শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
যুব প্রশিক্ষণ-কর্মসূচী ও সিলেবাস | বাংলাদেশ সরকার, যুব শিবির পরিচালনা বোর্ড | …………… ১৯৭১ |
যুব প্রশিক্ষণ
কার্যক্রম পাঠ্যক্রম এবং রুটিন
যুব শিবির পরিচালনা বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত
১) নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের সাধারণ কর্মসূচী।
১. সম্ভাব্য সময়সূচীঃ
১ম – ২য় দিনঃ প্রশিক্ষণার্থীদের আগমন; নিবন্ধন; দল ও উপদলে বিভাজন।
৩য় – ১৬তম দিনঃ সকল প্রশিক্ষণার্থীদের প্রেরণামূলক প্রশিক্ষণ প্রদান।
১৭তম – ১৮তম দিনঃ প্রয়োজনমত সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগদান। স্বেচ্ছাসেবক ভিত্তি ফৌজের শপথ (সংযুক্তি দ্রষ্টব্য); পুনঃ দলগঠন।
১৯তম – ৩২তম দিনঃ ভিত্তি ফৌজের স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়মতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ প্রদান।
৩০তম – ৩৪তম দিনঃ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নির্দেশনা; ভিত্তি কর্মের দায়িত্ব বণ্টন; দলনেতা নিবন্ধন।
৩৫তম দিনঃ প্রশিক্ষণ সমাপ্তি।
২.এই ব্যবস্থার আওতায় প্রতি ১৫ দিন পর পর প্রশিক্ষণার্থীদের একটি করে নতুন দল ডাকা হবে। প্রাথমিকভাবে সবাইকেই অনুপ্রেরণামূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। পরবর্তীতে প্রয়োজনমত সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগদান করা হবে। তন্মধ্যে কেউ যদি সশস্ত্র বাহিনীতে অংশ গ্রহণ করতে না চান বা কাউকে যদি নিয়োগ দেয়া না হয়, তবে ভিত্তি কর্মের স্বেচ্ছাসেবকদের আরও দুই সপ্তাহ ব্যাপী নিয়মতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। ফলে পাঠ্যক্রমের (অনুচ্ছেদ ৬৮-৭২ দ্রষ্টব্য) অংশ দুটো যুগপৎভাবে প্রতিটি শিবিরের পর্যায়নুক্রমিক পদানুবর্তী দলগুলোকে দেয়া হবে।
৩.যাহোক, যেহেতু সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগের সংখ্যা ও সময়সূচী পরিবর্তনশীল, তাই কোন প্রকার বিজ্ঞপ্তি ব্যতিরেকেই এই সময়সূচী পরিবর্তিত হতে পারে। তাই প্রতিটি শিবিরের প্রশিক্ষণ কর্মীগণ যত দ্রুত সম্ভব যথাসম্ভব পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করবেন। তাই, অনুচ্ছেদ ৭১-৭২ যা পাঠ্যক্রমের ন্যূনতম অপরিহার্য বিষয় তা আওতাভুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
২। পাঠ্যক্রমের রূপরেখা।
– আবু ইউসুফ
ক. প্রয়োজনীয়তা ও উদ্দেশ্য
(গেরিলা যুদ্ধঃ একটি পরিপূর্ণ যুদ্ধ)
৪. কে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ করবে এবং কিভাবে?
এটা অবশ্যই স্পষ্ট যে, কোন বিদেশী শক্তি আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবে না। তারা যা কিছুই করতে পারুক বা না পারুক, যে সাহায্যই তারা দিতে পারুক বা না পারুক, আমাদের স্বাধীনতা অর্জন বা হারানো নির্ভর করবে আমাদের আত্মনির্ভরশীল প্রচেষ্টার উপর। আমাদের একাই লড়াই করতে হবে।
৫. কিন্তু, আমাদের মধ্যে কারা যুদ্ধ করবে এবং কিভাবে?
আমাদের গেরিলা যোদ্ধাদের (মুক্তি ফৌজ) রণকৌশলের মাধ্যমে পাশবিক শত্রুদের ধ্বংস করতে হলে, অবশ্যই আমাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন সর্বোচ্চ সংখ্যক তরুণ যোদ্ধা সংগ্রহ, দ্রুততম সময়ে প্রশিক্ষণ নেয়া ও অস্ত্র সংগ্রহ করা।
৬. কিন্তু, আমরা যদি আমাদের সশস্ত্র যোদ্ধাদের শুধুমাত্র ধ্বংসের প্রশিক্ষণ দেই, তাহলে তারা ঘাঁটিতে বসে বা যুদ্ধ মধ্যবর্তী বা পরবর্তী সময়ে কিংবা শত্রু ধ্বংস করার পর কি করবে? তাহলে,আমরা যদি তাদেরকে কোন গঠন মূলক কাজের প্রশিক্ষণও না দেই,তবে কি তারা সম্ভাব্য পরনির্ভরশীল,এমনকি দস্যুদলে পরিণত হবে না,যারা জনগণের ঘৃণা অর্জন করবে,‘নিরাপদ ঘাঁটি’ হারাবে এবং পর্যায়ক্রমে নিজেদের গেরিলা যুদ্ধের জন্য অযোগ্য প্রমাণ করবে? সুতরাং ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গঠন মূলক মৌলিক কাজে নিয়োজিত করা আমাদের সশস্ত্র যোদ্ধাদের জন্য অপরিহার্য।
৭. কিন্তু, অন্যান্য যেসব তরুণদের হাতে অস্ত্র দেয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই, তাদের ব্যপারে কি করা যায়? আমরা কি তাদের যুদ্ধোদ্যমকে হতাশা এমনকি সম্ভাব্য স্ববিরোধীতায় রূপান্তরিত হতে দেব? আমরা কি ক্যাম্পকর্মী হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের যুদ্ধ প্রচেষ্টার সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর অগ্ররক্ষী ও পশ্চাৎরক্ষী হিসেবে কাজ করে ঘাঁটিকে নিরাপদ ও প্রস্তুত রাখার জন্য তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করব না?
৮. কিন্তু, বাংলাদেশের বাকি জনগণের করনীয় কি? আমাদের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় তাদের কি কোন সক্রিয় ভূমিকা নেই? তারা কি কেবল অসহায় ভাবে আমাদের সশস্ত্র যোদ্ধাদের ওপর নির্ভর করে নিরাপদ স্থানে নিস্ক্রিয় হয়ে থাকবে? এভাবে আসলেই কি গ্রামবাসীরা নিরাপদে থাকতে পারবে? প্রতিবাদের ভাষা ……… কিংবা ক্যাম্প কর্মীদের কাছ থেকে, কোন কিছুতেই কিছু হবে না। কারন, আমাদের শত্রুরা হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের সীমাহীন নৃশংসতা এখনো বন্ধ করছে না। বরং দাসত্ব বরণের বিরুদ্ধে জনগণের সর্বশেষ প্রতিরোধ ব্যর্থ করার জন্য আর্থ সামাজিক কৌশল হিসেবে অনাচার ও দুর্ভিক্ষ এই দ্বিমুখী বিপদকে ঠাণ্ডা মাথায় ব্যবহার করছে ।
৯. একটি গ্রাম যদি অন্ততপক্ষে খাদ্য ও সমাজশৃঙ্খলা,অল্পতম সরলীকরণযোগ্য সামাজিক জীবন,শত্রুর করুণা,ত্রাণ বা সুরক্ষা ভিক্ষা ছাড়া নিজেকে বজায় রাখতে পারে কেবল তাহলেই নিরাপদ ভূমি হিসেবে কাজ করতে পারে। অর্জনযোগ্য মান যাই হোক না কেন আমাদের গ্রামবাসীরা আইন-শৃঙ্খলার জন্য শত্রুর আমলাতন্ত্র বা জীবনযাপনের জন্য তার অর্থ প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর ছাড়া শুধুমাত্র খাদ্য এবং নিরাপত্তার জন্য অদম্য ইচ্ছার মাধ্যমে গ্রাম্য পঞ্চায়েতে শ্রম,সহযোগিতা ও শৃঙ্খলা সর্বাধিক কার্যকারী করণের মাধ্যমে অনুমেয়ভাবে তা করতে পারে।
১০. এবং একবার যখন গ্রামবাসীরা অদম্য সাহসকে ঢালের মত কাজে লাগিয়ে শত্রুপক্ষের পরোক্ষ অস্ত্র হতে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে,তারা শুধুমাত্র শত্রু হানাদার বাহিনীর দখলের বাইরে একটি নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবেই না বরং অর্থনৈতিক যুদ্ধে শত্রুর বিরুদ্ধে মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে সবচেয়ে কার্যকরী যোদ্ধা হবেন।
১১. শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের সমস্ত মানব সম্পদের সক্রিয় যোগদান নিশ্চিতকরণের জন্য সংশয়াতীত আত্মনির্ভরশীল গ্রাম্য ভূমির সক্রিয়করণ আমাদের বর্তমানের মূল যুদ্ধ প্রচেষ্টা হিসেবে প্রয়োজন।
১২. “স্বাধীন বাংলা বেতার” কে অবশ্যই ক্রমাগত উন্নতি করতে হবে এবং সেদিকে জোরদার প্রচেষ্টা চালাতে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু শুধুমাত্র শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শ্রমিক, গ্রাম্য জীবনের জ্ঞানে জ্ঞানী,শত্রুর কুমন্ত্রণার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে উৎসাহ,পথপ্রদর্শন এবং দৈনন্দিন আত্মনির্ভরশীলতায় সক্রিয় করতে সক্ষম হবে এরকম লোক দরকার।
১৩. সামগ্রিক যুদ্ধের প্রেক্ষিতে যুব শিবির পরিচালনা প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বিদ্যমান সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সাথে এরকম কর্মীদের নিয়ে একটি বাহিনী (ভিত্তি ফৌজ) সৃষ্টি করা। যাতে করে আমরা একই সাথে শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করার পাশাপাশি আমাদের সামাজিক ভিত্তি মজবুত করতে পারি এবং এইবারে আমরা শুধু নামেই জেতার জন্য না, সামগ্রিক ভাবে জিততেই যুদ্ধে নামবো।
খ. ব্যবহারিক কাজ
প্রশিক্ষকদের জন্য টীকা
১৪. প্রাথমিকভাবে এই সিলেবাস পুরোপুরিভাবে ব্যবহারিক কাজের জন্য,কারণ এটি একটি মাত্র ভিত্তির উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। তা হল শুধুমাত্র গঠনমূলক কাজের জন্য নিবিড় শ্রমের মধ্য দিয়ে আসতে পারে সহযোগীতা,শৃঙ্খলা এবং অকপটতা যা এমন এক স্তম্ভ যার উপর একটি আর্থ-সামাজিকভাবে স্বয়ংসম্পুর্ন সমাজ তৈরির জন্যে অদম্য ইচ্ছা জাগতে পারে কেননা স্বাধীনতা হিসেবে যুদ্ধ অথবা শান্তির মধ্য দিয়ে কল্যাণের জন্য বজায় থাকতে পারে।
১৫. প্রশিক্ষণ কোর্সের প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রশিক্ষণার্থীদের সক্রিয় করা-এমন কাজ করার জন্য, নিছক এমন কাজ করার জন্য তাদের অনুপ্রাণিত করতে না। তাই প্রশিক্ষিত সদস্যরা যাতে বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রামবাসীদের একই রকমভাবে কাজ করার জন্য সক্রিয় করতে পারে, কোর্সের মূল উদ্দেশ্য সেটাই। অন্য কথায়,প্রশিক্ষিত সদস্যদের যুদ্ধ ও শান্তির প্রাথমিক অস্ত্র হিসেবে অবশ্যই গঠনমূলক কাজে শ্রম দেবার অভ্যাস থাকতে হবে। তার হাতে গঠনমূলক শ্রমের অভ্যাস থাকতে হবে। এটির একমাত্র উদ্দেশ্য হল তার কথাগুলো যেন শ্রোতার হৃদয়ে অনুপ্রেরণার জন্ম দেয় মস্তিষ্কে কাজ করার পদ্ধতির ধারণা তৈরি হয়।
১৬. প্রথমেই,কায়িক শ্রম করলে শিক্ষিতদের মর্যাদার হানী হবে এরূপ প্রচলিত বাঙালী অনুভূতি ভাঙতে হবে। প্রশিক্ষণদাতা “কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে” কাজ করা এবং “যৌথ উদ্যোগের” উদ্দীপনার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারেন নিজেই। কোর্সের শেষে প্রশিক্ষণার্থীকে অনুভব করাতে হবে যে প্রাথমিক শ্রম হিসেবে কায়িক শ্রম ছাড়া কিছুই অর্জিত হবে না এবং এই কায়িক শ্রমের প্রতি অনীহা আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এবং এটি করা সম্ভব হবে শুধুমাত্র যদি প্রশিক্ষণদাতারা দূরে দাড়িয়ে শুধু কথা না বলে প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে একত্রে কাজ এবং কথার মাধ্যমে তাদের প্রচেষ্টার উপর নিবেদিত থাকে।
১৭. ব্যবহারিক কাজসমূহ ( বিস্তারিত এর জন্য অনুচ্ছেদ ৭১ দেখুন)
১. সারিবদ্ধ থাকা।
২. শারীরিক প্রশিক্ষণ।
৩. পরিচ্ছন্নতা।
৪. ক্যাম্পের কাজ।
৫. গ্রামীণ কৃষি চর্চা ( ক্যাম্পে যা কিছুই প্রশিক্ষণযোগ্য আছে তা করা, এবং গ্রামে অন্যান্য সম্ভাবনাগুলো নিয়ে আলোচনা করা)।
৬. গ্রামীণ শিল্পকলা, কারুশিল্প, দক্ষতা এবং শিল্প (উপরপর মতই)।
৭. স্বনির্ভরতা অনুশীলন।
৮. স্বায়ত্বশাসণ প্রশিক্ষণ।
৯. গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও যোগাযোগ ( যেমন ব্যবস্থা করা যেতে পারে)।
১০. ছোট অস্ত্র ব্যবহার ( উপরের মত)
১৮. দলবদ্ধ কর্মের জন্য দলীয় নীতি
চেতন বা অবচেতন মনে উপরোক্ত কর্মপদ্ধতি ও নিয়মনীতি মেনে নেয়া ও অনুসরণ করার ইচ্ছা প্রত্যেক প্রশিক্ষনার্থীর মধ্যে জাগ্রত করতে হবেঃ
১. আমরা যুদ্ধেরর মধ্যে আছি। কঠোর শৃঙ্খলা ছাড়া আমরা লড়াই করতে পারবো না বা জয়ী হতে পারবো না। আমাদের অংশে শৃঙ্খলার সামান্যতম শিথিলকরণ হতে পারে শত্রুদের অস্ত্রের সমান ভয়ঙ্কর।
২. কিভাবে একজন নেতা তৈরি হয় অথবা সময়ে সময়ে নেতাকে কেন পরিবর্তিত করা হয়? এর পিছনে যে কারণই থাকুক না কেন, একই সময়ে সবাই নেতা হতে পারে না। একটা সময়ে শুধুমাত্র একজন নেতা থাকবে এবং তাকেই অনুসরণ করতে হবে।
৩. যতক্ষণ সম্ভব গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু একবার কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এর বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য।
৪. কোনটা বাস্তবায়ন করতে হবে তা জানা উচিত। শুধুমাত্র “কাজ করা”র জন্য না করে লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে কাজ করা উচিত।
৫. উন্নতির পরামর্শ ব্যতীত সমালোচনা করবে না। আজকে আমরা সবাই নিজেদের কষ্টের জন্য দায়ী। ভবিষ্যৎ উত্তম হবে যদি আমরা সবাই সহযোগীতা করতে পারি।
৬. প্রথমে পালন কর,পরে তর্ক কর। আমাদের একটা যুদ্ধ জিততে হবে,বিতর্ক নয়।
৭. অন্যদের সাহায্য কর,কিন্তু কারো কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।
৮. কোন কাজ অন্য কেউ করার জন্য অপেক্ষা করবে না। যদি তুমি এটি নিজে করতে পারো,তবে করে ফেল।
৯. আটকে থেক না,বের হবার চেষ্টা কর।
গ. ভাষণ
প্রশিক্ষকদের জন্য ভাষণ
১৯. প্রশিক্ষনার্থীদের কর্মপদ্ধতিকে উৎকর্ষ করতে এবং যুদ্ধের আবশ্যক ধ্বংসকে প্রাধান্য না দেয়ার ধারণা দিতে বিভিন্ন কাজের বিরতির ফাকে ফাকে লেকচারগুলো দেয়া হবে। নিম্নোক্ত পয়েন্টগুলোর এক বা একাধিক হতে পারে লেকচারের বিষয়ঃ
ক. জাতি এবং ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালী জাতীয়তাবাদের গর্ব শেখ মুজিব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
খ. বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভালবাসাই দেশের কল্যাণের একমাত্র কারণ এবং তা করা সম্ভব স্বাধীনতার মাধ্যমে।
গ. অসভ্য শত্রুদের জন্য ঘৃণা যারা মানব সভ্যতার জন্য একটি কলঙ্ক।
ঘ. বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষের যুদ্ধ সম্পর্কে এবং ভিত্তি ফৌজ ও মুক্তি ফৌজের অসাধারণ ভূমিকার বর্ণনা। ভিত্তি ফৌজ সদস্য হিসেবে দেশের কল্যাণের জন্য প্রত্যেক মানুষের ভূমিকা।
ঙ) বাংলাদেশের মানুষদের স্বাধীনতার মাধ্যমে self sustained গ্রাম্য ঘাটির আমাদের আত্মনির্ভরশীল সংগ্রামের প্রতি নিবেদন।। (‘প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে দূর্গ গড়ে তোলো’-শেখ মুজিব)
২০. কোর্সের মূল উদ্দেশ্য সাধনের নূন্যতম চাহিদা হিসেবে ৭২ নং অনুচ্ছেদে লেকচারের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের নির্দিষ্ট রেফারেন্সসহ মূলকথা গুলো বলা আছে। সময় সাপেক্ষে আগ্রহী প্রশিক্ষণার্থীদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হবে। কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতিতে লেকচারগুলো এমন ভাষায় দিতে হবে যাতে এগুলো প্রশিক্ষণার্থীদের শুধু তত্ত্বীয় প্রেরণাই যোগাবে না বরং সবার সাথে মিশে একত্রে কাজ করার ইচ্ছা জাগাবে এবং এটা অবিলম্বে করতে হবে।
ক। সূচনা
২১. আমরা এখানে আমাদের আমাদের এলাকার মানুষের ভয় দূর করার জন্য আসিনি, বরং আমাদের উপর বর্তানো যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য এসেছি। এটি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল প্রকৃত বাংলাদেশীদের সর্বাত্মক যুদ্ধ। আমাদের একজন নেতা- শেখ মুজিব,একটাই শ্লোগান-জয় বাংলা,এবং একটাই কারণ- বাংলাদেশের মানুষদের স্বাধীনতার মাধ্যমে কল্যাণ করা।
২২. এই যুদ্ধ আমাদের হৃদয় এবং আবাসে, যা লড়তে হবে এবং জিততে হবে। যত মুহূর্ত আমরা দেরী করবো,ততই আমাদের ভাই বোনদের হত্যা,পোড়ানো,অপহরণ ও ধর্ষন করা হবে,ততই আমাদের স্বাধীনতা হারিয়ে যাবে,এবং ততই আমাদের সামাজিক ভিত্তি ধ্বংস করা হবে।
খ) শত্রু
(১) তাদের অমানবিকতাঃ
২৩। সমগ্র মানব সভ্যতার সবচেয়ে খারাপ শত্রুদের সমস্ত পাশবিকতার চেয়েও জঘন্যতম। অপ্রতিরোধ্য নিষ্ঠুরতা, অনৈতিকতা ও বর্বরতা; গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, বুদ্ধিজীবী ও যুব জনশূন্যতা; প্রকাশ্য ধর্ষণ, নির্যাতন ও অমানবীকরণ; দুর্ভিক্ষ ও অনাচার কে অস্বীকার; আমাদেরকে তাদের অর্ধমানবিক দাস ও বেশ্যায় পরিণত করে আমাদের সমাজকে ধংস করার জন্য ঠান্ডা মাথায় এই সব এ ছাড় দিচ্ছে।
(২) তাৎক্ষণিক পটভূমিঃ তাদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং রাষ্ট্রদ্রোহীতাঃ
২৪। ইয়াহিয়া নিজেই নির্বাচন পরিচালনা করেন যা শেখ মুজিবের খোলাখুলি ঘোষিত ছয় দফার উপর ভিত্তি করে যাতে শুধুমাত্র বাংলার নয় পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্যেও সমঅধিকার নিশ্চিত করে। তখন ছয় দফার দেশপ্রেম নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। যখন ছয়দফা প্রতিষ্ঠিত হয় একটি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নিরঙ্কুশ জাতীয় দাবী হিসাবে,ইয়াহিয়া নিজেই তখন নির্বাচনকে “সুষ্ঠু ও অবাধ” হিসেবে ঘোষনা দেন কারন তখন বৈধভাবে জাতীয়তার বন্ধনে বাঁধা পরে পুরো জাতি,যদি নাগরিকদের এক জাতী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইয়াহিয়া নিজেই শেখ মুজিবের প্রশংসা করে সমগ্র পাকিস্তান এর ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্বোধন করেন।
২৫। কিন্তু এম এম আহমেদ-হামিদ-ভুট্টো-ইয়াহিয়া গোপনে দুর্ধর্ষ চক্রান্ত চালায় এই জাতীয় দাবীকে সহিংস উৎখাতের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য। সংসদীয় অধিবেশনে বিলম্ব,অতপর স্থগিত;অপ্রয়োজনীয় গোলটেবিল বৈঠকের শুরু করা;এসবই ছিল সামরিক প্রস্তুতিকে আড়াল করার জন্য। তারপর,যখন শেখ মুজিব এর অধীনে কথিত অন্তর্বর্তী সরকার এর কাজ শুরু করার কথা, তখনি হঠাৎ কোনপ্রকার আগাম সতর্কতা ছাড়াই বাংলাদেশের উপর চালানো হলো এক নৃশংস গণহত্যা। জাতীয় দাবীর লঙ্ঘন একটি সর্বোচ্চ বিশ্বাসঘাতকতা,দেশবাসীর উপর কসাইয়ের মতো অতর্কিত আক্রমণ শুধু সর্বোচ্চ স্তরের বিশ্বাসঘাতকতাই নয় অত্যন্ত নীচু মাপের অমানবিকতা। গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠদের উপর বর্বরোচিত এই হামলার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর জাতি একতা,অখণ্ডতা এবং অখন্ড পাকিস্তানের অস্তিত্বকে চিরতরে শেষ করে দিয়েছে।
২৬। ভারতীয় ‘অনুপ্রবেশকারী’,’হিন্দু আধিপত্য’এবং ‘ইসলামী সংহতির’ সম্পর্কে বর্তমান ডাহা মিথ্যার যে অপপ্রচার তা ২৬শে মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া কর্তৃক অধিবেশন পেছানোকে ঢাকতেই করা হয়েছে। পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদের ভিত্তিকে তারা নিজেরা ধ্বংস করে দেয়ার পর,তারা এখনপাকিস্তানের অখণ্ডতার নাম করে আমাদের হত্যা করছে। ইসলামের নামে বাঙালি মুসলমানদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তারা ইসলাম ধর্মকেই চিরদিনের জন্য লজ্জিত করেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তার সংখ্যাগুরুকেই ‘আভ্যন্তরীণ ব্যাপার’হিসেবে উল্লেখ করছে। সশস্ত্র গুন্ডাদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হাজার হাজার নারী এবং শিশু সহ নিরস্ত্র ও অসহায় মানুষদের ‘দুর্বৃত্ত’বলে ডাকা হচ্ছে। ‘বাংলাদেশের জন্য ত্রাণ’ নামে আমাদের ধ্বংসের পায়তারা করা হচ্ছে।
(গ) পাকিস্তান এর পটভূমিঃ তার শোষণ এবং মিথ্যাচারঃ
২৭। ভারতের সম্ভাব্য অবিচারের ভয়ে বাঙালি মুসলমানেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ন্যায় বিচারের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি জমিদার-পুঁজিবাদী-আমলাতান্ত্রিক অক্ষশক্তি বাংলাদেশকে শোষণ করার মাধ্যমে শৃঙ্খলিত দাসে পরিনত করতে ষড়যন্ত্র করে এবং সেজন্য ন্যায়বিচার হতে বাঙ্গালীদের বঞ্চিত করেছে (বাংলার বিশ্বাসঘাতকদের সম্মতি নিয়ে)।ইসলাম ও অখন্ডতার ছদ্মবেশে রাজনৈতিক-অবিচার,অর্থনৈতিক শোষণ এবং সাংস্কৃতিক দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে রেখেছিল। কিছু অক্ষশক্তির মদত এই অমানবিক আগ্রাসন যুদ্ধের পেছনে রয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে রয়েছে তস্করের ঐক্য,সাম্রাজ্যবাদ বন্দুকের ডগায় তাদের নগ্ন দুষ্কর্ম চালায়।
গ) যেভাবে সে দুঃসাহস পেয়েছেঃ
(১) অপরিণামদর্শী পরনির্ভরশীলতা।
২৮। শত্রুপক্ষ মানব সভ্যতার সমস্ত বিধি লঙ্ঘনের দুঃসাহসই শুধু করেনি এমনকি তাদের দুষ্কর্মের দায়ভার চাপিয়েছে আমাদের উপরেই,কারন তারা ভেবেছিলো আমরা শুধু সামরিক অভিযানের জন্যই অপ্রস্তুত ছিলাম না বরং আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও মানসিক অপ্রস্তুতিকে আমাদেরই বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে আমাদের উপরে তারা দখল চালাবে। আমরা অন্যের উপর নির্ভর করি,কাজেকর্মে, কথাবার্তায়,নির্বাচনী মনোনয়নে,আন্দোলনে,হুমকি-ধমকিতে এবং এমনকি আমাদের নিজেদের জীবন দিতেও,কিন্তু অন্যদের কাজ করার জন্য অপেক্ষা করি।
(২) বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসঃ
২৯। পাকিস্তান (৪৭), ভাষা (৫২), যুক্তফ্রন্ট (৫৪), সাংবিধানিক সমানাধিকার (৫৬), গণঅভ্যুত্থান (৬৯)। কিভাবে ধারাবাহিক সমস্যাবলীর সমাধান করতে হয় তা নির্ণয়ে বাঙালীর অক্ষমতার কারনে এগুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের বিজয় ‘মুকুট’ পরিণত হয়েছিল একটি শোচনীয় পরাজয়ে। বিশ্বাসঘাতকদের ভূমিকা এবং তাদের শাস্তিদানে আমাদের গড়িমসিও অন্যতম কারণ। এমনকি এখনও অনেক বিশ্বাসঘাতক,অন্তঃশত্রু,এবং সুবিধাবাদী আছে যাদের শাস্তি দেয়া যায়নি। সম্ভবত আমরাই শ্রেষ্ঠ মানব জাতি যারা বারবার কল্যাণের ডাকে ব্যাপক আকারে উজ্জীবিত হয়েছে; তারা ভোট দিয়েছে,আন্দোলন করেছে এবং প্রয়োজনে জীবনও দিয়েছে;কিন্তু তারা বারবার বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে এবং বারংবার হতাশ হয়েছে কারণ কেউ তাদেরকে বলেনি কিভাবে আগাতে হবে।
৩০। সাময়িক ঐক্যই ছিল এই পর্যন্ত আমাদের একমাত্র শক্তি,কিন্তু নিয়মিত সুশৃঙ্খল কর্মের মাধ্যমে সমাধান বাস্তবায়িত না হলে তা শুণ্যই থেকে যায়। আমরা এই কাজের জন্য অন্যদের ওপর নির্ভরশীল হয়েছি এবং এই সুযোগে বেঈমান,অন্তঃশত্রু এবং বিশ্বাসঘাতকেরা দুষ্কর্মের মাধ্যমে শক্রকে সাহায্য করতে আমাদের সংকল্পকে নস্যাৎ করার চেষ্টায় উদিত হয়েছে। শত্রু এদের উপর নির্ভর করছে আর আমরা নির্মূল হচ্ছি।
ঘ) যেভাবে আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি
(১) আমাদের কি ইয়াহিয়া উপর নির্ভর করে এবং তার সাথে নিষ্পত্তি করা উচিত?(বা তার সমতুল্য)
৩০। ইয়াহিয়ার কাছে প্রাণভিক্ষা বা আপোষ করলেও আমাদের জীবনের অনাবশ্যক কষ্টের শেষ হবে না। বাঙ্গালীরা কি এই অমানুষিক দাসত্ব ও পতিতাবৃত্তির মধ্যে বেঁচে থাকতে পারবে? পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ এখন চিরতরে শেষ। বাঙ্গালীরা কি চতুর্থ শ্রেণীর ভূমিদাসদের মতো পাঞ্জাবিদের মনোরঞ্জন করে,অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানীদের,অন্যান্য অবাঙ্গালীদের,এবং বাঙ্গালী নিষ্ঠুর উচ্চশ্রেণীর অধীনস্থ হিসেবে বসবাস করতে পারবে?
(২) আমাদের কি শুধু বিদেশী শক্তির উপর নির্ভর করা উচিত?
৩২। বিদেশীরা হয়ত আক্রান্ত মানুষের অন্তর্বেদনায় সহানুভূতি দিতে পারে,কিন্তু বিদেশি সরকারগুলোর নিছক নৈতিকতার মূলনীতির উপর চলে না। যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানের গণতন্ত্র বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে না বা যুক্তরাজ্য কাজ করে না সংসদীয় প্রক্রিয়ার জন্য বা চীন পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তির জন্য কাজ করে না। সরকারগুলো বিশ্ব ক্ষমতার রাজনীতির অংশ হিসেবে তাদের নিজেদের স্বার্থে কাজ করে। ক্ষমতাহীন জাতিসংঘ সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভাল। যতক্ষণ না আমরা নিজেরা শক্তিশালী অবস্থান থেকে কথা না বলতে পারছি, ততদিন বৈদেশিক শক্তি আমাদের জন্য দৃঢ়ভাবে কাজ করার সম্ভাবনা কম। শত্রুপক্ষের একটি সৈন্যও দেশে থাকা পর্যন্ত একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখবে, আমরা তাদের কাছ থেকে খুব বেশী হলে এটুকু আশা করতে পারি।
(ঙ) আমাদের কি শুধু নিজস্ব সশস্ত্র যোদ্ধাদের উপরই নির্ভর করা উচিত?
৩৩। তাদের অদম্য বীরত্ব সত্ত্বেও,আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সুসজ্জিত হচ্ছে। এটা শত্রুর রক্ত ঝরানোর জন্য যা যথেষ্ট,কিন্তু বিভিন্ন সরঞ্জামে সুসজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে এটা সামঞ্জস্যহীন এবং সত্যিকার অর্থে কোন শক্তিশালী অবস্থান আমরা তৈরি করতে পারব না।
(৪) সফল বিপ্লব থেকে শিক্ষাগ্রহণঃ
৩৪। শুধু সশস্ত্র অভিযান দ্বারা কখনও কোন বিপ্লবই সফল হয়নি। প্রথম প্রচেষ্টায় ফরাসি বিপ্লবও শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ ছিল। এটা চীন বা ভিয়েতনাম বা আলজেরিয়া বা কিউবা যাই হোক না কেন, বিপ্লব শুধুমাত্র তখনই আনুপাতিক সফলতা পেয়েছে যখন সাধারণ মানুষ সশস্ত্র যোদ্ধাদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে গঠনমূলকভাবে কাজ করেছে। এই ধরণের বোঝাপড়া ছাড়া গেরিলা যুদ্ধ সম্ভব না। আমাদেরও ঠিক একই কাজ করতে হবে।
(৫) আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশের মানুষের সর্বাত্মক যুদ্ধঃ
৩৫। শত্রুপক্ষ পররাষ্ট্রনীতিতে শক্তিশালী কারন তারা সমরনীতিতে শক্তিধর। কিন্তু এই শক্তিশালী অস্ত্রের মূলে, অর্থনৈতিক ভাবে শত্রুপক্ষ অত্যন্ত দুর্বল কারণ তারা অত্যাবশ্যকরূপে বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল, এমনকি যখন তারা আমাদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত তখনও। সাম্রাজ্যবাদী সরকার চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন তাদের অনির্দিষ্টকাল অর্থায়ন করবে না। অতএব,যদি আমরা আমাদের পররাষ্ট্র ও সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মসংস্থান করি,তাহলে আমাদের জনগণের সাথে তাদের একটি অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হবে যাতে আমরা শুধু তাদের পরাজিতই করতে পারব তা না বরং পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের ভিত্তিও নড়ে যাবে। আমাদের যা করতে হবে তা হল, যে অর্থনৈতিক অসহযোগ শেখ মুজিব দ্বারা শুরু হয়েছিলো, জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে শত্রুদের চালানো পাশবিক অত্যাচারকে অগ্রাহ্য করেই শত্রুর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য। কারণ এই অর্থনৈতিক যুদ্ধই হচ্ছে শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের সবথেকে মারাত্মক অস্ত্র।
(৬) শত্রু কৌশলঃ
৩৬। কিন্তু, এসকল পাশবিক উন্মাদনার মধ্যে আমাদের জনগণের এই অর্থনৈতিক যুদ্ধ মোকাবিলা করার জন্য শত্রুপক্ষ এক অসৎ রণকৌশল অবলম্বন করছে। রাজধানী এবং শহরগুলিতে আমলাতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক নির্দেশনাকেন্দ্রগুলো শত্রুপক্ষ দখল করে নিয়েছে। তারা জানে গ্রাম বাংলার শস্যক্ষেত্র সরাসরি তারা দখল করতে পারবে না, তাই তারা এসবের দখল নেবার জন্য দ্বিমুখী আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে। তারা দুর্ভিক্ষ তৈরি করার জন্য কৌশলে আমাদের খাদ্যশস্য ধ্বংস করছে এবং শত্রুদের গুপ্তচরের কাজ করা কিছু বিশ্বাসঘাতকের আশ্রয়ে থাকা কিছু চোর ডাকাত সহ অন্যান্য নিচুস্তরের মানুষের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সামাজিক অনাচার তৈরি করে তারা আমাদের ধ্বংসের এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া তৈরি করতে চাচ্ছে।
৩৭। তাদের সব সন্ত্রাস ও আতঙ্কের মধ্যে আমাদের জনসাধারণ খাদ্য ও অভ্যন্তরীণ সামাজিক শৃঙ্খলা হতে বঞ্চিত হচ্ছে,যে দুটোই মানবসমাজের টিকে থাকার জন্যে অপরিহার্য। শত্রুপক্ষ আশা করে যে, সমাজের এরকম ধ্বংস দেখে নিজেরাই আবার স্বভাববশত অন্যের উপরে নির্ভরশীল অবস্থায় ফিরে যেতে চাইবে এবং “আইন,শাসন ও ত্রাণ” এর জন্য শত্রু নিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। আর এভাবেই তারা আরও একবার বন্দি হয়ে যাবে আমলাতান্ত্রিক অবিচারের দাসত্বে এবং শত্রুপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আর্থিক শোষণ ব্যবস্থায়।
৩৮। এমনকি যদি আমাদের জনগণ শেখ মুজিবের বার্তা ভুলে গিয়ে দাসত্ব মেনেও নেয়, শত্রু ইতিমধ্যে আমাদের অর্থনৈতিক উপরিকাঠামো এতটাই ধ্বংস করেছে যে সেই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য শীঘ্রই ফিরে পেতে পর্যাপ্ত পুনর্নির্মাণের কাজ করতে হবে। যেন উম্মাদনার চিন্তা দ্বারা তারা আমাদের সমাজে আবির্ভূত হয়েছে প্রতিশোধপরায়ণ ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে যা তৈরি করবে আরো আরো দুর্ভিক্ষ,অনাচার এবং অবমূল্যায়ন। কাজেই তারা যখন চলে যাবে হয়ত পিছনে বাঙ্গালিদের মধ্যে রেখে যাবে এক ঝাঁক অমানুষ।
(৭) আসল শত্রুঃ
৩৯। একটি জাতি হিসেবে গুরুতর বিপদের সময়েও আমাদের প্রধান শত্রু সুসজ্জিত বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মি না বরং সেই আদিম কালের সামাজিক কীট যারা এখন শত্রুদের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছে। এরা অতীতে আমাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকদের সাথে মিলে তাদের সমর্থক হয়ে আমাদের উদ্দেশ্যকে ধ্বংস করেছে।
৪০। শত্রুপক্ষ এবং তাদের দালাল-গুপ্তচরেরা তাদের সাফল্যের জন্য যতটুকু না তাদের সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে,তারচেয়ে বেশি নির্ভর করে আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীলতার মারাত্মক অভ্যাসের উপর, এক্ষেত্রে “আইন,শৃংখলা ও ত্রাণ” এর জন্য “উপরমহলের” আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের উপর নির্ভরশীলতা। এই মারাত্মক অভ্যাসই আমাদের আসল শত্রু।
(৮) স্বাবলম্বনঃ
৪১। কিন্তু এখন পর্যন্ত শুধু নিছক আমাদের স্বাধীনতাই ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি বরং সমাজও ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমাদের বাংলাদেশের মানুষদের উচিৎ অন্যের কাজের উপর এই সর্বনাশা নির্ভরশীলতা ছেড়ে দিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা,যেন আমাদের সামাজিক ভিত্তির এই প্রাণঘাতী শত্রুদের আগাছার মতো উপড়ে ফেলা যায়। এতেই আমাদের জাতীয় জীবন বাঁচবে।
৪২। কিন্তু এই গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র দেশপ্রেমিকদের অসংগঠিত ও অনিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হবে না, কারণ এই বিপথগামী পদক্ষেপগুলো অন্যান্য পথগুলোর মতোই আইনবিরোধী ও অসহনীয় হবে। এমন শাস্তিমূলক পদক্ষেপকে সত্যিকার অর্থে ফলদায়ক করতে হলে সার্বজনীন কারো অনুমোদন দরকার। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার (চাইলেও) এর আমলাতান্ত্রিক “অনুমোদন” জারি করতে পারে না কারণ মুক্তিফৌজ এখনো শত্রুপক্ষকে তাড়িয়ে দিতে পারছে না।
৪৩। এখন একটি সহজ উপায় হচ্ছে শত্রুদের নজরদারির বাইরে থাকা আমাদের গ্রামগুলোতে যতদুর সম্ভব অভ্যন্তরীণ শৃংখলা সংরক্ষণ করা। আমাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে আমাদের প্রাচীন গ্রামগুলোর পঞ্চায়েতকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং এর “শৃংখলা” জোরদার করা যেন চোর ও ডাকাতদের প্রতিরোধ করা যায় এবং গুপ্তচরদের কার্যকরীভাবে দমন করে সম্ভাব্য শত্রুদের আশ্রয় থেকে তাদের বঞ্চিত করতে হবে যেন তাদের শাসন করে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরানো যায়।
৪৪। আর পঞ্চায়েত প্রশাসন থেকে আমাদের সমাজমূলে প্রাপ্ত শৃংখলা ও নিরাপত্তার সাথে স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছাসহ আমাদের গ্রামবাসীরা (অন্তত যারা শত্রুদের নজরদারির বাইরে) সর্বোচ্চ খাদ্য উৎপাদনের জন্য তাদের শ্রম ও সহযোগিতাকে একত্রিত করতে পারে (একে অন্যের প্রতি সামাজিক সৌজন্যতার সাথে) এবং শত্রুপক্ষের শিকার হওয়া ছাড়াই নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে পারে (যদি তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ না-ও হয়)। এখানে নিঃসন্দেহে অনেক কষ্ট হবে। বিভিন্ন উদ্ভাবনী পন্থায় দেশীয় মাধ্যম এবং পদ্ধতি ব্যবহার করে আঞ্চলিক পণ্য সমৃদ্ধ ও বহুমুখীকরণের মাধ্যমে আমাদের মানুষেরা রুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।এছাড়াও যেসকল পণ্য গ্রামে উৎপাদন করা সম্ভব না এমনকি আশেপাশের এলাকা হতেও পাওয়া সম্ভব নয় সেগুলোর জন্যেও এই উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে আসবে।
৪৫। যুদ্ধকালীন প্রস্তুতির সময়ে শেখ মুজিব এর বলা “ঘরে ঘরে দুর্গ” আমরা আমাদের গড়তে পারি শুধু একটি মাত্র উপায়ে, তা হল আর্থ-সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে, যা আমাদের শাশ্বত স্বাধীনতার বীজস্বরূপ।
(৯) গ্রাম ইউনিটঃ
৪৬। প্রাথমিকভাবে গ্রামই হবে এসব কাজের মৌলিক ইউনিট কারন দৈনন্দিন (এসব কাজের ব্যবস্থাপনা এবং পর্যবেক্ষন) ব্যবস্থাপনা এবং এসব কাজ, সহযোগিতা এবং শৃঙ্খলার উপর নজরদারি গ্রামের চেয়ে বড় কোনো ইউনিটে সহজসাধ্য হবে না, যা আমাদের সমাজের মৌলিক, চলমান এবং অবিভক্ত একক। অনান্য ইউনিটগুলো ( ইউনিয়ন,থানা ইত্যাদি) শুধুমাত্র গ্রামগুলোর প্রশাসনিক জোট এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে,সেগুলো এখন শত্রু কবলিত হয়ে এবং দখলের ধরন অনুযায়ী আশ্রিত এবং লন্ডভন্ড অবস্থায় আছে । দখলকৃত, নজরদারীতে অথবা মুক্ত যে অবস্থাতেই থাকুক, ইউনিট হিসেবে শুধুমাত্র গ্রামই রয়েছে।
(১০) স্বায়ত্তশাসনঃ
৪৭। অন্য কোনো ‘প্রশাসন’ এর উপর নির্ভরশীলতা ছাড়াই গ্রামের দৈনন্দিন জীবনে গ্রামের পঞ্চায়েত হয়ে উঠবে সত্যিকার স্বায়ত্তশাসন। সত্যিকার অর্থে এটিই বাংলাদেশের প্রাচীন জনপ্রশাসন ব্যবস্থা ছিলো,যা ব্রিটিশদের প্রবর্তিত দ্বৈতশাসন নীতির মাধ্যমে অপসারিত ও অবমূল্যায়িত হয় এবং এখনো তা বজায় আছে । তবুও,আজকের দিনে প্রশাসনিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন হবে না, কারন ৭১ এর মার্চে শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক গন-অসহযোগ এর সময় গ্রামবাসী তা চালু করেছিলো, যখন আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থা বাস্তবিক অর্থেই অকার্যকর হয়ে পড়েছিলো এবং তখন এই ধরনের পঞ্চায়েত দিয়ে অথবা ভিন্ন (সালিশ,দরবার,বৈঠক ইত্যাদি) মাধ্যমে আমাদের গ্রামের আইন,শৃঙ্খলা এবং বিচারব্যবস্থা পরিচালিত হয়েছিলো। এখন প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি চলছে, এখন আমাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে আমাদের গ্রামের পঞ্চায়েতগুলো নিজেদের প্রাথমিক সংগ্রাম হিসেবে পুনরায় চালু করতে হবে। এই মূলনীতি মনে রাখতে হবে যে,গ্রামবাসীদের নিজদের পঞ্চায়েত নিজেদেরকেই নির্বাচন করার জন্য উৎসাহ দিতে হবে যেন তারা নিজদের জীবনে পঞ্চায়তের সিদ্ধান্ত এবং বিধিমালা মেনে নিতে নৈতিকভাবে সম্মত থাকে । (বিস্তারিতের জন্য ৬৭ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)
৪৮। আমাদের সমগ্রিক যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হওয়া সত্বেও,গ্রাম পঞ্চায়েত এর পুনঃপ্রবর্তন ইচ্ছাকৃতভাবে শত্রু কিংবা তার আমলাদের আরোপিত কোনো নিয়ম, আইন, বিধিমালা বা অধ্যাদেশ এর বিপক্ষে বা ভঙ্গে জড়িত থাকবে না। মূলত,শত্রু আমলাতন্ত্রে এই পঞ্চায়েতের কোনো নিবন্ধনও প্রয়োজন নেই; এটি গ্রামবাসীদের জন্য,গ্রামবাসীদের দ্বারা,গ্রামবাসীদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়;এর আওতাধীন (অনুচ্ছেদ ৬৭) কোনো নাম ছাড়াই অথবা শত্রুদের জিঘাংসার কোনো কারন হবে না এমন কোন উপযুক্ত নামে (এমন কি ‘শান্তি কমিটি’ এর নাম ব্যবহার করেও) গ্রামবাসীদের সাধারণ উৎপাদন এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কাজকর্ম উন্মুক্তভাবেই চলবে।
(১১) অর্থনৈতিক যুদ্ধঃ
৪৯। পঞ্চায়েত প্রশাসনের অধীনে স্বাবলম্বী আর্থসামাজিক “দূর্গ” এর সুরক্ষায় থেকে গ্রামবাসীরা তাদের কঠিন অর্থনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, সেক্ষেত্রে তা শুধুমাত্র সহজ ব্যাপারই হবে না, একই সাথে তাতে শত্রুদের আরোপিত কোনো আইন ভঙ্গও হবে না। শত্রুদের আমলাতন্ত্রের আইন, আদেশ এবং বিচার ব্যবস্থায় জনগন অংশগ্রহন করবে না, শত্রুদের উৎপাদিত পন্য (বস্ত্রবয়ণশিল্প, সিমেন্ট, ময়দা, তৈরীকৃত পণ্য) ব্যবহার করবে না এবং আমাদের পণ্য (পাট, চামড়া, চা ইত্যাদি) ব্যবহার করা থেকে শত্রুদের বিরত রাখতে হবে (প্রয়োজনে উৎপাদন বন্ধ রেখে), যা তারা আমাদের শোষণ করতে ব্যবহার করে। প্রতি বছর পাক মূদ্রায় ২৫০ কোটি রূপী এবং বৈদেশিক মূদ্রায় ১০০ কোটি রূপী ক্ষতি স্বীকার করে এভাবে শত্রুপক্ষ খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না যার উপর তাদের শিল্প-সামরিক অর্থনীতি নির্ভরশীল। জমির খাজনা দেয়ার উপরে এই অর্থনৈতিক যুদ্ধের প্রভাব খুব কম পরবে। যখন মানুষ শুধুমাত্র নিজেদের ব্যবহারের জন্য পণ্য উৎপাদন করবে এবং বিনিময় প্রথায় ব্যবসা শুরু করবে, এরকম অবস্থায় খাজনা নেবার মত খুব বেশি জায়গা থাকবে না।
১২। প্রতিরোধঃ
৫০। কিন্তু শত্রুরা সসভ্য উপায়ে যুদ্ধ করছেনা, তারা অমানবিকভাবে ছুটছে। তারা হত্যা, খুন, ধর্ষণ, বাড়িঘরে আগুন লাগানো ও লুটতরাজ করছে। যা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে আমাদের নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে অবশ্যই যেকোন উপায়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। ছদ্মবেশ ধারণ, লুকানো এবং শত্রুদের থেকে পালানোর সময় নিজেদের জানমাল এবং দ্রব্যসামগ্রী বিশেষ করে খাদ্য সাথে রাখতে হবে যাতে তারা শত্রুদের বার্তাবাহকদের বিরুদ্ধে তাদের অদূরবর্তী কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারে। একই সময়ে শত্রুপক্ষের নিষ্ঠুরুতার প্রতি অন্ধ উত্তেজনাকে প্রতিনিয়ত জমিয়ে রেখে বিভিন্ন যুদ্ধকালীন কার্যক্রমের মাধ্যমে অদম্য ইচ্ছা ও সহ্যশক্তিকে গেরিলা যোদ্ধাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে (৬৭ অনুচ্ছেদ বি ২)। উক্ত সংগঠন এবং এইসকল কার্যক্রমের নীতিমালাগুলি তাদের নিজস্ব পঞ্চায়েতের দ্বারাই সর্বোচ্চভাবে মেনে চলতে হবে এবং যখন, যেভাবে, যেকোন উপায়ে এই ভিত্তিগুলি তাদের আর্থসামাজিক নীতি “গ্রামে গ্রামে দুর্গ” প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে।
১৩। নিরাপদ ঘাটিঃ
৫১। গ্রামে “দুর্গ” গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযোগী এলাকাগুলি হচ্ছে যেসকল এলাকায় এখনো শত্রুপক্ষ হানা দেয়নি। শীঘ্রই কার্যক্রমগুলি একবার হানা দেওয়া গ্রামগুলিতেও ছড়িয়ে পড়বে যাতে জনগণ নতুন করে দল গঠন ও কাজ শুরু করতে পারে এবং আস্তে আস্তে অতি গোপনীয় প্রক্রিয়ায় এই কাজগুলি শত্রুদের পাহাড়াকৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে এবং এমনকি শত্রুদের দখলকৃত গ্রামগুলিতেও শত্রুদের নাকের ডগার সামনে দিয়ে কার্যক্রমগুলি ছড়িয়ে পড়বে। এই সকল গ্রামের দুর্গগুলিতেই আমাদের গেরিলারা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিরাপদ ঘাটি খুজে পাবে, শত্রুপক্ষের ভাড়াটে বিদেশি সৈন্যদের বিরুদ্ধে আমাদের সৈন্যরা যারা বিদেশী বা ভাড়াটে নয়, জনগণের সৈনিক হিসেবে কাজ করবে, জনগণের সহায়তায় ও নিরপত্তায় তারা জনগণকে সহায়তা ও রক্ষা করবে।
১৪। অংশগ্রহণঃ
৫২। অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা ঘাটির সুবিধার চেয়েও গ্রাম “দুর্গ” চালু করলে তা আমাদের সামাজিক ভিত্তিকে ঐ বর্বর শত্রুদের কাছ থেকে রক্ষা করবে। এটি আমাদের একটি ইতিবাচক গঠনকৌশল দেবে এবং অসহায় গ্রামবাসীকে একটি গঠনমূলক লক্ষ্য দেবে যারা সম্ভবত বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে শোষিত ও নিষ্পেষিত মানুষ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মূক্তিফৌজের একার দ্বারা খুব দ্রুত বিজয় অর্জনের অনির্ধারিত প্রত্যাশার অসহিষ্ণুতা এবং এর ফলশ্রুতিতে তৈরি হওয়া হতাশা থেকে এদের রক্ষা করবে এবং আমাদের উদ্দেশ্যের অনিবার্য দেরির ভয়াবহ বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত রাখবে, যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ ও দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে একদিকে তারা আমাদের নেতৃত্ব ও মুক্তিফৌজের সাথে সংহতি প্রকাশ করবে এবং শত্রুপক্ষ ও তাদের অনুচরদের প্রতি তাদের ঘৃণা অব্যাহত রাখবে। একমাত্র এভাবেই আমরা সাড়ে সাত কোটি জনগণকে পাশে নিয়ে শত্রুদের আমাদের মাটি থেকে নির্মূল করার এক যুদ্ধ শুরু করতে পারব এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের এই অস্থায়ী ঘাটিকে ভীষণভাবে নাড়া দিতে পারব।
১৫। বৈদেশিক নীতিঃ
৫৩। শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করে দেওয়ার মত এমন প্রাথমিক আত্মনির্ভরশীল আত্মবিশ্বাস আমাদেরকে একটি সফল বৈদেশিক নীতি তৈরির ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান দিতে পারে।
একমাত্র এরপরই তখন আমরা স্পষ্ট এবং পরিস্কারভাবে বলতে পারব, পাকিস্তান মৃত এবং তারা তারা চিরদিনের মত বিদায় নিয়েছে ও পাকিস্তানিদের আবরণ লাগিয়ে চলা পশ্চিম পাকিস্তানি সন্ত্রাসীদের বাংলাদেশের ভাগ্যের উপর কোন ধরনের আইনগত অধিকার নেই। যাতে আমাদের উদবাস্তু ব্যাক্তিরা আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তায় ঘরে ফিরে যাবে,যতক্ষণ না পর্যন্ত স্বাধীনতার চেয়ে কোন অংশে কম বিজয় অর্জিত না হয় এবং শত্রুপক্ষে সাথে আত্মসমর্পণ ব্যাতীত কোন ধরনের আলোচনার অবকাশ নেই। আমরা এরপর বিশ্বমানবতার বিবেকের উপর এসকল সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ব্যাপারে কষাঘাত করব যারা বা যেসকল সরকার ‘ইয়াহিয়ার সন্ত্রাসীদের” সহযোগিতা করছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের এমন অমানবিক বর্বরতার প্রতি বিশ্বশক্তিদের নীরবতামূলক ষড়যন্ত্রকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করব।
১৬। প্রথাগত বনাম গেরিলা যুদ্ধঃ
৫৪। এমন একটি সামগ্রিক যুদ্ধ শুরুর ক্ষেত্রে প্রথমে এবং মুখ্যভাবেই এই উপলধ্বি আমাদের সকলের মধ্যে নিয়ে আসা আমাদের জন্য জরুরি,বিশেষ করে আমাদের তরুণদের মধ্যে যে,আমরা কোন প্রথাগত যুদ্ধে লড়ছিনা যেখানে আমরা আমাদের সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একটি সম্মুখ যুদ্ধে শত্রুদলকে বিধ্বস্ত করতে এসেছি। আমাদের যুদ্ধটি হচ্ছে গেরিলা যুদ্ধ যেখানে আমরা শেখ মুজিবের মতে “যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে” শত্রুকে ধ্বংস করে দিতে হবে। এর প্রথম পর্যায়ে যখন আমাদের গেরিলারা শক্তি সঞ্চয় করছে তখন তাদের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে সন্দেহজনক বিশ্বাসঘাতক ও অর্থ পাচারকারীদের নির্মূলে লোকজনকে সহযোগিতা করে সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করা এবং দ্বিতীয়ত যুদ্ধে ওৎপাতা ও শত্রুপক্ষের বাণিজ্যিক যোগাযোগ নষ্ট করে দেওয়া এবং এতে করে তাদের যুদ্ধকালীন খরচকে অসহনীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। একমাত্র যখন শত্রুপক্ষের অবস্থা যথেষ্ট নড়বড়ে হয়ে যাবে তখনই আমাদের যুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায় সকল স্তরের জনগণ একত্রিত হয়ে তাদের সর্বশেষ আক্রমণটি করতে হবে। আমাদের সৈন্যদের অবশ্যই যেকোনভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে “সামরিক যুদ্ধের” জন্য সবাই একসাথে না বরং একটি অংশ হিসেবে, যদিও এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, আর্থসামাজিক যুদ্ধে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে একটি সমষ্টিগত যুদ্ধ গড়ে তুলতে হবে। কারণ এছাড়া অন্য কোন উপায়ে গেরিলা যুদ্ধ লড়ার সুযোগ নেই।
১৭। মাঠকর্মীঃ
৫৫। এই সমগ্র যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য আমাদের জনগণের সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হচ্ছে নিবেদিতপ্রাণ কিছু মাঠকর্মীদের নিয়ে গঠিত সেনাদল। বাংলাদেশের গ্রামগুলিতে আর্থসামাজিক “দুর্গ” গড়ে তুলতে কর্মীদের সক্রিয় করতে হবে। প্রথমেই প্রত্যেক কর্মীকে কঠোর পরিশ্রমের অভ্যাস গঠন করতে হবে, দেশমাতৃকার স্বয়ংসম্পূর্ণতা কেন আনতে হবে (উদ্দীপনা) এবং কিভাবে আনা যায় (পদ্ধতি), তা নিয়ে ভাবা শিখাতে হবে। এছাড়াও তাকে গ্রামের অর্থনৈতিক জীবনে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নিতে হবে যাতে সে গ্রামবাসীকে সক্রিয় করার আগে তাদের আস্থা অর্জন করতে পারে।
৫৬। এরপর সে যেকোন একটি গ্রামকে তার উপর সমর্পিত নির্দিষ্ট কাজ হিসেবে নির্বাচন করতে পারে এবং নিয়মানুবর্তী প্রক্রিয়ার (অনুচ্ছেদ ৬৪ দ্রষ্টব্য) মাধ্যমে গ্রামের বয়োজ্যোষ্ঠদের আড়ালে ত্থেকে জনগণের অদম্য ইচ্ছাকে উঁচুতে তুলে ধরতে পারে, শত্রুদের বর্বরতাকে তুলে ধরে তাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ আর্থসামাজিক “দুর্গ” কে প্রাথমিক ঢাল হিসেবে নিয়ে শত্রুদের মরণঘাতী অস্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।
৫৭।এবং এভাবেই আমাদের রাজনৈতিক যুদ্ধের ভিত্তি মাঠর্মীদের সাথে নিয়ে,সামরিক যুদ্ধের সম্মুখভাগে থাকা সশস্ত্র যোদ্ধাদের নিয়ে,আর্থ সামাজিক যুদ্ধের আসল হাতিয়ার জনগণকে পাশে নিয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসের সাথে সত্যিকার ও বাস্তবিকভাবেই শত্রুদের পরাজিত করতে পারব।
ঘ। কেন পরাভূত করতে হবে?
৫৮। কিন্তু এর পরে কি? যখন শত্রু পরাজিত হয়ে যাবে তখন আমরা এই স্বাধীনতা দিয়ে কি করবো? একমাত্র সম্ভাব্য উত্তর হলো আমরা স্বাধীনতাকে আমাদের কল্যাণের জন্য ব্যয় করবো।
৫৯। আমরা কিন্তু ২৩ বছর আগেই হয়ে সংখ্যালঘু পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে স্বাধীন হয়েছি। যখন তারা তাদের স্বাধীনতার ন্যায্য অংশ থেকেও বেশি নিজেদের উন্নতি এবং শক্তি সমৃদ্ধিতে ব্যয় করেছে, তখন আমরা তা করিনি। আর তাই এখন আমরা যে শুধু আমাদের উন্নতি এবং শক্তিই হারিয়েছি তা নয় বরং আমরা আমাদের ‘স্বাধীনতা’কেও হারাতে চলেছি।
৬০। কিন্তু কোন জাতি বা সমাজই সম্পূর্ণ স্বাধীন অথবা সম্পূর্ণ পরাধীন হতে পারে না, কারণ প্রতিটি সমাজই তার কাজকে এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে। স্বাধীনতা যতটুকু আছে তা ধরে রাখা এবং একইসাথে উন্নতি ও শক্তিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে অবশিষ্ট স্বাধীনতাকে সম্ভাব্য সকল উন্নতি ও শক্তির জন্য ব্যবহার করা। অন্যথায় শক্তি, সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতার কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা এখন নিদারুণ যন্ত্রণায় তা খুঁজে বেড়াচ্ছি।
৬১। আর এই পদক্ষেপ প্রতিটি মানুষেরই নিজে থেকে নিতে হবে। নেতাদের অবশ্যই পথ প্রদর্শনের জন্য প্রয়োজন; কিন্তু যতক্ষণ না সমাজের প্রান্তিক স্তরের মানুষেরা আমাদের সাথে শৃংখলাবদ্ধ হয়ে এবং পারস্পরিক সহযোগিতায় তাদের ফলপ্রসূ (আর্থিক) এবং প্রতিরক্ষামূলক (সামাজিক) কাজ শুরু করে, ততক্ষণ পর্যন্ত কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। মানুষের হাতেই স্বাধীনতা, শক্তি ও সমৃদ্ধির চাবি রয়েছে।
৬২। শেখ মুজিব আমাদের কল্যাণের জন্য গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে বেছে নিয়েছিলেন। এই পথে আমরা যা-ই অনুসরণ করি না কেন, (বিভিন্ন ‘মতবাদ’এ একাত্ম না হয়ে) আমাদের স্থায়ী কল্যাণের জন্য প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে গণতান্ত্রিক স্বায়ত্বশাসক কর্তৃক সামাজিক সহযোগিতা দ্বারা সমাজের ভিত্তি স্থাপন করা (যা প্রতিটি গ্রামের দুর্গস্বরূপ), যেখানে সকলে সমাজের প্রতারকের অধীনতা এবং শোষণ থেকে তাদের গঠনমূলক জীবনীশক্তি রক্ষা করতে পারবে। সকল উন্নয়নশীল দেশগুলো বিভিন্ন ‘মতবাদ’কে উপেক্ষা করে সাম্য বা যৌথ, গ্রাম বা নগর, সমষ্টিগত বা বিভক্ত ইত্যাদি যেমনই হোক না কেন, এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই গণতান্ত্রিক স্বায়ত্বশাসন যা সমাজের নিম্নস্তরের একমাত্র কর্তৃপক্ষ। আমাদেরও তেমনই করা উচিৎ। নেতা, তার প্রতিনিধি এবং তার কর্মচারি সবাইকেই অবশ্যই সচল, পথপ্রদর্শিত এবং তাড়িত হতে হবে। কিন্তু আমাদের সমাজের নিম্নস্তরের মানুষকে অবশ্যই এই পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সক্রিয় হতে হবে।
৬৩। যদি এরপর, আজকের শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের মানুষদের অন্ধ মানসিকতাকে যদি তাদের আত্মনির্ভরশীলতার অদম্য ইচ্ছায় রূপান্তরিত করা যায় এবং তাদের শ্রম, সহযোগিতা এবং শৃংখলাকে ঘৃণিত শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের হাতিয়ার এবং ঢালস্বরূপ প্রতিটি গ্রামে গণতান্ত্রিক পঞ্চায়েতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যতভাবে এবং যতটুকু পরিসরে ছড়িয়ে দিয়ে একই সামাজিক-অর্থনৈতিক ‘দুর্গ’ গঠনে সক্রিয় করা যায়, তাহলে সময়ের সাথে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করার মাধ্যমে আমাদের কল্যাণের একটি নতুন সূচনা হবে। এবং এই গঠনশীল গ্রামগুলোর শক্ত অবস্থানেই আমাদের জাতীয় কল্যাণের মহাপরিকল্পনার ভিত্তি রচিত হবেএবং আমাদের দেশ দ্রুত, নিশ্চিতভাবে, উচ্চমাত্রায় উন্নয়নশীল এবং বৃহত্তর কারো অসহায় শিকার না হয়ে উপরে উঠবে।
আমাদের জাতির এই অবশ্যম্ভাবী জন্মলগ্নে মাঠকর্মীদের এখনই সুযোগ বাংলাদেশের মানুষদের দুর্ভোগকে অনুকূল সময়ে রূপান্তরিত করার।
৩। মাঠকর্মীদের করণীয় এবং বর্জনীয়
৬৪। করণীয়ঃ
১। কাজের জন্য নিজের গ্রামটিকে বেছে নিন যেখানে আপনি নিজেকে সবচাইতে নিরাপদ এবং সমাদৃত মনে করবেন (একের অধিক কর্মী একই গ্রামে কাজ করতে পারবেন কিন্তু একটি গ্রামে যদি ইতিমধ্যে তালিকার ৮ নম্বর পর্যায়ে চলে যায় তবে সেখানে ভিড় করবেন না)
২। শান্তভাবে অবস্থান করুন এবং আমাদের উদ্দেশের প্রতি তাদের মনোভাব খেয়াল করুন (যদি মনোভাব বেশি শত্রুভাবাপন্ন হয় আপনি তাদের সাথে যোগ দেওয়ার ভান ধরতে পারেন এবং শত্রুদলের একজন হয়ে কাজ করুন অথবা আপনি গ্রাম ত্যাগ করতে পারেন এবং আপনার পছন্দানুযায়ী অন্য কোন গ্রামে চলে যেতে পারেন! যদি না হয়)
৩। গ্রামবাসীদের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ করুন, বিশেষকরে প্রভাবশালী বয়োজ্যেষ্ঠ এবং কর্মঠ কর্মীদের আপনি মনে মনে উদ্দ্যেশ্য অনুযায়ী (১) বন্ধুভাবাপন্ন (২) নিরপেক্ষ এবং (৩) শত্রুভাবাপন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে ফেলুন। আমাদের উদ্দ্যেশ্যের প্রতি নিবাদিত প্রাণদের খুঁজে বের করুন।
৪। উৎপাদনক্ষম পরিশ্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনের সাথে তাড়াতাড়ি মিশে যান।
৫। আন্তরিকভাবে মানুষ্কে সহযোগীতার মাধ্যমে বন্ধু বানাতে শুরু করুন এবং তাদের আস্থা অর্জন করতে থাকুন।
৬। আমাদের উদ্দেশ্য সাধনে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে ভবিষ্যত গ্রামরক্ষা কর্মীদের বিশ্বস্ত কেন্দ্র গড়ে তুলতে চুপসারে প্রচারাভিযান শুরু করুন তাদেরকে “প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়ে তোলার” চেতনায় অণুপ্রাণিত করুণ (গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠোদের সাথে মন্ত্রণাকারী আসন্ন বিপদজনক শত্রুদের দমন করুন)
৭। এসকল কেন্দ্রের মাধ্যমে কাজ করে গ্রাম পঞ্চায়েতকে নতুন দল গঠনে সক্রিয় করা (যদি প্রয়োজন হয়) এবং স্বাভাবিক কার্যক্রমগুলির আয়োজন করা (অনুচ্ছেদ ৬৭ বি১ দ্রষ্টব্য)
৮। যুদ্ধকালীন কার্যক্রমে গ্রাম পঞ্চায়েতকে সহযোগীতা এবং উৎসাহিত করা (অনুচ্ছেদ ৬৭ বি ২)।
৯। আপনার ধারনানুযায়ী গ্রামটি যখন আমাদের গেরিলাদের জন্য নিরাপদ মনে হবে আপনি তখন আপনার দলনেতা অথবা স্থানীয়ভাবে প্রসিদ্ধ কোন নেতা বা আমাদের একই উদ্দেশ্যের কোন কর্মীর মাধ্যেমে উপযুক্ত অঞ্চলকে জানিয়ে দিন।
১০। গ্রামের লোকদের তাদের নিজেদের স্বনির্ভরতা সক্ষমতার উৎসাহ দানের মাধ্যমে গ্রামের দুর্গকে আরো শক্তিশালী করে তুলুন।
৬৫। টিকাঃ ক) উপরোক্ত ধাপগুলি গৃহীত হবে সাফল্যের উপর। একটি ধাপের পর আরেকটি ধাপের ব্যাপারে আপনি যখন নিশ্চিত হবেন- শত্রুপক্ষের লুটতরাজ অথবা শত্রুদলের দালালদের উপস্থিতি সাজানো কার্যক্রমে সমস্যা করতে পারে এবং আপনাকে সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হতে পারে।
খ) ৫ম ধাপ থেকে ১০ম ধাপগুলিকে চলমান, তীব্রতর ও বিস্তৃত করতে হবে।
৬৬। বর্জনীয়ঃ “ভিত্তি ফৌজ”এর প্রশিক্ষণ নেওয়া এবং শপথ গ্রহণের পর-
(১) বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে না (একদম যদি বাধ্য না হয়)। যুদ্ধটি বাংলাদেশে হচ্ছে এবং এটি সেখানে লড়তে হবে এবং সেখানেই জিততে হবে। যতদূর ব্যাপ্তি পর্যন্ত ততদূর সম্ভব আপনার কাজ করে যেতে কারণ প্রতিটি ক্ষুদ্র কাজেই আমাদের উদ্দেশ্যকে সহায়তা করবে।
(২) ৬৪ অনুচ্ছেদের ৩য় ধাপে পৌছে থাকার পর হাল ছেড়ে দেবেন না। ৮ম ধাপ পর্যন্ত চালিয়ে যান এবং শুধুমাত্র তখনই আপনি কাজের জন্য অন্য গ্রামে চলে যেতে পারেন।
(৩) একই সময়ে আপনার উদ্যমকে একটি গ্রামের চেয়ে বেশি জায়গায় ছড়িয়ে দেবেন না।
(৪) জনগণের থেকে কোনরূপ নেতৃত্ব গ্রহণ বা অন্বেষণ করবেন না। এটি দোষ প্রকাশ করে এবং তৃণমূলকর্মীদের মৃত্যু ঘটায়। গতি নির্ধারক হিসেবে কাজ করুন।
(৫) কারো করুণা গ্রহণ করবেন না, এটা আত্ম-স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রতি অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়।
(৬) কোন ধরনের তহবিল সংগ্রহ করবেন না। সহযোগিদের শ্রম এবং সম্পদের উপর নির্ভর করুন।
(৭) নিজের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে শাস্তি প্রদান করবেন না (বার্তাবাহক বা যেকেউ হোক) যা ন্যায়হীনতা। স্থানীয়দের সম্মতি নিন।
(৮) বার্তাবাহকদের উপর দন্ডবিধায়ক কাজের কোনরুপ চিহ্ন রাখবেন না বা জনসম্মুখে প্রকাশ করবেন না।
(৯) শত্রুদের আক্রমন করবেন না; ছদ্মবেশ নিন বা তাদের থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন, শত্রুদের মুক্তিফৌজদের কাছে ছেড়ে দিন।
(১০) জনগণের সাথে প্রতারণা বা লুটরাজ করবেন না অথবা মুক্তিযুদ্ধের ন্যায় তাদের আথিতেয়তার উপর কোন ধরণের কর নির্ধারণ করবেন না। প্রকৃত মুক্তিফৌজ অবশ্যই এগুলো করবে না।
৪। গ্রাম পঞ্চায়েতের মূলকাঠামো
৬৭। ক) একটি সংগঠনঃ
১। আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বাসী গ্রামবাসীদের একটি সাধারণ সভার মাধ্যমে এর সদস্য ও গ্রামের অধিবাসীদের নিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। পঞ্চায়েতের অধিক সদস্যর উপস্থিতি বিশৃখলা তৈরী করতে পারে। গ্রামের আকারের উপর নির্ভর করে ৩ থেকে ৭ সদস্য নিয়ে এটি গঠন করতে হবে।
২। উক্ত সভাতেই নতুন পঞ্চায়েতের মাধ্যমে একজন পঞ্চায়েত নেতা মনোনীত করতে হবে এবং গ্রামবাসীদের দ্বারা গ্রহণযোগ্য হতে হবে। অর্থাৎ পঞ্চায়েতের নেতার সকল সিদ্ধান্ত এবং নিয়ম মেনে চলার অঙ্গিকার করতে হবে। তিনি পঞ্চায়েতের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করবেন এবং গ্রাম সরকারের প্রধান হিসেবে থাকবেন।
৩। নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নিজস্ব প্রণালী ও প্রক্রিয়া পঞ্চায়েতকে নির্ধারণ করতে হবে। সংকটকালে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও গ্রামবাসীদের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা নেতার কাছে অর্পণ করতে হবে।
৪। দুমাস বা এর পাশাপাশি সময়েই গ্রামবাসীদের মধ্যে সাধারণসভা হতে হবে। প্রতি সভাতেই নিন্দাপ্রস্তাব থাকবে। যদি কোন পঞ্চায়েত সদস্য খুবই অপরিহার্য হয়ে উঠেন আলোচনা এবং সিদ্ধান্তের পর সদস্য পুনঃনির্ধারণ বা পুনঃস্থাপিত হবেন।
৬৭। খ) কার্যাবলীঃ
১। সাধারণ কার্যাবলীঃ নিম্নলিখিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল আর্থ সামাজিক গ্রাম দূর্গ গড়ে তুলতে হবেঃ
অ) চোর-ডাকাত, কর্তব্যচ্যুত ও প্রতারকদের গ্রাম নিরাপত্তাকর্মীদ্র মাধ্যমে কঠোর হাতে দমন ও প্রতিরোধ করতে হবে।
আ) গ্রামের সকল বিবাদ স্বচ্ছতা ও তৎপরতার সাথে নিষ্পত্তি ও ন্যায় নির্ধারণ করতে হবে যাতে বাহিরের সংস্থার উপর “আইন, শৃঙ্খলা ও বিচারের” জন্য নির্ভরতা দূর করা যায়।
ই) সকল ক্ষেত্রে সমন্বিত শ্রম বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে ফলন ভাগ করার চর্চা পুনরূজ্জীবিত করা।
ঈ) গ্রামের সকল ভূমি, পানি, সবজি এবং প্রাণীজ সম্পদ ব্যবহার করে সমন্বিত শ্রমের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন সর্বোচ্চকরণ।
উ) দেশীয় সম্পদ (কৃষি, শিল্প, কারুশিল্প, দক্ষতা এবং শ্রমের মাধ্যমে) থেকে সর্বোচ্চ এবং বৈচিত্রময় গ্রামীণ পণ্য উৎপাদনে চিন্তা ও পদ্ধতিতে স্থানীয় উদ্ভাবনীক্ষমতা বৃদ্ধি; এবং স্ব-পুষ্টিসাধনে যতটা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, সংস্কৃতি ও বিনোদন, গ্রামে উৎপন্ন করা যায় এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ বিনময়ের মাধ্যমে পাওয়া যায় তা অর্জনে অদম্য ইচ্ছা বজায় রাখা।
২. যুদ্ধকালীন কর্মকান্ডঃ নিম্নলিখিত কাজের মাধ্যমে গ্রাম্য “দুর্গ” গুলোকে প্রাথমিক ঢাল এবং একইসাথে শত্রুর বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হবেঃ
(এ) শত্রু গুপ্তচরদের এতটা কার্যকরীভাবে দমন করতে হবে যেন সম্ভাব্য কেউও ভীত হয়।
(বি) শত্রু অভিযানের হাত থেকে লুকানো, ছদ্মবেশ ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল এবং ভান্ডার তৈরি করা ও প্রস্তুত রাখা।
(সি) শত্রুপক্ষের প্রতি আর্থ-সামাজিক বয়কট বজায় রাখা।
(ডি) অননুমোদিত আগ্নেয়াস্ত্র হেফাজতে নেয়া এবং তার প্রকৃত ব্যবহার নিশ্চিত করা।
(ই) মুক্তিফৌজের জন্য খাদ্য, আশ্রয়, তথ্য এবং সহায়তা নিশ্চিত করা। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করা, বিশেষ করে শত্রুপক্ষ ও তার দালালদের অবস্থানের তথ্য। প্রয়োজনে ভিত্তিফৌজের দলনেতা অথবা গুরুত্বপূর্ণ নেতা অথবা স্থানীয় কেউ যে আমাদের সাথে একই উদ্দেশ্যে কাজ করছে।
৬৭। গ) গ্রাম রক্ষীবাহিনীঃ
পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের মধ্য থেকে কর্মচঞ্চল এবং সক্রিয় সদস্য বাছাই করে গ্রাম প্রতিরক্ষার জন্যে বাহিনী বানাতে হবে। ‘জনতা’র সুবিধার্থে পঞ্চায়েত প্রধানের আদেশাধীনে তারা সকল সমন্বিত শ্রমিকদের একেবারে পুরোভাগে নিযুক্ত হবে, যেমন সামাজিক রীতি, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বাঁধ নির্মাণ, নিষ্কাশন, সেচ, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং যোগাযোগ। সকল কাজের সাথে রক্ষীবাহিনী গ্রামের পরিচ্ছন্নতা এবং সৌন্দর্যায়নে দায়িত্ব পালন করবে। যুদ্ধাবস্থায় তাদের বিশেষ কাজ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
৬৭। ঘ) আর্থিক সংস্থান
যখন গ্রামীণ কর্মকাণ্ড সমন্বিত শ্রম, সম্পদের বিনিময় এবং ফলনের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হয়, তখন আর্থিক সমস্যা আবির্ভূত হওয়া উচিৎ নয়। যেকোনো ক্ষেত্রে, টাকাই হচ্ছে প্রতারণা ও দুর্নীতিগ্রস্থ হওয়ার প্রধান উপায় এবং এটা থেকে সর্বাত্মকভাবে দূরে থাকতে হবে। এবং এই সময়ে এটি একটি শত্রুপক্ষের ফাঁদ।
৬৭। ঙ) পারিশ্রমিক
পঞ্চায়েত এবং গ্রামরক্ষীবাহিনীর সদস্যরা প্রাথমিক ভাবে তাদের সাধারণ কাজের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবা এবং অবৈতনিক দায়িত্ব পালন করবে। গ্রামীণ পণ্যের পূর্ব-অনুমোদিত বন্টনের মাধ্যমে সাপ্তাহিক অথবা মাসিক সম্মানী দেয়া হবে যা
পঞ্চায়েতের ব্যবস্থাপনায় গ্রামীণ প্রচেষ্টার ফলে বর্ধিত উৎপাদন থেকে দেয়া হবে। এই সম্মানী সাধারণ সভায় গ্রামবাসীদের তরফ থেকে হয়ত প্রদান করা হবে যখন পঞ্চায়েত বিপরীত কোন পন্থা খুঁজে বের করবে।
৫।ক্যাম্প রুটিন
(এবং পাঠ্যসূচীর আওতা)
৬৮. সকল ক্যাম্পের প্রশিক্ষণেই একই রকম মনোভাব বজায় রাখা খুব জরুরী। প্রশিক্ষণ এবং লেকচারের নির্বাচিত বিষয়গুলো পাঠসূচি থেকে এই অংশে তালিকাভুক্ত করা হবে যেন প্রাত্যাহিক সূচীর মাধ্যমে ক্যাম্পের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা পূরণ হয়। সময় থাকলে উন্নতির জন্য আরও বেশি কাজ অথবা লেকচার প্রদান করা হবে।
৬৯. প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে এবং ক্যাম্পের সুযোগ-সুবিধা ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশিক্ষণার্থীদের শুরুতেই একজন জেনারেল এবং শারীরিক প্রশিক্ষকের অধীনে ২৫০ জনের গ্রুপে ভাগ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। প্রতিটা গ্রুপ আবার ১০টি করে কর্মীদলে ভাগ করে দেয়া হবে।
৭০. প্রতিটি ক্যাম্পে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা এবং প্রশাসকের পরামর্শে প্রশিক্ষকদের সাহায্যে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার করে হলেও প্রকৃত সময়সূচী দেখানো হবে। ক্যাম্পে দিন শুরু হবে পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে সকাল ৫টা ৩০ এ এবং শেষ হবে রাত দশটায় আলোচনার মাধ্যমে। ব্যবহারিক কাজগুলোর সময়সীমা ১২০ মিনিট করে হতে পারে কিন্তু লেকচারের বিষয়গুলো ৬০ মিনিটের বেশি হবে না। ভিন্ন ভিন্ন দলের জন্য লেকচারগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে।
৭১. ব্যবহারিক কাজের বিষয়ঃ
এ. প্রেরণামূলক (সকল প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য)
পি.১ ক্যাম্প জীবনের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলায় রূপান্তরিত করা।
পি.২ দৈনিক সকালের শরীরচর্চা এবং বিকালের খেলাধুলা (কোন অনুশীলন বা কুচকাওয়াজ নয়)
পি.৩ ক্যাম্পের পরিচ্ছন্নতা এবং সৌন্দর্যবর্ধন জন্য প্রতিটি ক্যাম্পের সকল ছেলের জন্যে নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ করে দেয়া হবে।
পি.৪ দলগত ভাবে ক্যাম্পের কাজ করা। প্রতিটি দল নিম্নে উল্লেখিত কাজগুলো আবর্তন পদ্ধতিতে করবেঃ
(অ) ক্যাম্পের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, আবর্জনা নিয়ন্ত্রণ এবং সদ্ব্যবহার।
(আ) ক্যাম্প পরিষ্কার করা এবং যোগাযোগ।
(ই) ক্যাম্পের জন্য পানি আনা এবং ব্যবহারের জন্যে সঞ্চয় করা।
(ঈ) ক্যাম্পের জন্য জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ এবং বাজারজাতকরণ।
(উ) ক্যাম্প আবাসন, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির সংস্কার এবং উন্নয়ন।
(ঊ) ক্যাম্পে রান্না, পরিবেশন এবং কর্মীদলের জন্য খাদ্য পরিবহন।
(ঋ) ক্যাম্প নিষ্কাশন, জলপ্রবাহ, বন্যা এবং খরা থেকে সুরক্ষা।
(এ) ক্যাম্পে নাপিত এবং ধোপার কাজ।
পি.৫ দলগত ভাবে গ্রাম্য কাজ (সকল দলের জন্য আবর্তন পদ্ধতিতে)
(ঐ)কোদালের ব্যবহারঃ মাটি খোঁড়া এবং মাথায় করে জলাশয়,বাঁধ এবং রাস্তা তৈরির কাজের জন্য বয়ে নিয়ে যাওয়া।
(ও)ব্যবহারিক ক্ষেতে লাঙ্গল এবং নিড়ানীর ব্যবহার।
(ঔ)ফল এবং সবজি ফলন, চাষের বেড তৈরি করা, সারের মিশ্রণ, বীজ বপন এবং চারাগাছের রক্ষা।
৭১) বি) পদ্ধতিমূলক ( বিশেষ করে কর্মচারীদের জন্য)
পি.৬ গ্রামীন কারুশিল্প/এবং কারখানাঃ প্রত্যেক প্রশিক্ষনার্থীকে নিম্নের যেকোন একটিতে অংশগ্রহন করতেই হবে –
বাঁশ, বেত, ঘাস, পাতা এবং কাঠের কাজ, সেলাই, মৃৎশিল্প, প্রাথমিক চিকিৎসা, গ্রাম্য মূর্তিনির্মান, ছবি আঁকা, রঙ করা, গান গাওয়া, বাদ্য বাদন সহ যেকোন প্রকার গ্রামীণ কারু এবং শিল্প যা ক্যাম্পে করা সম্ভব।
পি.৭ স্বায়ত্বশাসন অনুশীলনঃ
(ক) এই কাজের শুরুতে প্রত্যেক কর্মচারীকে তার গ্রামের বাড়ির ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী পুনরায় সাজানো হবে এবং নতুন দল তাদের দলনেতা বাছাই করবে।
(খ) নির্দেশক দল সমান সংখ্যক প্রশিক্ষনার্থী সদস্য নিয়ে পুনরায় সংঘঠিত হবে, তারা তাদের নিজস্ব পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েতের নেতা নির্বাচন করবে (কোন প্রকার নির্বাচনী প্রচারণা হবে না। দলের সবাই একসাথে বসবে এবং নির্দেশককে বিচারক রেখে নিজেদের মধ্যে আলাপ এবং কন্ঠ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করবে)।
(গ) দলনেতা তার দলের পঞ্চায়েত এবং নির্দেশকের সাথে প্রতি রাতে বসে সারা দিনের অগ্রগতি এবং সমস্যা নিয়ে আলাপ করবেন, শাস্তিমূলক বিষয়সমূহ বিবেচনা করবেন এবং প্রয়োজনে শাস্তির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করবেন এবং পররবর্তী দিনের কর্মসূচি ঠিক করবেন।
(ঘ) তিনদিন অন্তর দলের সকল প্রশিক্ষনার্থী সহ পঞ্চায়েতের সভা হবে। দলনেতা, পঞ্চায়েতের সদস্য কিংবা পঞ্চায়েতের নেতার নামে কোন অভিযোগ থাকলে এতে শোনা হবে এবং প্রয়োজন হলে পুনরায় নির্বাচন অথবা পরিবর্তন করা হবে।
পি.৮ স্ব-নির্ভরতার অনুশীলনঃ
পি৪ এবং পি৫ এর প্রতিটি দলের কাজ শিবিরের কর্তৃপক্ষ মূল্যায়ন করবে এবং পি৬ এর পণ্য স্থানীয় বাজারে জন্য বিক্রি করে উন্নত খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। প্রতিটি সদস্য অথবা দল যাদের সামগ্রিক ফলাফল সবচেয়ে ভালো হবে, তাদের বিশেষভাবে প্রশংসিত করা হবে।
পি৯ এবং পি ১০ তথ্য সংগ্রহ এবং ছোট অস্ত্রের প্রশিক্ষন সাধ্যমতো দেওয়া হবে।
৭২) বক্তৃতার বিষয়সমূহঃ
(ক) সাধারণ (জি)
১) উৎসাহ প্রদান/ অনুপ্রেরণামূলক (সকল প্রশিক্ষনার্থীর জন্য)
জি-১ | জরুরী; কিভাবে এটাকে শেখ মুজিবের “সাড়ে সাত কোটি মানুষের যুদ্ধে” পরিনত করা যায় | ৪-৫, ৮-১০, ৫৪ পেজের লেখা দ্রষ্টব্য |
জি-২ | দলীয় কর্মসূচির নিয়মাবলী | ১৮ |
জি-৩ | আমরা কেন এখানেঃ শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবীর পক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদ | ২১-২২ |
জি-৪ | শত্রুপক্ষঃ তাদের অমানবিকতা | ২৪ |
জি-৫ | ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট | ২৩-২৬ |
জি-৬ | ২৭ | |
জি-৭ | আমাদের সম্পদ ও ঘাটতি | ২৯ |
জি-৮ | অন্যান্য বিপ্লব থেকে শিক্ষাঃ শত্রুর অবস্থান এবংআমাদের শক্তি | ৩০, ৩৪-৩৫ |
জি-৯ | শত্রুপক্ষের কৌশলঃ সত্যিকারের শত্রু | ৫৪ |
জি-১০ | মুক্তির উপায়ঃ “শেখ মুজিবের ঘরে ঘরে দূর্গ” | ৩৬-৪০, ৪৩-৪৫ |
জি-১১ | অর্থনৈতিক যুদ্ধ, প্রতিরোধ এবং নিরাপদ ঘাটি | ৪৯-৫১ |
জি-১২ | গেরিলা যুদ্ধ এবং তৃণমূল কাজ | ৫৪-৫৭ |
২) ম্যাথোডিকাল (সেচ্ছাসেবকদের জন্য)
জি-১৩ | কিভাবে আমরা কাটিয়ে উঠবো | ৩১-৩৫ |
জি-১৪ | শত্রুপক্ষের কৌশল | ২৯, ৩৬-৪০ |
জি-১৫ | আত্মনির্ভরতা | ৪১-৪৫ |
জি-১৬ | স্বায়ত্বশাসন | ৪৬-৪৮ |
জি-১৭ | অংশগ্রহণ, বৈদেশিক নীতি | ৫২-৫৮ |
জি-১৮ | আমাদের সংগ্রামের অনুমেয় প্রধান বিষয়সমূহ | ৬-৭, ১২-১৩ |
জি-১৯ | কেন কাটিয়ে উঠতে হবেঃ স্বনির্ভর আর্থসামাজিক অবস্থা এবং শেখ মুজিবের “গ্রামে গ্রামে দূর্গ গড়ে তোলা” হল আমাদের প্রধান ভাবাদর্শ | ৫৮-৬৩ |
জি-২০ | আলোচনা-পর্যালোচনা |
৭২) (খ) অর্থনৈতিক পুষ্টিসাধকতা (সকল প্রশিক্ষণার্থীর জন্য)
ই-১ খাদ্য এবং কৃষির অনুশীলন এবং বাংলাদেশের গ্রাম সমূহে দেশীয় উন্নতির সম্ভাবনাঃ বন্যা নিয়ন্ত্রণ
ই-৪ বাঁধ নির্মাণ, সেচ, সবুজ সার, জমি চাষ, বীজবপন, ফসল উত্তোলন, ফল, সবজি, হাঁস-মুরগী, গবাদি পশু, মৎস্য, জমি ও জলাশয়ের প্রতিটা ইঞ্চির ব্যবহার।
ই-৫ গ্রামীণ পোশাক এবং আবাসন।
ই-৬ গ্রামীণ সাস্থ্যঃ পরিচ্ছন্নতা, নিষ্কাশন, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পানি পরিশোধন, মহামারী প্রতিরোধে মশা-মাছি দমন; প্রতিকারক হিসেবে দেশীয় প্রাথমিক চিকিৎসা এবং ভেষজ ও অন্যান্য দেশীয় ওষুধ; অন্যান্য সুলভ চিকিৎসা সেবা।
ই-৭ গ্রামীণ শিক্ষা।
ই-৮ গ্রামীণ যোগাযোগঃ রাস্তা, পথ, সেতু, জলপথ- এসবের সংস্কার ও পরিচর্যা, এবং শত্রুর বিরুদ্ধে এসবের ব্যবহার।
ই-৯ গ্রামের সৌন্দর্যবর্ধন, সাংস্কৃতিক এবং বিনোদনমূলক কার্যক্রম।
ই-১০ গ্রাম্য চারুশিল্প, কারুশিল্প, দক্ষতা এবং কুটির শিল্প।
বি.দ্র. উপরের বিষয়গুলোর হয়ত মাঠকর্মীদের পদ্ধতিগত অংশের সাথে পুনরাবৃত্তি হতে পারে যা তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতার উন্নয়ন করবে। প্রশিক্ষকেরা সবসময় কার্যধারার সমৃদ্ধির জন্যে প্রশিক্ষণার্থীদের ধারণা নোট করবেন।
৭২। গ) সামাজিক (সব মাঠকর্মীদের জন্য প্রদত্ত সময় পরিসীমা)
এস-১ মানবসমাজের প্রয়োজনঃ সমাজে বেঁচে থাকার জন্যে ন্যুনতম পরিমাণ হলেও খাদ্য এবং সমাজশৃঙ্খলা দরকার। এর যে কোনো একটির অভাবেই সমাজ ভেঙে পড়ে। অন্যান্য বিষয়গুলো (বাসস্থান, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা, যোগাযোগ, সংস্কৃতি এবং বিনোদন) সামাজিক কল্যাণের জন্য দরকারী।
এস-২ গ্রামীণ বাংলাদেশে মালিক-শ্রমিক অংশীদারিত্বের চর্চাঃ বর্ধিত শ্রমিক এবং বর্ধিত উৎপাদনের জন্য সমন্বয় এবং সমবন্টন। সামাজিক নিরাপত্তা এবং উন্নয়নে পঞ্চায়েতের ভূমিকা।
এস-৩ গ্রাম্য পঞ্চায়েতের গঠন। (৬৭,এ,ডি-ই)
এস-৪ গ্রাম্য পঞ্চায়েতের সাধারণ কার্যক্রম। (৬৭. বি-১)
এস-৫ গ্রাম্য পঞ্চায়েতের যুদ্ধকালীন ভূমিকা। (৬৭. বি. ২)
এস-৬ উৎপাদনশীল খাতে গ্রামীণ পাহারা। (৬৭. সি)
এস-৭ নিরাপত্তা খাতে গ্রামীণ পাহারা। (৬৭. সি)
এস-৮ মিথ্যা তথ্যদাতা ধরার উপায়। (৬৪. ৬-৮)
এস-৯ মাঠকর্মীদের করণীয়। (৬৪-৬৫)
এস-১০ মাঠকর্মীদের অকরণীয়। (৬৬)
স্বাধীন বাংলা সরকার অনুমোদিত গ্রাম পঞ্চায়েতের কাঠামো
সংগঠন
১। ভিত্তি ফৌজ-কর্মি গ্রামবাসির সাথে গ্রামের দৈনন্দিন কাজে মিশে গিয়ে গ্রামবাসীকে শেখ মুজিবের অমর নির্দেশ “গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়” ব্যাখা করে আত্মনির্ভরশীল জীবন-যাপনের উৎসাহ উদ্দীপনা দিবে এবং তার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী শ্রম-সমবায়-শৃংখলার পথ দেখাবে।ভিত্তি ফৌজ-কর্মি গ্রামবাসি মুরব্বিদের আশ্রয়ে থেকে পরামর্শ –অনুপ্রেরণা দিয়ে কাজ করাবে কিন্তু নিজে কোন নেতৃত্বের মাতব্বরি করবে না।
২। গ্রামের সকল কাজে শৃংখলা রক্ষার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাধীনতাকামী গ্রাম পঞ্চায়েত গড়ে তুলতে হবে।গ্রামবাসীর সাধারন বৈঠক মনোনয়নে সমাজ সেবক শ্রদ্ধ্যাভাজন নেতাদের পঞ্চায়েতে নিযুক্ত হবেন।গ্রামের লোকসংখা অনুযায়ী ৩ থেকে ৭জন পঞ্চায়েত সদস্য হলেই চলবে।
