You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971 | বাংলাদেশ-ভারত যুদ্ধ সম্পর্কে একটি খতিয়ান | পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোণাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশ-ভারত যুদ্ধ সম্পর্কে একটি খতিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় —– ১৯৭১

 

গোপনীয়
পজিশন পেপার
———–
ই্ন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধ

এই বছরের মে ও জুন মাসে ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধের শঙ্কা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু পরবর্তীতে সেই শঙ্কা কোনো ভাবে নিবারণ করা সম্ভব হয়েছে ১৯৭১ সালের অগাস্টে স্বাক্ষরিত ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি অনুযায়ী।
ইন্দো-রাশিয়ান চুক্তির মৌলিক দিকগুলোয় সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নরূপ:
ভারতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে, বিশেষ করে নন-কংগ্রেস ও বাম রাজ্যগুলোতে এবং গত ২৪ বছরে তৈরি করা ভারী শিল্প যখন ফলপ্রসূ হতে শুরু করেছে, তখন পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো ধরণের কোনো সংঘর্ষে গড়ানোর ইচ্ছে তাদের ছিল না। পাশাপাশি, পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে উল্লেখযোগ্য স্থিতিশীলতা এনেছে এবং সেটি বাধাগ্রস্থ ও বিঘ্নিত করতে দেওয়া যাবে না।
পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোনো ধরণের সংঘর্ষ একটি সার্বিক যুদ্ধে রূপ নেবে এবং ভারত সেই ঝুঁকিটা নিতে পারে, যদি পুরোপুরি সুনিশ্চিত হওয়া যায় যে, (ক) এখানে কোনো তৃতীয় পক্ষ জড়াবে না, (খ) পাকিস্তানকে সামরিক ভাবে হারাতে পারবে (গ) যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত সময়, ৭-১০ দিনের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করতে পারবে। ভারতের সমর কৌশল কখনোই উপরে উল্লেখিত তিনটি শর্ত নিয়ে নিশ্চিত হতে পারবে না এবং এই কারণেই সবসময়ই যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
বাংলাদেশ সঙ্কট নিয়ে ভারতের পর্যালোচনা:
(ক) বাংলাদেশে যুদ্ধ করে পাকিস্তান টিকে থাকতে পারবে না এবং নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে না। কিছু সময়ের জন্য যদি নিয়ন্ত্রণে আনতেও পারে, অর্থনীতি কখনও সঠিক পথে ফিরবে না। পাকিস্তান দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়বে এবং কোনেদিনই ভারতের জন্য রাজনৈতিক বা সামরিক হু,কি হয়ে উঠতে পারবে না।
(খ) পাকিস্তানে, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানে আজ হোক বা কাল, সাধারণ ব্যবসায়ী, কৃষক ও শিল্প শ্রমিকদের ওপর অর্থনৈতিক ধসের প্রভাব পড়বেই। রাজনৈতিক উপাদান থেকে উৎসরিত চাপের পাশাপাশি এটিও চাপ সৃষ্টি করবে, যেটি চূড়ান্তভাবে সামরিক শাসকদের সঙ্গ সংঘর্ষের দিকে ধাবিত হবে। এটি একটি মনস্ত্বাত্ত্বিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যখন পাকিস্তানী শাসকরা বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে ইস্যুটি থিতু করবে এবং কেবল তখনই কোনো নিষ্পত্তি হলে সেটি আমাদের পক্ষে আসবে। এই নিষ্পত্তি হয়ত বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য।
(গ) অন্যদিকে ভারত কখনোই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর কথা ভাবেনি এবং ইন্দো-রাশিয়ান চুক্তিতেই সেটি পরিস্কার ফুটে ওঠে। এই কারণে ভবিষ্যতেও তারা কখনোই এমন কিছু করবে না যেটায় ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধের শঙ্কা বাড়াবে। এটির তাৎপর্য হলো, এই পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীকে ভারত এমন ভাবে অস্ত্রের জোগান দেবে, যেটির ফলে পাকিস্তান বলবে যে ভারত পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করেছে।
