শিরোনামঃ স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েমের সংগ্রামের আহবান
সূত্রঃ ছাত্র ইউনিয়ন
তারিখঃ১১ মার্চ ১৯৭১
শোষনমুক্ত স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েমের সংগ্রাম
আরো দুর্বার করিয়া তুলুন
প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী ও উহাদের ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনীর যে কোন রূপ হামলা , আক্রমণ , প্রতিরোধে আজ ছাত্র- শ্রমিক – মধ্যবিত্ত জনতাকে সর্বশক্তি নিয়োগ করিতে হইবে । চরম গণ বিরোধী শাসকগোষ্ঠী উহাদের সেনাবাহিনীকে লেলাইয়া দিয়া পূর্ব বাংলার জনগনের মহান সংগ্রাম কে রক্তের বন্যায় ডুবাইয়া মারিবার যে ঘ্ররণ্য চক্রান্ত আঁটিয়াছে উহাকে উপযুক্তভাবে মোকাবেলা করিতেই হইবে । এইজন্য আমরা জনগণের প্রতি জানাইতেছি সর্বাত্মক প্রস্তুতির আহবান ।
পূর্ব বাংলার জনগন আশা করিয়াছিল যে , নির্বাচনের পরে যথা নিয়মে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসিবে , শাসনতন্ত্র প্রণীত হইবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করিয়া সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়া যাইবে । কিন্তু ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ল বার বার গণদুশমন দেশী – বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমী স্বার্থ বাদীদের স্বার্থে শেষ পর্যন্ত ভুট্টোর সহিত ষড়যন্ত্রের পথ গ্রহণ করিয়া পূর্ব বংলার জনগনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে লেলাইয়া দেওয়ার নিতি গ্রহন করে । শাসনতন্ত্র ও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্ন দূরে চলিয়া যায় । এই পরিস্থিতিতে দীর্ঘকাল জাতিগত নীপিড়নে নির্যাতিত পূর্ব বাংলার জনগন নিরঙ্কুশ ঐক্যবদ্ধ কন্ঠে আওয়াজ তুলিয়াছেন – “ পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর । পৃথক রাষত্র গঠন কর” । শাসকগোষ্ঠী জনগনের এই দাবীকে অস্ত্রের দ্বারা মোকাবেলা করিতে চাহিতেছে । ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলার জনগন কে শাসাইতেছে ।
অনেক ঘটনার ঘাত ও প্রতিঘাতের মধ্য দিয়া বাংলাদেশের সাত কোটি জনতা আজ পূর্ব বাংলায় তাহাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার কায়েম করিতে চাহিতেছেন , চাহিতেছেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কায়েম করিতে । এই জন্য জনগণ আজ অকুতোভয়ে জীবন মরন সংগ্রামে লিপ্ত হইয়াছেন । শত শত শহীদের রক্তে , পূর্ব বাংলার শ্যামল মাটি রক্তলাল হইয়া উঠিয়াছে । আমরা জনগনের এই মহান বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম কে সঠিক নীতিতে অগ্রসর করিয়া লইয়া এমন একটি “ স্বাধিন পূর্ববাংলা” রাষ্ট্র গঠনের আহবান জানাইতেছি যে রাষ্ট্রে শ্রমিক – কৃষক – ছাত্র – মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি জনগণের প্রকৃত আশা আকাঙ্খা পূরণের পথ উন্মুক্ত হইবে । আমাদের দেশ মাতৃকার উপর হইতে জোতদার মহাজনদের সামন্তবাদী শোষণ উচ্ছেদ হইবে , দেশের জনগন কে পুনরায় পুঁজিবাদি শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হইতে হইবে না । সকল প্রকার শোষন মুক্ত বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় গণতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলা কায়েমের লক্ষ্য সামনে রাখিয়া বর্তমান সংগ্রাম কে অগ্রসর করিয়া লইবার আহবান জানাইতেছি ।
কিন্তু এই সংগ্রাম খুব সহজ সংগ্রাম নয় । প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী এই সংগ্রাম দমনের জন্য নানা প্রচেষ্টা করিবে । অন্যদিকে , তথাকথিত দেশ প্রেমিকরা এই সংগ্রামকে ভুল পথে ঠেলিয়া দেওয়ারো প্রচেষ্টা করিতেছে । ইহারা “ “স্বাধিন পূর্ব বাংলায়” তাহাদের শ্রেনী স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্য হইতে বাঙ্গালী জনতাকে বুঝাইতে চায় যে এই সংগ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে এবং এমন কি তাহারা আরো বুঝাইতে চায় যে এই সংগ্রামে পূর্ব বাংলার অবাঙ্গালি মেহনতী জনগণও আমাদের জনতার দুশমন । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে শাসকগোষ্ঠী আমাদের সংগ্রাম কে দমন করিতে চাহিতেছে উহারা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগন কেও শোষণ করিতেছে । তাই এই সংগ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনের বিরুদ্ধে নয় , পূর্ব বাংলার অবাঙ্গালীদের বিরুদ্ধেও নয় । এই সংগ্রাম পরিচালিত করিতে হইবে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী ও উহাদের সামরিক বাহিনির বিরুদ্ধে । মনে রাখিতে হইবে যে , অন্য জাতির সাধারন মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগনের স্বার্থে “স্বাধীন পুরববাংলা” কায়েম করা যাইবে না । তাই আমরা ছাত্র জনতার প্রতি আহবান জানাইতেছি যে , গণ স্বার্থে সঠিক নীতিতে “ স্বাধীন পূর্ববাংলা” কায়েমের সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন ।
বর্তমান গণসংগ্রামের পটভুমিতে ২৫ শে মার্চ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আহুত জাতিয় পরিষদে অংশগ্রহণের প্রশ্ন বিবেচনার পূর্বশর্ত হিসাবে জনাব শেখ মুজিবুর রহমান বর্তমানে ৪ টি দাবি উত্থাপন করিতেছেন । এই দাবী হইল সামরিক শাসন প্রত্যাহার কর , শাসন ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে অর্পণ কর , সেনাবাহিনী ব্যারাকে লও , গণহত্যার তদন্ত চাই । বর্তমান গণঅভ্যুত্থান কে অগ্রসর করিয়া লওয়ার স্বার্থে ২৫ শে মার্চের মধ্যে এই সকল দাবি পুরনের জন্য গণসংগ্রাম অব্যাহত রাখুন । সরকারের প্রতি অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখুন , ইয়াহিয়া সরকার কে দাবী মানিতে বাধ্য করুন ।
কিন্তু শাসকগোষ্ঠি যদি পুনরায় সেনাআহিনী লেলাইয়া দিয়া জনগনের সংগ্রাম কে দমন করিতে চায় , তবে ‘ যার যাহা আছে’ তাহা লইয়া সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করুন । পূর্ব বাংলার ঘরে ঘরে আজ দুর্গ গঠন করুন । আর বৃহত্তর আত্মত্যগী সংগ্রামের জন্য সর্বদা প্রস্তুত করুন । বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত ।
বর্তমানে করণীয়সমুহঃ
রাজনৈতিক প্রচার অব্যাহত রাখুন । গ্রাম অঞ্চলে কৃষক দের মধ্যে ইহা ছড়াইয়া দিন ।
সর্বত্র ‘সংগ্রাম কমিটি’ ও ‘গণবাহিনী’ গড়িয়া তুলুন ।
শত্রুর মকাবেলায় প্রস্তুত থাকুন ।
যে কোন রুপ দাঙ্গা- হাঙ্গামা- উস্কানি প্রতিরোধ করুন ।
শান্তি – শৃঙ্খলা নিজ উদ্যোগে বজায় রাখুন ।
এই সংগ্রামের সফলতার জন্য সকল গনতান্ত্রিক সংগ্রাম শক্তির একতা গঠনের জোর আওয়াজ তুলুন ।
ছাত্র ইউনিয়ন ১১ – ৩ – ৭১