জীবনচিত্ৰ নামঃ ডা. ক্যাপ্টেন বদিউল আলম চৌধুরী
Dr. Capt. Bodioul Alam Choudhury
পিতার নামঃ মৌলভী আহসানউল্লাহ
পিতার পেশাঃ চাকরি
মাতার নামঃ রইওদুন্নেছা।
ভাইবোনের সংখ্যাঃ চার ভাই ও দুই বোন; নিজক্ৰম-ততীয়
ধর্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম-জয়পুর, ডাকঘর-মহারাজগঞ্জ
উপজেলা-ছাগলনাইয়া, জেলা-ফেনী
শহীদ ডা. ক্যাপ্টেন বদিউল আলম চৌধুরী
নিহত/নিখোঁজ হওয়ার সময় ঠিকানাঃ কুমিল্লা সেনানিবাস
জন্মঃ ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯। ফেনী
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
এমবিবিএসঃ ১৯৫৩, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
শখঃ ফুটবল খেলা
চাকরির বর্ণনাঃ
সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মেডিকেল অফিসার, ১৯৫৩
১৬ জুন ১৯৬৫ আর্মি মেডিকেল কোরে যোগদান
কুমিল্লা কান্টনমেন্টঃ লেফটেন্যান্ট
যশোর ক্যান্টনমেন্ট
খারিয়া ক্যান্টনমেন্ট, পাকিস্তান
গিলগিট, চায়না
লাহোর ক্যান্টনমেন্ট, পাকিস্তান
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, সিনিয়র ক্যাপ্টেন, সেকেন্ড ইন কমান্ড, ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স (বর্তমান ৫ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স), ১৯৭০, আমৃত্যু
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী
নিহত/নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ৩০ মার্চ ১৯৭১
মরদেহঃ
প্রাপ্তি স্থানঃ কুমিল্লা ব্রিগেড অফিসের কাছে পাহাড়ের মাঝখানে অন্যান্য মরদেহের সাথে
প্ৰাপ্তি তারিখঃ ডিসেম্বর ১৯৭১
কবরস্থানঃ কুমিল্লা সামরিক হাসপাতালের সামনে
স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ বিএমএ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলক, কুমিল্লা ৫-ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের সম্মুখস্থ স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি
স্ত্রীর নামঃ রশিদা আলম চৌধুরী
বিয়েঃ ১৮ এপ্রিল ১৯৬৫
সন্তান-সন্ততিঃ দুই কন্যা
দিলরুবা আলম চৌধুরীঃ মেডিকেলের ছাত্রী ছিলেন
ডা. রুবিনা আলম চৌধুরীঃ এমবিবিএস, মেডিকেল অফিসার, মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম
তথ্য প্রদানকারী
রশিদা আলম চৌধুরী
শহীদ চিকিৎসকের স্ত্রী
রশিদা ম্যানসন, হোল্ডিং নং-৩৪, স্টেশন
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২০৫
আমার স্বামী
শহীদ ডা. ক্যাপ্টেন বদিউল আলম চৌধুরী
রশিদা আলম চৌধুরী
এই শুনছো! আমি তোমার প্রিয়তমা স্ত্রী, তোমার সন্তানদের মা। তোমার কাছে এ লেখা পৌঁছবে কিনা জানি না; কারণ তোমার বর্তমান ঠিকানা কেবল স্রষ্টাই জানেন। তবু লিখছি; হয়তো একদিন নিজের হাতেই তোমাকে দেবো এ লেখাটা।
তুমি চলে গেছো ৩৮ বছর; তোমার মতো সুন্দর মানুষের দেখা আর পেলাম না। সৃষ্টিকর্তা তোমার ভেতর-বাহির সবই সুন্দর করে গড়েছিলেন। সুদৰ্শন ছিলে। আপাদমস্তক ভদ্রলোক ছিলে। মানুষের সাথে মিশতে পারতে অকপটে। সবার সাথে ছিল তোমার সদ্ব্যবহার। পরিচারকদের সাথে যেমন সদয় ছিলে, নিজ অফিসের দারোয়ান-রক্ষীদের সাথেও ছিলে সহানুভূতিশীল। তাদের আপদে-বিপদে সবসময় পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। তাই তারা সর্বদা তোমাকে আপনজন জেনেছে।
ফেনীতে নিজ গ্রাম জয়পুরে যখন যেতে তখনও তোমার আন্তরিকতার ছোঁয়া পেতো গ্রামবাসীরা। তুমি সামরিক কর্মকতা হওয়া সত্ত্বেও গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে তোমার প্রধান পরিচয় ছিল একজন জনদরদি চিকিৎসক। গ্রামে তোমার সাথে বেড়াতে যাওয়াটা প্রকারান্তরে পরিণত হতো বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবাদান কার্যক্রমে। শুধু ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লিখে দিয়ে ক্ষান্ত হতে না, ওষুধগুলোর মূল্য বলে দিয়ে সেগুলো রোগীরা কিনতে পারবে কিনা সে খোঁজটা নিতে ভুলতে না। রোগী অসমর্থ হলে, নিজ পকেট থেকে টাকা বের করে রোগীদের দিয়েছো। পকেটের টাকা দিতে দিতে শেষ হয়ে গেলে ধরনা দিতে আমার কাছে, মার কাছে-‘এ্যাই একটু চাল দিয়ে দাও না, বিক্রি করে ওষুধটা কিনুক।’ এমন কতবার হয়েছে।
কেমন ছিল তোমার ব্যক্তিগত জীবন? এগুলো বললে কারো কারো কাছে গল্প বলে মনে হবে। পরিবারের প্রতি তোমার যত্ন-খেয়াল ছিল অপরিসীম। আমার নিজের প্রায়ই ঠাণ্ড লেগে থাকতো। নিজের ছোট্ট মেয়ে দুটিকে গোসল দিতে পারতাম না। তুমি দুপুরবেলা অফিস থেকে ফিরে ওদের নিজ হাতে গোসল করিয়ে দিতে, পরিচারকদের দিয়ে করাতে না; তোমার আশঙ্কা ছিল ওরা
২০৬ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. ক্যাপ্টেন বদিউল আলম চৌধুরী
সঠিকভাবে করতে পারবে না। ওদের গোসল করিয়ে কাপড়-চোপড় পরিয়ে সাইকেলে ওঠাতে। কিছুক্ষণ সাইকেলে চড়িয়ে তারপর খাবার টেবিলে নিয়ে বসতে। নিজের খাবার আগে ওদের মুখে খাবার তুলে দিতে। কখনো কখনো নিজেও একটু একটু খেয়ে ওদেরকেও খাওয়াতে।
আরেকটা বিষয় বলতে লজ্জাই লাগছে। তুমি অফিস থেকে মালীকে দিয়ে একটা ছোট বেলিফুলের মালা তৈরি করে আনতে। একদিনও বাদ দিতে না তুমি। সেই মালা নিজ হাতে আমার খোঁপায় পরিয়ে দিতে। তারপর মেয়েদের নিয়ে আমরা বেড়াতে বেরুতাম। হায় মন! আজও বেলিফুলের কোনো গাছ দেখলে আমি অপলক চোখে তাকিয়ে থাকি। বড় করে শ্বাস নিয়ে সুবাসটা নিই।
২৯ মার্চ ১৯৭১। তোমাকে হারানোর পূর্বদিন। তখন আমরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের কোয়ার্টারে। প্রচুর গোলাগুলি হচ্ছে। বিকেলবেলা এক ফাঁকে বাসার সামনে চা খেতে বসেছি, হঠাৎ একটা গোলাপ গাছের দিকে তোমার চোখ পড়লো। গাছটা শুকিয়ে গেছে, খুবই ম্রিয়মাণ। বাগানে মালিই পানি দিয়ে থাকে। তোমাকে কখনো দিতে দেখিনি। তখন কেন যেন তুমি নিজেই পানি আনতে ঘরে চলে গেলে। আমার নিষেধ শুনলে না। বালতি দিয়ে পানি এনে গোলাপ গাছটার গোড়ায় ঢেলে দিলে। বাঁচাতে চেয়েছে সবকিছু। কিন্তু নিজেই বাঁচতে পারলে না।
গোলাগুলির শব্দে রাতে আমরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারলাম না। ৩০ মার্চ ১৯৭১। তুমি ভোরে ওঠে গেলে। আমাকে উঠতে দিলে না। শীতের সকাল। নিজ হাতে পানি চুলায় গরম করতে দিলে। নিজের জন্য এক পাতিল। আমার জন্য আরেকটা। পরিচারকরা ঘুমাচ্ছে। ওদের ঘুমাও ভাঙলে না। নিজে গোসল সেরে আমাকে ডেকে তুললে, ‘এ্যাই, নাশতা করতে এসো।’ আমি বললাম, ‘নাশতা তো তৈরি হয়নি!’ তুমি বললে, ‘টেবিলে আসো না দেখি।’ আমি টেবিলে গিয়ে দেখি নাশতা টেবিলে পরিবেশন করা। তুমিই নাশতা তৈরি করেছে। সেমাই রেঁধেছো, ডিম রেঁধেছো। তৃপ্তি করে খেলাম।
