জীবনচিত্র নামঃ ডা. মেজর নইমুল ইসলাম
Dr. Major Naimul Islam
ডাকনামঃ বাচ্চু
পিতার নামঃ নুরুল হুদা
পিতার পেশাঃ সরকারি চাকরি
ভাইবোনের সংখ্যাঃ সাত ভাই ও এক বোন;
নিজক্ৰম-তৃতীয়
ধর্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ ঠাকুরগাঁও সদর, ডাকঘর/জেলা-ঠাকুরগাঁও
শহীদ ভা, মেজর নইমুল ইসলাম
নিখৌঁজ হওয়ার সময় ঠিকানাঃ সমরাস্ত্র কারখানা, জয়দেবপুর
জন্মঃ ২৯ নভেম্বর, ১৯২৩/১৯২৪
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
ম্যাট্রিক ও ঠাকুরগাঁও হাই স্কুল, অঙ্কে সর্বদা ১০০ নম্বর
এমবিবিএসঃ ১৯৫০, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ
শিক্ষাগত যোগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কারঃ মোহসীন স্কলারশিপসহ বিভিন্ন স্কলারশিপের মাধ্যমেই সমগ্ৰ ছাত্রজীবনে পড়াশোনা
শখঃ ফুটবল, টেনিস
চাকরির বর্ণনা(সরকারি)
আমি মেডিকেল কোরঃ পাকিস্তান নেভি, ১৯৫০-৬৪
আমি মেডিকেল কোরঃ চট্টগ্রাম সেনানিবাস, ১৯৬৮
মেজরঃ সমরাস্ত্র কারখানা, জয়দেবপুর, ঢাকা, ১৯৭০ থেকে আমৃত্যু
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ সমরাস্ত্র কারখানা, জয়দেবপুর, ঢাকায় কর্মরত অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ধৃত এবং তারপর থেকে নিখোঁজ
নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ৩ এপ্রিল, ১৯৭১
মরদেহঃ পাওয়া যায়নি
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরষ্কারঃ
স্ত্রীর নামঃ সুরাইয়া ইসলাম
বিয়েঃ ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫০
সন্তান-সন্ততিঃ এক পুত্র ও দুই কন্যা
নাদেরা ইসলামঃ পিএইচডি (ইংরেজি), কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত
নুসরাত ইসলাম – অর্থনীতি (অনার্স) এবং এমবিএ, কানাডা প্রবাসী
মইনুল ইসলাম – এমএ, ব্যবসায়ী
তথ্য প্রদানকারী
সুরাইয়া ইসলাম
শহীদ চিকিৎসকের স্ত্রী
বাড়ি-১০, সড়ক-১, সেক্টর-১,
উত্তরা আবাসিক এলাকা, ঢাকা
১৭৬ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
আমার স্বামী
শহীদ ডা. মেজর নইমুল ইসলাম
সুরাইয়া ইসলাম
এই সুদীর্ঘ বিবাহিত জীবনে কোনো প্রকার দুঃখ বা মনোকষ্টের অবকাশ আনার জীবনে ছিল না। তাই আজ চেষ্টা করেও দুঃখ বিজড়িত তেমন কোনো স্মৃতিই অন্তর হাতড়িয়ে খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ একটাই-আমার স্বামী ডা. নাইমুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত নম্রস্বভাবের, মার্জিত রুচি ও মনের স্বল্পভাষী একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ—একজন সৎ মানুষ।
ডা. নাইমুল ইসলাম ছিলেন সেনাবাহিনীর ডাক্তার। শুনেছিলাম ১৯২৩/১৯২৪ সালের ২৪ নভেম্বর তদানীন্তন দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা ছিলেন সাত ভাই ও এক বোন। তাই তাঁর সমসাময়িক বন্ধুস্থানীয়রা বলতেন, ‘তোরা তো সাত ভাই চম্পা এক বোন পারুল।’ তিনি ছিলেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। শ্বশুরের কাছে শুনেছিলাম তিনি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন, খুবই মেধাবী এবং মনোযোগী ছিলেন। লেখাপড়ার প্রতি ছিল তাঁর অসাধারণ আগ্রহ। তাঁর লেখাপড়ার জন্য কখনও নাকি তেমন টাকা-পয়সা খরচ করতে হয়নি। বৃত্তি পেয়েই লেখাপড়া করেছিলেন। শ্বশুরের কাছেই শুনেছিলাম তাঁকে নাকি কোনোদিনও পড়তে বসবার কথা বলতে হয়নি। তখন পার্বতীপুরে তেমন কোনো ভালো স্কুল ছিল না, তাই আমার শ্বশুর চেষ্টা করে ঠাকুরগাঁওয়ে বদলি হয়ে আসেন। ঠাকুরগাঁও তখন ছিল দিনাজপুর জেলার একটি মহকুমা (বর্তমানে ঠাকুরগাঁও জেলা)। ঠাকুরগাঁওয়ের সরকারি হাই স্কুল তখন বেশ নামকরা স্কুল ছিল। পরবর্তী সময়ে আমার শ্বশুর ঠাকুরগাঁওয়ে জমি কিনে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন যা আজও বিদ্যমান।
ডা. ইসলাম অঙ্কে খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। কখনো নাকি ১০০ ছাড়া ৯৯ পাননি। শৈশব-কৈশোর থেকে ডাক্তারি পাস করা পর্যন্ত স্কলারশিপ পেয়েই লেখাপড়া করেছিলেন। তখন তো বিভিন্ন প্রকার স্কলারশিপ ছিল। মুহসীন স্কলারশিপসহ অনেক স্কলারশিপ তিনি পেয়েছিলেন। তাদের আট ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন লেখাপড়ায় শ্ৰেষ্ঠ। তাই পিতার খুব স্নেহের ছিলেন; এককথায় সুযোগ্য সন্তান। তাঁর সেই সাফল্যকথা আজও আত্মীয়-স্বজনের আলোচনার বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ১৭৭
শহীদ ড. মেজর নইমুল ইসলাম
আগেই বলেছি, তিনি খুবই শান্ত-নম্র ও ভদ্র প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কখনো কড়া সুরে, কড়া মেজাজে কারো প্রতি কথা বলতে শুনিনি। আমাদের তিন সন্তান-বড় দুই মেয়ে, তৃতীয়টি ছেলে। সন্তান-সন্ততিসহ সবার সাথে তাঁর ব্যবহার ছিল বন্ধুর মতো। অপার শান্তির সংসার ছিল আমার। সেসব অনাবিল শান্তিময় জীবনের কথা তো ভোলা যায় না। আজ যখনই সেসব মধুময় দিনগুলোর কথা মনে পড়ে তখনই আঁখি পুরে আসে অশ্রু। একান্ত প্রিয়জন-আপনজন হারানোর ব্যথায়-কষ্টে বুকটা বিদীর্ণ হয়ে যায়। জীবনে আনন্দের আলো মুছে গেলে দুঃখের তারাই তো জুলে ওঠে- আমারও তাই। আমাদের প্রচুর টাকা ছিল না, ছিল না ঐশ্বৰ্য কিন্তু ছিল অপার শান্তি। কেবল আমাদের পরিবারিক বা সাংসারিক গণ্ডিতে নয়, অফিস ও বন্ধুমহলেও তিনি ছিলেন সবার প্রিয় ব্যক্তি। সন্তানদের কাছে ছিলেন প্রিয় পিতা আর অধস্তন কর্মচারীদের প্রিয় স্যার।
১৯৫০ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করে সেই বছরই পাকিস্তান আর্মিতে যোগ দেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত করাচিতে পাকিস্তান নেভিতে কর্মরত ছিলেন। তারপর নেভি থেকে আর্মিতে যোগদান করেন। প্রথম স্টেশন ছিল খাড়িয়া ক্যান্টনমেন্ট, তারপর ডেরা ইসমাইল খাঁ পেশোয়ার। অনেক চেষ্টা করে ১৯৬৮ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন। ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আমরা সপরিবারে চট্টগ্রামেই থাকি। ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরের কাছে গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানার ডাক্তার হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন, আমরাও ছিলাম সন্তান সন্ততিসহ৷ ১৯৭১ সালের ২ মার্চ। বাংলাদেশে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। চারদিকে থমথমে ভাব, যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। কলকারখানার কাজ বন্ধ, অফিসগুলোর কাজকর্মও অনিয়মিত, বন্ধই বলা চলে। ডাক্তার সাহেব অফিসের কথা বাড়িতে তেমন একটা বলতেন না। এমনিতেই তিনি ছিলেন চুপচাপ প্রকৃতির মানুষ। গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানায় তখন শুধু দু’জন আর্মি অফিসার ছিলেন। আমার স্বামী ডা. ইসলাম এবং ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাহ, যিনি ছিলেন একজন অবাঙালি। আমার বড় মেয়ে তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, থাকতো হলে। যতদূর মনে পড়ে মার্চের ১২/১৪ তারিখে আমাদের ধানমণ্ডিতে আমার বড় বোনের বাসায় রেখে ডাক্তার সাহেব চট্টগ্রাম গিয়ে মেয়েকে নিয়ে এলেন। তখন মেয়ের হল বন্ধ ছিল। আমরা আবার গাজীপুর চলে আসি।
২৫ মার্চে ঢাকা শহর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞ সংঘটিত হয়ে গেছে, আমরা সবাই আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছি। এমনি সময় ২৯ মার্চ বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ শুনলাম প্রচুর গোলাগুলির আওয়াজ। জয়দেবপুরে জনসাধারণের ওপর বোমাবর্ষণ শুরু হয়। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সমরাস্ত্র কারখানার সব বাঙালি কর্মচারী। ডাক্তার সাহেব বললেন, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যদি পারো তো তোমরা গ্রামে চলে যাও। দলে দলে মানুষ স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ গ্রামে চলে যাচ্ছিল। আমি বললাম, ‘মেয়েদের নিয়ে আমি কোথায় যাবো? মরতে হয় এখানেই মরবো।’ কিছুক্ষণ পর মেশিন টুলস্ ফ্যাক্টরিতে প্রচণ্ড শব্দে বোমা পড়লো। চারদিকে গোলাগুলি; প্রচণ্ড আওয়াজ-যেন কালবৈশাখীর কালভৈরবে মহাতাণ্ডব চলছে। চারদিকে সবাই আতঙ্কিত; দলে দলে সপরিবারে ছুটিছে। প্রায় ১২টার দিকে জনাকয়েক বাঙালি অফিসার তাদের পরিবার-পরিজনসহ আমাদের বাসায় এলেন। প্রত্যেকেই প্রাণভয়ে ভীত-শঙ্কিত-সন্ত্রস্ত। তারা সবাই আমার অচেনা। আমার বাড়িটা অন্য সব বাড়ি থেকে ছিল একটু দূরে। ডাক্তার সাহেব তাদের সবাইকে ভেতরে আসতে বলেন। আমি তাদের নাম জানলাম-কেউ মাহবুব সাহেব, কেউ স্কুলের হেডমাস্টার কুদ্দুস সাহেব। তাঁরা ভেবেছিলেন ডাক্তার সাহেব তো আর্মির লোক, এজন্য তাঁর বাসায় কিছু হবে না। আমাদের বাড়িতে আসা অন্য সবার মধ্যে মাহবুব সাহেব ও মাস্টার সাহেব শেষ পর্যন্ত বেঁচে গিয়েছিলেন। আমাদের সময় কাটতে লাগলো গুলির শব্দে আতঙ্কিত অবস্থায়। বাইরে কী হচ্ছে এরপর কী হবে ভাবতেও পারছিলাম না। বাসায় আগত সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে, ঐদিনই প্রায় ৩টার দিকে অসংখ্য খানসেন রাইফেল হাতে আমাদের বাড়িটি ঘিরে ফেলে এবং লাথি মেরে বাসার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। সবার দিকে রাইফেল তাক করে রেখে বেয়নেট চার্জের ভয় দেখিয়ে ডাক্তার সাহেবসহ বাড়িতে অবস্থানরত পুরুষদের রাস্তায় নিয়ে যায়। সে সময়ে ঘরের ভেতরে থাকা মহিলা ও শিশুদের আর্তচিৎকারে যেন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সেই দুঃসময়ের কথা মনে হলে আজও ভয়ে শিউরে উঠি। মনে করতে চাই না, তবু সব মনে পড়ে যায়। প্রকম্পিত হৃদয়ে আমরা বড়রা দোয়া-দরুদ কলেমা পড়তে থাকি। ঘরের ভেতরে শিশুদের নিয়ে আমরা মহিলারা… আমাদের চোখের সামনেই পুরুষদের নিয়ে
১৭৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ড. মেজর নইমুল ইসলাম
গেল আর বাইরে গোলাগুলির শব্দের প্রচণ্ডতা… সে কী ভয়াবহ অবস্থা… তা লিখে বোঝানো যাবে না। একাইভাবে ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত বারবার তাঁদের বাইরে নিয়ে যেত। ডাক্তার সাহেবকে জিগ্যেস করে কিছুই জানা যেত না, শুধু বলতেন। কথাবার্তা জিগ্যেস করে, বাইরের কারো সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় ছিল না, ছিল না কোনো প্রকার খবরাখবর পাওয়ার উপায়। বিদ্যুৎ-পানি সবকিছুর লাইন বিচ্ছিন্ন করেছে। কী যে চরম করুণ অসহায় অবস্থায় সে সময়গুলো কেটেছিল! সমস্ত চেতনা যেন লুপ্ত হয়ে যেত। চোরের মতো রেডিও শোনার চেষ্টা করতাম, যদি বাইরের কোনো খবর পাওয়া যায়; কিন্তু প্রায় চেতনাহীন-অসাড় মনে কিছুই যেন ঢুকতো না, কিছুই যেন শুনতে পেতাম না। এরই মাঝে হঠাৎ একদিন শুনলাম স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার পঠিত স্বাধীতার ঘোষণা৷
প্রতিদিনই ডাক্তার সাহেবসহ সবাইকে নিয়মিত নিয়ে যাওয়ার পর্ব চলছেই, অবাঙালিদের উল্লাস, খানসেনাদের বাঙালি নিধনযজ্ঞ চলছে। এরই মাঝে একদিন দেখি আমার বাসার অনতিদূরের একটি বাসা থেকে একটি ষোড়শী মেয়েকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে খানসেনারা, মেয়েটির মা-বাবার আর্তচিৎকারে কাকুতি-মিনতি…সবকিছুকে বিফল করে মত্ত উল্লাসে ফাঁকা আওয়াজ করতে করতে মেয়েটিকে নিয়ে গেল; সব তো নরপশুর দল। তা দেখে আমি আমার মেয়েটির জন্য খুব ভয় পেয়ে গেলাম। বাড়িটা ছিল দোতলা, নিচের তলায় ছিল কেরোসিন তেলের টিন। সবাইকে অনুরোধ করতাম কেরোসিনের টিনটা উপরে এনে দিতে, খানসেনারা যদি আমার মেয়েদের ধরতে আসে। তবে মেয়েদের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুনে একসাথে পুড়ে মরবো। খুঁজতাম ঘরের ভেতরে ইঁদুর মারার বিষ। আজ অকপটে বলছি, আমার স্বামী ও ছেলের চেয়ে মেয়ে দুটির জন্য আতঙ্কিত ছিলাম অনেক বেশি। আল্লাহর কাছে মেয়ে দুটির জন্য তাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য দোয়া চাইতাম। ভাবতেই পারিনি ডাক্তার সাহেবের মতো এমন নিরীহ একজন মানুষকে হত্যা করতে পারে—এটা ছিল আমার বোধের বাইরে।
৩ এপ্রিল সকালে নামাজ পড়ে তিনি আমাকে বললেন, ‘একটা সুটকেসে তোমাদের কিছু কাপড় নিয়ে নাও।’ জানতে চাইলাম, ‘তোমারটা নেবে না?’ বললেন, ‘দরকার নেই।’ কথাটা তখন ঠিক বুঝতে পারিনি, আজ উপলব্ধি করি। তিনি হয়তো সবকিছুই বুঝেছিলেন, সব জানতেন। যা হোক ঐদিন তিনি বললেন যে, আমাদের ঢাকা শহরের ফার্মগেটে নামিয়ে দেবে, আর সেখান থেকেই যে যার গন্তব্যে চলে যাবে। সকাল ৯-১০টা হবে, একটি বড় বাস এসে দাঁড়ালো, সেটাতে নিয়ে যাবে সবাইকে। আমাদের একটা ফিয়ার্ট গাড়ি ছিল… সেটিতে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় হেডমাস্টার সাহেব বললেন, ‘ভাবি আমার মেয়ে দুটিকে যদি গাড়িতে নিতেন; আপনি আমার স্ত্রী-ছেলেদের সাথে বাসে যান।’ বাসটিতে বাঙালিদের সাথে কিছু অবাঙালিও ছিল। ডাক্তার সাহেব কিছু বললেন না। আমি ছেলেকে নিয়ে বাসে উঠে বসলাম। তখন এত-বেশি আতঙ্কিত ছিলাম যেন চেতনাহীন একটা মানুষ, স্বাভাবিকভাবে কোনো কিছু ভাববার চিন্তা করার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ মনে হয় সবকিছুই পরিকল্পিত ছিল, সবই বোধহয় প্ল্যান করা। মনে হয়েছিল দীর্ঘদিন পর আমরা বন্দি অবস্থা থেকে বাইরে এলাম। ঢাকা শহর থমথমে—স্তব্ধ প্রায়; কেমন যেন বিভীষিকাময়, কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। আশায় বুক বেঁধে আছি, ফার্মগেটে আমাদের নামিয়ে দেবে, তারপর মুক্তি…; কিন্তু না; বাস এসে থামালো Second Capital-এ। আমাদের পেছনে পেছনে ডাক্তার সাহেবও এসে থামলেন। আমাদের গাড়িটি তিনিই চালিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। ফার্মগেট নয়, আমাদের আনা হলো, Second Capital-এ। আমরা পৌছানোর একটু পরেই একজন সিপাহি এসে বাঙালি পুরুষদের সবাইকে Second Capital-এর ভেতরে ডেকে নিয়ে যান। ডাক্তার সাহেব আমাকে গাড়ির চাবিটা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাও পারলেন না। এটাই তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা-তিনি চিরতরে হারিয়ে গেলেন আমার জীবন থেকে। আমি আমার মেয়েদের জন্য এতো বেশি চিন্তিত ও আতঙ্কিত ছিলাম যে অন্য কোনো প্রকার খারাপ কিছু চিন্তাতেই আসেনি। ভেবেছিলাম আর্মির লোকই তো ডেকেছে, নিশ্চয়ই চলে আসবেন। ঘন্টাখানেক পর মাস্টার কুদ্দুস সাহেব ফিরে এসে বললেন, ‘তাঁরা পরে আসবেন; চলেন আমরা এখন এখান থেকে চলে যাই।’ মাস্টার সাহেব প্রত্যেকের ঠিকানা নিলেন কে কোথায় যাবো। আমি আমার বড় বোনের ধানমণ্ডির বাড়ির নম্বর, ঠিকানা দিলাম। আমরা অপেক্ষারত আর কতগুলো সিপাই ঘুরাঘুরি করছে—বলছে, ‘এরা কারা? এরা কি ঐ পাঁচজনের ফ্যামিলি?’ ঘন্টা
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ১৭৯
শহীদ ডা. মেজর নইমুল ইসলাম
খানেকের মধ্যে আমার বোন তার ছেলেসহ আসে আমাদের নেয়ার জন্য। আমার বোনের হাত থেকে একজন সিপাই গাড়ির চাবিটা কেড়ে নিলো। আমার বোন অনেক কিছু বলার পর চাবিটা হাতে না দিয়ে ছুঁড়ে দিলো; এমনই অভদ্র পশুতুল্য সব নরপিশাচ! আমি ধানমণ্ডিতে বোনের বাসায় এলাম বাচ্চাদেরসহ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২৬ মার্চ স্মরণে গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানার মাধ্যমে ‘হাতিয়ারে’ নামে একটি ছোট স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। ‘হাতিয়ারে’ মাহবুবুর রহমান সাহেব ‘সমরাস্ত্র কারখানার বর্বর বাহিনী’ নামে ২৯ মার্চ ‘৭১ থেকে ৩ এপ্রিল ‘৭১ সময় পর্যন্ত ঘটনাগুলোর প্রায় সবকিছুই লিখেছেন। তাঁরাও সে সময়ে আমাদের বাড়িতে ছিলেন। তিনি এক জায়গায় লিখেন, ‘আমি এসে ডাক্তার মেজর সাহেবকে হাসান সাহেব আহত হওয়ার ঘটনা বললাম। ডাক্তার সাহেব হাসান সাহেবকে দেখতে চলে গেলেন। কিন্তু তিনি নিরুপায়। তাঁর কাছে কোনো ওষুধপত্র নেই। তিনি ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাহকে অনুরোধ করলেন হাসান সাহেবকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য। ব্রিগেডিয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন; কিন্তু কিছুক্ষণ পর একজন ক্যাপ্টেন এসে ডাক্তার সাহেবকে বললো, ‘হাসান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে আর তুমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছিলে? তোমাকে রক্ষা করা হবে না।’ ডাক্তার সাহেব বুঝতে চেষ্টা করলেন, বললেন, ‘দেখুন আমি একজন ডাক্তার; আমি রোগীর সেবা করি; সে বিদ্রোহী না খুনি, সেটা আমার জানার কথা নয়।’ ক্যাপ্টেন সাহেব চোখ রাঙিয়ে চলে গেল। ডাক্তার কি জানতে এর ফল হবে নির্মম হত্যা!
যে নাবিকের ভেঙে গেছে হাল, ছিঁড়ে গেছে পাল, সীমাহীন সমুদ্রে দিশেহারা, আমিও তেমনি হয়েছিলাম দিশেহারা। ডাক্তার সাহেব তো আর ফিরলেন না। আমার ভাইবোনরা, দুলাভাইরা সবাই সত্যি ঘটনা জেনে গেছে। শুধু আমিই জানি না তখনও আমার মহাসর্বনাশের কথা। প্রতীক্ষার প্রহর গুনছি… এই বোধহয় ডাক্তার সাহেব এলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। ঘরে-বাইরে অনিশ্চিত অবস্থা। আমার সংসার তো ছিন্নভন্ন-তছনছ হয়ে গেল, সেই অবস্থায় আমার বড় দুলাভাই সৈয়দ আহমদ সাহেব (অবসরপ্রাপ্ত ডিভিশনাল কমিশনার), মেজ দুলাভাই দেশের প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. সুলতান আহমেদ চৌধুরী, ছোট বোনের স্বামী বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ কাজী আব্দুল আলীম আর আমার অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ভাই মির্জা নুরুল হুদা কাদের বকস (ছোটি)-এরা সবাই আমার ভেঙে যাওয়া জীবনতরীর হাল শক্ত হাতে ধরলেন। তখন আমার বড় মেয়ে ইংলিশে অনার্স পড়তো;
১৮০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. মেজর নাইমুল ইসলাম
ছোট মেয়ের ১৯৭১-এ ম্যাট্রিক দেয়ার কথা ছিল, ছেলেটা পড়তো প্রাইমারি স্কুলে। সেই সময়ে আমার বড় মেয়ে থাকলো ছোট বোনের বাসায়, ছোট মেয়ে মেজবোনের বাসায় আর আমি ছেলেসহ বড় বোনের কাছে থাকলাম। আমার বাবার বাড়ি দিনাজপুরে, শ্বশুরবাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। তাঁরা কেউ নেই। সবাই বাড়িঘর ফেলে ভারতের শরণার্থী। অত্যন্ত কঠিন অবস্থায় দিনগুলো গেছে। তাই বলে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ করিনি, ওরাও খুব ভালো ছিল লেখাপড়ায়।
আল্লাহর অশেষ রহমতে দিন চলে গেছে, চলে যাচ্ছে। এক ছেলে আমার সাথেই আছে, ‘৯০ সালে এমএ পাস করেছে। কিছুদিন চাকরি করার পর এখন ব্যবসা করছে। মেয়ে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত, দু’জনেই দেশের বাইরে আছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লাহর অপার করুণা৷
বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সমস্ত ধুলো-মাটি কাদায়, চিরগৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি পরতে, গর্বিত বিজয়ের পরবর্তী আশা-নিরাশায়, সম্ভাবনার সবকিছুতেই তো তাঁরা আছেন। তাঁদের আত্মদানের কথা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটু যদি ভাবে তবেই তো তাদের আত্মদান বৃথা যাবে না। সেখানেই হয়তো কিছু সার্থকতা পাবে।
আমার স্বামী অত্যন্ত ভালোমানুষ ছিলেন। তিনি প্রায় বলতেন-‘আল্লাহর কাছে আমার জন্য দোয়া করো, রৌদ্র আমার খুব ভয় করে, আল্লাহ যেন বেহেশতের শেষ লাইনে একটু জায়গা দেন।’ আমার খুব বিশ্বাস আছে, আল্লাহ কাছে কিছু চাইলে তিনি তা পূরণ করেন-ফেরান না। আজ আমার মনে হয়—আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করেছিলেন। পেয়েছেন শহীদের দরজা।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় একদিন আমাকে বললেন, ‘আমার বড় ক্ষুধা পেয়েছে।’ আমি বললাম, ‘গোসল সেরে এসো খাবার দিচ্ছি।’ গোসল সেরে এলো, তখন তিনি বললেন, ‘এখন আর আমার ক্ষুধা নেই।’ অবাক হয়ে জানতে চাইলাম ‘কেন ক্ষুধা নেই?’ তিনি বললেন, ‘একটা পেপারওয়ালা এসেছিল, খাবারগুলো আমি তাকে দিয়েছি। খুব ক্ষুধার্ত ছিল, পেটটা এতো ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল যে ওকে দেখে আমার আর কোনো ক্ষুধা নেই।’ এমনি অসংখ্য স্মৃতির ভারে ন্যুজ হয়ে আছে আমার মন। কত ছোট ছোট মধুময় স্মৃতি… ভুলতে পারিনি, ভুলতে পারি না…বডড বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে মানসপটে।
লন টেনিস ছিল তাঁর প্রিয় খেলা। ভালো খেলতেন ফুটবলও।
হৃদয় নিংড়ানো কষ্টের কথাগুলো আজ লিখতে হচ্ছে। আজ তো সবই স্মৃতি… জগদ্দল পাথর হয়ে বুক চেপে ধরে। ডাক্তার সাহেবের মৃতদেহ বা কবরের কোনো কিছুরই চিহ্ন কোথাও পাইনি। আজ আমি বা আমাদের সন্তানেরা বাবার কবর জিয়ারত করতে পারে না; জানে না কোথায় কোন মাটির তলে মিশে আছেন তিনি? সবই তো মিশে আছে আজ আমার দীর্ঘশ্বাসে, আমার অশ্রুতে| প্রকৃতির নিয়মে দিন তবু চলে যায়…।
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
গ. প্রথম পুনর্মিলনী স্মরণিকা, আর্মি মেডিকেল কোর; প্রকাশনাঃ আর্মি মেডিকেল কোর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীঃ প্রকাশকালঃ ১৩৯৫ বাংলা, ১৯৮৯ ইংরেজী।
ঘ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৭০৭।
ঙ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট; প্রকাশনাঃ বাংলাদেশ ডাক বিভাগ; ৪র্থ পর্যায়; ১৯৯৫ ।(পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
চ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ৫ম খণ্ড, ১ম পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪০২, ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬; পৃ. ২৭।
ছ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল; প্রকাশনাঃ রক্তঋণ; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃ. ১০৮।
জ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৪৩।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ১৮১
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