২৪ চৈত্র ১৩৭৭ বুধবার ,৭ই এপ্রিল ১৯৭১
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ডঃ কামাল হোসেন ব্যতীত অন্যান্য দুশতাধিক আওয়ামীলীগ দলীয় জাতীয় /প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সামরিক বাহিনীর নির্যাতন এড়িয়ে ভারতে পৌঁছান।
–আওয়ামীলীগ নেতা তাজউদ্দঈন আহমদ ভারতের প্রধাণমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে একান্ত আলোচনা করেন। সঙ্গে ব্যারিষ্টার রহমতউল্লা (আমিরুল ইসলাম) ছিলেন। দু দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । শ্রী মতী ইন্দিরা গান্ধী ও জনাব তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে এই বৈঠকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আশ্রয় ও অবাধ রাজনৈতিক কায্ পরিচালনার সুযোগ এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিক সাহায্য – সহযোগীতা (বর্তমানে সীমিত ভাবে) প্রদানের আশ্বাস দেয়া হয়।
–সিলেট শহর থেকে ৩। ৪ মেইল দূরে কলপাড়া এলাকা ভস্মীভূত হয়। হিন্দুদের ওপর চলে অমানষিক নির্যাতন।মেয়েরা হয় ধর্ষিতা। পাক বাহিনীর দোশর আব্দুর নূরের নেতৃত্ব বহু মুসলিম পরিবার হল সর্বশান্ত –বহু নারী হল ধর্ষিতা।
–যুদ্ধ পরিচালনার জন্য মেহেরপুরের এস , ডি ও তৌফিক এলাহি চৌধুরী ,এস,ডি,পি, ও (ঝিনাইদা মাহাবুবউদ্দিন আহমদ, ঝিনাইদার ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপ মোঃ সফিকুল্লাহকে মেজর ওসমান চৌধুরী যুদ্ধ ক্ষেত্রে সরাসরী ক্যাপ্টেন র্যাঙ্কে কমিশন দেন। ৯,৩৪৩
–মেজর এস এ মতিনের নেতৃত্বধীন ব্রাভো কোম্পানী সাবরুম হয়ে রামগড় পৌছে। রামগড়ে এই বাহিনীর সঙ্গে মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন রফিক, মেজর শওকত আলী, লেঃ কাদের, এই , টি ইমাম সি, এস, পি , প্রমুখের সঙ্গে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয়।
–রংপুরে সেক্টরে (সেক্টর নং ৬) উইং কমাণ্ডার এম, কে , বাশারের নেতৃত্বধীন বাহিনীর সুবেধার গোলাম মোস্তফার তিস্তা অপারেশন এক গুরুতবপূর্ণ অধ্যায়। এ যুদ্ধে পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজ মোস্তফা সহ অনেকে নিহত হয়। তিস্তা অপারেশন সিপাহী আতাহার ও অন্য একজন অকুতোভয় বীর মুক্তিবাহিনী যুদ্ধে শহীদ হন। (মরনোত্তর পদক দেয়া হয়)
–চাঁদপুরে পাকবাহিনী মেজর তৈমুর ও সামরিক গোয়েন্দা শওকতের অত্যাচার অগ্নিসংযোগ আর তারই সাথে নিরীহ মানুষের ওপর জল্লাদ বাহিনীর নরদেমযজ্ঞ তৈমুর—চেঙ্গিশখানেক হারমানায়। মেঘনা তীরে রেলওয়ে ষ্টেশন হয় ওঠে কসাইখানা । মানুষের অসহায় আর্তনাদ স্রস্টার আসন কেঁপে থাকবে…। শত শত মানুষ কে একদিনেই হত্যা করল পাকবাহিনীর। উল্লেখ্য পরে সংবাদ পত্রে প্রকাশ দশহাজার লোক চাঁদপুরে পাকবাহিনী ও তাদের ধর্ম ব্যবসায়ী দোশরদের হাতে নিহত হয়েছে । (দৈঃ বাঃ)
–হামিদুল হক চৌধুরীরে বিবৃতিতে ঢাকায় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিবৃতিতে তিনি বলেছেনঃ পূর্ব—পাকিস্তানে গণহত্যা সম্পর্কে ভারত ভিত্তিহীন প্রচারণা চালাচ্ছে। আসলে দায়িত্বজ্ঞানহীন একশ্রেণীর লোকের কার্যকলাপ প্রদেশে আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। সরকার যা করেছেন তা হচ্ছে এই, আইন শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এবং শান্তিপ্রিয় জনগণের জীবনে নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা। এই চেষ্টায় জনগণের সহযোগীতা করা এবং ভারতীয় চক্রান্ত রোখার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
-সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট এন, পোদ্গর্নির পত্রের জবাবে ইয়াহিয়া খান পুনরুল্লেখ করেন যে, পাকিস্তান তাঁর আভ্যন্তরীণ ব্যাপ্রে কোন দেশকে হস্তক্ষেপ করতে না দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প। (দৈঃ পাঃ ৭:২৪) দৈনিক পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট বাণীর পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করে।
–জাতিসংঘ মহাসচিব উত্থান পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগাশাহীকে এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছেন যে , তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভাবেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বলে মনে করেন।(দৈঃ পাঃ)
–খুলনা তেরখোদা থানায় দু’হাজার মুক্তিসেনার ক্যাম্প গড়ে ওঠে ফহমউদ্দিন নামে একজন তহশিলদারের নেতৃত্বে। আব্দুল হামিদ মোল্লা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে ।
(৯: ৫৪২)
–স্বাধীন বাংলা বেতার আবার ফিরে এসেছে। মঙ্গলবার (এপ্রিল ৬) থেকে শর্ট ওয়েভে এর অনুষ্ঠান শুরু হয়। তবে ঘোষণাগুলী একরকম শোনাই যায়নি। (আঃ বাঃ পাঃ)
—লেঃ কর্ণেল মাসুদল হোসেন খান যিনি ২৩ মার্চ জয়দেবপুর দ্বিতীয় ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট বাঙ্গালী কমাণ্ডিং অফিসার ছিলেন, তাকে পড়িয়ে বিমানে পাকবাহিনী করাচী নিয়ে যায়। করাচী-লাহোর রুটে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার (২৪ মার্চ চট্টগ্রাম কমাণ্ডার ছিলেন) সাক্ষাৎ হয় কর্ণেল মাসুদের। তাদেরকে খরিয়ামে (লাহোর) প্রিজনার অব ওয়ার ক্যাম্পে রাখা হয়। ৮ই অক্টোবর পরিবিয়ার সদস্যদের দেখার জন্য লেঃ কর্ণেল মাসুদকে ঢাকা নিয়ে আসে পাক সামরিক সরকার। অন্তরীণ হলেন অর্ডিন্যান্স অফিসার মেসে। উল্লেখ্য পাশের রুমেই থাকতেন বেগম জিয়া তাঁর দুই সন্তান সহ। একই গার্ড কমাণ্ডার দেখাশুনা করত তাদের সকল্কে (একাত্তর রণাঙ্গন-পৃঃ)
–পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বাঙ্গালী হত্যার অভিযান শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে জামাতে ইসলামীর প্রকৃত উদ্দেশ্য উন্মোচিত হয়। জামাতে ইসলামীর নায়ক জেনারেল টিক্কাখানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পূর্ণ সহযোগীতার প্রদানের আশ্বাস দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে
ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশ আখ্যায়িত করে বলেন যে, ভারতের এই অভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্য প্রদেশের জনগণ ও তাঁর দল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সাহায্য করবে। (পুঃদেঃ/ দৈঃ পাঃ)
–আনন্দ বাজার প্রত্রিকা লিখেছেঃ মুক্তিফৌজের রণনীতি প্রসঙ্গে মেজর খালেদ বলেন, মুক্তি সেনাদের সংঘবদ্ধ ও তাদের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলাই এখন সবচেয়ে জরুরী। শত্রুপক্ষের শক্তি কোন এলাকায় কি রকম সে সকল খোজ খবর নেওয়ার পর হানা হবে আঘাত। মেজর মোশারফ জানান বিভিন্ন জায়গায় লড়াই করে মুক্তি ফৌজ হানাদারদের কাছ থেকে বহু অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে। আরও অস্ত্রসস্ত্র দখল ও অস্ত্রগার গুলির উপর আক্রমণ চালানার জন্য গেরিলা বাহিনী গঠন করা হবে।
–জামাত ইসলামীর প্রাদেশিক আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম মওলানা নূরুজ্জামান ঢাকায় এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনসাধারণ ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) যেখানেই দেখবে সেখানেই তাদের ধ্বংস সাধ্ন করা হবে।(দৈঃ পাঃ)
–জমিয়তে উলাময়ে ইসলামের প্রাদেশিক সভাপতি পীর মোহসিউদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া) ঢাকায় বলেন, সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) সহযোগীতায়র মাধ্যমে ভারত সরকার পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তপেক্ষ করে চলেছেন , যা আন্তর্জাতিক রীতিনীতির খেলাফ।(সংগ্রাম)
–মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সাধারণ সম্পাদক এ এন এম ইউসুফ ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, ভারত সরকার দুস্কৃতিকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) মদদ ও তথাকথিত বাংলাদেশ সরকারের সমর্থন দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকে বিভ্রান্ত তথা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে চলেছেন । (দৈঃ পাঃ)
–ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির সভাপতি মওলানা নুরজ্জামান খান ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তান সেনবাহিনী দুষ্কৃতিকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) দমনে নিয়োজিত। দেশপ্রেমিক নাগরিকরা দেশরক্ষায় তাদের সমর্থন ও সহযোগীতা করুন।
আওয়ামী লীগ এম, পি, এ মোহাম্মদ আজিজুর রহমাঙ্কে মুক্তিবাহিনী সিলেট জেল থেকে উদ্ধার করে। তাকে ২৭শে মার্চ পাকসেনারা গ্রেপ্তার করে অকথ্য অত্যাচার চালায়। সন্ধ্যায় চাদনিঘাটে মানিক চৌধুরী এম,এন, এ কর্ণেল রেজা ও মেজর দত্তের সঙ্গে আজিজুর রহমান সাক্ষাত করেন।
-মুজিবনগর সরকার কতৃক পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে প্রবাসী বাঙ্গালীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের সহযোগ স্থাপন এবং তাঁর ব্যাপকতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে ৭ এপ্রিল সর্বজনাব সুলতান শরীফ, মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু ও মাহমুদ হোসেন লন্ডন থেকে কলকাতা রওয়ানা হয়। ব্রিটেন দূতাবাস স্থাপনের ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য তারা প্রায় তিন মাস পর লণ্ডন ফিরে আসেন । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ,পাকিস্তানী নির্যাতন ও মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহস সম্পর্কে তিনটি প্রমাণ্য চলচ্চিত্র এ্যাকশান কমিটির উদ্যোগে প্রদর্শিত হয়। উল্লেখ্য এই তিন জনের সঙ্গে মুজিবনগরে লেখকের গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠেছিল ।
–এদিন এপ্রিল নয়া দিল্লীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সিনেটর উইলিয়া বি স্যাক্সবী বলেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কর্তৃক মার্কিন অস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের বিরুদ্ধে ব্যবহার তাকে দুঃখিত করেছে। পাকিস্তান কর্তৃক মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় মার্কিন সরকার নিন্দা না করায় তিনি নিরাশ হয়েছেন। ( স্বাঃ সং: প্রঃ বাঃ পৃঃ ৪০)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী