You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.16 | ১৬ই ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণ | পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় - সংগ্রামের নোটবুক
               শিরোনাম                     সূত্র                      তারিখ
১৬ই ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণ          পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়          ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

যেন মনুষ্যত্বকে গ্রাস না করে

বাংলার অজেয় ভাইবোনেরা,

আচ্ছালামু আলায়কুম !

রক্তাক্ত একটা ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে আমরা এসে পৌঁছেছি। বাঙালীর রক্তে গড়া লোহিত-সাগরের অতল তল থেকে একটা নতুন জাতি জন্ম নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। নাম তার বাংলাদেশ। শত সহস্র তরুণের বুকের রক্ত বাংলার শ্যামল মাটির বুকে অমিত ও অজেয় বিক্রমের আলপনা এঁকে দিয়েছে। এ রক্তিম আলপনার পাশাপাশি চলেছে অশ্রুভেজা কান্নার স্রোত। সারা বাংলা আজ অশ্রুসাগরে ভাসছে। কিন্তু সে অশ্রুই শেষ কথা নয়। অশ্রুসাগর পাড়ি দিয়ে এসেছে স্বাধীনতার সূর্য। পূত পবিত্র চিত্তে এ সূর্যকে বরণ করে নিতে হবে হাসিমুখে। আরা আর কাঁদব না।

আজকের কর্তব্য

স্বাধীনতার দুর্জয় সংগ্রামে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা বীরের মৃত্যু বরণ করেছেন। মরে তাঁরা অমর হয়েছেন। আমরা যারা বেঁচে আছি এবং যারা পৃথিবীর হলাহল পান করে মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি তাদের হয়তো দেয়ার মত আর বেশি কিছু নেই। আসন্ন আগামীর হাতে অনাগত ভবিষ্যতের দায় ও দায়িত্ব তুলে দেয়ার প্রতীক্ষায় সত্যনিষ্ঠ হইয়ে অপেক্ষা করাই আমার মতো মানুষের আজকের কর্তব্য।

স্বাধীনতার স্বর্ণফসল

আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সুদীর্ঘ ন’টি মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। দুর্বিষহ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে বাংলার প্রতিটি মানুষ এ দিনগুলো কাটিয়েছেন। পরম করুণাময়ের অপার অনুগ্রহে অচিরেই সেসব নিগ্রহের দিনগুলো দূর হবে আমাদের এ বিশ্বাস আছে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ অভূতপূর্ব ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। সে স্বাধীনতাকে সুসংহত করার জন্যে চূড়ান্ত সংগ্রাম চলছে। এ সংগ্রাম সাফল্যমন্ডিত হবে সন্দেহাতীতভাবে এ ধারণা আমরা করতে পারি। কিন্তু যেদিন সশস্ত্র সংগ্রাম শেষ হবে আর এক ধরনের সংগ্রাম। সে সংগ্রাম হবে সৃষ্টির সংগ্রাম। যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্ষতবিক্ষত একটা দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ওধর্মনিরপেক্ষতা- এ তিনটি বিঘোষিত জাতীয় মৌলনীতির উপর ভিত্তি করে দেশকে পুনগর্ঠন করতে হবে। দেশে একটা নতুন সমাজ কাঠামো ও মূল্যবোধের সৃষ্টি করতে হবে। যে জাতীয় ঐক্য ও সংগঠন আমাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্যের দিকে এগিয়ে দিয়েছে, সেই একই ঐক্য ও সংগঠন দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীনতার স্বর্নফসল ফলাতে হবে এবং বাংলার ঘরে ঘরে সে ফসল পৌঁছে দিতে হবে।

পতাকার পরিবর্তন নয়

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট আমরা একবার স্বাধীন হয়েছিলাম। কিন্তু সে স্বাধীনতা ছিল পতাকার পরিবর্তন। তাই অচিরেই সে স্বাধীনতা হতাশার বালুচরে হারিয়ে গেছে। শোষণের বেদীতে সে স্বাধীনতার অপমৃত্যু ঘটেছে। এই যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা সে অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের প্রমাণ করতে হবে, স্বাধীনতার মানে পতাকা পরিবর্তন নয়। রকের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সে স্বাধীনতা সম্পূর্ণ ভিন্নতর প্রতিশ্রুতিবাহী। এ সত্যটাকে ব্যক্তি, সমষ্টি ও সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থা এবং আচার-আচরণের মাধ্যমে সঠিকভাবে ব্যাপ্ত ও উপস্থাপিত করতে হবে।
বাংলাদেশের সংগ্রাম ভারত উপমহাদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের সব কটি দেশের দুয়ারে করাঘাত করেছে। মুক্তবুদ্ধি বিশ্ববিবেকগোষ্ঠী বাংলার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের আহবানে সাড়া দিয়েছেন। মানবিক মূল্যবোধ, শান্তি ও সভ্যতার বিকাশে বিশ্বাসী সকল বিশ্ব নাগরিক আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। সমগ্র বিশ্বের সাংবাদিক সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী এবং রাষ্ট্র ও জননেতাদের সাগ্রহ সমর্থনের কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পাকিস্থান ঘরোয়া বা আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে চালিয়ে দিতে বা ছাই চাপা দিতে পারে নি।

গণতন্ত্র হত্যার চেষ্টা

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ আর কারও কাছেই অপরিচিত নয়। কিন্তু বাংলাকে আন্তর্জাতিক জগতে উপস্থাপিত করতে গিয়ে আমরা বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে অনেক দেশ আছে যেখানে জনমত ও গণবিবেক সে দেশের সরকারকে কার্যকরভাবে প্রভাবাম্বিত করতে পারে না। ভূমন্ডলীয় ট্র্যাটেজির স্বার্থে এসব দেশ স্থানীয় জনমতকে নিদারুণভাবে উপেক্ষা করেছে। ফলে সে ধরনের দেশের জনগণের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ কিন্তু সরকারগুলোর ব্যবহারে আমরা ক্ষুব্ধ ও দুঃখিত। গভীর ক্ষোভের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করেছি যে। যেসব দেশ গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় বিশ্বাসী এবং হরদম গণতন্ত্র ও মঙ্গলমানসী বিধিবিধানের কথা কপচাচ্ছেন তারাই পাকিস্তানী স্বৈরতন্ত্রের দোসর হিসেবে অনন্তর গণতন্ত্রকে হত্যার চেষ্টা করেছেন বাংলার মাটিতে।

ভিখারির হাত যদি—

দরিদ্র জাতি ও ক্ষুদ্রায়তন দেহের প্রতি অমর্যাদাকর ব্যবহার প্রদর্শন বা সে দেশের ছোট করে দেখার একটা প্রবণতা আমরা কোন কোন বৃহৎ শক্তির মধ্যে লক্ষ্য করেছি। ভিখিরির হাত যদি আমরা প্রসারিত না করি তাহলে দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে যে আমাদের অমর্যাদা করা যায় না, এ কথাটা স্পষ্টভাবে এদের বলে দেবার প্রয়োজন আছে বলে আমার বিশ্বাস। ক্ষমতার মোহে আর সম্পদের দস্তে মানুষের, বিশেষ, করে অনুন্নত অঞ্চলের মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকে ছোট করে দেখাটা এদের বাতিকে পরিণত হয়েছে। ভিয়েতনাম রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা থেকেও যাদের এ বাতিকের অবসান হয়নি, আশা করি বাংলাদেশের উত্থানের দৃষ্টান্ত দিয়ে তারা তাদের চরিত্র শুধরে নেবেন।

মানুষের শক্তির কাছে-

বিশ্বের কোথাও যদি কোনদিন মানুষের মুক্তি সংগ্রাম বিজয়ী হইয়ে থাকে তবে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামও বিজয়ী হবে। ইতিহাস এ শিক্ষা ও সিদ্ধান্তই ঘোষণা করেছে। বৃহৎ শক্তি, সাম্রাজ্যবাদ, নয়া সাম্রাজ্যবাদ ও শোধনবাদের অক্ট্রোপাশ ছিঁড়ে আমরা যখন বেরিয়ে এসেছি এখন বালির বাঁধ দিয়ে এ জোয়ারের গতিরোধ করা যাবে না। মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বৃহৎশক্তির তোয়াক্কা কোনদিন করেনি। আমরাও করি না। যে শক্তি মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হয় না সে শক্তি পাশব শক্তি। সে পাশব শক্তির বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করছি এবং করব। অতি শক্তিমান দু-এক্টা দেশ তাদের আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তাদের মন ও মানসকিতা আজ দেউলিয়া হইয়ে পড়েছে। চিন্তাক্ষেত্রে যে ক্লীবত্ব তারা অর্জন করেছে তার পর এদের কাছ থেকে মুক্তিকামী মানুষের আশা করার কিছু নেই। মানুষের সংঘবদ্ধ শক্তির কাছে বল্বান ব্যক্তি বাঁ গোষ্ঠী চিরদিন হার স্বীকার করেছে।

ভোগের লিপ্সার অবসান-

নতুন জাতি হিসেবে যে গণশক্তির আমরা করেছি সে গণশক্তি দিয়ে আমরা আমাদের দেশকে গড়ে তুলব। ব্যক্তিসত্তাকে ভূলে গিয়ে গোটা জাতির জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। অসাধু প্রতিযোগিতা বা দলাদলির মাধ্যমে উচ্চাকাংক্ষার চরিতার্থ করার চিরন্তন অভ্যাস আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে। এ ধরনের আকাঙ্কার কাঙালরা অতীতে জাতির সর্বনাশ করেছে। কারণ অসাধু প্রতিযোগিতার দ্বারা তারা সৎ ও চরিত্রবান
ব্যক্তিদের কর্মপ্রেরণা ও প্রবুদ্ধিকে প্রতিহত করেছে। আমরা অবশ্যই আশা করব যে, আমরা দেশের তরুণের বুকের উষ্ণ রুধির-ধারা আকাঙ্ক্ষার কাঙালদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অবলুপ্তির অতল গহবরে। সমগ্র জাতির জন্য আমরা একাত্ম হয়ে কাজ করব এবং জাতীয় সমৃদ্ধির বন্টননামায় আমাদের যা বরাদ্দ থাকবে তাই আমরা ভোগ করব ভোগের লিপ্সার হোক অবসান। ত্যাগের দীপ্তিতে হোক দীপ্তিমান বাংলাদেশের রক্তাক্ত বসুমতি।

ঋণ অপরিশোধ্য

আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলার বাংলার সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষ আবেগ –আপ্লুত ও বিনয়াবনত চিত্তে ভারতের এ স্বীকৃতি গ্রহন করেছে। ভারত শুধুমাত্র আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নয়, এ ভারত অনন্যসুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। ভারত একটা শুধু ভূখন্ডই নয়, এটা বিবর্তনশীল মানব সভ্যতার অর্নিবাণ শিখাসম্পন্ন একটা পিলসুজও বটে। আয়তনের বিরাটত্ব, চিন্তার ব্যাপ্তি, আদর্শের দ্যুতি এবং বৈচিত্রের ঐক্যের সমাহার ভারত মুদু একটা দেশ নয়, এটা একটা উপমহাদেশ। বাংলাদেশের নির্যাতিত মানবতার পাশে ভারত যে অনাবিল বলিষ্ঠতা মানুষের জন্যে হৃদয়-নিংড়ানো প্রেম প্রীতি ভালবাসা দিয়ে ভারতবাসীদের ত্যাগ-তিতিক্ষার মর্যাদা দিতে চেষ্টার ত্রুটি করবে না এ বিশ্বাস আমার আছে। মহান ভাতের সৎ প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের উভয় রাষ্ট্রের সরকারও জনগণের মধ্যকার বন্দুত্ব দিন দিন গাঢ়তর হবে বলে আমাদের স্থিরপ্রত্যয় আছে। ভারতে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তার গতিশীল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দ্বারা ভারতের জীবন দর্শনকে বিশ্বদরবারে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ বলেও আমরা মনে করি।

আর এক বন্ধু

ভারতের পাশাপাশি আমাদের আর এক প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটান আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভুটানের মহারাজা জিগমে দরজি ওয়াংচোক ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের শরণার্থীদের প্রতি যে দরদ প্রদর্শন করেছেন সে সম্পর্কে আমরা ওয়াকিফ রয়েছি। বাংলার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর সহৃদয় সমর্থনের কথাও আমাদের অজ্ঞাত নয়। মহারাজা, তাঁর সরকার ও তাঁর জনগণের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুতে আমরা ব্রতী হব এ আশ্বাস আমরা তাদের দিতে পারি।

রুশ সরকার ও জনগণের প্রতি

বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে সোভিয়েট রাশিয়া আগাগোড়া যে গণমুখী ভূমিকা পালন করেছে সে ভূমিকা শুধু বাংলাদেশের নয়, মুক্তিকামী সকল মানুষের প্রশংসা অর্জন করেছে। রুশ সরকার আমাদের সমস্যা ও সংগ্রামের প্রতি যে গভীর সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন সেজন্য আমরা তাঁদের কাছে অভ্যস্ত কৃতজ্ঞ। আমরা আশা করি যে, রুশ সরকার ও জনগণ আমাদের রক্তাক্ত সংগ্রামকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করবেন এবং তাঁর ফলশ্রুতি হিসেবে তারা আমাদের সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও দেবেন।

স্কেন্ডিনেভীয় ও পোলান্ডসহ পূর্ব ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ আমাদের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। আমাদের সমস্যা, সংকট ও সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁরা ও শ্রদ্ধাশীল। আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা আশা করি, যে। মুক্তিকামী মানুষের সফল সংগ্রামের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে তাঁরাও এগিয়ে আসবেন।

বৃটেন ও ফরাসী ভূমিকিয়া

বৃটেন ও ফরাসী সরকার সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ প্রশ্নে একটা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। আমরা আশা করব যে, নিরপেক্ষতা এটা অর্থহীন কুটনৈতিক অনুশীলন নয়। বৃটেন ও বাংলাদেশের মধ্যকার
সম্পর্ক সুপ্রাচীন। আমরা মনে করি, বাঙালী মানসিকতা ও বাংলার ধ্যানধারনার সঙ্গে বৃটেনবাসীর সম্যক পরিচয় আছে। বৃটিশ ভারতে শাসনবর্হিভূত অঞ্চলশ গঠিত পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধবাজ গণতন্ত্রের দুশমনদের মানসকিতাও তাঁদের কাছে পরিচিত। তাই বৃটেন সরকারের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দুরূহ নয় বলেই মনে করি।

ফরাসী দেশ সভ্যতার প্রথম গণবিপ্লবের উত্তরাধিকারী। গণসংগ্রামকে উপলব্ধি ও অনুভব করার ব্যাপারে তাঁদের একটা সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে। ফরাসী বিপ্লবের উত্তরসুরী বাংলাদেশের বিপ্লবকে স্বীকৃতি জানিয়ে ফরাসী সরকার ও জনগণ তাঁদের গণমুখী ভূমিকা অব্যাহত রাখবেন বলে আশা করা অযৌক্তিক নয়।

পাষাতের রক্ষাকবচ
গণতন্ত্রের পুরোধা বলে প্রচারিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর জনগণতান্ত্রিক বিপল্বের পথিকৃৎ বলে পরিচিত চীন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের কামনা-বাসনার প্রশ্নে যে সম্পূরক নীতি গ্রহণ করেছেন সে নীতির নিন্দা না করে পারা যায় না। জাতিসংঘের ভেতরে ও বাইরে ওয়াশিংটন-পিকিং আঁতাত যে ভূমিকা গ্রহণ করেছে তাতে বিশ্বের স্বাধীনতাকামী প্রত্যেকটা মানুষ স্তম্ভিত হয়েছে। আত্নস্বার্থ ভূমন্ডলীয় যুদ্ধনীতির খাতিরে এ দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তির যে মিতালী হয়েছে। সে মিতালী মানুষের জন কল্যাণে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। সুবৃহৎ দুটি শক্তির এই ধরনের মিত্রতা বিশ্ব মানবগোষ্ঠীর জন্য বড় রকমের একটা সর্বনাশ ডেকে আনার আশংকা রয়েছে বললে আত্যুক্তি করা হবে না। মার্কিন প্রশাসনের হাতে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু আর মহান চীনে মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বরূপের যৌথ অভিব্যক্তি ইয়াহিয়ার মত একটা পাষন্ডের রক্ষাকবচ হইয়ে দাঁড়িয়েছে- এর চাইতে দুঃখের ও ক্ষোভের বিষয় আর কি হতে পারে।

পররাষ্ট্রনীতির রুপরেখা

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম জোতনিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি। আমাদের মত ক্ষুদ্রায়ত্ন এবং উন্নয়য়নকামী দেশকে ভূমন্ডলীয় শক্তি – সংঘাতে জিড়য়ে পড়া থেকে অবশ্যউ বিরত থাকতে হবে। আমরা সর্বপ্রকারের সামরিক জোট বা আঁতাতের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সকল মানুষের প্রতি আমদের সমর্থন থাকবে। কারও প্রতি আমাদের বিদ্ধেষ নেই। সবার জন্যে আমাদের বন্ধুত্বের দুয়ার উন্মুক্ত।

নিষ্ঠুর গ্রহসন দুঃসহ
আওয়ামী লীগ দলের পক্ষ থেকে দলের নেতা এবং স্বাধিন বাংলার জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নির্বাচনপূর্ব বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে ১৯৭০ সালের ২৮ শে নভেম্বর এ পররাষ্ট্রনীতির রুপরেখা জাতির সামনে পেশ করেছিলেন। স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বাংলার আদরের দলাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ ইয়াহিয়াচক্রের কারাগারে আবদ্ধ। কি নিদারুণ পারইপার্শ্বিকতায় না বংলার নয়নমণি দুঃসহ দিনগুলো কাটাচ্ছেন। আজ স্বাধীনতার নবীন ঊষাকে তাঁর অনুপস্থিতি শুধুমাত্র ম্লানই করে দেয়নি, তাঁকে ছাড়া স্বাধীনতা আমাদের কাছে নিতান্তই অপূর্ণাঙ্গ, অসম্পূর্ণ। বাংলার পথে-প্রান্তরে, গ্রামে-গঞ্জে, শহর-বন্দরে বঙ্গবন্ধুর অমোঘ বাণী বাঙময় হয়ে উঠেছে। কিন্তু তিনি থেকেও আমদের মধ্যে নেই। এ মর্ম-যাতনা দুঃসহ এ নিষ্ঠুর প্রহসন আমরা স্বীকার করে নিতে পারি না।
বিশ্ব দরবারে যেসব কুটিল কূটনীতিক নিরন্তর রাজনীতির দাবার ঘুঁটি চালছেন তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছি। শেখ মুজিবুর রহমানের মত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষকে দানবের গ্রাস থেকে উদ্ধার করে আনার দায়িত্ব বিশ্ববিবেকের। লুমুম্বা হত্যার কুৎসিৎ বিয়োগান্তক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেজন্যে তৎপর হওয়া মানবিক মর্যাদাবোধের সকল বিশ্বাসী নাগরিকদের অবশ্য কর্তব্য। বৃহৎ শক্তিবর্গ ও জাতিসংঘের কাছে আমাদের জোর
দাবী এই যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি করে তাঁর স্বপ্নরাজ্য বাংলাদেশে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হোক।
আজকের বিজয়লগ্নে আমি আমাদের মুক্তিবাহিনীর অফিসার ও জোয়ানদের অভিনন্দর জানিচ্ছি। বাংলার ঘরে ঘরে অযুত-লক্ষ যেসব তরুণ স্বাধীনতার পতাককে সমুন্নত রেখেছে তাদের কর্তব্যনিষ্ঠা প্রশংসার্হ। আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেসব ভারতীয় সেনাধ্যক্ষ ও জোয়ান সংগ্রাম করেছেন তাঁদের কাছে আমরা অন্তরের অন্তস্তল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
বাংলার ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমজীবি আর শিল্পি-সাংবাদিক অকুতোভয় আদর্শনিষ্ঠা গণপ্রতিনিধিরা স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্যে যে অক্লান্ত প্রিশ্রম করছেন তা অভুতপূর্ব ও স্মরনীয়। দেশে যেসব সরকারী কর্মচারী ও বিদেশে যেসব কুটনীতিক বাংলার সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে সংরামী ঐক্য ঘোষনা করেছিলেন তাঁদের সবাইকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি।

যেন মনুষ্যত্বকে গ্রাস না করে

বাংলা আজ জয়ী। বিজয়ের যেমন আছে, তেমনী আছে তার দায়িত্ব। নিরহঙ্কার চিত্তে বিজয়কে আমাদের বরণ করে নিতে হবে। বিজয়ের অহঙ্কার যে আমাদের মনুষ্যত্বকে গ্রাস না করে। আমরা যে অতীত পাপ-পঙ্কিলতার আবেষ্টনী থেকে নতুন সূর্যের কিরোনে অবগাহণ করে সত্যিকারের মানুষ হতে পরি এ কামনাই করি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমরা শুধু মাত্র আমাদের নয় বিশ্বপাপের মার্জনা চাইব। কবিকণ্ঠের বাণী উদ্বৃত করে আমরা বলব “হে করুণাময় তুমি বিশ্বপাপ মার্জনা কর।“

-জয় বাংলা

ভাষণে জনাব এম এ সামাদ, বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিনিধি, বুদাপেস্ট,১৯৭১।

ভদ্রমহিলা এবং মহোদয়গণ,
প্রথমেই বিশ্বের শান্তিকামী জাতির অগাস্ট সম্মেলনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এই সম্মেলনের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধি দেশগুলোর জনগণের প্রতি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমার শুভেচ্ছা। আমি আমার সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছি এবং বাংলাদেশের কোটি শান্তিকামী মানুষের আশা ও শুভকামনা জ্ঞাপন করছি।

ভদ্রমহিলা এবং মহোদয়গণ, আমরা এখন যুদ্ধে আছি। বাংলাদেশ, যেটি পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিল, আজ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং সাড়ে সাত কোটি মুখ নিয়ে একটি নতুন জাতি। গত দেড় মাস যাবত পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে আপনারা গণহত্যা ও নৃশংসতার ঘটনা সম্পর্কে শুনেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর বড় অস্ত্রাগার থেকে পাওয়া সেরা অস্ত্রে সুসজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানের সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর আগ্রাসন প্রতিরোধে আমাদের জনগণ এই মুহূর্তে যে পরিস্থিতিতে রয়েছে, এই অনুষ্ঠানে আমি পুনরায় আপনাদের সেই বাস্তবতা জানানোর সুযোগ পাচ্ছি।

১৯৪০ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের বার্ষিক অধিবেশনে পাশ করা নীতির ভিত্তিতে পাকিস্তানের অস্তিত্বের ভিত স্থাপিত হয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের নিষ্ঠুরতা থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে। অনেক রক্ত ঝরেছে, বিসর্জিত হয়েছে বহু প্রাণ, সম্পদ হারিয়েছে কিন্তু অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। ****The aspiration of the people of Bangladesh had its sources from the above-mentioned resolution which guaranteed the creation of a con- federation of autonomous and sovereign states consisting of Muslim majority areas in India

১৪ই অগাস্ট,১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা বাস্তবিক এসেছে কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতা ন্যস্ত হয় পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। তখন থেকেই শুরু হয় নিপীড়ন ও শোষণ।

যদিও অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ অধিক জনবহুল অর্থাৎ ৫৬ থেকে ৪৪ শতাংশ আনুপাতিক হার তবুও এটি একটি উপনিবেশে পরিণত হয়। বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের চাষকৃত সোনালি আঁশ পাট ছিল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস এবং মোট আয়ের ৭০% গঠিত হয়েছে চা, চর্মদ্রব্য, অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী এবং কাঁচামাল রপ্তানির মাধ্যমে।

কিন্তু এসব আয়ের খুব সামান্যই আমাদের নিজেদের উন্নয়নে ব্যবহৃত হত। যেখানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হত বাংলাদেশের মাধ্যমে, বৃহৎ শিল্প প্রকল্প সমূহ বাস্তবায়িত হত পশ্চিম পাকিস্তানে। পাঞ্জাবের মরুভূমি পরিণত হয়েছে হাজারো সবুজ ছায়াঘেরা স্থানে আর শুষ্ক পাহাড়, রুক্ষ জমি পরিণত হয় বিস্তৃত সমতল সড়কে। দেশভাগপূর্ব ছোট্ট মফস্বল করাচি এশিয়ার ব্যস্ততম বাণিজ্যিক নগরে পরিনত হয়। বাংলাদেশের সম্পদ ব্যয় করে রুক্ষ ও কঠিন মালভূমি ইসলামাবাদ পরিণত হয় রাজধানীতে।
স্বাধীনতার গত ২৩টি বছর বাংলাদেশের জন্য ছিল শুধুমাত্র শোষণের। বাংলাদেশে বসবাস করা মানুষের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৩গুন। জাতীয় বাজেটের ৬০% স্থাপিত হয়েছিল প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যেখানে বড়জোর ১০% প্রতিরক্ষা ব্যয় হত বাংলাদেশে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত ভাবে বাঙালি যুবক দের নেয়া হতনা, সুতরাং অফিসার সহ মোট যোগদান ৭ শতাংশের বেশি হতনা, যেখানে রক্ষীবাহিনীর ৭৮% শুধুমাত্র পাঞ্জাব থেকেই আসত। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প যেমন বিখ্যাত ‘টারবেলা’ এবং ‘মাঙ্গলা’ প্রকল্প তৈরি হয়েছে জাতীয় বাজেটের বাইরে থেকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে এরকম শতাধিক প্রকল্পের জন্য মিলিয়ন ডলারের সাহায্য এসেছে এবং শুধুমাত্র সেখানেই বিনিয়োগ হয়েছে। ব্যাংক আমানতের ৯২% নিয়ন্ত্রণ করত পশ্চিম পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের মোট মূলধনের ৮৫% ছিল করাচি কেন্দ্রিক। ৮৭% বেসরকারি বিনিয়োগে পশ্চিম পাকিস্তানের ২২টি পরিবারের একাধিপত্য ছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানের যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমী স্বার্থ দ্বারা টিকে ছিল, সেটি প্রতিষ্ঠা করেছে অবিচারের এক অসহনীয় কাঠামো। জাতীয় শিল্প সম্পদের প্রায় ৬০ শতাংশের উপর প্রায় ২ ডজন পরিবারের নিয়ন্ত্রণ ছিল, তার ব্যাংকিং এর ৮০ শতাংশ সম্পদ ও বীমা সম্পদের ৭৫ শতাংশ, মোট ব্যাংক অগ্রিমের ৮২ শতাংশ মোট হিসাবের মাত্র ৩ শতাংশে কেন্দ্রীভূত হয়। বিশ্বের অন্যতম পশ্চাদপদ কর কাঠামো যেখানে অপরিহার্য পণ্যের উপর অত্যাচারী পরোক্ষ করারোপ করা হয়, সেটি শুধু সাধারণ মানুষকেই কষ্ট দিবে। কর অবকাশ সুবিধা, বোনাস ভাউচার আকারে বিশাল ভর্তুকি, কৃত্রিমভাবে কম সরকারি হারে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান একচ্ছত্র অধিকার বৃদ্ধি ও বন্দী-বিনিময় চুক্তিপত্রে বিশেষ অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

সরকারের মোট রাজস্ব ব্যয়ের মাত্র ১৫ হাজার মিলিয়ন রুপি ব্যয় হত বাংলাদেশে যেখানে ৫০ হাজার মিলিয়ন রুপি পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হত। একই সময়কালে(১৯৬৮ সাল পর্যন্ত) মোট উন্নয়ন ব্যয়ের ৩০,৬০০ মিলিয়ন রুপি খরচ হয়েছে বাংলাদেশে যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে হয়েছে ৬০,০০০ মিলিয়ন রুপি। পশ্চিম পাকিস্তান ১৩ হাজার মিলিয়ন রুপি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিপরীতে ৩০ হাজার মিলিয়ন রুপির পণ্য আমদানি করেছে, এভাবে বাংলাদেশের তুলনায় ৩গুন বেশি আমদানি করেছে পশ্চিম পাকিস্তান।

পশ্চিম পাকিস্তানে ২০ হাজার মিলিয়ন রুপির পণ্য আমদানি সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের ৫ হাজার মিলিয়ন রুপি এর রপ্তানি আয়ে বরাদ্দের ফলে এবং ৮০ শতাংশের বেশি বৈদেশিক সাহায্যের রসিদ কাজে লাগাতে সক্ষম হয়ে।

বাংলাদেশে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ গুন বেশি ছিল। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে মণ প্রতি মোটা চালের দাম গড়ে ৪৫/৫০ রুপি ছিল যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ২০/২৫ রুপি করে এবং একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৫/২০ রুপির গম বাংলাদেশে ছিল ৩০/৫০ রুপি করে। সেরপ্রতি সরিষার তেল ছিল ৫১ রুপি যখন পশ্চিম পাকিস্তানে তা আড়াই রুপি।
একইভাবে সেই সময় প্রতি তোলা স্বর্ণ করাচিতে ১৩৫/১৪০ রুপি যেখানে বাংলাদেশে ১৬০/১৬৫ রুপি।

১৯৭১ সালের মার্চের পূর্ব পর্যন্ত সরকারি ক্যাডারে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কর্মচারীর আনুমানিক সংখ্যা নিম্নে দেখানো হলঃ

ছক ‘ক’
কর্মকর্তা পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশ
১ম শ্রেণী ৩,৭৬৯ ৮১১
২য় শ্রেণী(গেজেটেড) ৪,৮৮৫ ৮৮৪
২য় শ্রেণী(নন-গেজেটেড) ৫,৫৫১ ১,১৮৪
৩য় শ্রেণী ১,৩৭,৯৭৫ ১৩,৭২৪

গত ২৩ বছর যাবত পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থ দ্বারা বাংলাদেশের জনগণের উপর যে অবিচার নির্যাতন হয় এটি তার সংক্ষিপ্ত হিসাব।

রাজনৈতিক ভাবেও আমরা চরম বশীভূত ছিলাম এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা লোকজন এভাবে থাকাকে ঘৃণা করত। ১৯৪০ সালে যখন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালানো হয়, বাঙালিরা গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য প্রতিরোধ ও সংগ্রাম করে। স্বাধীনতার পর ১৯৫৪ সালে প্রথমবারের মত বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ কে ৯৭টি আসন সুরক্ষিত রেখে বিতাড়িত করে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান বাংলাকে দুটি রাষ্ট্রভাষার একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। একযোগে সমগ্র পাকিস্তানে ১৯৫৯ সালের প্রথম ভাগে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে নির্ধারিত হয় কিন্তু তার আগেই ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইউব খানের নেতৃত্বে সামরিক জেনারেলরা গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাত করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। সংবিধান রহিত হয় ও জাতীয় পরিষদের বিলুপ্তি ঘটে।

সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র উপেক্ষা ও ষড়যন্ত্র করে এবং ১৯৬২ সালে আইউব একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করে যার মাধ্যমে তারা তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব চিরস্থায়ী করতে পারে এবং সেই সাথে বাংলাদেশের মানুষ ও সম্পদকে শোষণ করতে পারে। ১৯৬৮ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো এক অভূতপূর্ব গনঅভ্যুত্থানের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে এবং দেশ পরিচালনায় অসুবিধা অনুধাবন করে আইউব শেখ মুজিব কে সামরিক হেফাজত থেকে মুক্তি দেয় এবং তার আমন্ত্রণে সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ নিয়ে ১৯৬৯ এর ফেব্রুয়ারি-মার্চে রাওয়ালপিন্ডিতে একটি গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের শেষে আইউব তার সমাপনী বক্তব্যে যদিও বাংলাদেশের দাবি পাশ কাটিয়ে যান তবে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংসদীয় ব্যবস্থা এবং অবিলম্বে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনেরর দাবি মেনে নেন। কিন্তু আবার, গোলটেবিল বৈঠকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার পরিবর্তে সেই একই গোপন ও বিদ্বেষপূর্ণ কায়েমি স্বার্থ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইউব সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ শক্তি, যা কিনা দেশকে শাসন করেছে, তা ছিল জনবিরোধী। তারা ছিল সামরিক বাহিনী, বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও একচেটিয়া পুঁজিবাদীদের মধ্যকার চক্রান্তের অংশ। এই শক্তি হাতে হাত রেখে একসঙ্গে কাজ করে এবং তারা কখনোই গণতান্ত্রিক শক্তিকে শক্তিসঞ্চয় করতে দেয় নি। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রসার বন্ধে কায়েমী স্বার্থ হাসিলের জন্য এটা ছিল ইচ্ছাকৃত চেষ্টা এবং যখনই এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, এই শক্তিগুলো একত্রিত হয়ে তা দমনে সফল হয়েছে।
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গন, যখন ইয়াহিয়া খান আইয়ুবের থেকে ক্ষমতা নিয়ে নিলেন, তখন দ্বিতীয়বারের মত সংবিধান রহিত করা হল এবং জাতীয় পরিষদও ভেঙে দেয়া হল। কিন্তু তারপরও জান্তা কর্তৃক গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছিল এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের আইনী কাঠামোও চালু করা হল। জনগণ জেনারেলের কথা বিশ্বাস করল এবং আওয়ামীলীগ, যা কিনা একটি সাংবিধানিক রাজনৈতিক দল, তারা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সামনে এগিয়ে এল। এবছর ডিসেম্বরের ৭ তারিখ হতে জানুয়ারির ১৭ তারিখ পর্যন্ত নির্বাচন হল এবং ইয়াহিয়া খানের ভাষায় তা ছিল একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। নির্বাচন শেষে আওয়ামীলীগ ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়ী হল। বাংলাদেশের মোট ভোটের ৮৫% পেল এবং ১৬৯ সিটের মধ্যে মাত্র ২টি সিটে পরাজিত হল। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ সিটের মধ্যে ২৮৮ সিটে তারা জয়ী হল। এভাবে আওয়ামীলীগ প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার পাশাপাশি জাতীয় পরিষদেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করল।
আওয়ামীলীগ এই নির্বাচন লড়েছিল ছয় দফার ভিত্তিতে। যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ ২৩ বছর ধরে শোষিত হয়েছে এবং বারে বারে ক্ষমতাসীন চক্রের প্রতারনার স্বীকার হয়েছে, ছয় দফা ছিল তাদের জন্য পাকিস্তানের গঠনতন্ত্রের মধ্যে থেকে একটি কার্যকর স্বায়ত্তশাসনের পন্থা। এটা ছিল বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। আশা ছিল, আওয়ামীলীগ সাংবিধানিক উপায়ে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থের শোষণ থেকে বাঙালি মুক্তি পাবে।
নির্বাচন শেষে জাতীয় পরিষদে সকল দলের নেতাদের নিজেদের মধ্যে এবং পৃথকভাবে প্রত্যেক দল ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে সংলাপ হয় এবং অবশেষে ৩ মার্চ, ১৯৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের দিন ধার্য করা হয়। ইতিমধ্যে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জনাব ভুট্টো অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য সকল পার্টির অধিবেশনে যোগদান প্রতিহত করার জন্য হুমকি দিতে থাকেন। সিন্ধু ও পাঞ্জাবে নির্বাচনে এগিয়ে থেকে তিনি সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক ব্যবহার শুরু করেন। ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল উমর, রাষ্ট্রপতির প্রধান কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল পিযাড়া এবং ইয়াহিয়া খানের অন্যান্য কাছের সহযোগীদের সঙ্গে মিলে জনাব ভুট্টো তার চাপের কৌশল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু যখন তার ব্যর্থতা নিশ্চিত এবং জাতীয় পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যরা ঢাকায় অধিবেশনে অংশগ্রহনের জন্য প্লেনের সিট নিয়ে ফেলেছেন, তখন জেনারেল ইয়াহিয়া শুনলেন জনাভ ভুট্টোর কথা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধবাজেরা (সেনাপতিরা?) এক রেডিও বার্তার মাধ্যমে ১ মার্চ, ১৯৭১ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদ স্থগিত ঘোষণা করলেন।
বাংলাদেশে স্থগিত প্রতিক্রিয়া অনিবার্য এবং স্বতঃস্ফূর্ত ছিল এবং দেশের সর্বত্র মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এই আর্বিটারি এ্যাক্ট বিষয়ে তাদের প্রতিবাদ ব্যক্ত করতে। মানুষ এখন নিশ্চিত ভাবে অনুভব করছে যে, ইয়াহিয়া সত্যিই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে আগ্রহী নয় এবং সংসদীয় রাজনীতির নামে প্রহসন করছে। জনপ্রিয় একটি মতবাদ অনুভূত যে, বাংলাদেশের অধিকার কখনোই পাকিস্তানের অবকাঠামোতে অনুভূত হবে না। যেখানে ইয়াহিয়া ক্রমেই সমবেত পরিষদে অজ্ঞভাবে নিজের রীট প্রচার করে এবং আহবান জানায় যে, শেখ মুজিবর রহমান পূর্ণ স্বাধিনতার জন্য যেতে পারে।
যাইহোক শেখ মুজিব একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি চাইছিলো। ৩রা মার্চ একটি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তিনি দখলকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সুমতি ফিরিয়ে আনার জন্য শান্তিপূর্ণ মোকাবেলা অস্ত্র হিসেবে বেছে নেন। এটা ছিলো স্বয়ং ২রা ও ৩রা মার্চে ঠাণ্ডা মাথায় নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের উপর গুলিবর্ষণ যাতে হাজারের বেশী হতাহতের ঘটনা ঘটে, তার উপর মৌখিক অঙ্গভঙ্গি।
এই আন্দোলন এখন অবশ্যই ইতিহাসের অংশ। কোন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ভিতরে ১লা হতে ২৫ মার্চ বাহিত হয় নাই। অসহযোগ ছিল পুরোটাই হাইকোর্টের কোন বিচারককে নতুন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ পরিচালনার জন্য পাওয়া যায়নি। পুলিশ এবং পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসসহ সমগ্র বেসামরিক প্রশাসন অফিসে যোগ দিতে অসম্মতি জানায়। মানুষ সেনাবাহিনীকে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।।
অসহযোগ কাজ থেকে নিবৃত্তিকে থামায়নি। বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ শেখ মুজিবের প্রতি ইতিবাচক সমর্থন দেয় এবং তাঁর নির্দেশে নিজেদের নিয়োজিত করে। এই অবস্থায় আওয়ামীলীগকে আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকার গঠন ছাড়ায় অসহযোগ থাকাকালীন দেশের অর্থনীতি ও প্রশাসন চলমান রাখার স্থায়ী দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা হয়। এই কাজটিকে তারা শুধু জনসাধারণ নয় প্রশাসন এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের শর্তহীন সমর্থন ছিল। শেষোক্ত দুজন আআওয়ামীলীগের নির্দেশনায় এবং তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার একমাত্র অধীনস্ত কতৃপক্ষ হিসেবে গৃহীত।
এই সর্বাঙ্গীণ পরিস্থিতিতেও অর্থনীতি এবং প্রশাসন চালু রাখা হয়েছিল, বাংলাদেশের হঠাৎ অভ্যুদয়ের কারণে শক্তি শূন্যতা তৈরি হওয়ার ভয়ঙ্কর সমস্যা শর্তেও। কোন আনুষ্ঠানিক কতৃপক্ষের অভাব থাকা সত্বেও আওয়ামীলীগ স্বেচ্ছাসেবক পুলিশের সহযোগিতায় আইন-শৃঙখলায় একটি স্তর সৃষ্টি করে যা স্বাভাবিক সময়ের মধ্যেই উন্মিত হয়।
বিক্ষোভে সার্বিক সমর্থন প্রাপ্ত আওয়ামীলীগের এই ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের মুখে জেনারেল ইয়াহিয়া তার কূটনীতি সংশোধন করে বলে মনে হয়। ৮ মার্চ তিনি এখনো একটি মোকাবেলায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, যখন সে তার উত্তেজক বক্তৃতায় সৃষ্ট সংকটের পূর্ণ দোষ, সংকটের স্থপতি মিঃ ভুট্টোকে না দিয়ে আওয়ামীলীগকে দেয়। এটা মনে হচ্ছিলো যে, ৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রত্যাশিত ছিল। ঢাকায় আর্মি সম্পূর্ণ সতর্কবস্থায় রাখা হয়েছে। এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুব খানকে প্রতিস্থাপন করতে উড়ে আসেন জান্তার কঠিন মনোভাব বুঝতে।
যাইহোক, শেখ মুজিবুর আরো একবার স্বাধীনতার পক্ষে ব্যাপক জনমত থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সমঝতার পথ বেছে নিয়েছেন। জাতীয় পরিষদে উপস্থিত থাকার জন্য তাঁর ৪-দফা প্রস্তাব উপস্থাপনে তাকে শুধুমাত্র জনগণের মনোভাবের কথাই চিন্তা করতে হয়নি বরং ইয়াহিয়ার জন্য একটি শান্তিপুর্ণ নিষ্পত্তির সুযোগের পথও খোলা রাখতে হয়েছে।

এখন এটা স্পষ্ট যে, ইয়াহিয়া এবং তাঁর জেনারেলদের কখনই পাকিস্থানের রাজনৈতিক সংকট শান্তিপুর্ণ ভাবে সমাধানের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না বরং তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে তাদের সামরিক শক্তিকে আরো শক্তিশালী করার জন্য কালক্ষেপন করা। ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর শুধুমাত্র তার গণহত্যার পরিকল্পনাকে আড়াল করার জন্য ছিল। এটা এখন পরিষ্কার যে এরকম একটি সংকটের আকষ্মিক পরিকল্পনা সংকটের অনেক আগেই করা হয়েছিল।

এই প্রবঞ্চনামুলক কৌশলের অংশ হিসেবে ইয়াহিয়া মুজিবের সাথে তার আলোচনায় সবচেয়ে বন্ধুত্বপুর্ণ আচরন অবলম্বন করে। ১৬ই মার্চ আলোচনার শুরুর দিকে তিনি যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং একটি রাজনৈতিক মীমাংসার আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মুজিবের সাথে চুড়ান্ত মিটিংয়ে তাকে আওয়ামী লীগের ৪-দফা প্রস্তাবে জান্তার অবস্থান ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে বলা হয়। তিনি ইঙ্গিত করেন যে, সেখানে কোন গুরুতর অভিযোগ নেই এবং ৪টি দফা সংগঠনকারী উপদেষ্টা দ্বারা একটি অন্তর্বর্তী সংবিধান তৈরী করা যায়।

মুলত যেসব কারনে চুক্তিটি হয়েছিলঃ
(১) সামরিক আইনের উত্থাপন এবং একটি প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণার মাধ্যমে একটি বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
(২) প্রদেশ গুলোতে সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর
(৩) ইয়াহিয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রনে থাকবেন
(৪) শাসনতন্ত্র চুড়ান্ত করার জন্য জাতীয় পরিষদের পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের আলাদা আলাদা প্রস্তুতিমুলক বৈঠক।

একবার শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে এই চুক্তি নীতিগত ভাবে উত্থাপিত হলে সেখানে শুধুমাত্র অন্তর্বর্তীকালে কেন্দ্রের উচ্চ পর্যায়ে বাংলাদেশের ক্ষমতার বিষয়টিই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এখানে এটা আবারো যৌথভাবে সমর্থিত হয় যে, ক্ষমতার বন্টন যতদুর সম্ভব জাতীয় পরিষদ সমর্থিত সংবিধান অনুযায়ী হতে হবে যা ছয় দফার ভিত্তিতে নির্মিত হিসেবে ধরা হয়।

যখন আলোচনার সমাপ্তি ঘোষণাও হয়নি তখন ২৫শে মার্চ আনুমানিক রাত ১১টার দিকে ইয়াহিয়া খান একটি বিশ্বাসঘাতকতা মুলক কাজ করেন যার সমতুল্য আর কোন ঘটনা ইতিহাসে নেই। একটি সুপ্রশিক্ষিত ও যন্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি আর্মি ঢাকার নিরীহ ও নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের ওপর ঝাপিয়ে পরে। কোন সতর্কবানী, ঘোষণা, বা কারফিউয়ের নির্দেশ ছাড়াই রাতের অন্ধকারে নিরীহ জনগণকে হত্যার জন্য নির্বিচারে ট্যাংক, মর্টার, কামান, মেশিন গান এবং রকেট ব্যবহার করা হয়। যে প্রধান এলাকাগুলোতে হামলা চালানো হয়েছিল সেগুলো হল রাজারবাগ সদর দপ্তরের পুলিশ ব্যারাক, পিলখানায় পুর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের হোষ্টেল এবং শিক্ষকদের কোয়ার্টার, তেজঁগা শিল্প এলাকা, ফেরী ঘাট, ষ্টেশন, রাস্তার পাশের বস্তি, মালিবাগ, মগবাজার, বাবুবাজার, নয়াবাজার ইত্যাদি যেখানেই লোক সমাগম ছিল। প্রথম দুই রাতে ঢাকায় এবং ঢাকার আশেপাশে আনুমানিক ১,০০,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়। প্রথম রাতে দুইটি দৈনিক পত্রিকার অফিস (দ্যা পিপল এবং ইত্তেফাক) সিল করা হয় ও সম্পুর্ন পুরিয়ে দেওয়া হয় এবং দুই দিন পর আরো একটি বাংলা সংবাদপত্রও (সংবাদ) জালিয়ে দেওয়া হয়।
আধুনিক ইতিহাসে বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার মত নজির নেই। সৈন্যরা অধিকাংশই পাঞ্জাবের গোত্র থেকে আগত এবং এরা মানুষ রুপী হলেও আচরনে ছিল পুরাপুরি ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত। তাদের কর্মকান্ড ছিল শুধুই ধ্বংস এবং নিশ্চিহ্নকরন। তারা লুটতরাজ, খুনখারাপি,ধ্বংস এবং ধর্ষন চালাচ্ছিল। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় ঢুকে দেশের সব প্রখ্যাত বিদ্যানদের হত্যা করেছিল। তারা বেছে বেছে মানব-হিতৈষী শিল্পপতিদের হত্যা করে তাদের অর্থ-সম্পদ লুট করত।
সাতাশ তারিখ সকালে, যখন অবশেষে ৩৩ ঘন্টা পর কার্ফিউ তুলে নেয় হল তখন প্রায় সমস্ত ঢাকাবাসী শহর ছেড়ে পালান শুরু করল এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে শতকরা ৭৫ থেকে ৮৫ ভাগ মানুষ শহর ছেড়ে চলে গেছিল। তারা এমন আতংক তৈরি করেছিল যে সে মুহুর্তে বাংলাদেশের সব শহর-নগর ছেড়ে মানুষ পালানো শুরু করেছিল। রাজনিতিবিদ, ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবি ছাত্র ব্যাবসায়ী এবং বুদ্ধিজীবী সকলে তাদের কর্মক্ষেত্রে ছেড়ে গ্রামে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। ২৫শে মার্চের আগে সশস্ত্র বাহিনীর যেসব বাঙ্গালী অফিসার বাংলাদেশে অবস্থিত এবং নাগালের মধ্যে ছিলেন তাদের সবাইকে নিরস্ত্র করে পরবর্তীতে পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছিল। যশোর এবং কুমিল্লা সেনানিবাসে প্রতিটিতে প্রায় ৩০জন করে বাঙ্গালী অফিসারকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। একইরকমের গণহত্যা প্রায় সবগুলো সেনানিবাসেই সংগঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশে ঢাকা, কুমিল্লা রংপুর যশোর এবং চট্রগ্রামে সেনানিবাস ছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা এবং সংগঠিত অপরাধসমুহ এধরনের ছোট পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না। হাজার হাজার খুন, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগের এমন ঘটনা আমি আপনাদের বলতে পারি ভদ্রমহিলা এবং মহোদয়গণ যাতে আপনারা এখানে বসে তথাকথিত শান্তিসম্মেলন আয়োজন করার জন্য লজ্জাই পাবেন। নদীর অপর পারে অবস্থিত জিঞ্জিরা বাজার ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল, যেখানে প্রায় ২৫০০০ মানুষের বাস। প্রায় ১০ থেকে ১৫ বর্গ কিলোমিটারের এলাকায় আগুন ধরিয়ে তারা প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ হত্যা করেছিল। একই ধরনের কাজ তারা করেছিল শান্তিনগর বাজার, রায়েরবাজার, Bhadhi,শাখারিবাজার, তাতিবাজার, কাপ্তানবাজার, চকবাজার টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায়।শুধু ঢাকা শহরে কাছেই খুন হওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৫০,০০০ ।

কিন্তু বাঙ্গালীরা যুদ্ধের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেছিল। ঢাকায় তারা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়লেও সারা বাংলাদেশে ২৪ ঘন্টার মধ্যেই জনগণ নিজেদেরকে মুক্তিবাহিনীতে সগঠিত করেছিল।৩০০০ নিয়মিত সদস্যের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল(১৭০০০ সদস্যের আধা সামরিক বাহিনী), পুলিশ(৪০,০০০ সদস্য),আনসার, মুজাহিদ এবং যুবকেরা প্রতিটি জেলায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। সারা বাংলাদেশে প্রশাসনের ভেঙ্গে পড়ায় এবং ভুখন্ড এবং জনগোষ্ঠীর ওপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে তারা বুঝতে পেরেছিল তাদের জয়ের হিসাবে ভুল হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলরা আরো বেপরোয়া এবং নার্ভাস হয়ে উঠছিল। যেখানেই তারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছিল সেখানেই তারা স্যাবার জেটের মাধ্যমে নির্বিচারে গুলি-গোলা বর্ষন করছিল। এছাড়াও হাজার হাজার গ্রাম ও শহর যেখানে বোমা বর্ষন করা হয়েছিল যার মধ্যে চট্রগ্রাম,সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, স্রীমঙ্গল, নরসিংদী ব্রাহ্মনবাড়িয়া, আখাউড়া, কসবা, কুমিল্লা, লাক্সাম, চাঁদপুর, ফেনী, খুলনা, দৌলতপুর, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা, কুমারখালি, আলমডাঙ্গা, পাবনা, শাহজাদপুর, রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, রংপুর, সান্তাহার, পার্বতীপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, বগুড়া, শেরপুর, ময়মন্সিংহ, টাঙ্গাইল, জামাল্পুর এবং জয়দেবপুর অন্যতম।
হাজার হাজার গ্রামের পাশাপাশি যে সব শহরে ভারী গোলাগুলি ও আকাশ পথে বোমাবর্ষন হয়েছে, সেগুলো হল চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভি বাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া, কসবা, কুমিল্লা, লাক্সাম, চাঁদপুর, ফেনী, খুলনা, দৌলতপুর, কালিগঞ্জ, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা, কুমারখালি, আলমডাঙ্গা, পাবনা, শাহজাদপুর, রাজশাহি, নবাবগঞ্জ, রংপুর, সান্তাহার, পার্বতীপুর, লালমনির হাট, নীলফামারি, দিনাজপুর, বগুড়া, শেরপুর, ময়মনসিং, টাংগাইল, জ়ামালপুর এবং জয়দেবপুর।

পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধের সবচেয়ে জঘন্য পন্থা অনুসরন করছে। কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সৈন্য পাঠানোর আগে তারা নির্বিচারে বোমাবর্ষন ও আক্রমন চালায়। এতে সাধারন জনগণ ভীত হয়ে পরে এবং তখন তাদের সৈন্যরা তাদের পথে আগাতে শুরু করে। তাদের যাত্রা পথে তারা থেমে যাকে সামনে পায় তাকে হত্যা করে, বাড়িঘর, ব্যাংক, গয়নার দোকান লুট করে, মহিলাদের ধ্বর্ষন করে, খাদ্য শষ্য এবং গবাদি পশু চুরি করে এবং সবশেষে গ্রামগুলো আগুনে জালিয়ে দেয়।

হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র গুলোতে বোমা হামলা হয়েছে, নার্স এবং সেবিকাদের রোগীর কাছ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, পাদ্রিদের নির্যাতন করা হয়েছে এবং রাজশাহিতে ধর্মপ্রচারকদের বন্দুকের মুখে সম্প্রচারে বাধ্য করা হয়েছে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একটি বিশাল অংশকে উদবাস্তুতে পরিনত করা হয়েছে এবং গীর্জা ও মসজিদ বন্ধ ও ধ্বংস করার মত বহু ঘটনা ঘটেছে।

যদিও অনেক এলাকায় বোমাবর্ষন হয়েছে তারপরও গত ছয় সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে (প্রায় ১০,০০০)। গেরিলা পদ্ধতিতে তারা শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যপকভাবে প্রতিরোধেই সমর্থ হচ্ছে না বরং তাদের কে হত্যা বা বিতাড়িত করার মাধ্যমে অনেক শহর এবং এলাকা পুনর্দখলও করছে। তাদের সকল সেনানিবাস ও সামরিক ঘাঁটি বর্তমানে সম্পুর্নরূপে মুক্তিবাহিনী দ্বারা বেষ্টিত এবং তাদের যোগাযোগের একমাত্র পথ হল আকাশ পথে অপসারন। সবগুলো সেতু উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং নদীপথ তাদের জন্য কখনই নিরাপদ না। নিয়োগ ও প্রশিক্ষন কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং যেসব হাজার হাজার যুবক প্রতিদিন অস্ত্র হাতে তুলে নিতে ও তাদের প্রিয় দেশকে রক্ষা করতে আসছে তাদেরকে সংক্ষিপ্ত কিন্তু কার্যকর গেরিলা প্রশিক্ষন দেওয়া হচ্ছে।

ইত্যবসরে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ তাদের জনগণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালন করবেন এবং আমাদের দেশের নতুন রাজধানী মুজিবনগরে সমবেত হবেন। ১৯৭১ এর ১০ই এপ্রিল পারস্পরিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং বাংলাদেশের জনগণের সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধি ঘোষনা করা হয় এবং সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ গঠন করা হয় এবং স্বাধীনতার ঘোষণা নিশ্চিত করা হয় যা ইতমধ্যেই সাড়ে ৭ কোটি বাংলাদেশি জনতার নেতা, শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রনীত হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাথে নিয়ে একটি রাজধানী গঠন করা হয়।

মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠিক ততটুকুই প্রসারিত হতে দিচ্ছে যতটুকুতে তারা তাদের ইচ্ছামত তাদেরকে ঘিরে ফেলতে এবং যুদ্ধে পরাজিত করতে পারবে। সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রন আছে শুধুমাত্র কিছু সেনা শহর বা যেখানে তাদের সামরিক সমাবেশ আছে সেখানে । এমনকি বেশির ভাগ শহর ও ছোট এলাকা যেগুলো এক সময় পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলে ছিল সেগুলো মুক্তিবাহিনী পুনর্দখল করেছে এবং এই প্রক্রিয়া বেশ লম্বা সময় ধরে চলছে। মুক্তিবাহিনী এখন চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট এবং যশোর গুলো পুনরুদ্ধারের জন্য লড়ছে এবং এই জায়গা গুলোতে অনবরত যুদ্ধ চলছে।
এই যুদ্ধের সবচেয়ে সংকটময় ও কঠিন দশায় মুক্তিবাহিনী সফলভাবে টিকে ছিল। এটি শুধু ইঙ্গিত করে যে, যে শক্তি তারা জোগাড় করেছে তা সমগ্র জনগণের সমর্থন দ্বারা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তরুণদের থেকে এত বেশি সাড়া পাওয়া যাচ্ছে যে কখনো কখনো তাদের একত্রে প্রশিক্ষণ ও স্থানসঙ্কুলান দেয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদল একটি হেরে যাওয়া যুদ্ধ লড়ছে। সাধারণ যুদ্ধ বিদ্যা ধারণা করে যে মনুষ্যোচিত সেনাবাহিনী কিংবা সামরিক বাহিনীর জন্য এটা প্রায় অসম্ভব বাংলাদেশকে আর ধরে রাখা। এই মুহুর্তে তাদের আনুমানিক ৮০০০০ সৈন্য আছে এবং অতিরিক্ত শক্তি দ্বারা তারা সর্বোচ্চ পরবর্তী ৪-৬ সপ্তাহ যেতে পারবে।পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ সীমান্ত এলাকার জন্য এই সংখ্যার চেয়ে বেশি তারা যেতে পারবে না।
পশ্চিম পাকিস্তান সেনাদের যুক্তিসঙ্গত অসমভাবনাগুলো নিম্নোক্ত রাশিতে সংক্ষিপ্ত করা যায়ঃ
(ক) সরবরাহ বিশেষ করে খাদ্য রেশন ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য তাদের পর্যাপ্ত প্রদেশ নেই।
(খ) ভারত দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় তাদের পিছু হটার ও বর্তমান কোনো স্থান নেই এবং করাচিও ৩০০০ মেইল দূরে এখন।
(গ) তারা জনগণ থেকে কোনো সমর্থন পাচ্ছে না।
(ঘ) তারা প্রচলিত যুদ্ধবিগ্রহে প্রশিক্ষিত।
(ঙ) পশ্চিম পাকিস্তান শিল্প অর্থপ্রদানে টান লাগিয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ তাদের অর্থনীতিতে এ যুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে বুঝতে পেরেছে।
(চ) তাদের সীমিত সামরিক জনশক্তি রয়েছে।
যেহেতু দেশের সমগ্র অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে এবং একটি মোট প্রকাশিত হয়েছে, তাই বাংলাদেশের গ্রাম অর্থনীতি একটি বৃহৎ চাপের মধ্যে চলছে। যেহেতু শহরগুলো এখন কম বেশি উদ্বাসিত ,তাই গ্রামগুলোতে জনসংখ্যা বাড়ছে। যেসব গ্রাম পুড়ে গেছে বা বোমাবর্ষিত হয়েছে সেগুলো অকর্ষিত রয়েছে। সরবরাহ সমস্যা প্রায় দুর্ভিক্ষের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বেকারত্ব তার সর্বোচ্চতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং নিত্য প্রয়োজনগুলো প্রতিদিন ভয়ংকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে । আরো বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ন জিনিস যেমন খাদ্যশস্য,লবণ,কেরোসিন,ম্যাচ,জামাকাপড়, পেট্রোল,ডিজেল, এবং ওষুধ সরবরাহ প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যদিও সাহায্যে করার ইচ্ছা পোষন করেছে,এখন পর্যন্ত পণ্য সাহায্য কিংবা কোনো সাহায্য আসে নি। কিছু মৃত শহরকে হিসাবে রেখে বাংলাদেশের গ্রামের সকল মানুষজন বাংলাদেশ সরকারের সাথে অবশিষ্ট রয়েছে এবং এবং এটি তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব,জীবন,স্বাধীনতা এবং এই জনগণের সম্পদ রক্ষা করা। তারা শতভাগ বাংলাদেশ সরকারের তদারকি ও যত্নের উপর নির্ভর করে আছে এবং সরকার ও এই সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।
এই মুহুর্তে অধিকৃত এলাকার নৃশংসতার গল্প পূর্ণ করা হচ্ছে। এই সকল এলাকায় যুদ্ধক্ষয় চলছে। পশ্চিম পাকিস্তান কর্মীগণ বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে, ফ্রন্টিয়ারের সীমান্ত স্কাউটকে পুলিশ ফোর্সের বদলি হিসেবে আনা হয়েছে এবং অবাঙালি স্থানীয় গুন্ডাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে বাঙালিদের এই এলাকায় খুঁজে বের করার জন্য এবং তাদের সম্পদ লুত করতে,যুবাদের হত্যা করতে এবং মহিলাদের ধর্ষণ করতে।
ভদ্রমহোদয়া ও ভদ্রমহোদয়গণ, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দ্বারা প্রশিক্ষিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থ নিজের পতনের জন্যই তাদেরকে ব্যবহার করেছে এবং যখনই পাকিস্তানে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে তাকে নস্যাৎ করার জন্য সামরিক বাহিনী ব্যবহৃত হয়েছে। জাতীয় বাজেটের বাইরেও সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা ভোগ করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নিজেই কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী হয়ে উঠেছে এবং সীমান্তে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধের পরিবর্তে বারংবার দেশ শাসনের দায়িত্ব তুলে নিয়েছে।
———
সিয়াটো ও সেন্টোর মতন চুক্তি পশ্চিম পাকিস্তানকে এই পথে চালিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। মার্কিন শর্তসাপেক্ষে যুক্তরাষ্ট্র বা চীন থেকে প্রাপ্ত ধারালো ও মারণাস্ত্রের মতন বৈদেশিক সামরিক সহায়তা এখন বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন থেকে প্রাপ্ত সাহায্য – সহযোগিতাও শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের একচ্ছত্র পুঁজিপতিদের উন্নয়নে কাজে লেগেছে। পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মার্কিন আধিপত্য ধরে রাখার পাশাপাশি পাকিস্তানে শক্তিশালী বুর্জোয়া গোষ্ঠী সৃষ্টি করা যা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সম্পদ শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ী শ্রেণীকে আরো বিকাশ লাভের জন্য সহায়ক হয়। বাংলাদেশের স্বার্থ বিরুদ্ধেই চালিত সকল শক্তিকেই বিদেশি সাহায্য গত ২৩ বছর ধরে টিকিয়ে রাখতে উৎসাহিত ও সহযোগিতা করেছে। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিজের দেশকে রক্ষা করার লক্ষ্যে সক্ষমতা বাড়ানোই যদি বৈদেশিক সাহায্য বিশেষত সামরিক সাহায্যের উদ্দেশ্য হয়, তবে আমেরিকা ও চীনে উৎপাদিত অস্ত্র কেন বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের উপর কেন গর্জে উঠছে?
—–
বাংলাদেশের জনগণ সবসময় মুক্তির জন্য সংগ্রামে বিশ্বাস করেছে। অতীতে তারা আলজেরিয়, ভিয়েতনামী জনগণ ছাড়াও লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, রোডেশিয়া, কিউবা এবং চীনেরও স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছে। ১৯৫৬ সালে ব্রিটেন যখন মিশর আক্রমণ করেছিল পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক নীতির বিপরীতে গিয়ে বাংলাদেশের জনগণ মিশরকে সমর্থন করেছিল। গত ২৩ বছর ধরে সিয়াটো বা সেন্টোসহ অন্যান্য সামরিক চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক শক্তিবলয় থেকে বের হয়ে একটি শান্তিপূর্ণ জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের জন্য আমরা দাবী জানিয়ে আসছি।
——-
আমাদের বর্তমান সংগ্রাম স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম। রাশিয়া, চীন, হাঙ্গেরী, কিউবা কিংবা আলজেরিয়ার জনগণ তাদের নিজস্ব স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যে সংগ্রাম করেছে তার সঙ্গে আমাদের সংগ্রামের কোন পার্থক্য নেই। ভিয়েতনামীরা যে সংগ্রাম করছে তা আমাদের সংগ্রামের মতই। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আমাদের সংগ্রাম একই।
——
ভদ্রমহোদয়া ও ভদ্রমহোদয়গণ পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ইসলামের নাম ব্যবহার করে মুসলিম দেশসমূহের কাছে আবেদন করছে। সম্মানিত সুধীবৃন্দ, আমি বলতে চাই, মুসলিম বিশ্বের ভাইদের প্রতি, আপনাদের বিবেকের কাছে আমি জিজ্ঞেস করছি, মা কি সন্তান থেকে বঞ্চিত হতে পারে? একটা শিশুকে কি তার মায়ের কাছ থেকে আলাদা করা যায়? কোন ইসলামের ভিত্তিতে আপনারা রক্তলিপ্সু খুনীদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায় যারা আমাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, আমাদের খাদ্যগার লুন্ঠন করছে, ডাক্তার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী এবং বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছে? এটাই কি ইসলাম যার উপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা আজ নির্ভর করছে? ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের প্রতি আমার আকুল আবেদন, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও মর্মার্থ আপনারা অনুধাবন করুন, প্রকাশ করুন।
ইসলামের নামে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশের উপর প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে, পশ্বাচারে এবং অমানবিকভাবে নির্যাতন চালায়। মহিলা ও মহোদয়গণ, আমরা শান্তি আলোচনায় রয়েছি এবং আমরা শান্তির জন্য সংগ্রাম করছি না। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা এই যুদ্ধে বাংলাদেশে ৭.৫ কোটি মানুষের শান্তি বিঘ্নত হয় নি? পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য এই যুদ্ধ শুধুমাত্র বাংলাদেশের মানুষের উপর হতে গ্রহণ করা উচিত নয় বরং দক্ষিণ এশিয়ার পুরো শান্তি হুমকির সম্মুখীন।আমরা প্রদর্শন করছি যে আমরা একটি দরিদ্র জাতি। স্থায়ী এই জড়বাদী জগতের মুখে আমরা অসহায়দের মত প্রদর্শিত হয়েছি। ক্ষমতা ব্লক এবং আন্তর্জাতিক ক্ষমতার রাজনীতি হয়তো ৭.৫ কোটি মানুষের মুল্য খুঁজে না। কিন্তু আমি আপনাকে এবং ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণকে জিজ্ঞাসা করতে পারি, জাতিসংঘের মত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের উদ্দেশ্য কী? এই কারণে কি এই সংস্থাগুলো যেটির পৃষ্ঠপোষকতা আজকের দিনে করছে? আন্তর্জাতিক সংহতি নৈতিকতা কি? এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি কি?কারণ বড় ক্ষমতার উদ্দেশ্য মামলা করবে না কিংবা পিং পং কূটনীতি বিরক্ত হতে পারে বা কারণটা হতে পারে পেন্টাগন বা মস্কো চোখে ক্ষমতার একটি তথাকথিত ভারসাম্য বিপর্যস্ত হতে পারে, বাংলাদেশের ৭.৫ কোটি মানুষের আজ কষ্ট ভোগ করতে হয়। আমি আপনাকে এবং মহিলা ও মহোদয়গণকে জিজ্ঞাস করছি, এটাই কি শান্তিপ্রিয় জাতির মধ্যে সংহতি? এটাই কি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের যুদ্ধ স্বাধীনতা নৈতিকতা, এটাই কি সমতা ও ন্যায়বিচারের দর্শন যার জন্য ৭.৫ কোটি মানুষ সংগ্রাম করেছে? এবং ভুক্তভোগী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ মানুষগুলো পরিত্যক্ত এবং অবহেলিত এবং অলক্ষিত। আমরা একটি বিজয়ী যুদ্ধে লড়েছি কারণ আমরা যুদ্ধে লড়েছি দন্ডজ্ঞার বাইরে একটি প্রত্যয়ের সাফ এবং সহজবোধ্য উপায়ে। আমরা আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য জানি এবং যদি প্রয়োজন পড়ে স্থায়ী বিজয় অর্জনের জন্য আমরা হাজার যুদ্ধে লড়ে যাবো। এই যুদ্ধটা শুধুমাত্র একটা যুদ্ধ নয় এটা ভৌগালিক মুক্তির যুদ্ধ। কিন্তু এটা বাংলাদেশের য ৭৫ কোটি মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য একটি যুদ্ধ হতে হবে। ভদ্র মহিলা ও মহোদয়গণ, আমি এখানে সরকার এবং বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ ম থেকে শান্তি, অভিবাদন এবং সংহতির একটি বার্তা সঙ্গে নিয়ে এসেছি এবং যখন আমি উপস্থাপন করলাম এবং বিশেষ করে মানুষ এবং হাঙ্গেরির সরকার,স্বাগতিক দেশের গভীরতম অভিনন্দন পৌঁছে এই সম্মেলনে। আমার আপনার কাছে আবেদন।আবেদনটি খুবই সাধারণ।আমাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিন,আমাদের সম্মান ও মর্যাদা দিন যা আমদের অবশ্যই হয় প্রাপ্য, জাতি হিসেবে আমাদের আনুষ্ঠানিক মর্যাদা দিন।