তারিখ | সুত্র | শিরোনাম |
……………১৯৭১ | বাংলাদেশ সরকার, প্রচার দপ্তর | দেশবাসির প্রতি বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রীর বেতার ভাষণ |
নতুন শপথ
আমার প্রিয় দেশবাসি,
আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার মরনজয়ী সংগ্রাম ধাপে ধাপে এগিয়ে আজ এক চুড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।মুক্তিযুদ্ধের এই সাফল্যের পরিপেক্ষিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব নতুন করে বুঝে নিতে হবে।বৃহত্তর জাতিয় স্বার্থের প্রতি গভির শ্রদ্ধ্যাবোধ,প্রত্যেকটি নতুন ঘটনার প্রতি সজাগ দৃষ্টি,সচেতন মানসিকতা এবং সর্বোপরি সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে একটি সুখি ও সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে পারি।
বন্ধুগন,নানারুপ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আমাদের মুক্তি সংগ্রামে যে সাফল্য অর্জন করেছে তাতে বিশ্ববাসী বিস্মিত না হয়ে পারেনি।বঙ্গবন্ধুর অগ্নিমগ্নে দীক্ষিত বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মপ্রত্যায় এবং শৌর্যবীর্যে যে ইতিহাস সৃস্টি হয়েছে যুগে যুগে পৃথিবীর মুক্তিকামি মানুষকে তা নতুন নতুন প্রেরণা জোগাবে।মানবতা ও ন্যায়নীতি বোধে উদ্ধুদ্ধ ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা একের পর এক শত্রুঘাটি দখল করে চলেছে।
মহান ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে আর ও দুর্বার এবং বিশ্বের দরবারে আমাদের সম্মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করেছে।ভারতের এই মানবতাবাধী এবং বন্ধুসুলভ ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ এবং কৃতজ্ঞ।আমাদের আর এক প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভুটান ও আমাদের বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।তাদের কাছে ও আমরা কৃতজ্ঞ।বাংলাদেশ আজ বিশ্বে এক প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব আজ একটি বাস্তব সত্য।
সমগ্র মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে।সেখানে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক জনজীবনের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা ফিরে আসছে দ্রুত গতিতে।
তবু বন্ধুগণ,একথা সত্যি যে বর্বর হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সর্বাত্মক ক্ষতি সাধনে এখন ও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।হামলার প্রথম স্তরে তারা বাংলাদেশের অনেক শিল্প-কারখানা জ্বালিয়ে দিয়েছে কিংবা কলকব্জা করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করেছে।তারপর থেকে শহরের পর শহর ,গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে,সোনা-দানা,গরু-বাছুর লুটতরাজ করে ,তাদেরকে নিজ বাড়িঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালির জীবনে ডেকে এনেছে এক চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়।ক্ষেতে-খামারে বিষাক্ত ঔষধ ছিটিয়ে আমাদের ফসল করেছে বিনষ্ট।রাজাকার এবং চোর-ডাকাতদের লেলিয়ে দিয়ে ,দেশপ্রেমিক নাগরিকদের বাড়িঘর জবরদখল করিয়ে তারা আমাদের সমাজে বপন করতে চেয়েছিল অর্থনৈতিক বিশৃংখলার বীজ।
তারপর আমাদের শিক্ষিত এবং কর্মক্ষম ব্যক্তিদের হত্যা করে মানবিক সম্পদকে করেছে পর্যুদস্ত-আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির পথকে করেছে দুস্তর।
আজ যখন মুক্তিবাহীনি আর মিত্রবাহিনীর মার খেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে,তখন ও চালাচ্ছে এই অবাধ ধ্বংসযজ্ঞ।
এই পর্যুদস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠনের বিরাট দায়িত্ব আমাদের উপর ন্যস্ত হয়েছে।একটি নাবজাত স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে সে দায়িত্ব সুষ্টুরুপে আমাদের পালন করতেই হবে।পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক পুর্নগঠনকে প্রধান দায়িত্ব হিসাবে ধরে নিয়েই রচিত হচ্ছে আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার খসড়া।প্রত্যেক বাস্তুহারা লোক যাতে সসম্মানে ফিরে আসতে পারে এবং তার দখলকৃত সম্পত্তি ফিরে পায় তার জন্য বাংলাদেশ সরকার শ্রীগ্রই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।যে সমস্ত দুষ্কৃতিকারী অন্যের বাড়িঘর জবরদখল করেছে তাদের কঠোর শাস্তি পেতেই হবে।কেউই তাদের রক্ষা করতে পারবে না ।
যুদ্ধের কারনে অনেক নাগরিককে তাদের অস্থাবর সম্পত্তি অরিক্ষিত অবস্থা রেখে পালিয়ে যেতে হয়েছে।এইসব সম্পত্তি যদি কেউ নিজের স্বার্থে বেদখল করতে চেষ্টা করে তাকে ও কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।যদি কেউ সরলভাবে বিশ্বাস করেন যে কোন সম্পত্তি লাওয়ারিশ অবস্থায় পড়ে আছে এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে তবে তিনি যেন নিকটবর্তী থানা সেক্টর বা সাবসেক্টর অথবা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ক্ষমতা প্রদাত্ত ব্যক্তি বা কর্মচারির কাছে তা জমা দেবার ব্যবস্থা করেন।প্রকৃত মালিককে এগুলো ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা যথাসময়ে করা হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো হবে সমাজতান্ত্রিক।এ কাঠামোর ভিত্তিতে আমরা গড়ে তুলবো এমন এক সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না ।যেখানে শ্রমিক পাবে তার শ্রমের ন্যায্য মূল্য ,কৃষক পাবে তার ফসলের ন্যায্য অধিকার।অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রাচীর রুদ্ধ করবে মানুষের দক্ষতা এবং প্রতিভা বিকাশের পথ।বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যেমন প্রতিটি পরিবারের দান রয়েছে,বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে যেমনিভাবে প্রত্যেকটি সক্ষম নাগরিকের অংশ নিতে হবে,তেমনি বাংলার অর্থনৈতিক উন্নতির ফসলে ও থাকবে সমান অধিকার।এক শ্রেণীকে শোষণ করে আরেক শ্রেণী ফেঁপে উঠবে এমন অর্থনৈতিক অনাচার বাংলার মাটিতে বরদাস্ত করা হবে না ।
বন্ধুগন,মনে রাখবেন জনসম্পদই একটি দেশের সবচাইতে বড় সম্পদ।বাংলাদেশের মত দরিদ্র দস্যু –বিদ্ধস্ত দেশের পক্ষে এ উক্তি আর ও বেশি সত্য।পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের যে বিরাট কাজ শুরু হয়েছে তা সুষ্টুভাবে সম্পন্ন করতে আমাদের প্রচুর ত্যাগ তিতিক্ষা সহ্য করতে হবে।পুনর্গঠনের এই পর্যায়ে সম্মলিত শ্রমই বস্তুতঃ পুজি হিসাবে কাজ করবে।বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে জাতিয় অর্থনীতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে সম্মিলিত শ্রম একটি গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা গ্রহন করতে পারে।বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ যেমনিভাবে এতদিন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কাজ করে আসছে ঠিক তেমনিভাবে আজ প্রত্যেকটি বাঙ্গালিকে হতে হবে এক- একজন কর্মঠ পুনর্গঠক।দ্রুত এবং সুষ্টু পুনর্গঠনের পূর্বশর্ত পুর্ন নিয়ম ও শৃংখলা।
তাই মুক্তাঞ্চলে আইন শৃংখলা বজায় রেখে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যান এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের সর্বোত্তভাবে সাহায্য করুন। কর্মচারীদের কাছে আমার অনুরোধ, জাতি গঠনের এই গুরুত্বপুর্ন মুহুর্তে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট সহ্য করে আপনাদের সমস্ত সময় ও শক্তি জনগনের সেবায় নিয়োজিত করুন।মনে রাখবেন,বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ আটমাস ধরে হানাদার সৈন্যদের হাতে চরম অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করে আসছে।লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষকে নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে গ্রামে-গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে ,বিনিদ্র রজনীর কষ্ট করতে হয়েছে।এদের অভাব দুঃখ –দুর্দশার অন্ত নেই।আপনাদের পরম সুহানুভুতি এবং সমবেদনা সহকারে এদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বাংলার কৃষক শ্রমিক সবার কাছেই আমার আবেদন তারা যেন যত দ্রুত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজ নিজ কাজে যোগ দিয়ে জাতিয় সম্পদ এবং উৎপাদন বাড়িয়ে তোলেন।মিল-মালিকদের কাছে আমার অনুরোধ,যত শ্রীগ্রই সম্ভব কল কারখানা চালু করুন,যাতে শ্রমিকরা আপন কাজে যোগ দিতে পারে এবং জাতিয় সম্পদ বৃদ্ধি হতে পারে।
বন্ধুগন,জাতীয় এই গুরুত্বপুর্ন মুহুর্তে আমি মুক্তিসংগ্রামে শহীদ এবং আহত ভাইদের স্বরণ করছি।নিজের বুকের রক্তে যারা স্বাধীনতা রক্ষা করতে এগিয়ে গেলেন সেইসব হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জাতি গর্বিত।মহান ভারতের মহীয়সী দেশনেত্রী শ্রীমতি গান্ধীর নেতৃত্বে মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ যেসব বীর ভারতীয় সৈনিক বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন আমি তাঁদের গভীর শ্রদ্ধ্যার সঙ্গে স্বরণ করছি।
নানা অসুবিধার মধ্যে ও ভারতের জনগন ও সরকার আমাদের লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষকে তাঁদের মাটিতে আশ্রয় দিয়ে এবং সর্বোপরি বর্বর পাক সরকারের চরম সামরিক হুমকির মুখেও বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাচার অধিকারকে সার্থকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আমিও ভারতকে আর একবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি।এই স্বীকৃতির ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।হাতে হাত মিলিয়ে পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করে দুইটি দেশ এগিয়ে যাবে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে।
আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে নৈতিক সমর্থন যুগিয়ে এবং জাতিসংঘ বাংলাদেশের মানুষের মানবিক অধিকারের মৌলিক প্রশ্নটিকে অত্যন্ত দৃঢ়টার সাথে এবং পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে সোভিয়াত রাশিয়া আর একবার প্রমান করেছেন যে বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের মুক্তি সংগ্রামে চিরদিন তার সমর্থন ছিলো এবং থাকবে।
বিশ্বের আর ও যে সকল বন্ধুরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে সাহায্য করেছে তাদেরকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।সাথে সাথে আমি বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকে অনুরোধ করছি বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য।এ সত্যকে মেনে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসুন।পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গি-শাহী,যারা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের সাহায্য দানে বিরত থাকুন।
বন্ধুগন,গত চব্বিশ বছর ধরে অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বাঙ্গালি শুধু রক্ত দিয়ে এসেছে।কিন্তু আজ তারা রক্ত নিতে শিখেছে।জমাট বাঁধা রক্ত যেন এক একটি বুলেট।অত্যাচারে ভেংগে যাওয়া হাড়গুলো যেন ধারালো বেয়নেট।ক্রোধে আক্রোশে ফেটে পোড়েছে এতদিনের বঞ্চিত লাঞ্ছিত মানুষগুলো।মিত্রবাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা ছুটে চলছে বাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।আঘাত হানছে শত্রুর প্রতিটি ঘাঁটি উপঘাটিতে ।এ আঘাত রোধ করতে পারে এমন শক্তি পৃথিবীতে কোথাও নেই।
শত্রু তাই দিশেহারা।চরম পরাজয় তাদের সমাসন্ন।দীর্ঘ চব্বিশ বছরের অমানিশার অবসানে স্বাধীন বাংলার আকাশে দেখা যাচ্ছে সুপ্রভাতের নব আভাস।
-জয় বাংলা
গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থও বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব এম, মনসুর আলী, কর্তৃক প্রদত্ত বেতার ভাষণ ।
গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর
কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত ।
________________________