জীবনচিত্র নামঃ ডা. লে. কর্নেল বদিউল আলম চৌধুরী
Dr. Lt. Col. Badiul Alam Choudhury
ডাকনামঃ বদু
ভাইবোনের সংখ্যাঃ এক ভাই ও দুই বোন; নিজক্রোম-দ্বিতীয়
ধর্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম/বাড়ি-চৌধুরী বাড়ি, শিথলাই,
উপজেলা-বীরগঞ্জ, জেলা-দিনাজপুর
শহীদ ডা. লে. কর্নেল বদিউল আলম চৌধুরী
নিখোঁজ হওয়ার সময় ঠিকানাঃ অফিসার্স কোয়ার্টার, চট্টগ্রাম সেনানিবাস, চট্টগ্রাম
নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১
মরদেহঃ পাওয়া যায়নি
স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ শহীদ বদিউল আলম সড়ক, চট্টগ্রাম সেনানিবাস। বিএমএ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি
স্ত্রীর নামঃ মাহমুদা বেগম
সন্তান-সন্ততিঃ দুই পুত্র ও দুই কন্যা
স্থপতি মুজাহিদ আলম চৌধুরীঃ বিএআর (বুয়েট), বিডিসি, ঢাকা ডা. জিনাত ইয়াসমিন আলমঃ এমবিবিএস, এমআরসিপি, অনকোলজিস্ট, কানাডা
সাবিহা আক্তারঃ এমএ (অর্থনীতি), চবি, এম এস (অর্থনীতি), ব্যবসায়ী, কানাডা
তানভীর আলম চৌধুরীঃ ব্যাচেলর অফ কমার্শিয়াল ফ্লাইং লাইসেন্স, কম্পিউটার প্রোগ্রামার, ব্যবসায়ী, ঢাকা
তথ্য প্রদানকারী
জেসমিন ফেরদৌস চৌধুরী
শহীদ চিকিৎসকের পুত্রবধু
বাড়ি নং-১৩, রোড ১৩/এ(নতুন), ধানমন্ডি
আ/এ, ঢাকা
২০০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
আমার বাবা
শহীদ ডা. লে. কর্নেল বদিউল আলম চৌধুরী
তানভির আলম চৌধুরী
আমি তখন বেশ ছোট, কিছু কিছু বিষয় বুঝতে শিখেছি। সে সময় পাকিস্তানের পেশোয়ারে আমার বাবা, শহীদ লে. কর্নেল বদিউল আলম চৌধুরী এএমসি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন থেকেই আমার বাবার মধ্যে লক্ষ্য করেছি যে, বাঙালিদের প্রতি তাঁর রয়েছে বিশেষ দুর্বলতা। সামরিক বাহিনীতে চাকরি করা সত্ত্বেও বাঙালিদের প্রতি তাঁর গভীর সহানুভূতি ও মমতা ছোট ছোট ঘটনা থেকেই স্পষ্ট উপলব্ধি করা যেতো। কোনো বাঙালি ছেলে পাকিস্তান সামরিক, বিমান বা নৌবাহিনীতে যোগদান করতে সুদূর পাকিস্তানে এলে পাকিস্তান সরকারের নীতি অনুযায়ী নানারকম কৌশলগত কারণ দেখিয়ে তাদের বিদায় করে দেয়া হতো। কিন্তু আমার বাবা এই জাতীয় কার্যকলাপ লক্ষ্য করলেই তিনি তাঁর উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে রীতিমতো তর্ক করে তাদের যোগদান করতে দিতে বাধ্য করতেন। তাঁর এই বাঙালিপ্রীতির কারণেই তাঁকে কোনো একস্থানে বেশিদিন রাখা হতো না। এমনকি মেডিকেল অফিসার হওয়ার কারণে, সামরিক বাহিনীর রীতি অনুসারে বিভিন্ন বিভাগে তাঁকে বারবার বদলি করা হতো। তিনি যখন ঢাকাস্থ ‘বিমান বাহিনী মেডিকেল ইউনিটে’ কার্যরত ছিলেন, তখন লক্ষ্য করেছিলেন যে, পাকিস্তানের বেসামরিক পাইলট নিয়োগে পূর্ব পাকিস্তানের কোটা থেকে পাঞ্জাবি তথা অবাঙালিদের সুযোগ দেয়া হতো। ঐ ইউনিট থেকে আমার বাবা মেডিকেল অফিসার হিসেবে এই জাতীয় পাইলটদের মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতেন। তখন আমি দেখেছি যে, এসব ক্ষেত্রে তিনি কোনো অবস্থায় অবাঙালিদের ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতেন না। অন্যদিকে ‘রিক্রুটিং টিমে’ মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় কোনো পশ্চিম পাকিস্তানি যেন রিক্রুট হতে না পারে তিনি সে চেষ্টা করতেন। এসব কারণে, বিমান বাহিনীর মেডিকেল অফিসার থাকাকালে যদিও মেডিকেল অফিসারদের পদোন্নতির পরীক্ষা দিতে হতো না, কিন্তু তাঁকে বারবার পরীক্ষা দিতে বলা হতো। তবে আমার বাবা প্রতিবাদস্বরূপ। কখনোই এসব পদোন্নতির পরীক্ষায়
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২০১
শহীদ ডা. লে. কর্নেল বদিউল আলম চৌধুরী
