শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ | বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয় | ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ |
স্বাধীনতার সূর্যোদয়ে
দেশবাসী সংগ্রামী ভাইবোনেরা,
বাংলাদেশে দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পন করেছে।সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিসংগ্রাম আজ সাফল্যের তোরণে উপণীত হয়েছে।
গতকাল বিকেল পাঁচটা এক মিনিটে সম্মিলিত ভারতীয় সৈন্য বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর নিযুক্ত “খ” অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি তার অধীনস্থ পাকিস্তানি স্থল,বিমান ও নৌবাহিনী ,আধা সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীসহ বিনা শর্তে আত্মসমর্পন করেছেন।
পঁচিশে মার্চ বাংলাদেশের জনসাধারণের যে দুঃস্বপ্নের রাত্রী শুরু হয়েছিল,এতদিনে তার অবসান হল।বাংলাদেশে আমাদের নিজেদের কর্তৃত্ব পুর্নরুপে প্রতিষ্ঠিত হল।এত অল্প সময়ে বোধহয় আর কোন জাতির স্বাধীনতার সংগ্রাম সফল হয়নি।স্বাধীনতার জন্য এত মূল্য ও বোধহয় আর কোন জাতি দেয়নি।
আজকের বিজয়,বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়,ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বিজয়,সত্য,ন্যায় ও গনতন্রের বিজয়।
আমরা যারা আজ স্বাধীনতার সুর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছি,আসুন শ্রদ্ধ্যাপ্লুত হৃদয়ে,কৃতজ্ঞচিত্তে স্বরণ করি সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে, যারা নিজেদের উতসর্গ করেছেন সকলের জন্য।
পাকিস্তানের সামরিক চক্র চেয়েছিল বর্বর শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের জনগনকে দমন করে রাখতে।হানাদারেরা দেশের মানুষকে হত্যা করেছে,পঙ্গু করেছে,ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে,আমাদের জাতিয় সম্পদ ধ্বংস করেছে।এই দুঃসময়ে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ভারত।আর তাই পাকিস্তানি সমর নায়কদের আক্রোশ গিয়ে পোড়ে ভারতের উপর।বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তারা রূপান্তরিত করে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে।পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানি আক্রমন পতিহত করেছেন।আর পুর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলিতভাবে সংগ্রাম করে তাঁরা মাত্র বারোদিনের যুদ্ধে দখলদার সেনাদেরকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করেছেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিপর্যয় এত দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হতে পারল ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনির সর্বাধ্যক্ষ জেনারেল মানেকশার নেতৃত্বে এবং সম্মিলিত বাহিনীর অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার নিপুণ রণকৌশলে।এই দুই সেনাপতির কাছে এবং ভারতের স্থল,নৌ ও বিমানবাহিনীর কাছে আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।
আমাদের সাফল্যে এই মুহুর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধাবনিতা গভির কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে।তিনি যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও নেতাদের কাছে আমাদের ন্যায় সঙ্গত সংগ্রামের ব্যাখা দিয়েছেন এবং যেভাবে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দায়িত্ব গ্রহন করেছেন,ইতিহাসে তার নজির নেই। আমাদের সংগ্রামের ফলে ভারতের জনসাধারণের যে বিপুল ভার বহন করতে হয়েছে সে বিষয়ে ও আমরা সচেতন।তাদের এই কষ্ট স্বীকার সার্থক হয়েছে। শরণার্থীরা এখন মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যেকে নিজের ঘরে ফিরে আসবেন।
আমাদের সংগ্রামের প্রতি দৃড়তাপুর্ন সমর্থন দানের জন্য বাংলাদেশের মানুষ সোভিয়াত ইউনিয়নের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।পোল্যান্ড এবং অন্য যেসব দেশ আমাদের ন্যায্য সংগ্রামকে সমর্থন করেছে,তাদের কাছে ও আমরা কৃতজ্ঞ।
আমরা একথা ও ভুলিনি যে,পৃথিবীর বিভিন দেশের জনগন,সংবাদপত্র,বেতার ও টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য আমাদের সংগ্রামকে যথার্থরুপে তুলে ধরে এই সংগ্রাম সফল করতে সাহায্য করেছেন।
দেশবাসী ভাইবোনেরা,
বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হয়েছে,কিন্তু আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি।আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখন ও শত্রুর কারাগারে।পাকিস্তানি শাসকদের আমি আহবান জানাচ্ছি তাঁরা শেষ মুহুর্তের অন্ততঃ শুভবুদ্ধির পরিচয় দিন,বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করুন।এই দাবী মেনে নেওয়ার সুফল সম্পর্কে পাকিস্তানকে অবহিত করাও তার বন্ধুদের কর্তব্য বলে আমি মনে করি ।
বন্ধুগন,
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এলো এক রক্তাপ্লুত ভূমিতে,এক ধ্বংসস্তুপের মধ্যে।জনগণের আশা ও আকাংখা অনুযায়ী এই দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব এখন আমাদের সামনে।দেশের দ্রুত পুনর্গঠনের কাজে আমরা ভারতের সহযোগিতা ও সাহায্য কামনা করবো।শুধু পুনঃনির্মাণ নয়- নতুন সমাজ গঠনের দায়িত্ব আমরা নিয়েছি।সংগ্রামের কালে সমগ্র জাতির যে ঐক্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় আমরা দিয়েছি,সে ঐক্য ও ত্যাগের মনোভাব অটুট রাখতে হবে।তবেই গণতান্ত্রিক ,ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি দৃঢ় হবে।সেই নতুন আলো পথে আমরা আজ যাত্রা করলাম।
জয় বাংলা