শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
জাতিসংঘ ও বাংলাদেশঃ একটি প্রতিবেদন | পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় | ৩ নভেম্বর, ১৯৭১ |
জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ
১. চেতনা এবং উদ্দেশ্যঃ মানবজাতির একটা স্বপ্ন হল বিশ্বসংস্থার চরম সভ্য এবং মানবিক চেতনাটি হবে শান্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
মুখ্য সমালোচনাঃ
(ক) জাতিসংঘ সংস্থাটি প্রধানত বড় শক্তিধর দেশগুলোর ক্ষমতার রাজনীতির দ্বারা পরিচালিত হয় এবং এই ক্ষমতার রাজনীতিই সংস্থাটির কার্যকারিতা নির্ধারণ করে।
(খ) সংস্থাটি প্রধানত ক্ষমতাধর দেশগুলোর তর্কবিতর্ক করার জায়গা মাত্র।
(গ) আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের সনদ একজন সাধারণ মানুষের অধিকার, এমনকি মৌলিক অধিকারও সংরক্ষণ করে না।
(ঘ) আন্তর্জাতিক অপরাধ যেমনঃ গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের কোন বিচার ব্যবস্থা নাই।
(ঙ) অধিকার নিশ্চিত আছে কিন্তু অধিকার লঙ্ঘিত হলে সেটা তদারকি বা দেখার মত কোন ব্যবস্থা নাই। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘিত হলেও, জাতিসংঘ অসহায়ভাবে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
(চ) জাতিসংঘের কথা আর কাজের ভিতরে বিস্তর ফারাক পরিলক্ষিত হয়।
পরামর্শঃ
(ক) জাতিসংঘকে আরও বাস্তব সম্মত প্রতিষ্ঠান হতে হবে যেখানে “না-ভোট” প্রদান করার ক্ষমতা তুলে নিতে হবে।
(খ) আইন করে জাতিসংঘের ভিতরে ক্ষমতাশীলদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত হওয়াকে অনুৎসাহিত করতে হবে।
(গ) জাতিসংঘকে এমন একটা প্রতিষ্ঠান বিশ্বনীতি নির্ধারণী রাজনীতি থেকে মুক্তবুদ্ধির চর্চা বেশী প্রাধান্য পাবে। এই চেতনাটাকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যেন সেটা জাতিসংঘকে সত্যিকারভাবে গণতান্ত্রিক এবং কার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন করে।
(ঘ) এমন পন্থা উদ্ভাবন করতে হবে যেন কারো মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে সে প্রকৃত অর্থে বিচার চাইতে পারে।
উপসংহার
জাতিসংঘের এখনও মূল চেতনা এবং উদ্দেশ্য হল আদর্শ বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বপ্ন। আমাদের এখন যা করা উচিত তা হল এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার রাস্তা খুঁজে বের করা। মানবাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে, গত দুই দশকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জাতিসংঘ এই ভুমিকা আরও কার্যকরী এবং প্রশংসনীয়ভাবে পালন করতে পারে।
পররাষ্ট্র দপ্তর
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মুজিবনগর
নভেম্বর ৩,১৯৭১
প্রিয় প্রতিরক্ষা সচিব,
আমি ঘোড়াশাল সার কারখানা সংক্রান্ত একটি নোট সংযুক্ত করছি। এটা মনে হয় যে, মুক্তিবাহিনী কর্তৃক জাপানী বিশেষজ্ঞদের দেওয়া হুমকি কিছুটা প্রভাব ফেলেছে।তাই ঘোড়াশাক কারখানার বিশেষজ্ঞদের হয়রানী বজায় রাখা প্রয়োজন যাতে প্রাথমিকভাবে তৈরী প্রভাব সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগানো যায়।
সংযুক্ত তথ্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর নজরে আনলে কৃতজ্ঞ থাকব।
বিনীত
(এম.আলম)
৩.১১.৭১
জনাব এ. সামাদ
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী
বাংলাদেশ সরকার
encl:as above
গোপন কপি
নিম্নলিখিত বার্তাটি টোকিও থেকে গৃহিত হয়েছে; “মাসুদ থেকে আলম বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সচিব।
সুপারিশ যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী দ্বারা বর্তমানে আক্রমণ হয় তা স্পষ্ট এবং দ্রুত বাংলাদেশের মুখপাত্র নিশ্চিত,যদি না ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়। ভারতীয় অস্বীকার এখানে প্রকাশিত কিন্তু বাংলাদেশী বিবৃতি প্রয়োজন মনে হচ্ছে।শুভেচ্ছা
আমাদের কাছে আরো খবর আছে যে, কিছু সাংবাদিক প্রশ্ন তুলছেন, কেন বর্তমান আক্রমনাত্মক মুক্তি বাহিনী সম্পর্কে মন্তব্য করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোন বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে না।
এ. জি.
২৬.১১.৭১
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়
বাংলাদেশ সরকার
অত্যন্ত জরুরী
নভেম্বর ২৭, ১৯৭১
মেমো নং 281 (3)/FS/MFA/71
কপি পাঠানো হয়েছেঃ
(১) বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা সচিব
(২) বাংলাদেশ সরকারের তথ্য সচিব
(৩) তথ্য ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য ই. পি. ডি.
(এম. আলম)
পররাষ্ট্র সচিব
২৭.১১.৭১
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির জাতিসংঘ মহাসচিবের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতিসংঘের মহাসচিব উ. থান্টের প্রতি জনাব হোসেন আলী ও তার পরিবারকে উদ্ধারের জন্য জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করার আবেদন জানিয়েছেন। জনাব হোসেন আলিকে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে এবং তাকে নয়াদিল্লীতে পাকিস্তান হাই কমিশনে বন্দী করে রাখা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে প্রেরিত একটি টেলিগ্রামে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আহ্বান জানিয়েছেন, যে হিংস্রতা বাংলাদেশের নাগরিকের উপর চালানো হয়েছে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন করা এবং সম্প্রতি এই সহিংসতা অধিকৃত এলাকা থেকে বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের পরিপার্শ্ব গুলোতেও প্রসৃত হয়ে পড়ছে বলেও তিনি জানান। তিনি জনাব হোসেন আলী ও তার পরিবারের মুক্তির আবেদন জানিয়ে মহাসচিবের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেন। পাকিস্তান হাই কমিশনে কর্মরত পশ্চিমা কর্মচারীদের দ্বারা বাঙালি কর্মচারীদের যে অমানবিক আচরণের শিকার হতে হয়েছে, রাষ্ট্রপতি তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন।
টেলিগ্রামের সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু নিম্নে উল্লেখিত হলো :- ” ভারতের নয়াদিল্লীতে পাকিস্তান হাই কমিশনে কর্মরত ১১জন বাঙালি যারা কার্যত বন্দী অবস্থায় ছিলো, ২নভেম্বর প্রধান বিচারালয় থেকে তেতাল্লিশ জন পরিজন সহ বেরিয়ে আসার সময় পশ্চিমা সৈন্যরা তাদের সিনিয়র অফিসারদের উপস্থিতিতে বিভিন্ন প্রাণঘাতী অস্ত্র নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে; এতে অনেকেই গুরুতর জখম হয়। এমনকি শিশু ও নারীরাও রেহাই পায়নি। আহতদের ক্ষতস্থান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো এবং অধিকাংশকে জরুরি চিকিৎসা সেবার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানের প্রধান বিচারালয়ের বাইরে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকদের উপর ভেতর থেকে পাথর ও উড়ন্ত মিসাইল নিক্ষেপ করে তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হয়। বিদেশী টেলিভিশনে এই ঘটনা বহুল প্রচারিত হয়।
জনাব হোসেন আলী নামে একজন বাঙালি কর্মচারীকে অচেতন না হওয়া অবধি নির্দয়ভাবে পেটানো হয় এবং তার স্ত্রী ও তিন কন্যাকে জোরপূর্বক আটকে রাখা হয়; তার নাবালক দুই পুত্র কোনমতে পালিয়ে যায়। বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করায় তার কিশোরী কন্যাকে চটকানো হয় এবং ভেতরে যেতে বাধ্য করা হয়। বিদেশি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিগণ এই ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী।জনাব হোসেন আলী পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগীয় কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। সম্ভবত ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের সাথে যোগাযোগ থাকায় তার জীবনে বিপদ নেমে আসে।
