শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
সমমনা দলসমূহের উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির আহ্বান | পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি | ৩ মে, ১৯৭১ |
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে
সমমনা দলসমূহের উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির আহ্বান, ৩ মে, ১৯৭১
প্রিয় সহকর্মীগন,
২৫শে মার্চ মধ্যরাত থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানী মিলিটারি জান্তা পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) যে অমানুষিক গণহত্যা চালাচ্ছে বিশ্ববাসী এ সম্পর্কে অবগত। বিগত পাঁচ সপ্তাহে পাকিস্তানী আর্মি প্রসিদ্ধ নেতৃত্বস্থানীয় ব্যাক্তিবর্গ ও বুদ্ধিজীবীসহ লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে; ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য শহরে লুটতরাজ ও লুটপাট চালিয়েছে, শত শত গ্রাম-হাট-বাজার পুড়িয়ে দিয়েছে; পুরো বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। মানুষের জীবন ও সহায়-সম্পত্তির এই অবাধ ধ্বংসযজ্ঞ এখনো চলছে এবং প্রায় দশ লক্ষ সহায়সম্বলহীন নিঃস্ব বাংলাদেশী মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আকাশ-মাটি-পানি এই তিন সামরিক শক্তি নিয়েই পাকিস্তানী জান্তারা প্রকৃতপক্ষে নীরিহ-নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের সমূলে ধ্বংস করার যুদ্ধে নেমেছে। বাংলাদেশ চলমান ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ইতোমধ্যে আধুনিক ইতিহাসে কালো দাগ একে দিয়েছে।
কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী জনগণের এই পরিষ্কার রায় মেনে নিতে রাজি ছিলো না অথবা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে রাজি ছিলো না। তাই কেন্দ্রীয় সরকার ষড়যন্ত্র করেছিলো এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য সমর্থন ছিলো যুক্তরাষ্ট্রীয় সাম্রাজ্যবাদীদের, যারা মাত্র পঁয়তাল্লিশ দিন অথবা তার কয়েকদিন পরেই এক মিথ্যা ও বানোয়াট অজুহাত আমলে নিয়ে ইউনাইটেড ফ্রন্ট মিনিস্ট্রি ভেঙে দিয়েছিলো। তাদের অজুহাত ছিলো যে, ইউনাইটেড ফ্রন্ট মিনিস্ট্রি, বিশেষ করে সাবেক নেতা এ. কে. ফজলুল হক, ভারতের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো এবং পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে পাকিস্তানকে বিনাশ করার চেষ্টা করছে। শাসক শ্রেণীরা পূর্ব পাকিস্তানে এক ভীতির রাজত্বও সঞ্চার করেছিলো এবং হাজার হাজার লোককে কারাগারে পাঠানো হয়েছিলো। কমিউনিস্ট পার্টি যারা জোট বেঁধেছিল এই সময়ে নিষিদ্ধ হয়েছিলো। উল্লেখযোগ্যভাবে, ইউনাইটেড ফ্রন্ট মিনিস্ট্রি ভেঙে দেওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ বা তার কিছুদিন পরেই পাকিস্তান সাম্রাজ্যবাদের অধীনে সামরিক চুক্তিতে যোগদান করেছিলো।
কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে শাসক গোষ্ঠীর এ ধরনের লজ্জাজনক আক্রমণের পরেও, স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন বিভিন্ন আকারে চলতে থাকে। সিন্ধি, পাঠান এবং বেলুচীরাও তাদের জাতীয় এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে লড়ে যাচ্ছিলো।
অন্যদিকে শাসক শ্রেণীরা স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের এই ক্রমবর্ধমান আন্দোলনকে নিরোধ করতে দুইটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিলো। কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের ইচ্ছামত দুইটি আইন পাস করে। এগুলোর মধ্যে একটি আইনে বলা হয় যে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সকল বিষয়েই “সমতা” থাকতে হবে, যার অর্থ ছিলো এই যে পূর্ব পাকিস্তান যার ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা (শতকরা ৫৬ ভাগ), তার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৪ শতাংশ জনগণকে সমান করা হয়েছিলো। দ্বিতীয় আইনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশগুলো, যেমন সিন্ধ, পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচীস্তান, রহিত করা হয় সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি একক পূর্ণাঙ্গ অথবা একক প্রদেশ হিসেবে গঠন করা হয়। জাতীয় দমননীতিকে তীব্র করতে এই দুটি আইন ছিলো প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীর নতুন পদক্ষেপ।
কিন্তু পূর্বে যেমনটা বলা হয়েছিলো, স্বায়ত্তশাসন এবং গণতন্ত্রের এই জনপ্রিয় আন্দোলনকে ঠেকানো যায়নি। এটা একই সাথে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানে চলছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানে একক প্রদেশ নীতি আরোপের পর ছোট জাতিগুলোর- সিন্ধি, পাঠান এবং বেলুচীস্তানিদের উপর দমন প্রকট আকার ধারণ করেছিলো। তারা অভিযোগ করেছিলো যে পাঞ্জাবী কায়েমি স্বার্থোদ্ধারে অদৃশ্য দাস বানানো হয়েছে তাদেরকে, যারা একক প্রদেশের চটুলতায় ঐ সকল প্রদেশগুলোতে প্রশাসনের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করেছিলো এবং তাদের অর্থনীতিতেও একটি প্রভাবশালী অবস্থান দখল করে নিয়েছিলো। সুতরাং সেই সময় থেকে সিন্ধি, পাঠান এবং বেলুচীস্তানীদের স্বায়ত্তশাসন এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের প্রধান স্লোগান হয়েছিলো একক প্রদেশ বাতিলকরণের দাবি ।
সাম্রাজ্যবাদীদের হস্তক্ষেপ
একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা জরুরী, ১৯৬৬ সালে তৎকালীন সংবিধান সভার মাধ্যমে সমতার ভিত্তিতে একটি সংবিধান গঠন করা হয়েছিলো দেশের জন্য, যারা ১৯৫৫ সালে পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিলো। প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী দ্বারা গঠিত ঐ সংবিধান একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিলো এবং বিভিন্ন জাতির স্বায়ত্তশাসনের জন্য জায়গা ছিলো না। রাষ্ট্রপতিকে বিভিন্ন বিশেষ ক্ষমতায় ভূষিত করা হয়েছিলো। এটার একমাত্র ক্ষতিপূরণমূলক বৈশিষ্ট্য ছিলো যে, এটা সংসদীয় শাসনের যোগান দিয়েছিলো এবং উর্দুর সাথে বাঙলা ভাষাকেও রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলো, একমাত্র এই কারণে যে এগুলোই ছিলো সবচেয়ে সনির্বন্ধ এবং জনপ্রিয় দাবি।
ঐ সংবিধানের গঠনের পর আরেকটি জনপ্রিয় দাবি উঠেছিলো যে নতুন সংবিধানের ভিত্তিতে দ্রুত একটি সাধারণ নির্বাচন হোক। এই দাবিটি খুবই জোরালো হয়ে উঠেছিলো। শাসক শ্রেণীর মধ্যে পক্ষ প্রতিপক্ষও ছিলো।
এই অবস্থায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীবর্গ ঘোষণা করেন যে ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
স্বায়ত্তশাসন এবং গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের সাথে সাধারণ নির্বাচনের এই ঘোষণা প্রভাবশালী এক শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে, যার নেতৃত্বে ছিলেন কুখ্যাত ইস্কান্দার মির্জা, একজন প্রাক্তন সেনাবাহিনী নেতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী সঙ্ঘেও ভীতির সঞ্চার করেছিলো। তারপর এটা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রীয় সাম্রাজ্যবাদীদের পরোক্ষ সম্মতি এবং সুস্পষ্ট সমর্থন যে নির্বাচিন এগিয়ে নিতে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন করতে শাসক গোষ্ঠী ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে শক্তহাতে সামরিক আইন দমন করেছিলো। তখন আইয়ুব খান যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদীদের স্পষ্ট সমর্থনে ক্ষমতায় আসে।গণতন্ত্রকে দমন করতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদীদের এটা ছিলো দ্বিতীয় নগ্ন হস্তক্ষেপ। প্রথমটি ছিলো ১৯৫৪ সালে যখন ইউনাইটেড ফ্রন্ট মিনিস্ট্রি জনগণের ভোটে ক্ষমতা পেয়েছিলো, তাদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদীরা সবসময় পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীর পশ্চাতে ছিলো, তাদের আহবানে গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে দমন করতে।
পুনরুজ্জীবিত জনপ্রিয় সংগ্রাম
এটা ছিলো আইয়ুব খানের স্বৈর শাসনামল দশক যখন গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে দমন, গণতন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে পদদলন এবং বাঙালিদের জাতীয় অধিকার এবং অন্য জাতিগুলোর অধিকার ভয়াবহ অনুপাত ধারণ করে। শাসক শ্রেণীর গঠিত ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করা হয়েছিলো। সাম্যবাদীরা কঠোরভাবে নির্যাতিত হয় এবং কোন গণতন্ত্রবাদী স্বায়ত্তশাসন কিংবা গণতন্ত্রের জন্য আওয়াজ তুললে তাকে কারাগারে পাঠানো হচ্ছিলো, গণতন্ত্রের সকল সাক্ষ্য প্রমাণ মুছে দেওয়া হচ্ছিলো এবং শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ যারা তাদের কোন অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে খুঁজে পাওয়া গেলে সিংহবৎ নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করা হতো। হিন্দুবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ক্ষেপিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো এবং জনগণকে তছনছ করতে সংগঠিত হয়েছিলো।
কিন্তু আইয়ুব শাসনামলের নিপীড়ন ও দমননীতি অবিসন্বাদিত যায়নি। ১৯৬১ সালের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এবং পাঠানভূমি ও বেলুচিস্তানের জনগণ তাদের স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবিতে অনেক গৌরবময় যুদ্ধ করেছিলো। ১৯৬১ সালে পাঠানদের বীরোচিত সংগ্রাম, ১৯৬১-৬২ সালে বেলুচিস্তানের আমৃত্যু সংগ্রাম, এবং ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও জনগণদের গৌরবময় সংগ্রামের কথা এই সূত্রে উল্লেখ করা যায়।
১৯৬৫ সালে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়, প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী সাময়িকভাবে উৎকট ভারত-বিদ্বেষী অপপ্রচারের মাধ্যমে দ্বিধান্বিত করতে পেরেছিলো। কিন্তু যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির এক সক্রিয় আন্দোলন সংঘটিত হয় (জুন ১৯৬৬)। আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি ছিলো মূলত সংসদীয় গণতন্ত্র এবং পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের এক কর্মসূচি। স্বায়ত্তশাসনের সাপেক্ষে ছয় দফা কর্মসূচি দাবি করেছিলো যে প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক বিষয়াবলী (বৈদেশিক বাণিজ্য ছাড়া) কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত হবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যসহ অন্য সকল বিষয় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে। মুদ্রা বিনিময় প্রসঙ্গে, ছয় দফা কর্মসূচি দুইটি বিকল্প রেখেছিলো। বলা হয়েছিলো, হয়তো পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি আলাদা কিন্তু সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য একটি মুদ্রা থাকবে এই শর্তে যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থাকবে এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পক্ষীয়দের মূলধন যুদ্ধ বন্ধে কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
সুতরাং আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বিস্তর স্বাশাসনিক ক্ষমতার দাবি করেছিলো এবং কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী পদক্ষেপ ছিলো না, যেমনটা কিছু স্বার্থসম্পন্ন লোকেরা ইঙ্গিত দিয়েছিলো।
আওয়ামী লীগের এই ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলো এবং এর ভিত্তিতে (১৯৬৬) আওয়ামী লীগের শুরু করা আন্দোলন ছিলো শক্তিশালী একটি, যেটি কমিউনিস্ট এবং মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে থাকা তৎকালীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বামপন্থী শাখারও সমর্থন পেয়েছিলো। আইয়ুব সরকার ঐ আন্দোলন হিংস্রতার সাথে দমন করেছিলো।
কিন্তু ১৯৬৮-৬৯ সালে আবারো আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে এক বিশাল জনপ্রিয় গণঅভ্যুত্থান হয়েছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি এই আন্দোলনে এক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলো, বিশেষত সকল রাজনৈতিক এবং বিরোধী শক্তিগুলোকে গঠন করে একটি সম্মিলিত জোট তৈরি করতে। পূর্ব পাকিস্তানে, এই জনপ্রিয় গণঅভ্যুত্থান ছাত্র কর্ম পরিষদ (সকল প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন নিয়ে গঠিত) দ্বারা পরিচালিত এগারো দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে তরান্বিত হচ্ছিলো এবং আওয়ামী লীগ ও ওয়ালী এবং মুজাফফরের নেতৃত্বে থাকা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মাধ্যমে সমর্থিত হচ্ছিলো। এগারো দফা দাবিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবির পাশাপাশি ছিলো নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বৈদেশিক নীতি, সামরিক চুক্তি বাতিলকরণ, ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স এবং বড় শিল্পগুলোর জাতীয়করণ, শ্রমিকদের জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম মজুরি, কর ও শুল্ক হ্রাসকরণ, শিক্ষাবিষয়ক পুনর্গঠন, পূর্ণ নাগরিক স্বাধীনতা ইত্যাদি (আওয়ামী লীগের ছয়দফা কর্মসূচি)।
পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনকারীসহ সকল বিরোধী শক্তিগুলো সংসদীয় গণতন্ত্র ও পূর্ণ বয়স্ক ভোটাধিকারের দাবিতে সম্মিলিত হয়েছিলো। পাঠানভূমি, বেলুচিস্তান এবং সিন্ধের জনগণ সংসদীয় গণতন্ত্র এবং স্বায়ত্তশাসনের আশায় এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো, বিশেষত একক প্রদেশ ভাঙনের জন্য।
এটা ছিলো পাকিস্তান জুড়ে ঐ জনপ্রিয় গণুভ্যুত্থান, যার প্রধান দাবি ছিলো গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসন, যা আইয়ুব খানের স্বৈর শাসনের পতন ঘটিয়েছিলো।
ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা বাতিল
কিন্তু আইয়ুব খান, তিনি পদত্যাগ করার আগে, প্রধান সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন এবং ১৯৬৯ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন আসে।
কিন্তু যদিও সামরিক শাসন ক্ষমতায় এসেছিলো এবং ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে একটি সামরিক আইন ছিলো, এটা ছিলো বিশাল জনসমর্থিত গণঅভ্যুত্থানের চাপ যা ইয়াহিয়া খানকে পরবর্তী জনসমর্থিত সার্বজনীন প্রত্যক্ষ নির্বাচনের এবং পূর্ণ বয়স্ক ভোটাধিকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করেছিলো। জনসংখ্যার ভিত্তিতে জাতীয় সভায় ১৯৫৫ সালে প্রবর্তিত “সাম্য” ও বিবৃতি বাতিলকরণ, নির্বাচিত জাতীয় সভার মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান গঠন, পশ্চিম পাকিস্তানে একক প্রদেশ বাতিলকরণ এবং সাবেক প্রদেশগুলোর পুনরুদ্ধার, সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ইত্যাদি বিষয়গুলোও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান।
কিন্তু ইয়াহিয়া খান একটি আইনী কাঠামো আদেশ (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) ঘোষণা করেন যেখানে শর্ত আরোপ করা হয় যে নির্বাচিত জাতীয় সভার মাধ্যমে গঠিত নতুন সংবিধান রাষ্ট্রপতির (ইয়াহিয়া খান) দ্বারা প্রমাণীকৃত হতে হবে, এবং অবশ্যই একটি ইসলামি সংবিধান হতে হবে।
এই LFO প্রমাণ করেছিল যে, যদিও ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা গণঅভ্যুত্থান ইত্যাদির চাপে নির্বাচন মেনে নিতে বাধ্য হয়, কিন্তু পূর্ণ সংসদীয় গণতন্ত্র ও পূর্ণ জাতীগত স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর করার মতো মেজাজে তারা ছিল না। বরং এই আদেশের মাধ্যমে ওরা নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সার্বভৌমত্ব খর্ব করেছিল, পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় ভিত্তি নিশ্চিত করেছিল এবং গণতন্ত্র ও বিভিন্ন জাতীসত্তার স্বায়ত্তশাসনের অধিকার সঙ্কুচিত করতে চেয়েছিল।
আমাদের পার্টিও সামরিক জান্তার এই ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে গেছে, LFO এর সমালোচনা করেছে এবং এর সংশোধন ও নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সার্বভৌমত্ব দাবি করেছে। ওয়ালি ও মুজাফফরের নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও তাই করেছে, কিন্তু LFO সংশোধিত হয়নি।
সাধারণ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের বিজয়
তবে পাকিস্তানে বিগত ২৩ বছরের মধ্যে এই ধরণের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে। ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৬৭টি ও প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ টির মধ্যে ২৯০টি আসন সুরক্ষিত করে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয় লাভ করে। পুর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ অল পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা – সর্বমোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি লাভ করে।
নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের প্রধান ভিত্তি ছিল তার নিজস্ব ছয় দফা দাবী ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবী। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রধানত জোর দিয়েছিল নিজেদের ছয় দফা দাবীর উপর যা পূর্ব পাকিস্তানে জনসাধারণের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিল ও জনগণ ধৃঢ়ভাবে এর জন্য ভোটও দিয়েছে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি চিৎকার শুরু করে যে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সুনিশ্চিতভাবে বারবার ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ও তার দল কখনও পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা চাননা কিন্তু বাঙ্গালীর উপর শোষণ ও নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য চান দেশের ভবিষ্যত সংবিধান যেন তার দলের ছয় দফা দাবীর উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এ উচ্চাশা করেছিল যে নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ শীঘ্রই তার অধিবেশন শুরু করবে, ছয় দফা দাবীর উপর ভিত্তি করে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত হবে ও বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়িত জনতা, বিশেষত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষরাও আশা করেছিল যে অতীতের অত্যাচারের দিন বুঝি এবার শেষ হবে ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে। বস্তুত পাকিস্তানের সকলেই সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল গণতন্ত্রের মাধ্যমে একটি পরিবর্তনের।
প্রগতিবিরোধীদের ষড়যন্ত্র
কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ক্ষমতাসিন সামরিক জান্তা ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ঘাবরে দিয়েছিল। তারা জনতার রায় ও তাদের আশা আকাঙ্খা খর্ব করার ষড়যন্ত্রে করতে লিপ্ত হয়। পিপল’স পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এ চক্রান্তের রাজনৈতিক অগ্রপথিক হিসেবে কাজ করেন। ভুট্টোর সমাজতান্ত্রিক নেতৃত্ব ও তার ভারতবিরোধী বজ্রধ্বনির মাধ্যমে পিপল’স পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাশনাল এসেম্বলিতে সিংহভাগ আসন (১৪৪টার মধ্যে ৮৪টি আসন) নিশ্চিত করেন।
ভুট্টোর পিপল’স পার্টি এ ৮৪টি আসন শুধু পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ থেকে লাভ করে কিন্তু সীমান্তবর্তী অঞ্চল (পাঠানল্যান্ড ও বেলুচিস্তান) থেকে একটি আসনও জয় করতে ব্যর্থ হয়। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী ও মুজাফফরের নেতৃত্বে) বেলুচিস্তান অঞ্চলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এরা জাতীয় পরিষদে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ৩টি আসন লাভ করে ও প্রাদেশিক পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়।
সুতরাং প্রকৃতপক্ষে ভুট্টো পুরো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেননি কিন্তু সেরকমভাবেই নিজেকে জাহির করেন ও জাতীয় পরিষদের অধিবেষণকে নষ্ট করার জন্য তিনি এই শ্লোগান প্রস্তাব করেন যে “পাকিস্তানের ভবিষ্যত সংবিধানের প্রশ্নে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও পিপল’স পার্টির মধ্যে কোন ধরনের চুক্তির পূর্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হওয়া যাবে না।”
