জীবনচিত্র নামঃ ডা. নরেন্দ্রনাথ ঘোষ
Dr. Narendra Nath Ghosh
ডাকনামঃ লঙ্কা
পিতার নামঃ ফটিক চন্দ্র ঘোষ
মাতার নামঃ রাধারানী
ভাইবোনের সংখ্যাঃ তিন ভাই ও চার বোন; নিজক্ৰম-পঞ্চম
ধর্মঃ হিন্দু
স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্ৰাম—মাদারজানি, ডাকঘর/উপজেলা-
ককটিয়া, জেলা-টাঙ্গাইল
শহীদ ডা. নরেন্দ্রনাথ ঘোষ
নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ সাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ
জন্মঃ ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
ম্যাট্রিকঃ প্রথম বিভাগ, ১৯৫২. এইচএম ইনস্টিটিউশন, করটিয়া, টাঙ্গাইল
আইএসসিঃ প্রথম বিভাগ, ১৯৫৪, সাদত কলেজ, করটিয়া, টাঙ্গাইল
বিএসসিঃ ১৯৫৬, সাদত কলেজ, করটিয়া, টাঙ্গাইল
এমবিবিএসঃ ১৯৬৪, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
শখঃ খেলাধুলা(ফুটবল), গান, নৃত্য, আবৃত্তি
চাকরির বর্ণনা (সরকারি)
মেডিকেল অফিসারঃ ঈশ্বরগঞ্জ থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ময়মনসিংহ, ১৯৬৯
মেডিকেল অফিসারঃ সাটুরিয়া থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মানিকগঞ্জ, ১৯৭০
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ রাজাকার-আলবদর সহযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী
নিহত হওয়ার তারিখঃ ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
মরদেহঃ পাওয়া যায়নি।
স্মৃতিফলক, স্মৃতিসৌধঃ বি.এম.এ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি
সন্তান-সন্ততিঃ এক পুত্র ও তিন কন্যা
সংগীত আহমেদঃ এইচএসসি, ঢাকা জিপিওতে কর্মরত
জাবেদ জাহাঙ্গীরঃ বিকম, ব্যাবসায়ী
রেহানা আহমেদঃ এমএ, গৃহিণী
জেসমিন আহমেদঃ বিএ, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে কর্মরত
তথ্য প্রদানকারী
সংগীতা আহমেদ
শহীদ চিকিৎসকের কন্যা
এফ-২/১৪, টি এন্ড টি কলোনি,
মতিঝিল, ঢাকা
১৭২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
আমার স্বামী
শহীদ ডা. নরেন্দ্রনাথ ঘোষ
মিনতী ঘোষ
প্রায় সাড়ে তিন দশক পর সেই স্মৃতিকথা লিখতে বসে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কলম এগোতে চায় না। কী হবে লিখে? নতুন করে আবার মনের গহন থেকে দুঃখ উস্কে তুলে কী লাভ? তার চেয়ে এই ভালো, আমার দুঃখ আমার হয়েই থাক। কিন্তু আমার স্বামী তো দেশের মঙ্গল চেয়ে মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নিরুদ্বেগে। স্বাধীনতার জন্য তাঁর আত্মাহুতি তাই নতুন প্রজন্মকে জানানো উচিত।
আমার শহীদ স্বামীর নাম ডা. নরেন্দ্রনাথ ঘোষ। সাধারণ্যে ‘ডা. নরেন’ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন।
১৯৩৬ সালে করটিয়া, টাঙ্গাইলের মাদারজনি গ্রামে তার জন্ম। তার পিতার নাম স্বর্গীয় ফটিক চন্দ্র ঘোষ। তিনি তার পুত্রের মৃত্যুর পরও জীবিত ছিলেন কিছুকাল। ব্যক্তিজীবনে তিনি যেমন ছিলেন অমায়িক ও মৃদুভাষী, পারিবারিক জীবনেও ছিলেন শান্ত, ভদ্র ও আন্তরিক। তার দর্শন ছিল ‘Simple living and high thinking?’ সবসময় বাহুল্য ও চাকচিক্য বর্জন করে চলতেন তিনি। সম্পদের লোভ তার কখনোই ছিল না। যা আয় করতেন গরিব রোগীদের চিকিৎসা-শুশ্রুষায় তা অকাতরে ব্যয় করে দিতেন। ফুটবল খেলা ছিল তার প্রিয় খেলা। ভালো গানও গাইতে পারতেন আমার স্বামী। নৃত্যকলায়ও তার দখল ছিল। খুব সুন্দর আবৃত্তি করতে পারতেন তিনি। ডা. নরেন্দ্রনাথের শিক্ষাজীবন শুরু হয় তার নিজ গ্রামে। ১৯৫২ সালে করটিয়া এইচএম ইনস্টিটিউশন থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৪ সালে করটিয়া সাদত কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫৬ সালে বিএসসি পাস করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি এমবিবিএস পাস করে ১৯৬৮ সালে ক্যান্সারের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেন।
দীর্ঘ পাকিস্তানি শাসনকালে বাঙালি জাতির ওপর পশ্চিমাদের শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ ও প্রতিকার আকাঙ্ক্ষার প্রতি তিনি বরাবরই ছিলেন সহানুভূতিশীল। একাত্তরে সশস্ত্ৰ মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি মানিকগঞ্জ জেলার
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ১৭৩
শহীদ ডা. নরেন্দ্রনাথ ঘোষ
সাটুরিয়া উপজেলার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। এ সময় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও নানা প্রকার সাহায্য দিয়ে ডা. নরেন্দ্রনাথ ঘোষ শক্ৰদের টার্গেটে পরিণত হন। পুরো যুদ্ধকালে তাকে একটি রাতের জন্যও আমি কাছে পাইনি। সারাদিন অফিসে কাজ করে কোনো বিশ্রাম না নিয়ে চলে যেতেন মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানায়। সেখানেও তিনি চিকিৎসকের হাত দিয়ে যুদ্ধ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। ভোর রাতে ক্লান্ত হয়ে ফিরতেন আহত মুক্তিসেনাদের সেবা-শুশ্রুষা করে। কখনো জিগ্যেস করলে বলতেন, ‘মায়ের জন্য কিছু করে যাই।’ হায়! দেশ প্রেমই তার কাল হলো। মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করার অপরাধে ’৭১-এর ১১ সেপ্টেম্বর সাটুরিয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে স্থানীয় কতিপয় রাজাকার ও আলবদরের সহায়তায় পাকবাহিনীর সদস্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।
হিন্দু আইনে পিতার জীবদ্দশায় সন্তান নিহত হলে সম্পত্তি পাওয়া যায় না। তাই শহীদ ডা. নরেন্দ্রনাথ ঘোষের পৈতৃক বিপুল সম্পত্তি থাকলেও আমরা তার কিছুই পাইনি। গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে চারটি সন্তান নিয়ে আমাকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। কারো কোনো সহায়তা কখনো মেলেনি।
মুক্তিযুদ্ধ আমার পরিবারের সবচেয়ে বড় সম্পদটিকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ‘মুক্ত’ বাংলাদেশ আমাদের অবহেলা আর বঞ্চনা ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। আমার স্বামীর ঘাতকরাই আজ সদৰ্পে সবখানে বহাল-তবিয়াতে সমাসীন।
এই ঘাতকদের কোনো বিচার হয়নি। কার কাছে আমি বিচার চাইবো? কে আমাদের প্রশ্নের জবাব দেবে? আমার স্বামীর ঘাতকরাই আজ সদর্পে সবখানে বহাল-তবিয়তে সমাসীন।
(*রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ১৯৭১ থেকে সঙ্কলিত)
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৭০৭ ।
ঘ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ৫ম খণ্ড, ১ম পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪০৭, ডিসেম্বর ২০০০; পৃ. ৩২ ।
ঙ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল; প্রকাশনাঃ রক্তঋণ; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃ. ৭২
চ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৪৩।
ছ. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান; সম্পাদনাঃ এ এস এম সামছুল আরেফিন, প্রকাশনাঃ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড; প্রকাশকালঃ ১৯৯৫; পৃ. ৫৪৬।
১৭৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