You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
তথ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পর্কে তথ্য সচিব কতৃক প্রতিরক্ষা সচিবকে লিখিত একটি চিঠি বাংলদেশ সরকার, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ২৯ নভেম্বর , ১৯৭১

জয় বাংলা তথ্য, প্রচার ও বেতার দফতর
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মুজিবনগর
ডিও নম্বরঃ পিআইপিবি ২৯ নভেম্বর, ১৯৭১
প্রেরকঃ জনাব এ এইচ খান
সচিব, বাংলাদেশ সরকার
সংবাদ, তথ্য, সম্প্রচার ও প্রচার মন্ত্রণালয়

আমার প্রিয় সামাদ,
আপনার মন্ত্রণালয়ের ডিও লেটার নম্বর সি-০০১/১৭০ তারিখ ২৩/২৪.১১.১৯৭১ এর দিকে আপনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

আমি এতদসঙ্গে জনাব আলমগীর কবিরের ২৭/১১/৭১ তারিখের চিঠির একটি কপি সংযুক্তি করছি। এই চিঠিটির আর ব্যখ্যার প্রয়োজন নেই। এই রিপোর্ট আমার আর কোনো কিছু যোগ করার মত নেই। জনাব বাদশা এর চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে সংবেদনশীল বিষয়ে বিরাজমান কর্মপদ্ধতিকে বাতিল করে দেবার আগে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এর সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ করা হয় নি। উপরন্তু, এটা প্রতীয়মান হয় যে বহিঃপ্রচার বিভাগ এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে যা এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যে দায়ী।

তাই আমি সুপারিশ করতে চাই যে, অতীত ঘটনার জন্য কে দায়ী তা শনাক্ত করার চেষ্টার পেছনে নিজেদের শক্তি খরচ না করে একত্রে বসে এরূপ পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সে লক্ষ্যে একটি উপযোগী কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করাটাই অধিকতর ফলপ্রসূ হবে।

আন্তরিকতার সাথে
(এ এইচ খান)

জনাব সামাদ
প্রতিরক্ষা সচিব
বাংলাদেশ সরকার

আসল কপি
জনাব এ এইচ খান, সচিব,
সংবাদ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়
বাংলাদেশ সরকার

রেফারেন্স: ডিও নম্বর. পিআইপিবি, ২৫ নভেম্বর ১৯৭১

জনাব,
আপনার চিঠি আমাকে একইসাথে ব্যথিত এবং বিস্মিত করেছে। কারণ যেসকল ঘটনা ঘটেছে বলে আপনার কাছে খবর পৌঁছানো হয়েছে সেগুলো আংশিক সত্য এবং ডাহা মিথ্যার এক মিশ্রণ বৈ অন্য কিছু নয়।
আমি বিস্মিত যে এরকম অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে কিভাবে আনা যায়, যখন সংশ্লিষ্ট ‘প্রতিবেদক’ কলকাতায় আমার সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে পারতেন। অন্যকিছুর জন্য না হোক, অন্তত খবরটির সত্যতা নিরূপনের জন্য হলেও। এতে আধিকারিক কর্তৃপক্ষের অমার্জনীয় অপব্যবহার নিশ্চিতভাবেই ফুটে ওঠে- যা সেসব কশাঘাতের একটি যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ রক্তের মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
সত্যিটা এখানে তুলে ধরলাম। দেশে ও দেশের বাইরে কমপক্ষে প্রায় ১২ বছর ধরে আমি পেশাদার সাংবাদিক। সেই সুবাদেই অনেক বিদেশী সাংবাদিকের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে। প্যারিসের ম্যাচ অ্যান্ড ল’এক্সপ্রেসের পিটার কারমাইকেল তেমনই একজন। এই মাসের প্রথম সপ্তাহের কোনো একটা সময়ে কলকাতায় অনেকটা ঘটনাক্রমেই পিটারের সঙ্গে আমার দেখা হয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তাহেরুদ্দিন ঠাকুরের সঙ্গে যথাযথ পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি আমার সহায়তা কামনা করেন। মুক্তিবাহিনী নিয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন করতে আগ্রহী তিনি, যাদের প্রতি হঠাৎ করেই পশ্চিমা গণমাধ্যম তুমুল আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমি সেটাই করেছি। মি. ঠাকুর পিটাররকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তাকে ভারতীয় ছাড়পত্র পাইয়ে দিতে তিনি চেষ্টা করবেন। তিনি এটাও বলেছিলেন যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কোনো আপত্তি না থাকলে বাংলাদেশ সরকার খুশিমনেই তাকে কোনো একটি মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প পরিদর্শনে পাঠাবে। তবে তিনি আমাকে গোপনে বলেন যে, বিশেষ ধরণের আগাম ছাড়পত্র ছাড়া কোনো বিদেশীকে এ ধরণের অনুমোদন না দিতে বাংলাদেশ সরকারকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গোপন সংবাদ পাঠিয়েছে। এ ব্যাপারে আমার এতটুকুই জানা ছিল।
নভেম্বরে দ্বিতীয় সপ্তাহে রেডিও বাংলাদেশের অনুষ্ঠানের কিছু কাজে এক দিনের জন্য আমি মেজর জলিলের সেক্টরে গিয়েছিলাম। বাবুল চৌধুরির তত্ত্বাবধানে জহির রায়হানের একটি ফিল্ম ইউনিটের সাথে আমি গিয়েছিলাম, যারা আপনার মন্ত্রণালয়ের জন্য তৈরী হচ্ছে এমন কিছু চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের জন্য সেখানে যায়। টাকিতে হুট করেই পিটারের সঙ্গে আমার দেখা। মনে হলো টাকিতে তিনি মোটেও আগন্তুক নন বরং আগেও বেশকবার এসেছেন। তিনি আমাকে বলেন যে বাংলাদেশে প্রবেশ করবার সম্পূর্ণ ভারতীয় ছাড়পত্র তার আছে এবং ওই কাজের জন্যই তিনি মেজর জলিলের সঙ্গে দেখা হওয়ার অপক্ষায় ছিলেন। মেজর জলিলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমি তাকে বলি যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন ফটোগ্রাফার আপনার সঙ্গে দেখা করতে বাইরে অপেক্ষা করছে। মেজর জলিল তাৎক্ষনিক তাকে ভেতরে ডেকে নেন। তাদের মধ্যে কি আলোচনা হয়েছে সেটা আমার মাথা ঘামানোর বিষয় নয়। অবশ্যই আলোচনার সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। মুক্তি