শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক উপস্থিত রাস্ট্রীয় রূপরেখা ও কর্মসূচী | বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি | ৩০ নভেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশের জনগণের সামনে উপস্থিত স্বাধীন সার্বভৌম
জন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা
রূপরেখা ও কর্মসূচী
ভূমিকা
পূর্ব বাংলা পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তি তথা দস্যু হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষতী যুদ্ধ ও লক্ষ লক্ষ নরনারীর জীবন এর বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ মুক্তি। এ মুক্তিসংগ্রামে পূর্ব বাংলার সমগ্র শোষিত মেহনতি মানুষের রয়েছে সক্রিয় অবদান। বিশেষ করে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত মুক্তি ফৌজের সর্বজনস্বীকৃত। বাংলার মায়ের মুক্তিপাগল ঐ সেনানীদের জীবনাহুতি ছাড়া এ সংগ্রাম কিছুতেই সফল হতে পারত না, যদিও পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক পশুগুলিকে পরাজিত করার প্রশ্নে ভারত সরকার ও তার সেনাবাহিনীর ভূমিকাও এখানে জড়িত আছে। তবুও এ কথা দৃঢ়তার সাথে বলা চলে যে, পূর্ব বাংলার মেহনতি জনগণ ও তার সন্তানদের দ্বারা গঠিত মুক্তিবাহিনীই ছিল এ যুদ্ধের নিয়ামক শক্তি। আগামী দিনেও স্বাধীন-সুখী-সমৃদ্ধিশীল সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনে এরাই নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
দেশ আজ হানাদার মুক্ত হলেও শত্রু-মুক্ত নয়, নয় শাসক ও শোষকহীন। কেননা, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর কেবলমাত্র পাকিস্তানী শাসকরাই শোষণ চালায়নি- তাঁদের সাথে শোষণের শরিকদার ছিল (ক) দেশের অভ্যন্তরের জোতদার মহাজন বা সামন্তবাদী শ্রেণী (খ) বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, যদিও এ তিনের মধ্যে প্রধান শত্রু ছিল পাকিস্তানী শাসকরা।
বাংলাদেশে আজ পাকিস্তানী শাসকরা না থাকলেও তাদের বহু কল-কারখানা, ব্যাঙ্ক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়ে গেছে, রয়ে গেছে মার্কিনসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের পুঁজি-পাট্টা; তদুপরি জোতদার-মহাজনরা রয়েছে অক্ষত। অতএব ঐসব দেশী-বিদেশী শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসন ও শোষণ থেকে জনগণকে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে, নতুবা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বিঘোষিত শোষকহীন সমাজ হবে অর্থহীন।
গত নয় মাসের ঘটনাবলী কি প্রমাণ করে? প্রমাণ করে দেশের অভ্যন্তরের জোতদান-মহাজন ও তাদের দালালরাই ছিল পাকিস্তানী শাসকদের মূল খুঁটি; এদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পূর্ব বাংলার অসংখ্য গ্রামে সংঘটিত হয়েছে অসংখ্য ‘মাইলাই’ (ভিয়েতনাম) হত্যাকান্ড। আজো শেষ হয়নি দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের ষড়যন্ত্র, ভাঙ্গেনি তাদের শোষণের বিষদাত।
তাছাড়া অর্থনৈতিক ব্যতীত রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন, তা পূর্ব বাংলার জনগণ গত চাব্বিশ বছর ধরে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে, উপলব্ধি করেছে বলেই বাংলার সাধারণ মানুষ সর্বাগ্রে স্বাধীনতার দাবী তুলেছে, সকলের আগে ধারণ করেছে অস্ত্র। এ জনগণই গত নয় মাসে সবচাইতে বেশী ত্যাগ স্বীকার করেছে। তাই এ জনগণকে সকল প্রকার শোষণ থেকে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে। শুধু মুখের কথায় জনগণের মুখে হাসি ফুটবে না, পেটে ভাত জুটবে না, বেকার পাবে না কাজ, ভূমিহীন পাবে না জমি, ঋণগ্রস্থ মানুষ হবে না ঋণমুক্ত, রোগী পাবে না ঔষধপথ্য, শিক্ষার দ্বার হবে না সকলের জন্য খোলা।
