শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
শ্রমিক লিগের পক্ষ থেকে বিশ্বের শ্রমিক সমাজের কাছে সাহায্যের আবেদন | বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম কমিটি | ৮ আগস্ত,১৯৭১ |
“বিশ্বের সকল শ্রমিকদের নিকট আপীল”
বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। একপাশের এই অসমযুদ্ধে হত্যা, লুটপাট ও লুন্ঠন এবং ৭৫ মিলিয়ন মানুষের উপর এবং অন্যদিকে ঐপনিবেশিক ধরে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বাংলাদেশের নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের যুদ্ধ হয় ন্যায়বিচার ও সস্বাধীনতার জন্য এবং ইয়াহিয়া খানের আক্রমন সশস্ত্র দলবল হয়ে ওঠে।
মানুষের সংগ্রাম পূর্ন স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য সত্যি হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
নিন্মলিখিত লাইন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শ্রমিক শ্রেনীর বিশেষ অবস্থানে বিশ্ব জুড়ে ব্যাক্তি জ্ঞানগর্ভের জন্য বর্ণিত হচ্ছেঃ- ” বাংলাদেশে চার মিলিয়ন শিল্প শ্রমিক আছে। এই শিল্পে শ্রমিক, যোগাযোগ ও আত্মীয় ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত। “
পশ্চিম পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠি দ্বারা বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষগুলো চিরস্থায়ী ঐপনিবেশিক শাসনের শিকার হয়েছে। গত ২৩ বছরে ভূমিমালিক, একচেটিয়া শিল্প এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকরা তথাকথিত ফিল্ড মার্শাল, জেনারেল এবং সশস্ত্র বাহিনীর এয়ার মার্শাল ধারাক্রমে বাংলাদেশের জনগনকে শোষন করেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শোষন ও দীর্ঘ লালিত সতন্ত্র রাজনৈতিক এবং আর্থ সাংস্কৃতিক ধারনা ধ্বংশ করার জন্য ক্রমাগত শয়তানির প্রচেষ্টার সঙ্গে ছিলেন। আমাদের জনগনের মেরুদন্ড ভেঙ্গে ফেলার জন্য এই আদেশ সম্পন্ন করা হয় যাতে অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য একটি স্বজাতি প্রবেশ একত্রীকরন তাদের অধিকার জাহির করতে না পারে। শোষন এবং তার সব গঠন ও বৈশিষ্ট্য নিপীড়ন ধীরে ধীরে ঐপনিবেশিক শাষনের একটি সর্বোত্তম রুপ নেয়। ১৯৬৬ সালের এই পর্যায়ে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জনগনের আসন্ন বিবিধ লড়াইয়ের জন্য তার ঘোষিত ৬ দফা দাবি গঠন ও প্রনয়ন করেন। ছয়দফা কর্মসূচি বাংলাদেশের জনগনের জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য একটি ব্যাপক রাজনৈতিক সূত্র ছিল। শ্রমিক গনের মধ্যে সবচেয়ে সচেতন অধ্যায় হচ্ছে, “জনসাধারন ” অবিলম্বে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এই প্রোগ্রামে অর্থনৈতিক মুক্তির এবং প্রতিশ্রুতি সংঙ্গায়িত হয় এবং পরবর্তী গনআন্দোলন একেবারে পুরোভাগ মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে।
বস্তুত, চরম নির্যাতনের মুখে ষাটের দশকের শেষ দিকে ছয় দফা কর্মসূচি পক্ষে অপ্রতিরোধ্য গনঅভ্যুত্থান তৈরি করে এবং ভীতি প্রদর্শন এবং আইয়ুব শাসনের দ্বারা দিন ক্ষয় এবং পতন এবং অাগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিব মুক্ত হন এবং পরে আওয়ামী লীগ গত সাধারন নির্বাচনে এক ঐতিহাসিক বিজয় দান করে যাতে বাংলাদেশের শ্রমিক ও ছাত্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে!
তারপর আবারও এই শ্রমিক আর ছাত্ররাই ভুট্টো-ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে শেখের অসহযোগ আন্দোলনের মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছিল। এবং পরিশেষে, যখনই ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের নিরাপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে অবজ্ঞা করে তাদের ওপর গুলি চালানো শুরু করল, তখনই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। তাছাড়া, পূর্ববর্তী আরও কিছু ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবী ও যোদ্ধা হিসেবে শ্রমিকরাই সর্বপ্রথম যোগদান করে।
আজ আমাদের লোকেদের ওপর ইয়াহিয়া খান ও তার সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত এই হত্যাযজ্ঞ, নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, নজিরবিহীন গণহত্যা বাংলাদেশের শ্রমিকদের সংকল্প ও দৃঢ়তাকে নষ্ট করতে পারেনি।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীর প্রায় ১ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকার শিল্প শ্রমিকদের আবাসিক কলোনিসমূহ উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আদমজী জুট মিল প্রাঙ্গণে হানাদাররা মসজিদের ভেতরে প্রায় শতাধিক শ্রমিককে হত্যা করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মিরা এখন নেতৃস্থানীয় শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে চিহ্নিত করে দেখামাত্র হত্যা করে তাদের শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিচ্ছে। শুরুতে ট্যাংক আর মর্টারের আক্রমণ থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা এখন আশ্রয় ও খাবারের অভাবে ধীরে ধীরে যন্ত্রণাদায়ক এক মৃত্যুর সাথে লড়ছেন।
সবরকম বাধা আর নির্মমতাসত্ত্বেও শ্রমিকরা এখনও তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শ্রমিক শ্রেণীর লোকেরা বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে এখনও সাড়া দিয়ে যাচ্ছে। হানাদারদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে নষ্ট করতে অসহযোগ আন্দোলন শিল্প ও যোগাযোগকর্মীদের জন্য একটি কার্যকর উপায়। যদিও এই একই উপায়ে দরিদ্র শ্রমিকরা তাদের কাজ ও মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যারা তা খুব সহজেই ইয়াহিয়াকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে অর্জন করতে পারত। কাজেই একথা স্পষ্ট যে, শত্রুদেরকে দূর্বল করতে অসহযোগিতার যে উপায় নিরুপণ করা হয়েছে, তা আসলে যাদের জন্য নিরুপণ করা হয়েছে অর্থাৎ বাংলাদেশে ৪০ লক্ষ শ্রমিককেই ধ্বংস করে দেবে, সারাবিশ্বের মানুষের সহযোগিতায় এই যুদ্ধের সময়ে যদি তারা টিকতে না পারে।
এমতাবস্থায়, আমরা বাংলাদেশের সংগ্রামরত শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বিশ্বের সকল জাতির শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি মানবতা ও সুবিচারের লক্ষ্যে আমাদের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের এই চরম সংকটময় মুহূর্তে সহযোগিতার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।
১। আমাদের বিভিন্ন ধরণের আর্থিক ও বস্তুগত সাহায্য প্রয়োজন।
২। আমরা আশা করছি যে, সারাবিশ্বের কর্মজীবী মানুষেরা যার যার নিজস্ব সংগঠনের মাধ্যমে একটি কার্যকর পরিকল্পনা নিরুপণ করে আন্দোলনে নামবেন, যাতে করে তাদের সরকার আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
৩। আমরা বিশ্বের অন্যান্য সহকর্মীদেরকে অনুরোধ করছি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তুলতে। আন্তর্জাতিক নাবিক ভ্রাতৃত্বকে পাকিস্তানি নৌযান কিংবা পাকিস্তানে যাওয়া বা পাকিস্তান থেকে আসা কোন নৌযানে কাজ না করার অনুরোধ করছি।
৪। আমরা সহকর্মীদেরকে আরও অনুরোধ করব সঠিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যাতে করে বিশ্বের দেশগুলো অবিলম্বে পাকিস্তান সরকারকে সবরকম অর্থনৈতিক কিংবা সামরিক সাহায্য প্রদান থেকে বিরত থাকে।
৫। আমরা বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণকে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতা দেয়ার জন্যে একটি আন্তর্জাতিক কর্মজীবী কো-অর্ডিনেশন ফোরাম গঠনের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করছি।
আমরা আমাদের সহকর্মী ভ্রাতৃত্বকে অনুরোধ করছি যে, সময় আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সাহায্যের ক্ষেত্রে অল্পসময়ের বিলম্বও আমাদেরকে হাজার বছরের ভোগান্তি ও পরাধীনতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। জয়বাংলা।
বিনীত
ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার সংগ্রাম
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শ্রমিকবৃন্দ
এসডি/ – মোঃ শাহ জাহান এসডি/ – আব্দুল মান্নান
দায়িত্বরত সভাপতি সাধারণ সম্পাদক
জাতীয় শ্রমিকলীগ এবং আহ্বায়ক, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল ওয়ারকারস’
সদস্য, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল ওয়ার্কারস’ অ্যাকশন কমিটি অ্যাকশন কমিটি,
মুজিবনগর, বাংলাদেশ