You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
রাজনীতি ও রণকৌশলগত খসড়া দলিলের সংক্ষিপ্ত সার পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ১০ আগস্ট, ১৯৭১

 পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির রণনীতি ও রণকৌশলগত খসড়া দলিলের সংক্ষিপ্ত সারঃ-

অদূর ভবিষ্যতে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসকে সামনে রেখে “পার্টির কংগ্রেস প্রস্তুতি কমিটি’’ কর্তৃক পার্টি সভ্যদের নিকট উপস্থিত করার জন্য পার্টির রণনীতি ও কৌশলগত খসড়া দলিল।

*পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ, আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় সামন্তবাদ বিরোধী পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করে তুলুন।
*তিন শত্রু বিরোধী সকল দল, মত,ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক মুক্তিফ্রন্টগঠনে অগ্রসর হোন।

*“জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের” ও মুক্তিফ্রন্ট গঠনের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রতিষ্ঠিত করুন।

(১) পূর্ব বাংলার সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা
(ক) পাকিস্তানী শাসক ও শোষকদের প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলা উপনিবেশ।
(খ) আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীদের প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলা আধা বা নয়া উপনিবেশ।
(গ) আভ্যন্তরীণ সামন্তবাদ তথা জোতদারী-মহাজনী প্রথার প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলা আধা সামন্তরিক।
অতএব, পূর্ব বাংলা বর্তমান সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা ঔপনিবেশিক, আধা ঔপনিবেশিক এবং আধা সামন্তবাদী।

(২) মূল শত্রুতিনটি
(ক) পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী শক্তি তথা পাকিস্তানী আমলা মুৎসুদ্দী গোষ্ঠী ।
(খ) বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।
(গ) সামন্তবাদ তথা জোতদার মহাজন গোষ্ঠী ।

(৩) প্রধান দন্দ্ব
পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে পূর্ব বাংলার সামন্ত গোষ্ঠী ছাড়া বাকি সকল শ্রেণীর জনগণের বিরোধ হল প্রধান বিরোধ।

(৪) বিপ্লবের চরিত্র
* উপনিবেশবাদ ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের থেকে মুক্তির প্রশ্নে এ বিপ্লব “ জাতীয় মুক্তি বিপ্লব”।
আভ্যন্তরীণ সামন্তবাদের থেকে কৃষক জনতার মুক্তির প্রশ্নে এ বিপ্লবের চরিত্র হবে “গণতান্ত্রিক”। অতএব এ বিপ্লবের চরিত্র “ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ” ।
*যেহেতু বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকবে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে বিপ্লবী শ্রেনীসমূহের সমবায়ে শ্রমিক-শ্রেনী ও তার পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি , তাই এ বিপ্লবের চরিত্র “ জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব”।
যেহেতু এ বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্তবাদের উৎখাত হবে এবং প্রকৃত কৃষকদের হাতে আসবে জমি, তাই এ বিপ্লবের চরিত্র, “ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবও” বটে । অতএব সব মিলে এ বিপ্লব হল “ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব” ।

(৫) বিপ্লবী মুক্তিফ্রন্ট
তিন শত্রুবিরোধী সামন্ত রাজনৈতিক দল, শ্রেনী-সংগঠন ও গণ-সংগঠন, রাজনৈতিক গ্রুপ ও মত এমনকি বিশিষ্ট সমবায়ে গঠিত হবে “জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট”।
(৬) বিপ্লবের নেতৃত্ব
শ্রমিক কৃষক ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিদের মৈত্রীর ভিত্তিতে শ্রমিকশ্রেনী ও তার রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এ বিপ্লব চূড়ান্ত রুপ নেবে।
(৭) বিপ্লবী অভিজ্ঞতা
*কোন প্রকার আপোসের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আসতে পারে না।
* নির্বাচন বা পার্লামেন্টারী প্রথার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার মুক্তি আসবে না।
* নিরস্ত্র জনতার ব্যাপক গণ-অভ্যত্থানের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা স্বাধীন হতে পারে না।
* ধনিক শ্রেনীর নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লব সফল হতে পারে না।
* উন্নত মানের সশস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ লড়াই-এর কায়দা যে কত ভ্রান্ত তা প্রমাণিত হয়েছে।
* শহর থেকে বিপ্লবের সূচনা ও স্বল্প সময়ে ক্ষমতা দখলের রণকৌশল যে চূড়ান্তভাবে ভ্রান্ত তাও
প্রমাণিত হয়েছে।
(৮) বিপ্লবের সঠিক পথ
* দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রামই পূর্ব বাংলার মুক্তির একমাত্র পথ।
* এ সংগ্রাম শুরু করতে হবে গেরিলা কায়দায়, তারপর এটা বিকশিত হবে চলমান ও নিয়মিত
যুদ্ধে।
*এ যুদ্ধের সূচনা গ্রামবাংলা থেকে । সেখানে শত্রু সবচাইতে দুর্বল।
* বিপ্লবের মূল শক্তি গ্রাম্য খেতমজুর, বর্গাচাষী ও গরীব যারা সংখ্যায় শতকরা ৮০-৮৫ জন।
(৯) বিপ্লবে বাঙালী ধনী শ্রেনীর ভূমিকা
* এ বিপ্লবে প্রধান দ্বন্দ্ব পাকিস্তানী শাসক-শোষক গোষ্ঠীর সঙ্গে পূর্ব বাংলার উঠতি ধনিক ও জাতীয় ধনিক শ্রেনীর তীব্র বিরোধ রয়েছে তাই তারা বিপ্লবের দোদুল্যমান মিত্র।
* যেহেতু তিন মূল শত্রুর মধ্যে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রধান দ্বন্দ্ব এবং এ ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে বাঙালী ধনীদের রয়েছে তীব্র সংঘাত সেহেতু শ্রেনী হিসাবে তারা ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের’ দোদুল্যমান মিত্র।
* বাঙালী ধনীদের এ অংশ বিপ্লবের প্রথম দিকে ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেবে না। বিপ্লবী শক্তিসমূহ যখন দৃঢ় ঐক্যের ভিত্তিতে সুসংহত ও সবল হয়ে অগ্রসর হবে একমাত্র তখনই এ দোদুল্যমান মিত্ররা ঐক্যফ্রন্টে আসতে বাধ্য হবে ।
* বাঙালী ধনীদের যে অংশ মুৎসুদ্দী তারা সব সময় আপোষকামী। তারা সশস্ত্র শ্রমিক-কৃষক-বুদ্ধিজীবীকে যমের মত ভয় করে। এরা শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।

(১০) কোন পণ? আপোষ না সংগ্রাম ?
পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বর্তমান স্তরে “রাজনৈতিক সমাধানের” অর্থ এক পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব বাংলার অবস্থান। এর অর্থ স্বাধীন সার্বভৌম জনগণের গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা নয়। এর অর্থ পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির নিকট আত্মসমর্পন। পূর্ব বাংলার বিপ্লবী জনগণ ও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে।
(১১) নমনীয় কৌশল
বাঙালী ধনি যারা কলকারখানার মালিক, বাঙালী, ব্যবসায়ী, কন্ট্রাক্টর , ধনী কৃষক এবং দেশপ্রেমিক জোতদারদের সম্পদ-বাড়ি গাড়ি ইত্যাদির কোন সম্পত্তির উপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না একটি মাত্র শর্তে যে তারা বিপ্লবের পক্ষে থাকবে। তবে তাদের অধীনে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারী ও বর্গাচাষীকে আগের মত নির্মম শোষণ করতে দেওয়া হবে না। এখানে থাকবে মুক্তিফ্রন্টের কঠোর বিধিনিষেধ।
যেসব ধনী, ধনী কৃষক, জোতদার বা যে কেউ শত্রুর সঙ্গে সহযোগিতা করবে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। জমি কৃষকদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হবে। এ কাজে ব্যাপক কৃষক জনতাকে সক্রিয়ভাবে পক্ষে পেতে হবে, যার উপর বিপ্লবের জয় পরাজয় নির্ভর করবে।

পরিশিষ্ট
প্রিয় কমরেডগণ, দীর্ঘ চব্বিশ বৎসর পর ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত বিভিন্ন শ্রেনীসমূহের তীব্র শ্রেণীসংগ্রামের মধ্যদিয়ে পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার রাজনীতি অনেকগুলি বিতর্কমূলক বিষয়ের অবসান ঘটিয়ে চলছে।
মূলতঃ সে বিষয়গুলি পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে ছিল চূড়ান্ত বাধা। যেমন পূর্ব বাংলা
“উপনিবেশ” কি না? ঔপনিবেশিক মুক্তির জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজন আছে কি না? বুজো নেতৃত্বে
জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম জয়যুক্ত হতে পারে কি না? সংগ্রামের কৌশল কি হবে- সম্মুখ সমর না গেরিলা পন্থা? শহর থেকে শুরু না গ্রাম থেকে সূচনা? সর্বোপরি, প্রধান দ্বন্দ্ব কি পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ না সামন্তবাদ? উপরোক্ত সমস্ত পন্ডিতী বির্তকের অবসান ঘটিয়ে আজ পূর্ব বাংলার বিপ্লব সুনির্দিষ্ট রুপ নিতে চলেছে। বাকী রয়েছে শ্রমিক কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে শ্রমিক শ্রেণীর ও তার পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবী মুক্তিফ্রন্ট। ইতিমধ্যে এগুলোও দানা বেঁধে উঠেছে। প্রতিটি পার্টিকর্মীর একনিষ্ঠ, ত্যাগ , সাহস, সহনশীলতা ও সংগ্রাম- এগুলো দ্রুত বিকশিত করতে সাহায্যে করবে। গত কয়েক মাসের মধ্যে পার্টি কর্মীরা তার প্রমাণও দিয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকে শহীদি মৃত্যবরণ করছে। অনেক নিচুস্তরের কর্মী উচ্চমানের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, অনেক উচ্চস্তরের কর্মী পেছনে হটে যাচ্ছে, দুর্বল জেলা সবল হয়েছে –সবল জেলা দুর্বল হয়েছে।

সবচাইতে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, পার্টি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে ও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং লড়াই-এর মাধ্যমে খাঁটি পার্টি গড়ে উঠছে। এর মাধ্যমে আমাদের পার্টি জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা অর্জন করেছে। অতএব, বন্ধুগণ, আজ একথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা চলে যে, দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অবশ্যই সাফল্যমন্ডিত হবে। জাতীয় ও আন্তজার্তিক জনমত এবং সংগ্রামী “শক্তি” আমাদের পক্ষে। দুনিয়ার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা আমাদের সহায়ক। মার্কসবাদ-লেলিনবাদ , কমরেড স্ট্যালিন, মহান নেতা মাও সে তুং, কমরেড হো-চি-মনের চিন্তাধারা ও অভিজ্ঞতা আমাদের পাথেয়। জয় আমাদের হবেই।

পূর্ব বাংলার “ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব” জিন্দাবাদ।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি দীর্ঘজীবী হোক।

১০-০৮-৭১ ইং

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!