You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৬ আষাঢ়, ১৩৭৮ বৃহস্পতিবার, ১ জুলাই ১৯৭১

-পূর্ব বাংলা সফর শেষে ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল সাংবাদিকদের জানায় ভয় ও আতঙ্কে সাড়া দেশ সস্ত্র রয়েছে। প্রতিনিধিদলের নেতা আর্থার বটমলে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি লেঃ জেঃ টিক্কা খানকে পূর্ব বাংলার নারকীয় সব ঘটনার জন্য দায়ী করে। (সংবাদপত্র) উল্লেখ্য, জুন ২০ তারিখে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র অফিস ৪ সদস্যের এই সাংসদীয় প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশের ঘটমান বিষয়ে সরোজমীন পরিদর্শনের ঘোষণা দেয়।

-ইসালামাবাদগস্থ ভারতীয় হাই কমিশনে প্রদত্ত পাকিস্তান সরকারের এক প্রতিবাদলিপিতে গত ২১ জন থেকে ২৫ জুনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের ১৮টি ঘটনার উল্লেখ করা হয়। (দৈঃপাঃ)। উল্লেখ্য, এ সব সশস্ত্র আক্রমণ মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণই ঘটিয়েছে। ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতার প্রশ্ন তখন ছিল না।

-পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য না করার জন্য ভারতের ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব উ.থান্ট, উদ্বাস্তু কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান এবং অন্যান্য বন্ধু সরকারের প্রতি আহবান জানান।

-পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক এ.খালেক এক বিবৃতিতে পাকিস্তান বিরোধী দুস্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) দুস্কর্ম প্রতিরোধ ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিকদের প্রতি আবেদন জানান। তিনি প্রত্যেক গ্রামে ডিফেন্স পার্টি গঠনের আহবান জানান।

-জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভারতের বাধা প্রদান সংক্রান্ত পাকিস্তানের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনেচ্ছুক শরণার্থীদের বাধাদানের পেছন ভারতের কোন স্বার্থ রয়েছে এম কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

-নিউজার্সির কংগ্রেস সদস্য মিঃ কর্ণলিয়াস গালাঘর মার্কিন প্রতিনিধি সভায় পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ রাখার উদ্দেশ্যে একটি বিধিনিষেধ জারির জন্য মার্কিন প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান।(সংবাদপত্র) বার্মার সংবাদপত্রে বিশেষতঃ ‘রেঙ্গুন ডেইলি’ পূর্ববাংলার ঘটনাকে গণহত্যা বলেছে। যদিও সরকারীভাবে কোন মন্তব্য করা  হয়নি। তবে ১২ হাজার বার্মায় আশ্রিয় শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে পরিস্থিতি উপযোগী হতে হবে হবে বার্মা সরকারের এক বক্তব্যে জানা যায়।

-সিংহল (বর্তমানে শ্রীলংকা) সংবাদপত্রে শরণার্থীদের সমস্যা নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এই দিন পাকিস্তান হাইকমিশনের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ভারত সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে,  মর্মে সংবাদ স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

-কলকাতায় অষ্ট্রেলিয়ান সংসদ সদস্য মিঃমানফ্রেড ক্রশ বলেন, পাকিস্তানকে মার্কিন সামরিক সহযোগিতা বন্ধ হওয়া উচিত। শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, সেখানের পরিস্থিতি প্রত্যাবর্তনের উপযোগী হওয়া প্রয়োজন।

-ফিজির সংবাদপত্রগুলোতে পাকবাহিনী অত্যাচারের সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়। জুন মাসে ‘ফিজি টাইমস” পত্রিকার (জুন ২৯) এক সম্পাদকীয়তে পূর্ব বাংলার গণ হত্যার তীব্র নিন্দা জানান হয়।

-ঢাকায় সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয়, চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত এমপি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে শক্তিশালী পাকিস্তানের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। (সংবাদপত্র)

-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রির প্রতিবাদে এদিন বাংলাদেশের কয়েক হাজার শরণার্থী কোলকাতাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সমানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। (সংবাদপত্র)

-জেনেভায় জাতিসংঘের উদ্বাস্তু কমিশনার-এর অফিসে থেকে ঘোষণা করা হয়, বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘ, বিভিন্ন সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ পর্যন্ত ভারতকে নগত অর্থ ও সামগ্রী বাবদ ১৬ কোটি ডলার সাহায্য দিয়েছে।

-ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লন্ডনে ‘টাইমস’ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নয়া পরিকল্পনা পূর্ব বাংলার পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলবে।

-খুলনা জেলা শান্তি কমিটির আহবায়ক মওলানা এ.কে.এমঃ ইউসুফ বিবৃতিতে পাকিস্তান রক্ষার জন্য প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও গভর্ণর টিক্কা খানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। (সংবাদপত্র)

-সুনামগঞ্জ এলাকায় টেকের হাট সাব-সেক্টরে শ্রী সুরঞ্জীত সেন গুপ্তের এমপিএর নেতৃত্ব মুক্তিসেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ৫নং সেক্টরাধীন টেকের হাত সাব-সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধ শক্তিশালী রূপ নেয়। স্থানীয় ও বাহিরাগত মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ, আনসার, ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিচ্ছিন্ন বহু সদস্যদের নিয়ে টেকের হাটে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিত করা হয়। উল্লেখ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে এক আবেদন জানিয়েছিলেন। এ মাসে বামপন্থী রাজনীতিকদের নেতৃত্ব তাদের ক্যাডার কর্মীদের সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রশিক্ষণ ও প্রচেষ্টা চালান হয়।                                                                                                 

মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যান্য স্থানের চেয়ে টেকের হাটে জাতীয় স্বার্থে বৈপ্লবিক ঐক্য গড়ে ওঠে টেকের হাটে সংগ্রাম পরিষদের যাবতীয় বেসামরীক কর্মের নেতৃত্ব থাকে আওয়ামী লীগ এমপিএ জনাব জহুর আর সামরিক কাজকর্মের নেতৃত্ব থাকে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এমপি এ। তিনি মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব পালন করেন। সেক্টরের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করে সর্বজনাব আলী ইউনুছ এডভোকেট, কমরেড নজির হোসেন, সালেহ চৌধুরী, ডাঃ নজরুল হক, ডাঃ হারিসউদ্দিন প্রমুখ। উল্লেখ্য যুদ্ধের সুবিধার জন্য সুনামগঞ্জকে ৫ নম্বর সেক্টরের অধীনে আনা হয়। ৫ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। এই সেক্টরের ৪টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এগুলা হলোঃ ভোলাগঞ্জ, সেলা (বাঁশতলা), বালাট ও টেকেরহাট (বড়ছড়া)। এইসব সাব-সেক্টর যারা কম্যান্ডার ছিলেন তাঁরা হলেনঃ ভোলাগঞ্জঃ প্রথমে কায়েস চৌধুরী, পরে লেঃ মোঃ তাহের উদ্দিন আখঞ্জি; মেলা (বাঁশতলা) ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন পরে মেজর(অব)মত্তালিব (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত); টেকেরহাটঃ প্রথমে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপিএ, পরে মেজর মুসলিন উদ্দিন ওরফে মেজর দীন। পরবর্তী জেড ফোর্সের তৃতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিল তার ৪টি কোম্পানী (আলফা , ব্রাভো, চার্লি, ও ডেলটা) নিয়ে ছাতক আক্রমণের জন্য ১২ অক্টবর জেলা সাব-সেক্টরে যোগ দেন। সুনামগঞ্জ আঞ্চলে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করে। সর্বজনাব দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরী, আবদুল হক এম এন এ, আবদুল হেকিম চৌধুরী এম এন এ, হোসেন বখত, আব্দুর রইস এডভোকেট, প্রসূনকান্তি রায়, আব্দুজ জহুর এমপিএ,ভাষা সৈনিক আলতাফ উদ্দিন আহমদ এডভোকেট, আলী ইউনুস এডভোকেট, গোরাঙ্গচন্দ্র দেশী, মোহাম্মদ আবদুল হাই, বজলুল মজিদ খসরু, মতিউর রহমান, রেহান উদ্দিন আহমেদ রাজ ও সুনীল শুকলা প্রমুখ।

-“দি টাইমস”- এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, ঢাকার উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রায় ৪০ মাইল দূরে সিন্দুরী নামক এক গ্রামের বাড়ি-ঘর লুটপাট করার পর পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রামটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। বিগত পাঁচ দিনে এই এলাকায় আরও সাতটি গ্রাম ধ্বংস করা হয়। অধিকাংশ অধিবাসী হিন্দু বলেই গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তাছাড়া অন্য কোণ কারণ রয়েছে বলে মনে হয় না। সৈন্যবাহিনী সিন্দুরী গ্রামের স্বর্ণকার রাধাবিনদ কর্মকার এবং ৭জন পুরুষ ও একজন বৃদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। চারজন মহিলাকেও তারা ধর্ষণ করে। (স্বাঃ সং: প্রঃ বাঃ পৃঃ ৮৫)

-জুলাই মাসে তরুণ ছাত্র শ্রমিক রাজনৈতিক কর্মী সমন্বয়ে প্রথম মুক্তি বাহিনীর প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়। প্রত্যক্ষ যুদ্ধের দামামা সকল সেক্টরে বেজে ওঠে। মেজর খালেদ মোশররফের নেতৃত্বাধীন ২ নং সেক্টরের এলাকায় মন্দভাগ এবং শালদা নদী জুড়ে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক যুদ্ধ সংগঠিত হয়। তুমুল সংঘর্ষে পাকবাহিনীর দুটো কোম্পানী সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়। হানাদার বাহিনীর ১২০ জন সেনা খতম হয়। মেজর রফিকুল ইসলাম এদিন নবীপুর পোষ্ট আক্রমণের নির্দেশ দান করেন। মুক্তিযোদ্ধারা ৬ জন হানাদার সেনাকে হত্যা করে এবং ১২ জন আহত হয়। বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শহীদ হন সিপাহী ফজলুর রহমান, হাবিলদার আবুল হোসেন, সিপাহী তোহা মিয়া। উল্লেখ্য, মেজর রফিক তখন ১ নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন এবং তার নির্দ্দেশানুসারে ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা দেবীপুর পোষ্ট আক্রমণ করেছিলেন। ইতোপূর্বে ১ নং সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়া।

প্রশিক্ষিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা, রাজশাহী শহর, ঝিকড়া, নোহাট, বিমানবন্দর, শেওলাঘাট, শাহজাবপুর সহ দেশের বিভিন্নস্থানে গেরিলা হামলা চালায়। এসব যুদ্ধ শুধু হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন চালাতে হচ্ছিল পাক মিলিশিয়া, ধর্মান্ধ রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধেও। নারায়ণগঞ্জের ‘পাকবে’ কোম্পানির ৩শ ফাইবার গ্লাশ স্পিডবোটও মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা অপারেশনে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ধ্বংস করে দেয়।

Reference:

একাত্তরের দশ মাসরবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!