আমি মানবতা এবং ন্যায়বিচারের নামে জরুরি ভিত্তিতে আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি এবং পাকিস্তানি দূত দ্বারা জনাব হোসেন আলী ও তার পরিবারের অন্যায় আটকাদেশ থেকে মুক্তির আবেদন জানাচ্ছি; যদি না ইতোমধ্যে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকে! আমি বিশ্বদরবারেও আকুল আবেদন জানাচ্ছি, বাংলাদেশের নাগরিকদের উপর এই ইচ্ছাকৃত সহিংসতার জন্য পাকিস্তান সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করতে। গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে, তা এখন বিদেশের কূটনৈতিক মিশনের পরিপার্শ্বগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে এবং সার্বজনীন নিন্দা প্রাপ্য হচ্ছে।”
সিঙ্গাপুরের কূটনীতিক বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রকাশ
একজন ৩৯ বছর বয়সী সিঙ্গাপুরে পাকিস্তান হাইকমিশনের একজন বার্তা সহকারী নভেম্বরের ৮ তারিখে বাংলাদেশের সরকারের সাথে থাকার ব্যপারে বলেন যে তার বাঙালি সহযোগীদের পশ্চিম পাকিস্তান আর্মি দ্বারা গনহত্যার কারনে উনি আর ইসলামাবাদ সামরিক শাসনের অধীনে চাকরি করবেন না।
নিজের স্ত্রী ও তিন সন্তানের সহিত জনাব আলি আহমেদ সংবাদ সংস্থা ও সাংবাদিকদের এবং পাকিস্তান হাই কমিশনের কাছে চিঠি পাঠানোর পর বিমানপথে সিঙ্গাপুর ত্যাগ করে।
জনাব আহমেদ পাকিস্তান মিশনের সাথে ১০ বছর ছিলেন এবং ইসলামাবাদে বদলির নির্দেশে ছিলেন। কিছুদিন আগে এক বাঙালিকে তার বাসা খালি করতে বলা হয় তার পশ্চিম পাকিস্তানি বদলির জন্য, এবং হোটেল ইস্ট এশিয়ায় যান যেখান থেকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সাথে যোগ দিতে উপমহাদেশে যান।
যদিও পাকিস্তান মিশনের বাঙালি কর্মীদের জরুরি কাজ থেকে বিরত রাখা হয়। জনাব আহমেদ তার বার্তা সহকারী হবার ক্ষমতার কারনে সিঙ্গাপুর থেকে বিচ্ছুরিত ও আগত সকল গোপন বার্তা সম্বন্ধে জানতেন। যখন অনেক পাকিস্তানি কূটনীতিক তাদের পক্ষে কথা বলছিলেন, তখন জনাব আহমেদ একমাত্র ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রকাশ করেন।
আরো মানুষের বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রকাশ
নভেম্বরের ২ তারিখ পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মীদের দ্বারা প্রহৃত হওয়ার পর নয়া দিল্লীতে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে পালিয়ে ৪৩ জন নর-নারী ও শিশু মুক্তি পায়। সকলে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রকাশ করে।
এই গ্রুপটি ১০ জন পূর্ব পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মী ও তাদের পরিবার নিয়ে গঠিত হয়। প্রহারের কারনে এদের মধ্যে দুইজন আহত হয় এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়।
অনেকের পলায়নের কারনে পাকিস্তান হাই কমিশনে শুধু বাঙালি ছিলেন জনাব হোসাইন আলী পাকিস্তান গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের প্রধান জনাব আব্দুল গনির সহকারী। জনাব হোসাইন আলী তার স্ত্রী,দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তান নিয়ে নিজেরাই হাইকমিশন থেকে পালান।