৩।একই বৈঠকে সদস্যরা নিজেদের মধ্যে,গ্রামে স্থায়ী অধিবাসী একজনকে নেতা মনোনিত করবে।এবং গ্রামবাসীর অনুমোদন পেলে তিনি পঞ্চায়েতের নেতা হিসাবে নিযুক্ত হবেন।নেতার জন্য গ্রামবাসীর সাধারন অনুমোদন অবশ্য প্রয়োজনীয়,কেননা পঞ্চায়েতের মুখপাত্র হিসাবে তিনি ই গ্রামের শাসন-বিচার-শৃংখলার অধিপতি হবেন।
৪।পঞ্চায়েতের দৈনন্দিন কার্যপ্রনালী পঞ্চায়েত নিজেরাই স্থির করে নিবেন।তবে সকল জরুরী অবস্থায় বিচার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা পঞ্চায়েত নেতার হাতে থাকবে।
৫।প্রতি দুই মাসের মধ্যে গ্রামবাসীর সাধারন বৈঠক বসবে, এবং পঞ্চায়েত সদস্যদের বিরুদ্ধে সমালোচনা কিছু থাকলে তা করতে হবে।সমালোচনার পর সদস্যেরা পুনরায় নিযুক্ত অথবা পরিবর্তিত হবে।
কার্যক্রম
১।গ্রামের আত্মনির্ভরশীলতা বাড়িয়ে তোলার সকল কাজে,বিশেষতঃ দুর্ভিক্ষ ও অরাজকতা দমনের কাজে আবালবৃদ্ধাবনিতা গ্রামবাসীর সকল সম্ভাব্য পরিশ্রম এবং সমবায় যতদুর সম্ভব বাড়াতে হবে।
২।পল্লী রক্ষি বাহিনীর মাধ্যমে এবং কঠোর শাসন-শৃংখলায় গ্রামের অভ্যন্তরীণ চুরি,ডাকাতি,লুটতরাজ,বিশ্বাসঘাতকতা এবং শত্রুপক্ষের আনুগত্য নিশ্চিহ্ন করে রাখতে হবে।
৩।গ্রামের অভ্যন্তরীণ সকল ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা করে,প্রয়োজনীয় শাস্তি দিয়ে,কোট কাছারি যাওয়া বন্ধ করতে হবে।মামলাবাজি নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।
৪।শ্রমিক-মালিকদের ঘনিষ্ঠ সহযোগ এবং প্রচলিত সকল উৎপাদনের ভাগাভাগি বিনিময় এবং বিতরন ব্যবস্থা করে সুখী সমাজ গড়ে তুলতে হবে।
৫।গ্রামবাসীর সাধ্যমত পরিশ্রম এবং সামবায়ের সাথে সাথে কৃষি আবগ কুটির শিল্পের সকল ক্ষেত্রে গ্রামে আর কি কি উৎপাদন হতে পারে এবং গ্রামের উৎপাদন দিয়েই কি করে বাইরে থেকে আসা জিনিসের কাজ চলতে পারে সেই উদ্ভাবনা শক্তিও বাড়াতে হবে।যে যে কোন বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে শুধু খাদ্য এবং সমাজ শৃংখলাতেই নয়,বস্ত্র,আবাস ,স্বাসহ্য,শিক্ষা,গামের পথ-ঘাট,শরীর চর্চা এবং মানসিক ও আধ্যাত্ব্যিক কৃষ্টির সকল ক্ষেত্রেই অদম্য মনোবলে আত্মনির্ভরশীল গ্রামের জীবন-যাপন শৃংখলা রক্ষা করা যায়।
*যুব প্রশিক্ষনকালে অনেক সময় পাঠ্যক্রম হিশেবে বিবেচিত হতো ।
গ্রামরক্ষীঃ
পঞ্চায়েত নেতার নির্দেশ শৃংখলায় সমাজসেবি কর্মঠ স্বেচ্ছাসেবকদের গ্রামরক্ষী দল গড়ে তুলতে হবে।নেতার নির্দেশে প্রয়োজন হলে প্রাণ দিবে এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে তারা কাজ করবে।শুধু গ্রাম পাহারা দেওয়া এবং চুরি-ডাকাতি,শত্রুর চরানাচুর দমনের কাজ ই নয়,গ্রাম-জীবনের সকল কাজে ও এরা অগ্রনী হয়ে থাকবে।এরাই হবে গ্রামের সত্যিকার ভিত্তি ফৌজ।এই গ্রামরক্ষা বাহিনীকে অনুপ্রেরণা দেওয়াই হবে ভিত্তি-ফৌজ কর্মীর অন্যতম কাজ।
অর্থব্যবস্থাঃ
শ্রম-সমবায় এবং ভাগাভাগি বিনিময় ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত গ্রাম জীবনে টাকা পয়সার তেমন কোনো প্রয়োজন থাকবে না।দুর্নীতি ও সামাজিক প্রতারণার বাহন হিসাবে টাকার ব্যবহার যত কমবে ততই মঙ্গল।
পারিশ্রমিকঃ
পঞ্চায়েত এবং গ্রামরক্ষীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবেই এইসব দায়িত্ব নিবে।তবু ও তাদের নামমাত্র পারিশ্রমিক যদি কিছু দিতেই হয় তবুও তার জন্য টাকা-পয়সার সত্যিই প্রয়োজন নেই।ঘরে ঘরে পঞ্চায়েতী “তোলা”তুলে তাদের জন্য মাসিক পণ্যের ব্যবস্থা করলেই চলবে।কিন্তু তারমধ্যে ও যেন শোষণ দমননীতির বিষ না ঢোকে,তার জন্য এ নীতি ও গ্রহন করতে হবে যে পঞ্চায়েতী শৃংখলায় গ্রামীন উৎপাদন যা বাড়তে তার উপরই “তোলা” উঠবে।উৎপাদন যদি না বাড়ে,গ্রামবাসী যদি পঞ্চায়েতের উপর সন্তষ্ট না থাকে, তবে দ্বৈমাসিক সভায় গোটা পঞ্চায়েত বদল করে নিলেই চলবে।
স্বাধীন বাংলা সরকার অনুমোদিত ভিত্তি ফৌজের মূলনীতি
গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়
শেখ মুজিবের অস্ত্র ধর
পশ্চিমা হানাদার বর্বর এবং চরানুচর বিশ্বাসঘাতকদের জঘন্য আক্রমনের হাত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বাঙ্গালি জাতির ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য আজকের এই মুক্তিযুদ্ধ।শুধু মুসলমান অথবা শুধু হিন্দু বাঙ্গালির যুদ্ধ নয়,এ শুধু ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবি অথবা শুধু কৃশক-শ্রমিক-বুদ্ধিজীবি শুধু কৃশক-শ্রমিক-মেহনতী বাঙ্গালির যুদ্ধও নয়।সকল বাঙ্গালির মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অমর আদর্শে আজকের এই যুদ্ধ,যে বাঙ্গালি যেখানে আছে,যে যেই কাজে যতটুকু পারে তারই সম্মিলিত দল-মত,শ্রেনী-ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙ্গালির সর্বাঙ্গীন জন –যুদ্ধ।
বাইরের কোন শক্তি এসে বাঙ্গালিকে এই যুদ্ধ করে দিবে না ।অথবা করলে ও তাতে বাঙ্গালির লাভ হবে না ।বাইরের কেউ সাহঅ্যা করুক বা না করুক এবং তা যতটুকুই করুক, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের চেষ্টায় বাঙ্গালি যতটুকু করবে এ যুদ্ধে বাঙ্গালির জয় ততটুকু ই হবে।কেননা পরম করুণাময় সর্বশক্তিমানও বলেছেনঃআমি কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তনে ততটুকু ই সাহায্য করব যতটুকু সে জাতি নিজের চেষ্টায় করবে।তাই আজ অতীতের সকল পরনির্ভরতা ভুলে গিয়ে বাঙ্গালিকে আত্মনির্ভরশীল সংগ্রামের পথ ধরতে হবে।
কিন্তু শুধু নেতৃত্বের মুখে যুক্তি-তর্ক দিয়ে আজকের এই জয় হবে না অথবা শুধু মুক্তিসেনার হাতে অস্ত্র দিয়েও নয়।তার সাথে সাথে চালিয়ে যেতে হবে শেখ মুজিবের দেওয়া মারণাস্ত্র- গ্রামে গ্রামে কোটি কোটি মুক্তিকামী বাঙ্গালির হাতে অর্থনৈতিক যুদ্ধ ।এই অর্থনৈতিক যুদ্ধের ভয়েই পশ্চিমা দুর্বৃত্ত আজ নৃংশস উম্মাদ হয়ে উঠেছে।
*যুব প্রশিক্ষনকালে অনেক সময় পাঠ্যক্রম হিশেবে বিবেচিত হতো ।
কেননা বংগ-লুন্টন বন্ধ হয়ে গেলেই তার জঙ্গিশাহী বিকল হয়ে যাবে।তাই অর্থনৈতিক মারণাস্ত্র দিয়েই তাকে উৎখাত করতে হবে-বাঙ্গালির উৎপাদন পশ্চিমার জন্য এবং পশ্চিমার উৎপাদন বাঙ্গালির জন্য হারাম করে দিয়ে তাকে ভাতে পানিতে মারতে হবে- পশ্চিম পাকিস্তানের চোরে চোরে লড়াই বাধিয়ে দিয়ে তাদের শয়তানির অস্তিত্ব চিরতরে ধ্বংস করে দিতে হবে।
সেই ভয়ে ,এই অর্থনৈতিক যুদ্ধ থেকে বাঙ্গালিকে নিরস্ত্র করার জন্য পশ্চিমারাআবার এক জঘন্য ফাদ পেতেছে।অন্য সকল পৈশাচিকতার সাথে সাথে তাদের হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের খাদ্য শস্য ধ্বংস করে দিচ্ছে।এবং তারই সাথে সাথে দুষ্কৃতকারী পঞ্চম বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে তারা বাংলাদেশে এক ভীষন লুটতরাজ- অরাজকতার আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে।যেন একদিকে দুর্ভিক্ষ অন্যদিকে অরাজকতার ত্রাসে বর্তমানের পরনির্ভরশীল বাঙ্গালি জনগণ আবার “সাহায্য” এবং “আইন শৃংখলার” জন্য পশ্চিমা প্রভুর আমলাতান্ত্রিক শাসনশোষনের জালে আত্মসমর্পন করে,যেন বাঙ্গালির জন্য সকল চেষ্টা,মুক্তি-ফৌজের সকল অস্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়।
তাই,আজ আর কোন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে অসহায় হয়ে বসে থাকলে চলবে না।আজ সর্বাঙ্গিন জনযুদ্ধের সর্বপ্রথম পদক্ষেপে গ্রামে গ্রামে বাঙ্গালিকে নিজের হাতে দুর্ভিক্ষ ও অরাজকতা দমনের পথ ধরতে হবে।এজন্য গ্রামে গ্রামে আজাদী পঞ্চায়েত গড়ে তুলতে হবে এবং তার শাসন- সস্থার মাধ্যমে সবদিকে সকল দুষ্ক্রতি-অরাজকতার বাহন হিসাবে শত্রুর চরানুচরকে কঠিন শাস্তি দিয়ে দমন করে রাখতে হবে,অন্যদিকে শত্রু কবলিত শহরে অর্থনীতির মুখাপেক্ষী না হয়ে গ্রামে গ্রামে আপন শ্রমে আয়ত্তগত খাদ্য এবং কুঠির শিল্পের উৎপাদন যতটুকু সম্ভব বাড়িয়ে তুলতে হবে-যেন যত কষ্ট করেই হোক না কেন গ্রামে গ্রামে বাঙ্গালি আপন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কর্ম শৃংখলার ভিত্তিতে এবং পঞ্চায়েতী শাসনের মাধ্যমে মোটা ভাত মোটা কাপড়ে জীবন –যাপন করে সমাজ-শৃংখলা বাচিয়ে রাখতে পারে,কোনমতেই যেন শত্রুর কাছে হাত পাততে না হয়।
হোক না তা সরল অথবা আদিম অর্থনিতি,তবুও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো পশ্চিমা শত্রু ধ্বংসের জন্য বাঙ্গালিকে সেই পথই ধরতে হবে।সেই গ্রামে গ্রামে আত্মনির্ভরশীল দুর্গের বজ্র-কঠিন ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে বাঙ্গালি তার অর্থনৈতিক মারণাস্ত্র চালিয়ে যাবে,শত্রুকে ভাতে-পানিতে পঙ্গু করে দিবে এবং সেই দুর্গের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে শেষ মুহুর্তে মুক্তিসেনার সহযোগিতায় শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বাংলার মাটি চিরতরে পুত পবিত্র করে তুলবে।
তারপর বাঙ্গালি তার মুক্ত দেশে,আপন শ্রমে আপন জনকল্যাণের চির –নির্ভর জয়যাত্রা আরম্ভ করবে।গ্রামে গ্রামে আত্মনির্ভরশীল বাঙ্গালির সম্মীলনে গড়ে উঠবে বৃহত্তর অর্থনীতি,বলিষ্ঠ দুর্জেয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে,গ্রামের দৈনিক কাজে মিশে গিয়ে,গ্রামবাসীকে এই দুর্গ সংগঠন এবং উন্নয়নের কাজে সাহায্য করাই হল ভিত্তি-ফৌজের মূলনীতি ও কার্যসুচী।
জয় মুজিব
জয় বাংলা