এমতাবস্থায় দেশের সকল শ্রেণীর জনগণকে দেশী-বিদেশী সকল শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত করতে হলে সর্ব প্রথম তিনটি কাজের উপর বেশী গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রথমতঃ দেশের সর্ব স্তরের জনগণের মধ্যে আনতে হবে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে পূর্ণ আস্থা। দেশের মাটিতে মিত্র বাহিনীর অবস্থানকে জনগণ ভীষণ আশঙ্কার চোখে দেখছে। যেহেতু আমাদের দেশের মানুষ ঘরপোড়া গরুর মত, তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলেই তাদের ভয় জাগা স্বাভাবিক। এ অবস্থায় সরকারকে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করতে হবে-
পাকিস্তানী শাসক তথা বাইশ পরিবারের, বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের এবং দেশীয় জোত-মহাজন শ্রেণীর যাবতীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। এ তিন শোষণের কবল থেকে জনগণ সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে।
দ্বিতীয়তঃ সকল স্তরের মুক্তি ফৌজকে নিয়ে একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলা এবং প্রাপ্তবয়স্ক ও কর্মক্ষম পুরুষদের সামরিক ট্রেনিং দানের জন্য মুক্তি ফৌজের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রেনিং কেন্দ্র স্থাপন করা।
তৃত্বীয়তঃ দেশের অভ্যন্তরে ছোট-বড় সকল রাজনৈতিক দলের সহযোগিতার সমগ্র জাতির উন্নতি ও কল্যাণার্থে একটা সামগ্রিক কর্মসূচী প্রণয়ন করা।
বাংলার কমিইনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে আমরা সমগ্র জাতির সামনে বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকারের নিকট বিবেচনার জন্য উপরোক্ত উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত কর্মসূচী সবিনয়ে উপস্থিত করছি। আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি যে, একমাত্র এ কর্মসূচী বাস্তবায়ণের মাধ্যমেই বাংলার সমগ্র শোষিত ও মেহনতি জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি আসতে পারে। আমরা এও দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করছি যে এ কর্মসূচী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের সাথে বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করবে।
প্রথমতঃ রাষ্ট্রের নাম হওয়া উচিত জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা (People’s Republic of Purba Bangla)। যেহেতু দুই বাংলা ছিল এক বাংলা, তাই ‘বাংলাদেশ’ নামটিতে সমগ্র বাংলাদেশ কে বুঝায় এবং এতে বিভ্রান্তি থেকে যায়।
রাষ্ট্র মূল নীতি সমূহঃ
(১) সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য দেশকে অনুন্নত কৃষিপ্রধান দেশ হতে উন্নত শিল্প প্রধান দেশ রূপে গড়ে তুলতে হবে। দেশকে শিল্পায়িত দেশরূপে গড়ে তোলার জন্য সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পূর্ব ধাপ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে মূল বাধারূপে তিনটি শত্রু সমাজের উপর পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। এ তিনটি শত্রু হচ্ছে- (১) উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদ, (২) দেশীয় সামন্তবাদ এবং (৩) আমলাতান্ত্রিক শোষণ।
পাকিস্তান উপনিবেশবাদ, আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ বা নয়া-উপনিবেশবাদ, দেশীয় সামন্তবাদ (জোতদার-মহাজন) ও এদের দালালদের সমস্ত সম্পদ এবং দেশীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজি গণতান্ত্রিক সরকার বাজেয়াপ্ত করবে।
(২) রাষ্ট্র হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম। আনুপাতিক ভোট* ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণ তাঁদের শ্রেণীভিত্তিক প্রতিনিধি নির্বাচন করে পার্লামেন্ট গঠন করবে এবং এ পার্লামেন্ট হবে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা কার্যকরী করার সর্বোচ্চ শক্রিশালী হাতিয়ার। ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সের প্রতিটি নর-নারীর ভোটাধিকার থাকবে।
(৩) সকলের জন্য কর্মসংস্থান, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এবং বৃদ্ধকালীন ভাতা প্রদান করার নিশ্চয়তা (গ্যারান্টি) সম্মুখে রেখে সমস্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যকরী করা হবে।
(৪) বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল জাতি, উপজাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে।
(৫) এ রাষ্ট্র দেশের সকল রকমের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চুরি-ডাকাতি-রাহজানি, ভিক্ষাবৃত্তি, ব্যাভিচার, মদ-মাতলামি-জুয়া, ছেলেধরা, কালোবাজারি মজুতদারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র আঞ্চলিকতা প্রভৃতি যেসব সামাজিক অনাচার ও শোষণ-নিপীড়ন মানুষকে যুগ যুগ ধরে পঙ্গু করে এসেছিল- তার পরিপূর্ণ উচ্ছেদ করবে।
উপরোক্ত মূলনীতি সামনে রেখেই বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি জন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিম্নোক্ত কর্মসূচী হাজির করেছে-
১। কৃষক ও কৃষি সমস্যার ক্ষেত্রে
(ক) বাংলাদেশের আধাসামন্তবাদী ব্যবস্থার অবশেষকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করা হবে। “যে চাষ করে জমি তাঁর” এ নীতির ভিত্তিতে কৃষিব্যবস্থার পুনর্গঠন করা হবে। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব তিন শত্রুর এবং তাদের দালালদের সমস্ত বাজেয়াপ্ত জমি ও কৃষি যন্ত্রপাতি ক্ষেতমজুর, বর্গাচাষী ও গরিব কৃষকদের মধ্যে প্রয়োজনের অনুপাতে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে।
(খ) বিপ্লব মিত্র শিবিরে অনেক অকৃষক জমির মালিক আছে বা থাকবে যারা কৃষির আয়ের দ্বারা স্বাচ্ছন্দে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে না বলে অন্য পেশা গ্রহণ করেছে- কৃষক হিসেবে এদের ভূমিকা নেই। এদের জমি উচিত মূল্যে সরকারী খরচে ক্রয় করে বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে বিলি করা হবে। কিন্তু এদের জমি তখনই নেওয়া হবে যখন এরা নিজ নিজ পেশার আয়ের দ্বারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে, তার আগে না।
(গ) অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান এর মৌলিক প্রশ্নে অসহায় বিধবা ও অন্যান্য অকৃষক মানুষদের হাতে জীবনধারণের মূল উপকরণ হিসেবে যে জমি আছে তা উচিত মূল্যে সরকারী খরচে ক্রয় করে নেওয়া হবে ও বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে বিলি করা হবে। তবে তা করা হবে ঐ সকল মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে, রাষ্ট্র কর্তৃক বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করার পর, তার আগে না।
(ঘ) আবাদযোগ্য পতিত জমি ও সরকারী খাস জমিসমূহ কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। ওয়াকফ, দেবোত্তর সম্পত্তি নামে যুগ যুগ ধরে কৃষকদেরকে শোষণ করা হচ্ছে তাকে বিলুপ্ত করা হবে। কিন্তু ধর্মীয় ও সৎ উদ্দেশ্যে যে ওয়াকফ বা দেবোত্তর করা হয়েছিল সে উদ্দেশ্য যাতে ব্যাহত না হয়, তার জন্য সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
(ঙ) উন্নত ধরণের বীজ, সার ও বৈজ্ঞানিক কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, কৃষিতে সেচসহ উন্নত বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থার প্রবর্তন, জরুরী কার্যক্রম হিসেবে বন্যা ও জলস্ফীতি প্রতিরোধের স্থায়ী দৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশকে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে।
*আনুপাতিক ভোট বলতে বুঝায়ঃ- নির্বাচনে ব্যক্তি না হয়ে পার্টি প্রার্থী হবে। জনগণ পার্টিগুলোকে ভোট দেবে। যে পার্টি সারা দেশে যত বেশী ভোট পাবে তা একত্র করে সম্পূর্ণ প্রদত্ত ভোটের অনুপাতে পার্লামেন্ট ঐ পার্টির প্রতিনিধির সংখ্যা নির্দিষ্ট হবে। তারপর ঐ পার্টি ব্যক্তি নির্দিষ্ট করে দেবে (অর্থাৎ পার্লামেন্ট মনোনিত করে পাঠাবে)। এ অবস্থায় কোন ভোটারের ভোট অপ্রতিনিধিত্বমূলক থাকে না।
(চ) বাংলাদেশের জলসম্পদের যথাযথ উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বিদেশী রপ্তানির উদেশ্যে বনজসম্পদ, বন্যপশু-পক্ষী-কীট্ট-পতঙ্গদের সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি সাধন করা হবে এবং মৎসশিল্পে বৈজ্ঞানিক প্রথা প্রবর্তনসহ উহার সার্বিক উন্নতি সাধন কর হবে।
(ছ) কৃষিশ্রমিক বা ক্ষেতমজুরদের জন্যে উপযুক্ত মজুরি পাবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(জ) জাতীয় শত্রু জোতদার-মহাজনদের নিকট যে সমস্ত কৃষক-মজুর ও গরীব কুটিরশিল্প যুগ যুগ ধরে ঋণদায়গ্রস্থ, তাদেরকে ঐ ঋণের নাগপাশ থেকে মুক্ত করা হবে।
(ঝ) কৃষকদের জন্যে এবং কুটিরশিল্পীদের জন্য বিনাসুদের দীর্ঘিমেয়াদী ঋণ পাবার ব্যবস্থা করা হবে এবং তাঁহাদের উৎপাদিত দ্রব্যাদির উচিত মূল্য পাবার ব্যবস্থা করা হবে। কৃষকদের মত কুটিরশিল্পীদের্ব প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ করা হবে।
(ঞ) কৃষক ও কুটিরশিল্পীদের স্বার্থে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সমবায় গঠনের জন্যে উৎসাহ ও সহযোগিতা প্রদান করা হবে। পর্যায়ক্রমে কৃষি সমবায়, পণ্য সরবরাহ ও বাজারজাতকরণ সমবায় প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(ট) জনসাধারণকে যৌথ অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় উদবুদ্ধ করার জন্য রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু সংখ্যক আদর্শ যৌথ খামারের প্রবর্তন করা হবে।
২। শ্রমিক ও শ্রম সমস্যার ক্ষেত্রে
(ক) শ্রমিকদের জন্য মানুষের মত বেঁচে থাকার উপযোগী মজুরি প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।
(খ) দৈনিক অনাধিক আট ঘণ্টা শ্রমের রেওয়াজ প্রতিটি শিল্প-ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ও দোকান কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কড়াকড়িভাবে চালু করা হবে। অবশ্য প্রয়োজনে ৮ ঘণ্টার অধিক শ্রমের জন্য দ্বিগুণ হারে উপরি পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করা হবে।
(গ) অবসরপ্রাপ্ত বা কাজ করতে গিয়ে পঙ্গু বা কার্যে অক্ষম হয়ে গেছে এমন শ্রমিকদের জন্য সরকার ও মালিকদের খরচে বিশেষ মজুরি (গ্রাচুইটি), বীমা ও পেনশনের ব্যবস্থা করা হবে।
(ঘ) শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় বাসস্থান এবং অবসর বিনোদন কেন্দ্রের ব্যবস্থা রাখা হবে।
(ঙ) শ্রমিকদের জীবনধারণের মান ও চাকরির শর্ত উন্নত করার প্রয়োজনে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, মালিকদের সাথে যৌথ দর কষাকষি ও ধর্মঘট করার পূর্ণ অধিকার দেওয়া হবে।
৩। শিল্প ও ব্যবসার ক্ষেত্রে
(ক) কৃষিনির্ভর অবস্থা থেকে দেশকে দ্রুত শিল্পসমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা হবে এবং এ নীতির উপর ভিত্তি করে শিল্পব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা হবে।
