন্সুর আহমেদ : পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনেও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। আপনার মনে আছে স্যার যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সকল দিক থেকে সমতার মূলনীতি মেনে নিয়েছিলো। এটা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য একটা বড় ছাড় ছিল কেননা তারাই আসলে সংখ্যা গরিষ্ঠ আর তারা এই সংখ্যা গরিষ্ঠতা আরও ২-৩ দশক ধরে রাখতে পারবে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে একটা সংশয় দেখা দিয়েছিলো যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণেরা তাদের সংখ্যা গরিষ্ঠতার বলে বিভিন্ন দিক থেকে তাদের অবদমিত করে রাখতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতাদের অদূরদর্শী মূলনীতির কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ এমনকি তাদের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও এই সংশয়টা আরও তীব্র হতে থাকে। তাদের জনগণ এমনকি তাদের নেতাদের মনে এই সংশয়টা তীব্র হচ্ছিলো যা তাদের আচরণের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছিলো যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের বিভিন্ন দিক থেকে অবদমিত করে রাখতে চাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ তথা তাদের নেতাদের এই সংশয় দূর করার জন্য আমরা পূর্ব পাকিস্তানীরা কিছু অকুন্ঠ প্রস্তাব এনেছিঃ আপনারা যদি চান আমরা সমতা মেনে নেই , তাহলে আমরা সেটা মেনে নিচ্ছি ,আমরা কখনোই আমাদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা দিয়ে তাদের অবদমিত করে রাখতে চাইনি, স্যার যখন আমরা সমতা মেনে নিয়েছি, আমরা ধারণা করেছিলাম যে এটা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ আর তাদের নেতাদের সত্যিকার দাবী যে আমাদের সব দিক থেকে সমতা মেনে নেওয়া উচিৎ। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের মনের এই যে অবদমিত করে রাখার সংশয়, এটা দূর করতে চাই। এটাই আমাদেরকে সমতা মেনে নিতে উৎসাহিত করেছে। এখন এই সভায় ৮০ জনের মধ্যে আমরা ৪০ জন। আগে ও আমাদের ৪৪ জন ছিল ৭৪ জনের মধ্যে। আমরা আমাদের একাধিপত্য ছেড়ে দিয়েছিলাম এই জন্য যে আমরা দেখাতে চেয়েছিলাম আমরা তাদের দাবায় রাখতে চাইনা। কিন্তু স্যার, আমাদের পাঞ্জাবী ভাইয়েরা প্রথম এই সুযোগটি পেয়েই কি করলো ? তারা যা করেছিলো তা হলো, সব ধরনের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করল, সব ধরনের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম কানুনের ইতি টেনেছিল, এখন তারা রাষ্ট্রের বড়বড় ২টি পদই পকেটে পুরে রেখেছে……………। স্যার, আমি শুধু এতো টুকুই ইঙ্গিত করতে চাই যে কি ভাবে জনগণের মনে এই সংশয়ের উদয় হল। এটা তাদের মনে এসেছে এই জন্যই যে তারা এই নীতিটি খুব তড়িঘড়ি আর বিশৃঙ্খল ভাবে শেষ করেছে। স্যার, তারা বলেছে যে কারা এটার পিছনে আছে? সকল জনগণ এটার পিছনে আছে এবং জনগণ কেউই চায়না যে এই নীতির বাস্তবায়ন হোক। তারা কেন সল্প সময়ের মধ্যে জনসভা করে না, আমি আমাদের মারীর শুভানুধ্যায়ী নেতা ডঃ খান সাহেবকে বলছি, আপনি আপনার নিজ অঙ্গরাজ্যে যান , সেখানে জনসভা করেন, আমি জানি তিনি জনগণকে ভয় পান না; তিনি একজন সাবেক সৈনিক নেতা আর তার রাজ্যের জনগণের খুবই পছন্দের মানুষ…………………। আমি খুবই খুশি যে ডঃ খান সাহেব আমার এই বক্তব্যের মর্ম বুঝেতে পারছেন আর তার জনগণকে বলছেন, কিন্তু আমাদের অন্য মন্ত্রীর “গদি” কুক্ষিগত করে রাখা নেতার, যেমন আমাদের মাননীয় সরদার আমীর আযম খান যিনি এই নীতিটি পরিচালনা করছেন, তিনিও না নিজের রাজ্যে যান, না তার এলাকায় কোন জনসভা করেন…………………
স্যার, আমি ইতমধ্যেই বলেছি পূর্ব বাংলার জনগণের মনে করাচির শাসন ব্যবস্থা দেখে কেন সংশয় তৈরি হয়েছে। আমরা সম্প্রতিকালে দেখেছি ক্ষমতা সমবণ্টন আর সমতার নামে কি ভাবে আমাদের বাংলার জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করা হয়েছে, কিভাবে গত আট বছর ধরে পাকিস্থানে গড়ে ওঠা দুই প্রদেশের গভর্নর জেনারেল আর প্রধান মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়ার ইতবাচক রীতিনীতিকে প্রথম সুযোগেই ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে স্যার, আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাথায় যা গেঁথে গেছে সেগুলো ছাড়াও আবারো বলছি স্যার, করাচী তাদের হাত থেকে চলে গেছে আর সেটা ন্যাস্ত হয়ছে পশ্চিম পাকিস্তানদের হাতে……………।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!