You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971 | বাংলাদেশ সরকারের জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের সদস্য কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আবেদন | পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম                    সুত্র            তারিখ
বাংলাদেশ সরকারের জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের সদস্য কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আবেদন পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়          ——————– ১৯৭১

 

বাংলাদেশেকে স্বীকৃতিপ্রদান
বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রশ্ন

রচনায়,
সিরাজুল হক
এ্যাডভকেট, সুপ্রিম কোর্ট।
সদস্যঃ জাতীয় পরিষদ, বাংলাদেশ
………………

একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি

জন্ম সবসময়ই একটি কষ্টকর প্রক্রিয়া। ৫৫ হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বসবাসকারী সাড়ে ৭ কোটি মানুষ ধ্বংস ও মৃত্যু যন্ত্রনা সয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। সম্ভবত পৃথিবীর আর কোন জাতি এত বড় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার মত অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়নি। যদি দুর্ভোগ ও ত্যাগ একটি জাতির জন্মের পুর্ব শর্ত হয়, বাংলাদেশ নিঃশর্তে শহিদ ও নিরীহ মানুষের রক্তে রঞ্জিত একটি নতুন ইতিহাস রচনা করেছে।
বাঙালিদের সংগ্রাম কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়- এটা একটি দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে চলা সংগ্রাম।দুর্ভাগ্যবসত, এই হতভাগ্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে স্বাধীনতা ও ন্যায়ের জন্য লড়াই করেছে এবং এর ফলে তারা কিছু মানুষের রোষানলে পরে।, এরা ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত ভারতের শেষ গভর্নর-লর্ড মাউন্টব্যাটন, যিনি দেশভাগের খেলায় কলকাঠি নেড়েছেন, তার একটি রাজনৈতিক সমঝতার মাধ্যমে একত্রিত হয়েছিল। কিন্তু একটি অংশের মানুষের অসহিষ্ণুতা এবং রাজনীতিবিদদের একগুয়েমি ঘৃণা ও শোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কড়ে জনগণকে একটি রাজনৈতিক সমঝতায় আসতে বাধ্য করে যাকে, একটি ‘ভৌগোলিক ধর্ষণ’ বলা যায়।
এটা সত্যি যে, অনিচ্ছা সত্তেও ভারতীয় মুসলমানরা একটি আদর্শ ও ন্যায় সংগত “স্থায়ী বাসস্থান ও নতুন সুযোগের আশায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু আদর্শ ও বাস্তবতার মধ্যে সর্বদাই বিস্তর ফারাক থাকে। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে এই দ্বন্দের আয়ুষ্কাল জানা যায়। এর শেকড় ছিল পাকিস্তানের দুটি অংশের সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ঐতিহ্যগত পার্থক্যের গভীরে। এই পার্থক্য গুলো ধর্মের নামে নয় বরং ধর্মকে ব্যবহারকরা হয়েছিল। এই পরীক্ষা মানুষের জীবনের প্রেক্ষিতে ব্যয়বহুল ছিল।পরবর্তিতে এটি একটি গভীর দুঃখজনক কাহিনীতে পরিনত হয়। তবুও বাংলাদেশের মানুষ কোন শক্তি ব্যবহার করেনি, তাদের থেকে প্রকৃতিগত ভাবে আলাদা অংশীদারদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করেছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সব দিক থেকেই, কিন্তু তারা কোন কারন খুঁজে পায়নি। তারা ইসলামের উচ্চতর মতবাদের তোয়াক্কা করে না, আমার মতে যেটার ভিত্তি ন্যায়েরনীতি ও যেকোন মুল্যে শান্তি।

এই সকল ঔপনিবেশিক মানসিকতা সম্পন্ন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্টি একগুঁয়ে ভাবে ধর্মের রক্তাক্ত দিকগুলো আকড়ে ছিল এবং কখনো পৃথিবীর অন্য কোন ধর্মের মুলমন্ত্রকে সাধুবাদ জানায়নি। পশ্চিমা শাসকরা নিজেদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে অধার্মিক, ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ এবং সভ্য জীবনের যেকোন উচ্চতর আদর্শ সম্পর্কে অচেতন হিসেবে প্রমান করেছে। এটা বলতে আমার কোন দ্বিধা নাই যে, যারা স্বাধীনতার আওয়াজকে অবদমন করার জন্য রক্ত ঝরাতে কোন ভেদাভেদ করে না তারা নিজেদের ধর্মহীন বলতে পারে, কিন্তু নিজেদেরকে মুসলিম বলার কোন অধিকার তাদের নেই।
এটা একটা নির্মম পরিহাস যে, যে কবি পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করেননি। ১৯৩০ সালের ডিসেম্বরে, এলাহাবাদের মুসলিম লীগের অধিবেশনে স্যার মোহাম্মদ ইকবাল এমন ভৌগোলিক বিভক্তির কথা কল্পনাও করতে পারেনন। তার প্রস্তাব গুলো ছিল এমনঃ
“আমি পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সিন্ধু এবং বেলুচিস্তানকে একটি একক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই”।
পাকিস্তান নামটি ১৯৩০ সালে জনাব রহমত আলী নামে ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র একটি লিফলেটে প্রথম উল্লেখ করেন, তিনিও বাংলাকে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করেননি।
১৯৩৩ সালে লন্ডনে যৌথ সাংসদীয় কমিটির এক অধিবেশনে গোলটেবিল বৈঠকে রেজিনাল কারডক্স ইউসুফ আলীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় মুসলিম প্রতিনিধি দলকে পাকিস্তানের নকশা সম্পর্কে মতামত দিতে বলেন। তাঁর উত্তর ছিল “এটা একটা ছাত্রের নকশা এবং এতে কিছুই নেই” তিনি আরো বলেন “আমাদের মতে এটা কাল্পনিক ও অবাস্তব”। তাহলে পাকিস্তানের সৃষ্টি হল কিসের ভিত্তিতে? এটা হল ১৯৪০ সালের বিখ্যাত লাহর রেজলিউশন যা সর্ব প্রথম নতুন রাষ্ট্রের ইংগিত দেয়। এটা নিম্ন উদ্ধৃত ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হয়।
“মুসলিমদের কাছে গ্রহনযোগ্য কোন সাংবিধানিক পরিকল্পনা এই দেশে কার্যকর হবে না যদি সেটা নিম্নলিখিত নীতির ভিত্তিতে না হয়।ভৌগোলিক ভাবে বহমান উপাদানগুলো যে অঞ্চলের সীমানায় পরবে সেখানকার অংশ হবে, এই রকম স্থানিক পুনর্বিন্যাসের সাথে সাথে ভারতের উত্তর পশ্চিম ও পুর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ এলাকা গুলোকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য একত্রিত করার প্রয়োজন হতে পারে যেখানে সাংবিধানিক একক গুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত এবং সার্বভৌম”।
এই রেজলিউশনের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, এর যথার্থতা যাই হোক না কেন, এতে “দুইটি সার্বভৌম রাষ্ট্র” কল্পনা করা হয়েছে। এখন আমরা কি বলতে পারি যে জনাব জিন্নাহ “সার্বভৌম” শব্দটার বা “রাষ্ট্র” ও “একক” শব্দের পরে বহুবচনের অর্থ জানেন না। এটা খুবই অসার যুক্তি। ১৯৪৭ সালের ৩রা জুনে, জনাব নেহেরু এক বেতারবার্তায় নিম্নলিখিত ভাষায় পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহন করেন।
“কয়েক প্রজন্ম ধরে আমরা একটি স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বপ্ন দেখেছি, নির্দিষ্ট কিছু এলাকাকে আলাদা করার প্রস্তাবে, যদি সেটা করতেই হয় তো সেটা স্থির করা আমাদের যে কারো জন্য অত্যন্ত কষ্টকর। যাইহোক, আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের বর্তমান সিদ্ধান্ত বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক”।
আমি এই আইনি দলিল গুলো শুধুমাত্র বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষনের জন্য উল্লেখ করছি, এটা দেখানোর জন্য যে পাকিস্তানের অস্তিত্ব উল্লেখ করা প্রকৃত দলিলে দুইটি সার্বভৌম রাষ্ট্র বিবেচনা করা হয়েছে।
জনগণের অনুমোদন এবং রায় দুইটিই ছিল পৃথক রাজ্যের পক্ষে।ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বাংলাদেশের জন্ম কোনো অভিনব ঘটনা নয়।
লাহোর প্রস্তাব হতে বিচ্যুতিহলো সকল নষ্টের গোঁড়া। ধর্ম এবং তথাকথিত জাতীয়তাবাদের নামে সাড়ে সাতকোটি মানুষ পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা অদৃশ্য নিপীড়ন, ঔপিনিবেশিক শোষণ এবং অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হয়েছিল।যেটা আগেই বলেছি, বাংলাদেশের জনগণ সর্বোচ্চ ত্যাগ শিকার করেছে, আর এই ত্যাগ তারা শিকার করেছে ভিন্ন প্রদেশবাসী বন্ধুদের এই কথা বুঝাতে যে,শুধু মাত্র ধর্ম দুইটি ভিন্ন জাতিস্বত্তাকে একসাথে বেঁধে রাখতে পারে না।বিচ্ছিন্ন দুইটি অংশকে সঠিক পথে রাখতে ন্যায়, সমতা, স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একতার প্রয়োজন।
তাদের দাবি ছিল সংযুক্ত পাকিস্তানের প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে ধর্ম।তাহলে দেখা যাক পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালীদের প্রতি কতটা ধর্ম সংগঠিতভাবে ইসলামী আইন প্রয়োগ করেছে।তথ্য উপাত্ত নিজেরাই কথা বলবে।
স্টিফেন আর. লুইস (Pakistan Industrialization and trade policies. London 1970. PP.142-3) ১৯৫০ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সময়কালে আমদানিকৃত নিত্য পণ্যের ভেতর পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ ছিল ৩০.৫ শতাংশ (সর্বোচ্চ)। যেখানে রপ্তানিতে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ ছিল ৬১.৪ শতাংশ।
এইভাবে উপার্জিত বিদেশী অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নে ব্যবহার হয়েছে আর উৎপাদিত পণ্য পূর্ব পাকিস্তানের সংরক্ষিত বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। শুধুমাত্র ৫০ কোটি টাকার বস্ত্রই প্রতি বছর পূর্ব পাকিস্তানে বিক্রি করা হয়েছে। এইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্ত উপহার ঔপনেবেশিক ধাঁছের অর্থনীতি। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৬৫-১৯৬৮) উন্নয়ন বরাদ্দের মাত্র ৩৭ ভাগ জুটেছে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে। বিদেশী সাহায্যের মাত্র ২০ ভাগ ব্যয়িত হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে, বাকী ৮০ ভাগ চলে গেছে পশ্চিম পাকিস্তানের ঘরে।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনী মাত্র ৫ শতাংশ অফিসার পূর্ব পাকিস্তানি। নৌ বাহিনীতে এই হার ১৯ শতাংশ এবং প্রকৌশল ক্যাডারে ৯ শতাংশ এবং নৌবাহিনীর‍্যাংকিং এ মাত্র ২৮.৫ শতাংশ। বিমান বাহিনীর মাত্র ১১ শতাংশ পাইলট বাঙালী। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত মেজর জেনারেল খেতাব পাওয়া ৫০ জন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র একজন বাঙালী।
সরকারী অর্থিনীতিবিদদের হিসাব অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের ২০টি পরিবার শিল্প সম্পত্তির ৬৬ শতাংশ, বীমা ৭০ শতাংশ এবিং ব্যাংক পুঁজির ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
বর্তমান দ্বন্দ্বের এই পটভূমি রাজনৈতিক ক্ষেত্রের দিকে নজর দিলে দেখা যায় ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত পাকিস্থানি শাসকেরা বাঙালীকে শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন থেকে বিরত রাখার জন্য ক্রমাগত দূরবীসন্ধি মূলক পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।১৯৬৮ পর্যন্ত সিভিল সার্ভিসে পূর্ব পাকিস্থানিদের প্রতিনিধি ছিল মাত্র ৩৬ শতাংশ। পাকিস্থান গঠনের প্রথম দিনটি থেকেই পশ্চিম পাকিস্থানি শাসকেরা ক্ষমতাকেন্দ্র নিজেদের উক্ষীণত রাখার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পরে। আর তাদের সাথে যোগ দেয় কিছু সংখ্যক ধনী ব্যক্তি যাদের উদ্দেশ্য ছিল একই। দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হয়ে পরে। ধনীরা তাদের সম্পদ আরো বাড়াতে থাকে। প্রতিবাদী প্রতিটি কণ্ঠের গায়ে বিশ্বাসঘাতকতার তাকমা এঁটে দেওয়া হয়। এমনকী মুষ্টিমেয় লাভের জন্য আইনকেও বিকৃত করা হয়। সংক্ষেপে পাকিস্থানের ইতিহাস হলো ধর্ম এবং জাতীয়তার বর্ববরতার ছদ্মবেশে ইতিহাস।
পশ্চিম পাকিস্থানের শাসকদের কাছে পাকিস্থানের বিপুল জনগণকে বোকা বানানোর এই দুইটি বিষয় চমৎকার হয়ে উঠে কারন ধর্মের নামে পাকিস্তানি জনগণকে যেকোনো অযৌক্তিক প্রস্তাব’ই গেলানো সম্ভব ছিল।শাসকগোষ্ঠী যে একমাত্র বৈরীতার মুখোমুখী হয়েছিল তা হল, স্বীকৃত মধ্যবিত্ত এবং ছাত্র সমাজের চেতনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া।
১৯৫২ সালের শুরুর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালী ভাষার উপর প্রথম আঘাত হানে এবং ক্রমান্বয়ে বাঙালী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পদদলিত করার পদক্ষেপ নেয়। একমাত্র শহীদের রক্ত ঝরার পরেই বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষাগুলোর মধ্যে একটি বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সামনে দীর্ঘ সংগ্রাম রয়েছে এই চেতনা বাঙালীদের অলোড়িত করে।
১৯৫৪ নির্বাচন করাচির শাসকদের নাস্তানাবুদ করেছিল, কিন্তু শীঘ’ই পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণের ন্যায দাবী আদায়কে সহজ করার জন্য বাংলায় কেন্দ্রীয় সরকার হতে আইন জারি করা হয়। ১৯৫৬ সালে একটি সংবিধান প্রণীত হয় কিন্তু এর বিষয় সমূহ পুরোপুরি প্রযুক্ত হওয়ায় আগেই এক নায়কতন্ত্রের কালহ জাতির গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনতাই করে। এটি শুধুমাত্র জেনারেল আইয়ুব কর্তৃক ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে একটি অভ্যুত্থান ছিল না, বরং এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনৈবেশিক বজায় রাখা এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরাধীনতা নিশ্চিত করার পথ। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত পশ্চিমা শাসকদের মধ্যমণি আইয়ূব গণতন্ত্রের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলে ছিলেন এবং নিজের সংজ্ঞায়িত গণতন্ত্র বহাল করেছিলেন। এটি ছিল একটি নতুন পদ্ধতি যাতে গণতন্ত্রের ছদ্ম পরিচয়ে একদল নির্বাচিত বেঈমান দ্বারা শাসন করার প্রক্রিয়া। দশ বছর ধরে এই পদ্ধতির ধারাবাহিকতায় মানুষের জীবনে নেমে আসে তা হল দূর্নীতি, ঘুস, এবং স্বজনপ্রীতি। সমগ্র জাতি এক নায়কের পদতলে ধুঁকছিল। মানুষের এই ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয় যখন তাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশদ্রোহী মামলায় (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়) অভিযুক্ত করা হয়। এক নায়ক মঞ্চ থেকে বিদায় নেয় কিন্তুক্ষমতা দিয়ে যায় তারই সুযোগ্য এবং ধূর্ত অধিকারী জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে।নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার ঘোষণার মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেন। তার উদ্দেশ্য তার পূর্বসুরীর চাইতে ভিন্ন কিছু ছিল না, কিন্তু তিনি নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করেন।এই পদ্ধতি ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জুড়ে দিয়ে ঔপনৈবেশিক শাসনকে দৃঢ় করা, কিন্তু এই অশুভ উদ্দেশ্যের ব্যাপারে বাঙালীর সচেতনতা রাওয়াল পিন্ডির পরিকল্পনার চাইতে কার্যকারী উপমাণিত হয়।তারা প্রবল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে তাদের নেতা শেখ মুজিবের সাথে দৃঢ় অবস্থানে দাঁড়ায় এবং তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করে। এতে থলের বিড়াল বেড়িয়ে পরে। এই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের ধীর্ঘ পরিকল্পিত মার্চ মাসের ঘটনাবলি এগিয়ে আসে।ইয়িহিয়া পোষা হিংস্র জানোয়ারদের শিকল খুলে দেওয়া হয় যাতে তারা সমগ্র বাঙালী জাতিকে নিশ্চিন্ন করে দিতে পারে।পাকিস্তানের মৃত্যু ঘন্টা বেজে উঠে।ছাত্রদের হত্যা করা হয়, নারীরা ধর্ষিত হয়, শিশুদের অঙ্গচ্ছেদ করা হয়। এই সবই করা হয় একটি জাগ্রত জাতির আত্মাকে হত্যা করার জন্য। বাঙালী প্রথমটায় স্থম্ভিত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু অল্প বিরোতিতেই তারা উজ্জীবিত হয়ে উঠে। সমগ্র জাতি এক মন, এক আত্মায় পরিণত হয়। অতীতকে ভেঙ্গে ফেলার লক্ষ্যে এবং অগ্রসীদের কালো হাত ভেঙ্গে দিতে। এইভাবে জন্ম নেয় একটি জাতি, একটি দেশ “স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ”। বাংলার মাটি থেকে যেন গজিয়ে উঠে এক মুক্তিবাহিনীর অঙ্কুর এবং দ্রুত পরিপত হয় শক্তির মহিরোহে। পাকিস্তানের শাসকেরা যারা আমেরিকান শাসকদের কাছ থেকে সমর্থন এবং চীনা মিত্রদের কাছ থেকে সাহায্যের আশ্বাস পাচ্ছিল তাদের কাছে আস্তে আস্তে ভবিষ্যৎ পরিষ্কার হতে শুরু করে। নিজেদের পিঠ বাঁচাতে তারা ভয়ঙ্ক্রর সব পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে কিন্তু তাদের পরাজয় ছিল কাছেই এমনকী তাদের ছায়ার চাইতেও কাছাকাছি।
বাঙালীরা তখন জাতি হিসেবে বিশ্ব বিবেকের কাছে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন
হয়ে উঠেছিল।
আমরা কী তোমাদের কাছ থেকে স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্তির যোগ্য?
স্বীকৃতির ব্যাপারে এই প্রশ্ন শুধুমাত্র কোনো আইনি প্রশ্ন ছিল না , ছিল বৈধতার চাইতে ও এখানে রাজনীতি এবং নৈতিকতায়। এটা সত্য য্য, এই প্রশ্নকে নির্ধারিত করার ব্যাপারে কিছু প্রতিষ্ঠিত এবং গৃহীত মানদন্ড আছে। কিন্তু এই সবই ছিল যে দেশ স্বীকৃতি দিচ্ছে তাদের আলোকিত জাতীয় স্বার্থে বিবেচনার বিষয়।
স্বীকৃতি দেবার উত্তম নিয়ম হচ্ছে উদীয়মান রাষ্ট্রের সরকার এর প্রতি যৌক্তিক প্রত্যাশিত স্থায়িত্বের সাথে সুনির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বাভাবিক আনুগত্য থাকা।দ্বিতীয়ত স্বীকৃতির দাবি অবৈধ হবে না এবং শেষত রাষ্ট্রের ঘোষিত নীতি ও আদর্শগুলো প্রাকৃতিক আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যা ন্যায়বিচার ও মুক্তির মূলনীতিগুলোকে প্রকাশ করে।
উপরে উল্লেখিত স্বীকৃতির যৌক্তিকতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের ঘটনা বিচার করলে এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে বাংলাদেশের সরকার কোন কল্পকাহিনী নয় বরং বাস্তবতা যা হাতে গোণা যাবে এমন কিছু বিশ্বাসঘাতক বাদে সমগ্র ৭.৫ কোটির জনগোষ্ঠীদ্বারা সমর্থিত।জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকারের প্রতি স্বাভাবিকভাবে শুধুমাত্র আনুগত্যই প্রকাশ করেছেন না বরং তাদের সরকারকে রক্ষায় ন্যায্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।তারা সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবৈশিকতার বর্বর শক্তির বিরুদ্ধে তাদের জীবন উৎসর্গ করছেন স্বাধীনতার জন্য।দুর্বল জনগোষ্ঠীর উপর শক্তি প্রয়োগের সাথে রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,সামাজিক এবং সাংস্কৃতি কে জড়িত করে শাসন চাপিয়ে দেয়াটাই সাম্রাজ্যবাদের গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা এবং বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণ পশ্চিম পাঞ্জাবের ছোট প্রদেশের পশ্চিমা শাসকদের এইসব ঔপনিবৈশিক ও সাম্রাজ্যবাদী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সবথেকে বেদনাদায়ক সংগ্রামের মধ্যে একটিতে রত।
যদি কোন বিশেষ সরকার স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে পাওয়া জনগণের ক্ষমতা অগ্রাহ্য করে এবং ঐ ক্ষমতা প্রদেশগুলোকে আরো বেশী স্বায়ত্বশাসন প্রদান করে শুধুমাত্র এই কারণে অত্যাচার,মৃত্যু এবং ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে সেই ক্ষেত্রে নিরস্ত্র মানুষ কি করবে?তারা কি শোচনীয় ভাবে সেই ঘৃণ্য শক্তির কাছে আত্মসমর্পন করবে যারা মানবিক মূল্যবোধ কে,জীবনের সভ্য আদর্শ কে ধ্বংস করতে চায় এবং জনগোষ্ঠীর একটি বিশেষ অংশ যারা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দেয় তাদের নিশ্চিহ্ন করতে চায়?
জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষরকারীগন কি আমাদের বলতে পারেন যে বাঙ্গালিরা কি করবে?
আমি এই কথা বলতে পেরে গর্বিত যে বাঙ্গালিরা মৌলিক মানবাধিকারগুলোতে তাদের আস্থা পুনরায় স্থাপন করেছে এবং মানুষের মূল্য ও মর্যাদাকে তাদের নিজেদের সেই সাথে সমগ্র মানবজাতির পক্ষে রক্ষা করছে।যদি জাতিসংঘ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের হাতের পুতুল হতে চায় এবং নিরস্ত্র মানুষদের উপরে চলমান নগ্ন আগ্রাসন না দেখার ভান করে তাহলে সনদের স্বাক্ষরকারীদের একদিন ঘোষণা দিতে হবে যে জাতিসংঘ কিছুই না কিন্তু এমন অপ্রয়োজনীয় একটি সংগঠন যা কোন অর্থ ছাড়াই বড় বড় কথা বলে।
আর কতদিন জাতিসংঘ সুবিধাজনক ভাবে নিজের মুখ “আভ্যন্তরীণ এখতিয়ার” এর আড়ালে লুকিয়ে রাখবে?এটা কোন বিদ্রোহ বা সশস্ত্র বিদ্রোহের ঘটনা নয়।এই ক্ষেত্রে আইনগত ভাবে গঠিত দল গণতান্ত্রিক ভাবে জনগণদ্বারা নির্বাচিত,যারা শান্তিপূর্ন সমাধানে পৌছানোর সকল উপায় নিঃশেষ হবার পরে গণতান্ত্রিক ভাবে অশুভ শক্তির সঙ্গ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনগণকে অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক বশ্যতার থেকে রক্ষা করতে।এই বিষয়ে জনগণের মতামত প্রকাশের একটি সম্মানজনক মাধ্যম “ দ্য নিউজ উইক” এর ১২ এপ্রিল,১৯৭১ এর মতামত আমি উদ্ধৃত করছি।
“ পরিহাসের বিষয় হচ্ছে সারা বাংলাদেশে যখন মুক্তির উত্তেজনা বাড়ছিলো,তখন এই মুজিবই আবেগকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছিলেন।একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা যে সেনাবাহিনীর রোষের বিষয়ে পরিণত হবে এই বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন,মুজিব মরিয়া হয়ে এমন আপসে আসতে চাইছিলেন যা বাঙলাকে তার জনগণের দাবিকৃত স্বায়ত্বশাসন দেবে একইসাথে পাকিস্তানের জাতীয় একতার বাহ্যরুপ রক্ষা করবে যা সেনাবাহিনীর দাবিকৃত।
যেটা সেনাবাহিনীর আক্রোশ নিয়ে আসতো, মুজিব সেটা প্রাণপণে রুখতে চেয়েছিলেন যাতে করে বাংলার মানুষ যে স্বায়ত্বশাসন চেয়েছে তা যেন পায় এবং এরই সাথে সেনাবাহিনীর দাবি করা পাকিস্তানী জাতীয় ঐক্যের সাথে মিল বজায় রাখতে। পাকিস্তানের দুটি দূরবর্তী এবং অসম অংশের কোন রকমে মানিয়ে নেয়ার জন্য মুজিবই ছিল শেষ ভরসা।শেষপর্যন্ত মুজিবের চেষ্টায় পশ্চিম পাকিস্তানের অহংকার মোচন হয়েছিলো বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের যারা সৈন্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিলো এবং স্বদেশপ্রেমের এবং গতানুগতিকভাবে বাঙালীদের হীন দৃষ্টিতে দেখার শিক্ষা দিচ্ছিলো। ধ্বংস যেখানে পরিকল্পিত।জাতির ঐক্য ধ্বংস করাই একমাত্র উদ্দেশ্য।ইয়াহিয়া সাফল্যের সাথে পাকিস্তান ধ্বংস করেছে।শুধুমাত্র বাঙালীদেরই ঘৃণ্য সমাধির মূল্যবান কফিন বহন করতে হয়েছিলো।বাংলাদেশ সকল নৈতিক এবং বৈধ অধিকারে চলে আসলো যা বিশ্বকর্তৃক স্বীকৃত দেয়া হয়েছিলো।বাংলাদেশ সরকার জনগণের স্থায়িত্বের প্রত্যাশা নিশ্চিত করেছে এবং বিশ্বের অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয়েছে। বিশ্বের ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চল হয়নি তবে বাংলাদেশ খুব কষ্টকর অবস্থায় পড়বে এবং পুুনরায় সমর্থনের দাবি করবে। সংবাদ মাধ্যমগুলো বিশ্বের জনগণের মত প্রকাশের নির্দেশক যা বিখ্যাত সম্পাদকদের দ্বারা পর্যবেক্ষকের ফল ছিলো। সানডে টেলিগ্রাম (২৮ মার্চ,১৯৭১) ‘ THE VICTIMS’ নামে সম্পাদকীয় কলাম লিখে।
পূর্ব পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের পুরো ভয়বহতাটুকু পশ্চিমা মননে উপলব্ধি করাটা বেশ কঠিন ছিল। আবারো এটা মনে হচ্ছিল যে বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে যতটা উন্মত্ততা ছিল তার পুরোটাই সেই দেশের দরিদ্র আর অসহায় মানুষের উপর নেমে এসেছিল যে দেশের উত্থান হয়েছিল ১৯৪৭ এর রাজনৈতিক ধূর্ততার মাধ্যমে এবং সে দেশটি এখন ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। যাই হোক না কেন পুরনো পাকিস্তান এখন মৃত। শাসকরা অস্ত্রের তথ্য অস্বীকারের চেষ্টা করছে কিন্তু দুঃখজনকভাবে আক্রমণ ঠেকানো যায়নি।দৈনিক টেলিগ্রাফ ২৯মার্চ,’৭১ এ বলেছিলো যে,পাঞ্জাব থেকে সকল বেয়োনেট বাঙালী জাতীয়তার ভুতে সজোরে ধাক্কা দিতে পারবেনা। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এই প্রতিক্রিয়া ২৮মার্চ,১৯৭১ এ নথিভুক্ত করেছিল ,বলেছিলো ‘যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জাতির কেন্দ্রীয় নীতির জমকালো সাদৃশ্য অর্জনে সক্ষম হচ্ছে, হিংস্রতা পরিব্যাপ্ত হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে এবং নিপীড়ন দমন করার জন্য বাঙালীকে ইসলামাবাদের দিকে মোড় ঘুরানো আবশ্যক নাহলে ভাষাগত,ভৌগলিকভাবে ভিন্নতার কারণে প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে। কিছু আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞরা যুক্তি দেখাতে পারে বাংলাদেশকে পুণরায় আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় এনে স্বীকৃতি দিতে। কিন্তু আমি এমন যুক্তিকে ব্যাহত করতে পছন্দ করবো। ১৭৭৮ সালে ফ্রান্সের হঠকারী সিদ্ধান্তে আমেরিকা স্বীকৃতি পেয়েছিলো| আমেরিকা ১৯০৩ সালে পানামাকে স্বীকৃতি দিতে সম্মতি দিয়েছিলো যখন সেটা কলম্বিয়া থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো আমেরিকা শুধুমাত্র এমনিতেই স্বীকৃতি দেয়নি,যুদ্ধ করে পানামা কলম্বিয়া থেকে স্বাধীন হয়েছিলো ।

১৮৩৭ সালে মূল দেশ মেক্সিকোর আপত্তি সত্ত্বেও আমেরিকা টেক্সাসকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
U.S.S.R. এবং চীন সিহানউক সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যদিও তাদের কম্বডিয়ার ওপর সক্রিয় নিয়ন্ত্রন ছিল না।

বৈধতার প্রশ্নে চুড়ান্ত সমাপ্তির জন্য, যে কেউ ভারতের বিচারপতি জনাব এম.সি. ছাগলা যা লক্ষ্য করেছেন তার উদ্ধৃতি দিতে পারেন, আমি বিশ্বাস করি সেটা নিম্নোক্ত কারনে পরিবর্তিত হবে নাঃ

আমার মনে হয় আইনগত ও বৈধতার দিক দিয়ে বাংলাদেশ অংশের সরকার ইয়াহিয়া খানের চেয়ে বেশি ভাল অবস্থানে আছে, যেখানে শেখ, জনগণের ইচ্ছার মাধ্যমে, গণতান্ত্রিক শক্তির অধিকার দাবি করছেন। ইয়াহিয়া খানের দাবি শুধুমাত্র পাশবিক এবং সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করছে। আমাদের সরকারের (ভারতের) এই মুহুর্তে বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কোনোরকম দ্বিধা করা উচিত নয়। আমাদের এখনি একটি জোরালো এবং সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে, অন্যথায় ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না. “

আমি বিশ্বের সকলকে শুধুমাত্র বিচারপতি জনাব ছাগলার কথার পুনরাবৃত্তি করতে পারি এবং যদি আপনারা যদি আপনাদের বিবেককে ঘুমিয়ে থাকতে দেন তাহলে শুধু বলতে পারি, -যে খুব শীঘ্রই আপনারা এই পাশবিক শক্তির কাছে মাথা নত করার জন্য লজ্জিত হবেন।, যার ছাপ যেকোন সময় পৃথিবীর যেকোন জায়গায় দেখা দিতে পারে। আমি আমেরিকার মানুষের মনযোগ আকর্ষন করছি, প্রথমে তাদের নিজেদের মনে শান্তি খুঁজতে এবং তারপর চীনের দুরবর্তী উপকূলের কথা ভাবতে। শান্তি মরিচিকার মতই অলীক রয়ে যাবে, যদি চীনের শান্তি আনতে আপনি আরো রক্ত ঝরানোর জন্য নিজের বন্দুক ধার দেন। যদি আপনার বিশাল ক্ষমতা মানবতার চাবুক হয়। ইতিহাস আপনাকে ক্ষমা করবে না। যদি আপনি আপনার বিশাল রাষ্ট্রকেশুধুমাত্র কূটনৈতিক সার্থ লাভের আশায় ক্ষুদ্র স্বার্থে আটকে থাকতে দেন স্বাধীন পৃথিবীর সেরা দেশ হিসেবে আপনার ভাবমুর্তি ধুলিস্বাৎ হয়ে যাবে। একটি ছোট শিশুর ভুত দেখে পালানোর মত আপনার বন্ধুরা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। আপনি যদি এখন ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের’ আচ্ছাদনে নিজেকে আড়াল করতে চান –আপনি অনন্ত গৌরব লাভ করতে পারবেন না বরং উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের গৌরব উজ্জ্বল সংগ্রামের মর্যাদা নষ্ট করবেন।

