১৪ আষাঢ়, ১৩৭৮ মঙ্গলবার, ২৯ জুন ১৯৭১
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ কামরুজ্জামান এক বিবৃতিতে এ দিন বলেছেন, ইয়াহিয়ার সকল প্রচেষ্টা আমরা বানচাল করে দেব। বাংলাদেশ বাস্তব রূপ পাবেই। কোন শক্তি এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারবে না, সেদিন সুদূর নয়। ইয়াহিয়া খান ঘোষিত আওয়ামী লীগ দলীয় পরিষদ সদস্যদের আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রত্যাখ্যান করে বলেন, অখণ্ড পাকিস্তান এখন মৃত এবং ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ঠাঁইনিয়েছে। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খান সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। ইয়াহিয়া সরকার নয়, শেখ মুজিবর রহমানের সরকারই বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি। আমারই বৈধ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশের জনগণ আমাদের ছাড়া কোন বিদেশী সরকারের চাপিয়ে দেয়া শাসনতন্ত্র মেনে নেবে না। আমরা দেশ শত্রুমুক্ত করার জন্য মুক্তি সংগ্রাম করছি এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী শত্রুকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম। জনগণ আওয়ামী লীগের পেছনে রয়েছে। মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের কেবল পূর্ণ নিয়ন্ত্রনেই নেই, সেখানে বেসামরিক প্রশাসক স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনা করছে। (বিডি-১ পৃঃ ৩৩১-৩২)
নিউইয়র্কে পাকিস্তান জঙ্গী জাহাজ ‘কাপ্তাই’ সমরাস্ত্র বোঝাই করছে, আরো অস্ত্র সরবরাহ করা হবে মার্কিন মুখপাত্রের এ দিনে বক্তব্য পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
-A protest was conveyed to the UK High Commission in Islamabad of June 29 against Sir Alec Douglas-Home’s statement to the British Parliament wherein he said that Britain would withhold further aid to Pakistan until progress was made towards a Political settlement in East Pakistan (KCA,P-24760)
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোষ হতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক মীমাংসার নামে কোন আপোষ করবে না। আমরা মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমেই আমাদের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনবো বিজয় আমাদের হবেই। (বিদি-১ পৃঃ ৩৩০-৩১)
লোকসভায় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা দিলেন যে, শারণার্থীদের সমস্যা এত প্রবল ও প্রকটাকার ধারণ করেছে যে, জার জন্য সার্বক্ষনিক ভাবে একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী নিয়োগ করা প্রয়োজন। সেজন্য বর্তমান শিক্ষাও সাংস্কৃতি মন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় কে অতিরিক্ত দায়িত্ব সহ দফতর বিহীন মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছে। ( কে সি এ পৃঃ ২৪৭ ২৩) এ দিন পশ্চিম বাংলার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। গভর্ণর মিঃএস এস ধাওয়ান পশ্চিম বাংলার সর্বময় কর্তৃত্বের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। (সংবাদপত্র)
২৯ শে জুন ১৫ জন বাংগালী খালসী ও অফিসার ওয়েলসের কার্ডিফ বন্দরে নোংগর করা পাকিস্তানী জাহাজ, এম ভি কর্ণফুলি থেকে পালিয়ে ট্রেনযোগে লন্ডন পৌঁছে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রাওয় প্রার্থনা করেন। তাঁরা বলেন, করাচী থেকে রওয়ানা হবার পর নানা ভাবে তাঁদের হয়রান ও অপমান, এমন কি শারিরিক নির্যাতন করা হয়। অফিসারদের মুখপাত্র একে এম নুরুল হুদা বলেন, পাকিস্তানের ফিরে গেলে তাঁদের শারীরিক নির্যাতন কিংবা হত্যা করা হবে বলে তাঁরা আশংকা করেন। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রবাহী জাহাজ থেকে ডক শ্রমিকরা মাল খালাস করতে অস্বীকার করার পর পাকিস্তানী সৈন্যরা জাহাজে ওঠে বাঙালী খালাসীদের প্রত্যেককে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। (স্বঃ সং: বাঃ পৃঃ ৮৪)
-কৃষ্ণনগর আটনম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে মেজর জিয়া বিশেষ জরুরী বিষয়ে আলোচনার জন্য নৌ কমান্ডো বাহিনীর অধিনায়ক আহমেদ রেজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তাঁদের আলোচনা সম্বন্ধে ১৯৯০ সালে প্রকাশিত ‘একাত্তরের স্মৃতিচারণ’। গ্রন্থে (পৃঃ ১৩০) উল্লেখ করা হয়, “পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্বন্ধে মেজর জিয়া জানালেন যে, যদিও বে-সামরিক তরুণদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য কিছু কিছু ব্যবস্থা শুরু হয়েছে তবুও সবকিছুই করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও তাঁর অঙ্গ সংগঠন প্রাধান্য রক্ষার উদ্দেশ্যে। ফলে, প্রকৃত অর্থে মুক্তি বাহিনী গড়ে তোলা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি জন্য তিনি কর্ণেল ওসমানিকেই সর্বতোভাবে দায়ী করেন।… সামরিক পর্ষদ গঠনের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব থেকে কর্ণেল ওসমানীর অপসারণের কোন বিকল্প নেই”। উল্লেখ্য, এ সপ্তাহেই সামরিক বাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানির নির্দেশ ক্রমে মেজর জিয়াকে সেক্টর অধিনায়কের পদ থেকে সাময়িক ভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়। সেক্টর হেড কোয়াটারের অবস্থান ছিল হরিণাতে। পরবর্তীকালে সেক্টর কমান্ডার হিসাবে স্বল্পকাল মেজর মীর শওকত দায়িত্ব পালন করলেও বস্তুত জুলাই মাস থেকে মেজর রফিকুল ইসলাম সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে আহমেদ রেজা লিখেছেন, ‘মেজর শওকত ছিলেন মেজর জিয়ার নেতৃত্বাধীন এক নম্বর সেক্টরে। নরসিঙ্গার থেকে এই সেক্টর এলাকা ছিলো অনেক দূরে। যখন সকল সেক্টরেট পূর্নোদ্যমে যুদ্ধ চলছে, তখন সেক্টরের দ্বিতীয় জ্যোষ্ঠ কর্মকর্তা মেজর শওকতের নরসিঙ্গের নির্লিপ্তও নিষ্ক্রীয় অবস্থান স্বাভাবিক আমাদের কৌতুহল উদ্রেগ করলো। প্রায় প্রতিদিনই মেজর জিয়া আসতেন মেজর শওকতের কাছে। দুপুরে এক সাথে খাওয়া-দাওয়া করতে সেখানে। মেজর মীর শওকত আলীর মাধ্যমে আলাপ হলো মেজর জিয়ার সাথে। দীর্ঘ দাড়ি-গোঁফ ভেদ করে তাঁর প্রকৃত চেহারা চেনার উপায় ছিল না। যা হোক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হলো আমাদের মধ্যে। মেজর জিয়ার বক্তব্যের মূল কথা ছিলো যে,এক দিকে যেমন ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধে প্রয়োজনীয় সামরিক সাহায্য দানে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করছে না, অপরদিকে এ বিষয়ে কোন কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছেন না। বরঞ্চ তিনি নিজস্ব ক্ষমতার অবস্থান সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ মারাত্মভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে এবং যুদ্ধ তৎপরতা দ্রুত কমে যাচ্ছে। তিনি সেই মন্তব্য করলেন যে, মাঝে-মধ্যে পাকিস্তানী পেট্রলের ওপর বিচ্ছিন্ন হামলা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কোন লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না। (একাত্তরের স্মৃতিচারণ পৃঃ৮৯)
-এদিন ব্রিটিশ টেলিভিশনের সংবাদ পরিক্রমায় মিসেস জীলনইটের পূর্ব বাংলা সফর সম্পর্কিত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এক জন সমাবেশ আলোচনারত মিসেস নাইটকে দেখান হ্য। শাহ আজিজুর রহমানকে এ সময়ে দেশে কোন গোলযোগ বা অশান্তি আছে কিনা জিজ্ঞাসা করার জন্য মিসেস নাইটকে অনুরোধ করেন। তাঁর প্রশ্নের উত্তরে সমাবেশের মধ্যে থেকে বলা হয়, দেশে অবস্থা শান্ত ও স্বাভাবিক (সাঃ মঃ প্রঃ বা-পৃঃ৮২)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী