You dont have javascript enabled! Please enable it! 06.4.1971 | ২৩ চৈত্র ১৩৭৭ মঙ্গলবার , ৬ এপ্রিল ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২৩ চৈত্র ১৩৭৭ মঙ্গলবার , ৬ এপ্রিল ১৯৭১

 

দিল্লীতে জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শ্রীমত ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শদাতা  পি, এন , হাকসারের একান্ত বিশেষ বৈঠক হয়। আলোচনায় সর্বধিক গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। ব্যারিষ্টার রহমত আলী ( আমীরুল ইসলাম এম ,এন এ, কুষ্টিয়া ) উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায় ।

–ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে মর্মে প্রজাতন্ত্রীচীন ভারতকে এক প্রতিবাদ নোট প্রেরণ করে।

–গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বপক্ষে দ্বিতীয় সচিব কে , এম শাহাবুদ্দিন , সহ প্রেস এ্যাটাশে আমজাদুল হক  দিল্লীর পাক দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ঐক্যমত প্রকাশ করেন।

-তারার-ডেমনা ঘাটে মুক্তিফৌজ এবং পাক-বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে।

-পাকবাহিনীর হাত থেকে সিলেট এবং শমসের নগর বিমান অবতরন কেন্দ্র দুটো মুক্তিফৌজের দখলে চলে আসে।

–হিলি সীমান্ত অতিক্রম করে সর্বজনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান , শেখ ফজলুল হক মণি , তোফায়েল আহমেদ ও দা আবু হেনা কলকাতা পৌছান। কলকাতার ভবাণীপুর রাজেন্দ্র রোডে এক বাসায় অবস্থান গ্রহণ করেন।

–আওয়ামী লীগ এম এন এ  রিয়াজউদ্দীন আহমেদ (রংপুরে) ও কুড়িগ্রামের এস,ডি, ও মামুনুর রশিদ সপরিবারের ভারতে আশ্রয় নেন। রিয়াজউদ্দিন আহমেদ (ভোলা মিয়া) এম, এন , এ ধুবরী তার শুশুর বাড়িতে আশ্রয় নেন।

–সোনাহাট ভুরুঙ্গামারী (রংপুর) পথিমধ্যে পাটেশ্বরী ব্রিজে মুক্তিবাহিনীর পাক বাহিনীর তুমুল লড়াই হয়। পাক বাহিনী পিছু ফিরে কাউনিয়ার পথে চলে যায়। পাক  বাহিনীর ১০ জন নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর দুই বীর সন্তান শহীদ হন। ভুরুঙ্গামীর মুক্ত এদিন থেকে প্রধান ঘাটি হয়ে ওঠে। এখান মুক্তি সংগ্রাম সংগঠনের জন্য ছাত্র-লীগে নিবেদিত প্রাণ ক’জন ছাত্রনেতৃবৃন্দ বিশেষ কৃতিত্বের দাবীদার। তন্মধ্যে আখতারুজ্জামান মণ্ডল যিনি ছিলেন ১৯৬৮ সনের গোপন সংগঠনের (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী) পরিষদের সদস্য) উল্লেখযোগ্য। পূর্বাহ্নে এই ছাত্র লীগের সঙ্গে বি এস এফ এর সংযোগ রক্ষা করে এবং অস্ত্র সরবরাহ পেতে থাকে। ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা মুক্তিসংগ্রামে  সহযোগিতার জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী ভুরুঙ্গামারী পাঠাতে শুরু করে।

 — সামরিক গভর্ণর লেঃ জেঃ টিক্কাখানের সঙ্গে দেখা করলেন প্রাত্তুন মন্ত্রী ও পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার সত্ত্বাধিকারী হামিদুল হক চৌধুরী। এটা ছিল এক আনুষ্ঠানিক ও প্রকাশ্য সাক্ষাৎকার। হামিদুল হক চৌধুরীর   সঙ্গে ছিলেন পীর দুদু মিয়া, আইনজীবী এ,কে, সাদী, জামাতে ইসলামীর আমীর গেলামে  আজম তারা পাকিস্তান সরকারকে সহযোগীতার আশ্বাস দিলেন এবং সেইসঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ রোধের জন্য সামরিক সরকারকে আরো দৃঢ় হওয়ার পরামর্শ দেয়। উল্লেখ্য শান্তি কমিটি গঠন থেকে শুরু করে বিদেশে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে প্রচার ও সাংগঠনিক  তৎপরতার জন্য জনাব হামিদুল হক চৌধুরী বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

