সম্পাদকীয়
আজাদ
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব আগামী নির্ব্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি এক বিশেষ বেতার ভাষণে তাঁহার এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়াছেন। তাঁহার এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয় বলিয়াও তিনি উল্লেখ করিয়াছেন। নিজের শাসনকে চিরস্থায়ী করার জন্য নয়, বরং দেশের অগ্রগতির উদ্দেশ্যে বর্তমান শাসনতন্ত্র কায়েম করা হইয়াছিল বলিয়া উল্লেখ করিয়া প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি জনমত সম্পর্কেও অবহিত রহিয়াছেন। জনসাধারণ প্রত্যক্ষ নির্বাচনের পক্ষপাতী, শিক্ষিত সমাজ মনে করেন যে, শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ হইতে তাঁহারা বঞ্চিত রহিয়াছেন, পূৰ্ব্ব পাকিস্তানবাসী মনে করেন যে, শাসনকার্য্যে তাঁহারা অংশীদার নহেন, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহ গণতান্ত্রিক আদর্শ অনুসারে যথেষ্ট ক্ষমতাসম্পন্ন নহে বলিয়া অনেকের ধারণা এবং ছাত্র সমাজ সকল শিক্ষা সমস্যার আশু সমাধান কামনা করেন। দেশ আজ দারুণ সংকটের ভিতর দিয়া চলিয়াছে। এই সঙ্কট অতিক্রম করার জন্য এসব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন বলিয়া উল্লেখ করিয়া প্রেসিডেন্ট সম্মেলনে যোগদানের জন্য তাঁহার আমন্ত্রণ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গ্রহণ করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, কোন কোন বাধার জন্য এই সম্মেলন এখনো শুরু হইতে পারে নাই। এসব বাধা অপসারণের চেষ্টা চলিতেছে। আলোচনার মাধ্যমে কোন সিদ্ধান্তে আসা শেষ পর্যন্ত যদি সম্ভব না হয়, তাহা হইলে আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের জন্য তিনি তাহার নিজস্ব শাসনতান্ত্রিক সোপারেশ কালবিলম্ব না করিয়া জাতীয় পরিষদে পেশ করিবেন বলিয়া প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করিয়াছেন। দেশ সঙ্কটমুক্ত হউক এবং জাতীয় জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরিয়া আসুক, ইহা অপেক্ষা অধিকতর কাম্য আজ আর কিছুই নহে। যে অস্বাভাবিক পরিবেশে গুরুতর সঙ্কটের সৃষ্টি হইয়া চলিয়াছে, তাহার অবসানের জন্য রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক মুক্তির পথ সন্ধানের প্রয়োজনীয়তাও দীর্ঘদিন হইতে অনুভূত হইয়া আসিতেছে। সঙ্কট একদিনে দেখা দেয় নাই, ক্রমে ক্রমে ইহা দানা বাধিয়া উঠিয়াছে। এ সঙ্কট অবসানের পরিপূর্ণ অবকাশ পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাঝে রহিয়াছে বলিয়া যে বিশ্বাস গোটা দেশকে আজ প্রাণ-চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে, তাহার সহিত শাসন কাঠামোর সামঞ্জস্য বিধানের সুযোগ যদি সৃষ্টি করা হয় তাহা হইলে দেশ অনিশ্চয়তার গোলকধাধার বাহিরে আসিয়া নিশ্চিততর ভবিষ্যৎকে সন্ধান করিয়া নিতে সমর্থ হইবে। ধীর-স্থিরভাবে ভাবিয়া দেখার সময় আজ জাতির সামনে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে এবং বিপর্যয়ের পাকচক্র হইতে বাহির হইয়া আসার দায়িত্বও গোটা জাতিকে সমানভাবে গ্রহণ করিতে হইবে। জনসাধারণের অভিলাষ অনুসারে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রকে সাজাইয়া তোলার সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তই প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করিয়াছেন। শাসনতন্ত্র সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত স্টেটসম্যান উচিত, এবং ব্যক্তিগত ধ্যান ধারণা যে জাতীয় কল্যাণ চিন্তার পথে প্রতিবন্ধক হইতে পারে নাই, তাহারও পরিচয় ইহাতে পাওয়া যাইতেছে। জাতি তাহার আশা আকাংখার অভিব্যক্তির জন্যও যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে। শাসনতন্ত্রের পরিবর্তনের বাস্তব রূপ কি দাড়াইবে এবং তাহাতে বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদের দায়িত্ব কি ভাবে পালন করিবেন, তাহা সাগ্রহে সারা দেশ লক্ষ্য করিয়া যাইবে।
দেশকে সঙ্কটের বাহিরে লইয়া আসার দায়িত্ব বিরোধীদলের নেতাদের উপরও বহুলাংশে আসিয়া পড়িয়াছে। দলীয় কর্মসূচীর উর্ধে জাতীয় আদর্শের লক্ষ্যভূমি নির্ধারণে তাঁহারা সমর্থ হইলে শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট সমাধানে নিজস্ব অবদান তাঁহারা সৃষ্টি করিতে পারিবেন। সুনির্দিষ্ট সোপারেশ পেশ করার দায়িত্ব পালনের ইহাই উপযুক্ত সময়। শাসনতান্ত্রিক সমস্যার জটিলতা উন্মোচন করা সম্ভব হইলে, পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্ত্তীকালীন ব্যবস্থা গড়িয়া তোলার পথে তেমন কোন বাধা নাও আসিতে পারে। বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ যে বিচক্ষণতার পরিচয় দান করিয়া আসিয়াছেন, তাহাই তাঁহাদিগকে সঠিক পথের সন্ধান দিবে। ঘটনা প্রবাহের উপর নিজেদের আধিপত্য প্রমাণ করার দায়িত্বও তাঁহাদিগকে স্বীকার করিতে হইবে। অস্থির ও পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কোন কিছুকেই অনড় বা শেষ কথা গ্রহণ না করার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। অনিবার্য্য ঘটনা প্রবাহ ভবিষ্যৎকে প্রতি মুহূর্তে নূতন নূতন রূপ দান করিয়া থাকে। এর মাঝে একটি কথা সত্য যে, রাজনীতিতে ব্যক্তি নয় নীতির প্রশ্নই শেষ কথা। নীতি ও কর্মসূচীর আলোকে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগ পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিকের জন্য থাকিবে, ইহা রাজনৈতিক আদর্শেরই গোড়ার কথা। পাকিস্তানের শক্তি ও সংহতির আদর্শে নীতি ও কর্মসূচী যাচাইয়ের দায়িত্ব পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিকের। পাকিস্তানের বিগত বৎসর সমূহের ইতিহাসে ক্ষমতাসীন ব্যক্তির পক্ষে ক্ষমতা ত্যাগের সমস্ত ঘোষণার নিদর্শন এই প্রথম। পাকিস্তনের শাসনতন্ত্রের রূপান্তরের জন্য পাকিস্তানের ছাত্র ও জনসাধারণ যে মহান উদ্দীপনার পরিচয় দান করিয়াছেন এবং যে বিপুল ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন, তাহাও পাকিস্তানের ইতিহাসের এক সুমহান ভিত্তি গড়িয়া তুলিতে সাহায্য করিবে।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