শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
ভারতস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার কর্তৃক একটি চিত্রপ্রদর্শনী উদ্বোধন কালে প্রদত্ত বক্তব্য | পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় | ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশ প্রেস বিজ্ঞপ্তি
BANGLADESH PRESS RELEASE
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মিশন
৯, সার্কাস এভিনিউ
কলিকাতা-১৭
(স্বীকৃত তথ্য উপাত্ত সহকারে বা ব্যতিত পুনর্লিখিত)
————————————————————————————————————————
নং – পিআর/৪৯ সেপ্টেম্বর ১৪, ১৯৭১
এম হোসেইন আলী চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন।
“আমি জনাব সুবল পাল এমন একটি অসাধারণ চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করার জন্য ধন্যবাদ প্রদান করতে চাই, যা বর্তমানে বাংলাদেশে হাজারো মানুষের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হচ্ছে তাতে অবদান রাখবে।” ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার জনাব এম হোসেইন আলী চিত্র প্রদর্শনীতে এই কথা বলেন।
জনাব হোসেইন আলী ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে চারুকলা একাডেমীতে চিত্রকর সুবল পাল এর চিত্রকর্মের প্রদর্শনীর উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
এছাড়াও জনাব আলী আরো বলেন যে সমালোচকরা হয়তো বলেন যে শিল্পের মধ্য দিয়ে উপযোগবাদী চরিত্র ফুটে উঠে না। কিন্তু শিল্প সবসময়ই মানবতা এবং সভ্যতার জন্য অপরিহার্য। এটি একটি জাতির চিন্তাধারা ও ভাবমূর্তি ফুটিয়ে তোলে। রঙ তুলির ইস্পাত কঠিন আঁচড়ে চিত্রকর সুবল পাল বাংলাদেশে বর্তমানে যা হচ্ছে তার একটি পরিষ্কার ছবি তুলে ধরেছেন। বলা হয়ে থাকে শিল্পের কাজই হচ্ছে বিনোদন প্রদান এবং সেই সাথে শিল্পীর জন্য উৎসাহের একটি অশেষ উৎস হয়ে ওঠা। যদি তাই হয়, তবে আমার মনে হয় এই ছবিগুলো অনেকের জন্যই হতাশা ও মন খারাপের কারণ হতে পারে কারণ এই ছবিগুলোতে চিত্রকর সুশান্ত পাল সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর একটি বিদেশী সেনাবাহিনীর অন্যায় আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞের জীবন্ত চিত্র তুলে এনেছেন। চিত্রকর তার ছবিতে বাংলাদেশে ঘটে ্যাওয়া বিষয়গুলো এমোণভাবে তুলে ধরেছেন, যেভাবে এইসব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে একজন শিল্পীর প্রতিবাদ জানানো উচিত। তিনি তার কাজটি সথিকভাবে এবং যথাযথভাবেই করেছেন।
দেশের মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে হাইকমিশনার আরো বলেন যে সভ্য পৃথিবীতে সবাই বাংলাদেশে যা হয়েছে এবং যা এইমুহুর্তেহচ্ছে সেইসব সম্পর্কেসবই জানেন। তাদের চোখের সামনেই একটি স্বাধীনতাকামী জাতি সামরিক জান্তা দ্বারা অমানবিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে তা দেখার জন্য আমি আরেকবার কাউকে অনুরোধ করবো না। এটি খুবই পরিচিত একটি গল্প, বাংলাদেশের নিরস্ত্র ও নিরীহ
পেইজ ৭৮৯
জনতার উপর এই ধরণের বর্বর হামলার কথা সবাই জানে। যাই হোক, আমি বলতে চাই যে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক এই দেশের ধর্মভীরু মানুষের উপর এই ধরণের গনহত্যা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার বলে তৈরী করে নি বরং পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করার পথ তৈরী করে দিয়েছে। ইয়াহিয়া খান কর্তৃক পাঠানো সামরিক গোষ্ঠী বুঝতে পারছে তারা এভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কামী মানুষকে উন্নত অস্ত্র শক্তির ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখতে পারবে না।
সভ্য বিশ্বের সব জায়গায় তাদের এই ধরণের বর্বর আক্রমণ নিন্দিত হয়েছে। তাদের অর্থনীতি, যা কিনা বাংলাদেশী সম্পদের উপর নির্মিত হয়েছে, তা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া এই অযৌক্তিক যুদ্ধের বিপরীতে শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। যার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশী মানুষের উপর বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে আসা অযৌক্তিক নিগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিদেশ থেকে যে সকল অনুদান ও সাহায্য আসতো তা সবই পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি এবং সামরিক সরঞ্জামের জন্য ব্যয় করা হতো। বাংলাদেশের সামরিক অগ্রগতি ব্যহত হওয়ার কারণ হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধভিত্তিক সামরিক অর্থনীতি যা কেবলমাত্র ভারতের সাথে যুদ্ধের জন্য পরিকল্পিত। কিন্তু মূলত এই সরকার নিজেদের কে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষের উপর নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষমতায় রেখেছে।
মুক্তি বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে হাই কমিশনার বলেন যে, আমাদের মরণজয়ী মুক্তিবাহিনী ইতোমধ্যেই শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে কঠিন আক্রমণ রচনা করতে সমর্থ হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী দিনে দিনে ছন্দ ফিরে পাচ্ছে। আমাদের গেরিলারা প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যক হানাদার সেনা হত্যা করছে এবং ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া, রেল লাইন তুলে ফেলা, রাস্তা নষ্ট করার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ, রসদ, অস্ত্রপাতি ও সৈন্য আদান প্রদান ব্যহত করছে। আমাদের গেরিলারা একইসাথে দেশে থাকা স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদেরও নির্মূল করছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মবিশ্বাস তাদের বিপুল সংখ্যক সৈন্য ও অন্যান্য রসদ হারিয়ে একেবারে তলানীতে নেমে আসায় তার কয়েক জায়গা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। মুক্তি বাহিনী বর্তমানে বাংলাদেশের একটি বিরাট অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। বিশ্বের সেরা সেনাবাহিনী এখন ভীত সন্ত্রস্ত এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে যুদ্ধে ইস্তফা দিয়ে আত্মসমর্পণ করছে।
রাজনৈতিকভাবে, আমরা বর্তমানে পূর্বের চাইতে বেশি একতাবদ্ধ। যদিও আওয়ামীলীগ নির্বাচনে অনেক বড় জয় পেয়েছিলো এবং বর্তমানে এটি দেশে সবচাইতে বড় আগ্রহের বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলোর এই মুহুর্তে উচিত হাতে হাত রেখে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা করে যাওয়া। দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেনী পেশার মানুষকে সাথে নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি বিজয়সূচক সমাপ্তি টানা।
চিত্রকর সুবল পালকে ধন্যবাদ জানিয়ে জনাব আলি জানান, একটি ছবি হাজার শব্দের প্রতিচ্ছবি।