অংশগ্রহন করেননি। এই কারনে তাঁর নিম্নপদস্থ বহু পশ্চিম পাকিস্তানি তাঁকে ডিঙিয়ে পদোন্নোতি লাভ করে। অবশেষে তাঁকে বিমান বাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে বদলি করে পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ সেনানিবাস কোয়েটা সামরিক হাসপাতালে কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এখানেও আমার বাবার বাঙালিপ্রীতির কারণে তাঁকে কাজে নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল।
সামরিক বাহিনীতে প্রতিবছর ‘বড়খানা’ উৎসব হতো। এরকম ‘বড়খানা’র একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে একের পর এক শুধু উর্দু গান, গজল পরিবেশিত হচ্ছিল। এমনি সমেয়ে আমার বাবা বিষয়টিকে বাঙ্গালীদের প্রতি ঘৃণার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে উত্তেজিত এবং বাংলা গান পরিবেশনে পাঞ্জাবি সামরিক কর্মকর্তাদের বাধ্য করেন। এসব কারণ ও পাঞ্জাবিদের আক্রোশগত কারণে তিনি মানসিক ও শারীরিক দিক দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন; তাঁর মধ্যে হৃদরোগের লক্ষণ দেখা দেয়। তিনি চট্টগ্রাম সামরিক হাস্পাতালের কমান্ডিং অফিসার হওয়ার সত্ত্বেও, পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করেন এবং ঢাকায় চলে আসেন। উল্লেখ্য, এই সময়টা ছিল বাঙালিদের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময়। কারণ এসময় অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। ঐ সময়ে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের কোনো সামরিক হাসপাতালে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ছিল না, ছিল তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের হাসপাতালে।
ইতোমধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের লড়াইয়ের প্রস্তুতি তিব্রতর হতে শুরু করেছে। সময় ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। তিনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে, চট্টগ্রাম সামরিক ছাউনিতে বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের কালো ছায়া নেমে আসতে পারে। সেজন্য আমাদের শত বাঁধা সত্ত্বেও এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের তোয়াক্কা না করে ১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ তিনি অসুস্থ শরীরেই সপরিবারে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফিরে যান এবং স্টেশন কমান্ডারসহ উচ্চপদস্থ বাঙালি কর্মকর্তাদের সাথে পরোক্ষভাবে বাঙালিদের অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপারে গোপনে গোপনে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। এই জাতীয় কয়েকটি বৈঠক আমাদের বাসায় হয়েছিল। ঐ সময় যেসব বাঙালি কর্মকর্তাকে আমাদের বাসায় দেখেছিলাম তাঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে উঁচু পদে আসীন হন।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ যখন বাংলাদেশের বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থা, তখন আমার এক দুলাভাই কুমিল্লা সেনানিবাসে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আমার বাবা আমার মাকে কুমিল্লা পাঠিয়ে দিলেন। এই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানীরা চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বাঙালি অফিসারদের রাখা নিরাপদ মনে না করায় একজন পাঞ্জাবি অফিসারকে ‘স্টেশন কমান্ডার’ হিসেবে প্রেরণ করে এবং বাঙালি স্টেশন কমান্ডারকে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়। তখন আমার বাবারসহ অন্যান্য বাঙালি অফিসার পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে, ভয়াবহ কিছু একটা দু’একদিনের মধ্যে ঘটতে যাচ্ছে। অবশেষে এলো সেই ভয়াবহ ২৬ মার্চের ভোররাত। রাত আটটা থেকে প্রচন্ডভাবে কামানের গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এসব বাঙালি অফিসার কিছু প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই ঐ রাতে সবাইকে পরিবারসহ রাইফেলের মুখে গ্রেফতার করে এনে রাত বারোটা থেকে একটি খোলা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তাঁদের চারদিকে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে অত্যন্ত সতর্কতাবস্থায় ঘিরে রাখা হয়। এই মরণ লাইনে, আমার বাবার সাথে আমার বড় বোনসহ(তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী) সবাইকে হাত উঠিয়ে এক অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। পড়ে একটি সংক্রামক ব্যাধির ওয়ার্ডে, যা ছিল বেড়ার, সেখানে প্রায় দু’তিনশ’ লোককে গাদাগাদি করে বন্দি অবস্থায় রাখা হয়। এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে সভ্যজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় প্রায় বিশ-বাইশ দিন ছিলাম।
এরপর একদিন। তারিখ ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল, বাবাসহ আরও তিনজন-ডা. মেজর রেজাউর রহমান (শহীদ চিকিৎসক), মেজর কামাল উদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন মাহমুদকে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় পাঞ্জাবি সৈন্যরা বন্ধুকের নল উঁচিয়ে বাইরে নিয়ে যায়। তখন আমাদের বলা হয়েছিল যে, স্টেশন কমান্ডার সার্কিট হাউসে কথা বলতে তাঁদের ডেকেছেন, কিন্তু ঐ যে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো, আদ্যবধি আমার বাবাকে আর কোনোদিন ফিরে পাইনি। লোকমুখে যতদূর জানতে পেরেছি, আমার বাবাকে ঐ দিন চোখ-হাত-পা বেঁধে
২০২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. লে. কর্নেল বদিউল আলম চৌধুরী
কর্ণফুলী ব্রিজের ওপর পাঞ্জাবি সৈন্যরা বেয়নেট চার্জ করে। কিন্তু তাতেও মারা না যাওয়ায় গুলি করে পানিতে ফেলে দেয়। এ কারণে আমরা তাঁর মৃতদেহেরও কোনো হদিস পাইনি।
আমার বড় ভাই মুজাহিদ (তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র) সেনানিবাসের ২৩ দিনের বন্দিদশায় দু’বার ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি হন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে পরিচিতজনের সৌজন্যে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন এবং মুক্তিও পেয়ে যান। ঢাকায় ফিরে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সাশস্ত্র ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্যে সীমান্তের ওপারে চলে যান। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
আমি পুত্র হিসেবে এবং আমার ভাইবোনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সব বিবেকবান মানুষের কাছে প্রশ্ন রাখি যে, বাঙালিদের যে বৃহত্তর স্বার্থে বাবা আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেলেন, যে কারণে মৃতুবরন করলেন, শহীদ হলেন, সেই কারণগুলো কি বাংলাদেশে আজও বাস্তবায়িত হয়েছে?
(*রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ১৯৭১ থেকে সঙ্কলিত)
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
ঘ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৭০৭।
ঙ. প্রথম পুনর্মিলনী স্মরণিকা, আর্মি মেডিকেল কোর; প্রকাশনাঃ আর্মি মেডিকেল কোর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী; প্রকাশকালঃ ১৩৯৫ বাংলা, ১৯৮৯ ইংরেজী।
চ. *স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ৫ম খণ্ড, ১ম পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪০২, ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬; পৃ. ৪০।
জ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৯, ৪৩।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২০৩
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