ভুট্টো ও পিপল’স পার্টির কিছু নেতা “সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা করতে” ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সাক্ষাত করেন, আসলে শুধু এটা জাহির করতে যে তারাও “একটি চুক্তি”তে পৌঁছাতে চায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভুট্টো ও তার পার্টি ছয় দফা দাবী ও জাতীগত স্বায়ত্তশাসনের বিরোধী ছিল। তারা ছয় দফা দাবী বর্জন করার জন্য আওয়ামী লীগকে চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ জনগণকে দেয়া তাদের প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। সুতরাং ভুট্টোর খেলা ব্যর্থ হয়ে গেছিল।
প্রতিক্রিয়াশীলদের ষড়যন্ত্র এরপর থেকে পুরোদমে চলছিল। কমিউনিস্ট পার্টি বিপদ আঁচ করতে পেরেছিল ও জনতাকে এর বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিল।
এদিকে ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন আহবান করেন।
অবিলম্বে ভুট্টো ঘোষণা দেয় যে সে ও তার দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে অংশ নেবে না এবং যদি অধিবেশন ঐ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় তবে “পুরো পশ্চিম পাকিস্তানে আগুন জ্বলবে”।
ভুট্টো, যার দলের জাতীয় পরিষদে আসন মাত্র ৮৪টি তার হুমকিতে ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ অনিবার্য কারণবশত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে রেডিওতে একটি বিবৃতি জারি করেন। তিনি সাংবিধানিক বিষয় আলোচনা করার জন্য ১০মার্চ ঢাকায় সকল পার্টির নেতাদের নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক আহবান করেন।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা ও গোলটেবিল বৈঠক আহবানের আগে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাথে ইয়াহিয়া খান আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি।
সবকিছুর মাধ্যমে এটাই স্পষ্ট হচ্ছিল যে ইয়াহিয়া খান সততা বা গণতন্ত্রের মূলনীতি অনুযায়ী নয় বরং সামরিক শাসন অব্যাহত রাখার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র অনুসারে কাজ করছিলেন।
নব গণজাগরণ
জাতীয় সংসদ অধীবেশনের আকস্মিক স্থগিতাদেশে সকল শ্রেণীর জনগণের উপর রূঢ় আঘাত নেমে এসেছে।জাতীয় সংসদ অধীবেশন স্থগিত করে আরটিসি (RTC)ডাকা উক্ত আঘাতের সাথে অপমান যুক্ত করার নামান্তর। সুতরাং তা তাৎক্ষণিকভাবেই আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ ও আন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তি কর্তৃক প্রত্যাখিত হয়েছিল। এমন কি ডানপন্থী পাকিস্তান ড্যামোক্রেটিক পার্টির নেতা নুরুল আমিনও এতে যোগদান করতে অস্বীকার করেন।
অন্যদিকে জনসাধারণ যখনই রেডিও তে জাতীয় সংসদ অধীবেশনের স্থগিতাদেশ শুনতে পেল, তখনই তারা হাজারে হাজারে স্বতস্ফুর্তভাবে “আমরা স্বাধীন পূ্র্ব বাংলা চাই” শ্লোগান দিতে দিতে পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলো শহর ও শহরতলীর রাস্তায় নেমে আসে।
এখানে উল্লেখ্য যে, বিশেষ করে ছয় দফা ও ১১ দফা আন্দোলনে (১৯৬৬ ও ১৯৬৯) তাদের দূর্ভোগের পর অব্যাহত জাতীগত অবদমন ও গণতন্ত্রের নিশ্পেষনের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের অদ্ভুত ভৌগলীক অবস্থান ইতোমধ্যেই জণসাধারণের এক অংশের মধ্যে “স্বাধীন পূর্ব বঙ্গ” এর মানসিকতা গড়ে তুলেছিল। তারপরও তারা আশা করছিল যে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করেও হয়ত গণতন্ত্র ও শায়ত্ত্বশাসণের প্রতি তাদের যে আকাঙ্খা তা বাস্তবায়ণ করা সম্ভব হবে।
অবশেষে তারা তাদের সমস্ত আকাঙ্খা নির্বাচনকে ঘিরে পুঞ্জিভূত করে ও আশা করে যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তবে তারা হয়ত সুদিন দেখতে পাবে। এখন তারা এমন কি এও দেখতে পেল যে জনসাধারণ নির্বাচণে যে রায় দিয়েছিল তা রদ করতে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের অধীবেশনেও আঘাত হানা হলো। সুতরাং তারা বুঝে গেল যে, পাকিস্তানের সাথে যুক্ত থাকা অবস্থায় গণতন্ত্র কিংবা শায়ত্ত্বশাসনের কোন সুযোগ নেই। ফলশ্রুতিতে একটি “স্বাধীন পূর্ব বাংলা”র শ্লোগান স্বতঃস্ফুর্তভাবে বেরিয়ে আসে যা তাদের দৃঢ় আত্ম সংকল্পের বহিঃপ্রকাশ বটে।
জাতীয় সংসদ অধীবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ০২ হতে ০৬ মার্চ পর্যন্ত পাঁচদিনের দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ ধর্মঘটের ডাক দিলে এই স্বতস্ফুর্ত জাগরণ সাংগঠনিক বিস্তৃতি লাভ করে গণ সংগ্রামে পরিণত হয়। ধর্মঘটের এই ডাক কমিউনিস্ট, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তি সমর্থন জানায়। আরও জানানো হয়েছিল যে ৭ই মার্চ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান এক গণ-র্যালীতে কর্ম পরিকল্পণা প্রদান করবেন।
শাসক সামরিক জান্তা, অন্যদিকে, এই স্বতস্ফুর্ত ও জনপ্রিয় গণজাগরণকে মেশীনগান ও বুলেটের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। তারা ২রা মার্চ সন্ধ্যা হতে ১২ ঘন্টার কার্ফ্যু জারী করে ঢাকা শহরকে অকার্যকর করতে সমর্থ হয়েছিল। যখন তারা (জনগণ) কার্ফ্যু অমান্য করে শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করে, তখন তাদের উপর মেশিনগান চালানো হয় যার ফলে অসংখ্ং প্রাণ ঝরে যায়। এভাবে ২রা মার্চেই নীরিহ ও নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করা শুরু হয়ে যায়। এধরণের হত্যা ছাড়াও সামরিক জান্তা বাঙ্গালী ও নন-বাঙ্গালীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়ার প্ররোচণা দিতে থাকে এবং এরকম কিছু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চট্টগ্রামে ও রংপুরে রদ করা হয়েছিল। এর কারণ ছিল আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট, ন্যাশনাল আওয়ামী গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ যার ফলে দাঙ্গা থিতু হয়ে থেমে যায়। এই দলগুলো ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ সর্বদাই জনসাধারণের মধ্যে পরম শান্তি রক্ষার চেষ্টা করে গেছে।
০২ মার্চের নিরস্ত্র মানবহত্যা প্রভৃতি কোনভাবই জনসাধারণকে নীতিভ্রষ্ট করতে পারেনি। ০২ মার্চের ধর্মঘট সম্পুর্ণ সফল হয়। সকল শ্রেণীর জনগণ এমনকি পুলিশ ও সরকারী কর্মকর্তাগণও ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন। পাশাপাশি, ০২রা মার্চ এর ধর্মঘটের পর থেকে বাংলাদেশের দেশের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমে সর্বত্র হাজার হাজার মানুষ স্বতস্ফুর্তভাবে মিছিলে অংশগ্রহণ করছিল। বাংলাদেশের সমস্ত জনগণ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব একতা দেখিয়েছে।
ইয়াহিয়া খানের হুমকী
শান্তিপূর্ণভাবে যখন ধর্মঘট চলছিল, তখন ০৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান একটি প্রচারণা চালায়। উক্ত প্রচারণায় ২৫শে মার্চের জাতীয় সংসদ অধীবেশনের বিরোধীতা করেন। একই সাথে তিনি ০২ রা মার্চের দুর্ঘটনার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও নেতাদের দায়ী করার পাশাপাশী ভুট্টোকে, যে কিনা সমস্ত বিপর্যয়কে ঘণীভূত করেছিল, সম্পূর্ণ নির্দোশ ঘোষণা করে। তিনি “পাকিস্তানের সংহতি ও অখন্ডতা সুরক্ষায়” সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকি্ প্রদান করেন। এই হুমকীর সাথে সাথে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসণে পরিবর্তন আনেন এবং নির্মমতার জন্য কুখ্যাত লেঃ জেঃ টিক্কা খান’কে গভর্ণর ও প্রধান সামরিক প্রশাসণিক কর্মকর্তা (CMLA) হিসেবে ঢাকার প্রেরণ করা হয়।
উপরের জিনিসগুলোই দেখীয়ে দেয় যে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই জনসাধারণের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালানোর প্রকৃত প্রস্ততি শুরু করে। “ক্ষমতা হস্তান্তর” এর জন্য তাদের বৈঠক ছিল কেবলই প্রতারণা মাত্র।
মুজিবের চার দফা ও অসহযোগ আন্দোলন
৭ই মার্চ, শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ভাষণ দেন, যেখানে আওয়ামী লীগ প্রধান’কে উৎসাহ প্রদানের জন্য প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ উপস্থিত ছিল। জনসাধারণের প্রত্যাশা ছিল যে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। কিন্তু তাঁর ভাষণে শেখ মুজিব তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেনঃ
i) ২৩ বছরের শোষণ ও বঞ্চণার সমাপ্তির লক্ষ্যে তিনি জন সাধারণ’কে তাঁদের অকুতোভয় সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বলেন।
ii) তিনি চারটি দাবী তুলে ধরেন-এগুলো হচ্ছে: ক) নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর; খ) সামরিক আইন/ মার্শাল ল তুলে নেয়া; গ) সেনা বাহিণীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া; এবং ঘ) ১লা মার্চ হতে সংঘটিত গণ হত্যার তদন্ত।
তিনি আরও বলেন যে এই চারটি দাবী মেনে নেয়া হলে তিনি ও তাঁর দল ২৫শে মার্চের জাতীয় সংসদের অধীবেশনে অংশগ্রহণের বিষয়টি বিবেচণা করবেন।
iii) তিনি উপরের দাবীগুলো মেনে না নেয়া পর্যন্ত ৮ই মার্চ হতে সরকার ও সামরিক বাহিণীর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন।
উপরের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ছাড়াও তিনি এই বলে সতর্ক করেন যে প্রতিক্রিয়াশীলরা ষড়যন্ত্র করছে এবং যদি সেনা বাহিণী পুনরায় এছাড়াও জনসাধারণের উপর আক্রমণ চালায়, তবে যাঁর কাছে যা কিছু আছে তা নিয়েই রুখে দাঁড়াতে হবে।
শেখ মুজিবের বক্তব্য সাধারণভাবেই প্রসংশিত হয়েছিল, যে চারটি দাবী তিনি উত্থাপন করেন তাও কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিসহ সকল গণতান্ত্রিক শক্তি কর্তৃক সমর্থিত হয়েছিল।
উপরের চারটি দাবীর সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে কমিউনিস্ট পার্টিও তাঁদের খোলামেলা বক্তব্য একটি লিফলেট আকারে প্রচার করে এবং একই সাথে জন সাধারণকে সকল ষড়যন্ত্র ও প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে ও যদি তারা কোন রকম আক্রমণ চালায় তা প্রতিহত করতে জন সাধারণকে জানিয়ে দেয়।
৮ই মার্চ হতে আওয়ামী লীগের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনও পূর্ণ সফল হয়েছিল। পুলিশ বিভাগসহ, পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসণ আওয়ামী লীগের নির্দেশণা মেনে চলছিল। বস্তবিক অর্থে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসণ আওয়ামী লীগই পরিচালনা করছিল। জন সাধারণেরও আওয়ামী লীগের উপর নিরঙ্কুশ সমর্থন ছিল ও তাঁরা আশা করছিল যে আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করা উচিৎ।
বিশ্বাস ঘাতকতার আক্রমণ
শান্তিপূর্ণ ও অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলার সময় শেখ মুজিবের সাথে বৈঠকের জন্য ইয়াহিয়া খান শীঘ্রই ঢাকা যাবেন বলে কেন্দ্রীয় সরকার হতে ঘোষণা করা হয়। যদি তিনি আসেন তবে যে কোন রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাৎ ও আলোচনার জন্য তাঁর প্রস্তুতির কথা শেখ মুজিব তাৎক্ষণিকভাবেই ঘোষণা করেন।
ইয়াহিয়া খান ১৪ই মার্চ ঢাকায় এসেছিলেন এবং ঐদিন থেকেই মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। চার বা পাঁচদিন পর শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খান উভয়েই জনসম্মুখে জানান যে আলোচনা “কিছু অগ্রগতি” হয়েছে। ইয়াহিয়া খান জনসম্মুখে আরও জানান যে আওয়ামী লীগ প্রধানের উত্থাপিৎ দাবীসমূহ তিনি “নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছেন”। ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবর রহমানের পরামর্শকদের মধ্যেও বিস্তারিত আলোচনা চলছিল। সুতরাং জন সাধারণও আশা করছিল যে শীঘ্রই একটি রাজনৈতিক সমাধান আসবে ও সঙ্কটের অবসান ঘটবে।
কিন্তু জন সাধারণের বিশ্বাসকে ধোকা দেয়া হয়েছিল। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক/ আলোচনা শেষ হওয়ার পূর্বেই ২৫শে মার্চ মধ্যরাত হতে সামরিক জান্তার নির্দেশে সেনা বাহিণী আকস্মিকভাবে ও বিশ্বাসঘাতকতার সাথে বাংলাদেশের জন সাধারণের উপর হিংস্র সশস্ত্র আক্রমণ চালায়।
শুরু হলো স্বাধীনতার সংগ্রাম
এই অবস্থায় নিজেদের গণতান্ত্রিক ও জাতীয় অধিকার রক্ষায় হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে প্রতিরোধ করা ব্যতীত বাংলাদেশের জন সাধারণের আর কোন বিকল্প ছিল না। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ এবং পুলিশ জন সাধারণের সাথে যোগ দেয়, মুক্তি ফৌজ/ বাহিনী গঠন করে এবং যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় অধিকার রক্ষার জন্য মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য সুসজ্জিত পাক সেনা বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করা ছাড়া জন সাধারণের আর কোন বিকল্প ছিল না। জন সাধারণের জন্য দ্বিতীয় কোন বিকল্প পথ খোলাও রাখা হয়নি।
এটা এমন ছিল যে গণতন্ত্র ও শায়ত্ব শাসণের জন্য বাংলাদেশের জন সাধারণের সংগ্রাম পরবর্তীতে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার স্বশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নেয়।
আওয়ামী লীগকেও, যারা কিনা বিগত নির্বাচনে জন সাধারণের নিরঙ্কুশ সমর্থণ পেয়েছিল, এই প্রজাতন্ত্রের একটি নতুন সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে স্বাধীনতার সংগ্রাম এই অবস্থায় চালিয়ে যেতে বাধ্য হতে হয়েছিল।
বৃহৎ শক্তির ভুমিকা
এখানে স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন সরকারের মনোভাব সম্পর্কে বলা আছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ইউএসএসআর স্পষ্টত বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা করে এবং আরও বলেন বাংলাদেশের সমস্যা অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা উচিৎ যা অস্ত্র দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়। এটি ইউএসএসআর এর চিঠি যা ইয়াহিয়া খানের প্রতি কমরেড প্রডগরনিযের, যা বাংলাদেশের জনগণ সহ আমাদের পার্টি দ্বারাও প্রশংসিত হয়। বাংলাদেশের জনগণ ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণসহ কম্যুনিস্টদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যাখ্যার প্রশংসা করে এবং কম্যুনিস্টদের অন্তর্ভুক্ত করেন।
কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এটাও দেখেন যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীতা এবং রিপাবলিক অব চায়নার মাওবাদী নেতারা পাকিস্তানের প্রগতিবিরোধী শোষণকে সমর্থন করছে, এই দুই সরকার বস্তুত বাংলাদেশের গণহত্যাকে উপেক্ষা করছিল। এবং ইউএস এর এর সাম্রাজ্যবাদীদের আচরন ছিল সন্দেহজনক।
একটি সংগ্রাম
প্রকৃত ঘটনাগুলো থেকে নিচের বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলঃ
(১) বাংলাদেশের সাম্যবাদের সংগ্রাম তখন তুঙ্গে এবং প্রগতিবিরোধীদের শোষণের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সাল থেকে করা স্বায়ত্তশাসন বহন করা যা গনতন্ত্র এবং বিভিন্ন জাতীয় অধিকার এর বিরুদ্ধে ছিল নির্মমভাবে ।
(২) বাংলাদেশের জনগণ কখনই পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা চাইতোনা। কিন্তু তারা সর্বদাই গনতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং ১৯৭০ এর হওয়া নির্বাচনের মাধ্যমে গনতন্ত্রের এবন জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইতো। এমনকি নির্বাচনে সুদূরপ্রসারী জয় এবং জাতীয় সমাবেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, আওয়ামীলীগ এবং আওয়ামীলীগের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কখনই ছয় দফা দাবির উপর ভিত্তি করা সংবিধানের থেকে বেশি কিছু চাইতেন না। শেখ মুজিব বারবার সামরিক জান্তা শাসনসভার সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টাও করতেন।
(৩) কিন্ত ইতোপূর্বে হওয়া নির্বাচনে সামরিক জান্তার শাসকগ্ণ জনগনের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়, যার ফলে নিরীহ মানুষের উপর অবিশ্বাস্য হামলা আরম্ভ হয়।এমনকি সৈন্যবাহিনীর ও ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন উদ্দেশ্য ছিল না। ইয়াহিয়া-মুজিব কথোপকথন সৈন্যবাহিনীর আক্রমনএর প্রস্তুতির জন্য সময় লাভ করার ছল ছাড়া আর কিছুই ছিলনা।
এর পর এটিই ছিল সৈন্যদের সেই আক্রমন যা সাম্যবাদী সংগ্রাম এবং স্বায়ত্তশাসন মাতৃভূমির জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধের রুপ নেয়।
(৪) এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল একচেটিয়া শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদীদের বিশেষ করে ইউএস এর সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে ৭৫ লক্ষ বাঙ্গালীর মৌলিক সংকল্প।
(৫) কোনভাবেই এটি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়। বরং বাংলাদেশের এই মুক্তি সংগ্রাম হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যা পশ্চিম পাকিস্তানে জুলুম নির্যাতনের শিকার মানুষের গণতন্ত্র ও স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনেও ভূমিকা রাখবে।
(৬) স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে মুক্তিফৌজ (লিবারেশন আর্মি) এবং বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা। অতএব, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকারের চালানো অপপ্রচার যেমন এটা “ভারতের উস্কানিতে চলা সংগ্রাম”, “ভারতীয় সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা সংঘটিত যুদ্ধ” এবং “ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে” ইত্যাদি, গুজব ছাড়া কিছুই নয়। একইভাবে পিকিংপন্থী কিছু গ্রুপ অপপ্রচার চালাচ্ছে যে এই মুক্তি সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদীদের মদদে হচ্ছে যা একটি জঘন্য মিথ্যা।
উপরিউক্ত সার্বিক পরিস্থিতি বিচারে বিশ্বের সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ নিশ্চিত হতে পারে যে আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য চলমান মুক্তি সংগ্রাম হচ্ছে সেইসব দেশী এবং বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যারা মানবতা এবং শান্তির শত্রু।
বাংলাদেশে এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর পরাজয় দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় গণতন্ত্র এবং শান্তির পক্ষে কাজ করা মানুষের শক্তি বৃদ্ধি করবে।
আপীল
অতএব পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্বের সকল ভ্রাতৃপ্রতিম কমিউনিস্ট এবং ওয়ার্কার্স পার্টি এবং গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কাছে নিম্নলিখিত ঐকান্তিক দাবী পেশ করছেঃ-
ক) পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগীতা প্রদান করুন যেন এই মুক্তিযুদ্ধে বিজয়লাভ করা যায় এবং দেশি ও বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজিত ও মূলোৎপাটন করা যায়।
খ) জোরালো আওয়াজ তুলুন যেন বিশ্বের সকল সরকার, বিশেষ করে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলো বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আগ্রাসন মোকাবেলায় সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়।
পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) কমিউনিস্ট পার্টি সবসময়ই বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অপরিহার্য অংশ থেকেছে এবং ১৯৬৯ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব কমিউনিস্ট সম্মেলনে জারিকৃত নথিতে স্বাক্ষর প্রদান করেছে। পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) কমিউনিস্ট পার্টি আশা করছে যে আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষার এই মুক্তি সংগ্রামে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং বিশ্বের অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতিম দলগুলো সহযোগিতা করবে। এটি একটি আপাদমস্তক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত নির্মম ও বর্বর সাম্রাজ্যবাদী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই যা চীনা মাওবাদীদের সমর্থন পাচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের এই সংগ্রামটি নিঃসন্দেহে একটি ভয়ানক সংগ্রাম। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় অর্জনে বিশ্বের সকল প্রগতিশীল এবং কমিউনিস্ট শক্তির সমর্থন এবং সহযোগিতা একান্ত জরুরী।
আমরা এই সহযোগিতার দিকে চেয়ে আছি এবং তা আসবে বলেই আশা করছি।
বিপ্লবী শুভেচ্ছান্তে,
বাংলাদেশ
৩রা মে, ১৯৭১
আবদুস সালাম
সেক্রেটারি, কেন্দ্রীয় কমিটি
পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) কমিউনিস্ট পার্টি।