You dont have javascript enabled! Please enable it! ২৭ চৈত্র ,১৩৭৭, শনিবার ১০ এপ্রিল ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২৭ চৈত্র ,১৩৭৭, শনিবার ১০ এপ্রিল ১৯৭১

–রাষ্ট্র প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন ঘোষণা আকাশবানী শিলিগুড়ি কেন্দ্র থেকে বের করা হয়। শীঘ্র স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী মন্ত্রীসভা ঘোষণা দেয়া হবে জানান হয়।

–একটি মুজিব থেকে লক্ষ মুজিবের কন্ঠ স্বরের ধ্বনি প্রতি ধ্বনি উঠে রনি”

গানটি প্রথম আকাশবানী কলকাতার সংবাদ পরিক্রমায় প্রচার করা হইয়। কথাঃ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার শিল্পী আংশুমান রায়।

–বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ল’স কনটিনিউয়াস ইনফোর্সমেন্ট অর্ডার (আইনের ধারাবাহিক আদেশ) জারী করেন। স্বাধীনতা ঘোষণা পত্র উপস্থিত নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দ্বারা গৃহীত হয়।( পরিশিষ্টের বিবরণ দেয়া হল)

–পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী দিনাজপুরের আরও উত্তরে এগিয়ে গিয়ে ঠাকুরগা পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে। সৈন্য ও সরঞ্জাম পরিবহন পাক বিমান বাহিনী অংশ নিয়েছিল (দৈঃপাঃ)

–বেনাপোল—কাগজপুকুর এলাকায় মেজর ওসমান চৌধুরী নেতৃত্বে প্রতিরক্ষা ব্যুহ স্থাপন করা হয়। ঢাকা থেকে ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন, ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজ এই সেক্টরে যোগ দেন। প্রথম শার্পুল থেকে পালিয়ে আসা ১৫০ জন সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন এই সেক্টরে যোগ দেন।

–পূর্ব পাকিস্তান সরকারের এক প্রেসনোটে বলা হয়েছে যে, সংবাদ প্ত্র এবং বেতার ও টেলিভিশন ঘোষণা করা হয় সকল কর্মচারীকে ২১ এপ্রিলের মধ্যে কাজ যোগদান করতে হবে অন্যথায় ১২০ নং সামরিক আইন আদেশ শাস্তিদান ছারাও বরখাস্ত করা হবে।

–পাকবাহিনী সকালে আবার নগরবাড়ীতে বিমান আক্রমণ করে প্রতিরোধ কারী মুক্তিযোদ্ধাদের ছত্র ভঙ্গ করে দেয় ।

—খ অঞ্চলের সামরিক শাসনর্কতা লেঃ জেঃ টিক্কা খান ঢাকা বাকেরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহের পাঁচজন ব্যক্তিকে ২৬ এপ্রিল সকালে ৮ টায় দ্বিতীয় রাজধানীতে একনম্বর সেক্টরের সামরিক আইনের সাব এ্যাডমিনিষ্ট্রেটর নিকট হাজির হওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন। ব্যক্তিগন হলেনঃ তাজউদ্দিন আহমেদ, তোফায়েল আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম , আব্দুল মান্নান, আবিদুর রহমান, (স্বত্বাধিকারী দি পিপল) (দৈঃপাঃ)

–খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসন কর্ণেল (অব) এম এ জি ওসমানীকে দপ্তরে হাজির হতে বলছে। (দৈঃপাঃ)

–সামরিক আইন আদেশ ১৪৮ জারী। এ আদেশের অধীন যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকারী বা সরকারী সম্পদ বিনষ্টকারীকে মৃত্যুদণ্ডদেয়ার বিধান রয়েছে।

–পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর চীফ অব ষ্টাফ জেনারেল হামিদ উত্তরাঞ্চলে , ইষ্টার্ন কমাণ্ডারে কমাণ্ডার লেঃ জেঃ এ এ কে নিয়াজী সিলেট এলাকা সফর করেছেন। (দৈঃ পাঃ)

–পাকিস্তান ন্যশনাল কাউন্সিল অব ইয়ুথের সভাপতি মাহবুর রহমান (পরে তথ্যমন্ত্রী) এক বির্বৃতিতে উল্লেখ করে,“ভারত ইতিপূর্বেই যথেষ্ট পরিমানে উস্কানী দিয়েছে এবং উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে, বিশ্ব শান্তির ক্ষেত্রে বিশ্বের জনগণের এটা আর চালিয়ে দেওয়া উচিৎ হবে না ।

–ভারতীয় বেতারে আমাদের সম্পর্কে মিথ্যা বিদ্বেষপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারনা বন্ধ করা উচিত। কারন এরা আমাদের দুর্ভাগ্য ও ক্ষতিই বাড়িয়ে তুলছে।’ (একাত্তরের ঘাতক ও দালাল কে কোথায় পৃঃ ৯৯)

বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য সকল শ্রেণী ও বর্গের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি অস্থায়ী রাস্ত্রপতির আদেশ জারী। সংবাদ (গন মাধ্যমে) প্রচারিত হয়।

— বিলেতে অবস্থানরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য বিচারপতি আবুসাইদ চৌধুরী লর্ড হিউম এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বিবিসি প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা প্রকাশ করেন। সারা দেশে পাক বাহিনীর অত্যাচারের বিভৎস কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে।

— সিলেট শহরের উপর দিয়ে পাক বাহিনীর বিমান এবং স্থল বাহিনীর সাহায্যে মেজর দত্তের নেতৃত্বধীন মুক্তি বাহিনীর উপর চার দিক থেকে আক্রমণ চালান। মুক্তিবাহিনী আবারও পিছু হঠতে বাধ্য হয়। মদন মোহন কলেজের প্রাক্তন আধ্যক্ষ সহ বহু লোককে হত্যা করা হয়। খুজারখোলা, বর্তখোলা, পিরোজপুর, কদমতলী গ্রাম সহ শহরের বহু বাড়ীঘর ভস্মিভূত করে পাকবাহিনী, নারীদেরকে ও অবমাননা করে। আকাশে কালবৈশাখীর ঝড়ের তাণ্ডবের মাঝে শত শন্ত সংখ্যালঘু নিরাপদ আশ্রয়ে  সীমান্তে ছুটে যায়।

— মৌলভী ফরিদ আহমদের নেতৃত্বে নয় সদস্যের ষ্টিয়ারিং শান্তি কমিটি গঠন করে।

— হানাদার পাক বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে ঢাকা রেডিও কেন্দ্র থেকে দেশাত্নাবোধক গানের টেপ ও বহু প্রচার সামগ্রী মুজিব নগরে নিয়ে আসেন সর্বজনাব আশফাকুর রহমান, টি এইচ শিকদার,তাহের সুলতান, শহীদুল ইসলাম, ও মঞ্জুর কাদের (বাবলু)। তাদের দুঃসাহস দেশপ্রেমের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। (একাত্তুরের রনাঙ্গন পৃঃ ৭৫)

 — সিলেটের লেঃ কর্ণেল (অবঃ) আব্দুর রব এম এন এ সিলেট থেকে আগারতলায় পৌঁছান। উল্লেখ্য পরবর্তীতে তিনি মুক্তিবাহিনী ডেপুট চীফ অব ষ্টাফ পদে আসীন হন। ইষ্টার্ন জোনের এক থেকে চারটা সেক্টরের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন, তিনি ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেক শ’ পূর্বঞ্চলীয় প্রধান লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা, লেঃ জেনারেল জে , এস গিল,মেজর জেনারেল বি এন সরকার,মেজর জেনারেল কালকটি প্রমুখ অফিসারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়াদি নিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করেন। (১৫ খঃ পৃঃ ৩৩৫)

–দি ব্লিৎচ (The Blitz)পত্রিকায় প্রকাশ বোম্বাইতে ভারতে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মিঃ জন কিটিং (John Keating) এর বক্তব্য সারা ভারতে সাড়া জাগাল। তিনি মনে করেন “ The holocaust in East Bengal was no more an internal affair. The shocking events in East Pakistan were the concern of the international community, he said”

–এদিন বিকাল পাঁচটার পাকসেনারা খাদিমগন অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর উপরে স্থল ও বিমান হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধদের কাছে ভারি অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় তারা পেছনে সরে এসে হরিপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। (বিচিত্র ২৬/৩/৯০)

–আবু সাঈদ চৌধুরী ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমের সংগ সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তিনি দি ডেইলি টেলিগ্রাফ এ প্রকাশিত সাইমন ড্রিগ এর রিপোর্টের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিচারপতি চৌধুরী তাকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও রক্তক্ষয় বন্ধ করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। এ সময়ে মিঃ সাদারল্যণ্ড ও মিঃ ব্যারিংটন উপস্থিত ছিলেন।–বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি বিস্তারিত বর্ণনার পর বিচারপতি চৌধুরী পুনরায় পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবার জন্য অনুরোধ করেন । এ ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার যতদূর সম্ভব কুটনৈতিক চাপ দেবেন বলে স্যার আলেক আশ্বাস দেন । তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে তারা নিশ্চয়তা পেয়েছেন এবং তাঁর প্রাণহানির আশংকা সে পর্যন্ত ঘটেনি। এই সাক্ষাতকালে বিচারপতি চৌধুরী পরিস্কার বুঝতে পারেন স্যার আলেক বাংলাদেশসের আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি। উল্লেখ্য হোয়াইটহলে অবস্থিত পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বেড়িয়ে এসে বিচারপতি চৌধুরী একটি ট্যাক্সি নিয়ে অল্ডউইচ এলাকায় অবস্থিত বুশ হাউসে বি বি সির ওভারসীজ সার্ভিসের বাংলা বিভাগে যান।

সিরাজুর রহমান ও শ্যামল লোধ তৈরি হয়েই ছিলেন। তারা বিচারপতি আবুসাইদ চৌধুরী সাক্ষাতকার গ্রহণ করে। এই সাক্ষাতকার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র হত্যার কাহিনী বর্ণনা করে বলেন , বিশ্ববাসীকে এই নৃশংস কথা তিনি জানাবেন এবং  বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া না পর্যন্ত তিনি দেশে ফিরবেন না। বি বি সে সেদিনই এই সাক্ষাৎকার প্রচার করে। কলকাতার সংবাদ পত্রে এই সাক্ষাৎকার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। বি বি স্যার সংগে সাক্ষাৎকারের পর দি ডেইলি টেলিগ্রাফ এর পক্ষ থেকে পিটার গিল বিচারপতি চোধুরী সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। বিবিসি সংগে সাক্ষাৎকার প্র বুশ হাউস ত্যাগ করার সময় স্থানীয় পাকিস্তান দূতাবাসের সেকেণ্ড সেক্রটারী মহিউদ্দিন আহমদকে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। মহিউদ্দিন বলেন, স্যার, আমি আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। আপনারা ডাকলেই আমাকে পাবেন লণ্ডনে তখন ও প্রবাসী সরকারের কূটনৈতিক অফিস স্থাপিত হয়নি বলে বিচারপতি চৌধুরীর তাকে চাকুরী ছেরে দিয়ে বাংলাদেশ আন্দলনে যোগ দেওয়ার কথা তখন বলেন নি। ( স্বা, সং: প্রঃ পৃঃ-৪১)

Reference:

একাত্তরের দশ মাসরবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী