You dont have javascript enabled! Please enable it!
                    শিরোনাম                  সূত্র              তারিখ
বাংলাদেশ সরকারের ভারতস্থ হাইকমিশনার কর্তৃক স্বপক্ষ ত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়  ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মিশন
৯,সার্কাস এভিনিউ,কলকাতা-১৭
বাংলাদেশ

মানুষেরর জীবনে কখোনো কখোনো এমন সময় আসে যখন অস্থায়ী কতৃপক্ষের কাছে বশ্যতা স্বীকারের চেয়ে কোনো মহতী আদর্শের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা উচিত।।কোনো সরকার তার ক্ষমতাবলে জোর করে আনুগত্য আদায় করতে পারে না। যখন তারা একটি সভ্যসমাজের প্রাথমিক নর্মস ও আদর্শ ভঙ্গ করা শুরু করে এবং মানবতা বিরোধী অপরাধ করে,যেমনটা পাকিস্তান সরকার করেছে তখন এর বিরোধিতা করা নৈতিক ভাবে অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে।জেফারসন তাই বলেছিলেন,’ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ।‘
আমি পাকিস্তানের বৈদেশিক বিভাগের সদস্য হিসাবে প্রায় ২২ বছর পাকিস্তান সরকারের সেবা করেছি এবং সর্বোচ্চ বিশ্বস্ততার সাথে পাকিস্তানের জন্য কাজ করেছি।এমনকি পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিকদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য যুদ্ধ শুরুর পরেও আমি সরকারের জন্য কাজ করে গেছি।যেহেতু সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল সেই কারনে বাংলাদেশে কি ঘটছে সেই বিষয়ে আমার কাছে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য ছিল না।হাজারো ভীত আহত ও পঙ্গু শরণার্থী রক্ত হিম করা অমানবিক নৃশংসতার ঘটনা নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে এসেছে যা সরকারের দাবিকে মিথ্যা প্রমান করেছে।ইতিমধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানকারি এবং খুব কাছ থেকে এসব ঘটনা দেখেছেন এমন কিছু বিদেশী ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের রিপোর্টআমার কাছে আসা শুরু করে এবং তথ্যেরএকটি নিরপেক্ষ উৎস তৈরি হয়।এইসব রিপোর্ট থেকে যে অবস্থা উঠে আসে সেটা ভয়াবহ ও মর্মস্পর্শী।এগুলো সন্দেহের উর্ধ্বে প্রমান করে যে বাংলাদেশে ঠাণ্ডা মাথায় গনহত্যা চালানো হচ্ছে।
পাকিস্তানের সরকার, বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তাসরকার। এরা মরিয়া হয়ে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা করছে।যদিও তারা মাত্র ৮ মাস পূর্বে নিজের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন বাতিল করেছে।সামরিক জান্তা হিংস্রতা নৃশংসতা ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে চুপ করিয়ে রাখতে চাইছে। এদের কর্তৃত্ব সম্পূর্ণভাবে সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল এবং এর নিয়ন্ত্রণ গোলন্দাজবাহিনীর পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ।এই সরকার এমনকি ক্ষমতায় থাকার ভান করারও সকল বৈধতা হারিয়েছে।পাকিস্তান জাতিকে এরাই ধ্বংস করছে।পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানের ফলে সৃষ্ট মৃতদেহের পাহাড় ও ধ্বংসাবশেষের নিচে সমগ্র পাকিস্তান চাপা পড়ে আছে।
বাংলাদেশ একসময় ছিল সমৃদ্ধির সোনালি অঞ্চল। পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর দলের কারণে সেটা এখন ঝলসে যাওয়া ভূমিতে পরিণত হয়েছে।বাংলাদেশের নিরস্ত্র,শান্তিপ্রিয় ও গনতান্ত্রিক মনভাবাপন্ন মানুষের উপর ইয়াহিয়া-হামিদ-ভুট্টোর ভাড়াটে গুন্ডাদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছে।বাংলাদেশে বর্তমানে খুন,লুন্ঠন,অগ্নিসংযোগ,ধর্ষণ নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের জনগণদের হত্যা করেছে এবং করে চলেছে।তারা অসংখ্য মানুষকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে।বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অগণিত মানুষ জীবন বাঁচাতে,অপমান থেকে,অসম্মানিত হওয়ার থেকে এবং গণহত্যার থেকে রক্ষা পেতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।জনসাধারণের মধ্যে অবিশ্বাস,ভয়,চিন্তা এবং উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।বাংলাদেশে ঘটতে থাকা ভয়াবহ ও নৃশংস ঘটনা আপনাদের অজানা নয়।
যদি পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ ও তাদের পোষ্য সামরিক জান্তা বাংলাদেশ কে পাকিস্তানের অংশ বলে মনে করতো তাহলে তারা বাংলাদেশ কে উপিনেবেশ বানাতো না,তারা গণহত্যা,গণধর্ষন,অগ্নিসংযোগ এবং ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হত না।এখন তারা সারা পৃথিবীকে বিশ্বাস করাতে চায় যে বাংলাদেশীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী।যে ৬ দফা কর্মসূচিতে নির্বাচনের আগে ও পরে জেনারেল ইয়াহিয়া কোন সমস্যা পান নাই সেই একই কর্মসূচি ২৬শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে রাষ্ট্রবিরোধী বলে আবিষ্কৃত হল।এটা একটা রসিকতা যে যদিও ইয়াহিয়া নির্বাচনের পরে ঘোষণা দেন নির্বাচন সম্পূর্ণরুপে অবাধ ও সুষ্ঠ হয়েছে কিন্তু মার্চের ২৬ তারিখে তিনি বলেন যে আওয়ামী লীগ হুমকি ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে জনসমর্থন পেয়েছে।নির্বাচনের সময় তার সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে তিনি যে নিজেই স্বীকার করেছিলেন সেটা তিনি ভুলে গেছেন।এটা শতাব্দীর সেরা পরিহাস যে যাকে তিনি “পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী” বলে উল্লেখ করেছিলেন সেই ব্যক্তিই রাতারাতি “বিশ্বাসঘাতকে” পরিণত হল।
এই বর্বরতা ও নৃশংসতা দিয়ে বাঙ্গালীদের মনোবল দমিয়ে রাখা যাবে না।যে জাতি সাংবিধানিক আন্দোলনে বিশ্বাসী তাদের হঠাৎ করে যুদ্ধের মাঝে ঠেলে দেয়া হয়েছে।এখন বাংলাদেশ যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে,মুক্তিযুদ্ধ।পশ্চিম পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর হাত থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের জনগণ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও একতাবদ্ধ।মুক্তি সংগ্রামকে সংগঠিত ও ফলপ্রসূ করার জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ ১২ এপ্রিল,১৯৭১ তারিখে মিলিত হন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার গঠন করেন।বাংলাদেশের প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক দল এই সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে।মুক্তিবাহিনী সকল ক্ষেত্রেই শত্রুর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত।নিয়মিত বাহিনি,গেরিলা যোদ্ধারা,কম্যান্ডো বাহিনী এবং দ্রুত আঘাত করে পালিয়ে যাওয়া যোদ্ধারা শত্রুদের প্রচন্ড ক্ষতি করছে।ইয়াহিয়ার কসাইদের কবল থেকে পালিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার তরুণ ইয়ুথ ক্যাম্পে আসছে।তারা চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য নিজেদের তৈরি করছে।আমরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।আমাদের সংগ্রাম সত্যের জন্য,মানুষের মর্যাদার জন্য এবং গনতন্ত্রের জন্য।সুতরাং আমাদের সাফল্যের ব্যাপারে আমরা আত্মবিশ্বাসী।
পাকিস্তান যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করছে যে এটা তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়।কিন্তু সত্যি কি তাই যখন এই অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে,যখন একটা জাতিকে ধ্বংস করতে চাওয়া হচ্ছে যার সুদূরপ্রসারিত ভৌগলিক সীমানা,ভাষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি,আশা এবং আকাঙ্ক্ষা রয়েছে?
এটা কি নিষ্ঠুর রসিকতার মত শোনায় না যখন পাকিস্তানের বর্বরতার প্রেক্ষিতে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ কে হত্যা করা হচ্ছে,বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে,যখন নারীদের ধর্ষন করা হচ্ছে,যখন বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের খুঁজে বের করা হচ্ছে এবং হত্যা করা হচ্ছে?

প্রদত্ত তারিখ (এম.হোসেন আলী)
৯ সেপ্টেম্বর,১৯৭১ বাংলাদেশ সরকারের ভারতস্থ হাইকমিশনার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!