শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
“ফ্যাক্ট শীট-৯”-দেশবিদেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে প্রতিবেদন | বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটির প্রচা্র পত্র | মে, ১৯৭১ |
ঘটনার বিবরণ – ৯
বিশ্বশান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের জনগণ
৪র্থ বিশ্বশান্তি সম্মেলনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থিত ছিলো, যা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে(মে ১৩-১.৬)। আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্ব পরিচালনা করেন জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব এম এ সামাদ এবং আরো ছিলেন জাতীয় আওয়ামি পার্টির যুগ্ম সচিব জনাব দেওয়ান মাহবুব আলী; যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটির নির্বাহী সদস্য ডা: সরওয়ার আলী এবং জনাব ওয়ালী আশরাফ।
আমরা যুদ্ধবিদ্ধস্ত
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার আমন্ত্রণে, সংগঠকদের ধন্যবাদপূর্বক প্রতিনিধিদের নেতা জনাব সামাদ বর্ণনা করেন যে, তাঁর দেশ যুদ্ধবিদ্ধস্ত। নৃশংস গণহত্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং এখানে সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাস। সংবাদপত্র এবং অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে গত দেড় মাস ধরে ঘটতে থাকা গণহত্যা এবং নৃশংসতার কথা আপনারা হয়ত শুনে থাকবেন। ২৩ বছরের শোষণের ইতিহাসকে ইঙ্গিত করে আমরা আরো জানাই, “১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সর্বশেষ অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাবের মূলনীতির ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ ঔপনেশিক শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের মানুষই সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ করেছিলো। বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিলো অনেক বেশি – উল্লেখ্য খসড়াটি ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি প্রদেশ সৃষ্টির নিশ্চয়তা দেয়। স্বাধীনতা অর্জিত হয় ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে। কিন্তু সমগ্র পাকিস্তানের ক্ষমতা ন্যস্ত ছিলো কিছু সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানির হাতে। তখন থেকেই শুরু হয় শোষণ ও নিপীড়ন। বাংলাদেশ কেবলই একটি উপনিবেশে পরিণত হয়, কিন্তু এ দেশের মানুষের নিরন্তর পরিশ্রমে এখানে অঢেল পরিমাণে পাট উৎপন্ন হতো, যা ছিলো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস এবং চা ও চর্মশিল্পের পাশাপাশি পাকিস্তানের মোট আয়ের ৭০% আসতো এখান থেকে। কিন্তু এ আয়ের খুবই অল্প পরিমাণ ব্যবহৃত হতো আমাদের উন্নতির জন্য। বাংলাদেশে অবস্থানরত জনগণের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল তিনগুণ বেশি।
সর্বশেষ নির্বাচন এবং পরবর্তী ঘটনাসমূহ বর্ণনাপূর্বক তিনি বলেন, “জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনাব ভুট্টোকে সমর্থন করেন এবং সমাবেশ পিছিয়ে দেন। সমাবেশ পিছিয়ে দেয়ায় বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া ছিলো বাঁধভাঙা ও স্বতঃস্ফূর্ত এবং সারা দেশের মানুষ এ স্বেচ্ছাচারপ্রসূত কর্মকান্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। মানুষ এখন বুঝতে পারছে যে, ইয়াহিয়া কখনোই ক্ষমতা স্থানান্তর করতে চায়নি এবং গণতন্ত্রের বিদ্রুপ করেছে। তা সত্ত্বেও, শেখ মুজিব একটি রাজনৈতিক মীমাংসার পথ খুঁজছেন।
জনাব সামাদ সংক্ষেপে বর্ণনা করেন কীভাবে জেনারেল প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সে ভয়াবহ কালরাতের যখন জেনারেল ইয়াহিয়া আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করছিলেন। তিনি বলেন, “২৫ মার্চ রাত ১১টা, তখনো আলোচনা শেষ হয়নি। ইয়াহিয়া খান বিশ্বাসঘাতকতার এক নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সশস্ত্র সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো দুর্বল ও নিরস্ত্র নাগরিকদের উপর। কোন ধরণের সতর্কতা ও কারফিউ ছাড়াই ট্যাংক, মর্টার, কামান, মেশিনগান এবং রকেট ব্যবহার করে নির্বিচারে হত্যা করলো নিরপরাধ মানুষদেরকে। প্রথম দু’রাতে হত্যা করা হয়েছে অগুণিত মানুষকে। ঢাকাতেই আনুমানিক হত্যার সংখ্যা ১,০০,০০০। ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়বৃন্দ, আমি আপনাদের বর্ণনা করবো সে সব ঘটনা যাতে আপনারা তথাকথিত শান্তির জন্য রাখা এ সম্মেলনে বসে তা অনুভব করতে পারেন।”
জনাব সামাদ বলেন যে, বাঙালিরা পিছু হটেনি। “মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে খুশিমত ছড়িয়ে পড়তে দিয়েছিল স্থান ও সময় বুঝে তাদেরকে ঘিরে ধরে যুদ্ধের মাধ্যমে কোণঠাসা করে দেবার জন্য।”
জনাব সামাদ নিশ্চিত করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুধুই একটি দখলদার বাহিনীর, যাদের কোন জনসমর্থন নেই।
নৃশংসতার নিন্দা জানায় সদস্যবৃন্দ
সম্মেলনে অংশ নেয়া ১২৪টি দেশের ৮০০ জনেরও বেশি সদস্য সর্বসম্মতিক্রমে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাংলাদেশের প্রতি নৃশংসতা ও গণহত্যার তাঁদের তীব্র প্রতিবাদ জানান। বিশ্বশান্তি সংস্থা স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশিদের সাথে তাদের সংহতি প্রকাশ করে। বাংলাদেশিদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এবং আত্ম-সংকল্পের কারণে তারা বাংলাদেশিদের ল্যামব্রাকিস পদকে ভূষিত করে।
জাতীয় আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা ভাসানির একটি বাণী উক্ত সম্মেলনে পাঠানো হয়।
সফরে রাষ্ট্রদূত
জনাব এম এ সামাদ বাংলাদেশ সরকারের সফরকারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে বিশ্ব সফরে নিযুক্ত হন। তিনি হাঙ্গেরিয়ান সরকারের সদস্যদের সাথে দেখা করেন এবং বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি সোভিয়েৎ রাষ্ট্রপতি জনাব পডগোর্নির সাথে খুব শীঘ্রই মিলিত হবেন। পূর্ব ইউরোপ সফরের পর তিনি যুক্তরাজ্য সফরে আশাবাদী।
কমন’স প্রস্তাব
হাউস অব কমনস সর্বসম্মতিক্রমে ১৪ মে, ১৯৭১ তারিখে একটি প্রস্তাব পাশ করে। প্রস্তাবনায় জনাব ব্রুস ডগলাস-ম্যান এম পি বলেন, “এই হাউজ পূর্ব পাকিস্তানে ঘটতে থাকা হত্যা ও বিনাশ এবং খাদ্যঘাটতির হুমকি নিয়ে উদ্বিগ্ন। শত্রুদের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য যথাযথ সরকারের প্রভাব, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তজার্তিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর স্বীকৃতি এবং রাজনৈতিক মীমাংসা অর্জন পাকিস্তানিদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে।”
এ দুঃখজনক ঘটনার প্রকৃতি ও ব্যাপকতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ” ………. সর্বনিম্ন মৃত্যুসংখ্যা আনুমানিক ১,০০,০০০, কিন্তু অনেক মূল্যনির্ধারকের মতে তা এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে।”
বিপুল সংখ্যক শরণার্থী যারা কিনা ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে, তাদের দেখে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, “… পরিস্থিতি এমন যে, যেখানে ক্যাম্পটি স্থাপন করা হয়েছে, ভবিষ্যতে তা জনসমুদ্রে পরিণত হবে”। তিনি বলেন, “ক্যাম্পে খাবারের পরিমাণ পর্যাপ্ত কিন্তু তাতে ভারতীয় সরকারের খরচ মাথাপিছু প্রতিদিন এক টাকা।”
ভারতীয় উদ্বেগ সত্বেও, তিনি বাংলাদেশে তাঁর সফরের বর্ণনা দিয়ে বলেন, “প্রতিনিয়ত আমরা একই ঘটনা শুনে আসছি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সেনাবাহিনী গ্রামে প্রবেশ করে, যা তখন সুরক্ষিত ছিলো না, তারা পুরুষদের উপর গুলি চালায়, নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করে, অগ্নিসংযোগ করে চলে যায়”।
তিনি আরো বলেন, “হত্যা এবং ঘৃণার পরিমাণ এতোই বেশি যে অবিভক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র এখন মৃত”।
হাইড পার্কে কথা বললেন বিচারপতি চৌধুরী
সভা শেষ হবার পরদিন কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির উপদেষ্টা এবং সম্মানিত এম পি জন স্টোন হাউজ ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, হাইড পার্ক স্পিকারর্স কর্ণারে একটি সার্বজনীন মিটিংয়ের আয়োজন করলেন, যেখানে উপস্থিত ছিলো প্রায় দু’হাজার বাঙালি। মিটিংটি আয়োজন করেছিলো স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি এবং এটি ছিলো বিচারপতি চৌধুরীর প্রথম জনসম্মুখে বক্তৃতা যেখানে তিনি কমন প্রস্তাবটি বিস্তারিত বর্ণনা করেন।
বাংলাদেশ স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি কর্তৃক প্রচারকৃত ও বন্টনকৃত
৩৫ গ্যামাজেজ বিল্ডিং, ১২০ হলবর্ণ , লন্ডন, ই. সি . ১.
যোগাযোগ. ৪০৫-৫৯১৬ ( অফিস সময়)
৬৭৩-৫৭২০