You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971 | বিদেশে অবস্থানরত বাঙালীদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আবেদন | পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোণাম সূত্র তারিখ
বিদেশে অবস্থানরত বাঙালীদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আবেদন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় —– ১৯৭১

 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
বিদেশে বাংলাদেশের নাগরিক ও বন্ধুদের জন্য
মুজিবনগর,
বাংলাদেশ

ভদ্রোমহোদয়গণ,
বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে জড়িয়ে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে খুবই প্রশীক্ষিত ও সশস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সৈনিকেরা প্রতিরোধ গড়েছে এবং লড়াই করছে। তাদের চাওয়া পরিস্কার। বাংলাদেশের প্রতি তাদের ঔপনিবেশিক নীতি তারা চালিয়ে যেতে চায়। আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার শেষ মরিয়া প্রচেষ্টায় তারা ধ্বংস, হত্যা ও সংঘর্ষের পথ বেছে নিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী শত শত গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে, আমাদের সব বড় বড় শিল্প প্রকল্প ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। তারা নির্বিচারে আক্রমণ করেছে এবং বোমা হামলা চালিয়েছে। আমাদর মায়েদের হত্যা করেছে, বোনদের ধর্ষণ করেছে এবং হাজার হাজার অসহায় মানুষকে দেশের বাইরে বিতারিত করেছে। তারা যেখানেই যায়, শিশু ও তরুণদের হত্যা করে, বাড়িঘর, ব্যাংক ও জুয়েলারি লুট করে, খাদ্যশস্য ও পশু চুরি করে এবং সবশেষে কাউকে জীবত না রেখে এলাকার পর এলাকা পরিত্যক্ত করে ছাড়ে।
বাংলাদেশের বীর জনতা যদিও যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যার খবর জানার পর ২৪ ঘন্টার মধ্যেই সারা বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
মানব ইতিহাসে এরকম গণহত্যা চালানোর নজীর আর নেই। সেই নৃশংসতার বিশদ এখানে আর উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই, কারণ আমরা নিশ্চিত যে বিশ্ব সংবাদমাধ্যম, রেডিও এবং বিশেষ করে ভারতীয় সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা জেনে গেছেন।
এই যুদ্ধে আমাদের সবারই অংশ নিতে হবে। ইংল্যান্ডে হোক বা আমেরিকায়, কিংবা জাপানে, এমনকি আইসল্যান্ডে, প্রতিটি বাঙালিই আমাদের মুক্তিবাহিনীর অংশ। আমরা আশা করি যে যেখানেই যে থাকি, আমরা প্রত্যেকেই সম্ভব যে কোনো ভাবে এই লড়াইয়ে অংশ নেব। অসহায় ও আর্ত ৭৮ মিলিয়র মানুষের জন্য এখন সারা বিশ্বের মনোভাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ভেতরে যেমন, তেমনি বাইরেও এই যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ।
ভদ্রমহোদয়গণ, এই মাটির সাহসী সন্তানেরা যখন শত্রুর আগ্রাসন থেকে এই মাটিকে রক্ষায় কঠিন যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ছে, দেশের বাইরে আমাদের নাগরিকরাও সমান অবদান রাখতে পারে যুদ্ধে নিজেদের সম্পৃক্ত করে, জনমত ও বিশ্ব মতামত গঠন করে, সভা-সেমিরার আয়োজন করে, তহবিল সংগহ করে, ত্রাণ ও প্রয়োজনীয় সরবরাহ পাঠিয়ে।

কি করা উচিত:
১. যুদ্ধের ময়দানের ধরণ মতো সংগঠন থেকে এবং দেশে যদি এই ধরণের সংগঠন একটির বেশি থাকে, পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করুন এবং সমন্বিত ফেডারেশন ধরণের সংগঠন গড়ে তুলুন যাতে একটি সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যায় ও যোগাযোগ করা যায়। যদি না অন্যভাবে অবাস্তব মনে হয়,, উপরে উল্লেখিত পদ্ধতি অনুসরণ করুন।
২. বাংলাদেশের নামে ও ধরণে একটি ব্যাংক হিসাব অবশ্যই খুলতে হবে অন্তত দুজন লোককে পরিচালনা করতে হবে। যোগাযোগের জন্য একটি তার সঙ্কেত থাকতে হবে এবং প্রতিটি কার্যক্রমে একটি স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে।
৩. বাংলাদেশের মানুষ আশা করে আপনারা লড়াই চালিয়ে যাবেন এবং বিশ্ব মতামত গঠনে তদবর চালিয়ে যাবেন, বিশেষ করে আমেরিকান ও কানাডিয়ান সংবাদমাধম, রেডিও ও টেলিভিশনে। আপনাদের সংগঠন একটি সংহতি কমিটির পৃষ্ঠপোষণা করতে যারে, যেখানে থাকবে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি, সংবাদকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষক এবং বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নানা মতের লোকের প্রতিনিধি ও ব্যক্তিত্ব, যারা আপনাদের হয়ে আন্দোলন চালিয়ে নেবে। জাতীসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসহ বিশ্বের সবদেশের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে হবে আপনাদের।
৪. সোভিয়েত রাশিয়া দূতাবাস, ভারতীয় হাই কমিশন ও আমাদেরকে সমর্থন করছে এরকম দেশগুলির সঙ্গে দৈনন্দিন যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হবে এবং অগ্রগতির খোঁজখবর নিতে হবে।
৫. তদবিরের মাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে বিভিন্ন দেশের ভাবনার খোঁজখবর রাখতে হবে।
৬. পাকিস্তানের সংশ্রব ত্যাগ করার জন্য বাংলাদেশের কূটনীতিকদের চাপ দিতে হবে এবং যেখানেই সম্ভব, বাংলাদেশের মিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৭. গণহত্যা বন্ধে কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য ইয়াহিয়া খান ও তার দোসরদের শাস্তির জন্য ইন্টারন্যাশলনাল কোর্ট অব জাস্টিস-এ পিটিশন দায়ের করতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল কমিশন ও জুরিস্টস-এর কাছেও যাওয়া যেতে পারে এবং তাদের সুপারিশ অনুসরণ করা যেতে পারে, ইতিমধ্যেই যা বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে।
৮. জাতীসংঘের মানবাধিকার সনদ এবং প্রাসঙ্গিক নানা ফোরামেও এই ধরণের লক্ষ্যে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে হবে। গণহত্যা সনদের সুবিধা নিতে হবে। সমর্থ, অনুপ্রাণিত ও খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক জুরিদের সম্পকৃত করতে হবে।
৯. জাতিসংঘের একটি পরিদর্শক দলের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা উচিত সত্যিকারের অবস্থা বুঝতে।
১০. রোগবালাই ও দুর্ভিক্ষ প্রায় আসন্ন। সংরক্ষিত খাদ্যের বেশির ভাগই সামরিক জান্তা লুট করে নিয়েছে বা বোমা মেরে ধ্বংস করেছে। খাদ্যশস্যের ঘাটতি এখন চরম। লক্ষ লক্ষ লোক এর মধ্যে না খেয়ে আছে। দয়া করে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও অন্যান্য মানবতাবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করুন দ্রুত ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে।
১১. সব ধরণের তদবির সামলাতে হবে রাজনৈতিক হাতে সর্বোচ্চ যত্ন ও পরিশীলত ভাবে। মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক আঙিনায় ইতিমধ্যেই আমরা যা অর্জন করেছি, সেসব নস্যাত করতে পারে একটি ভুল পদক্ষেপই। যথোপযুক্ত সময়ে আমাদের দূত পাঠানো হবে এবং প্রয়োজনীয় লিঁয়াজোর জন্য বিশ্ব আপনাদের সঙ্গে যোগযোগ করবে। আমাদের মৌলিক দর্শন হলো, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গেই বিদ্বেষ নয়।” বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে একতা ও বন্ধুত্ব। আমাদের চাওয়া শান্তিপূর্ণ সহবস্থান ও বিশ্ব শান্তি।
১২. ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে নৃশংসতার ব্যাপার আপনারা এরমধ্যেই জেনেছেন। আপনারা যতটা জেনেছেন, সেটিকে আরও গুরুতর করে তুলতে হবে আমাদের। বিশদ জানার জন্য ভারতীয় পত্রিপত্রিকা পড়ুন। বিদেশী সংবাদমাধ্যমকে বলা হতে পারে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেহেতু সব বিদেশী সাংবাদিককে আটকে রেখেছে, একমাত্র উপায় খোলা আছে ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করা। এভাবে যেসব সংবাদ সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেগুলোতে তাই প্রাপ্য গ্রহণযোগ্যতা ও গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং আমরা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, যাতে তারা নিজেরাই দেখতে পারে এখানকার পরিস্থিতি, বাংলাদেশ সরকারের কার্যকারিতা ও স্থিতিশীলতা এবং বিশেষ করে, যে অতুলনীয় মনোবল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমাদের জনতা বিদেশী বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে।
১৩. পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী এখন কেবল সীমাবদ্ধ আছে শহর ও সেনানিবাস এলাকায়। বাকি পুরো বাংলাদেশ মূলত বাংলাদেশ সরকারের কার্যকরি নিয়ন্ত্রণে আছে। গ্রামের নিরীহ ও অসহায় মানুষেরা খাদ্য, আশ্রয় ও নিরাপত্তার জন্য পুরোপুরি নির্ভর করছে বাংলাদেশ সরকারের ওপর। এটি বিশাল পরিসরের কাজ এবং দেশের ভেতরে-বাইরে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন।
আশু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র:
(ক) মিডিয়াম-ওয়েভ সম্প্রচার ট্রান্সমিটার, যেটি অন্তত ৩০০ মাইল পর্যন্ত কাভার করবে।
(খ) অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ (সুনির্দিষ্ট হওয়া ও পরিবহনের মাধ্যম জানার জন্য যে দেশে আছেন, সেই দেশে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এই ধরণের কোনো প্রতিনধির সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়া পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনা করবেন না)।
(গ) যোগাযোগের জন্য ওয়াকি-টকি ও ওয়ারলেস ট্রান্সমিটার
(ঘ) খাদ্যশস্য
(ঙ) লবণ
(চ) ম্যাচ ও কেরোসিন
(ছ) বস্ত্র (সামরিক ও বেসামিরক উভয়ই)
(জ) ওষুধ ও মেডিকেল যন্ত্রপাতি
(ঝ) পেট্রোল, ডিজেল ও জ্বালানি তেল
(ঞ) অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র
(ট) নগদ অর্থ (স্পষ্ট নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত পাঠানোর প্রয়োজন নেই)
(ঠ) তাবু ও তেরপল
(ড) বুট ও অনান্য পোশাক
১৪. ঐক্য প্রকাশ ও যোগাযোগের জন্য আপাতত ব্যবহার করুন এই ঠিকানা, বাংলাদেশ মিশন, ৯, সার্কাস এ অ্যাভিনিউ, কলকাতা-১৭.

রহমত আলি
(বাংলাদেশ সরকারের জন্য ও পক্ষে)