বর্তমানে ভারতের জনগণ নিজেদের স্বার্থে ন্যায়ের পক্ষে দাড়াচ্ছে, আমরা তাদের সহানূভুতির উষ্ণতায় অভিভুত, দৃশ্যত পুর্ব থেকে প্রধানমন্ত্রীর মহৎ রক্ত সংবাদের সাথে একটু দ্রুতই সাড়া দিচ্ছিল কিন্তু তা বৈধ স্বীকৃতির প্রশ্নের সম্মুক্ষিন হয়। ভারত তার বিবেকের ভারে পঙ্গু। তাই সে নিজেও উদ্যোগ নিতে শংকিত। সে এখন অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে এবং ন্যায় ও সত্যের পথে এগুতে দ্বিধাবোধ করছে। আমি নিশ্চিত তারা দীর্ঘদিন এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকবে না এবং তিনি যেকোন সময় আমাদের স্বীকৃতি দেবেন।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো শুধুমাত্র একটি মাত্র উদ্দেশ্যে তাদের সমবেদনা দেখাবে-যা তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। যদি তারা সত্যিই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাহলে তাদেরকে এটা নিছক নীতিবাক্য শিক্ষা দাওয়া ছাড়াই রক্ষা করতে হবে। জাতিসংঘ শুধুমাত্র সেই সকল রাষ্ট্রের সংকীর্ন স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত যারা এটি প্রতিষ্ঠা করেছে। ইউ.এন.ও. এর জন্য এর থেকে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হবেনা যদি বিশ্বের বড় শক্তিগুলো এর আদর্শ রক্ষার জন্য সংগ্রাম না করে।

আমেরিকা কি জানে না যে, যখন একটি জাতি তীব্রভাবে নিজেকে এর মূল রাষ্ট্র থেকে আলাদা করতে চায় তখন অন্য কোন রাষ্ট্র তাকে সেই অসৎ ঐক্যের জন্য জোর করতে পারে না। রাজনৈতিক কৌশল একটা অস্থায়ী সমাধান হতে পারে কিন্তু তাতে ঐক্য অর্জন সম্ভব নয়।

একটি জাতির চিন্তা চেতনাই গুরুত্বপুর্ন। নীচ রাজনৈতিক ইচ্ছা পুরণ কখনই শান্তি বয়ে আনবে না এবং স্বাধীনতার কোন উদ্দেশ্যও হাসিল হবে না। একটা জাতি যখন নিজেদের আলাদা সত্তা হিসেবে অনুভব করতে পারবে, তখনি এরা সতিকারের স্বতন্ত্র জাতি গঠন করতে পারবে এবং বাকি যোগ্যতাগুলো সময়ের সাথে সাথে অর্জিত হয়ে যায়। স্বীকৃতি দাওয়ার জন্য অন্য কোন ছোটখাট বিষয়ের ওপর নির্ভর করার প্রয়োজন নেই।

নতুন রাষ্ট্রটি তাদের কি ক্ষতি করবে? আমরা কোন বিশেষ রাষ্ট্রের বিরোধি নই- সবার সাথেই বন্ধুত্বপুর্নসম্পর্ক স্থাপনে আমরা আগ্রহী।তবে অবশ্যই, , যদি তারা আমাদের সম্মানের সাথে বাঁচবার অধিকার খর্ব না করে।
স্বীকৃতির ক্ষেত্রে ভালোমন্দের একটা গভীর তাৎপর্য আছে। যদি কোন রাষ্ট্র বিশ্বাস করে যে, ইয়াহিয়া এবং তার সামরিক সরকার ঠিক কাজ করছে তাহলে তাদেরকে আমাদের স্বীকৃতি দিতে সম্মত করা কষ্টস্বাধ্য ব্যপার, কিন্তু এটা খুবই দুখঃজনক হবে যদি তারা এরপরও একটি জাতির অত্যাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে দমন করার জন্য অস্ত্র বোঝাই জাহাজ পাঠায়। যদি অন্যায় শাসনের কারনে পাকিস্তানের একটু একটু করে পতন হতে থাকে- আমেরিকা কি পারবে সেটা পুনরুদ্ধার করতে? যদি অংশীদাররাই আলাদা হয়ে যায়, তো প্রতিবেশীদের কি করার আছে? বিচ্ছেদকে বিলম্বিত করা মানে বিচ্ছেদ নিশ্চিত করা। মানুষের দুর্ভোগ এখনো এড়ানো সম্ভব যদি মহাশক্তি গুলো তাদের ঘটনা মুল্যায়নের ক্ষেত্রে বিচক্ষনতার পরিচয় দেয়। তাদের এটা মেনে নেওয়া উচিত যে, পাকিস্তানের দুইটি পক্ষের মধ্যে আর ঐক্য অর্জন সম্ভব নয়। তার কেটে গেছে। কোন কিছু দিয়েই আর ঐক্যের মিল ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। যে সুক্ষ বন্ধন বিশ্বের দুটি দুরবর্তী অংশকে বেঁধে রেখেছিল, তা ক্ষমতা নয় একসাথে বসবাসের ইচ্ছা, বহির বিশ্ব থেকে একই বিপদের আশংকা- কিন্তু যদি বিপদ নিজেদের মধ্য থেকেই উদ্গত হয় তাহলে সে আশা সহজেই ভেঙ্গে যায়। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছে। বিশ্বের সকল অস্ত্রও একসাথে থাকার এই অর্ন্তইচ্ছাকে পুনরুদ্ধার করতে পারবে না- কারন যেখানে সমুদ্রের সব পানি দিয়েও পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে রক্তের দাগ মুছে ফেলা যায় না। ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ধারনা পুরপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বাস করে যে, তাদের যুক্তি ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক আইনকে অতিক্রম করেছে- এটা বিশ্ব বিবেকের দ্বারে পৌছে গেছে এবং স্পর্শ করেছে। আমাদের উদ্দেশ্য বিবেচনার স্তরে পৌছে গেছে এবং অবিলম্বে মানবজাতির মন জয় করবে যেহেতু আমাদের শক্তির ভিত্তি সত্যে, ন্যায় এবং গণতন্ত্রের উপর আমাদের বিশ্বাস।

বিশ্বাসীদের কোন মৃত্যু নেই।যদি কেউ আমাদের ডাকে সাড়া না দেয় তাহলে আমরা একাই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাব যতক্ষন না তা অর্জিত হয়।

জয় বাংলা