You dont have javascript enabled! Please enable it!

জীবনচিত্র           নামঃ ডা. লে. কর্নেল নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

Dr. Lt. Col. Nurul Absar Mohammad Jahangir

ডাকনামঃ বাদশা

পিতার নামঃ ডা. আব্দুল কাদের

পিতার পেশাঃ চিকিৎসক

মাতার নামঃ জাহানারা বেগম

ভাইবোনের সংখ্যাঃ চার ভাই ও দুই বোন, নিজক্ৰম-প্রথম

স্থায়ী ঠিকানাঃ বাড়ি-শোলাকুড়া হাউজ, ওয়ার্ড নং ৩

(নারায়ণপুর), ডাকঘর/উপজেলা-পাংশা, জেলা-রাজবাড়ী-৭৭২০

 

শহীদ ডা. কর্নেল নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

 

নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ কমান্ডিং অফিসার, ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের বাসভবন, ডাকঘর-কুমিল্লা সেনানিবাস, জেলা-কুমিল্লা

জন্মঃ মে, ১৯৩১, রাজবাড়ী

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ

ম্যাট্রিকঃ ১৯৪৪, প্রথম বিভাগ, পাংশা জর্জ হাই স্কুল, রাজবাড়ী

আইএসসিঃ ১৯৪৬, প্রথম বিভাগ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা

এমবিবিএসঃ ১৯৫৩, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

Graded specialist in chinical pathology: ১৯৬৩, Walter Reed Army Medical Institute, Washiagton DC, USA

সমাজসেবাঃ ছাত্রাবস্থায় মুকুল ফৌজ

চাকরির বর্ননাঃ

আর্মি মেডিকেল কোর, পাকিস্তান, ১৯৫৩

পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মির, পিন্ডি, শিয়ালকোট, মালি প্রভৃতি স্থানে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত

লে. কর্নেল, কমান্ডিং অফিসার, ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সঃ এ. এম. সি, কুমিল্লা সেনানিবাস, ১৯৭০ আমৃত্যু

প্রেসিডেন্টঃ সামরিক আদালত, চট্টগ্রাম বিভাগ, ১৯৭০

নিহত/নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ২৮ মার্চ ১৯৭১

মরদেহঃ

প্রাপ্তি স্থানঃ কুমিল্লা সেনাসদর দপ্তরের পেছনের পাহাড়

প্রাপ্তি তারিখঃ মার্চ ৭২

সন্ধানদানকারী পরিচয়ঃ ডা. ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খুরশিদউদ্দিন

কবরস্থানঃ কুমিল্লা সেনানিবাস

স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ কুমিল্লা সেনানিবাসের ৪০, ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের(বর্তমানে ৫, ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স) সিএমএইচে একটি স্মৃতিসৌধ আছে। এছাড়া বিভিন্ন স্মৃতিফলকে নাম লেখা আছে। যেমন-কুমিল্লা শহীদ স্মৃতি জাদুঘর, ঢাকা সেনানিবাসের স্টাফ রোড গেট, বিএমএ ইত্যাদি

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি

স্ত্রীর নামঃ জেবুন নিসা জাহাঙ্গীর

বিয়েঃ ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭

সন্তান-সন্ততিঃ দুই পুত্র ও এক কন্যা

মারুফ জাহাঙ্গীরঃ এমবিএ । নর্থ কেরোলিনা, ইউএসএ কর্মরত

ডা. মারগুব আরেফ জাহাঙ্গীরঃ এমবিবিএস, এমপিএইচ। উপ-পরিচালক, আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রকল্প, স্থানীয় সরকার বিভাগ

উজমা শাগুফতা জাহাঙ্গীরঃ বিএ

 

 

তথ্য প্রদানকারী

ডা. মারগুব আরেফ জাহাঙ্গীর

শহীদ চিকিৎসকের পুত্ৰ

১৬, নউ ইস্কাটন(২য় তলা)

গাউস নগর, ধাকা-১০০০।

 

 

১৮৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

 

আমার বাবা

শহীদ ডা. কর্নেল নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

ডা. মারগুবি আরেফ জাহাঙ্গীর

 

মার্চ ১৯৭১-এর প্রথম থেকেই সারা দেশে স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন চলছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মানুষ রাজপথে নেমেছিল। অসহযোগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনারাও আন্দোলনের পক্ষে তাদের সমর্থন দান করেন। সবার মাঝে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তাদের অধিকার চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছিল। আমার বাবা ডা. লে. কর্নেল এন এ এম জাহাঙ্গীর এর ব্যতিক্রম ছিলেন না এবং বোধের ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে হয়তো-বা কিছুটা এগিয়ে ছিলেন।

আগস্ট ১৯৭০ চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশেষ সামরিক আদালতের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি দেখলেন ‘মার্শল ল’ কোর্টের প্রায় সব মামলাই অমুসলিম আর আওয়ামী লীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাজানো। ফলে প্রাপ্ত নথিপত্র পরীক্ষাপূর্বক আসামিদের বেকসুর খালাস মঞ্জুর করেন। বেকসুর খালাসপ্রাপ্তদের মাঝে বহুল আলোচিত পাকিস্তানের পতাকায় অগ্নিসংযোগ মামলার আসামি মরহুম এম এ আজিজ ও অমূল্য বিকাশ সেনের নাম উল্লেখযোগ্য। এ কারণে আব্বা উৰ্ব্বতন পাকিস্তানিদের কাছে বিরাগভাজন হয়ে পড়েন।

অধিকন্তু ১২ নভেম্বর ১৯৭০-এর মহাপ্রলয়ঙ্করী বন্যা ও জলোচ্ছাসের পর নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও বরিশাল জেলার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ত্রাণকাজে থাকাকালীন পশ্চিমাদের সূক্ষ্ম কারচুপি লক্ষ্য করেন এবং ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। এর ফলেও তিনি সিনিয়র অবাঙালি কর্মকর্তাদের প্রচণ্ড ক্ষোভ ও রোষানলে পড়েন। কাজেই তারা মার্চের শুরু থেকেই তাঁকে নজরবন্দি করে রাখে।

 

২৫ মার্চ ১৯৭১

এদিন বিকেলে কুমিল্লা সেনানিবাস অফিসার্স ক্লাবে প্রবেশ করার পরই আমার বাবা চারিদিকে একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ আঁচ করতে পারেন। ক্লাবে উপস্থিত

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১৮৫

 

শহীদ ডা. কর্নেল নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

 

অবাঙালি অফিসার নিজেদের মধ্যে কানে কানে কথা বলছে এবং একটা উত্তেজনা চেপে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমার বাবা ক্লাব ত্যাগ করতে চাইলে, কুমিল্লাস্থ সেনানিবাসের তৎকালীন স্টেশন কমান্ডার পশ্চিমা ব্রিগেডিয়ার শফী তাকে বাধা দেয়। পরে ৬ জন মিলিটারি পুলিশ এসকর্ট করে তাকে বাসায় পৌছে দেয় এবং রাতেই বাসার চারিদিকে আর্মিগার্ড পজিশন নেয়। আমাদের স্বাভাবিক চলাচলের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

 

২৬ মার্চ ১৯৭১

আমার বাবাকে হেডকোয়ার্টারে ডেকে পাঠিয়ে কর্নেল ওসমানীর (পরে জেনারেল ও সম্মিলিত মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক) সাথে তাঁর সংশ্ৰব আছে কিনা বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর কোনো আত্মীয়তা বা জানাশোনা আছে কিনা এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কারণ আমার বাবা ও বঙ্গবন্ধু দু’জনেরই দেশের বাড়ি বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায়। উল্লেখ্য, দুই ব্যক্তির সাথে তাঁর কোনো রকমের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা অস্বীকার করলেও তিনি পাকবাহিনীর কর্মকর্তাকে তা বিশ্বাস করাতে পারেননি। তিনি দৃঢ়তার সাথে সেদিন বলেছিলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান ও ওসমানী বাঙালি জাতীয়তাবাদের নেতা এবং তিনি নীতিগতভাবে তাদের সমর্থন করেন। তখনো আমরা জানি না যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং ঢাকার ইতিহাসে, জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে।

