You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
পাকিস্তানে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ইয়াহিয়া খানের সর্বশেষ প্রচেষ্টা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশান অফ নিউ ইংল্যান্ডের পুস্তিকা ১৪ জুলাই ১৯৭১

পাকিস্তানে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া-এর সর্বশেষ সূত্র
বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশান অফ নিউ ইংল্যান্ড
জুলাই ১৪, ১৯৭১

ক্ষমতাশীল রাষ্ট্রগুলো এবং বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে বেসামরিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করতে বাধ্য হয়েছেন । জুন ২৮, ১৯৭১-এ তার এ হাস্যকর পরিকল্পনা ঘোষিত হয়। তিনি এমন একটি প্রক্রিয়ার সূচনা করেন যার মাধ্যমে চার মাসের কাছাকাছি সময়ের মধ্যেই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে। বেসামরিকসরকারগঠিতহওয়ারপরওতা সেনা আইনের আবরণে ঢাকা থাকবে। এছাড়া, সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপারটি যেঅকার্যকর পন্থায় সরকার গঠিত হবে তা নয়, বরং যেভাবে তাকে অভিহিত করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের প্রস্তুতকৃত সংবিধানের খসড়া
এ পরিকল্পনা অনুসারে জাতীয় অ্যাসেম্বলিতে সংবিধান রচনার প্রাথমিক উদ্দেশ্যেই নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ তাদের সে অধিকার হারাবেন। বরং সংবিধান রচনায় জাতীয় ও প্রাদেশিক কার্যাবলী সূচিত হওয়ার ঘোষণায় নির্বাচিত বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন সংঘটন এবং সংবিধান রচনায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের পর তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের জন্য তাদের এ অধিকার বিলোপের কোনো অবকাশ থাকেনা। বরং তা জনগণের উপর শাসকগোষ্ঠীর নিজস্ব সংবিধান চাপিয়ে দেয়ার শামিল। এ স্বেচ্ছাচারী সংবিধান যে সেনাশাসনের অধীনে অভিষিক্ত হবে তাতে আইনত এর কোনো স্থান থাকবেনা। এ সংবিধান দীর্ঘসময়ের গ্রহণযোগ্যতে হারাবে, যে পরিণতি ঘটেছিলো প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান প্রণোদিত সংবিধানের ক্ষেত্রে। তা শুধু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে অজ্ঞতাই নয়, একই সাথে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে যেকোন কিছুর মুখোমুখি হওয়া পরিকল্পিতভাবে এড়ানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে দেশে সংনিধান প্রণয়নের এ ‘অবিচ্ছেদ্য’ অধিকার সেনা শাসকদের কে দিয়েছে?
সংবিধানের প্রকৃতি
সংবিধানের প্রকৃতি ইয়াহিয়া খানের দ্বারা নির্দেশিত হয়েছে। তার মতে, এটি প্রাদেশিক ক্ষেত্রে দৃঢ়তর স্বায়ত্বশাসন এবং একই সাথে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চিত করবে। তা একই সাথে স্ববিরোধী এবং কথার মারপ্যাঁচ হিসেবে দাঁড়ায়। ২৫ মার্চের পর থেকে এযাবৎ সেনা অভিযানের মাধ্যমে বাঙালিদের সাথে যা ঘটেছে তার পর স্বায়ত্বশাসন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এই পরিকল্পিত ও নৃশংস গণহত্যা এবং অর্থনৈতিক ধ্বস পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক জান্তার উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে।তারা বাঙালিদের নিজ জনগণ বলে মনে করে না। বরং তারা মানবসভ্যতার ইতিহাসে নজীরবিহীনভাবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে চিরকাল অবদমিত রাখতে এবং বাংলাদেশকে উপনিবেশ হিসেবেশোষণ করতে চায়।তাদের বর্তমান পরিকল্পনা তাদের এ চক্রান্ত অবশ্যই ফাঁস করে দেয়, যদিও তা শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চোখে ধূলো দেয়ার অভিপ্রেত চেষ্টা। তাতে ভারতে অবস্থানরত ছয় মিলিয়ন শরণার্থীসহ দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের জন্য কোনো সমবেদনার প্রকাশ নেই। বাঙালিদের মধ্যে আত্ববিশ্বাস ও মঙ্গলকামনা সৃষ্টির কোনো উদ্দেশ্য নেই। পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাশাসকদের কাছে এসবের কোনো প্রয়োজনই নেই। তারা বিশ্বাস করে তারা সেনাশাসনে অবদমন ও নৃশংসতার মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে। তাদের এখনো এ সত্যটি মেনে নেয়া বাকি যে তথাকথিত একতা ও সংহতির বন্ধন তারা নিজেরাই ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।

প্রত্যাশিত সহকর্মীবৃন্দ:
বর্তমান পরিকল্পনায় ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে কোন ব্যাক্তিবর্গের সহায়তা প্রত্যাশা করেন? অবশ্যই আওয়ামী লীগ নয় যারা জাতীয় অ্যাসেম্বলিতে মাত্র দুটো বাদে বাকি সব সীল অর্জন করেছে। আওয়ামী লীগ চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের যা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’ ও ‘রাষ্ট্রবিরোধী বা অপরাধ্মূলক কর্মকান্ডে’ জড়িত ছিলেন তাদের অ্যাসেম্বলিতে বসতে দেওয়া হবেনা। এছাড়া যারা এগিয়ে আসবেন তারা নিজ নিজ ক্ষমতার ভিত্তিতে অ্যাসেম্বলিতে অংশ নিতে পারবেন। নির্বাচনের মাধ্যমে আসন পূর্ণ করা হবে। এই হলো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবেচনায় দেশে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়ার অংশ।এভাবেই ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমর্থন অর্জন করতে চান। কিন্তু তিনি জানেন যে অনেক আওয়ামী সমর্থক তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসবেনা। তিনি এটাও জানেন যে গত নির্বাচনের ফলাফলের সরাসরি প্রত্যাখ্যান পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও জটিলতার সৃষ্টি করবে। এ প্রেক্ষিতে গ্রণযোগ্যতা অর্জনের জন্য জগাখিচুড়ি সূত্র নিয়ে তার প্রাণপণ চেষ্টা, যদিও তিনি পুরোপুরিভাবে বুঝতে পেরেছেন যে তার এ প্রচেষ্টা অর্থহীন।
ইয়াহিয়া খানের সামনে বিকল্পের অভাবে আমরা বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই, যা তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন। তিনি অর্থহীন কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন, শুধুমাত্র সারা বিশ্বকে শান্ত করতে। তিনি ফাঁকা আসনগুলোর জন্য ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে দেশদ্রোহী ও সমমনাদের নিয়ে অ্যাসেম্বলি গঠন করতে চান। তা আইনত, সাংবিধানিক বা নৈতিক কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবেনা। সঠিকভাবে নির্বাচিত সদস্যদের অ্যাসেম্বলিতে বসা ও অংশগ্রহণ করার অধিকার কোনোভাবেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। জাতীয় অ্যাসেম্বলিতে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য আচরণ ইয়াহিয়া খানের যোগ্যতায় মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী আচরণ সম্পর্কিত তার ধারণা সত্যবিচ্যুত। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ এর রাতে পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞের আগে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। গোটা প্রচারমাধ্যম এর সাক্ষী। এর প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমান নন, বরং ইয়াহিয়া খানই পাকিস্তানের দ্বিবিভক্তির জন্য দায়ী। অতীত ও বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে এব্যাপারে কোনোপ্রকার পুনর্বিবেচনা্ প্রশ্নের উর্ধ্বে।
পরিকল্পনার লক্ষ্য
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্পষ্টভাবেই বাঙ্গালিদের জন্য এ পরিকল্পনার অবতারণা করেননি, বরং প্রাথমিকভাবে সারা বিশ্বের সরকার এবং বিশেষত পাকিস্তানপন্থী সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর জন্য। তিনি এ আশা করেন না যে বিশ্বের ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলোর চোখে তার এ পরিকল্পনার অসারতা ধরা পড়বেনা। তিনি যা চাইছেন তা হলো ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলোর কয়েকটি ‘পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার’ কূটনীতি চালিয়ে যাওয়ার কোনো অজুহাত খুঁজে পাবে।ইয়াহিয়া খান নিজের বরাতে দাবি করেন যে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলো পাকিস্তানে সংহতি ও দৃঢ়তা রক্ষার নামে বাংলাদেশে সেনা কর্মকান্ড সাধারণভাবে অনুমোদন করেছে। সত্যিই কি তাই? বিন্দুমাত্র না। বিশ্বের প্রচারমাধ্যমগুলো একক এবং প্রশ্নাতীতভাবে এ কর্মকান্ডের নিন্দা জানিয়েছে।ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলোও নিন্দা প্রকাশের সাথে ইয়াহিয়া সরকারের জন্য এ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে জোর দিয়েছে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত ধারণা এবং রাষ্ট্রগুলোর সরকারের ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই পরিকল্পনা গত তিন মাসে ইয়াহিয়া খানের সৃষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে পারেনা। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দেশদ্রোহী ও সমমনাদের নিয়ে গড়া এ শাসনতন্ত্র বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেনা। পরিশোধনের নামে এ নারকীয়তা এখনো চলছেই।কিন্তু শাসকগোষ্ঠী খুব ভালোভাবেই জানে যে এর জন্য সাড়ে সাত কোটি মানুষের গোটা একটি জাতিকেই বিলুপ্ত করে দিতে হবে। এভাবেই পাকিস্তানি বাহিনী অবশেষে বাংলাদেশ শাসনের অধিকারের প্রশ্নে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
যাই হোক, ইয়াহিয়া খান কঠোর দমনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শাসন করতে চান। তার এই উচ্চাভিলাষের কারণ কিছু ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের নীরব সমর্থন। এটা বোধগম্য যে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলোর আরো অনেক সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সম্পূর্ণ অসমর্থনযোগ্য পরিস্থিতির দীর্ঘসূত্রীতা্র পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কূটনৈতিক সমর্থন কি ন্যায়সঙ্গত?
বাংলাদেশের জনগণ অমানুষিক দুর্দশা, আতংক, হুমকি ও নিগ্রহের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছে। সেনা আগ্রাসনের ভয়ে ছয় মিলিয়ন শরণার্থী তাদের জন্মভূমিতে ফিরতে পারছেনা। বহু স্বাধীন প্রত্যক্ষদর্শী সেনাবাহিনীকে নৃশংস ও অস্ত্রমুখী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
শরণার্থীরা তখনই ফিরে আসতে পারবে যখন তাদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি হবে, যা শুধুমাত্র সম্ভব যদি তাদের নির্বাচিত নেতৃত্ব অবিলম্বে ক্ষমতা গ্রহণ করবে এবং সেনা আগ্রাসন তুলে নেওয়া হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জনগণ তাদের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক ও গঠনমূলক কর্মকান্ডে ফিরে যাবে যদি তাদের বেছে নেয়া নেতৃত্বে গঠিত সরকার দেশ শাসন করে।
সর্বশেষ বিশ্লেষণ
কোনো এলাকায় শান্তি-শৃংখলা তখনই বজায় থাকে যদি ও কেবল যদি অনিবার্য ব্যাপারগুলো যত দ্রুত সম্ভব মেনে নেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আশা করেন যে সময়ের সাথে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে পড়বে এবং ক্ষত শুকিয়ে আসবে। বিশ্বের সরকারগুলোর সম্ভাব্য ধারণা বাংলাদেশ অবশেষে নতি স্বীকার করবে। এতো বড় মূল্য দেয়ার পর এর চেয়ে সত্যবিচ্যুত আর কিছু হতে পারেনা
সুগঠিত ও সুসজ্জিত সেনাবাহিনী তাদের অস্ত্রসীমার মধ্যে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু মানুষের মনে নয়। সশস্ত্র বাহিনীর জন্য তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ মানুষের অসহযোগিতার সাথে গেরিলা কর্মকান্ড, একই সাথে ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তু মানুষের অদৃশ্য চাপ সেনাশাসক জান্তাকে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ভেঙে পড়তে বাধ্য করবে। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো যতো দ্রুত তা বুঝতে পারবে, দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তা ততই মঙ্গলজনক হবে। ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলো কি এভাবেই মানবসভ্যতার ইতিহাসের সর্ববৃহৎ দুঃখজনক ঘটনার নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে চরম মূল্যের মধ্য দিয়ে নতুন একটি জাতির অনিবার্য উদ্ভবকে বিলম্বিত করবে?
এ ব্যাপারে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়ার জন্য এর মধ্যেই হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে।
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!