শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
ভারত-পাকিস্থান যুদ্ধের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী | “বাংলাদেশ”-পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত পত্রিকা | ৩ নভেম্বর, ১৯৭১ |
ভারতের উপর পাকিস্থানের নগ্ন আক্রমণের প্রতি বাংলাদেশের নেতাদের নিন্দা জ্ঞাপন
৭.৫ কোটি বাংলাদেশী জনগণ সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় জনগণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছে
পাকিস্থান সম্পূর্ণরুপে এককভাবে এবং কোন রকম উস্কানি ছাড়া ৩ ডিসেম্বর ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে পাকিস্থানের এই নগ্ন আগ্রাসনের প্রতি সমস্ত শান্তিপ্রিয় মানুষ নিন্দাতে মুখর হয়ে উঠে। বিকাল ৫.৩০ ঘটিকার সময় মিসেস.গান্ধী কলকাতা ব্রিগেডের কুচকাওয়াজ ময়দানের মঞ্চ থেকে জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। প্রায় সেই সময়, পাকিস্থানের বিমান বাহিনী পশ্চিম সেক্টরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থানের উপর বিমান হামলা শুরু করে। একই সাথে পাকিস্থানী গোলন্দাজ বাহিনী দূরপাল্লার কামান হামলাও শুরু করে।
বাংলাদেশী নেতারা ভারতের উপর পাকিস্থানের এই ঘৃণ্য হামলার প্রতি চরম নিন্দা জানায় এবং একইসাথে ভাত্রিসুল্ভ ভারতের উপর বাংলাদেশী জনগণের সম্পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ভারতের মাটির উপর পাকিস্থানের এই নগ্ন আগ্রাসনের চরম নিন্দা জানান এবং একই সাথে বলেন বাংলাদেশী ৭.৫ কোটি জনগণ তাদের সম্পূর্ণ সমর্থন দিয়ে ভারতের জনগণকে তাদের মাটি থেকে শত্রুদের সমূলে উৎখাত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে মুজিবনগরে অবস্থিত খন্দকার মোশতাক এক বিবৃতিতে বলেন তিনি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে মিসেস. ইন্দিরা গান্ধীর গতিশীল নেতৃত্বে সাহসী ভারতীয় সামরিক বাহিনী খুব শীঘ্রই বিজয় এবং সন্মান ছিনিয়ে নিয়ে আসবে সারা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্য।
পূর্ণ বিবৃতিটি নিম্মরূপঃ-
“ভারতের মাটিতে পাকিস্থানের এই রকম কাপুরুষোচিত এবং অবিবেচিত আক্রমণকে নিন্দা জানার মত কোন ভাষা-ই যথেষ্ট না এবং পাকিস্থানের সব সময় প্ররোচনার সত্ত্বেও ভারত তার সাবড়ভোমরত্ত সবসময় শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করে গেছে।
ইসলামাবাদের সামরিক জান্তারা তাদের ক্ষমতালিপ্সুতা এবং রক্ততৃষ্ণার জন্য একবার বাঙ্গালী জাতির সক্ষমতা এবং সম্ভবনাকে অবমূল্যায়ন করেছিল। সেই একই বিবেকবর্জিত এবং দেউলিয়া নেতৃত্ব মহান গণতান্ত্রিক দেশ, ভারতবর্ষের ক্ষমতা এবং শক্তিকে অবমূল্যায়ন করার দুঃসাহস দেখায়। কিন্তু এইবার তাদের এই মূর্খতা প্রসূত পদক্ষেপ, তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস এবং বিলুপ্ত করে দিতে পারে। বাংলাদেশের ৭.৫ কোটি ভারতের জনগণের সাথে সম্পূর্ণভাবে একাত্মতা ঘোষনা করে, মানবতা বিরোধী এই শত্রুদের সমূলে উৎপাটন করতে এক সাথে কাজ করে যাবে। যে কোন আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমারা অথবা মুক্তি বাহিনী এই অঙ্গীকার রক্ষা করতে বদ্ধ পরিকর।
আমারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে মিসেস. ইন্দিরা গান্ধীর গতিশীল নেতৃত্বে সাহসী ভারতীয় সামরিক বাহিনী সারা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্য খুব শীঘ্রই বিজয় এবং সন্মান ছিনিয়ে নিয়ে আসবে। যুদ্ধবাজ, অত্যাচারী পাকিস্থানী শাসকগোষ্ঠী সবসময়-ই পৃথিবীর এই অঞ্চলে শান্তি এবং উন্নতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ঔপনিবেশিক চক্র বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে।