(খ) রেল, স্টিমার ও স্টেটবাস ব্যাঙ্ক, বীমা, পোর্ট, ডাক এবং কাগজ, পাঁট, বিদ্যুৎ, তৈল, খনি, জাহাজ নির্মাণ কারখানা, অস্ত্র কারখানা ও বিআইডিসি, ওয়াপদা ও বিসিক কর্তৃক নির্মিত কারখানা ইত্যাদি মূল শিল্প ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত থাকবে।
(গ) দেশকে দ্রুত আত্মনির্ভরশীল ও শিল্প-সমৃদ্ধ করার নীতিকে ছোট ও মাঝারি শিল্প এবং শিল্পপতিদের সরকারী সহযোগিতা দেওয়া হবে। অল্প সুদে ঋণ প্রদান ও যুক্তিসংগত দামে কাঁচামাল ইত্যাদি সরবরাহের ব্যবস্থা ও বাজারের সুযোগ-সুবিধা লাভে তাদের সাহায্য করা হবে।
(ঘ) রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহকে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার ও শ্রমিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি মারফত যৌথভাবে পরিচালনা ব্যবস্থা করা হবে। অন্যথায় আমলাতান্ত্রিক শোষণ হতে শিল্পকে রক্ষা করা যাবে না এবং শিল্প বিকাশের পক্ষে এগুনো যাবে না, যেহেতু আমলারা লুটের মাল হিসেবে শিল্পকে এ যাবৎ ব্যবহার করেছে।
(ঙ) ব্যক্তিগত মালিকানায় শিল্প ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অত্যাধিক মুনাফার ফলে যাতে একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ না ঘটে, শ্রমিক যাতে উপযুক্ত মজুরি ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তার জন্য এবং দ্রব্যমূল্যের প্রশ্নে জনসাধারণের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে মুনাফার উপর উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হবে।
(চ) আভ্যন্তরীণ খাদ্য ও পাঁট ব্যবসা এবং সমস্ত প্রকারের বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্যক রাষ্ট্রায়ত্ত করা হবে।
৪। ছাত্র ও শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে
(ক) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থার অমূল পরিবর্তন সাধন করা হবে। সর্বস্তরে বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী শিক্ষার প্রচলন করা হবে। কারিগরী ও বাস্তবমুখী শিক্ষার প্রাধান্য দেওয়া হবে।
(খ) মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক রাখা হবে। এরপর সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। শ্রমিক, কৃষক ও অল্প আয়ের লোকের ছেলেমেয়েদের জন্যে মাধ্যমিক শিক্ষার পরও দশন মান পর্যন্ত সরকারী খরচে শিক্ষা দেওয়া হবে। এদের মেধাবী ছেলেমেয়েদের জন্য সরকারী খরচে উচ্চশিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(গ) উপরোক্ত শিক্ষাব্যবস্থার জন্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষালয় এবং তার আনুষঙ্গিক যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(ঘ) বাংলা ভাষার মাধ্যমে যাবতীয় শিক্ষা প্রদানের যথাযথ ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধন করা হবে।
(ঙ) ধর্মীয় শিক্ষার অবাধ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে।
৫। চিকিৎসা ও বাসস্থানের ক্ষেত্রে
(ক) চিকিৎসা ব্যবস্থাকে জনসেবা এবং আরোগ্যের চাইতে প্রতিরোধ শ্রেয়তর (Prevention is better than cure) ঐ নীতিদ্বয়ের উপর ভিত্তি করে পরিচালনা করা হবে।
(খ) নিম্ন আয়ের লোকেরা যাতে সরকারী খরচে উপযুক্ত চিকিৎসার সুযোগ লাভ করে তার ব্যবস্থা থাকবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে মাতৃসদন, দাতব্য চিকিৎসালয়, আরোগ্য নিকেতন ও জটিল রোগের চিকিৎসা কেন্দ্র চালু রাখা হবে। বিনা চিকিৎসাইয় একজন লোকও যাতে মারা না যায় তার ব্যবস্থা থাকবে।
(গ) এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজী ও হেকিমী বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের যথাযোগ্য সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে।
