শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কর্তব্য সম্পর্কে পার্টি সার্কুলার | বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি | ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
পার্টি সার্কুলার
(পার্টি সভ্য, কর্মী ও দরদীদের জন্য)
মুক্তিযুদ্ধের নতুন অধ্যায় ও আমাদের করণীয়
আট মাসের কঠোর ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আজ সাফল্যের দ্বারে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। যে নর-পিশাচের দল বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ হত্যা করিয়া, অগণিত অসহায় নারীর মান-সম্মান বিনষ্ট করিয়া এবং এক কোটি নিরপরাধ লোককে দেশ ছাড়া করিয়া বীরত্বের পয়াকাষ্ঠা দেখাইয়াছিল তাহারা আজ মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় যৌথ দুর্বার আক্রমণের সম্মুখে প্রাণভয়ে পলায়ন করিতেছে। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ইতিমধ্যেই মুক্ত হইয়াছে এবং আশা করা যায় রাজধানী ঢাকাতে শীঘ্রই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হইবে।
ভারতের উপর আগ্রাসী আক্রমণ
সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল ইয়াহিয়া সরকারের সেনাবাহিনীর গণহত্যা, গ্রামে গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, নারীধর্ষণ প্রভৃতি বর্বর অত্যাচার চালাইয়া মুক্তিসংগ্রামকে রক্তের বন্যায় ডুবাইয়া দিতে চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু তা সম্পূর্ণ ব্যার্থ হইয়াছে। জনগণের ইয়াহিয়া-চক্রবিরোধী লৌহদৃঢ় ঐক্য, দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রামের প্রতি ভারতের জনগণের আকুণ্ঠ সমর্থন, ভারত সরকারের সাহায্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ এবং দুনিয়ার প্রগতিশীল জনগণের সহানুভূতির ফলে ইয়াহিয়া সরকারের চক্রান্ত প্রথম ধাপেই বানচাল হইয়া গিয়াছে। দুর্জয় মুক্তিবাহিনীর নিকট পর্যদুস্ত হইয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ইয়াহিয়া খান পাক-ভারতের মধ্যে যুদ্ধ হিসেবে চিত্রিত করিয়া সাম্রাজ্যবাদী দোসরদের হস্তক্ষেপের ষড়যন্ত্র করিতে থাকে।
গত ৩রা ডিসেম্বর অতর্কিতে ভারতের উপর পাকিস্তানের বিমান আক্রমণ এবং ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা ঐ ষড়যন্ত্রেরই অঙ্গ। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এই আক্রমণ প্রকৃতপক্ষে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধেই আক্রমণ।
বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী
বর্তমান অবস্থায় গত ৬ই ডিসেম্বর ভারত সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকারের স্বীকৃতি একটি সময়োচিত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আমরা এ জন্য ভারতের জনগণ ও ভারত সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছি। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতির ফলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী ও চীনের সাহায্যপুষ্ট পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিবাহিনী ও ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ন্যায্য লড়াই ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালিত হওয়ার ভিত্তি রচিত হইয়াছে।
ভারত সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতিদানের পর আমাদের মুক্তিবাহিনী ও ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনী একযোগে মিত্রবাহিনী হিসেবে সাধারণ শত্রু ইয়াহিয়া-চক্রের বিরুদ্ধে লড়াই করিতেছে। এই সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর দুর্বার আক্রমণের সামনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁহাদের বহু ঘাঁটি ছাড়িয়া প্রাণভয়ে পলায়ন করিতেছে। বাংলাদেশের বহু অঞ্চল মুক্ত হইয়াছে এবং আশা করা যায়, শীঘ্রই বাংলাদেশ পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করিবে। আমরা আজ স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হইয়াছি।