এই অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর মিরত্তু ফাঁদ আমরা তৈরি করে চলেছি। সেই দিন আর খুব বেশি দূরে নয় যেদিন তাদেরকে কবরের শান্তির স্বাদ দেওয়া হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ এবং পুনঃবাসন মন্ত্রী জনাব এ. এইচ. এম কামরুজ্জামান বলেন এই যুদ্ধ স্পষ্টতই তথাকথিত পাকিস্থান নামের রাষ্ট্রকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিবে। তিনি সিন্ধ এবং বেলুচিস্থান নেতাদের প্রতি আহবান জানান তারা পাকিস্থানী সামরিক জান্তাদের নিষ্ঠূর শাসনের খপ্পর থেকে বন্ধনমুক্তির জন্য সর্ব শক্তি দিয়ে আন্দোলন শুরু করে।
জনাব কামরুজ্জামান ঘোষণা করেন যে বাংলাদেশকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সৈনিকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবে।
ভারতের জনগণ এবং সরকারে প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি, তিনি আরও উল্লেখ করেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বোধকরি শুধু এশিয়ার ভিতরে-ই নয়, সারা পৃথিবীর ভিতরে গণতন্ত্র সর্বশ্রেষ্ঠ এবং উজ্জ্বল পৃষ্ঠপোষক। আর সেই জন্যই বাংলাদেশের ক্রান্তিলগ্নে মুক্তি বাহিনীকে তিনি সহায়তা প্রদান করেছেন। মন্ত্রী আর বলেন বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
অর্থমন্ত্রী
অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী বলেন যে মুক্তি বাহিনী এবং ভারতীয় সৈনিকেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এক নুতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করবে। এই ঘটনাটা ইতিহাসের পাতায় উদাহরণ হয়ে থাকবে। অর্থমন্ত্রী আরও আশা করেন যে ভারত যেমন যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তি বাহিনী কে সাহায্য করছে, যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশ গোড়তে একই ভাবে সহায়তা করবে।
হাই কমিশনার
ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের হাই কমিশনার জনাব এম. হোসেন আলী বলেন “পাকিস্থানের জান্তা কর্তৃক ভারতের বিরুদ্ধে এই হটকারী, অঘোষিত এবং অবিবেচিত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ ঘোষণা করায় বাংলাদেশ যারপরনায় হতাশ। এটা খুবই অশোভন এবং নগ্ন আগ্রাসন। বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর উত্তোরত্তর সফলতাতে হতাশ হয়ে সামরিক শাসক গোষ্ঠী এখন ভারতের বিরুদ্ধে কাপুরুষোচিত হামলা করেছে যাতে করে সমগ্র উপমহাদেশে যুদ্ধটা ছড়িয়ে দেওয়া যায়। বাংলাদেশের জনগণের কাছে যুদ্ধে হারার লজ্জাকে ঢাকার, এটা তাদের একটা মরিয়া প্রচেষ্টা মাত্র।
এই নগ্ন আগ্রাসন মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন পাকিস্থানি শাসক গোষ্ঠীর পাপের এবং অপরাধের পেয়ালা পরিপূর্ণ করেছে। যদি তারা মনে করে, গনতান্ত্রিক ভারতের শান্তিপ্রিয় ৫৫ কোটি জনগণের শক্তি এবং সামর্থ্যকে ঠেকানোর ক্ষমতা রাখে তবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করে। আমরা নিশ্চিত যে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর গতিশীল নেতৃত্বে দৃঢ়চেতা ভারতীয় জনগণ পাকিস্তানের এই আগ্রাসনকে সমূলে উৎপাটিত করবে এবং পশ্চিম পাকিস্থানের হটকারী সেনাপতিদের এমন শিক্ষা দিবে যে তারা কখনও ভুলবে না।