You dont have javascript enabled! Please enable it!

জীবনচিত্র    নামঃ ডা. কসিরউদ্দীন তালুকদার

                             Dr. Kosiruddin Talukder

পিতাঃ মরহুম নকীবউল্লাহ তালুকদার

পিতার পেশাঃ জমিদারি

মাতাঃ মরহুমা ফিরমন নেসা

ধর্মঃ ইসলাম

স্থায়ী ঠিকানাঃ মহিষমুণ্ডা, দুপচাঁচিয়া, বগুড়া

 

শহীদ ডা. কসিরউদ্দীন তালুকদার

 

নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ আদি নিবাস মহিষমুণ্ডা

জন্মঃ ১৭ জুলাই, ১৮৯৯, মহিষমুণ্ডা, বগুড়া

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ

এমবিবিএসঃ ১৯৩০, কলকাতা মেডিকেল কলেজ

চাকরির বর্ণনাঃ

থানা রোড, বগুড়া ‘ইউনাইটেড মেডিকেল স্টোর’ নামে ডিসপেনসারি খুলে প্র্যাকটিস শুরু করেন

হত্যাকারীর পরিচয়ঃ পাকিস্তানি সৈন্যরা আদি নিবাস মহিষমুণ্ডা থেকে তাকে ধরে নিয়ে মাঝিড়াস্থ সেনানিবাসের বধ্যভূমিতে হত্যা করে

নিহত/নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ২৯ মে ১৯৭১

মরদেহঃ

প্রাপ্তি স্থানঃ মাঝিড়াস্থ সেনানিবাসের বধ্যভূমি

স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ

স্ত্রীর নামঃ স্ত্রী সৈয়দা জেয়াউন্নাহার খাতুন

সন্তান-সন্ততিঃ দুই পুত্র, পাঁচ কন্যা

ডা. জিয়া হাসান

মাহবুব আরা বেগম

জাহান আরো বিল্লাহ

জেবউননেসা জামান

মনোয়ারা খোন্দকার

আনজুমান আরা বেগম

 

তথ্য প্রদানকারী

আনজুমান আরা বেগম(প্ৰয়াত)

শহীদ চিকিৎসকের কন্যা

হোয়াইট হাউস, বগুড়া

 

 

 

১২৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

আমার আব্বা

শহীদ ডা. কসিরউদ্দীন তালুকদার

আনজুমান আরা বেগম

 

যুগে যুগে, সময়ের আবর্তে কিছু বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব এ প্রিথিবীতে এসে তাঁদের কর্মময় জীবন আর ত্যাগ-তিতিক্ষার আদর্শে আমাদের নানাভাবে ঋণী করে গেছেন—সে ঋণ কখনো রক্তঋণ হয়েছে। রক্তঋণ দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ যাঁরা প্রশস্ত করে গেছেন তাঁদেরই একজনকে নিয়ে আমার আজকের কিছু কথা, কিছু উচ্ছাস, কিছু বেদনার অনুভূতি যা একান্ত আমার।

১৮৯৯ সাল, আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী আগে মধ্যাহ্ন গগনের তেজদীপ্ত সূর্য হয়ে আমাদের দুখু মিয়া (কাজী নজরুল ইসলাম) যখন জন্মালেন ঠিক তখনি মহিষমুণ্ডা বগুড়ার এক অজ পাড়াগাঁয়ের ধনাঢ্য পরিবারে দুখু মিয়ার মতো স্বাধীনচেতা, সত্যাশ্রয়ী এক শিশুর জন্ম হলো। পিতা নাকিবউল্লাহ তালুকদারের এই শিশু পুত্রটি কসিরউদ্দীন তালুকদার নামে পরিচিত হলো। বাপজান ডাকতেন ‘কসিম মিয়া’ বলে। বলাবাহুল্য, দুখু মিয়ার স্কুল পালানো স্বভাব কসির মিয়াকেও প্রভাবিত করেছিল। বাপজান তাঁর বিরাট সম্পত্তি, প্রজাপালন জনহিতকর কাজের চাপে আকণ্ঠ ডুবে থাকেন। এছাড়া ‘জুর’ হওয়ার কারণে সদা-সতর্ক মনোভাব তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে, তাই তাঁর সময় কোথায়? বড়ভাই ফয়েজউদ্দীন তালুকদার, আদর্শবাদী পুরুষ, পেশায় ডাক্তার। নিজ হাতে তুলে নেন ছোট দু’ভাই নবির মিয়া আর কসির মিয়ার পড়ালেখার দায়িত্বভার। গ্রামে ভালো স্কুল নেই তাই পাশের গ্রামে সোনামুখী হাইস্কুলে পাঠান দু’ভাইকে। ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে দু’ভাইয়ের স্কুল যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু বড়ভাইটি নিশ্চিন্ত হতে পারেন না, মনের কোণে দুর্ভাবনার কালো মেঘ জমা হয়। স্কুলে ঠিক যাবে তো? সন্দেহপ্রবণ মনকে নিরস্ত করতে না পেরে আরেক ঘোড়ায় চড়ে রওনা দেন পিছু পিছু সঙ্গে তাঁর বেতটি নিতে ভোলেন না, পাছে প্রয়োজন পড়ে। হ্যাঁ, যা ভেবেছেন ঠিক তাই, গাছের সাথে ঘোড়া বাঁধা, সহিস গাছের নিচে ঝিমোচ্ছে, নবির মিয়া, কসির মিয়া মারবেল খেলায় মত্ত—কে কার কাছে কত মারবেল জিততে পারে। হাতের বেত সাপের মতো লকলকিয়ে ওঠে, পিঠে পড়ে আচমকা সপাং সপাং। ব্যথায় কুঁকড়ে আধমরা অবস্থা। তখন কিন্তু আবার যাত্রা শুরু

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১২৫

শহীদ ডা. কসিরউদ্দীন তালুকদার

 

হয়-গন্তব্য সোনামুখী স্কুল। এভাবেই সোনামুখী স্কুল থেকে বগুড়া জেলা স্কুল। সেখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে দুটি লেটারসহ উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ। সেখান থেকে আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে দুটি লেটারসহ উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর্ব শেষ হয়। ১৯২৯ সালে কৃতিত্বের সাথে এমবিবিএস পাস করে ১৯৩০ সালে বগুড়া শহরে ডাক্তারি জীবন শুরু করেন। কসিরউদ্দীন তালুকদার। ছাত্রজীবনে ১৯২৩ সালে রাজশাহীর এক বনেদি পরিবারের কর্ণধার সৈয়দ মীর মেহের আলীর ধর্মপ্রাণ, বিদুষী কন্যা সৈয়দা জেয়াউন্নাহার খাতুনকে না দেখে, শুধু তার গুণাবলির কথা শুনে এবং হাতে কাজ করা নিখুঁত পরিচ্ছন্ন শিল্পের নৈপুণ্যে চমৎকৃত হয়ে উপযুক্ত স্ত্রীর মর্যাদা দেন।

তাঁকে তুলে ধরতে গিয়ে অভিধানের পাতা খুলে শব্দ চয়ন করতে হবে না আমার, সাদামাটা আটপৌরে ভাষা দিয়ে তাঁকে যেমন দেখেছি, মানুষ হিসেবে তাঁকে হৃদয় দিয়ে যতটুকু অনুভব করেছি তাই মনের আগাল খুলে বলবোতাঁর চরিত্রতে প্ৰাণ দিতে গিয়ে পার্শ চরিত্রগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে না-তাও আমি জানি। আপন মহিমার ঔজ্জ্বল্যে তিনি মহীরুহের মতো আশপাশের বেড়ে ওঠা চারাগাছগুলোকে জীবনে গান শুনিয়ে যাবেন, আমার বিশ্বাস। আমার দৃষ্টিতে তিনি যেন ‘রুটস’-এর সেই মহানায়ক কুনতাকিনতের মতো আরেক নির্ভীক প্রতিবাদী কণ্ঠ। এই প্রতিবাদী কণ্ঠই দৃঢ়প্রত্যয়ী অঙ্গীকারে সোচ্চার হয়েছিল সেদিন স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। বগুড়ার সাতমাথার চিকিৎসকদের মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে আওয়াজ তুললেন, ‘এ দেশকে স্বাধীন করতে হবে।’ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ভারও আগ্রহভরে তুলে নিলেন নিজ হাতেদেশের স্বার্থে এর বিনিময়ে যা পেলেন সেই পাওয়ার গৌরবটুকু রেখে গেলেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, আমাদের জন্য, আগামী প্রজন্মের জন্য। তাই তো আমি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পিতার গর্বিত সন্তান।

আব্বার প্রখর সততার প্রথম পরিচয় পাই আমাদের জন্মতারিখকে কেন্দ্র করে। সন্তানের জন্মতারিখ রদবদল তাঁর নীতিবিরুদ্ধ ছিল। তার মতে পৃথিবীর আলো-হাওয়া সম্পর্কে যে শিশুর জীবন শুরু হলো তাকে কোনো মিথ্যা দিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করা ঠিক নয়। একদিন এই সন্তানই তো দেশবরেণ্য হতে পারে। সন্তান, স্বজন, দেশ, দেশের সাধারণ মানুষকে নিয়ে তাঁর কত আশা, কত স্বপ্ন ছিল, আজ মনে পড়ে।

আমি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন আব্বার বয়স পঞ্চাশ বছর। একমাত্র ঘুম ছাড়া জীবনের কোনো একটি মুহুর্তকেও বোধহয় তিনি ব্যর্থ হতে দেননি। কাজই হলো জীবনের পরিচয়তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের ছবি আমি এখনও পরিষ্কার চোখে দেখতে পাইখুব সকালে উঠে অতি ভালোবাসা ও বন্ধুত্রে নিদর্শন হিসেবে যে গাড়িখানি তিনি বগুড়ার মহম্মদ আলী সাহেবের কাছ থেকে পেয়েছিলেন, সেটাতে স্টার্ট দিতেন-১৯৩৯ মডেলের ‘মরিস’ গাড়ি। তবুও জীবনের প্রায় শেষ দিক পর্যন্তই সেটাকে সচল রেখেছিলেন। গাড়ির মেকানিজম প্রায় তাঁর সবই জানা হয়ে গিয়েছিল। তাই গাড়ির নিচে শুয়ে কাজ করে কালিকুলি মেখে গলদঘর্ম হয়ে বের হতেন। তারপর সোজা গোসলখানায়। শুরু হতো একের পর এক নজরুলের গান- ‘বাজলো কিরে ভোরের শানাই’ থেকে শুরু করে মেহেদী হাসানের ‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়’ পর্যন্ত। বেশিক্ষণ নয় মাত্র ৫-৭ মিনিটের মধ্যে বের হয়ে সারাজীবনের নিয়মানুযায়ী বারান্দার তারে পরিধানের লুঙ্গি এবং গেঞ্জি ধুয়ে মেলে দিতেন। তারপর নাশতা পর্ব সেরেই যাত্রা করতেন। থানা রোডে তাঁর সেই সাধের ডিসপেনসারি দিকে-‘দি ইউনাইটেড মেডিকেল স্টোরে।’ যেখান থেকে ওষুধ না পেয়ে বিফল হয়ে কাউকে ফিরে যেতে হয়েছে বলে জানি না তাঁর জীবদ্দশায়। সাদা শেরওয়ানি, পাজামা আর পামসু পায়ে দিয়ে চিরুনিতে চুলটাকে ব্যাকব্রাশ করতেন, তারপর পকেট হাতাড়িয়ে বলতেন একটা কথা, চশমা-চাবি-ঘড়ি-কলম’, পাছে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বাদ না পড়ে। শেষ কথা-‘ও জি’ চললাম। মায়ের নাম জেয়াউন্নাহার, আব্বা ছোট্ট নামে ডাকতেন ‘জি’। ‘জি’ নামের মানুষটিকে যে কী সম্মান এবং সমীহ করতেন আব্বা তা না দেখলে কাউকে বিশ্বাস করানো যাবে না। আব্বাকে বলতে শুনেছি, ‘তুমি শুধু ডিউটিফুল নও, তুমি তোমার কাজে বিউটিফুল।’ যেহেতু আমি ছিলাম মায়ের একেবারে পেটমোছা এবং পিছলাগা, তাই ঘুমের সময় মাকে কাছে না পেলে আমার ঘুম আসতো না। মাকে কাছে আসবার জন্য বিরক্ত করতাম। মায়ের ঠাণ্ডা নরম হাতের ছোঁয়া পেলেই ঘুম আসতো। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি কেন আব্বা মাকে বলতেন, ‘তোমার এই লেজটাকে সরাও তো’ নিঃসন্দেহে আমি আব্বার-আম্মার মাঝখানে অনাহ্‌ত ছিলাম। ছোট হিসেবে তেমন কোনো সুবিধা কোনোদিন

 

১২৬ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

শহীদ ডা. কসিরউদ্দীন তালুকদার

 

নিতে পেরেছি বলে মনে হয় না-বড় বোনদের বেলায় তিনি যেমন কড়া ছিলেন আমার বেলায় তার কোনো কমতি হয়নি। ভাগ অঙ্ক শিখতে গিয়ে কী মারা যে খেয়েছিলাম তা এখনও মনে পড়ে।