 

২৭ মার্চ ১৯৭১

সকালবেলা ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের ইউনিটে নির্দেশ দেয়া হলো যেন তাঁরা তাদের ইউনিটের সব অস্ত্র জমা দেয়অধিনায়ক হিসেবে আমার বাবা এই নির্দেশনামা গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি সামান্য কিছু অস্ত্ৰ জমা দিয়ে বাকি অস্ত্ৰ লুকিয়ে ফেললেন। তিনি তাঁর সাথীদের বললেন, ‘মৃত্যু যদি অনিবার্য হয়, তবে তোমরা তোমাদের হাতের শেষ অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে মৃত্যুবরণ করো, কিন্তু আত্মসমর্পণ করে নিজেদের ও দেশকে কলঙ্কিত করো না।

তিনি আত্মসমর্পণের পথ তথা দাসত্বের পথ বেছে নেননি যা তাঁকে কখনও করতে দেখিনি। এদিকে ঐ দিনই বিকেল প্রায় ৪টার সময় পাকবাহিনী কুমিল্লা শহরে পুলিশ লাইন ও অন্যান্য স্থানে বর্বর হত্যাকাণ্ড চালায়।

 

২৮ মার্চ ১৯৭১

তিনি ঐ দিন ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য স্থানে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু টেলিফোন বিকল ছিল, তিনি কুমিল্লা শহরে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সেই সময় রেডিও, টিভি ও খবরের কাগজ বন্ধ ছিলফলে কোথায় কী হচ্ছে আমরা বুঝতে বা জানতে পারছিলাম না।

 

২৯ মার্চ ১৯৭১

২৯ মার্চ প্রায় বেলা ২টার সময় একজন পশ্চিম পাকিস্তানি সেপাই হামাগুড়ি দিয়ে টিলা সংলগ্ন ঝোপের ভেতর দিয়ে উঠে এসে আমাদের বাসার সামনের দরজায় এসে কড়া নাড়া দিতে লাগল। আমি দরজা খুলে দিতেই সে ভেতরে প্রবেশ করে আতঙ্কগ্ৰস্ত কণ্ঠে বললো, ‘কর্নেল সাহেবকে পালিয়ে যেতে বলুন, সেনাবাহিনীর সব বাঙালি অফিসার ও সেপাইদের মেরে ফেলার হুকুম হয়েছে।’ আমি ভয়ে-আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়লামপশ্চিমা সেপাইটি আর দাঁড়াল না। আমাকে কথাগুলো বলেই সে ঝড়ের বেগে প্রস্থান করলো। বিকেল ৩টার সময় আমার বাবা লে.কর্নেল জাহাঙ্গীর বাসায় ফিরলেন। এর আগেই তিনি একটা ব্যাগে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও আমার ছোট্ট বোনটির দুধের টিন ভরে রাখতে বলেছিলেন। তিনি ঘরে আসতেই আমি এক নিশ্বাসে পশ্চিমা সেপাইটি যা বলে গিয়েছিলেন সবই বাবাকে খুলে বললাম এবং এখান থেকে অবিলম্বে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বাবাকে পীড়াপীড়ি করতে লাগিলাম; কিন্তু বাবার ভেতরে কোনো চঞ্চলতা দেখলাম না। আমাকে শান্ত করে অত্যন্ত ধীর কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আমি কেমন করে পালাবো? এতোজন বাঙালি সেপাই, তাদের ছেড়ে আমি কেমন করে পালাবো? ওদেরকে আমি পালানোর জন্য বলেছি; কিন্তু ওরা আমার জন্য পালায়নি।

 

 

১৮৬ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

শহীদ ডা. কর্নেল নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

 

ওদেরকে একলা এই বিপদের মাঝে রেখে আমি কী করে পালাবো?’ এর কিছুক্ষণ পর বাবা গাড়িযোগে নিজের অফিসের দিকে রওনা দিলেন। আমি পথে আর্মিগার্ড বাবাকে বাঁধা দেয়ায় তিনি বাধ্য হয়ে ফিরে এলেন। ফিরে এসে বাবা তাঁর টাকা-পয়সা কোথায় আছে-এ সম্পর্কে কিছু কথা বলে আবার তাঁর ইউনিটের দিকে রওনা হন। কিন্তু এবারও তিনি ব্যর্থ হন। বাবা রওনা হওয়ার পরপরই আর্টিলারিগান ও মেশিনগানের তীব্র আওয়াজে চারদিকে ভরে উঠলো। আমি ভয়ে অস্থির হয়ে পড়লাম। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আর্টিলারিগানের কীভাবে ফায়ার হয় তাই দেখছিলাম। বাবা ফিরে আসতে এই দৃশ্য তার চোখে পড়তেই তিনি আমাদের ভেতরে নিয়ে এলেন, তারপর ফোনে নিজের অফিসের সাথে যোগাযোগ করলেন। জিগ্যেস করলেন, ‘কোথায় শেলিং হচ্ছে?’ এরপর আরো দু’চারটি কথা হলো। হঠাৎ দেখলাম বাবার মুখটা কঠিন হয়ে এলো। বাবা ফোনের রিসিভারটি শক্তি হাতে ধরলেন এবং বললেন, ‘ওরা যদি তোমাদের ওপর মেশিনগান ব্যবহার করে তোমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে মার খেও না, তোমাদের হাতে যে অস্ত্ৰ আছে তা দিয়ে যুদ্ধ করো। দেশের জন্য যুদ্ধ করে শহীদ হওয়ার চাইতে বড় গৌরব আর কিছুই নেই।’ এরপর আর কোনো কথা হলো না, মনে হয় লাইনটা কেটে গেল। ধীরে ধীরে ফোনটা রেখে দিলেন আমার বাবা।

স্বাধীনতার পর জানা যায় যে, ঐ দিন ২৯ মার্চ ১৯৭১, ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের বীর বাঙালি সৈনিকরা যুদ্ধ করে। তিনজন বাদে সব বাঙালিসেনা শাহাদাতবরণ করেন। তাঁরা প্রায় ২ ঘণ্টাকাল লড়াই করেন; কিন্তু পরে ট্যাঙ্ক, মর্টার, কামানের সমর্থনপুষ্ট পাকবাহিনীর আক্রমণে পরাজিত হন। অপরদিকে পাকবাহিনীর প্রায় ১০০ সৈন্য মারা যায়।

একই সময়ে আমাদের বাসস্থানেও কামানের গোলা আঘাত হানে। আমরা সবাই সাথে সাথে পাহাড়ে নিচে আর এক বাঙালি অফিসারের বাসায় আশ্ৰয় নিই এবং রাতটা ওখানে কাটাই|

 

৩০ মার্চ

সকাল পৌনে সাতটা হবে, আমরা যে বাসায় আশ্রয় নিয়েছি সেখানে এসে উপস্থিত হলো একটি জিপসহ পাকবাহিনীর দু’জন সেপাই। সেপাইরা জানালো উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে তারা আমার বাবাকে এসকর্ট করে নিয়ে যেতে এসেছে। বাবা বুঝলেন বিপদের সময় উপস্থিত। এটাই বুঝি আপনজনদের সাথে শেষ দেখা! বাবা আমদের সব ভাইবোনকে আদর করলেন, তারপর বাবা মায়ের সামনে এলেন। মায়ের হাতে তুলে দিলেন তাঁর নিজের কাছে রাখা শেষ অস্ত্র ০.৩২ রিভলবারটি। আবেগ বাইরে প্রকাশ করলেন না। বরং শান্তভাবে মায়ের চোখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ভয় পেও না। সঙ্কটে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়; তবে প্রয়োজনে অস্ত্রটির সদ্ব্যবহার করো।’ বাবা আমাদের সাথে আর বেশি কথা বলার সময় পাননি, পাকসেনারা বাবাকে নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে আমার মাকে দৃঢ়তার সাথে আবারও বলে গেলেন, ‘ভয় পেও না।’

সকাল ৯টা হবে, সকালের ঘটনার ঘোর তখনো কাটেনি আমাদের। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠলো। মা কাঁপতে কাঁপতে রিসিভার তুললেন, অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো আমার বাবার কণ্ঠস্বর। তিনি জানালেন, ৫৩ আর্টিলারি রেজিমেন্টের অবাঙালি কর্নেল ইয়াকুব মালিক এক কনফারেন্সে তাঁকে নিয়ে যেতে এসেছে এবং তিনি তখনই তার সাথে রওনা দিচ্ছেন। এই মায়ের সাথে বাবার শেষ কথা। তারপর আমরা বাবার আর কোনো খোঁজ পাইনি। এরপরই মাকেসহ আমাদের অন্যান্য বাঙালি পরিবারের সাথে ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলে বন্দি করা হয়। সেখানে আমাদের দিন কেটেছে চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। বাবার খবরের জন্য সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি, কিন্তু শ্বাসরুদ্ধকর সে পরিবেশে কার খোঁজ কে দেবে বা নেবে। আমার ছোট ভাই এবং মাত্র কয়েক মাসের ছোট্ট বোনটি কোনাদিন খাচ্ছি তো কোনাদিন খাওয়া পাচ্ছি না। এভাবে দিন কাটাচ্ছিলাম। এমনি সময়ে একদিন পাকবাহিনীর কর্নেল ইয়াকুব মালিক এলেন পাবলিক স্কুলে বন্দিদশায় অবস্থানরত বাঙালি পরিবারবর্গকে দেখতে। আমার মা সাহস করে এগিয়ে গেলেন তার কাছে, যদি তিনি আমার বাবার কোনো খবর দিতে পারেন; কিন্তু আমার বাবার নাম শুনতেই চোখমুখ লাল হয়ে উঠলো কর্নেল ইয়াকুবের। পড়ে হত্যাকারীর যেভাবে বলে থাকে সেভাবেই শীতল গলায় বললো, জাহাঙ্গীর একজন বিদ্রোহী। সে পাকিস্তানিদের ধ্বংস কামনা করতো। এমনকি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুর মুখামুখি দাঁড়িয়েও সে

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১৮৭

 

শহীদ লে. কর্নেল ডা. নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

 

(১৯৭২ সালে ‘দৈনিক বাংলার বাণী’র ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’

শীর্ষক বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত

শহীদ ডা. লে. ক. নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী

(মরহুম) জেবুননিসা জাহাঙ্গীর সাক্ষাৎকার; সাক্ষাৎকার

গ্রহনে শামসুল হক আলীনূর)।

 

আমার হাতে একটা পিস্তল তুলে দিয়ে তিনি বললেন, ‘কর্নেল শাহনুরের বদলা হয়তো আমার ওপর থেকেই ওরা নেবে। তোমাকে আত্মরক্ষার জন্য পিস্তল দিয়ে গেলাম। ওরা তোমার ওপরেও আক্রমণ চালাতে পারে।

কথাগুলো বলেই তিনি বাইরে এসে দাঁড়ালেন। সশস্ত্র পাকসেনারা তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল। তারপর তিনি আর ফিরে আসেননি।’

পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীররের পত্নী মিসেস জেবুন্নেসা জাহাঙ্গীর বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে কথাগুলো বললেন,

‘বাংলার মাটি আর বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ। তা না হলে কেন এমন হবে? আমার স্বামী কোনো অন্যায় করেননি। তবু কেন ওরা আমার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করলো? তিনি বাঙালি—এটাই কি তার সবচেয়ে বড় অপরাধ?’ একটু থেমে থেমে কথা বলেছিলেন মিসেস জেবুন্নেছা জাহাঙ্গীর।

তিনি বলেছিলেন একাত্তরের ১৯ মার্চের একটি ঘটনা। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে উচ্চপদস্থ আর্মি অফিসারদের জরুরি কনফারেন্স।

আলোচনার বিষয়-বাংলাদেশের যুবসমাজকে সমূলে উৎখাত করতে হবেউক্ত কনফারেন্সে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি, লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিক, মেজর আগা বোখারী, মেজর সুলতানসহ (বেলুচ রেজিমেন্টের লোক) অনেক উচ্চপদস্থ পাক আর্মি উপস্থিত ছিল। সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো-বাংলার সংগ্রামী যুব সমাজকে এলোপাতাড়িভাবে হত্যা করা হবে; কিন্তু প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর। না, তা হতে পারে না, অসম্ভব। দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তিনি সেদিন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রখে দাঁড়িয়েছিলেন।

আর এরপর থেকেই কোনো কনফারেন্সে জনাব জাহাঙ্গীরকে ডাকা হতো না। তিনি যেতে চাইলেও তাঁকে ঢুকতে দেয়া হতো না। এর ক’দিন পর

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১৮৯

 

শহীদ ডা. কর্নেল নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

 

সাহেবজাদা ইয়াকুব আমার স্বামীকে ডেকে পাঠান এবং ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যেতে বারণ করেন। বললেন মিসেস জাহাঙ্গীর।

তারপর এলো ২৫ মার্চসেদিন রাত সাতটার দিকে ব্রিগেডিয়ার শফি লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরকে ডেকে পাঠান ক্লাবে। ক্লাব থেকে ফিরে এসে তিনি আমাকে জানান আজ রাতের বেলায় ওরা হয়তো বাঙালিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়বে। ওদের কথাবার্তায় তাই মনে হয়েছে। কথা শেষ না হতেই ক্যান্টনমেন্টে এলাকার বাতি নিভে গেল। রাতে আমরা আর ঘুমাইনি। শুধু মেশিনগান, কামান আর ট্যাঙ্কের শব্দে বারবার শিউরে উঠলাম। মাঝে মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মানুষের অসহায় চিৎকারও শুনতে লাগলাম। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আগুন দেখা গেল। আমার স্বামী আমাদের সান্তনা দিতে লাগলেন। ভোরবেলা দেখলাম আমাদের বাসার সম্মুখে আর্টিলারিগান বসিয়ে ওরা কয়েকজন বসে আছে, যেন আমরা বেরুতে না পারি।

লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর বুঝতে পারলেন তিনি বন্দি। আর তাই তিনি ফোন করে তাঁর ইউনিটের বাঙালি সৈনিকদের সুযোগ বুঝে পালিয়ে গিয়ে বাংলার মুক্তিসংগ্রামে শরিক হতে বললেন। দূরালাপনীতে তিনি তার ইউনিটের বাঙালি সৈনিকদের বললেন মরতে যদি হয় তাহলে বীরের মতোই মরো। আমি তোমাদের কাতারে এসে শামিল হচ্ছি। কথা শেষ করে ব্রিগেডে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাইরে এসে দাঁড়াতেই পশ্চিমা হানাদার বাহিনী তাঁকে বাধা দেয় এবং বলে-আপনার বাইরে যাওয়া চলবে না।

২৯ মার্চ রাতে ফোনে তিনি খবর পেলেন চট্টগ্রামের কুমিরায় যুদ্ধ করতে গিয়ে বাঙালি সৈনিকদের হাতে লে. কর্নেল শাহনুর নিহত হয়েছিলেন।

৩০ মার্চ খুব সকালে এক দল পাঞ্জাবি দানব বাসা থেকে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেল, যাওয়ার আগে আত্মরক্ষার জন্য তিনি আমাকে একটা পিস্তল দিয়ে গেলেন। এরপর আমি তাঁর আর কোনো খোঁজ পাইনি।

স্বামী নেই, ঘরে খাবার নেই। দুধের শিশু কাঁদছে, দুধ নেই। এক ফোঁটা পানিও নেই। ঘরের বাইরে গোলাগুলি চলছে। বাইরে বেরুবার পথ বন্ধ। এক ফোঁটাও পানির জন্য ছটফট করছে আমার সন্তান্রা। তবু দানবরা পানি দেয়নি। খাবার দেয়নি। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিসেস জাহাঙ্গীরআর ঠিক সেই সময় মিসেস জাহাঙ্গীরের ছোট ছেলে আরিফ বললো, পানির জন্য আমরা আল্লাহর কাছে কত কেঁদেছিতারপর থেকেই আল্লাহ্‌ বৃষ্টি দিয়েছেন। আর আমরা সেই বৃষ্টির পানি পান করেছি। পাত্রে জমিয়ে রেখেছি।

বৃষ্টি না হলে ছেলেমেয়েদের বাঁচানো যেত না, অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন মিসেস জাহাঙ্গীর।

এমনিভাবে ক’দিন অনাহারে কাটানোর পর নরপিশাচরা তাদের ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি স্কুলে আটক করে রাখে। সেই স্কুলে বাঙালি আর্মি অফিসার ও সৈনিকদের অনেক পরিবারকে আটকে রাখা হয়েছিল।

তারপর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মিসেস জাহাঙ্গীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে তিন শিশুসন্তান মারুফ (১৩), আরেফ (১০) ও দু’বছরের মিমির হাত ধরে বেরিয়ে এলেন।

তিনটি শিশুসন্তানসহ মিসেস জাহাঙ্গীর প্রাণে বাঁচলেন, কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না তার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে।

মিসেস জেবুন্নেসা জাহাঙ্গীর আমাকে জানান যে, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত অধিকাংশ বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে তাঁর স্বামী লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরসহ লেফটেন্যান্ট ফারুক, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন বদরুল আলম, মেজর ইসলাম, মেজর খালেক, মেজর মুহিদুল

 

১৯০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

 

শহীদ ডা. কর্নেল নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

 

 

 

 

 

 

জামালের নাম তাঁর স্মরণে আছে। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা লাভের পর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে অসংখ্য বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। সেসব বধ্যভূমি থেকে লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরসহ অগনিত বাঙালি আর্মি অফিসার ও সৈনিকদের নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয়।

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরের দেহাবশেষ সমাধিস্থ করেন।

 

প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ

 

ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।

খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)

গ. প্রথম পুনর্মিলনী স্মরণিকা, আর্মি মেডিকেল কোর; প্রকাশনাঃ আর্মি মেডিকেল কোর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীঃ প্রকাশকালঃ ১৩৯৫ বাংলা, ১৯৮৯ ইংরেজী।

ঘ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৬১৫, ৭০৭।

ঙ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট; প্রকাশনাঃ বাংলাদেশ ডাক বিভাগ; ৩য় পর্যায়; ১৯৯৪ ।(পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)

চ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ৫ম খণ্ড, ১ম পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪০২, ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬; পৃ. ৪০

ছ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল; প্রকাশনাঃ রক্তঋণ; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃ. ২৬।

জ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৪৩।

 

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১৯১

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!