তুমি আমাকে গোসলে যেতে বললে। আমি বললাম, পরে করবো। তুমি বললে, ‘না, আমি চলে গেলে তুমি দেরি করে ফেলবে।’ আমাকে ঠেলে গোসলে পাঠালে।
ইউনিফর্ম পরে অফিসের উদ্দেশে বেরুলে। নিজের মোটর সাইকেলে গিয়ে বসলে। কিন্তু সাথে সাথেই আবার ঘরে ফেরত এলে। বললে, ‘আজকে একদম ভালো লাগছে না। কেমন যেন লাগছে। রুবিনাকে একটু নিয়ে এসো তো।’ রুবিনা আমাদের ছোট মেয়ে। মাত্র এক মাস বয়স। কম্বল গায়ে গভীর ঘুমে। আমি কম্বল সহাই ওকে এনে তোমার কোলে দিলাম। তুমি ওকে আদর করলে। তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলে। অনন্তের পথে। সেটাই যে তোমার অগস্ত্যযাত্রা তা কে জানত?
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থনকারী বাঙালি অফিসার-সিপাহিদের প্রতি তোমার অকুণ্ঠ সহমর্মিতা ও সহযোগিতা ছিল। তাদের কয়েকজনকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যেতেও সহায়তা করেছিলে। চিকিৎসা সেবা প্রদানের অজুহাতে কুমিল্লা পুলিশ লাইনে গিয়ে অনেক পুলিশকে তুমি ব্যারাক থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্যে করেছিলে। মুক্তিযুদ্ধের জন্য তোমার এমন তৎপরতা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের কাছে অজানা ছিল না। তাদের হিংস্ৰ নারকীয় প্রতিশোধস্পৃহার পরিচয় দিল অবিলম্বেই। মুক্তিযুদ্ধের ঊষালগ্নেই তারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ।
৩০ মার্চ সকালে সেই যে তুমি বাসা থেকে ভগ্নমনোরথে বেরিয়ে গেলে; আর ফিরে এলে না।
পরবর্তীকালে তোমার হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী নরসুন্দর রমণী মোহন শীলের কাছে শুনেছি, তোমাকেসহ ডা. লে. কর্নেল নূরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গার, ডা. ক্যান্টেন এ কে এম ফারুক, ডা. সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এ জেড এম খন্দকার নুরুল ইমাম তুর্কী প্রমুখকে ২৪ এসএফ মেসে সকাল থেকে নিয়ে বন্দি করে রাখে। বিকেলের দিকে তোমাদের সবাইকে নিয়ে ব্রিগেড অফিস প্রাঙ্গণের একটু দূরে গর্তের পাশে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে। নরপশুরা তোমাদের কবরও দেয়নি, গর্তের ভেতরে মাটি চাপা দেয়। তারপর বুলডোজার দিয়ে মিশিয়ে ফেলে। সেই সাথে তুমি মিশে গেলে বাংলার মাটি, নদী আর আকাশের সাথে। বাংলার মাটির গন্ধে, নদীর স্রোতে, আকাশের মেঘে তুমি রয়েছ চির জাগরূক।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২০৭
শহীদ ডা. ক্যাপ্টেন বদিউল আলম চৌধুরী
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৭০৭।
ঘ. প্রথম পুনর্মিলনী স্মরণিকা, আর্মি মেডিকেল কোর; প্রকাশনাঃ আর্মি মেডিকেল কোর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী; প্রকাশকালঃ ১৩৯৫ বাংলা, ১৯৮৯ ইংরেজী।
২০৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