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা এবং পার্টির কর্মীরা যে যেখানে আছেন, উক্ত মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সহুযোগিতা করিয়া কাজ করিবেন যাহাতে পাকবাহিনী তাড়াতাড়ি বিধ্বস্ত হইয়া আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়। ইহা আমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, যদিও ভারতীয় সৈন্যবাহিনী একটি বিদেশী রাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনী, তবুও এই বাহিনী বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সাহায্যে আগাইয়া আসিয়াছেন এবং পাকবাহিনীর সহিত সম্মুখরণে রক্তও ঢালিতেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থেই এই বাহিনীকে সর্বতভাবে সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য এবং এই কাজে জনগণকে উৎসাহিত করিতে হইবে। বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক ও মৈত্রী ঘনিষ্টতর করিয়া আমাদের দেশের উপর প্রতিক্রিয়া ও সাম্রাজ্যবাদীদের হস্তক্ষেপের পথ রুদ্ধ করিতে সাহায্য করিবে।
মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েতের অবদান
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যে মহান সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে আগাইয়া আসিয়াছে, তাহা অতুলনীয়। ২৫ শে মার্চ তারিখে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া-চক্রের গণহত্যা প্রভৃতি শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরেই দুনিয়ার বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির ভিতর একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদনগি গণহত্যাড় তীব্র নিন্দা করেন এবং সে নির্যাতন বন্ধ, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, তাঁহার হাতে ক্ষমতা অর্পণ ও বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে একটা সন্তোষজনক রাজনৈতিক মীমাংসা করার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করেন। তখন হইতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ সম্পর্কে ঐ সমর্থন সূচক নীতি দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করিয়াছে। এই নীতির ভিত্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে নিজ দেশের জনগণকে সমাবেশ করিয়াছেন এবং বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে দুনিয়াতে একটি প্রবল জনমতও সৃষ্টি করিয়াছেন।
ইয়াহিয়া খান যখন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিতেছিল তখনই সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই মুক্তি সারা এশিয়াতে শান্তির একটা দৃঢ় রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করিতেছে। উপরন্তু, ইহার ফলে ও বাংলাদেশ প্রশ্নে সোভিয়েতের সমর্থন নীতি হেতু ভারত সরকারও ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী নীতি গ্রহণ করিতে আরও অনুপ্রাণিত ও উতসাহিত হইয়াছেন।
সম্প্রতি পাক-ভারত যুদ্ধ বাধিবার পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ও চীনের মাওবাদী নেতৃত্ব ইয়াহিয়ার পাশে দাঁড়াইয়া নিরাপত্তা পরিষদের মারফত বাংলাদেশ ও এই উপমহাদেশে হস্তক্ষেপ করার চক্রান্ত করে। ইহাতে আমাদের মুক্তির সংগেয়ামের সামনে একটা সংকট উপস্থিত হয়। সেই সংকট সময়ে সোভিএত ইউনিয়নই নিরাপত্তা পরিষদে তাহার ভেটো প্রয়োগ করিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনের মাওবাদী নেতৃত্বের চক্রান্ত ব্যর্থ করিয়া দেয় এবং আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সাফল্যে বিরাট অবদান রাখে।
বস্তুতঃ সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমাবধি ইয়াহিয়া-চক্রের বর্বর অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে দাঁড়াইয়াছে এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আমাদের মুক্তি সংগ্রকামকে প্রভূত সাহায্য করিয়াছে ও করিতেছে। দুনিয়ার নীপিড়িত জাতি সমূহ ও জনগণের ন্যায্য অধিকারের সংগ্রামকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়ার যে নীতি সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবরই অনুসরণ করিয়াছে, সেই প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকভাবে নীতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকিয়াই সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে দাঁড়াইয়াছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু। সোভিয়েতের সাহায্য ও সমর্থনই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি।
আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ নাই