(ঘ) সকল মানুষের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু যতদিন পর্যন্ত পরিপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, ততদিন পর্যন্ত স্বল্প আয়ের মানুষের জন্যে গৃহনির্মাণের প্রয়োজনীয় উপকরণ কম মূল্যে (Subsidized price) সরবরাহ করা হবে। শহর শিল্প ও ব্যবসাকেন্দ্রে স্বল্প ভাড়ায় ঘর পাবার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
৬। বিচার ব্যবস্থা ও আইন সম্বন্ধীয় ক্ষেত্রে
(ক) জনসাধারণের স্বার্থের জন্যে আইন, আইনের জন্য জনসাধারণ নহে- ঐ নীতির ভিত্তিতেই আইন ব্যবস্থার পরিবর্তন করা হবে। বিচার যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, তার জন্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ হতে পৃথক করা হবে।
(খ) বিনাবিচারে কাহাকেও শাস্তি দেওয়া বা হয়রানি করা হবে না। যে কোন আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি এমন ব্যক্তির উচ্চতর আদালতে আপীল করার অধিকার থাকবে। অভাবগ্রস্তদের জন্য বিনা খরচে আইনগত সাহায্য ও পরামর্শ লাভের ব্যবস্থা থাকবে।
(গ) ছোটখাট ও প্রাথমিক বিরোধের যাতে শুরুতেই অবসান হয় তাঁর জন্য গণয়াদালতের ব্যবস্থা থাকবে।
(ঘ) বিচার ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রচলন করা হবে। প্রতিটি বিচারক জনসাধারণ কর্তৃক যথাযথভাবে নির্বাচিত হবেন। প্রয়োজনবোধে নির্বাচকমন্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিচারককে প্রত্যাহার এবং তদস্থলে নতুন বিচারক নির্বাচিত করতে পারবেন।
(ঙ) অন্যায় অবিচার বা অসদাচরণের দায়ে কোন বিচারককে উচ্চতর আদালতে অভিযুক্ত করা যাবে।
৭। ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে
(ক) রাষ্ট্র পরিপূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে। যার যার ধর্ম তার কাছে পবিত্র এবং ধর্মের ব্যাপারে কোনরূপ জবরদস্তি নেই- ধর্ম প্রসঙ্গে এ নীতি কড়াকড়িভাবে কার্যকরী হবে। ধর্মের ব্যাপারে কোন বৈষম্যমূলক আচরণ যাতে না ঘটতে পারে তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রাখা হবে; অর্থাৎ প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীরা নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন জরার সুযোগ পাবে। রাষ্ট্র প্রত্যেক ধর্মের স্বীকৃতি ও ধর্ম পালকদের অবাধ অধিকার থাকবে- কিন্তু ধর্মের নামে কোন প্রকার জোর-জুলুম করা বা করা বা শোষণ চলতে দেওয়া হবে না।
(খ) বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক রাষত্রের সংস্কৃতি বা তমদ্দুনের ভিত্তি-
১) বাঙ্গালী জাতির সংস্কৃতির বিকাশ ও তার উন্নয়ন সাধন;
২) সংস্কৃতি ও সাহিত্য মেহনতি জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে রূপায়িত করা;
৩) গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রের মূলনীতি বা আদর্শেও বিরোধী যাবতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রকাশ, প্রচার ও প্রসার রোধ করা;
৪) কুরুচিপূর্ণ যাবতীয় গান, বাজবা, সিনেমা, থিয়েটার, শিল্পকলা ইত্যাদি তথাকথিত শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর কঠোর বাধানিষেধ আরোপ করা;
৫) জনগণের সর্বস্তর সুন্দর, সুষ্ঠ স্বাভাবিক মননশীলতা ও মানসিকতা যাতে গড়ে ওঠে তার জন্য এবং শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৮। খাজনা ট্যাক্স ও করের ক্ষেত্রে
(ক) সকল প্রকারের ইজারাদারীসহ প্রচলিত খাজনা প্রথার বিলোপ সাধন করা হবে। সমস্ত বকেয়া খাজনা মওকুফ করা হবে। ‘খাজনা প্রথার স্থলে উৎপাদন অনুসারে কর আদায়ের প্রথা প্রবর্তন করা হবে। নিম্ন আয়ের কৃষক ও গরীব কুটির শিল্পীদে জন্য- যাদের ভরণ পোষণের পর উদ্বৃত্ত থাকে না- তাদেরকে রেহায় দেওয়া হবে।