অন্যায়ের সাথে আপোস তাঁর কোনোদিনই হয়নি। রেখেঢেকে কথা বলা যা আমরা বলে থাকি তা তিনি কোনোদিনই বলেননি। যা অন্যায় মনে হয়েছে কটুভাবে-স্পষ্টভাবে বলে ফেলেছেন, এজন্য মানুষের বিরাগভাজন হয়েছেন। স্পষ্টবাদিতাই তার প্রধান শক্র হয়েছে। বুদ্ধি হওয়া থেকেই দেখিছি মা মিটিং করতে যান। ব্রিটিশ আমল থেকে একমাত্র মিউনিসিপ্যালিটির মহিলা কমিশনার ছিলেন তিনি একটানা বাংলাদেশ হওয়া পর্যন্ত। এছাড়া জেল পরিদর্শন ও অন্য জনহিতকর কল্যাণের সাথে মায়ের জড়িত হওয়ার পেছনে ছিল আব্বার উৎসাহএককালে বগুড়ার রাস্তাঘাট বড় পীড়াদায়ক ছিল। রেলওয়ে স্টেশন থেকে যত মালামাল পরিবহনের কাজ গরুগাড়ির মাধ্যমেই হতো। আমাদের বাড়ি রেলওয়ে স্টেশনের কাছে, বাদুড়তলায়। বাড়িতে এতো ধুলোবালি হতো যে সারাদিন এক কাজের লোক বাড়ি পরিষ্কার করতেই ব্যস্ত থাকতো। আমার মা ছিলেন এই ওয়ার্ডের কমিশনার। মিটিংয়ে যাওয়ার আগে আব্বা ও মাকে প্রায়ই কথাকাটাকাটি করতে দেখতাম। আব্বা মাকে বলতেন, ‘তুমি একদম স্পষ্টভাবে বলবে যে, রাস্তা মেরামতের ইট কোনোমতেই ফার্স্টক্লাস ছিল না, থার্ডক্লাস ইট না হলে রাস্তা এতো তারাতারি খারাপ হতো না।’ খোলাখুলিভাবে সবার সামনে এ ধরনের কথা বলতে পারা সম্ভব নয়-এ আপত্তি জানালে আব্বা খুব রাগ করতেন। মা বলতেন, ‘থাক অমন কথা আমি বলতেও পারবো না, আমি মিটিংয়েও যাবনা, তুমিই গিয়ে বলো তোমার প্রয়োজন হলো।’ এ প্রসঙ্গে আরো একটি ঘটনা বলি। তখন আমার বয়স ৯-১০ বছর হবে। সবে টাইফয়েডে ভুগে উঠেছি। বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার পথে, হঠাৎ কানে স্লোগানের শব্দ শুনতে পেলা—‘কসিরা ডাক্তার মুর্দাবাদ’ স্লোগান আরো কাছে একেবারে বাড়ির গেটে-, ‘কসির ডাক্তার মুর্দাবাদ।’ ব্যঙ্গ করে আরও একজন বলে উঠলেন, ‘কোথায় ডাক্তার সাহেব, বাইরে বের হচ্ছেন না কেন?’ আব্বা বের হয়ে বললেন, ‘আমি সেদিন যা বলেছি আজও সেই কথা বলবো। রাসুলুল্লাহর(স.) মতো মহামানব এমন ব্যবহার করতে পারেন না। যে বইয়ে এমন কথা লেখা আছে সে বইয়ের পাতা আমি ছিঁড়ে ফেলবো।’ ঘটনা হলো-কোনো মাহফিলে যেখানে মুসলমান ছাড়াও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন, সেখানে একজন প্ৰগলভ মুসল্লি সাহেব রসূলে আকরম (স.) সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলে ফেলেন যে, তিনি যখন সাহাবীদের মাঝখানে কথা বলতেন, মুখে থুথু জমলে ফেলতেন আর সাহাবীরা তা মুখে মাখতেন। এ ধরনের উক্তি আব্বাকে সাংঘাতিকভাবে উত্তেজিত করেছিল সেদিন। সোচ্চার হয়েছিলেন একমাত্র তিনিই। রসূলের কোনো সাহাবী তাঁর প্রতি ভক্তি-ভালোবাসায় আপুত হয়ে এমন কাজ করতে পারেন; কিন্তু পরিচ্ছন্নতা তো ইসলামের অঙ্গ হিসেবে শামিল করা হয়েছে। এটাই ছিল আব্বার উক্তি। আজীবন পরচর্চা ও বিলাসিতাকে তিনি প্রাণভরে ঘূণা করেছেন। সারাজীবনে কোনো বাবুগরি তিনি করেননি, নিজের জন্য কোনো বাড়তি খরচ তাঁর ছিল না। খুব বেশি কাপড় জমা তৈরি করা তাঁর অপছন্দের কারণ ছিল। শিক্ষাথাতে এবং সুস্বাস্থ্যের জন্যে প্রয়োজনীয় খরচ করতে তিনি কার্পণ্য করেননি কোনোদিনএবার আমি তাঁর পছন্দের দিকটাই আসি। বাপ-দাদার মতো মানুষকে খাওয়াতে তিনি খুবই পছন্দ করতেন। সংসারের খাটুনি খাটা মানুষটি যেমন আলাদা আদর আপ্যায়ন পেতে চান সংসারে, যত্নে বেড়ে রাখা তরকারীর বাটি নিয়ে নীরবে নিভৃতে আহারে তৃপ্ত হতে চান-আব্বা তা চাননি। কোনোদিনই দেখিনি আমরা। এক টেবিলে সবাইকে নিয়ে খেতেই ভালোবাসতেন। বিশেষ করে রাতে সবাইকে একসাথে খাবার টেবিলে জমায়েত হওয়ার জন্য সিঁড়ির কাছে গিয়ে কাঁসার থালে কাঁসার চামচ দিয়ে ঢং ঢং করে ঘন্টা দিতেন। উপরে নিচে যে যেখানে থাকতাম টেবিলে হাজির হতাম। খাবার সময় টেবিলে কথা বলা খুব একটা হতো না। খাবারের দিকে আঙুল দিয়ে এটা-ওটা এভাবেই কথা বলতাম আমরা। আব্বা তৎপর থাকতেন এবং সবার প্রতি খেয়াল করতেন। যেমন কে মাথা নিচু করে খাচ্ছে, কার পাতে কিছু নেই, গভীরভাবে দৃষ্টি দিতেন এবং মাকেও সে মতো আব্বার ‘রানিং কমেন্ট্রি’ শুনতে হতোসবাই খাচ্ছি নিঃশব্দে, হঠাৎ দেখছি মায়ের মাথায় সরপোশটা শোভা পাচ্ছে। এক নির্মল হাসির ফোয়ারা ছুটতো সবার মুখে। আব্বা বলতেন, ‘তোদের মা মেম সাহেব।’ আমাদের এই মেম সাহেব মা সারাজীবন আব্বাকে যে কীভাবে সাংসারিক শান্তির ছায়ায় শান্তভাবে বিচরণ করতে দিয়েছিলেন তার

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১২৭

শহীদ ডা. কসিরউদ্দীন তালুকদার

 

প্রত্যক্ষদর্শী আমরা। স্বভাবে আব্বা ছিলেন ব্যস্তবাগীশ-পান থেকে চুন খসলে তিনি অস্থির হতেন, মা ধীরস্থির এবং বুদ্ধিমতী। আমাদের যত আবদার-অভিযোগ মায়ের কাছেই পাড়তাম। বিশেষ করে স্কুলের রিপোর্ট কার্ড সই করবার সময় মায়ের কাছে তা গছিয়ে দিয়ে উপরিতলায় পালিয়ে থাকতাম। ভাবতাম ডাক বোধহয় পড়বে না, কিন্তু না সে আশা গুড়ে বালি, সুড়সুড় করে ঠিকই নিচে নেমে এসে মাকে সামনে ধরে রেখে জবাবদিহি করতে হতো অঙ্কে কেন কম নম্বর পেলাম। আব্বার বাড়ি ফেরার একটা সিগন্যাল ছিল যা আমাদের বড়ই সহায়ক ছিল। ভাইবোন মিলে যখন আড্ডায় মশগুল-জমজমাট আসর, তখন ধপ ধপ ধপ-বাড়ির গেটে এসেই পায়ের জুতো থেকে ধুলো ঝাড়বার শব্দ পাওয়া মাত্র যে যেখানেই থাকি না কেন পড়ি কি মরি করে একেবারে পড়ার টেবিলে স্থির। আব্বা দেখতেন সুবোধ ছেলেমেয়েরা সব পড়ার টেবিল অলঙ্কৃত করে বসে আছে। বাইরে থেকে এসে খোঁজ করতেন ‘ঝর্না’, ‘রুবা’ কোথায়? তাই মাকে পটিয়ে-পাটিয়ে যদি কোনোদিন সিনেমায় গেছি সাধ্যি কার শান্তিমতো সিনেমা দেখে। ছবি যখন শেষের দিকে-নায়ক-নায়িকার ভুল বোঝাবুঝির অবসান হতে যাচ্ছে, দর্শকের চোখের নোনা পানি শুকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক আলতো ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা দু’বোন ঝর্ণা (মাহবুব আরা) ও আমি (রুবা) অন্ধকারে ঘনঘন ঘড়ি দেখছি। মনে মনে বলছি, আল্লাহরে আল্লাহ আব্বা যদি আজ একটু দেরি করে বাড়ি ফিরতেন অন্তত, পথে আব্বাকে পাশ কাটিয়ে যদি রিকশা আমাদের পার হতে পারতো। তা কি হওয়ার জো আছে? আব্বা তো ফিরবেন সেই ৯টার পরপর আর ছবি শেষ হবে সোয়া ৯টায়। হায়রে কপাল একটুর জন্য কীদুর্ভোগ কপালের। ফিরতি পথে আমাদের দু’জোড়া চোখ সেই থানা রোডের উত্তরা সিনেমা হল থেকে একমনে হেঁটে যাওয়া নীরব সেই পথচারীকে খুঁজে ফিরতো অযথাই। বাড়ির গেটে এসে রিকশা থামলে ভাই (খিচ্চু) আরো ভয় দেখিয়ে বিজ্ঞের মতো বলতেন, ‘যাও ঠ্যালা বোঝ, আব্বা রেগে আগুন।’ বেশ মনে পড়ে বৈজু বাওয়ার গান শুনিয়ে আব্বাকে খুশি করতে পেরেছিলাম আমরা দু’বোন। তাই আব্বা গান শিখবার জন্য আরও ৩-৪ বার বৈজু বাওয়া দেখতে অনুমতি দিয়েছিলেন। সিনেমা দেখে খুশি মনে বাড়ি ফিরতে পারিনি কোনোদিন। ঐ চোরের মতো উঠানের টিনের দরজা দিয়ে পা টিপে টিপে বাড়িতে ঢুকতে হয়েছে আর শুনতে হয়েছে-আব্বা মাকে বলছেন, ‘তুমি আশকারা দিয়ে এদেরকে মাথায় তুলেছ—সিনেমায় কী আছে শুনি? ঐ তো একই ঘটনা। বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল, না হয় ত্যাজ্য পুত্র করল, সিনেমার শেষ দৃশ্যে সবাই ভুল বুঝতে পারল একে অপরকে, ব্যস! এই তো? আব্বা যখন রাগ করতেন তখন মাকে দেখেছি একদম চুপ। আবার সময় বুঝে মা যখন আব্বার ভুলগুলো তুলে ধরতেন আব্বা তখন মিটমিট করে অপ্রস্তুত হয়ে হাসতেন আর বলতেন, ‘হয়েছে বাবা হয়েছে, থামো থামো।’ আমরা আড়ালে-আবড়ালে থেকে এসব দেখে খুব উপভোগ করতাম। অনাবিল আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান এই আব্বা, যা ইচ্ছা তাই করতে পেরেছেন। অধ্যবসায় তাঁকে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পেরেছে যেখানে অতিথিপরায়ণ, ন্যায়পরায়ণ, ধর্মপরায়ণ চিকিৎসক কসিরউদ্দীন শুধু মোটর মেকানিজম, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, দর্জি বিজ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তি হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেননি নিজেকে, ছাত্রজীবনে আবৃত্তিকার সেই যুবক কসিরউদ্দীন বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে ‘এবার ফিরাও মোরে’ আবৃত্তি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তখন আমি সেই কলেজের ছাত্রী। স্পষ্ট মনে আছে, প্রফেসর ওয়াদুদ যখন আব্বাকে জোর করে মঞ্চে উঠিয়ে দিলেন তখন আব্বা বললেন দর্শকদের উদ্দেশ করে, বেশ বিনীত ভাব ছিল কণ্ঠে, ‘আমি প্রথমেই আপনাদের কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিচ্ছি, অনেক ভুলভ্রান্তি হবে কারণ চর্চা নেই আমার, উপরন্তু আমার বেশ কিছু দাঁত পড়ে গেছে তার জন্য আমার উচ্চারণে কিছু অসুবিধা হবে।’ সবাই হতবাক হয়ে শুনেছিল সেদিন তাঁর সুদীর্ঘ আবেগজড়িত আবৃত্তি। শিক্ষানুরাগী, সঙ্গীতামোদী, রান্নাবান্নায় পটু আব্বা প্রবীণতম চিকিৎসক হয়েও ডাক্তারের অভিনীত নাটকে চাকরের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করে সহকর্মী ও দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলেন। ওই নাটকে গানের অংশে আমরা দু’বোন অংশ নিয়েছিলাম আর বড় ভাই ডাক্তার জিয়া হাসান ছিলেন পরিচালনায়। নাটক শেষে ছবি তোলার জন্য সবার ডাক পড়লো-সবার ঘোরতর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও চাকরের সেই গামছা ঘাড়ে ঝুলিয়ে বিনীতভাবে মাটিতে বসে পড়লেন। বাড়িতে কতবার যে অভিনীত চরিত্রের ডায়লগ মহড়া দিয়েছেন। যেমন আস্তে আস্তে মাথা নিচু করে, ‘বাব্বু আমায় ডেকেছেন, আজ্ঞে?’ চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলবার কী আপ্রাণ চেষ্টা। কী একাগ্রতা, আজও মনে হলে কেমন যেন

 

 

১২৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

শহীদ ডা. কসিরউদ্দীন তালুকদার

 

লাগে। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে সেলাই করেছিলেন একজোড়া ময়ুর আবার নিচে লিখেছিলেন, ‘সত্যরে করিয়া ধ্রুবতারা।’ নারী প্রগতিতে বিশ্বাসী আব্বা চল্লিশের দশকে বড় দু’বোনকে কলকাতা লেডি ব্ৰেবোর্ন কলেজে রেখে লেখাপড়া করিয়েছেন। শিক্ষার প্রতি অবাধ অনুরাগেই বাড়ির ছেলের বউদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন আমাদের মতো। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনিও বগুড়ার ইতিহাস। ডাক্তার হিসেবে তাঁর যথেষ্ট হাতযশ ছিল। রোগীর ব্যবস্থাপত্র এতো তাড়াতাড়ি লিখতেন যে রোগীর মনে হতো, ডাক্তার সাহেব বোধহয় ভালোভাবে পরীক্ষা করলেন না। আব্বা খসখস করে ক্ষিপ্ৰহস্তে লিখেছেন প্রেসক্রিপশন, রোগীর জিব দেখে পেটের পিলে কত পরিসর হয়েছে তা তাঁর বোঝা হয়ে গেছে। এদিকে রোগী ভালো করে বোঝাবার জন্য ভ্যানর ভ্যানর করেই যাচ্ছে—‘বুঝলেন ডাক্তার সাহেব, আমার না খুঁ-উ-ব দুর্বল লাগে, পেট মোচড়ায়, বুকের ভেতর ঢিব-ঢিব করে।’ ‘আরে বাপু থামো তো, হয়েছে হয়েছে বুঝে গেছি’-আব্বা বলতেন। কী মহৌষধ দিতেন জানি না, রোগীরা শেষ পর্যন্ত ভক্তে পরিণত হতো। এভাবেই আব্বা দেখা পেয়েছিলেন পল্লী মঙ্গলের। পরোপকারী এই গ্রামের রোগীটির নাম আব্বাই দিয়েছিলেন ‘পল্লী মঙ্গলের।’ যেহেতু হিতকর কাজে তার নামডাক ছিল। ক্ষেতের শাক, মিষ্টি আলু গামছায় বেঁধে আব্বাকে দিতে পারলে পল্লী মঙ্গল তৃপ্ত হতেন। পল্লী মঙ্গল আজ বেঁচে নেই কিন্তু পল্লী মঙ্গলের স্ত্রী ‘বুড়ার বেটি’ আমাদের বাড়িতে প্রতিপালিত হয়েছেন। ‘পণ্ডিত’ আব্বার দেয়া নাম। যার আসল নাম ‘ময়েজ’আমাদের বাড়িতে একটানা পঁয়তাল্লিশ বছর রান্না করে পরম তৃপ্ত করেছিল সবাইকে-সেই পণ্ডিতও ছিল আমাদের বাড়ির সদস্যের মতো। আমার নতুন সংসারে অল্প কিছুদিন পণ্ডিতের সাহচার্য পেয়েছিলাম। বেশি দিন রাখতে পারলাম না শত আদর-যত্ন করেও, কারণ ঢাকায় মন তার টিকল না। কাজের মানুষটিরও যে একটা মন থাকে। সে সম্পর্কে আব্বার উপলব্ধি ছিল প্রখর। তাই তার সাথে মাঝে মধ্যে মশকরা করে আব্বা পশ্চিম বগুড়ার গ্রাম্য ভাষায় কথা বলতেন, ‘ক্যারে পণ্ডিত, ভাত হোছে?’ পণ্ডিত টেনে জবাব দিত, হো-ছে।’ তেমনিভাবে আমাদের পাড়ার কলিম মিস্ত্রির মেয়ে আঞ্জু আমার ছোটবেলার খেলার সাথী, সংসারের টানাপোড়েনের জ্বালায় ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে থাকতো। আব্বা তখন খুব সিগারেট খেতেন, ব্র্যান্ড ছিল সিজার্স। আঞ্জু কথা বলতো একটু অস্পষ্টভাবেতাই আব্বা যখন সিগারেট আনবার জন্য পয়সা দিতেন তখন ও বলতো, ‘থব পতারি নিমু?’ মানে সব পয়সাই নেব? তারপর থেকে পরে যতদিন ও বেড়াতে আসত ওকে দেখলেই আব্বা বলতেন, ‘ক্যারে থব পতারি ভাত খাছু?’ এই যে সাধারণ মানুষগুলোকে আপন করে নিতে পারা, সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পরও বাড়িতে ফিরে আঞ্জুর মায়েদের মতো হাইপারটেশনের রোগী যখন ‘আব্বা হামার জানডা অ্যানা ভালো করে দেন আব্বা, হামি আর বাঁচুম না’ বলতো তখন আমরা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যেতম। মনে হতো এবার বুঝি আব্বা গর্জে উঠবেন; কিন্তু না যদিও কর্মক্লান্ত আব্বা কখনও-সখনও বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘না তোমার জ্বালায় আর পারি না, একটু বিশ্রাম নিতেও দাও না।’ ঠিকই ব্যবস্থাপত্র করে দিতেন। ওষুধও দিতেন। লোকজনকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। ডিসপেনসারিতে থাকাকালীন রোগী ছাড়াও অনেক অভাবী লোকজনের সঙ্গে তাঁর দেখা-সাক্ষাৎ হতো। না খাওয়া কত অভুক্ত মানুষকে যে চিরকুট হাতে বাড়িতে পাঠিয়েছেন তার হিসাব রাখিনি। চিরকুটে সংবাদ থাকতো, ‘যিয়া, এই পত্র বাহকটিকে দুপুরে খাইয়ে দেবে।’

ফলের মধ্যে আম আব্বার প্রিয় ছিল। আমাদের সময় ভালো আমি কিনে পাড়ার ছেলেমেয়েদের ডেকে এনে দিতেন। আবার পাড়ার এই দুষ্ট ছেলেগুলোকে যখন আমের আঁটি আমাদের বাড়ির গাড়ি বারান্দায় দেয়াল ঘষে বিশ্ৰী দাগ দিতো বাঁশি বাজানোর জন্য, তখন আব্বা সে দাগ দেখে রেগে একেবারে অগ্নিশৰ্মা হয়ে যেতেন। কোনোদিন আব্বার সাধের হোয়াইট হাউসে ভুলেও একটি পেন্সিলের আঁচড় কাটতে পারিনি, এমনকি ছোটবেলায়ও নয়। আব্বা হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন সেই রাজমিন্ত্রি সাহেবদের। এখনও মনে আছে, সেই অতি পরিচিত নামগুলো। গনি মিন্ত্রি, রহিসউদ্দিন মিস্ত্রি, জোগানদার গোলা আর রঙ মিন্ত্রি পরশউল্লার কল্যাণে আব্বার সাধের বাড়ি সাদা ধবধবে হয়ে থাকতো বছর বছর ধরে। জন্মের পর থেকে দেখেছি বাড়ির ‘মেইনটেন্যান্স’ কাকে বলে। তাই তো আব্বাকে গভীর তৃপ্তির সাথে বলতে শুনতাম, চাঁদনি রাতে যখন আমি বাইরে থেকে আসি তখন বাড়ির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় সত্যিই কি আমি এই বাড়ি তৈরি করেছি।’ তাঁর এই গৃহনিৰ্মাণ শিল্পকর্মটি যা তিনি ইঞ্জিনিয়ারের সাহায্য ছাড়া নিজের প্ল্যানে নির্মাণ

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১২৯

 

শহীদ ডা. কসিরউদ্দীন তালুকদার

 

করেছিলেন তা তাঁর নিখুঁত স্থাপত্যের নিদর্শন হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

আব্বার শিকার করবার বাতিক ছিল। মাঝে মধ্যে আমাদের গাড়ি করে কয়েক মাইল দূরে নিয়ে যেতেন ভোরবেলায় শিকারের উদ্দেশ্যে। লক্ষ তাঁর খুব ভালো ছিল। এক গুলিতে জোড়া ঘুঘু ফেলতে পারা আব্বার জন্য নতুন কোনো বাহাদুরি ছিল না। কোনো কোনোদিন সকালবেলায় মর্নিং ওয়াকে নিতেন। আমি পা বাঁকাভাবে ফেলবার জন্য আব্বার বকা হজম করতাম আর ঝর্না সোজাভাবে হাঁটবার জন্য আব্বার বাহবা পেতো। লম্বার প্রতি তাঁর একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। তাই মাঝে মধ্যেই দেয়ালের গায়ে মাথা ঠেকিয়ে দাড় করিয়ে স্কেল ধরে দেখতেন কে বেশি লম্বা হলাম। ভালো খাবার পছন্দ থাকলেও ভোজনবিলাসী তিনি ছিলেন না; কিন্তু ডাক্তার হিসেবে স্বাস্থ্যসম্মত কথা বলেই ক্ষ্যান্ত থাকতেন না। সবসময় বলতেন, ‘পেট হলো একটা জালার মতো—যত ভরাবে ততই ভরবে, খিদে ভাব একটু থাকতেই খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে, কারণ পানির জায়গাটা রাখতে হবে। না হলে ‘স্টমাক’ ভালোভাবে ‘ফাংশান’ করবে না। নিয়মিত মধু খেতেন ও আমাদের খাওয়াতেন। বলতেন হাত পতিতে, মধু ঢেলে দিতেন হাতে, চোটে চোটে খেতাম।

আব্বার সেই বনেদি গাড়ি ড্রাইভ করতে শিখেছিলেন বড় দুই ভাই ও মেজ বোনমেজআপা চল্লিশের দশকে মাথায় স্কার্ফ বেঁধে ড্রাইভে যেতেন, আব্বাই উদ্যোক্তা। কিন্তু আমি যখন ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি তখন আব্বা হাজার ফুসলিয়েও আমাকে রাজি করাতে পারেননি। কারণ হলো তখন গাড়ির অবস্থা সম্পর্কে আমার সম্যক ধারণা জন্মে গিয়েছিল। এ গাড়ি যে একমাত্র আব্বার চালিত হতে পারে, অন্য কোনো ব্যক্তি এমনকি পালশা গ্রামের যে তিন ভাই আমাদের এ গাড়ির ড্রাইভার নিযুক্ত হয়েছিলেন। কালক্রমে ওসমান ভাই, লোকমান ভাই ও রহমান ভাই তাঁরাও গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত দিতে ভয় পেতেন। কারণ গাড়িতে চড়ার পর আমার দৃষ্টি থাকতো আব্বার দিকে (শেষ জীবনে আব্বার একটা অভ্যাস হয়েছিল, তা হলো তিনি দু’দাঁতের পাটি একত্রে চেপে ধরে মুখটাকে এদিক-ওদিক নাড়াতেন—এটা হতো যখন তিনি চুপচাপ থেকে কোনো গভীর চিন্তা করতেন বা খুব টেনশনে থাকতেনযদি গাড়ি ডাইনে কাটতে হতো অনেক ত্রস্ত হস্তে যাকে বলে সাত তাড়াতাড়ি করে (একটুখানি ডাইনে হাত ঘুরিয়ে নেয়) স্টিয়ারিংটাকে কয়েকবার ঘুরাবার পর গাড়ি ঘুরানো যেতো। তাই আব্বার কাছে গাড়ি শিখতে যাওয়ার প্রস্তাবে আমতা আমতা করে অনিচ্ছাই প্রকাশ করেছি। তাঁর মতো অমন চালক না হলেও তারই সূত্রে আমার এই পৈতৃক প্রাণের মায়া ছাড়াবার মতো ‘বোকা’ আমি ছিলাম না। আমার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল, যা না বললে তিনি যে কতটা জেদি ছিলেন তা বোঝানো যাবে না। আমাদের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাসবোধ থেকেই জন্মেছিল এক ধরনের বেপরোয়াভাব। আমরা এমন কিছু করবো না যা দেখে লোক হাসবে—এ ধরনের আস্থা বোধহয় ছিল তাঁর। ঐ সময়টায় গাড়ি না শিখলেও সাইকেল চালাবার শখ হয়েছিল-সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াবো ঠিক তা নয়, একটু চড়তে শিখব আর কি। ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে চললাম বাড়ির কাছেই রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণ পাশের খোলা বিশাল মাঠে, লোকজন নেই কোথাও, কাছে-ধারে-সঙ্গে নিয়ে গেলাম আমার ফুফুর ছেলে মন্টু ভাইকে (যিনি আমাদের সাথে একই অন্নে প্রতিপালিত) আমার গাইড হিসেবে। রাতে যথাসময়ে সবাই যখন একত্রে খেতে বসেছি ভাই বললেন, ‘তুই কি আজ মাঠে সাইকেল শিখতে গিয়েছিলি?’ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম নীরবে। আরো বললেন, তাই তো শুনলাম একজন বলেছে, ‘ডাক্তার সাহেবের মেয়েকে দেখলাম সাইকেল চালাচ্ছে। আমার বেশ মনে আছে আব্বা বলেছিলেন, ‘কাল থেকে আরো বেশি করে চালাবি।’

আব্বার সুরজ্ঞান ছিল প্রখোর- গলার ওঠানামা কোথায় ঠিকমতো হচ্ছে না তাও তিনি ধরে ফেলতেন। হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন না বলে আমাকে প্রায়ই শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন, ‘থাম, আমি শিখব হরমোনিয়াম বাজাতে।’ হলোই তাই, ছুটি উপলক্ষে সেবার ঢাকা বেড়ানো শেষ করে যখন বাড়ি ফিরলাম, আব্বার একটা আলাদা রকম খুশি খুশি ভাব চোখে পড়লো। তার যেন আর সইলো না, টানতে টানতে হাজির করলেন আমার হারমোনিয়াম। বিজ্ঞের মতো একটা খাতা হারমোনিয়ামের ওপর মেলে রেখে বললেন, ‘শোন’-‘ঝুনাকে ঝুনাকে বিছুয়া বাজেরে’-রাগভিত্তিক গানের মুখ শুধু ঐ একটি নয়, পরপর ১৬/১৭টি গানের মুখ একের পর এক বাজিয়ে গেয়ে শোনালেন। আমি তো একেবারে থএই অসম্ভব কেমন করে হয়েছে তা দেখে আমি একেবারে বোকা বনে গেলাম। এমন ‘টেকনিক’ তাঁর একান্তভাবেই অভিনব আবিষ্কার। দেখলাম হারমোনিয়ামের প্রথম রিড থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সাদা-কালো সব রিড় ১.২.৩.৪.৫ করে সংখ্যা লিখেছেন এবং গানের খাতায় যে গানগুলো তিনি একমাসে বগুড়ার প্রখ্যাত কমোডিয়ানের (প্রফেসর

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১৩০

 

শহীদ ডা. কসিরউদ্দীন তালুকদার

 

আলাউদ্দিন বলে লোকে যাঁকে জানে, তিনি রাগসঙ্গীত জানতেন) কাছ থেকে শিখেছিলেন, সে গানগুলোর প্রতিটি শব্দের নিচে নিচে কী কী নম্বরের রিড পড়ছে তা লিখে নিয়েছেন—এজন্য তাঁকে যে কত মূল্যবান স্বল্প অবসরটুকুর মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে তার প্রমাণ বাবুর্চি পণ্ডিতের কাছে পেয়ে গেলাম। খাস পশ্চিম বগুড়ার টানে নালিশের সুরে বলতে শুরু করল—‘ডাক্তার সাহেব ডিসপেনসারিতে খিনি আসেই ঐ হারসমুনি লিয়েই থাকোছে—দিনরাত হাইরে, প্যাঁ প্যাঁ কান হামার খুছে’। কর্মবীর আব্বার এই অসম্ভবকে সম্ভব করার আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টা দেখে বীরযোদ্ধা নেপোলিয়নের সেই বিখ্যাত উক্তি যা তিনি জীবন দিয়ে উপলব্ধি করে বলতে পেরেছিলেন- ‘ইম্পোসিবিল ইজ এ ওয়ার্ড হুইচ ইজ ফাউন্ড ইন দ্য ডিকশনারি অব ফুলস’ নতুন করে স্মরণ না করে পারিনি। জেনারেল ফিজিশিয়ান ছিলেন আমাদের আব্বা। কিন্তু মা থেকে শুরু করে আমি পর্যন্ত বাড়ির যতজনের পোকা খাওয়া দাঁত ছিল সবগুলোই আব্বার দ্বারাই উৎপাটিত হয়েছিল বলাই বাহুল্য। আমার সাত বছর বয়সের সেই বিশাল ঢিবির মতো ফোঁড়াটা যার দাগ আমার শরীরে স্পষ্টভাবে জ্বলজ্বল করছে-মায়ের কোলে বসিয়ে ‘কই দেখিতো কি হয়েছে’-চোখের পলকে চাকু দিয়ে দিলেন এক আঁচড়, পুঁজ আর রক্তে মায়ের শাড়িতে ঢল নেমেছিল। কেঁদেছিলাম অনেক, তবে ব্যথার কটকটানি থেকে যে কী আরাম পেয়েছিলাম তা এখনও ভুলিনি। আরেকদিন ঐ রকমই বয়স আমার ছিল তখন, নাকের ভেতর বোতাম ঢুকিয়েছিলাম-কী বিভ্ৰাট। আব্বা অস্থিরভাবে এই এত্তোবড় বিরাট এক পিচকারি হাতে নিয়ে এসে হাজির। অতবড় ইনজেকশন তো আমি কোনোদিন দেখিনি তাঁর হাতে, আমি তখন বলির পাঁঠা আর কি-মা আমাকে কোলে নিয়ে আমার মাথাটা চেপে ধরেছেন, ছোট ভাই (খিচ্চু ভাই) আমার সমস্ত শরীরটাকে চেপে ধরে আছেন মা-সমেত। আব্বা শরীরটাকে ঝঁকুনি দিয়ে যে কতবড় হাঁচির সাথে ঐ দুষ্টু বোতামটা সবার সম্মুখে টুপ করে বের করেছিলেন। তা মনে করলে আজও হাসি পায়। এমনতর কত শত সুখস্মৃতিময় ঘটনা বলে কি শেষ করা যায়?

সেই ১৯৫৮ থেকে ১৯৯২-সুদীর্ঘ প্রায় তিন যুগ ধরে গান গাইবার পেছনে কার অবদান? আমার গলার কোনো বিভ্ৰাট হলেই আব্বা বলতেন—‘তোরা বড়ই অলস, তোদের কিচ্ছু হবে না। লবণ পানি দিয়ে নিয়মিত গড়গড় করলে দেখবি অসুখই হবে না। গলার জন্য এই যতুটুকু তোদের যত আলসেমি।’ এভাবেই চলছিল বছরগুলো, তবে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই দু’তিন বছর গলা নিয়ে বিভ্রাটে পড়েছিলামছবির গান নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকতাম সে সময়, অথচ ঐ গলার মধ্যেই গাইতে হলো ‘আবির্ভাব’, ‘সন্তান’, ‘পিতাপুত্রে’র মতো আরও অনেক ছায়াছবির গান। এই মর্মে আব্বাকে যখন চিঠি লিখে জানালাম-আব্বা লিখলেন, ‘আমি তো ইএনটি স্পেশিয়ালিস্ট নই তাই ঢাকাতে চিকিৎসা করাই ভালো, ঢাকায় ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে কাজ চালাবার মতো সুস্থ হলাম কিন্তু কত জোড়াতালি দিয়ে যে উল্লিখিত গানের রেকর্ডিংয়ে অংশ নিয়েছিলাম তা একমাত্র আমিই জানি। বগুড়ায় গেলাম বেড়াতে সম্ভবত গানের প্রসঙ্গ উঠতেই আমি বললাম, ‘না গান গাওয়া আমার দ্বারা আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়। গলার এমন দুরবস্থা নিয়ে কেউ গাইতে সাহস করে, আমার তো যথেষ্ট দুঃসাহস আছে আমি বলবো’-আব্বা আমার কথার সুরে একটা অভিমানের সুর ধরতে পেরেছিলেন। তাই ঐ দিন আমরা কেউ জানিনি অথচ অনেক রাত জেগে বইপত্র ঘেঁটে এবং চিন্তাভাবনা করে আব্বা আমার ‘চিকিৎসার উপায় বের করে ফেললেন। সকালবেলা দেখা হতেই আমাকে বললেন, ‘আমি তোকে ইনজেকশন দেবো।’ আমাকে আরও বোঝালেন যে হয়তো কোনোদিন গান গেয়ে পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণে স্বল্প রক্তক্ষরণে গলায় যে দানাগুলো বেঁধেছে। তার কারণেই যখন-তখন ভেঙে যাচ্ছে। যাঁরা রাজনীতিবিদ, অতিরিক্ত কথা যাঁদের বলতে হয় তাঁদের বেলাতেও এমনটা হয়ে থাকে। ইনজেকশন দিয়ে তিনি আমার এই দানাগুলোকে লিকুফাই করে দেবেন-এই আশ্বাস দিলেন। ইনজেকশনের সেই অ্যামপুলগুলো কেন জানি ফেলিনি। যত্নের সাথে সুটকেসে করে নিয়ে এসেছিলাম ঢাকায়। তখন তো জানি না জীবনের মতো আব্বার শেষ চিকিৎসার সাক্ষ্য বহন করবে এই অ্যামপুলগুলো।

আমি তো সুস্থ হলাম কিন্তু আমার শিল্পী জীবনের স্থপতিকে হারাবার দিন যে সমাগত, তা তো বুঝিনি। ১৯৭০-এর ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর ১৯৭১-এ মানুষের তৈরি দুর্যোগে বাংলাদেশের মানুষ ঘরছাড়া হলো, ভিটেছাড়া হলো, দিশেহারা হলো। ২৫ মার্চে হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করতে গিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা আহত হলেন তাদের চিকিৎসার ভার আব্বা নিজের হাতে তুলে নিলেন। গভীর রাতেও অধীর আগ্রহে সজাগ থাকতেন পাছে তাঁদের প্রয়োজন হয়। ৬ এপ্রিল সপরিবারে বগুড়া থেকে মুরাইলে যাওয়ার পথে মানুষের দুঃখ-দুৰ্দশা দেখে গভীর ক্ষোভের সাথে বলে ওঠেন, ‘আল্লাহর কাছে হাজার শোকর, আমাকে কোনোদিন

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ১৩১

 

শহীদ ডা. কসিরউদ্দীন তালুকদার

 

পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে পা রাখতে হয়নি।’ ক’দিন পরে আবার বগুড়া ফিরে এলেন। এদিকে হানাদার বাহিনী যখন বগুড়া শহরে বোমাবাজি শুরু করলো তখন আবার যাত্রা শুরু করলেন সেই ফেলে আসা আদি নিবাসের ঠিকানায়, মহিষমুণ্ডার দিকে। মাত্র ২১ মাইলের দূরত্ব অথচ ১৬ বছর ধরে স্মৃতিবিজড়িত বাপ-দাদার ভিটে-মাটিতে আসা হয়নি। জড়িয়ে ফেলেন নিজেকে জাগতিক ব্যস্ততায়, পারিবারিক দায়দায়িত্বে যে বাড়িতে দাদাজান একবেলা অতিথিকে না খাইয়ে অন্ন স্পর্শ করতেন না সেই বাড়িতে এলেন। অতিথির মতো জীবনের শেষ ক’টি দিন খুঁটিয়ে দেখলেন গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়ি। আরও দেখলেন, লেখাপড়া শিখে কোন কোন বাড়ির ছেলে কতটুকু স্বাবলম্বী হয়েছে; গ্রামের মানুষের সার্বিক অবস্থার সবটুকুই তাঁর জানা হয়ে গেল। প্ৰাণ ভরে নিশ্বাস নিলেন, আশ্বাসে বুক ভরালেন। তিনি যেদিকেই যান, যে ধারেই হাঁটেন গাঁয়ের আবালবৃদ্ধবনিতার মিছিল তাঁকেই অনুসরণ করে। এই গ্রামের আলো হাওয়ার স্পর্শে বেড়ে ওঠা মানুষটি শহরের কত বড় ডাক্তার ও বিস্ময় যেন তাদের চোখের তারায় প্রকাশ পায়।

২২ এপ্রিল স্বার্থান্ধ, লোভী, পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী নারকীয় হত্যা, অগ্নিকাণ্ডের পৈশাচিকযজ্ঞ শুরু করে বগুড়া শহরে। আব্বার শুভ্ৰ সাদা স্থাপত্যের সাক্ষী হোয়াইট হাউস ও ডিসপেনসারি ‘দি ইউনাইটেড মেডিকেল স্টোর’ লুট, অগ্নিকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হলো। আব্বা গ্রামে বসে খবর পেলেন৪৮ বছরের বিবাহিত জীবনে মাকে নিয়ে, আমাদের নিয়ে যে স্বপ্নসাধের সংসার তাঁর গড়ে উঠেছিল তা ছারখার হয়েছে শুনে হা-হুতাশ করলেন না-দেশের মানুষের দুর্দিনে, মানুষের ছিন্নভিন্ন দশা তাঁকে নতুন আশাবাদের কথা স্মরণ করালো। ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতার সেই আবৃত্তিকার দেশের মানুষের ম্লান মূঢ়মুখে ভাষা দেয়ার জন্য, আশা দেয়ার জন্য মনস্থির করলেন বগুড়া ফিরবার। ৩ মে থেকে ১০ মে বগুড়ার কাছাকাছি গ্রাম ঘোড়াগাড়ি থেকে শহরে আসা-যাওয়া করতে লাগলেন। নিজের চোখে দেখলেন তাঁর তিলে তিলে গড়া হোয়াইট হাউসের করুণ পরিস্থিতি আর মেডিকেল স্টোরের সর্বনাশএই সেই ডিসপেনসারি যেখানে আমার গানের প্রশংসায় আব্বা বিভোর থাকতেন। আমার প্রত্যেকটি বেতার অনুষ্ঠান মন দিয়ে শুনতেন, সমালোচনা করতেন। ২১ মে মাকে নিয়ে ফিরলেন শহরে। শুধু ভাই আবু হাসান তার পরিবারসহ থেকে গেলেন গ্রামে।

২৯ মে শনিবার ‘৭১ মা যেমন বর্ণনা দিয়েছিলেন, ‘তোদের আব্বা সকালবেলায় সবে গোসল সেরেছেন, শরীরটা তাঁর একটু খারাপই ছিল, তবুও রোজাকার সেই অভ্যাসমতো পরনের লুঙ্গি-গেঞ্জি ধুয়ে মেলে দিলেন। আগের দিন হাত-পায়ের নখ কেটে পরিষ্কারভাবে গোসল করেছিলেন। সবে নাশতা পর্ব শেষ করেছেন এরি মধ্যে দু’জন যমদূতের মতো সিপাই এসে থানায় ডেকে নিয়ে গেল। বললো, ‘থানায় যেতে হবে, একটা এনকোয়ারি আছে। এখুনি ফিরে আসবেন।’ ৩১ মে পর্যন্ত মা পথ চেয়ে বসে থেকেছেন কিন্তু বিউটিফুল ডিউটিফুল ‘জির ডাক্তার সাহেব’ আর আসেননি। তাঁর ‘ডাক্তার সাহেব’ যেখানে গেছেন সেখানে যাওয়ার প্ৰস্তুতি নিয়ে তাকে বিশটা বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। তারপর হয়তোবা তাঁদের দেখা হয়েছে…জানি না।

হ্যাঁ, সেই মাঝিড়া, বগুড়ার দক্ষিণে ক্যান্টনমেন্টের সীমানায় ‘৭১-এর বধ্যভূমি। এখানে আব্বাকে সহ ১১ জনকে হত্যা করেছিল নরঘাতকরাসেই সময় যখন ওরা ধর্মকে শেষ অস্ত্র করে গান গাইয়েছিল এ দেশের শিল্পীদের দিয়ে ‘তসবিহকে দানোঁ য়্যায়সে হাম হায় সারে মুসলমাঁ’-এ দেশের মানুষ নয়, এ দেশের মানুষের বুকের রক্তে ভেজা মাটি এদের কাম্য ছিল, তাই হিংস্র থাবার নখরে আব্বার হৃৎপিণ্ডটাকে ক্ষতবিক্ষত করে মৃত্যু-যন্ত্রণা দেখতে হয়েছিল। সে ক্ষত থেকে চাপ চাপ রক্ত ঝরে সাদা শেরওয়ানিতে আঁটা রেডক্রস চিহ্নের সাথে মিলে একাকার হয়ে মানবতার প্রতীকটিকে চরম লজ্জা আর অপমানের হাত থেকে রেহাই দিয়েছিল।

গান আমি আজও গাই কিন্তু আমার সেই ভক্তটির অভাবে ডিসপেনসারির সেই ঘরটিতে আমার গানের অনুষ্ঠানের সমালোচনায় রোগীদের নিয়ে কেউ আর মুখর হয় না। ডিসপেনসারির সেই অজস্র পায়রার ঝাঁক আর বাক বাকুম করে এখন গান গায় না। কোথায় যেন সব চলে গেছে, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

ইচ্ছা ওদের পূরণ হয়নি তার আগেই আব্বা পরম শান্তিতে চোখ বন্ধ করে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়েছিলেন। চোখে দেখিনি, শুনেছি; পেছন থেকে সূচালো হয়ে বিদ্ধ দু’খানি বুলেট হৃৎপিণ্ডে যে বিরাট ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, সে ক্ষত আমার চেতনা থেকে এখনো শুকিয়ে যায়নি।

 

(লেখিকা প্রখ্যাত গায়িকা আনজুমান আরা ২৯ মে ২০০৪ পরলোক গমন করেন।)

 

 

১৩২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!