কিন্তু আমাদিগকে আত্মসন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। সাম্রাজ্যবাদীরা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের উপর তাহাদের কব্জি শিথিল হইয়া যাওয়ার আশঙ্কায় উন্মাদের মত আচরণ করিতেছে। ইয়াহিয়া-চক্রের ব্যাপক নরহত্যা এবং নানা পাশবিক অত্যাচারের কথা বেমালুম চাপিয়া গিয়া সাম্রাজ্যবাদীরা এখন ভারতকেই আক্রমণকারী বলিয়া অবিহিত করিতেছে এবং বশংবদ ইয়াহিয়া সরকারকে টিকাইয়া রাখার জন্য পথ খুঁজিতেছে। এ জন্য তাহারা সম্ভবপর হইলে যে কোন ঘৃণ্য পদ্ধতি গ্রহণ করিতে পারে, এমন কি খোলাখুলি হস্তক্ষেপ করিতেও দ্বিধা না করিতে পারে। অন্যদিকে চীনের নেতৃত্ব মার্কসবাদ- লেনিনবাদের পথ হইতে বিচ্যুত হইয়া এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং সুবিধাভোগী নীতি অনুসরণ করিয়া প্রতিক্রিয়াশীল ইয়াহিয়া সরকারকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন জানাইতেছে, বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের বিরুদ্ধাচরণ করিইতেছে এবং ভারত সরকারকে আক্রমণকারী আখ্যা দিয়া নানা প্রকার হুমকি দিতেছে। জাতিসংঘ চীন বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সকল চক্রান্তের প্রতি সমর্থন দিতেছে। তাই, এইরূপ একটি আশঙ্কাও দেখা দিয়াছে যে, অন্ধ সোভিয়েত বিরোধিতা হইতে চীন-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সহিত সোভিয়েত বিরোধী তথা সমাজতন্ত্রবিরোধী চক্রান্তে শামিল হইয়া চীন-সোভিয়েত সংঘর্ষ সৃষ্টি করিতে পারে। এমন আশঙ্কা আছে যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের ও চীনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ হইলে বাংলাদেশ প্রশ্নকে ভিত্তি করিয়া বাংলাদেশের বুকে এমন কি সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে এক প্রলংকারী যুদ্ধের সৃষ্টি হইতে পারে এবং আমাদের মুক্তি সংগ্রাম ব্যাহত হইতে পারে।
আমাদিগকে এই বিপদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকিতে হইবে এবং সকল প্রকার অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে।
সাম্রাজ্যবাদীদের ও চীনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত সৃষ্টি করিতে হইবে এবং মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধকে তীব্রতর করিয়া দ্রুত অর্জন করিতে হইবে।
সাফল্যের পথে মুক্তিযুদ্ধ
যদি বাহিরের কোন হস্তক্ষেপ না হয়, তবে বর্তমানে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হইয়াছে, যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত সাফল্য অর্জন করিতে পারে। এই সম্ভাবনার দিকে দৃষ্টি রাখিয়াই আমাদের পার্টির বর্তমান করণীয়গুলি স্থির করিতে হইবে।
করণীয়ঃ
(১) আজ আমাদের স্বাধীনতা সংগাম সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে আসিয়া পৌছিয়াছে। ইহা উপলব্ধি করিয়া মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা বাহিনীতে আমাদের কর্মী ও সমর্থকগণ সুদৃঢ় সক্রিয় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করুন। যাহাতে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিপূর্ণ বিজয় ত্বরান্বিত হয়। বলাবাহুল্য যে, আমাদের কর্মী ও সমর্থকগণ মুক্তিবাহিণি ও মিত্রবাহিনীর সাধারণ কার্যক্রম মানিয়া নিয়া তাহাদের সঙ্গে সহযোগিতা করিয়া সংগ্রাম পরিচালনা করিবন।
(২) মুক্রিযুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজয় ত্বরান্বিত করা ও অন্যান্য কর্তব্য সম্পর্কে আজ দেশবাসীকে সচেতন, সংগঠিত এবং সক্রিয় করা এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ হিসেবে দেখা দিয়াছে। আমাদের পার্টির যেসব কর্মী ও সমর্থক দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়াইয়া আছে, তাহাদের কর্তব্য হইবে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জনগণকে সক্রিয় করিয়া তুলিতে চেষ্টা করা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যাহাতে জনগণ পরিপূর্ণ সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্বমূলক আচরণ করে তাহার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করিতে হইবে। যে সমস্ত পার্টি সভ্য ও কর্মী প্রবাসে চলিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছেন, তাহারাও অবিলম্বে স্ব স্ব জেলা কমিটির পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরিয়া আসিতে শুরু করিবেন এবং সেখানে গিয়া উপরোক্ত কাজগুলি শুরু করিয়া দিবেন।
(৩) মুক্তিযুদ্ধকে দ্রুত সাফল্যমন্ডিত করা ও আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে একটি পরিপূর্ণ স্বাধীন, সমৃদ্ধাশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়িয়া তোলার জন্য পার্টিও সমস্ত সদস্য, কর্মী ও সমর্থকগণ প্রতিনিয়ত জনতার স্বার্থে কাজ করিয়া যাইবেন এবং পার্টির নীতি ও কর্মসূচী জনগণের মধ্যে অবিরত প্রচার করিবেন।
(৪) যেসব অঞ্চল মুক্ত হইয়াছে বা হইতেছে সেসব অঞ্চলের গ্রামে, ইউনিয়নে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দলমতের প্রতিনিধিদের লইয়া সর্বদলীয় গণকমিটি (People’s committee) গঠন করার চেষ্টা করিতে হইবে। এই কমিটির উপরেই সেই অঞ্চলের প্রশাসনিক ক্কাজের দায়িত্ব যাহাতে দেওয়া হয়, সে জন্য চেষ্টা করিতে হইবে।
(৫) প্রতিটি মুক্ত অঞ্চল অন্যতম সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হইল আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। ইহা করতেই হইবে। জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সমস্ত জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধান করিতে হইবে। অবাঙ্গালীবিরোধী বা কোন প্রকার দাঙ্গা-হাঙ্গামা যাহাতে না হয় তার জন্য যথাসাধ্য ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।
(৬) মুক্ত এলাকাইয় খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদির সুষ্ঠ বিতরণের ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করিতে হইবে। জনগণের উপর কোন জোর-জুলুম করা চলিবে না। স্কুল, কলেজ, হাটবাজার প্রভৃতি আবার চালু করিয়া তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরাইয়া আনার চেষ্টা করিতে হইবে।
সকলের মিলিত প্রচেষ্টা দরকার
মুক্তিযুদ্ধ সাফল্যমন্ডিত হওয়ার পরপরই আমাদিগকে নানা ধরণের গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হইতে হইবে। বিপুল সংখ্যক শহরণার্থী পুনর্বাসনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা করা, যুদ্ধবিধ্বস্ত ভাঙ্গাচোরা অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করা, ভবিষ্যতে দেশকে গড়িয়া তোলার জন্য এবং বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করার কাজ আমাদের সামনে উপস্থিত হইতেছে। জনতার পরিপূর্ণ আস্থা ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া উক্ত বিরাট কাজ সুসম্পন্ন করা সম্ভবপর নয়।
এই জন্য প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দল ও প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
মুক্তিযুদ্ধকে জোরদার করা ও সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালনার জন্য আমরা প্রথম হইতেই ঐক্যবদ্ধ জাতীত ফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব করিয়াছি। বর্তমান জটিল ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং দেশের পুনর্গঠনের কাজ সুচারুরূপে অগ্রসর করার জন্য ঐরূপ ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাইয়াছে। কোন দলকে ছোট মনে করা তাহার প্রভাবকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য নয়, দেশবাসীকে সুদৃঢ় ঐক্য গঠনের জন্য ইহা একান্ত প্রয়োজন। এইরূপ ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট দেশ পুনর্গঠনের উপযোগী একটা কার্যক্রম গ্রহণ করিয়া উহা কার্যকরী করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করিতে পারে। এই কার্যক্রমের মূল কথা হইবে- দেশকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাবমুক্ত করিয়া একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। উক্ত কার্যক্রমের মূল বিষয় হইবে- কৃষি জমির সিলিং নির্ধারণ করিয়া খোদ কৃষকের হাতে জমি বিতরণ; শ্রমিকদের বাঁচার মত নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ; চাকুরীর নিরাপত্তা ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিতকরণ; ব্যাঙ্ক, বীমা, বড় বড় শিল্প, পাঁট ও আমদানী-রপ্তানী ব্যবসা প্রভৃতি জাতীয়করণ; ছোট ও মাঝারি শিল্পপতিদের জাতীয় শিল্প গড়িয়া তোলার ক্ষেত্রে উৎসাহ দান; সোভিয়েত ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সাহায্যে শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প গড়িয়া তোলা; সমতার ভিত্তিতে ভারতের সাথে সন্ধুত্বমূলক অর্থনৈতিইক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়িয়া তোলা; স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি গ্রহণ; সাম্রাজ্যবাদীদের শর্তযুক্ত সাহায্য বর্জন এবং সমাজতান্ত্রিক ও নিরপেক্ষ দেশগুলির সহিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করা।
গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর হইতেই আমরা ইয়াকে সমর্থন করিয়া আসিয়াছি এবং আমরা এই সরকারকে সমর্থন করি। তবে আমরা মনে করি যে, বর্তমানে দেশের সামনে যে সকল সমস্যাদেখা দিয়েছে, তাহা যথাযথভাবে সমাধান করার জন্য এই সরকারের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল সংগ্রামী শক্তিগুলোর প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন। ইহা দেশবাসীর মনে বিপুল অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ সৃষ্টি করিবে এবং দেশ গঠনের কাজে প্রতিটি মানুষকে সক্রিয় করে তুলিবে।
দেশ পরিপূর্ণভাবে স্বধীনতা অর্জনের পরে দেশে একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র রচনার প্রশ্ন দেখা দিবে। এ জন্য অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটে একটি শাসনতান্ত্রিক পরিষদ গঠন করিতে হইবে। এই শাসনতান্ত্রিক পরিষদ কর্তৃক শাসনতন্ত্র রচিত হওয়ার পূর্বে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র যাহাতে সারাদেশের নিকট গ্রহণযোগ্য হইতে পারে সে জন্য সকল সংগ্রামী শক্তিগুলোর প্রতিনিধিদের সমবায় একটি সামরিক শাসনতন্ত্র পরিষদ গঠণ করা প্রয়োজন।
ঐক্যবদ্ধ জাতীয় ফ্রন্ট গঠন, উহার একটি সাধারণ কার্যক্রম গ্রহণ, সম্প্রসারিত অস্থায়ী জাতীয় সরকার গঠন এবং অন্তর্বর্তী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রভৃতি বিষয়ে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ-আলোচনা চালাইতে হইবে এবং দেশবাসীর মধ্যেও উহার সপক্ষে জনমত গড়িয়া তুলিতে হইবে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বিকাহসের স্তরে তথা দেশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবিরোধী একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গঠন করার ক্ষেত্রে বুর্জোয়া-পেটি বুর্জোয়ার দল আওয়ামী লীগকে আমরা সাধারণভাবে মিত্র বলিয়া গণ্য করি। বর্তমান অবস্থায় দেশবাসীর স্বার্থের অনূকুলে ও দেশ পুনর্গঠনের কাজে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগিতা করিয়া চলাই আমাদের সাধারণ নীতি। এই সহযোগিতার ভিতরেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মতবিরোধ দেখা দিতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের কাজের সমালোচনা প্রভৃতি মিত্রসুলভভাবেই পরিচালনা করিতে হইবে।
কমরেডগণ,
মাতৃভূমির যে স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের জনগণ গত আট মাস যাবৎ বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করিয়া আসিতেছেন, সেই স্বাধীনতা আজ আমাদের স্বারে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। এক দশক আগে আমাদের পার্টি বাঙ্গালী জাতির আমতনিয়ন্ত্রণের যে দাবী ঘোষণা করিয়াছিল আজ সেই দাবী বাস্তবায়িত হইতে চলিয়াছে। ঘৃণ্য দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ও বৃটিশ সাম্রাজুবাদীদের আশীর্বাদে রচিত কৃত্রিম এবং সাম্প্রদায়িক-প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র পাকিস্তান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দুর্বার আঘাতে আজ ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভিশাপ হইতে বাঙ্গালী জাতির মুক্তি আজ আসন্ন। দুনিয়ার বুকে জন্ম নিয়াছে এক নবীন গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র-বাংলাদেশ।
আমরা বিশ্বাস করি, পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়িত জাতিসমূহও শীঘ্রই তাদের ন্যায্য জাতীয় ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য রুখিয়া দাঁড়াইবেন এবং তাহাদের ন্যায্য অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা করিবেন। তাঁহাদের এই ন্যায্য সংগ্রামে আমাদের পার্টি সবসময় সাহায্য করিয়াছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
বাঙ্গালী আওয়ামী লীগ জাতির জীবনে আজ এক নূতন দিনের সূচনা হইতেছে। আসুন আমরা সবাই মিলিয়া শপথ গ্রহণ করি যে বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি জনগণকে অতীতের সমস্ত নঞ্চনা, শোষণ ও অত্যাচার হইতে মুক্ত করিব এবং স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এক সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠন করিয়া সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে আগাইয়া যাইব।
কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি
৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১