(খ) শিল্প-কৃষি ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্রমিক উচ্চ হারের কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে, অর্থাৎ উচ্চ আয়ের জন্য উচ্চতর হার এবং নিম্ন আয়ের জন্য নিম্নতর হারে কর আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে এবং পরোক্ষ ট্যাক্স প্রথা বিলোপ করা হবে।
৯। নারী সমাজের ক্ষেত্রে
(ক) নারীর যে সমস্ত সামাজিক অব্যবস্থা বা দূর্নীতির দরূন যুগ যুগ ধিরে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হয়ে আসছে সেগুলোর অবসান ঘটানো হবে। সম্পত্তির উত্তরাধিকতার, বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, বৃত্তিগ্রহণ ও চাকুরীতে প্রবেশ প্রভৃতি বিষয়ে নারীরা পুরুষদের সমান অধিকার ভোগ করবে।
(খ) নর ও নারীর সমান অধিকার থাকবে। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান কাজের জন্য সমান মজুরির ব্যবস্থা রাখা হবে। গর্ভাবস্থায় সংকটকালীন সময়ে মেহনতকারী নারীকে সর্বোত্তম প্রয়োজনীয় ছুটি ও বিশেষ চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হবে
১০। উপজাতি ও তপসিলীদের ক্ষেত্রে
(ক) বাংলাদেশের যে সমস্ত অনুন্নত উপজাতি আছে তাদের মাতৃভাষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উন্নয়ন করা হবে।
(খ) চাকরি এবং অন্যান্য সামাজিক ও শিক্ষাগত সুযোগের ক্ষেত্রে উপজাতি, তফসিলী ও অন্যান্য পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে।
১১। রাষ্ট্র কাঠামো ও সরকারী প্রশাসনের ক্ষেত্রে
(ক) বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইনসভা হবে এককক্ষবিশিষ্ট। ঐ আইনসভা হবে – জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের স্বার্থের রক্ষক ও জনগণের মধ্যে থেকে আসা-গণপ্রতিনিধিদের সর্বোচ্চ সংস্থা।
(খ) বিপ্লবের তিন শত্রু বা তাদের সাহায্যকারী দালালদের কোনরূপ নাগরিক অধিকার বা ভোটাধিকার একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকবে না। ঐ নির্দিষ্ট সময়ে সরকারী শাসন বা প্রশাসন ব্যবস্থায় তাদেরকে কোনরূপ অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু তাঁরা যাতে তাদেরও প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন করে নতুন সমাজের নতুন মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারে- তার জন্য রাষ্ট্র উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
(গ) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জেল ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে অপরাধীদের নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নতি সাধন করে তাদের পূনর্বাসন করবে।
(ঘ) পার্লামেন্ট, আইনসভা বা স্থানীয় শাসন বা প্রশাসন সংস্থাগুলোর নির্বাচনে জনসাধারণের মধ্যে যারা আঠার বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের এবং মানসিক সুস্থ অবস্থায় আছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের সকলেরই সার্বজনীন, সমান ও প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার থাকবে। সংশ্লিষ্ট নির্বাচকমন্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ প্রয়োজনবোধে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি বা প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার (Recall) করতে এবং নতুন প্রতিনিধি নির্বাচিন করতে পারবে। গোপন ব্যালট প্রথাত ভোটদান ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হবে।
(ঙ) দেশে ব্যাপক গণপঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রচলন করা হবে। স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থায় গণপঞ্চায়েতের প্রাধান্য থাকবে।
(চ) সর্বনিম্ন প্রশাসক থেকে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত সকল সরকারী প্রশাসক ও পরিচালক জনসাধারণের গোপন, সমান ও প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে। প্রধানতঃ স্থানীয় জনসাধারণ থেকেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসক বা পরিচালক নির্বাচিত করা হবে। নির্বাচকমন্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ প্রয়োজনবোধে উপরোক্ত যেকোন প্রশাসক বা পরিচালককে প্রত্যাহার করে নতুন প্রশাসক বা পরিচালক নির্বাচিত করতে পারবে।
(ছ) যে কোন প্রশাসক বা পরিচালকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
(জ) দেশের সামরিক, আধা-সামরিক বা প্যারা-মিলিশিয়া বাহিনীর সর্বত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকবে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তাদের ভোটাধিকার থাকবে। আমাদের দেশের সামরিক বাহিনী এ যাবৎ যে দাসত্বমূলক অবস্থায় বা মৌলিক অধিকারবিহীন অবস্থায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়ে এসেছে, তার থেকে তাদের মুক্ত করা হবে। তাদের দেশপ্রেমকে আরও উন্নত করার জন্য এবং গণতন্ত্রের ভাবধারায় তাদের আরও উদ্বুদ্ধ করার জন্য যথাযথ সরকারী প্রচেষ্টা থাকবে।
(ঝ) দেশরক্ষার কাজে যাতে দেশের সমস্ত নাগরিক বিশেষ করে শ্রমিক ও কৃষক প্রয়োজনবোধে অংশগ্রহণ করতে পারে- তার জন্য উপযুক্ত সামরিক শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা থাকবে।
(ঞ) বিপ্লবে অংশগ্রহণের কারণে যারা পঙ্গু বা বিকলঙ্গ ও শহীদ হয়েছেন বা হবেন যথাক্রমে তাদের বা তাদের পরিবারের উপযুক্ত ভরণপোষণের দায়িত্ব সরকার বহন করবে।
(ট) বিপ্লবে জড়িত থাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ জনসাধারণের প্রতিটি অংশকে পুনর্বাসন করা হবে। বিল্পব চলাকালে পূর্ব বাংলার যে সকল অধিবাসী দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছে তাদের সম্পত্তি ফেরত পাবার ও তাদের পুনর্বাসনের উপযুক্ত ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করবে।
১২। বৈদেশিক ও আন্তর্জাতিক নীতির ক্ষেত্রে
(ক) বিশ্বের ধনবাদী-সাম্রাজ্যবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক এই দুই শিবিরের মধ্যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার নিঃসন্দেহে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পক্ষেই থাকবে।
(খ) বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিভিন্ন নিপীড়িত জাতির বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার জাতীয় মুক্তির ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সপক্ষে থাকবে এবং সামর্থ্য অনুসারে ঐ সমস্ত জাতিকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করবে।
(গ) বিশ্ব সর্বহারার সমর্থনে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি পরিচালিত হবে। প্রত্যেক জাতির নিপীড়িত জনসাধারণের সাথে আন্তর্জাতিক মৈত্রী ও সৌহার্দ্যের নীতি সরকার গ্রহণ করবে।
(ঘ) গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ্র রাষ্ট্র প্রতিবেশীদের সঙ্গে- যথা ভারত, বার্মা, নেপাল, সিংহল ও মহাচীনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে স্থাপন করে চলবে এবং এই রাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন সমাজব্যবস্থার সাথে পঞ্চশীলার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের নীতি অনুসরণ করে চলবে।
[১৯৭১ সালের ৩০শে, ৩১শে নভেম্বর ও ১লা ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেস (দ্বিতীয় বিশেষ) গৃহীত রাজনৈতিক দলিলের ভিত্তিতে রচিত]
বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক কমরেড আবুল বাশার কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত।