You dont have javascript enabled! Please enable it!
       শিরোনাম     সূত্র      তারিখ
“বাংলাদেশ স্টিয়ারিং কমিটি” প্রচারিত একটি বিজ্ঞপ্তি বাংলাদেশ স্টিয়ারিং কমিটি লন্ডন  ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১

জরুরী বিজ্ঞপ্তি
স্বাধীন সার্বভৌম গণ-প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবীতে হাইড পার্কে গত রবিবারের জনসভা ও মিছিলকে কেন্দ্র করে যে তর্কের ঢেউ উঠেছে এবং স্টিয়ারিং কমিটি বর্তমানে যে প্রশ্নবাণের সম্মুখীন হয়েছে সে সম্বন্ধে স্টিয়ারিং কমিটির বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বলার খুব প্রয়োজন। বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর নির্দেশক্রমে স্টিয়ারিং কমিটি এ সভা ও গণমিছিলের আয়োজন করে এবং নিমন্ত্রণপত্র ও খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সমস্ত শাখা কমিটিগুলোর কাছে ঐ সভা ও শোভাযাত্রাকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলার জন্য আবেদন জানায়। বিলাতে সর্বত্র অ্যাকশন কমিটিগুলোর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং দল নিরপেক্ষভাবে সকল বাঙালির সমবেত প্রচেষ্টায় ঐ দিন হাইড পার্কে প্রচুর লোকসমাগম হয়। সভামঞ্চে স্টিয়ারিং কমিটির কাউকে না দেখে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে স্টিয়ারিং কমিটি কর্তৃক আয়োজিত জনসভা স্টিয়ারিং কমিটি পরিচালনা না করে একটা দলের উপর ছেড়ে দিল কেন? দূর-দূরান্ত থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ এই জন্যই সেদিন প্রতিবাদ করেছে, প্রকাশ্যে স্টিয়ারিং কমিটির কাছে কৈফিয়ৎ তলব করেছে এবং স্টিয়ারিং কমিটি বাধ্য হয়ে জনতার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে বলার।
ঐদিন স্টিয়ারিং কমিটি ছাড়াও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ স্বীকৃতির দাবীতে হাইড পার্কে জনসভা এবং সবশেষে গণমিছিলের বন্দোবস্ত করে। প্রথমে স্টিয়ারিং কমিটি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল। পরে যখন ঘটনাটি জানাজানি হয় তখন স্টিয়ারিং কমিটি অপর পক্ষের নেতৃবৃন্দের কাছে পৃথকভাবে তাঁদের সভা পরিচালনা না করে স্টিয়ারিং কমিটির সাথে সহযোগিতার অনুরোধ জানান। দুঃখের বিষয়, লীগের এই দলের নেতৃবৃন্দ স্টিয়ারিং কমিটির প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। এমতাবস্থায় স্টিয়ারিং কমিটি এক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়। একদিকে জনতার কাছে ওয়াদাবদ্ধ এবং খবরের কাগজের মাধ্যমে বহুল প্রচলিত জনসভা চালিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে দু’টা সভা হলে গত আট মাস ধরে প্রবাসী বাঙালি জনতা একতা ও দুর্নিবার সংগ্রামের মাধ্যমে যা কিছু অর্জন করেছে তার সবকিছু বিসর্জন দেওয়া।
লীগের নেতৃবৃন্দের কাছে স্টিয়ারিং কমিটি এই মর্মে দাবী জানায় যে, খুনী ইয়াহিয়া বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে সেদিন যখন নিরস্ত্র নরনারীর উপর বর্বর আক্রমণ করেছিল তখন ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ, সকল ভেদাভেদ দলীয় কোন্দল এবং ব্যক্তিবর্গ ত্যাগ করে প্রবাসী বাঙালিরা স্টিয়ারিং কমিটির জন্ম দিয়েছিল। দেশপ্রেম আর বিবেকের কাছে সেদিন ক্ষুদ্র স্বার্থ ও অহম পরাজয় বরণ করেছিল। স্মরণ থাকে যে, স্টিয়ারিং কমিটি অ্যাকশন কমিটিগুলোর সাহায্যে বিদেশে যে সংঘবদ্ধ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তার কাজ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। শত শত শহীদের তাজা রক্তে অর্জিত স্বাধীনতাকে বানচাল করে দেওয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন কুকুর আর বিভ্রান্ত গণচীন আজ বদ্ধপরিকর। তাছাড়া পৃথিবীর কোন বৃহৎ শক্তির কাছ থেকে আমরা এখনও কোন স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি। জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে বিরামহীন সংগ্রামের এখন বরং বেশি প্রয়োজন। যা হোক আওয়ামী লীগের এই দলটির নেতৃবৃন্দের কাছে আমাদের যুক্তিতর্ক কোন মূল্য বহন করল না। তাঁরা তাদের সংকল্পে অটল থাকলেন।
অতঃপর এই জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য স্টিয়ারিং কমিটি এক জরুরী সভায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আলোচনা করেন:
১। একই জায়গায় একই সময়ে একই উদ্দেশ্যে বাঙালিদের আলাদা দু’টো সভা ও শোভাযাত্রার ফলাফল কি দাঁড়াবে?
২। এর ফলে বৃটিশ জাতি পৃথিবীর কাছে আমাদের কি নতুন রূপ প্রকাশ পাবে?
৩। পৃথিবী কর্তৃক স্বীকৃতি পাবার আগেই বাঙালিদের মধ্যে প্রকাশ্য রাজপথে দলাদলি দেখানোর ফল কি দাঁড়াবে?
৪। বাঙালি বীরের রক্তস্রোতের মধ্যে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে বর্তমান মুহূর্তে শুধু একটা শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে তার সবকিছু জলাঞ্জলি দেওয়ার অধিকার প্রবাসী বাঙালিদের আছে কি?
উপরের বিষয়গুলো আলোচনা করা এবং সেই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার অনুরোধ জানিয়ে স্টিয়ারিং কমিটি লীগের ঐ দলটির কাছে পুনরায় আবেদন জানান। কিন্তু দলটি যে কোন মূল্যে তাদের নিজের সভা চালিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ঠিক এ সময় নিউইয়র্ক থেকে গ্রেট বৃটেনে নিযুক্ত স্বাধীন বাংলার হাই কমিশনার, বৃটেনে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের নেতা এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশ ডেলিগেশনের নেতা বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী টেলিফোন মারফৎ স্টিয়ারিং কমিটিকে জানান যে, ঐ দলটি যখন যে কোন অবস্থাতেই মিটিং করে যাবেন তখন দেশের সম্মান রক্ষার্থে এবং বাঙালি জাতি নিশ্চিত অপমান থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে স্টিয়ারিং কমিটি যেন ভিন্ন সভা না করে সকল অ্যাকশন কমিটিগুলোকে ঐ দলটির সাথে সভা ও শোভাযাত্রায় যোগ দিতে অনুরোধ করেন।
এ পরিস্থিতিতে দেশের মর্যাদাহানির সম্ভাবনা দেখে, কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে নিজেদের গভীর দায়িত্বের কথা স্মরণ করে এবং স্বাধীন বাংলার বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে স্টিয়ারিং কমিটি সমগ্র বাঙালি জনতার কাছে তাদেরকে লীগের সভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করতে অনুরোধ জানায়।
স্টিয়ারিং কমিটি ত্যাগ স্বীকার না করলে আমাদের স্বাধীনতার নতুন সূর্য সেদিন কিছুটা ম্লান হয়ে যেতো- প্রবাসী বাঙালির এতদিনের সংঘবদ্ধ দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত সবকিছুর সাফল্য মাত্র এক ঘন্টার ব্যবধানে ধ্বংস হয়ে যেতো। নিজস্ব সভা বাতিল করে স্টিয়ারিং কমিটি যে অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছেন এবং যে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও অপমান ভোগ করেছেন তার জন্য স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা দুঃখিত হন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বর্তমান অপমানের চেয়ে অনাগত ভবিষ্যতে তাদের সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে অপরাধী হতে হতো। দল, গোষ্ঠী এবং ব্যক্তির চেয়ে জাতি অনেক বড় এবং জাতির জন্য অপমানিত হলে তাতে গৌরব ছাড়া ক্ষতি নেই, একথা স্মরণ রাখা দরকার।
জয় বাংলা।
নিবেদক-
স্টিয়ারিং কমিটি, লন্ডন
ইসি ৩।
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!