শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত চিঠি | পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় | ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত চিঠি, ১৫ই অক্টোবর, ১৯৭১।
(বাংলাদেশ সরকারের সীল)
মুজিবনগর,
১৫ই অক্টোবর, ১৯৭১
মহামান্য,
ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১-এ লেখা চিঠির ধারাবাহিকতায় পরবর্তী যোগাযোগ ও ব্যক্তিগত আলোচনার জন্য আমরা এই চিঠি লিখছি । মহামান্য, আপনি অবগত আছেন যে, ১০ই এপ্রিল নির্বাচিত আইনসভা ও প্রাদেশিক প্রধিনিধিদের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষিত হয় যারা প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন বাংলাদেশী জনগণের মুখপাত্র । এই ঘোষণা ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ হতে পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনী কর্তৃক একতরফা, অবাধে ও পাশবিক হত্যাযজ্ঞ ও অত্যাচারের এবং মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকারের খর্ব করার বিরুদ্ধে রায় ।
২. এটা সবাই জানে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশের জনগণের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নির্মম ঔপনিবেশিক অত্যাচার, অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কথা । শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে তাঁদের অধীনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সরকার ব্যবস্থা গঠন করা হয়, যা আপনাকে ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১-এর চিঠিতে জানানো হয়েছে ।
৩. গত কয়েক বছর ধরে আমাদের জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে তাঁদের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অহিংস আন্দোলন করে এসেছে । এমনকি পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক জাতীয় সংসদের অধিবেশন অন্যায়ভাবে বন্ধ ঘোষণা করার পরেও আমাদের জনগণ সহিংস আন্দোলনের পথে না গিয়ে, তাঁদের অহিংস আন্দোলনের ধারা অব্যাহত রেখেছে । ২৪শে মার্চ, ১৯৭১ সালের রাত পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠী তথা-কথিত সমঝোতার কথা বলে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে অন্যায়ভাবে সুযোগ নিয়েছে ।
৪. তাদের পরিকল্পনা বিশ্ববাসীর সামনে চলে আসে যখন তারা অন্যায়ভাবে আমাদের দেশের অসহায়, ঘুমন্ত, নিরপরাধ ও নিরস্ত্র শিশু, নারী ও পুরুষদের উপরে ২৫শে মার্চ কালো রাতে পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ঝাপিয়ে পড়ে । যুবক ও তরুণদের ছাড়াও ছাত্র, কৃষক ও শ্রমিক নেতাদের উপর তারা আলাদা ও বিশেষভাবে টার্গেট করেছিলো । এর ফলে অস্ত্রের সাহায্য নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না ।
৫. ১০ই এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা হওয়ার পর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন আরও শক্তিশালী ও বেগবান হয়েছে । আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ রক্ষায় ও সাড়ে সাত লক্ষ জনগণের সংগ্রামে সামিল হতে পূর্বের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও অন্যান্য প্যারা-মিলিটারি বাহিনীর প্রায় ৬০,০০০ সদস্য অস্ত্রহাতে নেমে পড়েছে । মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং ঔপনিবেশিক নিপীড়ন হতে এদেশের জনগণের রক্ষার্থে তাঁরা শত-সহস্র্য তরুণ-যুবাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ শক্তি, যা কিনা দেশকে শাসন করেছে, তা ছিল জনবিরোধী। তারা ছিল সামরিক বাহিনী, বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও একচেটিয়া পুঁজিবাদীদের মধ্যকার চক্রান্তের অংশ। এই শক্তি হাতে হাত রেখে একসঙ্গে কাজ করে এবং তারা কখনোই গণতান্ত্রিক শক্তিকে শক্তিসঞ্চয় করতে দেয় নি। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রসার বন্ধে কায়েমী স্বার্থ হাসিলের জন্য এটা ছিল ইচ্ছাকৃত চেষ্টা এবং যখনই এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, এই শক্তিগুলো একত্রিত হয়ে তা দমনে সফল হয়েছে।
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গন, যখন ইয়াহিয়া খান আইয়ুবের থেকে ক্ষমতা নিয়ে নিলেন, তখন দ্বিতীয়বারের মত সংবিধান রহিত করা হল এবং জাতীয় পরিষদও ভেঙে দেয়া হল। কিন্তু তারপরও জান্তা কর্তৃক গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছিল এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের আইনী কাঠামোও চালু করা হল। জনগণ জেনারেলের কথা বিশ্বাস করল এবং আওয়ামীলীগ, যা কিনা একটি সাংবিধানিক রাজনৈতিক দল, তারা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সামনে এগিয়ে এল। এবছর ডিসেম্বরের ৭ তারিখ হতে জানুয়ারির ১৭ তারিখ পর্যন্ত নির্বাচন হল এবং ইয়াহিয়া খানের ভাষায় তা ছিল একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। নির্বাচন শেষে আওয়ামীলীগ ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়ী হল। বাংলাদেশের মোট ভোটের ৮৫% পেল এবং ১৬৯ সিটের মধ্যে মাত্র ২টি সিটে পরাজিত হল। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ সিটের মধ্যে ২৮৮ সিটে তারা জয়ী হল। এভাবে আওয়ামীলীগ প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার পাশাপাশি জাতীয় পরিষদেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করল।
আওয়ামীলীগ এই নির্বাচন লড়েছিল ছয় দফার ভিত্তিতে। যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ ২৩ বছর ধরে শোষিত হয়েছে এবং বারে বারে ক্ষমতাসীন চক্রের প্রতারনার স্বীকার হয়েছে, ছয় দফা ছিল তাদের জন্য পাকিস্তানের গঠনতন্ত্রের মধ্যে থেকে একটি কার্যকর স্বায়ত্তশাসনের পন্থা। এটা ছিল বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। আশা ছিল, আওয়ামীলীগ সাংবিধানিক উপায়ে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থের শোষণ থেকে বাঙালি মুক্তি পাবে।
নির্বাচন শেষে জাতীয় পরিষদে সকল দলের নেতাদের নিজেদের মধ্যে এবং পৃথকভাবে প্রত্যেক দল ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে সংলাপ হয় এবং অবশেষে ৩ মার্চ, ১৯৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের দিন ধার্য করা হয়। ইতিমধ্যে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জনাব ভুট্টো অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য সকল পার্টির অধিবেশনে যোগদান প্রতিহত করার জন্য হুমকি দিতে থাকেন। সিন্ধু ও পাঞ্জাবে নির্বাচনে এগিয়ে থেকে তিনি সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক ব্যবহার শুরু করেন। ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল উমর, রাষ্ট্রপতির প্রধান কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল পিযাড়া এবং ইয়াহিয়া খানের অন্যান্য কাছের সহযোগীদের সঙ্গে মিলে জনাব ভুট্টো তার চাপের কৌশল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু যখন তার ব্যর্থতা নিশ্চিত এবং জাতীয় পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যরা ঢাকায় অধিবেশনে অংশগ্রহনের জন্য প্লেনের সিট নিয়ে ফেলেছেন, তখন জেনারেল ইয়াহিয়া শুনলেন জনাভ ভুট্টোর কথা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধবাজেরা (সেনাপতিরা?) এক রেডিও বার্তার মাধ্যমে ১ মার্চ, ১৯৭১ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদ স্থগিত ঘোষণা করলেন।