You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.05 | বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘এইড বাংলাদেশ কমিটি, ইউরোপ’- এর প্রতিবেদন | বাংলাদেশ নিউজ’ - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘এইড বাংলাদেশ কমিটি, ইউরোপ’- এর প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশ নিউজ’ ৫ জুলাই, ১৯৭১

বাংলাদেশের খবর
(এইড বাংলাদেশ কমিটির অঙ্গসংগঠন, ইউরোপ)
জুলাই ৫, ১৯৭১।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
ধ্বংসযজ্ঞ, ৭ কোটি ৬০ লক্ষ বাঙালির গণতান্ত্রিক কণ্ঠকে বর্বরভাবে দমিয়ে রাখা, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা ছাত্রাবাসে ঘুমন্ত শিক্ষার্থী, প্রকৌশলী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবি, অধ্যাপক এবং নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা ইত্যাদি প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানচিত্রে উদিত হয়েছে একটি নতুন দেশ। দেশটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’, পূর্ববর্তী ‘পূর্ব পাকিস্তান’।
স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এবং এ দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম। উক্ত অনুষ্ঠানে বিশ্ব মিডিয়ার লোকজনসহ প্রায় দশ হাজার প্রত্যক্ষদর্শী উপস্থিত হয়েছিলেন। ঠিক তখন জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অধীনে কর্মরত বাহিনী বাংলাদেশের গ্রাম এবং শহরগুলোতে বোমা, মেশিনগান ইত্যাদির দ্বারা লক্ষ লক্ষ পলায়নপর শরণার্থী হত্যা করছিল। বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেয়া এবং ইতিবাচক পদক্ষেপের দ্বারা লক্ষ লক্ষ বাঙালীর দূর্দশা লাঘব করার এখনই উপযুক্ত সময়। রক্ত যদি স্বীকৃতির জন্য যথার্থ মূল্য হয়, তবে আমরা তার জন্য যথেষ্ঠ মূল্য প্রদান করেছি।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছেন এবং বাংলাদেশের ৭ কোটি ৬০ লক্ষ জনগণ তাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন।
একনায়ক ইয়াহিয়া খান ব্যালটের জবাব বুলেট দিয়ে দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন এবং জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে যুদ্ধ শুরু করেছেন। ঘুমন্ত অবস্থায় তারা আমাদের ছাত্রদের মেশিন গান দিয়ে হত্যা করেছে; অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবি, বিজ্ঞানীদেরকে তাদের ধর্ষিতা স্ত্রী, মেয়ে এবং বোনদের সামনে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের শহরগুলোতে বোমাবাজি করা হয়েছে এবং নাপাম বোমার দ্বারা গ্রামগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। পুরো বাংলাদেশ বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে যেখানে ভিড় করছে অসংখ্য শকুন এবং আমাদের প্রিয়জন ও নিকটাত্মীয়ের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো কুকুরের সংখ্যাও অগণিত।

যদি একটা ‘মাই লাই’ পুরো সভ্য দুনিয়ার ভিত নাড়িয়ে দেয় তাহলে বাংলাদেশে শত শত ‘মাই লাই’ তৈরি হওয়াকে কিভাবে অবহেলা করা যায়? আমরা মানবতা এবং গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বৈশ্বিক সম্প্রদায়কে এই পাশবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে অনুরোধ জানাচ্ছি। তাদের ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে তার অসভ্য সৈনিকদলকে অপসারণ করতে বাধ্য করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানে সকল আর্থিক এবং সামরিক সাহায্য বন্ধ করার মাধ্যমে এ অবস্থা অর্জন করা যেতে পারে। বাংলাদেশে সামরিক শক্তি ও সাহায্য নিয়ে প্রবেশ করার মাধ্যমে জনগণের ভোগান্তি কমানোর জন্য সরাসরি হস্তক্ষেপ জাতিসংঘের একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য।

বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা
বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে অনুমান করা যায় যে, বাংলাদেশের অবশিষ্ট জনবল এবং অস্ত্রাদি অত্যন্ত সাশ্রয়ী এবং বিচক্ষণভাবে ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশের সামরিক নীতি বর্তমানে শক্ত জমিনের মত। সম্মুখযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান মিলিটারির ব্যাপক গোলাবারুদসমৃদ্ধতাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে তা স্বীকৃত। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ একটি নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।
বড় বড় শহর এলাকাগুলো আক্রমণকালীন অবস্থার অতিবাহিত করেছে। আক্রমণকারীদের বর্বর হত্যাকান্ড শহরের কেন্দ্রস্থলগুলোকে কিছুটা হলেও জনশূন্য করে ফেলেছে।
অপরদিকে, কেন্দ্রীয় সরকার ভৌগোলিক এবং কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান নিয়েছে যাতে অতিসত্ত্বর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহন করা যায়।
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ এবং অপরাধকর্ম লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঘরছাড়া করেছে। এখনো পর্যন্ত প্রায় ষাট লক্ষ মানুষ গন্তব্যহীন।
দখলকৃত গ্রামগুলোতে মজুদকৃত শস্য ধ্বংস করা হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান খাদ্যসল্পতাকে চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের জনগণের মনোবল ভেঙে দেয়ার পাশাপাশি তাদের শারীরিকভাবেও দূর্বল করে ফেলতে চায়, এই ভীতি ছড়ানোর মাধ্যমে দখলদারদের সৃষ্ট গণ্ডগোল এবং ত্রাস কৃষিক্ষেত্রের সবধরণের কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করেছে।

বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য ইউরোপের বন্ধু দেশগুলো কি করেছিল?
যদি পাকিস্তান সাহায্য ক্লাবের সদস্য, ক্ষমতাসীন ব্যক্তিত্ব, সাহায্য সংস্থা আছে এমন দেশ বাংলাদেশ থেকে দ্রুত পাকিস্তানি সৈন্য অপসারণের জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিত তবে অবশ্যই বাংলাদেশের এই দূর্দশার ইতি খুব দ্রুতই টানা যেত। ভৌগোলিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের অদ্ভূত অবস্থান এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার কথা বিবেচনা করে আমরা বিশ্বকে মানবতার স্বার্থে পশ্চিম পাকিস্তানে কোন সাহায্য না দিতে অনুরোধ করলাম, যাতে তারা সেই সরঞ্জাম দিয়ে বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা না করতে পারে।

এইড বাংলাদেশ কমিটি, ইউরোপা
‘এইড বাংলাদেশ কমিটি, ইউরোপা’ অতি সম্প্রতি ‘স্কেফেন-টেলবাডেস্ট্রাট ২৫, রুরমন্ড, নেদারল্যান্ড’এ একটি প্রধান কার্যালয়ের সাথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর টেলিফোন নম্বরটি হল ০৪৭৫০-৯৭৮৭। এর নীতি হল, বাংলাদেশে চলমান বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে সমগ্র বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা এবং লক্ষ লক্ষ ভুক্তভোগী মানুষকে খাদ্য, ওষুধ, বস্ত্র, কম্বল, দুধ এবং অন্যান্য দ্রব্যাদির সরবরাহের পাশাপাশি নীতিগত সমর্থন যোগানো। এছাড়া এটি শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবীর প্রচার এবং প্রসার ঘটাচ্ছে যা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টত বোঝা যায়, নির্বাচনের সময় পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার কোন ধরনের উদ্দেশ্যই বাঙালিদের ছিলনা। যদিও পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা তাদের নিশ্চিত করেছিল, তারা পাকিস্তানের কাছ থেকে কোনরকম ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করতে পারেনা। তাদের সামনে স্বাধীনতা ঘোষণা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ খোলা ছিলনা। এছাড়া এই কমিটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পিছনে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণটিও প্রচার করছে।

সংবাদ সম্মেলনসমূহ
‘বাংলাদেশ এইড কমিটি, ইউরোপ’ বাংলাদেশে চলমান বর্তমান প্রবল পরিস্থিতি সম্পর্কে পুরো বিশ্বের মতামত এবং সংহতি প্রকাশের জন্য তিনটি সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে। সেগুলো অনুষ্ঠিত হয় ফ্রাঙ্কফুর্ট, দি হেগ এবং হার্লিনে। কমিটির এই কর্মকান্ড জার্মান রেডিও এবং টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়।

বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয় সেবা গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছিল কি?
১৬ এপ্রিল ‘বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয় সেবা’র সম্পাদক জেনেভা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে টেলিগ্রাম করেছেন। টেলিগ্রামটিতে মূলত নির্বিচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ছাত্র হত্যার দ্বারা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চক্রান্তকে নিন্দা জানানো হয়।

‘স্বাধীনতা’ হানাদার বাহিনীর উচ্ছেদ চেয়েছিল কি?
১৮ এপ্রিল লন্ডনে হয়ে যাওয়া ‘লিবারেশন’ (প্রাক্তন ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা আন্দোলন) এর বার্ষিক সভায় বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার নিন্দা জানানো হয় এবং এই যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়। বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের উচ্ছেদের বিষয়েও সেখানে একটি প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হয়।

গাফফার খান ইয়াহিয়া-ভূট্টো-কাইয়ূম গোষ্ঠীর প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন

‘আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’র ২৫০ জন শিক্ষক একটি স্মারকলিপিতে ইয়াহিয়া খান ইসলাম এবং পাকিস্তানের নামে বাংলাদেশে যা করেছেন তার প্রতি তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। ইন্দোনেশিয়া সংসদের স্পীকার এবং ‘আন্তর্জাতিক ইসলামিক সম্মেলন’ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের সংঘটিত এই পাশবিকতার নিন্দা জানিয়েছে।

বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত করা হয়েছিল হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে অবস্থিত চতুর্থ বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে (মে ১৩-১৬)। উক্ত সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে নেতৃত্ব দেন জাতীয় সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব আ সামাদ।

যুদ্ধরত বাংলাদেশ
সংস্থাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার থেকে প্রতিনিধি আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে প্রতিনিধি দলের প্রধান জনাব আ সামাদ জানালেন যে, বাংলাদেশ এখন যুদ্ধাবস্থায়। জনাব সামাদ পরিপূর্ণভাবে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা হানাদার ছাড়া আর কিছু নয়, কারণ তাদের বিশেষ কোন সমর্থনই নেই- এই বিষয়টিও পরিষ্কার করলেন।

পাশবিকতা নিন্দিত
সম্মেলনে ১২৪ টি দেশ থেকে উপস্থিত প্রায় ৮০০ সদস্য অবিসংবাদিতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া পাশবিকতা এবং গণহত্যার প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করে। ‘বিশ্ব শান্তি সংসদ’ স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের সাথে সংহতি প্রকাশ করে। সংসদটি স্বকীয়তা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগনকে ‘ল্যাম্ব্রাকিস মেডেল’ দিয়ে সম্মানিত করে।

রাষ্ট্রদূতের সফর
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব এম এ সামাদ বর্তমানে বিশ্ব পরিদর্শন করছেন। তিনি ইতোমধ্যে হাঙ্গেরির সরকারের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি পূর্ব ইউরোপিয়ান ভ্রমনের সমাপ্তি হিসেবে সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি জনাব পডগর্নির সাথে সাক্ষাত করবেন এবং এরপর তিনি যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

বৈশ্বিক মতামতে সংহতি

বিগত দুই মাস ধরে বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকা বৈশ্বিক মতামতের সংহতি প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনা করেছে যেটা বর্তমানে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের পাশবিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
দুই ইংরেজি পত্রিকা- ‘দ্যা টাইমস’ এবং ‘দ্যা গার্ডিয়ান’র বিশেষ প্রতিবেদন দেখিয়েছে যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইয়াহিয়া খানের ভিতর আলোচনা চলাকালীন ইয়াহিয়া গোপনে বাংলাদেশে যুদ্ধের সৈন্যদল এবং সরঞ্জামাদি নিয়ে আসেন। পাকিস্তান সরকার থেকে প্রতি পদক্ষেপে চাপ প্রদান করা দুই দলের ভিতর পার্থক্য স্পষ্টত প্রতীয়মান করছিল। কথার খোলাসা না করেই ইয়াহিয়া বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যরা হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর।

শরণার্থীদের দূর্দশা
সর্বশেষ প্রতিবেদন অনু্যায়ী ভারতে শরণার্থীদের ভিতর কলেরা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। শরণার্থীর সংখ্যা পঞ্চাশ লক্ষ অতিক্রম করতে চলেছে এবং ৬০,০০০ এরও বেশি লোক প্রতিদিন শরণার্থী হচ্ছে। ওষুধ দুর্লভ হয়ে পড়েছে এবং ভারতীয় সরকার সাহায্যের জন্য বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রোগাক্রান্ত এলাকায় ব্রিটিশ, ডাচ এবং জার্মান সরকার ইতোমধ্যে আর্থিক সাহায্যসহ অন্যান্য সাহায্য পাঠিয়েছে। ‘এইড বাংলাদেশ কমিটি’ রেডিও, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে জার্মানীর জনগনের কাছে সাহায্যের জন্য বিশেষভাবে আবেদন জানিয়েছে। ‘মেডিকো ইন্টারন্যাশনাল’ ইউরোপে এবং ‘সেইন্ট জন’স অ্যাম্বুলেন্স প্রিগাডো, কলকাতা’ ভারতে এর প্রতিনিধি দ্বারা পশ্চিমবঙ্গে ২৫০০০০ ডি, এম এর বেশি চিকিৎসা সাহায্য পাঠিয়েছে। এরা আরও টাকা এবং সরঞ্জাম সংগ্রহ করছে।

বাংলাদেশি সৈন্যদের প্রত্যুত্তর

সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ঝটিকা অভিজানে হারের পর পাকিস্তানী সৈন্যরা অবস্থান হারাতে শুরু করেছে। স্বাধীনতার সৈনিকরা উক্ত এলাকাগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছে, এমনকি ঢাকা বিমানবন্দরও হুমকির সম্মুখীন। পাকিস্তানি সৈন্যরা সরঞ্জাম এবং লোকবলের অভাবে খুব বাজেভাবে ভুগছে। সাধারণ লোকের সমর্থনের অভাবে তারা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাবে ভুগছে। তারা দল ধরে শহর থেকে চলে যেতে পারে এবং তাদের বহরগুলোতে স্বাধীনতাকামী গেরিলা যোদ্ধারা সাধারণ মানুষের সাহায্য নিয়ে ওঁত পাতছে।
সময় এখন বাংলাদেশের পক্ষে এবং পাকিস্তানী সৈন্যারা বাংলাদেশের ওপর হস্তক্ষেপের প্রতিদান হিসেবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ কমিটি, ইউরোপের আবেদন

আমরা সকল দেশ, বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে ভারতে বাংলাদেশী শরণার্থী এবং বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ ভুক্তভোগীদের জন্য সাহায্য পাঠানোর আহ্বান জানাই। ধারণা করা হচ্ছে যে, শুধুমাত্র শরণার্থীদের জন্যই ত্রিশ লক্ষ কলেরা প্রতিষেধক, বিশ লক্ষ টিএবিসি প্রতিষেধক, এক লক্ষ বোতল স্যালাইন, পঁচিশ হাজার মোলার ল্যাকটেট, দশ লক্ষ অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ক্যাপসুল, এক লক্ষ প্যাকেট কটন, সত্তর হাজার ফুট গজ ব্যান্ডেজ এবং দশ হাজার ডোজ ডিপথেরিয়া প্রতিষেধক সিরাম প্রয়োজন। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ অসহায়ের চিকিৎসা সাহায্য খুব বেশি প্রয়োজন। কিন্তু তাদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেয়ার জন্য আমাদের কিছু সময় প্রয়োজন। তাই মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে আমরা আমাদের কাছে টাকা-পয়সা এবং দ্রব্যাদি পাঠানোর জন্য অনুরোধ করছি যাতে করে আমরা তা পৌঁছে দিতে পারি। “আবারো আমরা মানবতার দোহাই দিয়ে অনুরোধ করছি, পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য পরিষদে যাতে কোন সাহায্য পাঠানো না হয় এবং এর দ্বারা আমরা ভুক্তভোগী বাংলাদেশকে পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার পূর্বেই বাঁচাতে পারব।”
আমরা বিভিন্ন দেশের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে চাপ দেয়ার জন্য অনুরোধ করব যাতে করে দেশটি বাংলাদেশ থেকে তার আক্রমণকারী সৈন্যদের সরিয়ে নেয়। আমরা তাদের কাছে আরও অনুরোধ করি যেন তারা অতিসত্ত্বর ‘বাংলাদেশ সরকার’কে স্বীকৃতি দেন।

এইড বাংলাদেশ কমিটি- ইউরোপ কর্তৃক ইস্যুকৃত।