শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
জেলা প্রশাসকদের আশু কর্তব্য সম্পর্কিত সংস্থাপন বিভাগীয় সচিবের চিঠি | বাংলাদেশ সরকার সংস্থাপন বিভাগ | ১৬ ডিসেম্বর,১৯৭১ |
বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার সংস্থাপন বিভাগ
তারিখঃ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
মেমো নং সং বি ভি ৩১৭৯ (১৯)
প্রেরকঃ মোঃ নুরুল কাদের
সচিব,সংস্থাপন বিভাগ
প্রাপকঃ জেলা প্রশাসক
বিষয়: জেলা প্রশাসকদের জন্য তাৎক্ষণিক কর্ম
১। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিয়োগ দেয়া বেসামরিক প্রশাসকরা তাদের পদের করণে একটি বিশাল কাজের চাপের সম্মুখীন হবে। যুদ্ধের সময়ে শত্রু বাহিনীর সঙ্গে দেশের সমগ্র প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে পরেছে যা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করার আগেই পুনরুদ্ধার করতে হবে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে জনসাধারণের মাঝে ব্যপক উদ্যম দেখা যাচ্ছে যাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে হবে এবং দ্রুত পুনর্গঠনের দিকে কাজে লাগাতে হবে। প্রশাসকদের এই অবস্থা বজায় রাখতে হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা এবং অন্যান্য শ্রেণীর জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
২। অন্যান্য কাজগুলো মধ্যে নিম্নলিখিত গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
ক) আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠাঃ স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা সহ অন্যান্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরেছে। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব হিসাবে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এজন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ও পুলিশকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে তাদের আগের অবস্থানে ফেরত পাঠানো হবে।
(অ) প্রতিটি থানায় ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া ও নজর রাখা যে এসপি পর্যাপ্ত জনবল মোতায়েন করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে কিনা।
(আ) সহযোগী এবং অপরাধীদের দণ্ডদান প্রক্রিয়া অল্পের মধ্যে শেষ করতে হবে। এজন্য নির্বাচিত প্রতিনিধি, রাজনৈতিক কর্মী, মুক্তিযোদ্ধাদের এবং সাধারণভাবে মানুষের পূর্ণ সমর্থন লাভ করতে হবে। এটি রাজাকারদের যত দ্রুত সম্ভব গ্রেফতার করার কাজেও প্রয়োজন হবে।
খ) সরকার পুনরায় কার্যকরীকরণঃ সরকার ইতিমধ্যে একটি ঘোষণার মাধ্যমে সমস্ত সরকারি কর্মচারীদের স্বীয় পদে ফিরে আসতে অনুরোধ করেছেন। যারা প্রকাশ্যে শত্রু বাহিনীকে সাহায্য করেছেন তারা ব্যতীত অন্যরা খুব বেশি প্রশ্ন বা বাছাইয়ের মুখে পরবেন না। এই কাজের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নেয়া হবে
(অ) সব কর্মীদের তাদের কাজ ফিরে যাওয়ার জন্য সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘোষণা দেয়া হবে। ফিরে আসার পর তারা আপনাকে তাদের পুনরায় যোগদান সম্পর্কে জানাবে।
(আ) যারা প্রকাশ্যে শত্রু সঙ্গে সহযোগিতা করেছে তাদের হেফাজতে নেয়া হবে। এজন্য আপনি স্থানীয় মানুষের আলোচনার পর আপনার বিচার করবেন।
(ই) বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিয়োগ যেখানেই হোক, তা দখলদার সরকার কর্তৃক প্রণীত আদেশ রহিত করবে। যেসব পদ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পূরণ করা হয়েছে তা বলবত থাকবে। এই পদে দখলদার সরকার দ্বারা নিযুক্ত ব্যক্তি স্পেশাল ডিউটি অফিসার হিসেবে থাকবেন।
(ঈ) যারা স্বীয় পদ ছেড়ে গিয়েছিলেন কিন্তু বাংলাদেশ সরকার অধীনে পুনরায় চাকরি পাননি তাদের আগের পদে পুনরায় শুরু করতে বলা হয়েছে। হানাদার বাহিনী দ্বারা এই পদে করা নিয়োগ গুলো বাতিল করা হয়েছে। এইরকম কর্মচারীরা পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত স্পেশাল ডিউটি উপর অফিসার্স থাকবে।
(উ) যারা তাদের পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং দখলদার সরকারের সেবা করা থেকে থেকে বিরত ছিল তাদেরকে তাদের অফিসে জয়েন করতে বলা হয়েছে। এবং বাকিরা স্পেশাল ডিউটি অফিসার হিসেবে থাকবেন।
গ) অর্থনৈতিক জীবন পুনর্নির্মাণঃ স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম যত দ্রুত সম্ভব পুনরুদ্ধার করা অপরিহার্য। একই সাথে ব্যাংক সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দায় ও সম্পদ সহ শত্রুপক্ষ ও রাজাকারদের রেখে যাওয়া সম্পদের একটা সঠিক ধারণা থাকা দরকার। এসকল সম্পদ যেন লুট বা ধ্বংস না হয়ে যায় সেজন্য অতিদ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গুলো নেয়া উচিত
(অ) পরবর্তি নির্দেশ দেবার আগ পর্যন্ত সকল ব্যাংক ও কোষাগারকে সমস্ত লেনদেন স্থগিত রাখবে। নগদ টাকা, সোনা সহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিস ব্যাংকে যাচাই বাছাইয়ের আগ পর্যন্ত জমা থাকবে এবং পর্যাপ্ত প্রহরা মোতায়েন করে এগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। যাচাইয়ের প্রতিবেদন কোন বিলম্ব ছাড়াই সরকারের নিকট পাঠাবে।
(আ) শত্রুপক্ষের ও পলাতক রাজাকারদের শিল্প প্রতিষ্ঠান,কলকারখানা,দোকানপাট সিল করে দেয়া হবে। দরকার মনে করলে শর্ত সাপেক্ষে জেলা প্রশাসক যথাযথ পরিচালক নিযুক্ত করে উপরোক্ত যেকোনো স্থাপনা চালু করতে পারবে। অন্যান্য স্থাপনাগুলোর ক্ষেত্রে কর্মচারীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হচ্ছে যাতে সরকারি নির্দেশনা পাওয়া মাত্র তারা কাজে যোগ দিতে পারে।
(ই) অন্যান্য সমস্ত কারখানা ও দোকানপাট পুনরায় যত দ্রুত সম্ভব খোলার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করা হবে। হাসপাতাল,ডাক্তার খানা,পৌর পরিষেবা ইত্যাদি অবিলম্বে পুনরায় শুরু করা উচিত।
(ঈ) পাওয়ার পাম্পের মাধ্যমে সেচ কাজে সহায়তা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
(ঘ) যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠাঃ
যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা অগ্রাধিকার পাবার মত একটি বিষয়। এটা ছাড়া সরকারের অন্যান্য সকল কার্যক্রম বিফলে যাবে। অনুগ্রহ করে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করার অনুরোধ রইলঃ
(অ) সকল টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ সেবা পুনরুজ্জীবিত করা উচিত। ডাক ও কুরিয়ারকেও যথযথ উপায়ে ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও আপনার উচিত যখনই সম্ভব সশস্ত্র বাহিনীর বেতার ব্যবস্থার সদ্ব্যবহার করা।
(আ) সড়ক ও রেল যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করতে হবে। এজন্য এই বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে এবং যা কিছু সম্ভব পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়াও এ বিষয়ে আপনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করতে হবে।
(ই) নদীপথে যোগাযোগের উপর জোর দিতে হবে।
(ঙ) ত্রাণ ও পুনর্বাসনঃ ত্রাণ সরবরাহ ও উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার কৌশল সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। এটা ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব না হলেও কঠিন হবে। এ বিষয়ে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ সমূহ নেয়া উচিতঃ
(অ) উদ্বাস্তু এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের দেখাশোনা করার জন্য থানা পর্যায়ে মনোনীত ব্যক্তিদেরকে দায়িত্ব দেয়া হবে।
(আ) সরকারি খাদ্য গুদামে খাদ্য শস্যের পরিমান যাচাই করে দেখতে হবে।
(ই) শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে এবং একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যেতে জনসাধারণকে অনুরোধ করতে হবে।
(ঈ) এই বিষয়ে বিশদ আদেশ শীঘ্রই সরকার দ্বারা জারি করা হবে। এই সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সম্ভাব্য সব ধরণের সহায়তা দেওয়া যেতে পারে।
(চ) জরুরী সরবরাহঃ খাদ্য,কেরোসিন,লবণ,চিনি,সরিষার তেল সহ অপরিহার্য অনেক জিনিসের সরবরাহে অনেক ঘাটতি হতে পারে। সরকার এই সমস্যাকে বেশ ভাল ভাবেই বিবেচনা করছে। অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে
(অ) এইসব পণ্যের বিদ্যমান মজুদের সঠিক তথ্য দরকার যাতে সঠিক বিতরণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
(আ) মজুদদারী এবং কালোবাজারি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা
(ই) আগামী তিন মাসের জন্য আপনার প্রয়োজনীয় তথ্য সরকারকে জানানো উচিত।
সর্বশেষে আমি নির্বাচিত প্রতিনিধি,রাজনৈতিক কর্মী,মুক্তিযোদ্ধা এবং জনসাধারণের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতার সঙ্গে কাজ করার জন্য জোর দিচ্ছি। আপনার সামনে যে কাজ তা আসলেই বিশাল মাপের এবং এটা সম্পন্ন করার জন্য সকল স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
সব দিকের খবর সম্বলিত একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন খুব দ্রুতই সরকারের নিকট পাঠাতে হবে। এবং খুব শীঘ্রই পুর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
(এম. নুরুল কাদের)
মেমো নং বিডি / ৩১৭৯ (১৯)/১ (২৩)
তারিখঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
অনুলিপিঃ
1. চেয়ারম্যান, ট্রেড, কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর বোর্ড.
2. চেয়ারম্যান, পরিকল্পনা সেল.
3. প্রতিরক্ষা সচিব
4. পুলিশ কমিশনার
5. ত্রাণ কমিশনার.
6. প্রধান প্রকৌশলী.
7. স্পেশাল অফিসার-ইন-চার্জ, পি & টি বিভাগ
8. রাষ্ট্রপতির পার্সোনাল সেক্রেটারি
9. প্রধানমন্ত্রীর পার্সোনাল সেক্রেটারি
10. দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর পার্সোনাল সেক্রেটারি
11. এ ডি সি সি-ইন-সি.
তথ্যের জন্য.
(কে আহমেদ)
উপ-সচিব
সংস্থাপন বিভাগ