মুক্তিবাহিনীর বড় কোনো বিজয় এই পর্যায়ে বিবেচিত হবে পাকিস্তানে ভারতের সশস্ত্র অনুপ্রবেশ হিসেবে।
(ঘ) স্বীকৃতির প্রশ্নটিও তাই উঠছে না। ভারত যদি মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র নিয়ে আরও সহায়ত করতে চায়, সেটি তারা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়াই করতে পারে। স্বীকৃতি দেওয়া মানেই তাই সার্বিক পরিমণ্ডলে সহায়তা বেড়ে যাওয়া নয়, যদিও সাধারণ মানুষের ধারণা যে স্বীকৃতি দেওয়া মানেই মুক্তিবাহিনীর প্রতি ভারতের সহায়তা বিশাল আকালে বেড়ে যাওয়া। এজন্যই ভারতের এখনও সময় হয়নি সত্যিকার অর্থেই স্বীকৃতি বা সহায়তা দেওয়ার।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপে এবং বিশেষ করে পশ্চিবঙ্গের পরিস্থিতির কারণে, ভরতে কখনও কখনও কংগ্রেস সরকারের কাছে হয়ত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া উপযুক্ত মনে হতে পারে, কিন্তু আগামী ছয় মাসের মধ্যে এলে সেটি স্রেফ একটি কাগুজে স্বীকৃতি হবে।
ভারতের জন্য এখনও পর্যন্ত পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের মূল প্রয়োজন ঠিকই মিটেছে এবং নিকট ভবিষ্যতেও মিটবে। এর মধ্যে তারা একই অবস।তান ধরে রাখবে যেটি এখন চলছে। তারা এমন ভাবে সহায়তা চালিয়ে যাবে যেটায় ভারী অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ বা মুক্তাঞ্চল হিসেবে কোনো ভূখন্ড স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে বিমান বা গোলন্দাজ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে চোখধাঁধানো কিছু মনে হবে না।
পাকিস্তান সরকারের মূল অবস্থান হলো, ভারতের কারণে তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। সেই কারণেই এটি ইন্দো-পাকিস্তান বিরোধ। তাদের অভিসন্ধি ধরে রাখতে এবং বিষয়টি আন্তর্জাতিক এখতিয়ারের নিয়ন্ত্রণে আনতে ইয়াহিয়া সরকার একবার এবং এখনও ভঅরতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে, শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের মূল্য ইস্যুটি অন্যটি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে।
শঙ্কাটা এখনও আছে। পাকিস্তানের জন্য সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের প্রথম ভাগ হবে আন্তর্জাতিক একটি সংঘর্ষের জন্য জুতসই সময়। এজন্যই তারা এখন পর্যালোচনা করছে, এই সময়টি পেরিয়ে গেছে কি না। বাংলাদেশ নিয়ে কঠোর যে কোনো কিছুই করবে ভারত। রুশ সরকারের কাছ থেকে তারা এটাই খুজেঁ বের করার চেষ্টা করছে। যদি ভরত সরকারের এই ধরণের কোনো পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া যায়, পাকিস্তান সরকারও এই সময়ে ভারতের সঙ্গে সীমান্তে ভয়াবহ রকমের সংঘর্ষের ঝুঁকি নেবে। অন্যদিকে, যদি তারা রুশ সরকারের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পায় (যেটি তারা সবসময়ই পাচ্ছে), তাহলে পাকিস্তান সরকারের এরকম কিছু করার সম্ভাবনা নেই।

পর্যালোচনা
বাংলাদেশ সরকারের উচিত স্বীকৃতির চেয়ে অস্ত্র সহায়তা ও সরবরাহে বেশি জোর দেওয়া। কারণ এতদিনে এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত যে যুদ্ধ আমাদের জিততে হবে নিজেদেরই। যত দ্রুত জিততে পারি, ততই আমাদের জন্য ভালো এবং এজন্যই যুদ্ধ পরিচালনা ও জয়ের জন্য একটি স্বতন্ত্র নীতি বাংলাদেশ সরকারের গড়ে তুলতে হবে। নিজস্ব শক্তিতেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এখনকার মতোই জোড়ালো রাখার দাবী জানানোর সময় এসেছে। ভারত আমাদের প্রতি অনেক বেশিই নিবেদিত এবং আমাদের স্বীকৃতি ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতেই হবে কেবলমাত্র তখনই, যখন সময় তাদের দিক থেকে উপযুক্ত হবে এবং সেই সময়টা কাছে নিয়ে আসতে আমরা ভূমিকা রাখতে পারি।