নভেম্বরের ২ তারিখে টোকিওতে জনাব এস এম মাসুদ পাকিস্তান দূতাবাসের সংবাদদূত এবং তার পরিবার এবং তৃতীয় সচিব মুহাম্মদ আব্দুল রহিম বাংলাদেশে প্রতি বিশ্বস্ততা প্রকাশ করেন কারন “আমরা আর ভান করতে পারছি না।”
জনাব মাসুদ ৫৬ বছর বয়সী এবং ছয় সন্তানের পিতা এবং জনাব রহিম(২৯) তারা দুজনেই পূর্ব বাংলার। কুমিল্লার জনাব মাসুদ টোকিওতে ১৯৭০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে চাকরীরত আছেন এবং জনাব রহিম একজন অবিবাহিত পূর্ব বাংলার রাজশাহীর। জনাব রহিম টোকিওতে ১৯৭০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে চাকরীরত আছেন।
জনাব মাসউড এবং জনাব রহিম জাপানিজ সাংবাদিকদের বলেন তারা পক্ষত্যাগ করেছিলেন কারন “আমরা পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের ভয়াবহ অত্যাচার সহ্য করতে পারছিলেন না।”
নভেম্বরের ২ তারিখ বার্নেতে সুইজারল্যান্ডে পাকিস্তান দূতাবাসের মধ্যম সম্পাদক এবং সাবেক অভি্যোগ বিষয়াবলী জনাব ওয়ালিউর রহমান ঘোষনা করেন যে তিনি পদত্যাগ করেছেন এবং সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় চান।
তিনি একটি সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানে ১৫ লক্ষ মানুষ হত্যার জন্য দায়ী করেন।
মিশরের রাজধানী কায়রোতে পাকিস্তানের প্রধান বিচারালয়ের মুখ্য জনাব ফজলুল করিম অক্টোবরের ২৬ তারিখ লন্ডনে আসেন পাকিস্তান সরকারের শাসনপ্রনালীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বাংলাদেশের আন্দোলনে অংশ নিতে।
৩১ বছর বয়সী এই কূটনীতিক এক বিবৃতিতে বলেন “পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা গুপ্তসভা সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মৌলিক চাহিদাগুলো থেকে বঞ্চিত করতে এবং তাদের চিরস্থায়ীভাবে পরাধীন রাখতে।”
লন্ডন ভিত্তিক আন্দোলনের এক মুখপাত্র বলেন প্রায় ৪০ জন পূর্ব বাঙালি কূটনীতিক বিদেশে তাদের পদ ছেড়ে দেন কারন পাকিস্তানি সেনারা মার্চ মাসে পূর্ব বাংলায় স্থানান্তরিত হন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আজ আমি হতাশ হয়ে আপনাকে লিখছি যা কয়েক সপ্তাহ ধরে আমার চিন্তাকে মেঘাচ্ছন্ন করে রেখেছে।সাত মাসের-ও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যকে সাহায্য করার পর আপনাকে এটা জানানো হয়তো অস্বাভাবিক মনে হতে পারে।কিন্তু আমার কর্তব্যবোধ আমাকে নির্দেশ দিচ্ছে আপনাকে জানাতে যে,কোনো কারণ ছাড়াই আমি মানসিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছি।আপনার অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুবিধার্থে আমি নিম্নে সংক্ষিপ্ত আকারে বিষয়গুলো তুলে ধরছিঃ
১)মার্চের শেষে ঢাকা ছাড়ি এবং পূর্বদিকে ৩ সপ্তাহ কাটানোর পর ১৯৭১ সালের এপ্রিলের ১৯ তারিখ কলকাতায় আসি।আমি এখানে এসেছি একটি স্বাধীন বাংলাদেশের অঙ্গীকার পূরণে,পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর ভয়ে না।আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমান-এর বিচারের সময় এবং ১৯৬৯ সালের গোলটেবিল মিটিং বা তারপরেও আমার অবদান সম্পর্কে আপনি,আপনার সহকর্মীরা এবং আওয়ামী লীগ দল অবগত আছেন।
২)বাংলাদেশ সরকারের কার্যনির্বাহকদের মাধ্যমে আমি ফেরার পর থেকেই আমাদের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যপূরণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছি।শুরুর দিকে শুধুমাত্র বাহ্যিক কার্যকলাপ মিশনের মাধ্যমে পরিচালিত হত। আমি নিজেকে এতে নিযুক্ত করেছি যাতে আমার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে কাজ করতে পারি।পরিস্থিতির কারণে,কূটনৈতিক ও জনসংযোগ সদরের জন্য দরকারি যন্ত্রপাতি পর্যাপ্তপরিমাণে ছিল না।যখনই প্রয়োজন,আমি এই ফাঁক কমানোর এবং এই শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করেছি।আমি চিঠির খসড়া করেছি,বৈদেশিক সংস্থার জন্য নীতিমালা তৈরী করেছি,বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জন্য ব্রিফিং তৈরী করেছি,বিদেশী সংবাদদাতা ও পরিদর্শকদের অবগত করেছি,বাংলাদেশের আন্দোলনের তথ্য ও দলিল সংকলন করেছি এবং বিভিন্ন সময়ে আরো অসংখ্য কাজ করেছি।
৩)আমাদের বৈদেশিক কার্যালয় এবং কূটনীতিক প্রচেষ্টা কে শক্তিশালী করতে বৈদেশিক প্রচারযন্ত্রের উন্নতি সাধনে আমি বিভিন্ন উপলক্ষে বিভিন্ন পরিকল্পনা জমা দিয়েছি।আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের সাথে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব আমাদের এই ঘটনার জন্য সুফল বয়ে এনেছে।যখন-ই আমি কথা বলেছি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল আমাদের ঘটনার সত্যতা প্রতিপাদ্য করা এবং এই নেতৃত্বের নেপথ্যে আওয়ামীলীগ ও শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা।জনাব আলম বৈদেশিক সচিবের দায়িত্ব নেয়ার পর আমিও চেষ্টা করেছি যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করতে এবং তাকে ও বাকি সব মিশনের কাজে সবধরনের সম্ভাব্য সহযোগিতা প্রদান করেছি।এছাড়াও যখনই প্রয়োজন হয়েছে আমি জনাব হোসেইন আলী কে বিভিন্ন বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছি।আমি আমার সাধ্যের বাইরে গিয়েও অনেক কাজ করেছি শুধুমাত্র আমাদের বিষয়টাকে শক্তিশালী করতে এবং আরও অসংখ্য কাজ করেছি মিশনের জন্য।আমার উপস্থাপনে এই ধারণা বিকশিত হয়েছে এবং এখন তা খুব ভালভাবে কাজ করছে।“বাংলাদেশ” নামে একটি ইংরেজি বুলেটিন এই বিভাগ থেকে প্রত্যেক সপ্তাহে প্রকাশিত হচ্ছে।আমাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে এই বিভাগকে আর কার্যকর করতে আমি একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা জমা দিয়েছি।
৫) এতদিন ধরে একমুহূর্তের জন্যও এমন হয়নি যে আমার অবদান অপ্রয়োজনীয় বা এই ব্যাপারে বাংলাদেশের জন্য আমার কাজ করার বিষয়ে
আমি মনে করেছিলাম আরো কার্যকর ভাবে কাজ করার জন্য পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজের বণ্টন করা যায় সেই জন্যে আমার সেটাই করা উচিত।এটা আমাকে আমার দায়িত্ব পালনের সময় আরো সৃজনশীল এবং তৎপর হবার ক্ষেত্রে সহায়তা করতো।এই সময় পররাষ্ট্র সচিব আমাকে জানান যে আমার অবস্থান কে আনুষ্ঠানিক করার ব্যাপারে সমস্যা আছে।এটা শোনার পরে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে আমি প্রথম বারের মত পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে দেখা করি।তিনি আমার প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন এবং আমার যাবতীয় কাজের জন্য তিনি আমার প্রশংসা করেন কিন্তু তার সাথে বলেন যে আনুষ্ঠানিক ভাবে আমার দায়িত্বে থাকার ব্যাপারে বিভিন্ন পক্ষ থেকে সমস্যা রয়েছে।যদিও তিনি আগের মত স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে আমার কাজ চালু রাখার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন।
(৬) যেহেতু আমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের জনগণের জন্য কাজ করা সেহেতু আমি পররাষ্ট্র দপ্তরে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি।যদি আমার প্রয়োজন হয় সেজন্য হৃদ্যতার সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আমার জন্য সামান্য ভাতার ব্যবস্থা করেছেন।
(৭) যাইহোক এরই মধ্যে বর্হিবিশ্ব প্রকাশনা বিভাগ থেকে আমার দ্বারা সংকলিত ও প্রস্তুতকৃত দুটি বৈ প্রকাশিত হয়।একটির নাম “বাংলাদেশ-সমসাময়িক ঘটনা এবং দলিলপত্র” এবং অন্যটির নাম “বাংলাদেশ-স্বায়ত্ত্বশাসন থেকে স্বাধীনতা” (ওয়ার্ল্ড প্রেস কমেন্ট্রারি)।সহৃদয় প্রকাশনা বিভাগ প্রথমটিতে আমার নাম উল্লেখ করেছেন যদিও প্রকৃতপক্ষে আমি নাম উল্লেখ করার ব্যাপারে রাজি ছিলাম না।
(৮) এই অবস্থাটি অপমানজনক ও অবমাননাকর যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে আমি সেটা মনে করছি না। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি যে আমাকে কার্যকর ভাবে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না।সেই সাথে এটা অধিক সংখ্যক বিদেশী সংবাদদাতা ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ ও কাজের ক্ষেত্রে লজ্জাজনক।
(৯) সব সময়ই বিভিন্ন সূত্র থেকে এবং বিশেষত পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে আমাকে জানানো হয়েছে যে বাংলাদেশের পক্ষে আমার কাজ করার ব্যাপারে আপনার পক্ষ থেকে আপত্তি রয়েছে।এই পরিস্থিতিকে মানুষের পক্ষে অসহ্য এবং রাজনৈতিক ভাবে দুর্ভাগ্যজনক মনে করায় গত সপ্তাহে আমি পুনরায় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে দেখা করেছিলাম।তিনি আমাকে বিষয়টি নিয়ে আপনার ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনা করার উপদেশ দেন এবং আমাকে আশ্বস্ত করেন যে এই অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির শুধুমাত্র তখনই পরিবর্তন হবে যখন আপনি এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আমাকে আরো কার্যকর ভাবে কাজ করতে অনুমতি দেবেন।যখন এই বিষয় নিয়ে আমি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনা করি তখন তিনি এইসব ঘটনা শুনে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বিষয়টি নিয়ে আপনার সাথে আলোচনা করতে উপদেশ দেন।
জনাব প্রধানমন্ত্রী,আমি এইখানে সম্পূর্ণরুপে এটা পরিস্কার করতে চাই যে আমার দায়িত্ব নির্ধারিত থাকলে আমি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আমার কাজ অব্যাহত রাখতে পারলেই খুশী হব।আমি ইতিমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধে সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে এবং আমাদের সংগ্রামকে আরো ভালো এবং কার্যকর ভাবে উপস্থাপন করার জন্য আমার সীমাবদ্ধ সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করার ব্যাপারে আমার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছি।
আমি আশা করি আপনি এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন।আমি পররাষ্ট্র দপ্তরে বা পরিকল্পনা কমিশনে বা আপনি আমার জন্য উপযুক্ত মনে করেন এমন যে কোন ক্ষেত্রে কাজ চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক।
আপনার বিশ্বস্ত
(মউদুদ আহমেদ)
ব্যারিস্টার-এট-ল
তারিখ.১২/১১/৭১
অনুলিপি পাঠানো হলঃ
১. প্রধানমন্ত্রী
২. ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি
৩. পররাষ্ট্র মন্ত্রী