You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
শিক্ষা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য শাজাহান সিরাজের ভাষণ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ
BANGLADESH CENTRAL STUDENT’S ACTION COMMITTEE

সদর দপ্তরঃ ঢাকা HEAD OFFICE: DACCA
বাংলাদেশী সাথী ভাইবোনেরা,
আজ মহান ১৭ই সেপ্টেম্বর। এ দিনটি বাংলার ছাত্রসমাজ ও গোটা বাঙালী জাতির ঐতিহাসিক ক্রান্তিক্ষণ। এ দিনের গায়ে আমাদের ভাই ওয়াজিউল্লা, বাবুল, গোলাম মোস্তফার তাজা খুনে জড়ানো। আজ থেকে নয় ন’বছর আগে এমনি সারা বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির অঙ্গনে বিদ্রোহের অগ্নিলাভা জ্বলে উঠেছিল। লক্ষ হাতের বজ্রমুঠিতে জ্বলে উঠেছিল রক্তরাতুল লাল ঝান্ডা।

একদিন মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে পলাশীর আম বাগানে বাংলার স্বাধীনতাসূর্য ম্লান হয়ে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকেরা এ দেশে মনিব সাজে। অফিস-আদালত-রাজপথে, সকল শিক্ষা নিকেতনে ওদের ভাষা, সভ্যতা, সংস্কৃতির দুর্বহ পাথর চেপে বসে। ধীরে ধীরে এই পাথর “অহল্যার অভিশাপে” পরিণত হয়। পঙ্গু করার প্রচেষ্টা বাঙালী জাতীয় ভাষা, সভ্যতা ও কৃষ্টির সতেজ হৃৎপিণ্ডকে। একমাত্র ইংরেজিই রাজভাষার সমাসীন হয়। সাথে সাথে ফিরিঙ্গি শিক্ষা ব্যবস্থা জোঁকের মত চেপে বসে আমাদের অস্থি মাংস হাড়ে হাড়ে।
ভারত ভাগ হয়ে তথাকথিত পাকিস্তানের জন্ম হল। জন্মলাভের শুরু থেকেই বাংলাদেশকে পাঞ্জাবের কলোনি করার হীন ঘড়যন্ত্র শুরু হল। বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতিকে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করার হীন ষড়যন্ত্রে উপনিবেশবাদী পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বারবার বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের উপর বুলেট, বেয়নেট ব্যবহার করে রাজপথকে লালে লাল করে দিয়েছে। …

শহীদের অতৃপ্ত আত্মার চিৎকার যায় নাই, যেতে পারে না। প্রতিবছর ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে আমরা প্রভাতফেরী , পুষ্প্যমাল্য, সভা, শোভাযাত্রার মাধ্যমে এই মহান দিবস পালন করে থাকি। কিন্তু বাংলাদেশ আক্রান্ত। পাঞ্জাবী সেনাদের রাইফেল, কামান, মেশিনগান, আর মর্টারের আঘাতে বাংলার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত , লাখ লাখ শহীদের রক্তে বাংলার পথ প্রান্তর রক্তাক্ত। সারা বাংলাদেশ জ্বলে-পুড়ে ছারখার। আমরা আজ যুদ্ধে লিপ্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আর বিদেশে ছাত্র-ছাত্রী-যুবকেরা বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আজকের এই মহান সুপ্রভাতে তাই কোন প্রভাতফেরী নেই, একগুচ্ছো ফুলের পরিবর্তে একমুঠো বুলেট, ফেষ্টুন-প্ল্যাকার্ডের পরিবর্তে হাতে রাইফেল নিয়ে , মিছিলের পরিবর্তে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা হয়ে ছাত্র-ছাত্রী, ভাইবোনেরা সারা বাংলার গ্রাম-গঞ্জে ওয়াজিউল্লা-বাবুল-মোস্তফার হত্যাকারী পাঞ্জাবী হানাদারদের হত্যা করে শহীদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে মৃতঞ্জয়ী অভিযান চালিয়েছে। অভিযান চালিয়েছে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করতে।

মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা ভাইয়েরা,

বাংলার অবিসাংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাত ধরে শহীদদের নামে শপথ করে , বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে আমরা ওয়াদা করেছিলাম যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে পাঞ্জাবীদের হত্যা করে মাতৃভুমিকে আমরা মুক্ত করবোই। আমরা সে ওয়াদা ভুলে যাই নাই। আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমনে আজ পাক সেনাবাহিনী ভীতসন্ত্রস্ত। প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনে শত শত হানাদার খুন হতে চলেছে। ১৭ই সেপ্টেম্বরের এই মহান দিনের বিপ্লবী অগ্নিলাভার রঙ চোখে- মুখে ছড়িয়ে পাক হানাদার বাহিনীর দস্যুদের খতম করার কাজে আসুন আমরা আরো কঠোর প্রত্যয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ওয়াজিউল্লা-বাবুল-মোস্তফার মত ব্যাক্তিগত স্বার্থকে বির্সজন দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির স্বার্থে নিজেদের আত্মোৎসর্গ করি।

কৃষক শ্রমিক মেহনতি ভাইয়েরা,
পাঞ্জাবী শত্রুসেনার বুলেটের আঘাতে আজও আপনারা প্রান দিচ্ছেন। রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারে আপনাদের গণজীবন আজও বিপর্যস্ত। আপনাদের এ রক্তদান বৃথা যাবে না। আপনাদের সন্তান হয়ে আপনাদের রক্ষা করার জন্য আমরা আজ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছি। একটি পাঞ্জাবীদেরও জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে দেব না। রাজাকার বাহিনীতে যারা আছে তাদের কেবল একটি কথাই বলতে চাই, তোমরা অনেকেই বাঙালীর সন্তান। বাংলাদেশের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে পাঞ্জাবীদের সাহায্য না করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন কর। অন্যথায় তোমাদেরকেও পাঞ্জাবীদের মত একটি একটি করে হত্যা করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা গেরিলারা আজ বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে হানাদারদের খতম করতে। আপনারা গেরিলাদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা করুন। কারণ তারা আপনাদেরই ভাই, আপনাদেরই বন্ধু। কিছু সংখ্যক দুস্কৃতকারী তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সেজে আপনাদের উপর অত্যাচার করছে। তাদের নামের তালিকা নিকতবর্তী মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে পাঠিয়ে দেন।

বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে, সারা বাংলাদেশকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে, হাজার হাজার মা বোনের ইজ্জত নষ্ট করেও যখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমনে খুনী ইয়াহিয়ার কুকুর বাহিনী বাংলার পথে ঘাটে খুন হচ্ছে ও পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে, ঠিক সেই মুহুর্তে মাতাল ইয়াহিয়া অভিনব পন্থায় স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন শুরু করেছে। জল্লাদ ইয়াহিয়াকে শেষ বারের মত একটি কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- শেখ মুজিবের উপর আঘাত আসলে তুমি টিক্কা বাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে যেখানেই যাও না কেন , সেখানেই গিয়ে তোমদের হত্যা করা হবে। পাঞ্জাবের তখতে তাউসকে ভেঙ্গে খান খান করে ইতিহাস থেকে নাম-নিশানা মুছে ফেলা হবে।

সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ যখন খুনী ইয়াহিয়ার এই গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠে প্রতিবাদ জানিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে আমাদের পাশে এসে দাড়িয়েছে তখন বিশ্বের বৃহৎশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের দোসর চীন-মার্কিন সরকার জঙ্গিশাহীকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেও কোন ফায়দা না দেখে বাংলাদেশের শত্রু ডঃ মালিককে ক্ষমতায় বসিয়ে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার অভিনব প্রচেষ্টায় মেতে উঠেছে। আমরা সেই সকল শক্তিকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই, হিমালয় পাহাড় ধসে যেতে পাড়ে , বঙ্গোপসাগর শুকিয়ে মরুভুমি হতে পারে , কিন্তু বাংলা সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পাঞ্জাবের গোলাম করে রাখা যাবে না। আমরা তোমাদের কাছে ভিক্ষা চাই নাই। ভিক্ষা করে স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না। যুদ্ধ করেই আমরা শত্রুসেনাদের খতম করে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করব ।

বাংলার ছাত্রসমাজ ও জনগণের পক্ষ থেকে আজকের এই পবিত্র দিনে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমরা বলতে চাই- বাংলার ভৌগলিক স্বাধীনতার সাথে সাথে বাংলার কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন- আমি কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েম করব। লক্ষ লক্ষ মানুষের তাজা রক্ত আর ধবংসস্তূপের মধ্যদিয়ে যে নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তার অর্থনীতি অব্যশই সমাজতান্ত্রিক হতে হবে। আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে অব্যশই নির্মূল করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুজিবাদী ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে খান খান করে একটি শ্রেনীশোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বিজ্ঞান ভিত্তিক গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা , যার মাধ্যমে প্রতিটি মায়ের সন্তান একই নীতিতে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। পাঞ্জাবের ২২ পরিবারকে উৎখাত করে আবার নতুন করে কোন পুঁজিপতি বাংলাদেশে যাতে সৃষ্টি না হয়,
জনগণের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করার কোন সুযোগ যাতে না থাকে তার বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তার ভিত্তিতে অব্যশই ভাবী শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে।
ওয়াজিউল্লা, বাবুল, মোস্তফার রক্তে অনুপ্রাণিত আজকের স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধের ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা চিশতি শাহ হেলালসহ লাখ লাখ শহীদের উত্তরসূরী হিসাবে বাংলার মাটি ও মানুষকে মুক্ত করার যে মহান দায়িত্ব নিয়ে আমরা ছাত্রসমাজ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছি, তা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হবো না। মানব সভ্যতার অবসম্বাদিত খুনী ইয়াহিয়া-টিক্কার বাদিশাহীর হেরেম ভেঙ্গে চুরমার করে আমরা আমাদের জন্মভূমির সকল প্রান্তে স্বাধীনতার বিজয় বৈজয়ন্তী ওড়াবো। বাংলার ছাত্রসমাজ ও জনগণের পক্ষ থেকে সংগ্রামী সালাম জানাই বীর শহীদ ভাইদের। জয় আমাদের হবেই। আফ্রো-এশিয়ার নির্যাতিত মানবগোষ্ঠীর মহান নেতা শেখ মুজিব দীর্ঘজীবি হোক। মহান ১৭ই সেপ্টেম্বর অমর হোক-
জয় বাংলা
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!