 —পূর্ব রনাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী ৪৮০ কিঃ  মিঃ ঢাকা-শ্রীহট্ট রেলপথটি নানাজায়গায় বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ফলে শ্রীহট্ট শহরে অবরুদ্ধ পাকসেনা

বাহিনীর কাছে ঢাকা থেকে অস্ত্র শস্ত্র ও রসদ পাঠানো অসম্ভব করে তুলছে। সোমবার শ্রীহট্ট খণ্ডে জোর লড়াই চলছে। (আঃ বাঃ পঃ)

—আনন্দবাজার পত্রিকায় আগরতলা ডেটলাইন থেকে গতকাল প্রতিবেদন ছেপেছে। মুখ্য সংবাদ হলঃ বড় বড় শহরের নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকা ছাড়া বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল এখন মুক্ত। বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনজন মেজর সম্মিলিত ভাবে এই মুক্তাঞ্চলের প্রশাসন ভার গ্রহন করেছেন। তাদের সাহায্য করেছেন অসামরিক অফিসার ও আওয়ামীলীগের স্বেচ্ছাসেবকরা। মুত্তনঞ্চলের স্রিহট্ট এলাকার অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশারফ, ময়মনসিংহে এলাকার মেজর সফিউল্লা ও চট্টগ্রাম এলাকার মেজর জিয়াউর রহমান। …….. গত শনিবার (এপ্রিল ৩)  স্রিহট্টের কোন এক স্থানে মেজর মোশাররফের সদর দফতরে তিন মেজর এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে স্থির হয়ঃ যতদিন না জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসে এই ত্রয়ীই সেনাবাহিনী পরিচালনা করবেন। মেজর মোশাররফ  ইউ এন আইয়ের প্রতিনিধিকে বলেন, স্বাধীনতা ঘোষণার সময় মুক্তিফৌজ পুরোদস্তর সৈন্যর সংখ্যা ছিল হাজার কয়েক মাত্র। এখন তা বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের হাজার স্বেচ্ছাসেবককে নিয়মিত ভাবে সামরিক তালিম দেওয়া হয়েছে।

–তউলিন (ফ্রান্স) পাকিস্তানী সাবমেরিন মনগ্রোর ১৩ জন বাঙ্গালী নাবিকরা বিদ্রোহ করেছিলো বলে জানা যায়। বন্দর কতৃপক্ষ সাবমেরিন ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলতে অস্বীকার করেন। (আঃ বাঃ পাঃ)

–আশুগঞ্জ এলাকায় মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বধীন বাহিনীর ক্যাপ্টেন গফফার এক কোম্পানী মুক্তিফৌজ নিয়ে আশুগঞ্জ অবস্থান নেন। ৩১ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সিলেট থেকে নদীপথে আসছিল। উল্লেখ্য এসসময়ে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর কাজী মোঃ শফিউল্লার নেতৃত্বধীন জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টের বিদ্রোহী বাহিনী যোগ দেয়। এসময়ে বিরাট এলাকা কোম্পানীগঞ্জ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া হয়ে সিলেটের খোয়াই নদী পর্যন্ত শত্রু মুক্ত ও স্বাধীন ছিল।

–ঢাকায় বিদেশী কূটনীতিক মিশন, জাতিসংঘ প্রতিনিধির লোকেরা কলকাতায় বিমানে পৌছে ঢাকায় নারকীয় গণহত্যার বর্ণনা প্রসঙ্গে কিসিং আরকাইভ লিখছেঃ

“ Evacuation of British and American nationals from Easy Pakistan, as well as of those of many othe nationalities, was carried out by air and sea during the first week of April; The evacutation of all UN personel and their dependents from East Pakistan was also ordered by the UnitedNationas Secretary-General , U thant, Britis refugess from East Pakistan arriving at Calcutta spoke on April 6 of “bloody massacres” and ‘mass under’ in and around Chittagong, a british Engineer saying that he had seen “Bodies pilled high in the gutters” and dogs and crows eating cropses in the streets nine days after they had fallen there”..  Refugees spoke of mass killings and shootings by both sides the Army and Awami League supporters –and eastimatted the dead as running into many thousands” [ KCA, PP 24569]

–মুসলিমলীগ নেতা খানে সবুর এক বিবৃতিতে বলেনঃ ইয়াহিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ সময়োচিত হয়েছে এবং শেখ মুজিবের ছয় দফা যে পাকিস্তান ভাঙ্গায় নীল নক্সা তা প্রমাণিত। তিনি পাক সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞকে দেশের একান্ত অভ্যন্তরীন ব্যাপার বলে আখ্যায়িত করেন।

–আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছেঃ দিন কয়েক আগে মেজর জিয়াউর রহমাইন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তখন তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন মেজর জিয়া বলে। উল্লেখ্য ৩০শে মার্চ সকালে মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান ও সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কর্মকাণ্ড হিসেবে ঘোষণা করেন। (৯খঃ পৃ৪৫)

লন্ডন রোববার একদল পার্লামেন্ট সদস্য পূর্ব বঙ্গে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করার উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন। এঁদের মধ্যে ব্রসডগলা-ম্যান ফ্রাংক জাড়, নাজেল ফিসার, এরিক হেফার এবং জন পার্ডোর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। বিকাল্বেলা পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার আলেক।

ডগলাস-হিউম পার্লামেন্টে পুর্ব বঙ্গ সমস্যা সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করেন। পার্লামেন্টে পেশকৃত প্রস্তাব পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রভাবিত করবে বলে প্রস্তাব পেশকারীরা আশা করে। ৬ই তারিখের মধ্যে ১৬০ জনের ও বেশী পার্লামেন্ট সদস্য এই প্রস্তাব সমর্থন করেন । স্যার আলেকের বক্তব্য বাংলাদেশ আন্দোলন সমর্থনকারীদের কিছুটা নিরাশ করে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মতবিরোধ আলাপ-আলোচনার মাধ্যম্মে দূর করা বাঞ্ছনীয় বলে ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী ইতিপূর্বে ইয়াহিয়া খান জানিয়েছেন। আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর সামরিক বল প্রয়োগ করার জন্য তিনিন দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সংঘাত  বন্ধ করে পুনরায় আলোচনা শুরু করার আবেদন জানান।

শ্রমিক দলের পক্ষ থেকে ডেনিস হীল পূর্ব বাংলার জনসাধারণের আশা ও আকাঙ্ক্ষার কথা মনে রেখে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে অনুরোধ করেন।

স্যার আলেক কর্তৃক ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রদত্ত বক্তৃতার সমালোচনা প্রসঙ্গে “দি গার্ডিয়ান” পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, গতকাল স্যার আলেক ডগলাস –হিউম পূর্ব পাকিস্তানে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবীর প্রতি সমর্থন ঘোষণা সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি সে সুযোগের অপচয় করেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভিন্ন দলীয় সসদ্যরা যে প্রশ্ন তুলেছেন সে সম্পর্কে অবাক হওয়া তাঁর পক্ষে উচিৎ হবেনা। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ভোটের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে ক্ষমতা গ্রহণের অধিকার দিয়েছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্যই সামরিক অস্ত্র ব্যভার করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক নির্যাতন অসংগত—এ কথা খোলাখুলি ভাবে বলতে না পারলে স্যার আলেকের পক্ষে বিবৃতি দান স্থগিত রাখা উচিৎ ছিল। (দি গার্ডিয়ান ৬ এপ্রিল)

–শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য ফ্রাংক জডার এক চিঠির উত্তরে পাকিস্তান হাই কমিশনার জানান, পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবকে কয়েক দিন আগে গ্রেপ্তার করেছেন এবং বর্তমান তিনি আটক রয়েছেন। ৬ই এপ্রিল তারিখের দি গার্ডিয়ান ও ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। ( স্বাঃ সং প্রঃবা-পৃ ৩৯)

Reference:

একাত্তরের দশ মাসরবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী