তারিখ | সুত্র | শিরোনাম |
৭ডিসেম্বর,১৯৭১ | বাংলাদেশ সরকার | জাতির উদ্দেশ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ |
সংগ্রামের শেষ প্রহরে নতুন অগ্নিশপথ
আমার প্রিয়দেশবাসী ভাইবোনেরা,
সংগ্রামময় , অমারাত্রির শেষমত প্রহর আমরা অতিক্রম করে এসেছি । স্বাধীনতার সূর্যাভাসে বাংলাদেশের দিকবিদিক আজ উদ্ভাসিত। স্বাধীনতার এই সূর্যসকালে আপনারা আমার অভিনন্দন ও সুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আজ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের পাতায় লিখিত হল আর একটি স্মরণোজ্জ্বল দিন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক ন্যায্য স্বীকৃতি দিয়েছেন আমাদের প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতবর্ষ। বাংলাদেশের মাটিতে যে নির্মমতম গণহত্যা অনুষ্ঠিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করার জন্য মহান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ওই দীর্ঘ আট মাসব্যাপী যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তার জন্য আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের তরফ থেকে তাঁকে ও ভারতবাসীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
মিত্র রাষ্ট্র ভারতের সৈন্য বাহিনীর জোয়ানরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার শত্রুদেরকে নির্মূল করার আজ যুদ্ধ করে চলেছে । আর এই ভাবেই দুই দেশের জনগণের মধ্যে যে অটুট বন্ধুত্ব রচিত হচ্ছে তা রক্ত দিয়ে লেখা। মিত্র রাষ্ট্র ভারতের জোয়ানদেরকে আমি বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
বাঙ্গালির শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস
প্রায় সাড়ে আট মাস হতে চললো , আমরা এ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে এসেছি।এই সংগ্রামের ইতিহাস, জয়ের ইতিহাস , শত্রুকে উপর্যুপরি আঘাত হানার ইতিহাস, বাঙ্গালির শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস , শত্রুদের পর্যায়ক্রমে পরাজয়ের ইতিহাস। এ ইতিহাসে যাঁরা লিখেছেন , বাংলার সেই কোটি কোটি জনসাধারণ ,যাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষা এ ইতিহাস লিখায় সাহায্য করেছে , তাদের সবাইকে আমি সংগ্রামী সালাম জানাই। বাংলার বীর সন্তানেরা যাঁরা অস্ত্র ধারণ করে হানাদার দস্যুকে আঘাত হেনেছেন, সেই মুক্তিবাহিনীর , বীর সৈন্যদেরকে আমি আজকের দিনে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।
আজকের দিনে স্মরণ করি সেই সমস্থ বীর শহীদদেরকে যাঁদের রক্তে বাংলার শ্যামল প্রান্তর লাল হয়েছে , আর যাঁদের বীরত্বের ইতিহাস বাঙ্গালি জাতির জন্য এক গৌরবময় অধ্যায় করে গিয়েছে।
বন্ধুরা আমার , রক্তের আখরে , এই সংগ্রামের ইতিহাসের সাফল্যের এ ক্লান্তিলগ্নে আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি বাঙ্গালী জাতির পিতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমান কে। স্বাধীনতার এ ঊষালগ্নে আজ তিনি আমাদের মধ্যে নেই। বর্বর জঙ্গিশাহির কারাগারে আজ তিনি আবদ্ধ। আমার জানিনা অন্ধকার কারাগারে কি দুঃসহ জীবন তিনি যাপন করছেন। বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের বীর মুক্তিবাহিনী , আমরা সবাই যাঁর আদর্শে অনুপ্রানিত, আর যাঁর আদর্শকে রুপ দেওয়ার জন্য আজকের এই সংগ্রাম চলছে এবং চলবে – সেই মহান নেতাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমার চেষ্টা করছি এবং করে যাবো। যে হানাদার দস্যুরা বাংলার নয়নমণিকে আজও আবদ্ধ রেখেছেন , তাদের কাছে আমি বলতে চাই , সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর দুর্জয় সাহস আর প্রতিজ্ঞা যেমন অস্ত্রের ভাষায় রুদ্ধ করা যায়নি , তেমনি করে বাংলার অবিসংবাদিত নেতাকে কারাগারে রেখেও তারা নিস্তার পাবেন না।
প্রিয় দেশবাসীর কাছে আমি , আমার সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস দিচ্ছি, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য চেষ্টা করেছি , সেই চেষ্টা চালিয়ে যাবো।কেননা আমরা মনে করি , বঙ্গবন্ধুকে ফেরত না পেলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করা সম্ভবপর হবেনা।
বিভিন্ন দেশের প্রতি আবেদন
বন্ধুরা আমার , আজকের এই দিনে ভারতবর্ষ যখন আমাদেরকে স্বীকৃতি দিয়ে সারা পৃথিবীর সামনে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছাকে পূরণ করেছে, সেই দিনে আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে আবেদন করবো, আপনারা স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সত্তাকে স্বীকৃতি করে দিন। স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রের যে মূল্যবোধ যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে মানুষের অগ্রগতিকে সাহায্য করেছে , সেই স্বাধীনতার ও গনতন্ত্রের মূল্যবোধে যদি কারো কোনো আস্থা থাকে , আজকে তাঁদের প্রতি আমার উদাত্ত আহ্বান , দ্বিধা না করে স্বাধীন বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দিয়ে গনতন্ত্র ও স্বাধীনতার মর্যাদাকে রক্ষা করুন।
বন্ধুরা আমার , আর বিশ্বাস , ভারতবর্ষের দৃষ্টান্ত অনুসরন করে অচিরেই পৃথিবীর আরও দেশ আমাদেরকে স্বীকৃতি দেবেন। পৃথিবীর যে সমস্ত বৃহৎ রাষ্ট্র আজকে রাজনীতির আর জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে বাস্তব সত্যকে স্বীকার করে নিতে পারছেন না , তাঁদের ভুমিকা ভবিষ্যৎ কালের বংশধররেরা কোনো দিনই ভুলবেন না। পৃথিবীর সকল দেশের শান্তিকামী মানুষের জন্য আমার দেশের জনগণের ভালবাসার কথা আমি আবার ঘোষণা করছি। কিন্তু যারা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে আজকে ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বানচাল করার জন্য এখনো ক্ষীণ ও দুর্বল প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, সে সমস্ত রাষ্ট্র আজও একজন অত্যাচারী ক্ষয়িঞষু একনায়ককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন- সেই সমস্ত বৃহৎ রাষ্ট্রের কাছে আমি এখনো আবেদন করবো, আপনারা আপনাদের নীতি পরিবর্তন করুন , বাস্তবকে সিকারকরে নিন স্বাধীন বাংলাদেশের সত্তাকে আপনারা উপেক্ষা করতে পারেন নাই , ভবিষ্যতেও পারবেন না
বন্ধুরা আমার , স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে , আজকে হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হটে যাচ্ছে ।আমাদের মিত্র বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা , মুক্তিবাহিনীর নৌ-বিভাগের দুর্ধর্ষ নাবিকেরা, মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী বৈমানিকেরা আজকে শত্রুকে আঘাত হানতে হানতে পিছু হটিয়ে দিচ্ছেন ।শুধুমাত্র কয়েকটি বড় বড় ক্যান্টনমেন্টে আজকে তারা আবদ্ধ।
আর বেশি দেরি নাই
প্রিয় দেশবাসী ভাইয়েরা, আপনারা বিশ্বাস করুন , আর বেশি দেরি নাই , যেদিন মিত্র বাহিনীর সহায়তায় আপনাদের মুক্তিবাহিনি ইয়াহিয়া খানের নৃশংস সৈন্য বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে সমূলে উৎখাত করবে।
তাই আমি দেশবাসীর কাছে আবেদন করবো, শেষ আর চরম আঘাত হানার জন্য যখন আমাদের মুক্তিবাহিনী , আমাদের মিত্রবাহিনীর সহায়তায় জোরকদমে এগিয়ে চলেছে , তখন আপনারা তাঁদের প্রতি যে সহানুভূতি , সাহায্য বিগত আট মাস দেখিয়েছেন , সেই সহানুভূতি এবং সাহায্য দিয়ে শেষ বিজয়ের মুহুর্তটিকে ত্বরান্বিত করুন।
বন্ধুরা আমার , প্রিয় দেশবাসী ভাইয়েরা আমার ,আজকে বাংলাদেশের গোটা কয়েক জায়গা ছাড়া বাকি অঞ্চল মুক্ত । এই সমস্ত মুক্তাঞ্চলে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শাসন ব্যাবস্থা কায়েম করা হচ্ছে, মুক্তাঞ্চলে মারা সরকারের তরফ থেকে যে শাসন ব্যাবস্থা কায়েম করা হচ্ছে , আমি আনন্দিত যে সেই শাসন ব্যাবস্থায় পরিপূর্নভাবে মুক্তাঞ্চলের জনগণের সাহায্য এবং সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি।
বন্ধুরা আমার ,অচিরেই সারা বাংলাদেশ জুড়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শাসন ব্যাবস্থা কায়েম হতে চলেছে। দীর্ঘ তেইশ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন এবং গত আট মাসে শত্রুদের নির্বিচার স্বেচ্চাচারিতার ফলে বাংলাদেশের শাসন কাঠামো ও অর্থনৈতিক অবস্থা সাংঘাতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। এর অপরিহার্য পুনর্গঠনের দায়িত্ব আমাদের সকলের উপর রয়েছে।
বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি ও সমাজ ব্যাবস্থা পুনর্বিন্যাসের দায়িত্ব আমাদের সরকারের সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসী সবাইকে নিতে হবে। যে অটুট মনোবল ও অতুলনীয় বীরত্ব দিয়ে দেশকে আপনারা শত্রুমুক্ত করে চলেছেন ইতিহাসে তা অনন্য ঘটনা হিসেবে স্থান পাবে। সেই মনোবল এবং উদ্যমকে এখন দেশ গঠনের কাজে নিয়োগ করতে হবে। এক দিকে যেমন শেষ শত্রুটি নিধন না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম করে যেতে হবে, অন্যদিকে তেমনি স্বর্ণপ্রসবিনী বাংলা হৃদ সৌন্দর্য ও সম্পদের পুনরুদ্ধারের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের মৌলিক নীতি
স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের আমার সরকারের মোউলিক নীতি ইতিপূর্বেই ঘোষণা করা হয়েছে।ধর্মনিরপেক্ষতা , গনতন্ত্র আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলা গঠন করতে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষে মানুষে কোনও প্রভেদ থাকবে না। হিন্দু, মুসলমান , বৌদ্ধ , খৃষ্টান, যে যে ধর্মেই হোন না কেন , তাঁদের ব্যাক্তিগত আর সামাজিক জীবনে পরিপূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। রাষ্ট্রীয় জীবনে গণতন্ত্রের মূল আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যতের সুখী আর সমৃদ্ধশালী বাংলা আমরা গড়ে তুলবো।
গনতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হবে। প্রত্যেক নাগরিককে গনতান্ত্রিক বাংলাদেশে তার রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হবে।
জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দায়িত্ব , স্বাধীনতা আর অগ্রগতির দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
বন্ধুরা আমার , আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই হবে ভবিষ্যৎ গনতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের মূল লক্ষ্য। তাই দেশবাসী ভাইদের কাছে আমি আবেদন করছি , সরকারের তরফ থেকে আইনের শাসন প্রবর্তন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত সোনার বাংলার শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্য সরকার যে পদক্ষেপ গুলি নেবেন, আপনারা এই পদক্ষেপে সরকারকে এবং সহযোগিতা করবেন।
দেশবাসী ভাইদের কাছে আরো আবেদন করব, নিজের হাতে আপনারা আইনের ভার তুলে নিবেন না। আপনারা শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নিজ নিজ এলাকায় নিজের দায়িত্ব গ্রহণ করুন। মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিকেরা এবং আমার সরকারের নিয়োজিত কর্মচারীরা আপনাদেরকে পরিপূর্ণভাবে সাহায্য করবে।
বন্ধু আমার , তেইশ বছরের শোষণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে পশ্চিমা পুঁজিপতিরা। বাংলার সম্পদকে লুণ্ঠন করে তেইশ বছরে সোনার বাংলাকে শ্মশান করেছে। নৃশংস সেনাবাহিনী আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড , অনেক সিল্প-কারখানাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিপর্যস্ত এ অর্থনীতিকে সম্বল করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আর মুক্তি আনার শপথ নিয়েছে। আমার সরকারের তরফ থেকে আমি বলিষ্ঠ ভাবে ঘোষণা করতে চাই যে , একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর সকল স্তরের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের প্রচেষ্টা আমরা চালিয়ে যাবো । আমরা এমন একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করবো , যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দূর হবে- যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রতিটি কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্ত মানুষ তার জীবন ধারণের পরিপূর্ণ সুযোগ পাবে।
কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের কোনো সরকারের পক্ষেই কোন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কার্যকরী করা সম্ভবপর হয় না যদি না দেশবাসীর পরিপূর্ণ সমর্থন পাওয়া যায় ।
আমার সরকার অচিরেই অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মুল বিষয়গুলো দেশবাসির সামনে প্রকাশ করবেন।আমি দেশবাসী ভাইদের কাছে আবেদন জানাই,সরকারের এই প্রচেষ্টায় আপনারা পুরিপুর্নভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করবেন।
বন্ধুরা,বহু দুঃখ ,বহু কষ্ট আমরা করেছি। বহু রক্ত আমরা দিয়েছি,বহু মায়ের বুক খালি হয়েছে,বাংলার বহু নারী তার ইজ্জত খুইয়েছে স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য।যে স্বাধীনতা আজকে অর্জিত হতে চলছে,সেই স্বাধীনতাকে স্থায়ীভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য ফলপ্রসূ করার মহান দায়িত্ব দেশবাসী সবাইকে নিতে হবে।
তাই দেশবাসী ভাইবোনেরা, স্বাধীনতার সংগ্রাম সমাপ্তি হলেই আপনার আমার সংগ্রাম সমাপ্তি হবে এ যেন আপনারা না ভাবেন।দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন,গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মতোই দৃঢ় মনোবল নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের কাজ করে যেতে হবে।
নতুন সংগ্রামের আহবান
প্রিয় দেশবাসী ভাইবোনেরা,অর্থনৈতিক,সামাজিক ,সাংস্কৃতিক সংগ্রামের এই আহবান আজকে আমি আপনাদেরকে জানাচ্ছি। আমি আশা করি ,স্বাধীনতা সংগ্রামে যেভাবে আপনারা বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছেন,আগামী দিনের সুখী সমৃদ্ধিশালী বাংলা গঠনের সংগ্রামে তেমনিভাবেই আপনারা সাড়া দিবেন।আমার যে সমস্ত প্রিয় দেশবাসী নৃশংস হানাদার দ্বারা বিতাড়িত হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়ে বাধ্য হয়েছেন নৃশংস হানাদার নৈস্য দ্বারা বিতাড়িত কথা বলতে চাই।
ইতিহাসের নজিরবিহিন এই দুর্নিপাকের মোকাবিলা করেছেন আপনারা,দুর্নিবার সাহস ও তিতিক্ষার সাথে।এর জন্য শুধু আমাদের নয়, সারা বিশ্বের সহানুভূতি আপনাদের জন্য আজ উম্মুখ।
আমি স্থিরবিশ্বাসী যে আপনাদের দুঃখের দীর্ঘরাত্রী প্রায় ফুরিয়ে এল,অতী শ্রীগই আপনারা আপনাদের প্রিয় মাতৃভুমিতে সসম্মানে ফিরে আসতে পারেন।বাংলাদেশ সরকার আপনাদের নিরাপদে দেশে ফিরে আসা এবং পুনর্বাসনের সব দায়িত্ব সানন্দে নিয়েছেন।
প্রিয় দেশবাসী ভাইয়েরা ,আজকের এই দিনে আপনাদের তরফ থেকে সারা পৃথিবীর ছোট বড় সকল রাষ্ট্রকে আমি জানিয়ে দিতে চাই যে,আমার সরকারের পররাষ্ট্রনীতি হবে –জোট নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি।এই জোট নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে বিশ্বের সকল শান্তিকামী দেশ আর শান্তিকামী মানুষের সঙ্গে আমরা সহ অবস্থানের নীতিতে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে চাই।
আমরা সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের বিরোধী। পৃথিবীর যেখানের মানুষ গণতন্ত্র আর স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করবে,আমরা সেই সমস্থ সংগ্রামী মানুষকে সমর্থন ও সহযোগিতা করবো।
প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা,এই মহান আদর্শকে রুপ দেওয়ার জন্য আমাদের আজ এই চরমলগ্নে নতুন করে অগ্নিশপথ নিতে হবে।বীর মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা,বাংলার সংগ্রামী ছাত্র ও তরুণেরা,দেশমাতৃকাকে শত্রুর কবল মুক্ত করার জন্য তোমরা বীরত্বের সাথে সংগ্রাম করেছ।
শত্রুর উপর শেষ আঘাত
বীর মুক্তিবাহিনীর ভাইয়েরা,সংগ্রামের এই শেষ মুহুর্তে তোমাদের কাছে আমি উদাত্ত আহবান জানাবো,জোর কদমে তোমরা এগিয়ে চলো।
আমাদের মিত্রবাহিনীর ভাইয়েরা,আমাদের স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তাদের বুকের তাজা রক্ত বাংলার শ্যামল মাটিতে ঢেলে দিচ্ছেন।তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর শেষ দুর্গগুলোর উপর প্রচন্ড আঘাত আনতে হবে।আঘাতের পর আঘাত করে শত্রুর দুর্গগুলিকে চুর্ণ করে দাও।
আজকে তোমাদের একটি দুর্জয় শপথ হোক- সেই শপথ ঢাকা চলো।ঢাকার বুকে বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা উড্ডিন করো।
আমি আল্লাহতালার কাছে মোনাজাত করছি। বাংলার দুর্জয় বীরেরা,তোমাদের চরম সাফল্য নিকটবর্তী হোক।
প্রিয় দেশবাসী ভাইবোনেরা, সংগ্রামের এই শেষ মুর্হুতে আপনারা ও মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শেষ চেষ্টায় শরিক হোন।আপনাদের কাছে আমার এই আকুল আবেদন।ইনশাআল্লাহ আমাদের সুনিশ্চিত সাফল্য আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি।
আল্লাহর মেহেরবানীতে,গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঢাকার বুকে প্রতিষ্ঠিত হবে ।বাঙ্গালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পুরন হবে।
শেখ মুজিবুর রহমান –জিন্দাবাদ
বাংলার সংগ্রামী জনতা- জিন্দাবাদ
বাংলার মুক্তিবাহিনী – জিন্দাবাদ
জয় বাংলা