বাহিনী যে সত্যিই আছে এবং তারা পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের বিতাড়িত করার সামর্থ্য রাখে, সেটা পশ্চিমা দুনিয়াকে জানানোর প্রয়োজনীয়তা পিটার মেজর জলিলকে বোঝাতে সক্ষম হন। তখন মেজর জলিল জিজ্ঞেস করেন পিটারের ভারতীয় ছাড়পত্র আছে কিনা। পিটার হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন। এরপর মেজর জলিল তাকে কাছেরই এক মুক্তি বাহিনী ক্যাম্পের ছবি নেবার অনুমতি দেন। পরদিন একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে নিয়ে গিয়ে কিছু লড়াই দেখানোর প্রতিশ্রুতিও তিনি তাকে দেন। এরপর মেজর জলিল তার একজন অফিসারের তত্ত্বাবধানে পিটারকে সেই ক্যাম্পে পাঠান। তিনি ক্যাপ্টেন হুদাকে বাংলাদেশের প্রায় চার মাইল ভেতরের অগ্রবর্তী ঘাঁটি অব্দি পিটারকে সঙ্গ দিতেও নির্দেশ দেন। কাকতালীয় ব্যাপার হল আমাদের কাজটাও ছিল ঐ একই ক্যাম্পে। প্রায় একটা পর্যন্ত আমি সেখানে কাজ করি। তারপর আরেকটি ক্যাম্পে চলে যাই। পরে বিকেলে আমি আমার জিনিসপত্র নেবার জন্য প্রথম ক্যাম্পে আসি, কারণ সেদিনই আমার কলকাতায় ফেরার কথা। আমি দেখলাম ক্যাম্প কমান্ডারের সঙ্গে পিটারের বেশ জমে গেছে। সে বললো, প্রথম দিনের কাজে সে খুবই খুশি। তবে একই দিনে বাংলাদেশে ঢুকতে সে খুবই আগহী ছিল। আমি যখন কলকাতার উদ্দেশে রওনা হলাম তখন সে ক্যাপ্টেন হুদার জন্য অপেক্ষা করছে, যিনি তাকে বাংলাদেশে নিয়ে যাবেন। বাবুল চৌধুরি পিটারকে একদমই চিনতেন না। তিনি সে রাতেই কিছু টুকটাক কাজ সেরে নেওয়ার জন্য বশিরহাটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, ফিরবেন পরদিন সকালে।
দুই দিন পর টাকি থেকে ফিরে বাবুল প্রতিবেদন দেয় যে, পরদিন কিছু বিদেশী সাংবাদিককে নিয়ে একই সদরদপ্তরে যান জনাব বাদশা (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমিনুল হক বাদশা) এবং পিটারকে সেখানে দেখে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে যান কারণ বাদশার সাহায্য ছাড়াই সে ওখানে গিয়েছে। যাইহোক, পিটারকে তিনি তার দলভুক্ত করে নেন এবং ‘মুক্তাঞ্চলে’ তাদের পরিদর্শনের ব্যবস্থা করেন।
এখন সত্যিটা হলো এসবই একজন সেক্টর কমান্ডারের ওপরই নির্ভর করে। তিনি অনুমতি না দিলে পিটার ক্যাম্পের ধারেকাছে যেতে পারত না। আমি যতদূর জানি মেজর জলিল একজন অভিজ্ঞ অফিসার এবং তিনি পরিষ্কারভাবেই জানতেন এখানে ঝুঁকি কতটা। তিনি পিটারকে বলেছিলেন যে ক্যাম্পটি সীমানা অঞ্চলে অবস্থিত তবে পুরোপুরি বাংলাদেশের মাটিতে নয়। পিটার তাকে একজন পেশাদার হিসেবে প্রতিশ্রতি দিয়েছিল যে সত্যিটা বাইরের দুনিয়ায় ফাঁস করবে না। মেজর জলিল তাকে বিশ্বাস করেছিলেন কারণ তিনি জানতেন খ্যাতিমান পশ্চিমা সাংবাদিকরা পেশাদারী নৈতিকতার অংশ হিসেবেই কথা দিয়ে কথার বরখেলাপ করেন না এবং বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে এটা তাদের সাফল্যেরও অন্যতম কারণ। প্রায় সব বিদেশী সাংবাদিকই জানেন বাংলাদেশ সরকারের সদরদপ্তরগুলো কাদের মাটিতে অবস্থিত। কিন্তু তারা কখনোই সত্যিটা ফাঁস করেননি। আমার তো মনে হয় প্রায় সব বিদেশী সাংবাদিক একদম পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে জানেন এই মুহূর্তে আমাদের কতগুলো শক্তিশালী ট্রেনিং ক্যাম্প আছে এবং সেসব কোথাকার মাটিতে অবস্থিত। কিন্তু তারা সস্তা সত্য উন্মোচনের পথে যান নি এবং সেই কারণেই যুদ্ধের সাতমাস পার হবার পরেও মুজিবনগরের সত্যিকার অবস্থান এখনো অনুমান করা যায়নি। ‘ভারতীয় মাটি’ বলে বাড়িয়ে বলবার এই প্রদর্শনী বরং সন্দেহজনক এবং গুরুগম্ভীর হওয়া সম্ভবপর বলে মনে হয় না।
সুতরাং অভিযোগের জবাবে আশা করি আমি এটা বোঝাতে সমর্থ হয়েছি যে পিটার কারমাইকেলকে কোনো মুক্তি বাহিনী প্রশিক্ষণ শিবিরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা বা আগ্রহ, কোনোটাই আমার ছিল না। দ্বিতীয়ত পিটার এক রাতের বেশি ক্যাম্পে থাকতে পারে নি কারণ দ্বিতীয় দিন আমিনুল হক বাদশার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। আর যদি আগের পরিকল্পনা মোতাবেক তাকে অগ্রবর্তী ঘাটিতে নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে তাহলে সে এক রাতও সেই ক্যাম্পে ছিল না।
এটা বিস্ময়কর যে এই তথাকথিত ‘প্রতিবেদক’ এতগুলো মিথ্যা একটি সরকারী বিভাগকে জানানোর পরে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সেসব নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি, এইক্ষেত্রে যা আমি, তার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রকৃত সত্যটা জানবার চেষ্টা না করেই আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টা নিয়ে এগোবার সিদ্ধান্ত নেয়। এরূপ মনোভাব অতিশয় দুঃখজনক। হয় সরকারী কর্তৃপক্ষকে চূড়ান্ত ভাবে অপব্যবহার ও অপদস্থ করা হচ্ছে অথবা যেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি খুব ঝামেলা সহ্য করে এসকল মিথ্যা জোগাড় করেছে সরকার তাকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করছে। আন্তর্জাতিক আঙিনায় আমি আছি-সবসময়ের মতো। বাংলাদেশের মানুষ ও সরকারের জন্যে শুরু থেকেই নি:শর্তভাবে আমি নিজেকে ঢেলে দিয়েছি। এ দুটির প্রতিই আমার নিষ্ঠাকে আমি ভালোবাসি ও হৃদয়ে লালন করি। সরকার ও মানুষের প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষা দেয় নি এমন কিছু লোক যখন আমার প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ঠুনকো অজুহাতের আশ্রয় নেয়, তখন সেটি আমাকে প্রচণ্ডভাবে আহত করে। আমি আশা করব এই ধরণের কলঙ্ক লেপনের ঘৃণ্য প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে আপনারা তাকে চিরতরে শেষ করে দেবেন।
পরিশেষে আমি জানিয়ে রাখতে চাই যে গত সপ্তাহে ল’এক্সপ্রেসে মুক্তি বাহিনীর ওপর সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে পিটার কারমাইকেল আমাদের বেশ ভালই উপকারে এসেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন সে অন্য একটি ব্যাপার নিয়ে ক্ষুব্ধ। আপাতদৃষ্টিতে জনাব বাদশা সিবিসির পিটার জেনিংসকে বলেছেন যে তিনি পিটার কারমাইকেলকে পাকিস্তানী চর বলে সন্দেহ করেন। জনাব জেনিংস মনে
করেছিলেন বিষয়টা পিটারকে জানানো তার কর্তব্য কারণ এই দোষারোপ এত বড় আকারের ছিল যা পশ্চিমা সাংবাদিকদের সমগ্র সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করতে পারে। পিটার আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি বিষয়টি শুধুমাত্র বাংলাদেশ এবং ভারতীয় সরকার পর্যায়ে না বরং আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংঘের সামনেও আনতে যাচ্ছেন। অসার মন্তব্য হলেও মনে হচ্ছে আমরা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে কিছু প্রতিকূল প্রচারের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। সম্ভবত ‘প্রতিবেদক’ এর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আপনি এ ব্যাপারে অবগত করতে পারবেন।

আপনার বিশ্বস্ত
আলমগীর কবির
কর্মসূচি সংগঠক,
রেডিও বাংলাদেশ।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!